Powered By Blogger

২৮ অক্টোবর ২০১৯

ভারতে বাংলাদেশ-ফোবিয়ার হেতু কি?

দীপাবলী উপলক্ষে হিলি সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের উপহার বিনিময়।
বাংলাদেশের সীমানায় ভারতীয় জেলে আটকের ঘটনায় রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বড়াল ও পদ্মার নদীর মোহনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনার পর থেকেই আরো অনেক বাংলাদেশী সাংবাদিকের মতো তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলাম ভারতীয় গণমাধ্যমে। তখনই ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে প্রকাশিত ‘স্বরাজ্য ম্যাগ’ নামের এক গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণের একটি শিরোনামে হঠাৎ চোখ আটকে যায়। যার বাংলা অর্থ, বিএসএফ এর নতুন মাথাব্যাথা: বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী জওয়ানরা মৌলবাদী হয়ে উঠছে এবং প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে ‘প্রসাদ’।

রাজশাহী-মুর্শিদাবাদ সীমান্তের ওই ঘটনার মাত্র তিনদিনের মাথায় (২১ অক্টোবর ২০১৯) প্রকাশিত এই প্রতিবেদন জুড়েই ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ছাপ। যেখানে জানানো হয়েছে, বিশেষত যেসব সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই, সেইসব সীমান্তে পূজাদের সময় দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে বিএসএফ জওয়ানদের দেওয়া ‘খিচুড়ি’ আনুষ্ঠানিকভাবে ওপারে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। একইভাবে বিজিবির জওয়ানরাও ঈদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে বিরিয়ানী এবং মিষ্টি পাঠাতেন। তবে তারা ‘প্রসাদ’ নিতে অস্বীকার করার পরে অনেক জায়গায় থেমে গেছে এই শুভেচ্ছা বিনিময়।

এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও একান্ত আলাপে বিজিবির এক কর্মকর্তা বলেছেন, “সীমান্তে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।” সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব দীপাবলি উপলক্ষেও বিভিন্ন সীমান্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময় করেছেন বলেও জানান তিনি। 
যদিও উল্লেখিত প্রতিবেদনের উপ-শিরোনামে অবসরপ্রাপ্ত বিএসএফ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, “নিম্নস্তরে ইসলামীকরণ ও উগ্রপন্থীকরণের কারণে আমাদের ‘কাফের’ ভাবছে বিজিবির সদস্যরা। এ কারণেই তারা এত প্রতিকূল ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে।” এছাড়া “বিজিবির নিম্নস্তরে ইসলামীকরণে আন্তঃসীমান্ত পাচার, বিশেষত গবাদি পশু এবং মানবপাচারের উত্থান হয়েছে” বলেও উল্লেখ করা হয়। 
সীমান্তে কর্মরত বিএসএফ কর্মকর্তাদের ভাষ্য দাবি করে স্বরাজ্য ম্যাগের সহযোগি সম্পাদক জয়দ্বীপ মজুমদার তাঁর প্রতিবেদনের শুরুতেই জানিয়েছেন, “বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায় আন্তর্জাতিক সীমান্তে বিজিবি জওয়ানদের দ্বারা বিএসএফের এক হেড কনস্টেবলকে হত্যা এই দ্বন্দ্ব ও শত্রুতার পরিচায়ক মাত্র।” দু'দেশের সীমান্ত বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের মধ্যেকার সম্পর্ক অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও বিজিবির জওয়ান, ল্যান্স নায়েক, নায়েক এবং হাবিলদার স্তরের সাথে বিএসএফ জওয়ানদের ‘ক্রমবর্ধমান বৈরিতা’ অনুভব করছেন বলে তাঁকে জানিয়েছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। 
গত কয়েকদিনে এই প্রতিবেদনটি নিয়ে কথা হয়েছে ওপার বাংলার একাধিক বন্ধুর সাথে। যারা জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও কট্টর নন, মূলত রাজনীতি, সাহিত্য, সংবাদ, চলচ্চিত্রের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক নানা কাজের সাথে জড়িত। তাদের মুখেই জানতে পারি, ‘স্বরাজ ম্যাগ’ নামের এই পত্রিকাটি মূলত উগ্র হিন্দুবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) অন্যতম মুখপাত্র। যে কারণে তারা এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে রাষ্ট্রীয় চাপে এমন প্রচারণাটা মূলধারার গণমাধ্যমেও শুরু হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। 
যে কারণে এমন প্রচার : ভারতীয় বন্ধুদের ভাষ্য, সীমান্তে স্থিত বিএসএফ ও বিজিবি কর্মীরা যে যার রাষ্ট্রীয় সীমানাকেন্দ্রিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত৷ তারা উভয়েই আপনার রাষ্ট্রের ব্যাপারে দায়বদ্ধ এবং নিজ নিজ রাষ্ট্রকে অপবহির্শক্তির হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর৷ এই সুরক্ষার বিষয়টি বাদে বর্ডারের অপরপ্রান্তের অপর রাষ্ট্রের অন্দরে কী হচ্ছে তা দেখার বা তা নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই, যদি না অপর রাষ্ট্রের সীমানা থেকে কোনোরকম কোনো ‘থ্রেট’ একপক্ষ পেয়ে থাকে৷ দুটি প্রতিবেশী রাষ্টের পারস্পরিক গণসংস্কৃতি, বিশ্বাস, ভাবনার তরিকা, অভ্যাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফারাক আছে, মিলও আছে, কিন্তু ফারাকগুলিই একেকটির দৃশ্যমান পরিপ্রেক্ষিতের ভিন্নতা বজায় রাখে রাষ্ট্রের নিরীখে। একেকটি রাষ্ট্রের নিজস্বতাও তার সার্বভৌমত্বের অংশ৷ 
এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাঙালী মুসলমান৷ তাই তার বর্ডার গার্ডের মধ্যে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ট্রের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী ইসলাম বিশ্বাসীর সংখ্যাই বেশি৷ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের শতাংশের হিসেবের থেকে কিছুটা বেশি সনাতন বিশ্বাসী মানুষ বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডে থাকলেও জনবিন্যাসের বাস্তবতা অনুযায়ী হিন্দুর চেয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বেশি৷ 
অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে স্থিত ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে ভারতের ধর্ম বিশ্বাস ভিত্তিক জনবিন্যাস অনুযায়ী মুসলিমের চেয়ে হিন্দুর সংখ্যা অনেক বেশি৷ যদিও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে নিয়োজিত বিএসএফ কর্মীরা কেউই পশ্চিম বাংলার বাঙালী হিন্দু বা মুসলিম নয়৷ তারা হয় উত্তর ভারত, মধ্য ভারত, পশ্চিম ভারত অথবা উত্তরপূর্ব ভারতের হিন্দু বা মুসলিম। যদিও হিন্দু বেশি৷ 
হিন্দুরা সাধারণত গরু খায় না৷ আবার বিশ্বাসী মুসলমানও এমন কিছু করে না যাতে তার ঈমান নষ্ট হয়৷ বিশ্বাসী মুসলিমদের সামনে কেউ যদি নিজস্ব আচারে আল্লাহর একত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, সেই ব্যক্তির ওই আচরণে সমর্থন জানানোটা তাদের ঈমানী নৈতিকতার পরিপন্থী৷ একইভাবে বিশ্বাসী হিন্দুকে যদি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গো-মাংস খাওয়ানোর মতো কাজে প্রণোদিত করতে চাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে প্রনোদিত হওয়াটাও নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচার! তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাঙালীর বর্ডারে নিয়োজিত লোকেরা যেহেতু বেশির মুসলিম তাই কোনো পৌত্তলিক দেবতার প্রতি নিবেদিত প্রসাদগ্রহণের ঘটনা তাদের কাছে ঈমানী চেতনার বিরোধী। যেভাবে বিশ্বাসী হিন্দুর কাছে গো-মাংস খাওয়া অধর্ম৷ 
প্রতিটি মুসলিমের অধিকার আছে তার ঈমান রক্ষা করার৷ প্রতিটি হিন্দুরও অধিকার আছে গো-মাংস গ্রহণ না করে সংস্কার রক্ষা করার৷ এখন বিজিবি প্রসাদ নেয়নি বলে বিএসএফের কাঁধে বন্দুক রেখে স্বয়ং সেবক সংঘ যদি বিজিবির মধ্যে ‘র‍্যাডিক্যাল ইসলাম’ বা ইসলামী জঙ্গিবাদের ভূত দেখলে তো বিজিবিও কোরবানীর মাংস বিএসএফকে দিতে চাইবে। এক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হলে তারা শুধুমাত্র বিএসএফ কর্মীদের দিকে ‘র‍্যাডিক্যাল হিন্দুত্বের’ অভিযোগও তুলতে পারে! কিন্তু বিজিবি প্রসাদ প্রত্যাখান করার যে ঘটনা ঘটিয়েছে তা আসলে তাদের এক্তিয়ারের মধ্যেই পরে। কারণ এটা তাদের ‘কালচারাল চয়েস’৷ একইভাবে বিএসএফ যদি কোরবানীর গো-মাংস না নিতে চাইতো, সেটাও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার৷ কে কী খাবে বা খাবে না কী পরবে বা পরবে না এই সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিগত৷ এই সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক, জঙ্গিবাদী বা জাতিবাদী নয়৷ 

বিজিবি নিজ মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রসাদ প্রত্যাখ্যান করেছে তাঁর ধর্মবিশ্বাসের অধিকার রক্ষায় এবং সার্বভৌমত্বে দাঁড়িয়ে৷ অন্য রাষ্ট্রের বর্ডার গার্ডে নিযুক্ত বিশ্বাসী মুসলিমকে প্রসাদ দিতে চাওয়া এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার দিকে জঙ্গীবাদের অভিযোগ করাই বরং অন্যের ‘ডেমোক্রেটিক’ এবং ‘সভারনিটি’ ভায়োলেট করার সামিল। বিজিবির গায়ে পরে বিএসএফের মালিক রাষ্ট্রের এই ঝগড়া আপাত অর্থে অর্থহীন হলেও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যবাহী৷ কারণ প্রসাদের অজুহাতে বিজিবির দিকে র‍্যাডিক্যাল ইসলামের ব্যাপারে যে অভিযোগ স্বয়ং সেবক সংঘ তুলেছে তা অমূলক হলেও এই মিথ্যাপ্রচার দিয়েমপশ্চিমবঙ্গে ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশ-ফোবিয়াকে জোরালো করতে পারবে। আর ইসলামোফোবিয়া, বাংলাদেশ-ফোবিয়া, এসব হলো পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এনআরসি বাস্তবায়বের জন্যে বানোয়াট একটি বিষয়৷

আমার বন্ধুরা আরো বলেছেন, এনআরসির জন্য বাংলাদেশ ফোবিয়া তৈরি করা দরকার, যাতে প্রচার করা যায় বিজিবির মদদে হুহু করে কয়েক বছরে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এবং ত্রিপুরবঙ্গে মানুষ ঢুকেছে৷ এই মিথ্যা প্রচারকে সামনে রেখে এনআরসির সমর্থনের গণভিত্তি তৈরি করা হবে। তারপর ওই গণভিত্তির গণকেই এনআরসি দিয়ে বাস্তুচ্যুত, দেশচ্যুত করা হবে৷ বাংলাদেশ-ফোবিয়ার মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র রচনা করতেই বিজিবির সাথে বিএসএফকে দিয়ে পায়ে পা তুলিয়ে ঝগড়া করানোর ফিকির খুঁজছে দিল্লী৷ এই কাজ তাদের পক্ষে আরো সহজ কারণ দুই বাংলার বর্ডার অথবা বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা সীমান্তের ভারতীয় সীমানার নিয়োজিত বিএসএফ কর্মীরা অধিকাংশই হিন্দুস্তানী ও হিন্দীভাষী৷ বিজেপি তথা দিল্লীর এই ষড়যন্ত্রে তারা অংশীদার। কারণ, বিজেপি ও স্বয়ং সেবক সংঘের রাজনীতি হলো হিন্দী জাতিবাদী রাজনীতি৷ হিন্দুত্বের একমাত্রিক স্লোগানকে সামনে রেখে তারা আসলে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা থেকে বাঙালী উচ্ছেদ করে এই অঞ্চলকে হিন্দুস্তানী, মারোয়ারি, বিহারী, গুজরাতিদের লীলাভূমি বানাতে চায়৷ বানিয়া পুঁজির বাজার ও কারখানা বানাতে চায়৷এটাই হিন্দী জাতিবাদ। 
হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তানী জাতিবাদের লক্ষ্য ইসলামোফোবিয়ার মতো বাংলাদেশফোবিয়া তৈরি করে এনআরসি বাস্তবায়িত করা। সেকারণেই বিজিবির বিরুদ্ধে এমন ফালতু অভিযোগ তুলেছে হিন্দী জাতিবাদী আরএসএসরা।
বন্ধুদের সোজাসাপ্টা বক্তব্যে পাঠকদের কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে আশাকরি। এক্ষেত্রে একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমার প্রত্যাশা, ভারতীয়দের এই ফোবিয়া তথা অস্বাভাবিক ভীতি বা উদ্বেগ ‘বিদ্বেষ’ না ছড়াক। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্থিতি বজায় থাকুক।

ইতিহাস কথা বলে : ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ইতিহাস এই উপমহাদেশে নতুন নয়। তবে স্বরাজের এই প্রতিবেদনটি স্মরণ করিয়ে দেয় ১৮৫৭ সাল। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এদেশে ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল নিয়ে আসে। ১৮৫৩ সালে তৈরি এই রাইফেলের ব্যবহৃত কার্তুজে চর্বিযুক্ত অংশ ছিল, যা ব্যবহারের পূর্বে সৈন্যকে তা দাঁত দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে হতো। গুজব রটানো হলো এই চর্বিযুক্ত অংশ গরু এবং শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি। যেহেতু গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেওয়া হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৈন্যদের কাছে অধার্মিক কাজ ছিল, সেহেতু এই গুজবের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭–৫৮ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা ভারতীয় মহাবিদ্রোহ।

২৫ অক্টোবর ২০১৯

বালের্জীবনামার | ঈয়ন

ফুরায়ে যাওয়া কবির অসম্পূর্ণ শেষ কবিতার মতো বিষণ্ন মদের পাত্রে লেগে আছে অজস্র জন্মের চূড়ান্ত চুম্বনের চিহ্ন। সঙসারের প্রতিটি অলস দুপুরে যা পাঠ করতে করতে জেনেছি—
না হলে পরিচর্যায় কোনো ভুল
মরা গাছেও ফুটতে পারে ফুল।
অথচ ভেজাকাকের মতো স্থবির বৃষ্টির দিনগুলোয় ইদানীঙ স্মৃতিপথে পায়চারী ছাড়া কিছুই তেমন করা হয় না। যে মায়ার সরণি ধরে খানিকটা আগালেই ইচ্ছাহীনতার ধুধু প্রান্তর। যেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো না লাগার যাবতীয় কারণের দিকে তাকিয়ে মোহাবিষ্ট হওয়া মাত্রই মনে পড়ে—
নিজের কাছেও দুর্বহ
হয়েছি সেই কবে;
—শৈশবে!
যদিও শিশুতোষ মেঘ সদৃশ ঘন হতাশার কোনো রঙ থাকে না। বরঙ তা যেন বর্ণচোরা ছল ও কৌতূহল। মোহের জলে ডুবে নিতে গিয়ে শ্বাস, মিটেছে পিয়াস। ভুল, দুর্বলতা ও অতৃপ্তির বাতাসে দোদূল্যমান বিষণ্ণতার ক্লান্তিতে তামাম স্পৃহা পুরোপুরি ‘নাই’ হওয়ার বেদনায় তাই থমকে ভেবেছি—
ধুর, এ শরীরের ভার
আত্মায়—
বইতে পারছে না আর।
আপাতত কিছুই করার ক্ষমতা নেই হয়ত, কিছুই না। ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন অলিগলিতে আপোষ করতে করতে চূড়ান্তভাবে ভেঙে গেছি। সুস্থতা হারিয়েছে বিশ্বাস, কিঙবা হারিয়েই গেছে—
এবঙ ফের হারিয়ে ফেলছি সব
দেহের কাঁধে বুলছে মনের শব।

১৬ অক্টোবর ২০১৯

রাষ্ট্রধর্ম বাড়িয়েছে ইসলামী উগ্রবাদ

একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীর দৃশ্য
“রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের তিন দশকে বেড়েছে ইসলামী উগ্রবাদের শক্তি,” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরী করেছিলাম গত বছর, যা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। চলতি বছরের জুলাইতে প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সাহায্য চাওয়ায় যখন খুব হৈচৈ হচ্ছে, তখন অপ্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি ফের স্মরণে আসে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রিয়া সাহা ওয়াশিংটনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউজে গিয়ে ট্রাম্পকে বলছেন, “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানে তিন কোটি ৭০ লাখ (৩৭ মিলিয়ন) হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ‘উধাও’ হয়ে গেছেন। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ (১৮ মিলিয়ন) সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রয়েছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ছাড়তে চাই না। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা আমার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। জমি কেড়ে নিয়েছে। এর কোনো বিচার এখনো পাইনি।”
“কারা এসব করেছে,” প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানতে চাইলে দলিত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘শারি’ পরিচালক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংগঠক প্রিয়া সাহা আরো বলেন, “উগ্রপন্থী মুসলমানরা এটা করেছে। সব সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা এটা করে থাকে।” 
এমন বক্তব্যের জেরে সরকার-বিরোধী, ডান-বাম, বাঙালী মুসলমানদের সব পক্ষই যখন প্রিয়াকে তুলোধনো করছে, তখন খেয়াল হয় আরো ছয় বছর আগে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির এক শুনানিতে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ থেকে ২০১৩ সাল এ পর্যন্ত চার কোটি ৯০ লাখ (৪৯ মিলিয়ন) হিন্দু মিসিং হয়েছে। 

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদও বহু বছর ধরেই বলছে, গত পাঁচ দশকে আনুমানিক এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশান্তরিত হয়েছেন। সে হিসেবে গড়ে বছরে দেশ ছেড়েছেন দুই লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। তাছাড়া সরকারি পরিসংখ্যান মতে সত্তরের দশকে এ দেশে ২০ দশমিক এক শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। চলতি দশকের শুরুতে ২০১১ সালে যা কমে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক সাত শতাংশে। 
ঘাঁটতে গিয়ে জানতে পারি, নিরাপত্তহীনতায় কোটি মানুষ দেশ ছাড়লেও কমেনি সাম্প্রদায়িক পীড়নের মাত্রা; বরং রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের পর দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযুক্তকারী অষ্টম সংশোধনীর প্রস্তাব পাসের ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়েছে গত বছর। 
তৎকালীন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ১৯৮৮ সালের ১১ মে জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেছিলেন। পরে ৭ জুন এটি পাস হলে ৯ জুন ‘স্বৈরশাসক’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুমোদন পেয়ে তা আইনে পরিণত হয়। অবশ্য তার আগেই সংবিধান ইসলামীকরণ শুরু করেন আরেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। ফরমান জারি করে তিনি প্রস্তাবনার আগে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) বাক্যটি যোগ করেন। সেইসঙ্গে মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিলুপ্ত এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাংবিধানিক সুযোগ তৈরী করা হয়। 

এরই ধারাবাহিকতায় এরশাদের শাসনামলে কায়েম করা হয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ৷ ওই সময় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে সংবিধানের এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে উচ্চ-আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন লেখক সাহিত্যিক, সাবেক বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের পনেরো জন বিশিষ্ট নাগরিক। এর ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হলে মামলাটি আলোচনায় আসে। এর কিছুদিন পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হলে আরো একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওই সময় রুল ইস্যু করলেও আদালত ২০১৬ সালে রিট দুটি বাতিল করে দেয়। 

রিটকারীদের মধ্যে যারা এখনও বেঁচে রয়েছেন, তাদেরই একজন জাতীয় অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। এক আলাপে তিনি বলেছিলেন, “শেষ অবধি উচ্চ আদালত আমাদের মামলার অধিকারই স্বীকার করেনি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় থাকা প্রবীণ এই বুদ্ধিজীবীর অভিমত, “রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়েছে। এভাবে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য দেয়া উগ্রবাদীদের উৎসাহিত করে। কারণ তাদেরও বোঝানো হয় , পৃথিবীতে তাদের ধর্মই শুধু শ্রেষ্ঠ আর অন্য সব ধর্ম নিকৃষ্ট।”
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রধর্ম বিরোধী রিট বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে করেছিল জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ইসলামসহ বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভাবধারার ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো। 
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম রেখে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিয়ে বা উগ্রবাদী শক্তির সামনে মাথানত করে জঙ্গিবাদ দমনের কথা আমরা বলি কি করে! মুক্তিযুদ্ধ করার সময় আমি কি কখনো ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশে এমন একটি সময় আসবে যখন আমাদের ‘মাইনরিটি’ হিসেবে ‘সেকেন্ড গ্রেডের সিটিজেনে’ পরিণত করা হবে এবং তার থেকে উত্তরণের জন্য আবার লড়াই করতে হবে।” 

রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী দাবি করে রানা আরো বলেন, “একাত্তরে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা ফেরাতে না পারলে মৌলবাদ উৎখাত করা যাবে না।” সংখ্যাগরিষ্ঠ দেওবন্দী ওহাবী ভাবধারার কওমি মতাদর্শী মুসলিমদের চাপে থাকা প্রায় আড়াই লাখ কাদিয়ানীর সংগঠন আহমদিয়া মুসলিম জামা’তের আমির মোবাশশেরউর রহমান মনে করেন, “রাষ্ট্রধর্মের বিধান ধর্মীয় গোষ্ঠির ক্ষমতায় যাওয়ার একটা দরজা।”

অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ পরে পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটি পরিবর্তন করে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একই সংশোধনীতে সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়।

তবে “অবশিষ্ট ছয় শতাংশ সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করলে, অর্থাৎ সংখ্যালঘু শূন্য হলে কিভাবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করবে বাংলাদেশ?” এক আলাপে এমন প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও গল্পকার তুহিন দাস। মুক্তচিন্তার পক্ষে লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশ এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় থাকার কারণে ২০১৫ সালে আগস্টে ‘আনসারবিডি’ নামের এক উগ্রবাদী সংগঠনের হুমকী পেয়ে তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশ ত্যাগ করেন। 

চলতি দশকে কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা করে মহামূল্যবান প্রাচীন পুঁথি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, খ্রিস্টান গির্জাগুলোতে বোমা হামলা হয়েছে, নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে; এছাড়া রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বসতভিটা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে দাবি করে তুহিন বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার ফলে এ ধর্মের অধিকাংশ মানুষেরা মনে করে, এ দেশটা শুধু তাদের এবং সবকিছুতে তাদেরই অধিকার।” 

অবশ্য ভাষ্কর, লেখক ও গবেষক গোঁসাই পাহলভী মনে করেন, “সংবিধানের চর্চা সাধারণ মানুষর ভেতর নেই। তারা সংবিধান বুঝে ‘এ্যাক্ট’ কিংবা ‘রিএ্যাক্ট’ করেন, এমন নয়। জনগণের কৌমচেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনা, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই উগ্রতার পেছনে দায়ী। আরো আছে আন্তজার্তিক ঘটনাবলীর প্রভাব।”
তুহিন ও গোঁসাই, দুজনেই রাষ্ট্রের বৈষম্যের উদাহরণ হিসাবে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘একদিনের ঈদ’ উপলক্ষে কমপক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটির বিপরীতে হিন্দুদের প্রধান উৎসব ‘পাঁচ দিনের দূর্গা পূজা’ উপলক্ষে মাত্র একদিন ছুটি থাকা কথা বলেন। 
বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকে এই জনপদের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে, উল্লেখ করে তরুণ প্রকাশক ও সাংবাদিক সৈয়দ রিয়াদ বলেন, “দেশের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর যে ধরণের আক্রমণ করা হয় তা দেখেই মনে হয়, এই দেশে সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নেই।” 

তরুণ কবি রূমান শরীফের অভিমত, “একটি গণতান্ত্রিক দেশে সব ধর্মের মানুষ; আকি, নাস্তিক সবাই বাস করে। সেখানে রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ধর্ম থাকা মানে ওই ধর্মানুসারী বাদে বাকি নাগরিকদের অস্বিকার করা। সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করে দেয়। নাগরিকদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাঁর দাবি বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতপোষণকারীরা মোটেই নিরাপদবোধ করেন না। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, প্রকাশক, ব্লগারদের ওপর হামলার বা তাদের খুনের এখনো কোনো বিচার হয়নি।”

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ক এক আলোচনায় বক্তারা বলছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করছে। তারা আরো বলেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার না হওয়ায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
“ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আসলে খুব চালাক,” বলেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান। 
আচ্ছা প্রিয়া সাহা বা তাঁর পরিবারের সর্বশেষ অবস্থা কেউ জানেন কী? খবরে দেখেছিলাম, তাঁর স্বামী স্বামী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মলয় সাহাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, পিরোজপুরে পৈত্রিক বাড়িতে হামলা ও আগুনের ঘটনার প্রতিকার চেয়ে প্রিয়া সাহা স্থানীয় সাংসদ ও পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কাছে গেলেও তিনি অনীহা দেখিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

প্রিয়া সাহা
আরো পড়ুন:

০৯ অক্টোবর ২০১৯

সব শিক্ষালয়ের হলে তল্লাশী আসন্ন!

ফাইল ফটো
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির নামে চলমান উশৃঙ্খলতা রুখতে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের আবাসিক হল ‘সার্চ’ (তল্লাশী) করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “সেই নির্দেশটা আমি দিয়ে দেবো।” বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আজ তিনি যেসব বার্তা দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে এটাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার। আওয়ামী লীগ প্রধান উল্লেখ করেন, “আপনাদের (সাংবাদিক) মাঝেই আমি বলে দিচ্ছি, এই জিনিসটা আমরা করবো। পরিস্কারের বেলায় কোনো দলটল আমি বুঝি না।”

এর আগে ফাহাদ হত্যা প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ফোনালাপে বলছিলেন, “রাজনৈতিক দূর্বুত্ত্বায়নের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গতমাস থেকে যে কঠোর শুদ্ধি অভিযান চলছে, তার সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষনেতাকে বহিস্কারের মধ্য দিয়ে। তখন থেকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রধান বেশ কঠোর অবস্থানই আমরা লক্ষ্য করেছি। এমন সময়ে ছাত্রলীগের যে নেতারা ভিন্ন মতালম্বী বুয়েট শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তারা মূলত শেখ হাসিনাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন বলে আমি মনে করি।”

ভরসা প্রতিবাদে — উন্মাদনায় ভয়

আবরার ফাহাদ মুজাহিদ
“আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না,” বলে গেছেন যে দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা; ভুলে যাবেন না, প্রায় পাঁচ দশক আগে “পিন্ডি না ঢাকা - ঢাকা..ঢাকা..” স্লোগানে বিশ্ব কাঁপানো শোষিতের রক্ত বইছে সেই ভূখণ্ডের তরুণ-যুবাদের ধমনীতে। যে কারণে তারা একদিন না একদিন “দিল্লী না ঢাকা - ঢাকা..ঢাকা..” স্লোগানে রাজপথ কাঁপাবে, এটা অনুমেয়ই ছিল। কিন্তু এই সুযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ মুজাহিদকে যারা ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’, ‘গাজওয়ায়ে হিন্দ’, ‘হিন্দের যুদ্ধ’ বা হিন্দুস্থান বিরোধী আন্দোলনের ‘প্রথম শহীদ’ দাবি করছেন, তাদের ব্যাপারে ‘খুব খেয়াল’। 
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই সশস্ত্র সংঘর্ষ ইসলাম প্রবর্তক আবু আল-কাশিম মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের ভবিষ্যতবাণীতে প্রতিশ্রুত এক সমর, যা হিন্দুস্তানের মূর্তিপূজারীদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা করবে। দীর্ঘদিন থেকেই এ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপাত্য বিস্তার করতে চাইছে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (একিউআইএস) এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলা একুশ বছর বয়সী আবরারকে ভারত বিরোধীতার কারণে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও তারা  পুঁজি করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো কিছু প্রকাশনায় অন্তত তেমনই ইঙ্গিত পেলাম, যা ভীতিকর। 
দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আচারণের বিরোধীতা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু ভারত বিরোধীতার নামে আমরা উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদকে সমর্থন কিংবা আমন্ত্রণ করছি কি-না এ ব্যাপারেও দয়া করে সচেতন থাকুন। ভরসা রাখি বাঙালের সহজাত প্রতিবাদী সত্ত্বায়, ধর্মীয় উন্মাদনায় আমার ভয়। বুয়েট শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যু আপনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) শিক্ষক শামসুল আলম খান মিলনের মৃত্যুর ঘটনা মনে করিয়ে দিতেই পারে! শুধু মনে রাখবেন, ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই ক্ষমতায় ছিল মিলনকে হত্যাকারী এরশাদ সরকার। নিশ্চয়ই আওয়াজ হোক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, তবে তা ধর্মান্ধদের সুরে নয়। 

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শেখের বেটির জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

ছবি: সংগ্রহিত
মা–বাবার কাছে না থাকায় যাঁর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল, স্বজন হারিয়েও যিনি অর্ধযুগ দেশে ফিরতে পারেননি, যাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে—সেই হতভাগা নারী আর কেউ নন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ ৭২ পেরুনো এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলাপকালে দেশের প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বলেছিলেন, “খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য থেকে তাঁর উত্থান। সহজাত ব্যক্তিত্ব আর নেতৃত্বের গুনেই নিজেকে তিনি আজকের উচ্চতায় নিয়ে আসতে পেরেছেন।” 
চার মেয়াদে দেড় দশকের বেশী সময় ধরে ক্ষমতাসীন এই মানুষটির পরিবারের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস। তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই এসেছে স্বাধীনতা । সাংবিধানিকভাবে তাঁকে ‘জাতির জনক’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলনেরও অন্যতম নেতা ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যা পাওয়া উপমহাদেশের এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। দেশের মূলধারার রাজনীতিতে তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা হাসিনার পদার্পণও মূলত ‘শেখের বেটি’ হিসেবেই।   
বঙ্গবন্ধুর সাখে শেখ হাসিনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “রাজনীতিতে আসার প্রথম কয়েক বছরের জন্য শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেওয়ার দরকার নেই। সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু’ ম্যাজিক কাজ করেছে। পিতা ও পরিবার হারানোর বেশ কয়েকবছর পর তিনি যখন আওয়ামী লীগ প্রধান হয়ে দেশে আসলেন, তখন ‘বঙ্গবন্ধু-কন্যা’ হওয়ার কারণে প্রাথমিকভাবে অনেক সুবিধা পেয়েছেন।” আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অরুন কুমার গোস্বামী বলেন, “যদিও আওয়ামী বিরোধীরা বলে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জনগণ রাজপথে নামেনি। এটা দালিলিকভাবে সত্য হলেও ‘ফ্যাক্ট’ (প্রকৃত সত্য) হচ্ছে, মানুষ তখন সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এতে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সহানুভুতি বেড়েছে।” 

ড. শান্তনু বলেন, “স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে তাঁর (শেখ হাসিনা) স্বতন্ত্র রাজনৈতিক গুনাবলী বিকশিতে হতে শুরু করে। সেই থেকে তাঁর গত তিন দশকের রাজনৈতিক জীবন যদি আমরা দেখি, তা খুবই সমৃদ্ধ।” ড. অরুনের দাবি, “তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আজকের অবস্থানে পৌঁছানোর একটি ইতিবাচক সংযোগ রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়েছে। বিষ্ময়কর অগ্রগতি দেখে আন্তর্জাতিক মহলও অবাক। সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন ‘টেকসই’ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রতিটি সূচকে এগিয়েছি আমরা।” 

অরুন আরো বলেন, “শেখ হাসিনা যেভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, তা এর আগে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান করেননি। তিনি জাতীয় মাইলফলকগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ২০২১, ২০৪১, ২১০০ ও ২১২১ এগুলো পেরুবে।”  ড. আতাউরও মনে করেন, হাসিনা যেভাবে শক্ত হাতে দেশকে ‘টেকসই’ উন্নয়নের দিকে পরিচালনা করেছেন, তা আর কখনো হয়নি। তিনি অনেক বেশী সক্ষমতা ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। “দেশের ইতিহাসে তিনি রাজনৈতিক নেতার চেয়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বেশী উজ্জল হয়ে থাকবেন,” বলেন এই বিশ্লেষক। এ ব্যাপারে ড. শান্তনুর বক্তব্য, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি যে ‘রকেট’ গতিতে এগিয়েছে, তাঁর দলের ভোট কিন্তু একই গতিতে বাড়েনি।” 

৭৩ তম জন্মদিনের প্রাক্কালে (২৬ সেপ্টেম্বর)  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল (ইউনিসেফ)। তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি এই সম্মাননা অর্জনের মাত্র দুই দিন আগে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অপর এক অনুষ্ঠানে তাঁকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ আখ্যা দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)। এই সম্মাননাটি শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতে সাফল্যের স্বীকৃতি। 
এর আগে গত  বছর এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। নেতা ক্যাটাগরিতে তালিকায় জায়গা পাওয়া ২৭ জনের মধ্য তিনি ছিলেন ২১ নম্বরে। ফোর্বস, সিএনএন, ফরচুনসহ একাধিক গণমাধ্যমের জরিপে বিশ্ব, এশিয়া এবং মুসলিম জাহানের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায়ও ছিলেন তিনি। 
ছবি: সংগ্রহিত
জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সর্বাধিককাল দায়িত্ব-পালনকারী হাসিনাকে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে নানাজনের সাথে, মূলত সাংবাদিকতার সুবাদে। যার কিছু প্রকাশিত হয়েছে, কিছুটা হয়নি। নিজের মত প্রকাশের সুযোগ না থাকায় কোথাও বলতে পরিনি, তিনি বাংলার আদ্যাশক্তিরই প্রতিরূপ। প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনেই আজ এই লেখার অবতারণা। 

পথটা সহজ ছিল না : শেখ হাসিনার এই সাফল্য একদিনে অর্জিত হয়নি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারও আগে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের প্রথমে সহসভাপতি, পরে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থান করায় বেঁচে যান।পরিবারের সদস্যদের শেষকৃত্যে করার অনুমতিও সে সময়কার সরকার তাঁদের দেয়নি। পরের ছয় বছর ভারতে ছিলেন তাঁরা। নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে তাঁর অনুপস্থিতিতেই সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের পর ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থে‌কে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোট সাতবার তাঁকে গৃহবন্দী ক‌রে রাখে শাসকগোষ্ঠী। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সেনা‌সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাঁকে সাবজেলে থাকতে হয়। 
ছবি: সংগ্রহিত
এর আগে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে একইদিনে দুবার তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হয়। ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালেও তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়েছিল। ২০০১ সালেও তাঁকে দুইবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে স্বীকার করেছেন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (বর্তমানে বিলুপ্ত) শীর্ষনেতা মুফতি হান্নান। 

শেখ হাসিনার ৩৬ বছরের (১৯৮১-২০১৭) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসের সংকলন “জননেত্রীর জয়যাত্রা” সম্পাদনাকারী আসিফ কবীর বলেন, “পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের মানসিক আঘাতের পাশাপাশি স্বজন হারানোর সুতীব্র বেদনা ও বিচারহীনতার সংক্ষুব্ধতা- এই তিন নিদারুণ চাপ সয়েই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। সামরিক ও ছায়া সামরিক শাসকরা আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের জন্য নানা চক্রান্ত, কূটকৌশল ও নিষ্পেষণ চালিয়েছে। তা সত্ত্বেও জননেত্রীর (শেখ হাসিনা) নেতৃত্বে তারা বারবার পুর্নগঠিত ও পুনরুজ্জীবিত হয়ে অগ্রসর হয়েছেন। প্রধানের দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস এবং অপরিসীম সাহসের কারণেই দলটি এত বছরেও অতীত হয়নি।” 
শেখ হাসিনার ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।গত বছরের অক্টোবরে এ সংক্রান্ত মামলার রায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। ফাঁসির আদেশ হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ আরো ১৯ জনের। 
২১ আগস্টের হামলার পর
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে সবচেয়ে নিন্দনীয়, নৃশংস ও নারকীয় ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী প্রেস সচিব আসিফ বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করায় রাষ্টধীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইতিহাসে বিরল। তবুও পিছপা হয়নি শেখ হাসিনা বা তাঁর দল। খুব কাছ থেকেই তাঁকে দেখছি শাসনব্যবস্থার সংস্কার, জনগণকে যুপোপযোগী সুরক্ষা দান এবং নগর থেকে প্রান্তিক পর্যায় অবধি উন্নয়নের কাজে নিবেদিন থাকতে।তাঁর নেতৃত্বে দেশের অবকাঠামো খাতে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়েছে তা অচিরেই সম্পন্ন হয়ে জনগণের দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ হবে।” 

বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অভিযোগ, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসিত করেছেন। একইসঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দিয়ে গেছেন। বিএনপিকে নিয়ে গড়া রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে হারিয়েই তিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এটিকে ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন দাবি করা ওই দলটি ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা দুই দফায় মোট ১০ বছর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বও পালন করেছেন। এর আগে বিএনপির বয়কটে ‘বিতর্কিত’ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয় অর্জনের পর হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিএনপিকে হারিয়েই তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ও ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার এই দায়িত্বগ্রহণ করেছিলেন।  

আসিফ বলেন, “রাজপথের দল থেকে সংসদের বিরোধী বা সরকারি দল, সব ভূমিকাতে আওয়ামী লীগের সাফল্যের কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।” বিগত কয়েক বছরে দলীয় ফোরামে বেশ কয়েকবার শেখ হসিনা নিজেই অবসরে যাওয়ার বিষয়টি তুলেছেন। প্রতিবারই দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সমস্বরে জানিয়েছে, তাঁকে আমৃত্যু দলের প্রধান হিসেবে চায় তারা। ড. আতাউর বলেন, “শেখ হাসিনা খুবই বাস্তববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। যে কারণে অনেক কঠিন সময় পার করেও তিনি নিজেকে, নিজের দলকে এবং বাংলাদেশকে একটা ভালো অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছেন।”
ড. শান্তনু  বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার কোনো বড় রাজনৈতিক দলে শেখ হাসিনার মতো এত লম্বা সময় ধরে কেউ নেতৃত্বে নেই। তাঁর কারণেই আওয়ামী লীগ আজ শুধু দেশ নয়, পুরো উপ-মহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। যখন ভারতের কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগসহ শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের পুরানো দলগুলোও ক্রমে দুর্বল হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের এই দলটি ক্রমে আরো সামর্থ্যবান হচ্ছে। এটা নিশ্চিত যে তিনি (হাসিনা) না থাকলে আওয়ামী লীগ এখন যেরকম অবস্থায় আছে, সেটা থাকত না।” 
শান্তনু আরো বলেন, “তাঁর রাজনীতি কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে দক্ষিণ-এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জায়গা থেকে যদি দেখলে বলতে হয়, এটা এমনই হওয়ার কথা।  বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন যে এতদিন ধরে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, এটা শেখ হাসিনার বড় একটি কৃতিত্ব। দলকে তিনি ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। কখনো শক্ত হাতে, আবার কখনো প্রজ্ঞার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলেছেন।”

ছবি: সংগ্রহিত
শাসনে সাফল্য-ব্যর্থতা :  বিশ্লেষকদের মতে, বিগত দশকে শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশী সফল কূটনীতিতে। আগের সরকারের কারণে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে যে দুরত্ব তৈরী হয়েছিল, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই তিনি তা ঘুচিয়ে ফেলেন।  তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই তিনি চীনের সাথেও সম্পর্কের গভীরতা বাড়াতে পেরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বিরোধীতা করলেও তিনি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হননি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু বলেন, “কূটনৈতিক দিক থেকে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট। তিনি দ্বিতীয়বার এমন একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, যখন আন্তর্জাতিক কতগুলো পরিস্থিতি, বিশেষকরে উগ্রপন্থী সহিসংতার কারণে সারাবিশ্বই উদ্বিগ্ন। এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সাথে রাশিয়া, চীনেরও কোনো বিরোধ নেই; বরং তারা সবাই একাট্টা। এই ইস্যুতে বৃহৎ প্রতিবেশী (ভারত) এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘গুড বুকে’ জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন শেখ হাসিনা। উগ্র জঙ্গিবাদ দমনের ভূমিকাই তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে। এটা তাঁর অন্যতম শক্তি।” আন্তর্জাতিকমহলে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নাজুক অবস্থানও আওয়ামী লীগকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। 

ছবি: সংগ্রহিত
ড. আতাউর বলেন, “শেখ হাসিনা খুবই দক্ষতার সাথে সব সামলে নিয়েছেন। তাঁর শাসনামলের দুইটি দিক আছে, একটা রাজনৈতিক এবং অন্যটা অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক দিকে তিনি ভালো করেছেন, এটা মোটামুটি সব মহলই স্বীকার করছে। বৈষম্য, দুর্নীতি, অর্থপাচার বেড়েছে, তবুও অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শেখ হাসিনার একটি বড় অর্জন। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর কিছু নেতিবাচক অর্জনও আছে।” ২০১৪ সা‌লের ‌নির্বাচ‌নের আগে ও প‌রে বি‌রোধী দলীয় নেতাকর্মীরা গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা‌ণ্ডের শিকার হ‌য়ে‌ছেন ব‌লে অভি‌যোগ আছে। তার শাসনামলে প্রায় সাড়ে পাঁচশ গুমের ঘটনা ঘটেছে। সেইসঙ্গে ঘটেছে কয়েক হাজার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘খুব বেশী’ কথা বলাও ‘ঝূঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তাঁর ভাষ্য, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তিনি ‘জিরো-টলারেন্সের’ কথা বলেছিলেন, তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এটা ছিল। কিন্তু গত ১০ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো কমেইনি, বরং এর সাথে যুক্ত হয়েছে গুম। মানুষ আগেও ‘গুম’ হয়েছে, কিন্তু এটা মাত্রাতিরিক্ত ঘটেছে এই সময়টায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মি-সমর্থক নেতা থেকে শুরু করে সাবেক রাষ্ট্রদূত, এমনকি সেনাকর্মকর্তারাও গুম হয়েছেন। এই যে বর্বরতা, এটা বাঁধাহীন ভাবে নির্বিচারে চলেছে। এটা সরকারের বিরোধী মতের ওপর দমন পীড়নেরই বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি।” 

ছবি: সংগ্রহিত
গত বছর সরকা‌রি চাক‌রি‌তে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়‌কের দা‌বি‌তে স্কুল ক‌লেজ শিক্ষার্থী‌দের আন্দোলনও ক‌ঠোরভা‌বে দমন করার অভি‌যোগ আছে শেখ হাসিনার বিরু‌দ্ধে।  বিত‌র্কিত ধারা বহাল রে‌খে ডি‌জিটাল নিরাপত্তা আইন পাস ক‌রে মত প্রকা‌শের অধিকার ক্ষুণ্ন করার দায়ও বর্তা‌নো হয় তাঁর ওপর। এ ব্যাপারে লিটন বলেন, “তুমুল প্রতিবাদের পরও বাকস্বাধীনতা হরণকারী আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাকে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরো শক্তভাবে প্রতিস্থাপিত হতে দেখলাম। এসব আইনে অনেক ক্ষেত্রে জামিনের অধিকারও দেওয়া হয়নি।মত প্রকাশের দায়ে ইতিমধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, নারী অধিকার কর্মি, সমাজকর্মি, ছাত্রসহ অসংখ্য মানুষকে কারাবরণ করতে দেখেছি।” 
ড. শান্তনু বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখছে একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বাক-স্বাধীনতাহরনকারী আইন জারির অভিযোগ রয়েছে; অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের ঝূঁকি অসাধারণভাবে কমে গিয়েছে। যে কারণে অভ্যন্তরীন কোনো ইস্যুতে তারা শেখ হাসিনার সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, বাক-স্বাধীনতাহরন আমাদের শাসনব্যবস্থার অংশ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে বড় অভিযোগগুলো, সেগুলোও অনেকখানি ‘ব্লার’ (অস্পষ্ট) করে দিতে পেরেছে।” 
যদিও লিটনের দাবি, “রোহিঙ্গাদের বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থান অবশ্যই মানবিক। তবে তা দিয়ে আভ্যন্তরীন মানবাধিকার লংঘনকে ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা (মানবাধিকার কর্মিরা) দীর্ঘদিন ধরেই একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। যে কমিশন ২০০৪ সালের পর থেকে এখন যত বিচার বহির্ভূত হত্যা বা গুম হয়েছে তা তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করবে, বিচারের আওতায় আনবে। আওয়ামী লীগ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অর্থাৎ এই ইস্যুতে শেখ হাসিনার নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।” 

নানা ‘বিতর্ক’ থাকলেও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল উল্লেখ করে  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অরুন বলেন,  এক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা সফল হয়েছেন। বিরোধীরা সবসময় তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ বললেও তিনি তাদের সাথে সংলাপ করেছেন। রাজনৈতিক কৌশলে পরাভূত হয়ে সব রাজনৈতিক দলই এবার তাঁর সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল, তারই জেরে দীর্ঘদিন এদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন হয়নি।”
অরুন আরো বলেন, “মূলত সামরিক শাসন বারবার এই আস্থা-বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনেছে। শেখ হাসিনা এই নির্বাচন সফলভাবে সামলিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সেই আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে এনে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর এই ভূমিকা ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লেখা থাকবে।” 
তবে “শেখ হাসিনার ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা আছে,” উল্লেখ করে ড. শান্তনু বলেন, “কিছুদিন আগে আমরা দেখতে পেয়েছি তিনি ‘কওমী জননী’ উপাধিও পেয়েছেন। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁর দলটি ধর্মনিরপেক্ষ।” এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি আতাউরের অভিমত, “অনেক সময় তাঁকে (হাসিনা) আপোষও করতে হয়েছে। যেমন – ইসলামিক দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের দূরত্ব ঘোচাতে নমণীয় হয়ে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন।” 
দেশের ডানপন্থী রাজনীতির মূলশক্তি হিসেবে বিএনপির শক্তিশালী খর্ব হওয়ায় সৌদিআরবসহ মুসলিম বিশ্বের ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে বিএনপি একচেটিয়া অবস্থান টলে গেছে বলে দাবি করেছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, মুসলিম দেশগুলোর কাছে শেখ হাসিনাও এখন গ্রহনযোগ্য একটি নাম। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দেওয়াটা তাঁর জন্য খুবই ইতিবাচক হয়েছে। 
ছবি: সংগ্রহিত
২০১৭ সালে রো‌হিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর ব্রিটেনভিত্তিক গণমাধ্যম চ্যানেল ফোরের একটি প্রতিবেদনে তাঁকে ‘মাদার অফ হিউম্যা‌নি‌টি’ আখ্যায়িত করা হয়। এর আগে তাঁর শাসনামলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসান হয়েছিল।  শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং পরিবেশ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হাসিনাকে বিভিন্ন সম্মানসূচত ডিগ্রি এবং পুরস্কার প্রদান করেছে। 

ব্যক্তিগত জীবন ও স্বজন :  ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মানো শেখ হাসিনার পরিবারের সাথে ১৯৫৪ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ানরত অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার সাথে। তিনি ২০০৯ সালের ৯ মে ইন্তেকাল করেন। এই দম্পত্ত্বির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। 

ছোট বোন শেখ রেহানাকে আদর করছেন শেখ হাসিনা
ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ একজন তথ্য প্রযুক্তিবিদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টাও। মেয়ে সায়মা হোসেন ওয়াজেদ একজন মনোবিজ্ঞানী এবং তিনি অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণে কাজ করছেন।  সাধারণত অবসর পান না শেখ হা‌সিনা, পে‌লেই রান্না ক‌রেন, বই প‌ড়েন। এছাড়া তিনি তাঁর সাত না‌তি-নাত‌নি‌র স‌ঙ্গে সময় কাটা‌তে ভালবা‌সেন তি‌নি। গত বছরের নভেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া তথ্যচিত্র ‘হাসিনা: এ ডটার্স টেল’ –এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। 
চলতি মাসে নিজ দলের নেতাদের দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষ এবং দেশের সূবর্ণ জয়ন্তীতেও ক্ষমতায় থাকছে তাঁর দল। তবে  “তিনি লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকা শুধু তাঁর দল নয়, সমগ্র জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলছিলেন ড. শান্তনু।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) এই নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, “দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় বর্তমানে আওয়ামী লীগে অনেক আবর্জনা যুক্ত হয়েছে। সরকারি দল হিসেবে তাদের এখন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে আগামীতে তাদের নাম করে কেউ অপরাধ করার সাহস না পায়।”  নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন,  “চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে শেখ হাসিনা যে অপূর্ব সুযোগ পেয়েছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এরকম সুযোগ খুব কম মানুষ পেয়েছে। আশা করি, তিনি এটার সদ্বব্যবহার করবেন।”

৩১ জুলাই ২০১৯

সাম্প্রতিক দিনলিপি

© ঈয়ন

দেহের নদে দৌড়ে বেড়ায় বুভুক্ষু শুশুক

হিজলগন্ধা মাতাল সন্ধ্যায়— অরণ্যের মধ্যরাতসম নিস্তব্ধতা ঘনিয়ে আসে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে পরিণত হওয়া নগরে। শালুক দোলানো হাওয়ার কাঁধে মাথা রেখে, মৃত নক্ষত্রের মতো ঘুমিয়ে পড়ে —প্রতিটি ব্যর্থ প্রণয়ের অব্যর্থ নিরাশা। কায়মনোবাক্যে বাঁচার প্রত্যয়ে আবারও প্রেম খোঁজে দুরুদুরু বুক; আর— দেহের নদে দৌড়ে বেড়ায় বুভুক্ষু শুশুক। যারে পোষ মানাতে পারে শুধু কলাবতীর রাঙা ঠোঁটের চাবুক। [৩১ জুলাই ২০১৯ / মিরপুর-ঢাকা।]

হিতাকাঙ্ক্ষা

আর্মেনিয়ান বাঁশির মতো
বিরহী স্নায়ুর মরুদ্যানে—
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া
যে প্রাণবন্ত জোয়ান যাদুকর
নিগূঢ় খেয়ালের মতো নাচে
দৃঢ় ক্যানভাসে ক্যানভাসে,
মায়ারঙা নিখাদ প্রণয় এঁকে
তাঁর অবিদিত আমুদে বুকে
ডুবে যায় তৃষ্ণার্ত রাধিকা;
আহা কী কোমল প্রখর চুমুক
রমণীয় ভরাট চিবুকের ঢালে
আবারো ফিরলে তৃপ্তির টোল
মনমরা বিফল অতীত ভুলে
—প্রিয় প্রাক্তনও সুখে থাকুক
[৩০ জুলাই’১৯ / মিরপুর-ঢাকা।]

Journey to hell

Sometimes it seems
Life is pretty cheap
Although too deep
Like lover’s last kiss
Maybe it's a bad trip
But not in God's grip
I'm competing Devils
As an unmanned ship
[28 July 2019 / Mirpur - Dhaka.]

রোদন

বৃক্ষহীন পাথুরে উপত্যকায় বিকশিত
জন্মান্ধ কবির মাতাল মাদলের তালে
কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠলে নদী,
—সহস্র সেতার হয়ে বাজে
দুনিয়ার শেষ জলদস্যু মন;
আর ঠিক তখনই কোথাও
উদাসী সুরের বরষায়—
পলির মতো ভেসে যায় কথা,
নৈঃশব্দের বনে উড়ে যাওয়া
নামহীন রাতপাখির বুকেও
—খা খা করে ওঠে নীরব ক্রন্দন।..
[২৬ জুলাই’১৯ / মিরপুর-ঢাকা।]

উনপাঁজুরে

মনীষার একাংশে তপ্ত মরুভূমি
আর বাকিটায় শীতল জল নিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকা অমসৃণ পাহাড়—
জীবনের সব মেঘ জমিয়ে রাখে
—তাঁর নিরস নির্নিমেষ চোখে;
যা বরষা হয়ে ঝরেনি কোনোদিন
অরণ্যের সাথে দেখা না হওয়ার আক্ষেপে।
[২৫ জুলাই’১৯ / মিরপুর-ঢাকা।]

© শ্যামল শিশির

২৮ জুলাই ২০১৯

পিতৃহারা যে কান্না থামেনি আজও

খন্দকার খলিলুর রহমান
ছবির মানুষটির নাম খন্দকার খলিলুর রহমান। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদ, তথা এককালের শিল্প-নগরী খুলনার শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার চাখার ইউনিয়নের বলহার গ্রামের খন্দকার বাড়িতে তার শেকড়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন খুলনার অবাঙালি বিহারি অধ্যুষিত খালিশপুর শিল্প এলাকায়। সদ্য স্বাধীন দেশে নূন্যতম মজুরী নির্ধারণে তার তৎপরতা ছিলো শ্রমিক প্রতিনিধির ভূমিকায়। রাজনৈতিক কারণে, বিশেষত পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জেল-জুলুম ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। তবু বারবার রাজপথে ফিরেছেন, থেকেছেন। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি শরীরে নিয়েও জীবনের শেষ অবধি অন্যায়, অনাচারের প্রতিবাদ করে গেছেন।
সুফিজমে আকৃষ্ট খলিল ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী। আবার খেলাধূলাও পছন্দ করতেন খুব। বহুদিন ফর্দ নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে কলোনীর শিশুদের মার্বেল খেলতে দেখে বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। পরে তাকে খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে তিনি তুমুল উৎসাহে মার্বেল খেলছেন। আজও তার আরো অনেক গল্প শোনা যায়, একের পর এক মিল বন্ধ হয়ে জৌলুস হারানো সেই শিল্প এলাকায়।
সেবার শ্রমিকদের ফরিদপুর আর নোয়াখালী গ্রুপের মধ্যে তুমুল গণ্ডগোল, মারামারির জেরে দুপক্ষের প্রায় আড়াইশ শ্রমিক গ্রেফতার হন। তাদের নেতা হিসেবে গ্রেফতার হন খলিলও। এর আগে দু’পক্ষকে ঠেকাতে গিয়ে তার মাথা ফেঁটে যায়। এমন অবস্থায়ও তিনি বউয়ের সব গয়না বিক্রি করে সবার জামিনের ব্যবস্থা করেন। কারান্তরীণ শ্রমিকেরা তখন কথা দিয়েছিলেন, পরবর্তী মাসের বেতন থেকে চাঁদা দিয়ে তারা এই গয়না কিনে দেবেন। কিন্তু তা আর তারা করেননি। যারই জেরে আজও ফরিদপুর আর নোয়াখালীর মানুষদের বিশ্বাস করতে চান না তার বিধবা স্ত্রী রশিদা খানম মুক্তা। ঠিক ৩১ বছর (২০১৯) আগের এই দিনে (২৮ জুলাই) তিনি নিজের স্বামীকে হারিয়ে ছিলেন।

সেদিন বরিশাল থেকে খুলনার পথে ছুটতে ছুটতে দেখেছি কাঁদছে আমার মা। তার সেই পিতৃহারা কান্না আজও থামছে না। বহু বছর পর একইদিনে দেহত্যাগ করেন আমার আরেক প্রিয়জন আহমদ ছফা। নানা এবঙ তিনি একই বয়সী ছিলেন বোধকরি।

২৫ এপ্রিল ২০১৯

হিমু ভাই, দেখা হবেই - ‘মিস’ নাই ..

“ছবিটা সম্ভবত ২৫ এপ্রিল দুপুরের দিকে রানা প্লাজার পিছনে তোলা। তার কিছুক্ষণ আগে
পৌঁছানোর পর আমি কাঁকন, সাদিকসহ আরও কয়েকজন মিলে অর্ধেক মাটির নিচে থাকা এক
মহিলার লাশ টেনে বের করি,” এমন ক্যাপসন দিয়ে ফেসবুকে এই ছবিটি প্রকাশ করেছিলেন হিমু।
বাংলাদেশী গণমাধ্যমের তৎপরতার প্রসংশা এখন সর্বজন বিদিত। যে কোনো ঘটনায় আমাদের, মানে সাংবাদিকদের ‘ব্রেকিং’ দেওয়ার প্রতিযোগীতা এখানে বিশ্বমানের। অথচ হিমালয় হিমু ওরফে নওশাদ হাসান হিমুর মৃত্যুর ১২ ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে নিয়ে সংবাদ দেখলাম শুধুমাত্র ডেইলি স্টারে, যার শিরোনাম “গায়ে আগুন দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ রানা প্লাজা স্বেচ্ছাসেবকের।” এছাড়া প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে “তুই পাগল না মুই পাগল” শিরোনামে প্রকাশিত ফারুক ওয়াসিফের লেখা এক মতামতের মধ্যে খবরটি উল্লেখ রয়েছে। 
ফারুক লিখেছেন, “তার সঙ্গে দেখা রানা প্লাজা ধসের দিন। কী এক উন্মাদনার বশে ধ্বংসস্তূপ থেকে আহত ও নিহত লোকজনকে সরিয়ে আনছিল। হাতুড়ি-ছেনি-করাত দিয়ে উদ্ধার করছিল। হয়তো তার জন্য কারও হাত বা পা-ও কাটতে হচ্ছিল। পাগলটা কবিতাও লিখত। কিন্তু মৃত্যুপুরীর সেই দুঃসহ স্মৃতি সে আর ভুলতে পারেনি।” 
“রানা প্লাজার নিহত ব্যক্তিদের মতো তাকেও ভুলে যাচ্ছিল সবাই। দিনে দিনে অবসাদের চোরাবালি ঘিরে ধরে তাকে। ফেসবুকে একের পর এক স্ট্যাটাস দেখেও কেউ বুঝতে পারেনি যে রানা প্লাজা ধসের দিন ঘটবে আরেকটি ধস। গতকাল ২৪ এপ্রিল গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে সে,” যোগ করেন তিনি। 

সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক আসগর আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, “এটি আত্মহত্যার ঘটনা। তবে তার মৃত্যুর পেছনে কারণগুলো এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।” 

এর আগে বুধবার দিবাগত রাতে হিমুর মৃত্যুর খবরটি চাউড় হলে সাংবাদিক এম জে ফেরদৌস ফেসবুকে লেখেন, “রানা প্লাজায় যারা উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলো তারা সবাই কমবেশি হিমুকে চেনে। হিমালয় হিমু, উদ্ধারকাজে ওর তৎপরতার কারণেই কিনা জানি না, অনেকেই ওরে ‘কালাপাহাড়’ বলে ডাকতো। কয়েকঘন্টা আগে হিমু গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ২৪ এপ্রিল, তাও সেটা সাভারেই।” 

বন্ধুরা জানাচ্ছে, সহস্রাধিক প্রাণ কেড়ে নেওয়া রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনার পর থেকে গত ছয় বছর হিমু আর কাঁচা মাংস ধরতে পারত না, কোনো সুগন্ধিও সহ্য হতো না তাঁর। এই ডগ ট্রেইনার ও আইনজীবি এক সময়ে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর এই মৃত্যুকে প্রতিবাদও ভাবছেন অনেকে। 
ফেসবুকে পশ্চিমবঙ্গের কবি অতনু সিংহ লিখেছেন, “আত্মহত্যা কখনো কখনো ব্যক্তির রাজনৈতিক বিদ্রোহ৷ দার্শনিক একটি কাজও বটে। হিমালয় হিমুর মৃত্যু তাই আমাদের অপরাধী করে দেয়!” 
কাল রাতে যখন খবরটি পেলাম ফেসবুক মেসেঞ্জারে হিমায়ল হিমুকে তখনও ‘অনলাইন’ দেখাচ্ছে, অথচ তাঁর বন্ধুরা বলছিলেন তিনি চিরতরে ‘অফলাইনে’ চলে গেছেন। মাত্র তিন-চার দিন আগে এই মানুষটির সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার। 

সাভারের বিরুলিয়ার সাদুল্লাপুর গ্রামে গিয়ে তাঁর দেখা হয়েছিল মূলত বন্ধু রাজীব আশরাফের কল্যাণে। কুকুরের প্রতি হিমুর অকৃত্রিম মমত্ত্ব বোধ দেখে সেদিন আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম। সাদুল্লাপুর থেকে একইসঙ্গে ঢাকায় ফিরেছিলাম আমরা, সাথে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ধার করে আনা একটি মুমূর্ষ কুকুর। সেটিকে কোলে করে মোহাম্মদপুরের এক পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন হিমু। দিয়া বাড়ি ট্রলার ঘাট থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাঁকে বলেছিলাম, “শিগগিরই ফের দেখা হবে।” হিমু বলেছিলেন, “অবশ্যই ভাই।” 

তিনি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন শুনে তাঁর প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম মাত্র দুই ঘন্টা আগে ‘হ্যাশট্যাগ’ দিয়ে লিখেছেন, ‘জয়বাংলা - প্যারা নাই’। তার সামান্য আগে লিখেছেন, ‘কোনো মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’। এর ঘন্টাখানেক আগে হিমু একইভাবে লিখেছেন, ‘আগুন সর্বগ্রাসী, তাই ভালোবাসি’। তারও আগে মোটা চার ঘন্টায় চারটি ‘স্ট্যাটাস’ দিয়েছেন তিনি। এক ও দুই ঘন্টা আগে লেখেন একইকথা, ‘ছোটকাল হৈতেই আগুন আমার অনেক পছন্দ’। এর ঠিক আগের দুই ঘন্টায় তিনি লিখেছেন, ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে *দাইতে লাগিল’ এবং ‘এমনি করেই হয় যদি শেষ হোক না’। 

হিমু’২০১৫
হিমুর বাড়ি উজিরপুরে হলেও বেড়ে উঠেছেন পটুয়াখালীতে। আমি বরিশাল শহরে বড় হয়েছি জেনে বলেছিলেন, তিনিও একে স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। আরো কি কি নিয়ে জানি কথা হয়েছিল আমাদের, যা খুব সামান্য সময়ের হলেও তাঁর অসাধারণ সারল্য অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল। যে কারণে তাঁর হলদে হাসিটা স্মরণে আসতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার। রাজীব বলছিল, হিমু কুকুরদের জন্য একটা সেবাকেন্দ্র খুলতে চায়। তাঁর এই পশুপ্রেম নিয়ে হয়ত লিখতাম কখনো, কিন্তু হায় মানুষ কত দ্রুত হারিয়ে যায়। 

হিমুর আরো দুটি লেখা খুব মনে লেগেছে। গত পরশু তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিদিন মনে মনে শখানেক মানুষ খুন করি’। আরো লিখেছেন, আত্মহত্যাকারী যদি কাপুরুষ হয় তাইলে যারা স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে তাঁরা বোকা*দা।” 

আপাতত বিদায় হিমু ভাই, তবে আপনার সাথে দেখা হবেই, ‘মিস’ নাই। 

১৬ এপ্রিল ২০১৯

নয়াখোলার শেষ কম্বল শিল্পীর গল্প

সালামত উল্লাহ।
‘ছয় ভাই, এক বোনের সকলে; এমনকি বোন জামাই আর ভাইয়ের বউরাও ভেড়ার লোমের কাজ করতেন। আমার ওস্তাদ ছিলেন বড়ভাবী। তিনিই আমাকে কাজ শিখিয়েছেন। এখন অবশ্য আমি ছাড়া আর কেউই এ কাজ করেন না। বড় ভাই আর তার মেয়ে করতেন। তারাও ছেড়ে দিয়েছেন। বড় ভাই এখন গ্রাম ডাক্তার।’ আঞ্চলিকতার সাথে খানিকটা বিহারী মেশানো ভাষায় একটু থেমে কিছুটা গল্পচ্ছলে কথাগুলো বলছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের নয়াখোলা এলাকার সালামত উল্লাহ। 
২০১৪ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহের বর্ষাস্নাত এক সকালে তাঁর সাথে কথা হয়। কৈশোরে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভেড়ার লোমের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন নিজের জীবন। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে অর্ধশতক। গত ৫০ বছরে কত ঘটনার মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছে তাঁকে। এই পেশার আয়েই নিজের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তাও প্রায় ১৭ বছর হয়ে গেছে। 
সালামত বলতে থাকেন, ‘১৫-১৬ বছর আগেও এই নয়াখোলার ২০ পরিবারের ৫০-৬০ জন মানুষ ভেড়ার লোমের কম্বল তৈরীর কাজে জড়িত ছিলেন। আর এখন আমি ছাড়া আর কেউ নাই।’ ভেড়ার লোম কাটা থেকে শুরু করে, লোম বাছাই, জাত অনুযায়ী আলাদা করা, ধুনানোর পর তুলা তৈরী, তুলা থেকে সুতা আর সুতা দিয়ে কম্বল বুনানো, বুনন করা কম্বল পানিতে ভিজিয়ে জমাট করে তা শুকানো, এসব তিনি একাই করেন। আগে কিছু কাজে সহধর্মীনির সাহায্য পেতেন। তাঁরও বয়স হয়ে গেছে। ‘এখন আর আগের মত পারে না’- বলে থেমে, একটু হাসলেন সালামত। 

সালামতের পূর্বপুরুষের বাড়ি ভারতের মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর। দেশভাগের পর আরো অনেক মুসলমান পরিবারের সাথে তারাও এ পাড়ে চলে আসেন। ওই সময় থেকেই বংশ পরম্পরায় পাওয়া ভেড়ার লোমের কাজ ছেড়ে পেশা বদলাতে শুরু করেন তাঁর জ্ঞাতিদের অনেকে। তবে কিছু মানুষ তাদের পুরানো পেশা আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তেমন চেষ্টাই ছিলো সালামতের পিতার। যা জারি রেখেছেন সালামতও। 

‘শুধু কম্বল না, এককালে কার্পেটও তৈরী হত এখানে’ - এমনটা উল্লেখ করে সালামত জানান, ভেড়ার লোম সংগ্রহে তাঁর কোনো খরচ হয় না। সারাদেশের ভেড়া মালিকরাই তাঁর কথা জানেন। তারা কোনো দাম-তো রাখেনই না, উল্টো নিজেদের খরচেই তাঁকে ভেড়ার লোম কাটাতে নিয়ে যান। লোম বাছাই করতে করতে পাশে রাখা দুটি বস্তা দেখিয়ে তিনি জানান, ওখানে মোট দেড়শো ভেড়ার লোম রয়েছে। সম্প্রতি তিনি নোয়াখালী থেকে কেটে এনেছেন। এভাবে সারা দেশ থেকেই তিনি ভেড়ার লোম সংগ্রহ করে বেড়ান। 
২০টি ভেড়ার লোম দিয়ে যে সুতা তৈরী হয়, তা দিয়ে অনায়াসে পাঁচ দৈর্ঘ আর তিন হাত প্রস্থের একটি কম্বল তৈরী করা সম্ভব। সালামত তাঁর প্রতিটি কম্বল বর্তমানে (২০১৪ সালে) মাত্র সাতশ টাকা করে বিক্রি করেন। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতি মাসে তিনি গড়ে ১০-১২ টি কম্বল তৈরী করতে পারেন। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিরও সহায়তা নিচ্ছেন খানিকটা। ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরী তুলো এখন আর তিনি হাতে ধুনন করেন না। শিবগঞ্জ তুলোধুনোর মেশিনে ধুনন করিয়ে আনেন। সেখানে প্রতি কেজি তুলো ধুননে ১২ টাকা করে নেয়।
আলাপ ও ছবি তোলা শেষে ফেরার সময় খাদে নামানো অদ্ভুত নিঃসঙ্গ স্বরে সালামত শুধু জানতে চেয়েছিলেন ‘আবার আসবেন তো?’ নয়াখোলার শেষ কম্বল শিল্পীর চোখে তখন রাজ্যের বিষাদ। পরক্ষণেই মায়াভরা হাসিতে বিষন্নতা লুকিয়ে বলেন, ‘আমি মরলে তো এখানকার কেউ আর এই কাজ দেখাতে পারবে না।’ 

নিজের তৈরী কম্বল দেখাচ্ছেন সালামত।
বাংলাদেশ-জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাস্তবায়িত এক প্রকল্পের আওতায় শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সেতুচি ক্যাটালগ - বাংলাদেশ ক্রাফটস’ শীর্ষক প্রকাশনায় আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেছিলাম বছর চারেক আগে। যে কাজে সংযুক্ত করার পাশাপাশি আমায় পথ দেখিয়েছেন লেখক ও গবেষক অনার্য তাপস, আর চাঁপাইয়ে গিয়ে পেয়েছি গম্ভীরা শিল্পী ফাইজুর রহমান মানি, সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং তরুণ আইনজীবী মেরাজ হোসেনের সহায়তা । ছবি তুলতে তুলতে সেবার যেসব গল্পের সন্ধান পেয়েছিলাম, তার কয়েকটি ব্লগ পাঠকদের জন্য এখানে টুকে রাখার তাগিদ অনুভব করছি।

০৬ এপ্রিল ২০১৯

নিজেরই প্রতিবিম্বগণ যার হন্তারক

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নৈশ আড্ডায় অভিজিৎ দাস, ৭ জুলাই ২০১৩।..
কবি রাসেল রায়হানের সম্পাদক সম্পাদিত শিল্প সাহিত্যের সংবাদ বিষয়ক ওয়েবজিন ‘কালকুট’ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করেছিল এই লেখাটি।  নিখোঁজ কবি অভিজিৎ দাসের জন্মদিন উপলক্ষে আজ পুনরায় প্রকাশ করছি লেখাটি।  
“যোগেন মণ্ডলের বাঙলায় আজও থামেনি নমঃশূদ্র পীড়ন। ১৪’র অক্টোবরে গুম হন কবি অভিজিৎ দাস, ১৭’তে লাপাত্তা সাংবাদিক উৎপল দাস।” – গত বছর নভেম্বরে এক মুখবই প্রকাশনায় লিখেছিলাম এমনটা । আসলে উৎপলের ঘটনা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে অভিজিৎ-কে। তিনি সেই কবি, নিজেরই প্রতিবিম্বগণ যার হন্তারক। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটি বছর; কোথাও মেলেনি আমাদের এই বন্ধুর খবর। উৎপল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার যেভাবে সরব হয়েছে তা আশাব্যঞ্জক। তাকে নিয়ে জাতীয় সংসদে অবধি আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই সংবাদ-আলোচনা বা তার সহযোদ্ধা সাংবাদিকদের তামাম, প্রচেষ্টা কত দিন জারি থাকবে তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে মনে। কারণ অভিজিৎ-কে ফিরে পাওয়ার সকল প্রচেষ্টা কিন্তু এরই মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। কবি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে যাচ্ছেন স্বজন-বান্ধবদের স্মৃত্মির অতল গহবরে।

[উল্লেখ্য, নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস ১০ দিন পর উৎপল ফিরে এসেছিল।]
সেবার উত্তরের হওয়া একটু আগেভাগেই বইছিলো। হিম হিম ভাব চলে এসেছিলো উষ্ণনগরী ঢাকার ভোরগুলোয়ও। ২০১৪-এর অক্টোবরের এমনই এক ভোরে, সম্ভবত ছয়টা বা সাড়ে ছয়টার দিকে সহোদর (ছোট ভাই) বিশ্বজিৎ দাসের শ্যামলীর বাসা থেকে বেড়িয়ে যান বাংলাদেশের তরুণ কবি ও গণসঙ্গীত শিল্পী অভিজিৎ দাস। এরপর থেকেই তিনি লাপাত্তা। দুই বাংলাতেই তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন বন্ধু, স্বজনরা। খোঁজার কথা জানিয়েছিলো পুলিশও। কিন্ত হদিস মেলেনি। প্রায়ই স্মরণ করি - কত গান কত স্মৃতি; ভাবি অভিজিৎ আদৌ ফিরবেন কি?
এরই মধ্যে কত কি ঘটে গেছে। চলতি বছরের মে মাসে চলে গেলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে কত মানুষ খবর নিতে মুঠোফোনে আওয়াজ দিয়েছিলো তার ইয়াত্তা নেই। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি আসলে মনে মনে অভিজিৎ দাসের কণ্ঠ শোনার অপেক্ষা করছিলাম। 
গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালী জন্মের কালে আতুঁর করে রাসেলের সাথে মাত্র দুই জন মানুষ ছিলেন। যার একজন অভিজিৎ দাস। রাতের পর রাত আমরা বরিশালের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে, শ্মশান, কবর আর মানুষের বাজার ঘেঁটে শেষ অবধি একটু নিস্তব্ধতা খুঁজে নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। 
২০০৭ সালের সেই সংবাদ, আজকের পরিবর্তন।..
সাহিত্যের সংবাদনির্ভর অনলাইন ম্যাগাজিন ‘কালকূট সম্পাদক কবি রাসেল রায়হান যখন অভিজিৎ দাসকে নিয়ে লেখার কথা বললেন, সাথে সাথেই কেন যেন মনে পড়ে গেলো বহু পুরানো এক সংবাদের শিরোনাম - ‘পুলিশী হয়রানীতে দুই সাংস্কৃতিককর্মি’। সে বছর মহাশ্মশানে এক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজ চলছিলো। যেখানে সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন কবি অভিজিৎ, আর তার কাজ দেখতে গিয়েছিলেন - প্রয়াত নির্মাতা রাসেল। রাত তিনটার দিকে তারা যখন বাড়ি ফিরছিলো তখন পুলিশের অসদাচরণের শিকার হন তারা। তাদের সাথে তখন পুলিশের কি বাহাস হয়েছিলো তার বিস্তারিত উল্লেখ ছিলো ওই প্রতিবেদনে। 
ঠিক দশ বছর আগের, ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বরে প্রকাশিত হয় ওই সংবাদ। তখন আমি সাপ্তাহিক ২০০০ -এর বরিশাল প্রতিনিধি, একইসঙ্গে স্থানীয় দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকার প্রতিবেদক। দুটো পত্রিকাই তখন প্রগতিশীল চিন্তাচর্চার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। সময় কত দ্রুতই না বয়ে যায়। ব্যক্তিগত ব্লগে অভিজিৎ দাস নিরুদ্দেশ, না গুম?- শিরোনামে প্রথম লিখেছিলাম ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর। পরের বছর অক্টোবরে লিখেছিলাম ফেরে নাই অভিজিৎ দাস। নতুন পাঠকদের জন্য প্রথম লেখাটির কিয়দাংশ সংযুক্ত করতে চাই।
অভিজিৎ কি তবে তার প্রিয় অগ্রজ বিষ্ণু বিশ্বাসের মতোই স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করলেন? এম্নিতেই বিষ্ণুকে প্রচণ্ড পছন্দ করেন তিনি। তার দুটি কবিতায় সুরও দিয়েছেন। আর বিষ্ণুর মতো তিনিও ডোবেন আজব হ্যালুসিনেশনে। কাছের মানুষেরা তার ভীতিবিহবলতার মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। ১৯৬২’র ২৯ মে ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে জন্মানো বিষ্ণুও হ্যালুসিনেশনে ভীতচকিত হতেন। তিনি দেখতেন একটা সাদা গাড়ী অথবা ছুরি হাতে কেউ একজন তাকে তাড়া করে ফিরছে।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আরো জানিয়ে রাখি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করে ৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বিষ্ণু। কিছুটা বাউন্ডুলে হলেও তার লেখালেখি, আড্ডা - সবই চলছিলো স্বাভাবিক। ছন্দপতন ঘটলো ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায়। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা প্রসূত হিংস্রতা কবিকে বিপর্যস্ত করে মারাত্মকভাবে। করে তোলে আতঙ্কগ্রস্ত। এই আতঙ্ক নিয়েই ১৯৯৩ সালে তিনি উধাও হন। এর প্রায় ১৮ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে তার সন্ধান মেলে।
নিখোঁজ হওয়ার কয়েক বছর আগে অভিজিৎ জানিয়েছিলেন, বরিশালের জাগুয়া গ্রামের যে জমিতে তাদের আদি ভিটা ছিলো তা দখল করে সেখানে ক্লিনিক তৈরী করছেন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। ভেঙে ফেলা হয়েছে তাদের পুরানো বাড়ি-ঘর, পূর্বপুরুষদের সমাধি। কোনো ভাবে এটা ঠেকাতে না পারার কারণে প্রচণ্ড হতাশ ছিলেন কবি। যদিও তার জ্ঞাতিদের কয়েকজন ক্ষতিপূরন বাবদ কিছু নগদার্থও পেয়েছেন।
বয়সে খানিকটা বড় হলেও অভিজিৎ দাসের সাথে আমার অন্তরঙ্গতায় কোনো ঘাটতি নেই সম্ভবত। যে কারণে তার নিপাট নির্লিপ্ত অভিমানের সাথেও আমি পরিচিত। আর এ কারণেই হয়ত ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, অভিমানী কবিকে লাপাত্তা হতে বাধ্য করিনি’তো আমরা; মানে পুঁজিবাদী চমকে মোহাবিষ্ট স্বজন, বন্ধু আর সমাজ? বা সেলফিজমের যমানাই গুম করেনি’তো তাকে? এ জাতীয় নানা শঙ্কার মাঝে দাঁড়িয়েও মনে হয়, বইমেলার আগেই ফিরে আসবেন কবি। সাথে থাকবে তার নতুন কাব্যগ্রন্থ। নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ, ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগণ, মাটির চামচ মুখে এবং করপল্লবসঙ্গিনী, সারাটা আঁধার বেড়াবো মাতাল কুসুম বনে বনে -এর সঙ্গে যুক্ত হবে আরেকটি নাম। শেষ বইটির পুরো কাজটুকু নিজ হাতে করেছিলেন কবি। করিয়েছিলেন প্রচ্ছদও। তিনি লাপাত্তা হওয়ার পরে বইটি প্রকাশ করা হলেও সেখানে কবির করিয়ে যাওয়া প্রচ্ছদটি ব্যবহার করা হয়নি। এ ঘটনায় মনে পড়ে যায় প্রয়াত কবি রকিবুল হক ইবনকে-ও। মূলত তার সাথে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মাদারীপুর সফরে অভিজিৎ যে গানটি বেঁধেছেন তার কথাগুলো; গোঁসাইয়ের কপাল এমন/ফলে সাড়ে তিন মন/দুই মনের বিক্রি শেষে/আধ মন যায় খাজনা দিতে/এক মন যায় পশুপক্ষীর পেটে/ ও ভোলা মন …

অভিজিৎ দাসকে চেনেন না, এমন পাঠকদের জন্য এখানে আরো কিছু তথ্য টুকে রাখা দরকার। আপাদমস্তক এই কবি ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর বাবা এবং তার আগে ২০০৭ সালের ১৬ মে মা’কে হারান। অবশ্য তাদের মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন কাব্যিক উদাসীনতা। সংসারের দিকে তার খেয়াল ছিলো না কোনো। তবে জ্ঞাতসারে কখনো কারো ক্ষতির কারণ হননি আমাদের এই আত্মভোলা বন্ধু । তাই বিশ্বাস করি, তারও ক্ষতির কারণ হবেন না কেউ। যেখানেই আছেন, ভালো আছেন – সুস্থ আছেন কবি। যদিও অযন্ত-অবহেলায় তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব বেশী ভালো নেই মনে হয়। তবুও আশা করতে দোষ কি?

রাসেল আহমেদ ও অভিজিৎ দাস।..
নিখোঁজ হওয়ার আগে দীর্ঘ সময় কবি অভিজিৎ-এর কোনো আয় ছিলো না। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিলো দৈনিক আমাদের সময়। পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে শিল্পপতি নূর আলী ও সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খানের দ্বন্দ্ব চলাকালে ছাঁটাই হওয়া কর্মিদের মধ্যে ছিলেন কবিও। এরপর আর কোথাও কাজ করেননি তিনি। তবে কর্মহীন ছিলেন না কখনো। কবি বা যন্ত্রী বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন সারাদিন। আর যেখানেই নিপীরনের খবর পেয়েছেন, ছুটে গিয়েছেন। খোলা গলায় গান ধরেছেন শোষিতদের পক্ষে - ‘দুধ ভাত শুধু তোমাদের আর আমরা কেবলই পাথর চিবুতে বাধ্য’। শোষকদের বিরুদ্ধে গানই তার শ্লোগান। এমন অজস্র গানের স্রষ্টা তিনি। কয়েক বছর ধরে ছবি আঁকার ভুতটাও মাথায় চেপেছে তার । এঁকেছেন এবং হারিয়েছেন অজস্র ছবি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতালকে সমর্থন জানাতে গিয়ে ২০১১ সালের জুলাইয়ে অভিজিৎ গ্রেফতারও হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে তিনি লাঠিচার্জ ও ধাওয়ার সম্মুখীনও হয়েছেন বহুবার। তবুও রাজপথ ছাড়েননি কখনো। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত - পথেই কাটিয়ে দিয়েছেন। 
অভিজিৎ বলেছিলেন, প্রায় দেড় দশক আগে বরিশালের দৈনিক প্রবাসীতে তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ওস্তাদ ছিলেন সাংবাদিক শওকত মিল্টন। এছাড়াও যদ্দুর জানি অভি বরিশালের দৈনিক আজকের বার্তা, ঢাকার দৈনিক বাংলাদেশ সময়, আর্ট ম্যাগাজিন শিল্পরূপসহ আরো অগণিত পত্রিকায় কাজ করেছেন। বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকাপন ইনিস্টিটিউট (আইআরআই) আর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথেও ছিলেন বেশ দীর্ঘ সময়। ধ্রুবতারা, শূন্য মাতাল, কালনেত্র, কাঠবিড়ালীসহ আরো অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনও বেরিয়েছে তার হাত দিয়ে।


আজকাল মুখবইয়ের নতুন আয়োজন নিত্যই প্রাত্যহিক স্মৃত্মি মনে করিয়ে দেয়। অভিজিৎ দাসের সাথেও যে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তা তিনি এভাবে না লুকোলে হয়ত খেয়ালই করতাম না। তিনি আজ কোথায় যে আছেন, জানতে ইচ্ছে করছে খুব। তিনি ফিরলে কত স্পৃহা ফিরবে আবার; মাঝে মাঝে তা ভাবতেও ভালো লাগে। যদিও পেরিয়ে গেছে বছর, পেরিয়ে যাচ্ছে মাস; তবু ফিরলেন না অভিমানী অভিজিৎ দাস। হারিয়ে যাওয়ার আগের রাতে আগের রাতে ছোট ভাই বিশ্ব ও বড় বোন চৈতালী দাসের সাথেও বেশ ঝগড়া হয়েছিলো অভিজিৎ-এর। তাই পরদিন সকাল থেকেই অভিমানী ভাইকে খোঁজা শুরু করেন তারা। কিন্তু এক দিন, দুই দিন করে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও আর খোঁজ মেলে না জীবনানন্দের শহরে বেড়ে ওঠা এই কবির।
newsreel [সংবাদচিত্র]