সহযোদ্ধা বেষ্টিত বঙ্গবন্ধু |
বহুল আলোচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সুবর্ণ জয়ন্তী আজ। এটি মূলত পাকিস্তান আমলে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনা সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি এই মামলা দায়ের করেছিলো।
মামলার অভিযোগ ছিলো যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা। তবে তা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিতি পায়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিলো বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়। মামলাটি নিষ্পত্তির চার যুগ পর ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘সত্য মামলা আগরতলা’ বইতে ২৬ নম্বর আসামী ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী (পরবর্তীতে কর্ণেল, অব.) এটিকে ‘সত্য মামলা’ বলে দাবি করেন।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণসর্মথন লাভ করে। সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সশস্ত্রবাহিনীর কিছু সংখ্যক বাঙালি অফিসার ও সিপাহি অতি গোপনে সংগঠিত হতে থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা কখনও সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ লক্ষ্যে অতি গোপনে কাজ করে যেতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার কারণে এ ষড়যন্ত্র প্রকাশ পায়। শুরু হয় সরকারের গ্রেফতারি তৎপরতা। আইয়ুব সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী সারা পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার বাঙালিকে গ্রেফতার করে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি এক প্রেসনোটে ঘোষণা করে যে, সরকার ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। এ ঘোষণায় ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ৮ জনের গ্রেফতারের খবর প্রকাশ পায়। এতে অভিযোগ করা হয় যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিলো। স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি অপর এক ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করে। পরবর্তীতে ৯ মে আসামীদেরকে ‘দেশরক্ষা আইন’ থেকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু ‘আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ তাদের পুণরায় গ্রেফতার করে সেন্ট্রাল জেল থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রথমে কোর্ট মার্শাল করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা মনে রেখে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসারদের বেসামরিক আইনে অভিযুক্ত করে। মামলার বিচারের জন্য ফৌজদারি দন্ডবিধি সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ৩৫ জনকে আসামি করে পাকিস্তান দন্ডবিধির ১২১-ক ধারা এবং ১৩১ ধারায় মামলার শুনানি শুরু হয়। মামলায় শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং’ নামে মামলাটি পরিচালিত হয়।
ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে একটি সুরক্ষিত কক্ষে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। মোট ১০০টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। সরকার পক্ষে মামলায় ১১ জন রাজসাক্ষীসহ মোট ২২৭ জন সাক্ষীর তালিকা আদালতে পেশ করা হয়। তন্মধ্যে চার জন রাজসাক্ষীকে সরকার পক্ষ থেকে বৈরী ঘোষণা করা হয়। এর আগে ব্রিটিশ আইনজীবী ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য টমাস উইলিয়াম ১৯৬৮ সালের ৫ আগস্ট শেখ মুজিবের পক্ষে ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন পেশ করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনায় তাঁর সহযোগী ছিলেন আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ। সরকার পক্ষে প্রধান কৌশুলী ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ও অ্যাডভোকেট জেনারেল টিএইচ খান। তিন সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি এসএ রহমান। তিনি ছিলেন অবাঙালি। অপর দুজন এম আর খান ও মুকসুমুল হাকিম ছিলেন বাঙালি। মূলত এই সময় সরকারি নির্দেশে মামলাটিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে আখ্যায়িত হয়। মামলার এ শিরোনামের পেছনে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল; মামলার এ নামকরণ করে শেখ মুজিবকে দেশের জনগণের কাছে ভারতীয় চর ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে জনসমর্থন সরকারের পক্ষে যাবে এবং শেখ মুজিবকে কঠোর সাজা দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সরকারি সাক্ষীরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সরকারের বিপক্ষেই বিষোদ্গার করতে থাকেন। সাক্ষীরা বলেন, সরকার তাদের নির্যাতন করে এ মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছে, অথচ এ মামলা সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। ফলে দেশবাসীর কাছে এটি সরকারের একটি ষড়যন্ত্র হিসাবে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ততোদিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরকারি এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সকল বন্দির মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার পিছু হটতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। সরকার প্রধান হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য হন। এই গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে.. |
ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধু |
ক্রমানুযায়ী সব আসামীর : শেখ মুজিবুর রহমান, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, এলসিডি নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজউল্লাহ, কর্পোলাল মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ. ফজলুল হক, ভূপতিভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধানকৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, প্রাক্তন হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, লেফটেন্যান্ট এ জি মোহাম্মদ খুরশিদ, খান এম শামসুর রহমান সিএসপি, রিসালদার এ কে এম শামসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, এসসি মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, মেজর শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা এএমসি, ক্যাপ্টেন এএনএম নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আব্দুল জলিল, মোহাম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, ফাস্ট লে এম এস এস রহমান, সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ এবং ফাস্ট লেফটেন্যান্ট আব্দুর রউফ।
সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবসহ সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয় |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন