Powered By Blogger
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

০৫ মার্চ ২০২১

সেনারা ব্যারাকে ফিরেছে!

আজ  ৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পঞ্চম দিনের মত হরতাল পালনকালে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় চার শ্রমিক শহীদ হন এবং ২৫ জন শ্রমিক আহত হন। এ সংবাদে ঢাকায় জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যায় সরকারিভাবে ঘোষনা করা হয়, আজ ঢাকায় সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতালের পর ব্যাংক খোলা থাকে। মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদানের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। 

লাহোরে দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড এ ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকেলে করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছোন। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। 

রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশী বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব জনাব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকেলে কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষকবৃন্দ মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ করেন।

ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে লাঠি মিছিল বের হয়।  নিহতদের স্মরণে তারা গায়েবানা জানাজা পড়ে। আওয়ামী লীগ কর্মিরাও লাঠি হাতে বিক্ষোভ করে। 

এগার দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান।

রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পিপলস পার্টির প্রধান জেড. এ. ভুট্টোর আলোচনা বৈঠক শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, তা অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।

০৪ মার্চ ২০২১

ভেঙ্গে পড়ে প্রাদেশিক শাসন

সংগ্রহিত
আজ ৪ মার্চ। একাত্তরের এই দিনে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকা-সহ সারা বাংলায় সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দু্ইটা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ছয় জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে আজ নিয়ে দু’দিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে।
বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার্থ শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রী ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন।
রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে প্রচার শুরু করে। বেতার টেলিভিশন শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বানে সাড়া দেয়ায় তিনি বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান। তিনি ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পান নি, শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
একই দিনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অনতিবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালির অধিকার দাবি করেন।
পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন ঢাকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বান করার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিৃবতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণ-বিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দেশের সংহতির জন্য তাঁর দল যদ্দুর সম্ভব ছয় দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিষ্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবো।’ একই দিন করাচী প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

০৩ মার্চ ২০২১

শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো: বঙ্গবন্ধু

ছবি: সংগ্রহিত
আজ ৩ মার্চ। অগ্নিঝড়া একাত্তরের এই দিনটিও উত্তাল ছিল আন্দোলনে। এটিই ছিল জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার পূর্ব ঘোষিত দিন। কিন্তু এই দিন সমগ্র বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রদেশে) জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দিনের জন্য সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এ সময় দেশের সব শহরের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ও বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর এবং সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়।

রংপুওে এই দিন পাক সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুর আড়াইটা থেকে ২৪ ঘন্টাব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। সিলেটে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকায় কারফিউয়ের মেয়াদ শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ১০ মার্চ ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়, এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। 
ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই দিন বটতলায় জমায়েত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু জনতা তার কাছে তাৎক্ষণিক এবং সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার দাবি জানায়। 

এদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘স্বাধীনতার ইশতাহার’ ঘোষণা করে। ছাত্রনেতা এএসএম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাহজাহান সিরাজের যৌথ নেতৃত্বের এই পরিষদ ইস্তেহারও বিলি করে। ইস্তেহারে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এত দ্বারা ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশ এখন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।’ এতে এর তিনটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ ছিল। এগুলো হচ্ছে বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ, বৈষম্যের নিরসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। একইসঙ্গে এতে আন্দোলনের ধারা হিসেবে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলা হয়।

এর আগে সমাবেশের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বুলেটে আহতদের জীবন রক্ষার জন্য জনগণের প্রতি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলার স্বাধিকার বিরোধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে।

০১ মার্চ ২০২১

ইয়াহিয়ায় ঘোষণায় ঢাকায় প্রতিরোধ

বঙ্গবন্ধু’১৯৭১ / সূত্র: mujib100.gov.bd
বছর ঘুরে আবারো এসেছে বাঙালীর গৌরবজ্জল সংগ্রামের মাস। একাত্তরের এই মার্চে হাজার বছরের ঔপনিবেশিক পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার জোয়ার এনেছিল নদীমাতায়। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো শ্লোগানগুলো ছড়িয়ে পড়েছিলো সারাবাংলায়। কী এক যাদুর পরশে বাংলাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন এক অগ্নিপুরুষ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মাসেই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহওে গ্রেফতার হবার একটু আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন, যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআর -এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। 

ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’

এই ঘোষণাপত্রটি প্রথমে বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেমসহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েক কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান প্রচার করেন। পরে বাঙালি সেনা অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

জিয়ার ভাষ্য ছিল, ‘আমি, মেজর জিয়া। বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

জিয়া আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। 

এর আগে একাত্তরের এই দিনে, অর্থাৎ পহেলা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ হোটেল পূর্বানীর সামনে জমায়েত হয়। সেখানে তখন বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল বৈঠক চলছিল। উত্তেজিত জনতা বঙ্গবন্ধুর কাছে অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানান। তিনি এই এ সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দেন এবং এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। বঙ্গবন্ধু জনতাকে সংযত থাকতে উপদেশ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ঘোষণা দেবেন। 

পরে ১৯৭৩ সালের ১ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জয় লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। 

০৩ জানুয়ারী ২০১৮

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫০ বছর

সহযোদ্ধা বেষ্টিত বঙ্গবন্ধু
বহুল আলোচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সুবর্ণ জয়ন্তী আজ। এটি মূলত পাকিস্তান আমলে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনা সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি এই মামলা দায়ের করেছিলো। 
মামলার অভিযোগ ছিলো যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা। তবে তা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিতি পায়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিলো বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়। মামলাটি নিষ্পত্তির চার যুগ পর ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘সত্য মামলা আগরতলা’ বইতে ২৬ নম্বর আসামী ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী (পরবর্তীতে কর্ণেল, অব.) এটিকে ‘সত্য মামলা’ বলে দাবি করেন। 
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণসর্মথন লাভ করে। সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সশস্ত্রবাহিনীর কিছু সংখ্যক বাঙালি অফিসার ও সিপাহি অতি গোপনে সংগঠিত হতে থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা কখনও সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ লক্ষ্যে অতি গোপনে কাজ করে যেতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার কারণে এ ষড়যন্ত্র প্রকাশ পায়। শুরু হয় সরকারের গ্রেফতারি তৎপরতা। আইয়ুব সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী সারা পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার বাঙালিকে গ্রেফতার করে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি এক প্রেসনোটে ঘোষণা করে যে, সরকার ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। এ ঘোষণায় ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ৮ জনের গ্রেফতারের খবর প্রকাশ পায়। এতে অভিযোগ করা হয় যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিলো। স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি অপর এক ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করে। পরবর্তীতে ৯ মে আসামীদেরকে ‘দেশরক্ষা আইন’ থেকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু ‘আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ তাদের পুণরায় গ্রেফতার করে সেন্ট্রাল জেল থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রথমে কোর্ট মার্শাল করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা মনে রেখে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসারদের বেসামরিক আইনে অভিযুক্ত করে। মামলার বিচারের জন্য ফৌজদারি দন্ডবিধি সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ৩৫ জনকে আসামি করে পাকিস্তান দন্ডবিধির ১২১-ক ধারা এবং ১৩১ ধারায় মামলার শুনানি শুরু হয়। মামলায় শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং’ নামে মামলাটি পরিচালিত হয়। 

ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে একটি সুরক্ষিত কক্ষে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। মোট ১০০টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। সরকার পক্ষে মামলায় ১১ জন রাজসাক্ষীসহ মোট ২২৭ জন সাক্ষীর তালিকা আদালতে পেশ করা হয়। তন্মধ্যে চার জন রাজসাক্ষীকে সরকার পক্ষ থেকে বৈরী ঘোষণা করা হয়। এর আগে ব্রিটিশ আইনজীবী ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য টমাস উইলিয়াম ১৯৬৮ সালের ৫ আগস্ট শেখ মুজিবের পক্ষে ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন পেশ করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনায় তাঁর সহযোগী ছিলেন আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ। সরকার পক্ষে প্রধান কৌশুলী ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ও অ্যাডভোকেট জেনারেল টিএইচ খান। তিন সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি এসএ রহমান। তিনি ছিলেন অবাঙালি। অপর দুজন এম আর খান ও মুকসুমুল হাকিম ছিলেন বাঙালি। মূলত এই সময় সরকারি নির্দেশে মামলাটিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে আখ্যায়িত হয়। মামলার এ শিরোনামের পেছনে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল; মামলার এ নামকরণ করে শেখ মুজিবকে দেশের জনগণের কাছে ভারতীয় চর ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে জনসমর্থন সরকারের পক্ষে যাবে এবং শেখ মুজিবকে কঠোর সাজা দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সরকারি সাক্ষীরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সরকারের বিপক্ষেই বিষোদ্গার করতে থাকেন। সাক্ষীরা বলেন, সরকার তাদের নির্যাতন করে এ মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছে, অথচ এ মামলা সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। ফলে দেশবাসীর কাছে এটি সরকারের একটি ষড়যন্ত্র হিসাবে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ততোদিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরকারি এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সকল বন্দির মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার পিছু হটতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। সরকার প্রধান হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য হন। এই গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। 

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে..
এসব কারণে ঐতিহাসিকরা এই মামলা এবং মামলা থেকে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে প্রেরণাদানকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা বলে গণ্য করে থাকেন। এমনি উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ঢাকা সেনানিবাসে মামলার ১৭ নম্বর আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুদ্ধ জনতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনসহ বেশকিছু সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় অতিথি ভবনে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এস এ রহমান ও সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদের অবস্থান করতেন। তারা উভয়েই পালিয়ে যান এবং সেখানে মামলার কিছু নথিপত্র পুড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবসহ সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবর রহমানসহ মামলায় অভিযুক্তদের এক গণসম্বর্ধনা দেয়া হয় এবং শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। 

ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধু
মামলা প্রত্যাহারের পরও সরকারের রোষানলে ছিলেন অভিযুক্তরা পরেও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোরে মামলার দুই নম্বর আসামী নৌ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী । সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী সংসদেও ঘোষণা করেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঘটনা পুরোপুরি সত্য ছিলো। তার ‘সত্য মামলা আগরতলা’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি বলেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যাঁরা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম, ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি তাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেব, তাদের বন্দী করব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করব।” শওকত তার বইতে আরো জানান, ১৯৬১ সাল থেকেই কতিপয় দেশ প্রেমিক বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অফিসার বাংলাদেশকে সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীন করার জন্য রীতিমত গোপন সংস্থা তৈরির কাজ হাতে নিয়েছিলো।

ক্রমানুযায়ী সব আসামীর : শেখ মুজিবুর রহমান, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, এলসিডি নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজউল্লাহ, কর্পোলাল মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ. ফজলুল হক, ভূপতিভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধানকৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, প্রাক্তন হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, লেফটেন্যান্ট এ জি মোহাম্মদ খুরশিদ, খান এম শামসুর রহমান সিএসপি, রিসালদার এ কে এম শামসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, এসসি মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, মেজর শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা এএমসি, ক্যাপ্টেন এএনএম নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আব্দুল জলিল, মোহাম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, ফাস্ট লে এম এস এস রহমান, সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ এবং ফাস্ট লেফটেন্যান্ট আব্দুর রউফ।

সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবসহ সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়

০২ জানুয়ারী ২০১৮

স্মরণে সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার
সিরাজ সিকদার নিহত হয়েছেন। আজ থেকে ঠিক ৪৩ বছর আগের এই দিনে, অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি সরকারি এক প্রেসনোটে এভাবেই এ বামপন্থী বিপ্লবী নেতার মৃত্যুর খবর দিয়েছিলো রাষ্ট্র। এ ঘটনার ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জুন এই বিষয়ে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়, যা ২৫ বছর ধরে ঝুলে আছে। তবে এত দিনেও মানুষের মন থেকে বিস্মৃত হননি সিরাজ। আজও বিভিন্ন আলোচনায় সগৌবরবে তার নাম উচ্চারিত হয়। বিশেষত রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবেই তার কথা চলে আসে। 

সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হন ১৯৭৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তিনি ধরা পড়েছিলেন পুলিশের হাতে। পরে রক্ষী বাহিনীর হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে ৯২ সালে যে মামলা দায়ের করেন সেখানে মোট ৭ জনকে আসামী করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন বর্তমান সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিম। অন্যান্য আসামিরা হলেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, সাবেক পুলিশ প্রধান আইজিপি ই এ চৌধুরী এবং সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান। 

বিএনপির শাসনামলে দায়ের করা ওই মামলার আর্জিতে বলা হয়, ‘আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) সহচর ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং আসামিরা আসামি তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন। তারা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার ও হত্যার ঘটনা বর্ণনায় আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উল্লেখিত আসামিরা তাঁদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ই এ চৌধুরীর একজন নিকটাত্মীয়কেও চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করে ওই দিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দিদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় মামলার এক নম্বর আসামি এসপি মাহবুব তার রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই ওই সময় সিরাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এরপর শেখ মুজিব, মনসুর আলীসহ দুই জন অভিযুক্ত সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এসপি মাহবুবকে নির্দেশ দেন। তিনি ও অন্য আসামীরা বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। এরপর তার ওপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে এসপি মাহবুবের সাথে থাকা বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায়। সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ সালের ১১ জুলাই ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ নামের একটি বই প্রকাশিত হয়। এটি লিখেছেন আনোয়ার উল আলম। তিনি ছিলেন রক্ষী বাহিনীর একজন উপ পরিচালক। এই বইতে বলা হয়- ‘আসলে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কিছুটা নারীঘটিত কারণে সিরাজ সিকদার ধরা পড়েন।’ এর আগে একাত্তরে পর সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “পূর্ব বাংলার বীর জনগণ, আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান”। এ সময় তিনি একটি রাজনৈতিক দলিল হাজির করেন। যেখানে আওয়ামীলীগকে জাতীয় বিশ্বাস ঘাতক ও বেঈমান হিসেবে উল্লেখ করে তাদেরকে ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৬ ডিসেম্বরকে কালো দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। সিরাজের আহবানে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের এই দিনে দেশব্যাপী হরতাল পালন করার কালে মাওলানা ভাসানীও বিবৃতি দিয়ে তা সমর্থন করেছিলেন। সবমিলিয়ে শেখ মুজিবকে তখন বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিলো সিরাজ সিকদার ও তার সর্বহারা পার্টি। তাকে হত্যার তার বোন ভাস্কর শামীম সিকদার বেশ কয়েকবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। 

সিরাজ সিকদারের পিতার নাম আবদুর রাজ্জাক সিকদার। তিনি ১৯৫৯ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (বর্তমান এসএসসি) পাশ করেন। এরপর ১৯৬১ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রকৌশলবিদ্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন । ছাত্র অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত তিনি ১৯৬৫ সালে মিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির কংগ্রেসে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি সরকারের নির্মাণ (সিঅ্যান্ডবি) বিভাগের কনিষ্ঠ প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন। মাত্র তিন মাসের মাথায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে টেকনাফের ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি বেসরকারী কোম্পানীতে যোগদান করেন। 

সিরাজ সিকদার ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে উপস্থিত করেন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের এক খসড়া থিসিস। এই থিসিসে তিনি পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বলে অভিহিত করেন। একই বছরের শেষের দিকে তিনি ঢাকা শহরে মাও সেতুং গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। আইয়ুব সরকার এটি পরবর্তীকালে বন্ধ করে দেয়। মওদুদীর জামায়াতে ইসলামীও প্রথম থেকে তাদের বিরোধীতা করে আসছিলো। এরপর ১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা ওড়ায়। পরে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এর চার নম্বর দফাটি ছিল, ‘পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ বা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করেন।’ পরে ৩০ এপ্রিল তিনি বরিশালের সরূপকাঠীর পেয়ারাবাগানে গড়ে তোলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী। এরপর ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি। ওই কংগ্রেসে সিরাজ সিকদারকে সভাপতি করে একটি অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়।

০৫ জানুয়ারী ২০১৭

পিতার অতৃপ্ত আত্মার কান্না থামে না


‘যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমার দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, এখানে বসে কেউ যদি তার বীজ বপন করতে চান তাহলে তা কি আপনারা সহ্য করবেন?’ প্রশ্নটা ১৯৭৪ -এর মার্চের, যা আজও অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক। কারণ প্রশ্নকর্তা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় এই ২০১৭ -এর জানুয়ারিতেও সংখ্যালঘুর উপাসনালয় আক্রান্ত হয়। অথচ সেই ৭৩-এ তিনি বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে।ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ।মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে।হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে।কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।’ অথচ বাঙলায় আজও কত কী ঘটে যায়। হায়, পিতার অতৃপ্ত আত্মার কান্না থামে না।

আক্রান্ত মন্দিরের চিত্রগুলো বাংলা ট্রিবিউন থেকে নেয়া। দুর্বৃত্তরা গ্রিল ভেঙে মন্দিরে প্রবেশ করে দুর্গা মন্দির, হরি মন্দির ও রাধা গোবিন্দ মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর করে। পরে তারা মন্দিরে অগ্নি সংযোগ করে। 
newsreel [সংবাদচিত্র]