Powered By Blogger
বাংলাদেশ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বাংলাদেশ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১০ জানুয়ারী ২০২১

দীনেশ দাসকে মনে পড়ে

দেখতে দেখতে নয়টি বছর হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকার কাকরাইল মোড়ে বাস চাপায় নিহত হন সাংবাদিক দীনেশ দাস। ফেসবুকের ফিরে দেখা কর্মসূচীর কল্যাণে আজ ফের মনে এলো সেই সময়টা। যেখানে নিজের বৃত্তান্তে নিজের সম্পর্কে দাদা লিখে রেখেছিলেন, ‘আই অ্যাম রোমান্টিক পারসন।’ তাঁর মৃত্যুর চারদিন পর ‘নিশ্চিন্ত দীনেশদা’ শিরোনামে লিখেছিলাম -
হয়ত মৃত্যুই দীনেশদাকে নিশ্চিন্ত করেছে। তবে তিনি আদৌ তৃপ্ত হবেন কি? অর্থ সংকটে পরিবারের ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রীক যত উদ্বিগ্নতা তাকে মৃত্যুর পূর্ব-মুহুর্ত পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে; তা থেকে কি তিনি এভাবে মুক্ত হতে চেয়েছেন? এত শুভাকাঙ্খী, এত পরিচিত জন। কেউ কি তাকে একটি চাকরি দিতে পারতেন না? একজন সৎ সংবাদকর্মির ২৫ বছরের অভিজ্ঞতার কি কোনো মূল্যই ছিলো না? অথচ এখন তাঁর মৃত্যু কত মূল্যবান হয়ে গেল। সরকার দীনেশদার পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বৌদিকে একটি চাকরি দেয়ার পাশাপাশি তার মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্বও নিয়েছে। আবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমনকি জামায়াত নেতারাও টাকা দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ইতিমধ্যেই টাকা দিয়েছেন। অথচ শেষ কটা দিন কী অর্থ কষ্টেই না তাঁর কেটেছে। সদাহাস্যোজ্জল শিশুমনা মানুষটার মুখে হাসিও দেখিনি কত দিন। এখন হয়ত তিনি সবই দেখছেন। আর বৌদির কাছে গিয়ে বলছেন, 'বলেছিলাম না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অথৈর পড়াশুনা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।'
তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর দিনটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় লেখক ও সাংবাদিক মাহফুজ জুয়েল বলেছিলেন, “চোখে পড়ার মতো মেঠো-বিচরণ ছিলো দিনেশদার। একসময় যেখানেই যেতাম সেখানেই তাঁকে দেখতে পেতাম! মাঠে-ঘাটে দেখতে দেখতেই পরিচয়। তারপর টুকটাক গল্প হয় রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে, কর্মসূচিতে, পল্টনে, প্রেসক্লাবে, মুক্তাঙ্গনে, মুক্তিভবনে, বামপন্থীদের সংবাদসন্ধানী সাংবাদিক; শ্যামসুন্দর মায়াময় নিরীহ মুখের দিনেশদা। মনে পড়িয়ে মন খারাপ করে দিলে।আহা, দিনেশদা।” আরো দুই বছর পর কবি ও সাংবাদিক রুদ্রাক্ষ রহমান লিখেছিলেন, “দীনেশ আমার তুই-তুইবন্ধু ছিলো। আমরা অনেকটা সময় এই শহরে ভাতের জন্য হেঁটেছি। সাক্ষী আশিস সৈকত! এবং আমরা এতোটাই ব্যর্থমানুষ যে দীনেশের জন্য কিছুই করতে পারিনি! অতএব ওর কাছে ক্ষমা চাই, বার বার।”
পলিটিক্যাল রিপোর্টিং, মূলত ইসলামি ও বামদলগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল দাদার সাথে। তিনি ছাড়াও শ্রদ্ধেয় সেলিম জাহিদ,  ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ, রাশিদুল হাসান রাশেদ, বন্ধুপ্রতীম রাজীব আহমদ তখন ওই অঙ্গনের ডাকসাইটে প্রতিবেদক। দাদার সাথে আমার চেয়ে ঢের বেশী স্মৃতি আছে ওই তিনজনের। তবুও আজ এখানে ফের টুকে রাখছি নয় বছর আগের লেখাটির কিয়দাংশ। 

সত্যি কথা বলতে কি, দীনেশ'দা মারা যাওয়ার আগে নিজেও কখনো বুঝিনি যে তাকে কতটা ভালোবাসি। হয়ত আমার মত আরো অনেক সহকর্মিই তা বুঝতে পারেননি। গত বছরে (২০১১ সালে)বন্ধ হয়ে যাওয়া শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজে কাজ শুরুর সময়ে ‘পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার’ ছিলাম। আমাকে জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ বাম ও ইসলামী মিলিয়ে ৩৭টি দলের খবর রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরই বদৌলতে ওই সরল প্রাণ মানুষটির সাথে আমার পরিচয় হয়। জামায়াত-শিবিরের অফিস, মুক্তাঙ্গন, পল্টন, মুফতী আমিনীর ডেরা থেকে শুরু করে কমিউনিষ্ট পার্টির অফিস। কত জায়গায়ই না এক সাথে কত সময় কেটেছে। এরপরও ওই বিটে যতদিন ছিলাম তা ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে প্রথম দিনেই আপন করে নেয়ার গুনটি দাদার মাঝে বেশ ভালো মত ছিল। আর তাঁর রসিক চরিত্রের সচ্ছতায় মুগ্ধ না হওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক। যে কারণে ‘পার্লামেন্ট রিপোর্টিং’ শুরু করার পরও দাদার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি কখনো। ফেসবুকে খুব একটা সক্রিয় না হলেও তাঁর ইয়াহু মেইলটি প্রায় নিয়মিতই খোলা থাকত। মাঝেই মাঝেই ‘চ্যাটবক্সে’ হাজির হতেন দাদা। খুব বেশী সময়ের জন্য না হলেও বেশ জমজমাট আলাপ হতো। অবশ্য গত দেড়-দুই মাস ধরে সেখানও অনিয়মিত ছিলেন তিনি। হয়ত  দৈনিক আমাদের সময় থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর আর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগটাই পাননি। আসলে দীনেশ'দার বহুপুরানো সহকর্মী সালাম ফারুক ভাইয়ের একটি লেখা শেয়ার করার জন্য বসেছিলাম; কিন্তু নিজেই কত কিছু বলে ফেললাম। আর শুধু একটি কথাই বলি। এখন বুঝি, দাদাকে অনেক ভালোবাসি।

চাকরির টেনশনমুক্ত দীনেশদা’ শিরোনামে একটি অনলাইনে লিখেছিলেন ফারুক ভাই; যা হুবুহু তুলে দিচ্ছি -
মৃত্যুর মাত্র ১৪ ঘণ্টা আগে শনিবার রাত সাতটায় ঘনিষ্ঠজন, কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার আজিজুল পারভেজকে বলেছিলেন, 'পকেটে মাত্র ২০ টাকা আছে।' রোববার সকালে মাটির ব্যাংক ভেঙে জমানো টাকা থেকে ১০০ টাকা হাতে দিয়েছিলেন স্ত্রী। জানা গেছে তিন মাসের বাড়িভাড়াও বাকি। ২৫ বছরের সাংবাদিকতার জীবনের এই পর্যায়ে এসে এমন হালেই দিন কাটছিল তাঁর। তিনি দৈনিক আমাদের সময় থেকে 'অন্যায়ভাবে' সদ্য চাকরিচ্যুত হওয়া দীনেশ দাশ, আমার দীনেশদা। এখন আর তার সেই টাকার চিন্তা নেই, নেই বাড়িভাড়ার টেনশন, জমানো টাকা থেকে তাকে দিনের খরচ দিতে হবে না বৌদির। সাংবাদিকতা করে অর্জন করা একমাত্র সম্বল মোটরসাইকেলটি নিয়ে তাকে আর ঘুরতে হবে না কাজের খোঁজে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) গত নির্বাচনের আগের রাতে তার মোটারসাইকেলে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'দাদা, পাওনা টাকাগুলো আমাদের সময় পে (পরিশোধ) করেছে কি-না।' জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'না, টাকা-পয়সা তো কিছু দিলো না। তবে আমাদের সময় থেকে লোন নিয়ে হলেও এ মোটরসাইকেলটাই এখন আমার একমাত্র সম্বল।' সেই একমাত্র সম্বলটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। রোববার সকালে একমাত্র মেয়ে অথৈকে ভিকারুননিসা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ডিআরইউ’র দিকে যাওয়ার পথেই বাসের চাপায় নিভে গেল তার প্রাণপ্রদীপ। তার আর যাওয়া হলো না প্রিয় প্রাঙ্গণটিতে।

গত বছর আমি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর থেকে অমর একুশে বইমেলা কাভার করেছিলাম। দাদার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কালের কণ্ঠের আজিজুল পারভেজ ভাই, সমকালের মুন্না ভাই আর আমি ছিলাম নিয়মিত। তাই কখনো আসতে দেরি হলে দাদা ফোন করে বলে দিতেন, তার জন্যও যেন বইয়ের কাভার, বই ইত্যাদি কালেক্ট করে নিই। আমরা তা করতাম। মাঝেমধ্যে দাদার মোটারসাইকেলে চড়ে ফিরতাম অফিসে। আর মাত্র ২৩ দিন পরই শুরু হবে এবারের বইমেলা। দাদাকে ছাড়া বইমেলা- এখনই বিশ্বাস হতে চাইছে না। আমাদের সময়ে দীর্ঘ সময় কাজ করার সুবাদে দীনেশদা’র সান্নিধ্য পেয়েছিলাম খুব ভালোভাবেই।

শুরুতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে খানিকটা দুর্বল দাদাকে প্রায়ই সাহায্য করতে হতো আমার। ক’দিন আগেও ফেসবুকে দাদার আইডি নিয়ে একটি জটিলতার সমাধান করে দিয়েছিলাম। দাদার স্নেহমিশ্রিত আবদারে কখনোই বিরক্ত হতাম না। ঠাট্টা-মশকরা করতে করতেই তার কাজটুকু করে দিতাম। ডিআরইউ’র মিডিয়া সেন্টারে বসে দাদার সেইসব আবদার আর পূরণ করতে হবে না। বয়সে ১০/১২ বছরের বড় হতে পারেন। কিন্তু কথাবার্তা, আচার-আচরণ কোনো দিক থেকেই সেই পার্থক্য বুঝতে দিতেন না দীনেশদা। নানান ঢঙের টিটকারি, দুষ্টুমি সবই চলত তার সঙ্গে। যেন বাল্যকালের বন্ধু।

জ্ঞানপিপাসু দীনেশ দাশের সংগ্রহে ছিল দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দলিলের অনুলিপি। সামান্য বেতনে চাকরি করেও খুঁজে খুঁজে এসব যোগাড় করতেন তিনি। অনুকরণীয় চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের স্মৃতি ধরে রাখতে তিনি গঠন করেছিলেন মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ। প্রতি বছর এ সংসদ থেকে সেরা রিপোর্টার বাছাই করে পুরস্কৃত করা হতো। সর্বশেষ আয়োজনটি ছিল গত ২৯ ডিসেম্বর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতেন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সংবাদ সংগ্রহে। নিজ ধর্মের প্রতি প্রবল ঝোঁকও অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটিকে দায়িত্ব থেকে টলাতে পারেনি। ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাই তার হয়ে উঠেছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আর তাই অনেকেই মজা করে তার নাম উচ্চারণের সময় আগে ‘মাওলানা’ শব্দটি জুড়ে দিতেন।

আমি আমাদের সময় ছেড়েছি বছর তিনেক আগে। কিন্তু গুটি কয়েক সমবয়সী সহকর্মীর মতো দীনেশদা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বিলীন হয়ে যায়নি। একবার বৌদি’র অসুস্থতায় রক্তের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন আমাকেই। ছুটে গিয়েছিলাম। সব সেরে রাতে ফিরেছিলাম দুইটায়। সেই থেকে দাদার স্নেহের মাত্রা যেনে বেড়ে গিয়েছিল অনেক। 

কিছুদিন আগে আমরা সহকর্মী বন্ধু বেলাল হোসেনকে হারালাম, নিখিল ভদ্রকে পঙ্গু হতে দেখলাম। আর এবার হারালাম শান্ত-নিরীহ, বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ বন্ধুজন দীনেশদাকে। ভুয়া লাইসেন্সেধারী অদক্ষ ও বেপরোয়া বাসচালকদের হাতে আর কতো সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ খুন হলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়বে? আর কতো প্রাণহানি ঘটলে বিআরটিএ তার দায়িত্ব পালনে সচেতন হবে?

০৮ নভেম্বর ২০২০

ফের বিষবাষ্পে ভারী বাংলার বাতাস

"জিহাদ জিহাদ জিহাদ চাই, জিহাদ করে বাঁচতে চাই; বিন খালিদের (সম্ভবত মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদকে বোঝানো হচ্ছে) হাতিয়ার/বীর শহীদের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার," এমন নানা শ্লোগান তুলে সেদিন একপক্ষকে 'মূর্তি ভাঙ্গার আন্দোলন' ঘোষণা করতে দেখেছি। যার রেশ না কাটতেই বীরদর্পে প্রতিপক্ষের গালে জুতা মারার বাসনা জানান দিয়ে আরেকপক্ষকে আজ বলতে শুনছি, "জ্বালোরে জ্বালো, আগুন জ্বালো; কুরুক্ষেত্রের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।" ধর্মযুদ্ধের এই দামামা বাংলায় ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোর ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ফের ভারী হয়ে উঠছে বাংলার বাতাস। একদিকে “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার,” অন্যদিকে "জয় শ্রী রাম, জয় জয় শ্রীরাম;" ধ্বনি তুলে বিদ্বেষপূর্ণ আচারণকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার আদি চেষ্টাও চলছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে রাষ্ট্রকে এখনই সতর্ক হতে হবে। একইসঙ্গে সাধারণ মুসলমান ও হিন্দুদের মনে রাখতে হবে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ারও হাজার বছর আগে থেকে পারস্পরিক সহাবস্থানে অভ্যস্ত এই ভূমির নানা মত ও পথের মানুষ। তাদের উদার নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো যতগুলো ঘটনা এখানে ঘটেছে, প্রত্যেকটিতে এমন কেউ লাভবান হয়েছে, যারা এই ভূমির কেউ নন। ধর্মপ্রাণ বাঙালীর ভাবাবেগকে পুঁজি করে এই মুহুর্তে কে বা কারা লাভবান হতে চাইছে, সেদিকেও খেয়াল রাখুন; খুব খেয়াল।

২৮ এপ্রিল ২০২০

গণমাধ্যম: বিনিয়োগের চরিত্র বিশ্লেষণ

কয়েকজন বাংলাদেশি সংবাদকর্মী।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের করোনাকালীন সংকট বিষয়ক সাম্প্রতিক আলোচনায় রাষ্ট্রের অসহযোগীতা, সাংবাদিকদের অনৈক্যসহ আরো নানা বিষয় আলোচনায় আসছে। ঘাঁটতে গিয়ে মনে হলো, এক্ষেত্রে বিনিয়োগের চরিত্র বা মালিকদের স্বভাব বিশ্লেষণ সবচেয়ে জরুরী।

প্রবীণ সাংবাদিক আফসান চৌধুরীর মতে, দেশের গণমাধ্যমের বেশিরভাগ মালিকই এদিক সেদিক করে পয়সা বানায়, সরকারের সাথে খাতির করে। তাদের সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক নেই। স্রেফ ইজ্জত বাড়াতে বা নানা উপায়ে অর্জিত সম্পদ নিরাপদে রাখার জন্য গণমাধ্যম চালু রাখে। 
“তারা গণমাধ্যম দিয়ে মুনাফা করতে চান না, বরং সেখানে উপরি আয়টা ব্যবহার করতে চান। সেই আয় কমে গেলে তারা আর এটা টানতে আগ্রহী হন না। মালিকের দুইশ কোটি টাকা থাকলেও তখন তিনি বেতন দেবেন না। এটা আমাদের গণমাধ্যমের কাঠামোগত সমস্যা,” বলেন আফসান চৌধুরী। 
ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খণ্ডকালীন শিক্ষকের দাবি, “স্রেফ ক্ষমতাচর্চার জন্য এত গণমাধ্যম চালু রাখার বিপদটা কী হতে পারে এবার তারই বড় একটি প্রমাণ পেলাম আমরা। মূলত এ কারণেই করোনাভাইরাস জনিত সঙ্কটের প্রথম ধাক্কাতেই আক্রান্ত গণমাধ্যম।” 

এ ব্যাপারে গণমাধ্যম বিশ্লেষক খন্দকার আলী আর রাজি বলেন, “করোনা না এলেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য এই পরিণতি এড়ানো কঠিন ছিল। কারণ মানুষের সংবাদ কেনার সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে এগুলো গড়ে ওঠেনি। আবার যে ধরনের সংবাদের জন্য মানুষ মূল্য দিতে রাজি, সে ধরনের সংবাদ পরিবেশন করে না তারা।” 

“ভোক্তার চাহিদার সাথে সম্পর্কহীন সংবাদমাধ্যম যে টিকে থাকার কথা না তা এ মুহূর্তে কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদিও ইতিহাস বলে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারকে বিবিধ সেবা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব একভাবে রক্ষা করে চলবে,” যোগ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক।

সম্পর্কিত পোস্টঃ

২৭ এপ্রিল ২০২০

করোনা কালের সাংবাদিকতা

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) পরিচ্ছন্নতা 
কর্মী সুফিয়া বেগম; কাজ শেষে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে 
ফুটপাতে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কোভিড-১৯ সামলাতে 
সরকার ঘোষিত বাধ্যতামূলক ছুটির কালেও প্রতিদিন জঞ্জাল 
পরিস্কার করতে বের হয়েছেন। যদিও সাথে থাকা ব্যাগে 
ডিএনসিসির ‘ইউনিফর্ম’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। 
ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই কী তা জানেন-ই 
না তিনি। ছবিটির ঢাকার এক সাংবাদিকের তোলা। 
চাকরি আর বেতনের অনিশ্চয়তা গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের, মানে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের। যদিও বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কায় এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এর সাথে নতুনতর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি-তো আছেই। তবে ইদানীং সবচেয়ে ভয়াবহভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষমতাধরদের রোষানল। যে কারণে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। 

এই মহামারীর কালে দেশের প্রথম সাঁড়ির অনলাইন পোর্টাল বিডি নিউজের প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী এবং জাগো নিউজের সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মহিউদ্দিন সরকারসহ মোট আটজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি। 

সংগঠনটির দাবি, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে দুর্নীতি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষনা থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকরা যখন এমন দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন কিংবা প্রকাশের জন্য অনুসন্ধান করছেন, তখন তারা নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাসহ নানারকম হয়রানি, শারীরিক হামলা, ভয়ভীতি-হুমকি এবং হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। 

“মামলাগুলো অবিলম্বে তুলে নেয়ার আহবান জানিয়েছি আমরা। আমাদের দাবি নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে সরকার তাঁদের (সাংবাদিকদের) হয়রানি বা গ্রেফতার করা থেকে বিরত থাকবে,” বলা হয় বিবৃতিতে। 

এর আগে ২১ এপ্রিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের পক্ষে দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম এক বিবৃতিতে বলেন, “করোনাভাইসের মহামারি মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম যখন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের হয়রানি ও ভয় দেখানোর চেষ্টা অত্যন্ত দুঃখজনক।” 

একইদিন প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স (ডব্লিউপিএফআই), তথা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের একধাপ অবনতি হয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ১৫১ তম। টানা ছয় বছর এই অবস্থান ১৪৪ থেকে ১৪৬-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করার পর গত বছর এক ধাক্কায় চার ধাপ নেমে ১৫০ হয়েছিল। 

এ নিয়ে আলাপের জন্য যোগাযোগ করা হলে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান জানান, তিনি এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। সূচকের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরএফএস যা বলেছে, তা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য চাওয়া হলে বেনারকে তিনি বলেন, “পরে আমি এ সম্পর্কে মন্তব্য করব।” পরবর্তীতে পুনরায় যোগাযোগের পর তিনি এনিয়ে কথা বলতেই অস্বীকৃতি জানান। 

সূচকের বিশ্লেষণে আরএফএস বলেছে, ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রহণ করা কঠোরতর নীতির অন্যতম প্রধান ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে সাংবাদিকরা রয়েছেন। মাঠ পর্যায়ে সংবাদকর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ এবং সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বিচারিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে নির্বাহীরা। এই আইনে নেতিবাচক প্রচারণার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড। ফলস্বরূপ, স্ব-সেন্সরশিপ অভূতপূর্ব স্তরে পৌঁছেছে কারণ সম্পাদকরা কারাবন্দি বা তাদের মিডিয়া আউটলেট বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিতে নারাজ। এছাড়া যেসব সাংবাদিক এবং ব্লগাররা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ মত ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চান তারা উগ্রবাদী ইসলামপন্থীদের হয়রানি, এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছে। 

সার্বিক সূচক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আরএসএফ মহাসচিব ক্রিস্টোফ ডিলোয়ার বলেন, “আমরা সাংবাদিকতার জন্য এমন একটি অবধারিত দশকে প্রবেশ করছি, যা এর ভবিষ্যতের ওপর প্রভাবসঞ্চারী সঙ্কটের সাথে যুক্ত। করোনাভাইরাস মহামারীটি নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার অধিকারকে হুমকীতে ফেলা নেতিবাচক কারণগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং এটি নিজেই একটি উদ্বেগের কারণ। ২০৩০ সালে তথ্য, বহুত্ববাদ এবং নির্ভরযোগ্যতার স্বাধীনতা কেমন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আজেই নির্ধারিত হচ্ছে।” 

ঠিক তখনই এই সূচকটি প্রকাশিত হলো যখন করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কাতেই নজিরবিহীন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে দেশের সংবাদ শিল্প ও সাংবাদিকরা। কয়েকদিন আগে ঢাকার মূলধারার বেশ কিছু জাতীয় দৈনিকের মুদ্রণ বন্ধের ঘটনাসহ শীর্ষস্থানীয়পত্রিকাগুলোর কলেবর আর প্রচার কমিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলাম। ততোদিনে সরকারের কাছে সাংবাদিকদের জন্য প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে। তখনই জেনেছিলাম, আয় সঙ্কটে সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন নিয়েও জটিলতাতৈরী হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। বাড়ছে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র বিতরণকারীদের বেকারত্ব। 

“আমার ৪৭ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে এমন পরিস্থিতি কখনও দেখিনি। যেসব জায়গায় আমি লেখি, কেউই গত তিন মাসে পয়সা দিতে পারেনি। অনেক নামিদামি পত্রিকাও লেখক সম্মাণী দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু গণমাধ্যম হয়ত বন্ধই হয়ে যাবে,” বলেছিলেন ৬৮ বছর বয়সী বাংলাদেশি গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। তাঁর মতে, “এটা শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়, বেসরকারি খাতের সকল পেশার ক্ষেত্রে হচ্ছে। এই ধরণের পরিস্থিতি কেউ কোনোদিন পড়েনি। এবারের সঙ্কটটা সবার। তবে আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে এটা আরো তীব্র, কারণ এগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিকে সাংঘাতিক রকম ভর্তুকি দিয়ে চালানো হয়।”
  
এসব নিয়ে আরও লিখতে হবে, মানে লিখবো নিশ্চয়।। আজ শুধু সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা টুকে রাখছি।
২৩ এপ্রিল : নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জে চাল আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য আনতে গেলে হামলার শিকার হন এসএ টিভির প্রতিনিধি সজল ভূঁইয়া।ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ কার্যালয়ের সামনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খানের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়।  
২১ এপ্রিল : প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সে নাম উল্লেখ না করায় ব্যবসায়ী নেতার বিরুদ্ধে সাংসদপন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় নরসিংদীর স্থানীয় নিউজ পোর্টাল সময়নিউজ ডটকমের সম্পাদক হৃদয় খান ও প্রকাশক শফিকুল ইসলাম মতির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এই দুই সাংবাদিক সম্পর্কে বাবা-ছেলে। হৃদয় খান বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ ‍টুয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছেন।  
একইদিন ঠাকুরগাঁওয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজ টোয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ লিটুকে পৌর শহরের দুরামারী নামক স্থানে সদর থানার টহল পুলিশ মারধর করে। এছাড়া সিলেটের জৈন্তাপুরে সারীঘাটে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক রোগীর সংবাদ প্রকাশের জেরে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি রেজওয়ান করিম সাব্বিরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।  
১৯ এপ্রিল : গলাচিপা পৌর এলাকার কয়েকজন ছেলে কাঁটাখালী বাজার আওয়ামী লীগ অফিসে যুবলীগ সভাপতি রিয়াজ খলিফার পুলিশের ওপর হামলা চালানোর ছবি তুলতে গেলে এতে মাই টিভি ও এশিয়ান টিভির প্রতিনিধিকে মারধর করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।  
১৮ এপ্রিল : চাল চুরির সংবাদ প্রকাশের জেরে অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ ও জাগোনিউজের সম্পাদকসহ চারজনের বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি থানায় মামলা দায়ের করেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম ভাসানী। এজাহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ারও অভিযোগ আনা হয়েছে।  
একইদিন সাভারে মারধারের শিকার হন দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার প্রতিনিধি ওমর ফারুক, শরীয়তপুরে অনলাইন জয়যাত্রা টিভি ও অগ্রযাত্রা পত্রিকার জেলা প্র‌তি‌নি‌ধি মহসিন রেজা ও দৈ‌নিক আমা‌দের কন্ঠ পত্রিকার সোহাগ খান সুজন এবং বরিশালে বাংলাভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান কামাল হাওলাদার।  
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার নঈম মিয়ার বাজারে ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদদাতা এম শাহীন আল আমীন ছবি তুলতে গেলে পৌর মেয়রের লোকজন মারধর করে তাঁর ক্যামেরাও ছিনিয়ে নেয়। তবে পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম সওদাগর মারধরের বিষয়ে অস্বীকার করে বলেন, “ছবি তুলতে নিষেধ করার পরও তিনি ছবি তুলেছিলেন। তাই ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।” 
এছাড়া এই দিন সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করায় দৈনিক যুগান্তরের সাভার প্রতিনিধি মতিউর রহমান ভান্ডারিকে ফোনে হুমকি দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব। তিনি সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। সাংবাদিককে শাসিয়ে বলেন, “তোমার পেছনে আজকে থেকে মনে করবা আবার অন্য ধরনের কিছু সাংবাদিক ঘুরবে। তোমার সম্পাদককে বইলা রাখো তুমি।”
১৬ এপ্রিল : রাজধানীর দক্ষিণখান থানার মাজার এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবীতে ইনসাফ গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মালিক পক্ষের হামলার শিকার হন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ক্রাইম অনুসন্ধানের সাংবাদিক তমা। ওই গার্মেন্টসের বিষয়ে কোনও সংবাদ প্রকাশ করলে মেরে লাশ গুম করে দেওয়ারও হুমকী দেওয়া হয় তাঁকে। 
১৫ এপ্রিল : লকডাউনের মধ্যেও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা শ্রমিকদের ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ অব্যাহত থাকায় ডিসি-এসপিসহ জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় আল মামুন নামের এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করেন ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার এসআই মো. জহুরুল ইসলাম । 
১৪ এপ্রিল : গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল ওজনে কম দেয়ার প্রতিবাদ করায় আনন্দ টিভির সাংবাদিক খোরশেদ আলম খানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কাপাসিয়া থানা পুলিশ ওএমএস ডিলার মাসুদ সরকারসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে।  
একইদিন মুন্সীগঞ্জে ১০ টাকা মুল্যের চাল বিক্রিতে অনিয়মের খবর ফেসবুকে দেওয়ায় দৈনিক অধিকার পত্রিকার মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি আরফি রিয়াদ এবং তাঁর পরিবারের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।  
এছাড়া এইদিন সাতক্ষীরার তালায় খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক খুলনাঞ্চলের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি খান নাজমুল হুসাইন (২৯), এবং তাঁর ছোট ভাই দৈনিক আজকের সাতক্ষীরার তালা উপজেলা প্রতিনিধি খান আল-মাহবুব (২০) কে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্ত্বরা।  
১২ এপ্রিল : নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার জিরতলী ইউনিয়নের বড় হোসেনপুর গ্রামে ক্রাইম নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমের সাংবাদিক মো. পলাশ উদ্দিনের উপর স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন চড়াও হন, তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি ও দেওয়া হয়।  
১০ এপ্রিল : চাল চুরির প্রতিবেদন করায় যুবলীগ নেতার হুমকীতে সস্ত্রীক পালাতে বাধ্য হন আনন্দ টিভির জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা প্রতিনিধি মো. নাসিম উদ্দিন। পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন তিনি।  
৯ এপ্রিল : নারায়ণগঞ্জ থেকে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে ফিরে আসা ১৯ ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসী ও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় এশিয়ান টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার মো. গোলাম মোস্তফাকে মারধর করে তাঁর ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই দিন ফতুল্লা থানার কাশিপুর ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় নিম্নআয়ের মানুষদের বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় মেম্বার আমির হোসেনের দুর্ব্যবহারের শিকার হন সাংবাদিকরা।  
৩ এপ্রিল : হামলার শিকার হয়েছেন দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি নাজমুল সাঈদ সোহেল ও তাঁর পরিবার। 
১ এপ্রিল : হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের সংবাদ প্রচার করায় সাংবাদিক শাহ সুলতান আহমেদকে ক্রিকেট খেলার ব্যাট দিয়ে পেটান স্থানীয় চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুন। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হন আরও দুই সাংবাদিক এম মুজিবুর রহমান ও বুলবুল আহমেদ।  
৩১ মার্চ : চাল চুরির খবর ফাঁস করায় ভোলায় সাংবাদিক সাগর চৌধুরীর ওপর মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালায় বোরহানউদ্দিন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বড় মানিকা ইউপি চেয়ারম্যান জসিম হায়দারের ছেলে নাবিল হায়দার। ক্ষোভ মেটাতে মোবাইল চোর ও ছিনতাইকারী অপবাদ দিয়ে ওই সাংবাদিককে পেটানোর সময় ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে লাইভ করেছিল সে। 
২৭ মার্চ : প্রশাসনের করোনা সংক্রামণ বিষয়ক সচেতনতা তৈরীর প্রচার-প্রচারণার ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটার শিকার হন বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক দেশ জনপদ পত্রিকার শাফিন আহমেদ রাতুল ও দৈনিক দখিনের মুখ পত্রিকার নাসির উদ্দিন। এদের মধ্যে রাতুল বরিশাল ফটো সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের সাধারণ।
এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস বিষয়ক গুজব ঠেকানোর কথা বলে বেশকিছু ওয়েবসাইটের সম্প্রচার বন্ধ করেছে সরকার। সামগ্রিকভাবে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন ও বার্তা সংস্থায় কর্মরতদের কর্তব্য পালন হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। এরই মধ্যে একের পর এক গণমাধ্যমকর্মী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাচ্ছি।

২১ এপ্রিল ২০২০

২৮ দিনে প্রথম ৫০, পরের ৫ দিনে ৫১ মৃত্যু!

পঙ্গুত্ব বরণের কারণে গত আট-নয় বছর ধরে সোহরাব উদ্বাস্তু, ভিক্ষুক।
তবুও এই কোভিড কালের মতো দুর্দশার সম্মুখীন হননি কখনও।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ ছুঁয়েছিল গত ১৫ এপ্রিল। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার ৪৪ দিনের মধ্যে ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিষয়ক অনলাইন বুলেটিনে সোমবার জানানো হয়, মোট মৃত এখন ১০১, আর আক্রান্ত দুই হাজার ৯৪৮ জন। 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রথম ৫০ জন মারা গিয়েছে ২৮ দিনে এবং পরের পাঁচদিনে ৫১ জন। 

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে এবং ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা এক থেকে একশ ছাড়াতে, অর্থাৎ ১০১ হতে সময় নিয়েছে মাত্র ৩৩ দিন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক এই প্রতিবেদককে বলেন, “সংখ্যাটা এখন আস্তে আস্তে আরও বাড়বে। জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধির স্বভাবটা এমনই। প্রথমে কম সংখ্যায় বাড়লেও পরে শত শত, হাজার হাজার বা হাজারেরও বেশী হারে বাড়তে থাকে।” 

“করোনাভাইরাসে মৃত্যুর আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে নজর দিলেও বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে,” যোগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের এই অধ্যাপক। 

বৈশ্বিক হিসাবে করোনায় মৃতের সংখ্যা এক থেকে প্রথম ৫০ হাজারে পৌঁছাতে লেগেছে ৮২ দিন, আর পরবর্তী ১৫ দিনে মারা গেছে লক্ষাধিক। গত ১১ জানুয়ারি প্রথম মৃত্যুর পর ২ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়ায়; ১৭ এপ্রিলে যা এক লাখ ৫১ হাজার ছয়ে পৌঁছে যায়। 

“তবে হা-হুতাশের বা ভয় দেখানোর দরকার নেই। এখনও সময় আছে। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়াটাই অনেক বেশী জরুরী। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং সরকারের নির্দেশাবলীগুলো এখন ধর্মীয় শিস্টাচারের মতো পালন করতে হবে,” বলেন ড. রুহুল। 

গত ২৪ ঘন্টায় ৪৯২ জন ভাইরাস আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে বুলেটিনে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ৭২ ঘন্টায় এক হাজার ১১০ জন নতুন কোভিড আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছে, মারা গিয়েছেন ২৬ জন।

“আমরা আসলেই একটা বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যেন ঘরে থাকি, ‘মাস্ক’ ব্যবহার করি, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখি এবং স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলি। তাহলে তা না হলে সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারবো না,” বলেন তিনি। 

সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে সর্বশেষ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের আট জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। অযথা ঘোরাঘুরি করে নিজেকে এবং অন্যের জীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা ড. রুহুলের দাবি, “আমরা করোনার প্রবেশই ঠেকিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটি পারিনি। তবে সারা বিশ্ব বা ইউরোপ-আমেরিকার তূলণায় আমাদের অবস্থা এখনও অনেক ভালো আছে।” 

“সরকারের ভুল-ভ্রান্তি বা সমন্বয়হীনতা নিয়ে সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু জনগণেরও ভুল আছে। ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে আমাদের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। অনেক বেশী সাবধান হতে হবে,” বলেন তিনি। 

“আরেকটু সচেতন হলেই বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে,” উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জানান কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার জন্য সারাদেশে ৫০৭ প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রয়েছে। বুলেটিনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে মোট হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন কোয়ারেন্টিনে আছেন ৮০ হাজার ৪০২ জন, যার মধ্যে ৭৫ হাজার ৭৪৭ জনই বাসায়। 

গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ জনসহ মোট সুস্থ হয়েছেন ৮৫ জন। প্রতিনিয়ত নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার হার বেড়েছে বলেও বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়। এর আগে রবিবার ৩১২ এবং শনিবার ৩০৬ জনকে শনাক্তের কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

গাজীপুরে আক্রান্তের হার বেশী : “গাজীপুরে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা প্রায় ২০ (১৯ দশমিক পাঁচ) শতাংশ। এছাড়া কিশোরগঞ্জে ১৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং নরসিংদীতে ছয় শতাংশ। ঢাকায় এবং নারায়ণগঞ্জেও আগের মতোই অনেক বেশী আছে,” বুলেটিনে বলেন ডা.নাসিমা।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে গাজীপুরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোববার পর্যন্ত ওই জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭৩। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০৬ জন শনাক্ত হওয়ায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা এখন ২৭৯। এর মধ্যে একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ নয় চিকিৎসক, ১২ নার্স ও ৩৪ স্বাস্থ্য কর্মীসহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগেরই মোট ৫৭ জন।

ড. রুহুল বলেন, “ডাক্তার-নার্সদের ঢাল-তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধে পাঠালে শুধু তারাই যে মরবে তা নয়, তাদের মাধ্যমেও অনেকে আক্রান্ত হবেন।” এর আগে শনিবারই স্বাস্থ্য বুলেটিনে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছিলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে গাজীপুর।

জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার পুলিশ সুপার ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “যে কারখানাগুলো খোলা রয়েছে তারা কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী) বানানোর কথা বলে শ্রমিকদের ডেকে এনে অন্য পণ্য বানাচ্ছেন।”

“অনেক মালিক রয়েছেন যারা বেতন দেবেন বলে শ্রমিকদের ডেকে নিয়ে আসছেন। কিন্তু বেতন দিতে পারছেন না। তারা শ্রমিকদের ঠকাচ্ছে। এটা ‘লকডাউন’ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক বড় অন্তরায়,” যোগ করেন তিনি। 

পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব। আমি পরবর্তীতে গার্মেন্টস মালিকদের সঙ্গে বসব। ‘লকডাউন’ নিশ্চিত করে সীমিত পর্যায়ে হলেও উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। তবে এজন্য ডব্লিউএইচও’র শর্ত মেনেই কাজ করতে হবে।”

প্রসঙ্গত, বেতন-ভাতার দাবিতে লকডাউন ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে বারবার বিক্ষোভ করেছেন গাজীপুরের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।

সিএমএসডিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং কেন্দ্রীয় ওষধাগারের (সিএমএসডি) কর্মকর্তাদেরদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বিভিন্ন মেডিকেল সামগ্রী বুঝে নেওয়ার সময় কেবল মোড়ক না দেখে ভেতরের সবকিছু যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

সিএমএসডির পরিচালককে উদ্দেশ্যে করে ভিডিও কনফারেন্সের তিনি বলেন, “লেখা আছে এন-৯৫ কিন্তু ভেতরের জিনিস (মাস্ক) সবসময় সঠিকটা যাচ্ছে না। এর সাপ্লাইয়ার কে? বাবুবাজারের মহানগর হাসপাতালে এগুলো যাচ্ছে। এটা তো করোনাভাইরাসের জন্য ‘ডেডিকেটেড’। এ রকম যদি কিছু কিছু জায়গায় হয়, এটা তো ঠিক নয়।”

“আমি আমাদের মন্ত্রীর কাছে কিছু ছবি পাঠিয়েছি,” যোগ করেন তিনি। তবে বুলেটিনে হাজির হয়ে সিএমএসডি পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদ উল্লাহ দাবি করেন, মহানগর হাসপাতালের এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের জন্য তারা কাউকে অনুমোদন দেননি। 

“বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠান মাস্ক সরবরাহ করে, তাদের স্বাভাবিক মাস্ক সরবরাহ করার জন্য কার্যাদেশ দিয়েছি। যার মান ও যার মূল্য ওধুষ প্রশাসন নির্ধারণ করে,” বলেন তিনি। 

২৮ অক্টোবর ২০১৯

ভারতে বাংলাদেশ-ফোবিয়ার হেতু কি?

দীপাবলী উপলক্ষে হিলি সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের উপহার বিনিময়।
বাংলাদেশের সীমানায় ভারতীয় জেলে আটকের ঘটনায় রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বড়াল ও পদ্মার নদীর মোহনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনার পর থেকেই আরো অনেক বাংলাদেশী সাংবাদিকের মতো তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলাম ভারতীয় গণমাধ্যমে। তখনই ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে প্রকাশিত ‘স্বরাজ্য ম্যাগ’ নামের এক গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণের একটি শিরোনামে হঠাৎ চোখ আটকে যায়। যার বাংলা অর্থ, বিএসএফ এর নতুন মাথাব্যাথা: বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী জওয়ানরা মৌলবাদী হয়ে উঠছে এবং প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে ‘প্রসাদ’।

রাজশাহী-মুর্শিদাবাদ সীমান্তের ওই ঘটনার মাত্র তিনদিনের মাথায় (২১ অক্টোবর ২০১৯) প্রকাশিত এই প্রতিবেদন জুড়েই ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ছাপ। যেখানে জানানো হয়েছে, বিশেষত যেসব সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই, সেইসব সীমান্তে পূজাদের সময় দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে বিএসএফ জওয়ানদের দেওয়া ‘খিচুড়ি’ আনুষ্ঠানিকভাবে ওপারে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। একইভাবে বিজিবির জওয়ানরাও ঈদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে বিরিয়ানী এবং মিষ্টি পাঠাতেন। তবে তারা ‘প্রসাদ’ নিতে অস্বীকার করার পরে অনেক জায়গায় থেমে গেছে এই শুভেচ্ছা বিনিময়।

এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও একান্ত আলাপে বিজিবির এক কর্মকর্তা বলেছেন, “সীমান্তে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।” সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব দীপাবলি উপলক্ষেও বিভিন্ন সীমান্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময় করেছেন বলেও জানান তিনি। 
যদিও উল্লেখিত প্রতিবেদনের উপ-শিরোনামে অবসরপ্রাপ্ত বিএসএফ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, “নিম্নস্তরে ইসলামীকরণ ও উগ্রপন্থীকরণের কারণে আমাদের ‘কাফের’ ভাবছে বিজিবির সদস্যরা। এ কারণেই তারা এত প্রতিকূল ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে।” এছাড়া “বিজিবির নিম্নস্তরে ইসলামীকরণে আন্তঃসীমান্ত পাচার, বিশেষত গবাদি পশু এবং মানবপাচারের উত্থান হয়েছে” বলেও উল্লেখ করা হয়। 
সীমান্তে কর্মরত বিএসএফ কর্মকর্তাদের ভাষ্য দাবি করে স্বরাজ্য ম্যাগের সহযোগি সম্পাদক জয়দ্বীপ মজুমদার তাঁর প্রতিবেদনের শুরুতেই জানিয়েছেন, “বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায় আন্তর্জাতিক সীমান্তে বিজিবি জওয়ানদের দ্বারা বিএসএফের এক হেড কনস্টেবলকে হত্যা এই দ্বন্দ্ব ও শত্রুতার পরিচায়ক মাত্র।” দু'দেশের সীমান্ত বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের মধ্যেকার সম্পর্ক অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও বিজিবির জওয়ান, ল্যান্স নায়েক, নায়েক এবং হাবিলদার স্তরের সাথে বিএসএফ জওয়ানদের ‘ক্রমবর্ধমান বৈরিতা’ অনুভব করছেন বলে তাঁকে জানিয়েছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। 
গত কয়েকদিনে এই প্রতিবেদনটি নিয়ে কথা হয়েছে ওপার বাংলার একাধিক বন্ধুর সাথে। যারা জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও কট্টর নন, মূলত রাজনীতি, সাহিত্য, সংবাদ, চলচ্চিত্রের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক নানা কাজের সাথে জড়িত। তাদের মুখেই জানতে পারি, ‘স্বরাজ ম্যাগ’ নামের এই পত্রিকাটি মূলত উগ্র হিন্দুবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) অন্যতম মুখপাত্র। যে কারণে তারা এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে রাষ্ট্রীয় চাপে এমন প্রচারণাটা মূলধারার গণমাধ্যমেও শুরু হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। 
যে কারণে এমন প্রচার : ভারতীয় বন্ধুদের ভাষ্য, সীমান্তে স্থিত বিএসএফ ও বিজিবি কর্মীরা যে যার রাষ্ট্রীয় সীমানাকেন্দ্রিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত৷ তারা উভয়েই আপনার রাষ্ট্রের ব্যাপারে দায়বদ্ধ এবং নিজ নিজ রাষ্ট্রকে অপবহির্শক্তির হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর৷ এই সুরক্ষার বিষয়টি বাদে বর্ডারের অপরপ্রান্তের অপর রাষ্ট্রের অন্দরে কী হচ্ছে তা দেখার বা তা নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই, যদি না অপর রাষ্ট্রের সীমানা থেকে কোনোরকম কোনো ‘থ্রেট’ একপক্ষ পেয়ে থাকে৷ দুটি প্রতিবেশী রাষ্টের পারস্পরিক গণসংস্কৃতি, বিশ্বাস, ভাবনার তরিকা, অভ্যাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফারাক আছে, মিলও আছে, কিন্তু ফারাকগুলিই একেকটির দৃশ্যমান পরিপ্রেক্ষিতের ভিন্নতা বজায় রাখে রাষ্ট্রের নিরীখে। একেকটি রাষ্ট্রের নিজস্বতাও তার সার্বভৌমত্বের অংশ৷ 
এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাঙালী মুসলমান৷ তাই তার বর্ডার গার্ডের মধ্যে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ট্রের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী ইসলাম বিশ্বাসীর সংখ্যাই বেশি৷ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের শতাংশের হিসেবের থেকে কিছুটা বেশি সনাতন বিশ্বাসী মানুষ বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডে থাকলেও জনবিন্যাসের বাস্তবতা অনুযায়ী হিন্দুর চেয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বেশি৷ 
অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে স্থিত ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে ভারতের ধর্ম বিশ্বাস ভিত্তিক জনবিন্যাস অনুযায়ী মুসলিমের চেয়ে হিন্দুর সংখ্যা অনেক বেশি৷ যদিও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে নিয়োজিত বিএসএফ কর্মীরা কেউই পশ্চিম বাংলার বাঙালী হিন্দু বা মুসলিম নয়৷ তারা হয় উত্তর ভারত, মধ্য ভারত, পশ্চিম ভারত অথবা উত্তরপূর্ব ভারতের হিন্দু বা মুসলিম। যদিও হিন্দু বেশি৷ 
হিন্দুরা সাধারণত গরু খায় না৷ আবার বিশ্বাসী মুসলমানও এমন কিছু করে না যাতে তার ঈমান নষ্ট হয়৷ বিশ্বাসী মুসলিমদের সামনে কেউ যদি নিজস্ব আচারে আল্লাহর একত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, সেই ব্যক্তির ওই আচরণে সমর্থন জানানোটা তাদের ঈমানী নৈতিকতার পরিপন্থী৷ একইভাবে বিশ্বাসী হিন্দুকে যদি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গো-মাংস খাওয়ানোর মতো কাজে প্রণোদিত করতে চাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে প্রনোদিত হওয়াটাও নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচার! তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাঙালীর বর্ডারে নিয়োজিত লোকেরা যেহেতু বেশির মুসলিম তাই কোনো পৌত্তলিক দেবতার প্রতি নিবেদিত প্রসাদগ্রহণের ঘটনা তাদের কাছে ঈমানী চেতনার বিরোধী। যেভাবে বিশ্বাসী হিন্দুর কাছে গো-মাংস খাওয়া অধর্ম৷ 
প্রতিটি মুসলিমের অধিকার আছে তার ঈমান রক্ষা করার৷ প্রতিটি হিন্দুরও অধিকার আছে গো-মাংস গ্রহণ না করে সংস্কার রক্ষা করার৷ এখন বিজিবি প্রসাদ নেয়নি বলে বিএসএফের কাঁধে বন্দুক রেখে স্বয়ং সেবক সংঘ যদি বিজিবির মধ্যে ‘র‍্যাডিক্যাল ইসলাম’ বা ইসলামী জঙ্গিবাদের ভূত দেখলে তো বিজিবিও কোরবানীর মাংস বিএসএফকে দিতে চাইবে। এক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হলে তারা শুধুমাত্র বিএসএফ কর্মীদের দিকে ‘র‍্যাডিক্যাল হিন্দুত্বের’ অভিযোগও তুলতে পারে! কিন্তু বিজিবি প্রসাদ প্রত্যাখান করার যে ঘটনা ঘটিয়েছে তা আসলে তাদের এক্তিয়ারের মধ্যেই পরে। কারণ এটা তাদের ‘কালচারাল চয়েস’৷ একইভাবে বিএসএফ যদি কোরবানীর গো-মাংস না নিতে চাইতো, সেটাও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার৷ কে কী খাবে বা খাবে না কী পরবে বা পরবে না এই সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিগত৷ এই সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক, জঙ্গিবাদী বা জাতিবাদী নয়৷ 

বিজিবি নিজ মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রসাদ প্রত্যাখ্যান করেছে তাঁর ধর্মবিশ্বাসের অধিকার রক্ষায় এবং সার্বভৌমত্বে দাঁড়িয়ে৷ অন্য রাষ্ট্রের বর্ডার গার্ডে নিযুক্ত বিশ্বাসী মুসলিমকে প্রসাদ দিতে চাওয়া এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার দিকে জঙ্গীবাদের অভিযোগ করাই বরং অন্যের ‘ডেমোক্রেটিক’ এবং ‘সভারনিটি’ ভায়োলেট করার সামিল। বিজিবির গায়ে পরে বিএসএফের মালিক রাষ্ট্রের এই ঝগড়া আপাত অর্থে অর্থহীন হলেও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যবাহী৷ কারণ প্রসাদের অজুহাতে বিজিবির দিকে র‍্যাডিক্যাল ইসলামের ব্যাপারে যে অভিযোগ স্বয়ং সেবক সংঘ তুলেছে তা অমূলক হলেও এই মিথ্যাপ্রচার দিয়েমপশ্চিমবঙ্গে ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশ-ফোবিয়াকে জোরালো করতে পারবে। আর ইসলামোফোবিয়া, বাংলাদেশ-ফোবিয়া, এসব হলো পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এনআরসি বাস্তবায়বের জন্যে বানোয়াট একটি বিষয়৷

আমার বন্ধুরা আরো বলেছেন, এনআরসির জন্য বাংলাদেশ ফোবিয়া তৈরি করা দরকার, যাতে প্রচার করা যায় বিজিবির মদদে হুহু করে কয়েক বছরে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এবং ত্রিপুরবঙ্গে মানুষ ঢুকেছে৷ এই মিথ্যা প্রচারকে সামনে রেখে এনআরসির সমর্থনের গণভিত্তি তৈরি করা হবে। তারপর ওই গণভিত্তির গণকেই এনআরসি দিয়ে বাস্তুচ্যুত, দেশচ্যুত করা হবে৷ বাংলাদেশ-ফোবিয়ার মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র রচনা করতেই বিজিবির সাথে বিএসএফকে দিয়ে পায়ে পা তুলিয়ে ঝগড়া করানোর ফিকির খুঁজছে দিল্লী৷ এই কাজ তাদের পক্ষে আরো সহজ কারণ দুই বাংলার বর্ডার অথবা বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা সীমান্তের ভারতীয় সীমানার নিয়োজিত বিএসএফ কর্মীরা অধিকাংশই হিন্দুস্তানী ও হিন্দীভাষী৷ বিজেপি তথা দিল্লীর এই ষড়যন্ত্রে তারা অংশীদার। কারণ, বিজেপি ও স্বয়ং সেবক সংঘের রাজনীতি হলো হিন্দী জাতিবাদী রাজনীতি৷ হিন্দুত্বের একমাত্রিক স্লোগানকে সামনে রেখে তারা আসলে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা থেকে বাঙালী উচ্ছেদ করে এই অঞ্চলকে হিন্দুস্তানী, মারোয়ারি, বিহারী, গুজরাতিদের লীলাভূমি বানাতে চায়৷ বানিয়া পুঁজির বাজার ও কারখানা বানাতে চায়৷এটাই হিন্দী জাতিবাদ। 
হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তানী জাতিবাদের লক্ষ্য ইসলামোফোবিয়ার মতো বাংলাদেশফোবিয়া তৈরি করে এনআরসি বাস্তবায়িত করা। সেকারণেই বিজিবির বিরুদ্ধে এমন ফালতু অভিযোগ তুলেছে হিন্দী জাতিবাদী আরএসএসরা।
বন্ধুদের সোজাসাপ্টা বক্তব্যে পাঠকদের কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে আশাকরি। এক্ষেত্রে একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমার প্রত্যাশা, ভারতীয়দের এই ফোবিয়া তথা অস্বাভাবিক ভীতি বা উদ্বেগ ‘বিদ্বেষ’ না ছড়াক। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্থিতি বজায় থাকুক।

ইতিহাস কথা বলে : ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ইতিহাস এই উপমহাদেশে নতুন নয়। তবে স্বরাজের এই প্রতিবেদনটি স্মরণ করিয়ে দেয় ১৮৫৭ সাল। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এদেশে ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল নিয়ে আসে। ১৮৫৩ সালে তৈরি এই রাইফেলের ব্যবহৃত কার্তুজে চর্বিযুক্ত অংশ ছিল, যা ব্যবহারের পূর্বে সৈন্যকে তা দাঁত দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে হতো। গুজব রটানো হলো এই চর্বিযুক্ত অংশ গরু এবং শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি। যেহেতু গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেওয়া হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৈন্যদের কাছে অধার্মিক কাজ ছিল, সেহেতু এই গুজবের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭–৫৮ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা ভারতীয় মহাবিদ্রোহ।

১৬ অক্টোবর ২০১৯

রাষ্ট্রধর্ম বাড়িয়েছে ইসলামী উগ্রবাদ

একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীর দৃশ্য
“রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের তিন দশকে বেড়েছে ইসলামী উগ্রবাদের শক্তি,” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরী করেছিলাম গত বছর, যা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। চলতি বছরের জুলাইতে প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সাহায্য চাওয়ায় যখন খুব হৈচৈ হচ্ছে, তখন অপ্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি ফের স্মরণে আসে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রিয়া সাহা ওয়াশিংটনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউজে গিয়ে ট্রাম্পকে বলছেন, “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানে তিন কোটি ৭০ লাখ (৩৭ মিলিয়ন) হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ‘উধাও’ হয়ে গেছেন। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ (১৮ মিলিয়ন) সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রয়েছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ছাড়তে চাই না। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা আমার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। জমি কেড়ে নিয়েছে। এর কোনো বিচার এখনো পাইনি।”
“কারা এসব করেছে,” প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানতে চাইলে দলিত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘শারি’ পরিচালক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংগঠক প্রিয়া সাহা আরো বলেন, “উগ্রপন্থী মুসলমানরা এটা করেছে। সব সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা এটা করে থাকে।” 
এমন বক্তব্যের জেরে সরকার-বিরোধী, ডান-বাম, বাঙালী মুসলমানদের সব পক্ষই যখন প্রিয়াকে তুলোধনো করছে, তখন খেয়াল হয় আরো ছয় বছর আগে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির এক শুনানিতে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ থেকে ২০১৩ সাল এ পর্যন্ত চার কোটি ৯০ লাখ (৪৯ মিলিয়ন) হিন্দু মিসিং হয়েছে। 

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদও বহু বছর ধরেই বলছে, গত পাঁচ দশকে আনুমানিক এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশান্তরিত হয়েছেন। সে হিসেবে গড়ে বছরে দেশ ছেড়েছেন দুই লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। তাছাড়া সরকারি পরিসংখ্যান মতে সত্তরের দশকে এ দেশে ২০ দশমিক এক শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। চলতি দশকের শুরুতে ২০১১ সালে যা কমে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক সাত শতাংশে। 
ঘাঁটতে গিয়ে জানতে পারি, নিরাপত্তহীনতায় কোটি মানুষ দেশ ছাড়লেও কমেনি সাম্প্রদায়িক পীড়নের মাত্রা; বরং রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের পর দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযুক্তকারী অষ্টম সংশোধনীর প্রস্তাব পাসের ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়েছে গত বছর। 
তৎকালীন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ১৯৮৮ সালের ১১ মে জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেছিলেন। পরে ৭ জুন এটি পাস হলে ৯ জুন ‘স্বৈরশাসক’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুমোদন পেয়ে তা আইনে পরিণত হয়। অবশ্য তার আগেই সংবিধান ইসলামীকরণ শুরু করেন আরেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। ফরমান জারি করে তিনি প্রস্তাবনার আগে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) বাক্যটি যোগ করেন। সেইসঙ্গে মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিলুপ্ত এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাংবিধানিক সুযোগ তৈরী করা হয়। 

এরই ধারাবাহিকতায় এরশাদের শাসনামলে কায়েম করা হয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ৷ ওই সময় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে সংবিধানের এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে উচ্চ-আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন লেখক সাহিত্যিক, সাবেক বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের পনেরো জন বিশিষ্ট নাগরিক। এর ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হলে মামলাটি আলোচনায় আসে। এর কিছুদিন পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হলে আরো একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওই সময় রুল ইস্যু করলেও আদালত ২০১৬ সালে রিট দুটি বাতিল করে দেয়। 

রিটকারীদের মধ্যে যারা এখনও বেঁচে রয়েছেন, তাদেরই একজন জাতীয় অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। এক আলাপে তিনি বলেছিলেন, “শেষ অবধি উচ্চ আদালত আমাদের মামলার অধিকারই স্বীকার করেনি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় থাকা প্রবীণ এই বুদ্ধিজীবীর অভিমত, “রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়েছে। এভাবে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য দেয়া উগ্রবাদীদের উৎসাহিত করে। কারণ তাদেরও বোঝানো হয় , পৃথিবীতে তাদের ধর্মই শুধু শ্রেষ্ঠ আর অন্য সব ধর্ম নিকৃষ্ট।”
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রধর্ম বিরোধী রিট বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে করেছিল জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ইসলামসহ বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভাবধারার ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো। 
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম রেখে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিয়ে বা উগ্রবাদী শক্তির সামনে মাথানত করে জঙ্গিবাদ দমনের কথা আমরা বলি কি করে! মুক্তিযুদ্ধ করার সময় আমি কি কখনো ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশে এমন একটি সময় আসবে যখন আমাদের ‘মাইনরিটি’ হিসেবে ‘সেকেন্ড গ্রেডের সিটিজেনে’ পরিণত করা হবে এবং তার থেকে উত্তরণের জন্য আবার লড়াই করতে হবে।” 

রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী দাবি করে রানা আরো বলেন, “একাত্তরে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা ফেরাতে না পারলে মৌলবাদ উৎখাত করা যাবে না।” সংখ্যাগরিষ্ঠ দেওবন্দী ওহাবী ভাবধারার কওমি মতাদর্শী মুসলিমদের চাপে থাকা প্রায় আড়াই লাখ কাদিয়ানীর সংগঠন আহমদিয়া মুসলিম জামা’তের আমির মোবাশশেরউর রহমান মনে করেন, “রাষ্ট্রধর্মের বিধান ধর্মীয় গোষ্ঠির ক্ষমতায় যাওয়ার একটা দরজা।”

অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ পরে পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটি পরিবর্তন করে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একই সংশোধনীতে সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়।

তবে “অবশিষ্ট ছয় শতাংশ সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করলে, অর্থাৎ সংখ্যালঘু শূন্য হলে কিভাবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করবে বাংলাদেশ?” এক আলাপে এমন প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও গল্পকার তুহিন দাস। মুক্তচিন্তার পক্ষে লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশ এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় থাকার কারণে ২০১৫ সালে আগস্টে ‘আনসারবিডি’ নামের এক উগ্রবাদী সংগঠনের হুমকী পেয়ে তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশ ত্যাগ করেন। 

চলতি দশকে কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা করে মহামূল্যবান প্রাচীন পুঁথি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, খ্রিস্টান গির্জাগুলোতে বোমা হামলা হয়েছে, নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে; এছাড়া রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বসতভিটা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে দাবি করে তুহিন বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার ফলে এ ধর্মের অধিকাংশ মানুষেরা মনে করে, এ দেশটা শুধু তাদের এবং সবকিছুতে তাদেরই অধিকার।” 

অবশ্য ভাষ্কর, লেখক ও গবেষক গোঁসাই পাহলভী মনে করেন, “সংবিধানের চর্চা সাধারণ মানুষর ভেতর নেই। তারা সংবিধান বুঝে ‘এ্যাক্ট’ কিংবা ‘রিএ্যাক্ট’ করেন, এমন নয়। জনগণের কৌমচেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনা, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই উগ্রতার পেছনে দায়ী। আরো আছে আন্তজার্তিক ঘটনাবলীর প্রভাব।”
তুহিন ও গোঁসাই, দুজনেই রাষ্ট্রের বৈষম্যের উদাহরণ হিসাবে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘একদিনের ঈদ’ উপলক্ষে কমপক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটির বিপরীতে হিন্দুদের প্রধান উৎসব ‘পাঁচ দিনের দূর্গা পূজা’ উপলক্ষে মাত্র একদিন ছুটি থাকা কথা বলেন। 
বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকে এই জনপদের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে, উল্লেখ করে তরুণ প্রকাশক ও সাংবাদিক সৈয়দ রিয়াদ বলেন, “দেশের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর যে ধরণের আক্রমণ করা হয় তা দেখেই মনে হয়, এই দেশে সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নেই।” 

তরুণ কবি রূমান শরীফের অভিমত, “একটি গণতান্ত্রিক দেশে সব ধর্মের মানুষ; আকি, নাস্তিক সবাই বাস করে। সেখানে রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ধর্ম থাকা মানে ওই ধর্মানুসারী বাদে বাকি নাগরিকদের অস্বিকার করা। সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করে দেয়। নাগরিকদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাঁর দাবি বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতপোষণকারীরা মোটেই নিরাপদবোধ করেন না। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, প্রকাশক, ব্লগারদের ওপর হামলার বা তাদের খুনের এখনো কোনো বিচার হয়নি।”

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ক এক আলোচনায় বক্তারা বলছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করছে। তারা আরো বলেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার না হওয়ায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
“ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আসলে খুব চালাক,” বলেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান। 
আচ্ছা প্রিয়া সাহা বা তাঁর পরিবারের সর্বশেষ অবস্থা কেউ জানেন কী? খবরে দেখেছিলাম, তাঁর স্বামী স্বামী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মলয় সাহাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, পিরোজপুরে পৈত্রিক বাড়িতে হামলা ও আগুনের ঘটনার প্রতিকার চেয়ে প্রিয়া সাহা স্থানীয় সাংসদ ও পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কাছে গেলেও তিনি অনীহা দেখিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

প্রিয়া সাহা
আরো পড়ুন:

০৯ অক্টোবর ২০১৯

সব শিক্ষালয়ের হলে তল্লাশী আসন্ন!

ফাইল ফটো
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির নামে চলমান উশৃঙ্খলতা রুখতে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের আবাসিক হল ‘সার্চ’ (তল্লাশী) করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “সেই নির্দেশটা আমি দিয়ে দেবো।” বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আজ তিনি যেসব বার্তা দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে এটাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার। আওয়ামী লীগ প্রধান উল্লেখ করেন, “আপনাদের (সাংবাদিক) মাঝেই আমি বলে দিচ্ছি, এই জিনিসটা আমরা করবো। পরিস্কারের বেলায় কোনো দলটল আমি বুঝি না।”

এর আগে ফাহাদ হত্যা প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ফোনালাপে বলছিলেন, “রাজনৈতিক দূর্বুত্ত্বায়নের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গতমাস থেকে যে কঠোর শুদ্ধি অভিযান চলছে, তার সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষনেতাকে বহিস্কারের মধ্য দিয়ে। তখন থেকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রধান বেশ কঠোর অবস্থানই আমরা লক্ষ্য করেছি। এমন সময়ে ছাত্রলীগের যে নেতারা ভিন্ন মতালম্বী বুয়েট শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তারা মূলত শেখ হাসিনাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন বলে আমি মনে করি।”

ভরসা প্রতিবাদে — উন্মাদনায় ভয়

আবরার ফাহাদ মুজাহিদ
“আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না,” বলে গেছেন যে দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা; ভুলে যাবেন না, প্রায় পাঁচ দশক আগে “পিন্ডি না ঢাকা - ঢাকা..ঢাকা..” স্লোগানে বিশ্ব কাঁপানো শোষিতের রক্ত বইছে সেই ভূখণ্ডের তরুণ-যুবাদের ধমনীতে। যে কারণে তারা একদিন না একদিন “দিল্লী না ঢাকা - ঢাকা..ঢাকা..” স্লোগানে রাজপথ কাঁপাবে, এটা অনুমেয়ই ছিল। কিন্তু এই সুযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ মুজাহিদকে যারা ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’, ‘গাজওয়ায়ে হিন্দ’, ‘হিন্দের যুদ্ধ’ বা হিন্দুস্থান বিরোধী আন্দোলনের ‘প্রথম শহীদ’ দাবি করছেন, তাদের ব্যাপারে ‘খুব খেয়াল’। 
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই সশস্ত্র সংঘর্ষ ইসলাম প্রবর্তক আবু আল-কাশিম মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের ভবিষ্যতবাণীতে প্রতিশ্রুত এক সমর, যা হিন্দুস্তানের মূর্তিপূজারীদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা করবে। দীর্ঘদিন থেকেই এ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপাত্য বিস্তার করতে চাইছে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (একিউআইএস) এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলা একুশ বছর বয়সী আবরারকে ভারত বিরোধীতার কারণে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও তারা  পুঁজি করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো কিছু প্রকাশনায় অন্তত তেমনই ইঙ্গিত পেলাম, যা ভীতিকর। 
দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আচারণের বিরোধীতা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু ভারত বিরোধীতার নামে আমরা উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদকে সমর্থন কিংবা আমন্ত্রণ করছি কি-না এ ব্যাপারেও দয়া করে সচেতন থাকুন। ভরসা রাখি বাঙালের সহজাত প্রতিবাদী সত্ত্বায়, ধর্মীয় উন্মাদনায় আমার ভয়। বুয়েট শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যু আপনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) শিক্ষক শামসুল আলম খান মিলনের মৃত্যুর ঘটনা মনে করিয়ে দিতেই পারে! শুধু মনে রাখবেন, ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই ক্ষমতায় ছিল মিলনকে হত্যাকারী এরশাদ সরকার। নিশ্চয়ই আওয়াজ হোক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, তবে তা ধর্মান্ধদের সুরে নয়। 

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শেখের বেটির জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

ছবি: সংগ্রহিত
মা–বাবার কাছে না থাকায় যাঁর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল, স্বজন হারিয়েও যিনি অর্ধযুগ দেশে ফিরতে পারেননি, যাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে—সেই হতভাগা নারী আর কেউ নন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ ৭২ পেরুনো এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলাপকালে দেশের প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বলেছিলেন, “খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য থেকে তাঁর উত্থান। সহজাত ব্যক্তিত্ব আর নেতৃত্বের গুনেই নিজেকে তিনি আজকের উচ্চতায় নিয়ে আসতে পেরেছেন।” 
চার মেয়াদে দেড় দশকের বেশী সময় ধরে ক্ষমতাসীন এই মানুষটির পরিবারের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস। তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই এসেছে স্বাধীনতা । সাংবিধানিকভাবে তাঁকে ‘জাতির জনক’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলনেরও অন্যতম নেতা ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যা পাওয়া উপমহাদেশের এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। দেশের মূলধারার রাজনীতিতে তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা হাসিনার পদার্পণও মূলত ‘শেখের বেটি’ হিসেবেই।   
বঙ্গবন্ধুর সাখে শেখ হাসিনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “রাজনীতিতে আসার প্রথম কয়েক বছরের জন্য শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেওয়ার দরকার নেই। সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু’ ম্যাজিক কাজ করেছে। পিতা ও পরিবার হারানোর বেশ কয়েকবছর পর তিনি যখন আওয়ামী লীগ প্রধান হয়ে দেশে আসলেন, তখন ‘বঙ্গবন্ধু-কন্যা’ হওয়ার কারণে প্রাথমিকভাবে অনেক সুবিধা পেয়েছেন।” আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অরুন কুমার গোস্বামী বলেন, “যদিও আওয়ামী বিরোধীরা বলে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জনগণ রাজপথে নামেনি। এটা দালিলিকভাবে সত্য হলেও ‘ফ্যাক্ট’ (প্রকৃত সত্য) হচ্ছে, মানুষ তখন সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এতে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সহানুভুতি বেড়েছে।” 

ড. শান্তনু বলেন, “স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে তাঁর (শেখ হাসিনা) স্বতন্ত্র রাজনৈতিক গুনাবলী বিকশিতে হতে শুরু করে। সেই থেকে তাঁর গত তিন দশকের রাজনৈতিক জীবন যদি আমরা দেখি, তা খুবই সমৃদ্ধ।” ড. অরুনের দাবি, “তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আজকের অবস্থানে পৌঁছানোর একটি ইতিবাচক সংযোগ রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়েছে। বিষ্ময়কর অগ্রগতি দেখে আন্তর্জাতিক মহলও অবাক। সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন ‘টেকসই’ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রতিটি সূচকে এগিয়েছি আমরা।” 

অরুন আরো বলেন, “শেখ হাসিনা যেভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, তা এর আগে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান করেননি। তিনি জাতীয় মাইলফলকগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ২০২১, ২০৪১, ২১০০ ও ২১২১ এগুলো পেরুবে।”  ড. আতাউরও মনে করেন, হাসিনা যেভাবে শক্ত হাতে দেশকে ‘টেকসই’ উন্নয়নের দিকে পরিচালনা করেছেন, তা আর কখনো হয়নি। তিনি অনেক বেশী সক্ষমতা ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। “দেশের ইতিহাসে তিনি রাজনৈতিক নেতার চেয়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বেশী উজ্জল হয়ে থাকবেন,” বলেন এই বিশ্লেষক। এ ব্যাপারে ড. শান্তনুর বক্তব্য, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি যে ‘রকেট’ গতিতে এগিয়েছে, তাঁর দলের ভোট কিন্তু একই গতিতে বাড়েনি।” 

৭৩ তম জন্মদিনের প্রাক্কালে (২৬ সেপ্টেম্বর)  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল (ইউনিসেফ)। তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি এই সম্মাননা অর্জনের মাত্র দুই দিন আগে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অপর এক অনুষ্ঠানে তাঁকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ আখ্যা দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)। এই সম্মাননাটি শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতে সাফল্যের স্বীকৃতি। 
এর আগে গত  বছর এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। নেতা ক্যাটাগরিতে তালিকায় জায়গা পাওয়া ২৭ জনের মধ্য তিনি ছিলেন ২১ নম্বরে। ফোর্বস, সিএনএন, ফরচুনসহ একাধিক গণমাধ্যমের জরিপে বিশ্ব, এশিয়া এবং মুসলিম জাহানের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায়ও ছিলেন তিনি। 
ছবি: সংগ্রহিত
জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সর্বাধিককাল দায়িত্ব-পালনকারী হাসিনাকে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে নানাজনের সাথে, মূলত সাংবাদিকতার সুবাদে। যার কিছু প্রকাশিত হয়েছে, কিছুটা হয়নি। নিজের মত প্রকাশের সুযোগ না থাকায় কোথাও বলতে পরিনি, তিনি বাংলার আদ্যাশক্তিরই প্রতিরূপ। প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনেই আজ এই লেখার অবতারণা। 

পথটা সহজ ছিল না : শেখ হাসিনার এই সাফল্য একদিনে অর্জিত হয়নি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারও আগে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের প্রথমে সহসভাপতি, পরে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থান করায় বেঁচে যান।পরিবারের সদস্যদের শেষকৃত্যে করার অনুমতিও সে সময়কার সরকার তাঁদের দেয়নি। পরের ছয় বছর ভারতে ছিলেন তাঁরা। নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে তাঁর অনুপস্থিতিতেই সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের পর ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থে‌কে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোট সাতবার তাঁকে গৃহবন্দী ক‌রে রাখে শাসকগোষ্ঠী। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সেনা‌সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাঁকে সাবজেলে থাকতে হয়। 
ছবি: সংগ্রহিত
এর আগে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে একইদিনে দুবার তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হয়। ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালেও তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়েছিল। ২০০১ সালেও তাঁকে দুইবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে স্বীকার করেছেন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (বর্তমানে বিলুপ্ত) শীর্ষনেতা মুফতি হান্নান। 

শেখ হাসিনার ৩৬ বছরের (১৯৮১-২০১৭) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসের সংকলন “জননেত্রীর জয়যাত্রা” সম্পাদনাকারী আসিফ কবীর বলেন, “পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের মানসিক আঘাতের পাশাপাশি স্বজন হারানোর সুতীব্র বেদনা ও বিচারহীনতার সংক্ষুব্ধতা- এই তিন নিদারুণ চাপ সয়েই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। সামরিক ও ছায়া সামরিক শাসকরা আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের জন্য নানা চক্রান্ত, কূটকৌশল ও নিষ্পেষণ চালিয়েছে। তা সত্ত্বেও জননেত্রীর (শেখ হাসিনা) নেতৃত্বে তারা বারবার পুর্নগঠিত ও পুনরুজ্জীবিত হয়ে অগ্রসর হয়েছেন। প্রধানের দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস এবং অপরিসীম সাহসের কারণেই দলটি এত বছরেও অতীত হয়নি।” 
শেখ হাসিনার ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।গত বছরের অক্টোবরে এ সংক্রান্ত মামলার রায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। ফাঁসির আদেশ হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ আরো ১৯ জনের। 
২১ আগস্টের হামলার পর
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে সবচেয়ে নিন্দনীয়, নৃশংস ও নারকীয় ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী প্রেস সচিব আসিফ বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করায় রাষ্টধীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইতিহাসে বিরল। তবুও পিছপা হয়নি শেখ হাসিনা বা তাঁর দল। খুব কাছ থেকেই তাঁকে দেখছি শাসনব্যবস্থার সংস্কার, জনগণকে যুপোপযোগী সুরক্ষা দান এবং নগর থেকে প্রান্তিক পর্যায় অবধি উন্নয়নের কাজে নিবেদিন থাকতে।তাঁর নেতৃত্বে দেশের অবকাঠামো খাতে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়েছে তা অচিরেই সম্পন্ন হয়ে জনগণের দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ হবে।” 

বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অভিযোগ, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসিত করেছেন। একইসঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দিয়ে গেছেন। বিএনপিকে নিয়ে গড়া রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে হারিয়েই তিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এটিকে ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন দাবি করা ওই দলটি ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা দুই দফায় মোট ১০ বছর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বও পালন করেছেন। এর আগে বিএনপির বয়কটে ‘বিতর্কিত’ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয় অর্জনের পর হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিএনপিকে হারিয়েই তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ও ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার এই দায়িত্বগ্রহণ করেছিলেন।  

আসিফ বলেন, “রাজপথের দল থেকে সংসদের বিরোধী বা সরকারি দল, সব ভূমিকাতে আওয়ামী লীগের সাফল্যের কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।” বিগত কয়েক বছরে দলীয় ফোরামে বেশ কয়েকবার শেখ হসিনা নিজেই অবসরে যাওয়ার বিষয়টি তুলেছেন। প্রতিবারই দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সমস্বরে জানিয়েছে, তাঁকে আমৃত্যু দলের প্রধান হিসেবে চায় তারা। ড. আতাউর বলেন, “শেখ হাসিনা খুবই বাস্তববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। যে কারণে অনেক কঠিন সময় পার করেও তিনি নিজেকে, নিজের দলকে এবং বাংলাদেশকে একটা ভালো অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছেন।”
ড. শান্তনু  বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার কোনো বড় রাজনৈতিক দলে শেখ হাসিনার মতো এত লম্বা সময় ধরে কেউ নেতৃত্বে নেই। তাঁর কারণেই আওয়ামী লীগ আজ শুধু দেশ নয়, পুরো উপ-মহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। যখন ভারতের কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগসহ শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের পুরানো দলগুলোও ক্রমে দুর্বল হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের এই দলটি ক্রমে আরো সামর্থ্যবান হচ্ছে। এটা নিশ্চিত যে তিনি (হাসিনা) না থাকলে আওয়ামী লীগ এখন যেরকম অবস্থায় আছে, সেটা থাকত না।” 
শান্তনু আরো বলেন, “তাঁর রাজনীতি কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে দক্ষিণ-এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জায়গা থেকে যদি দেখলে বলতে হয়, এটা এমনই হওয়ার কথা।  বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন যে এতদিন ধরে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, এটা শেখ হাসিনার বড় একটি কৃতিত্ব। দলকে তিনি ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। কখনো শক্ত হাতে, আবার কখনো প্রজ্ঞার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলেছেন।”

ছবি: সংগ্রহিত
শাসনে সাফল্য-ব্যর্থতা :  বিশ্লেষকদের মতে, বিগত দশকে শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশী সফল কূটনীতিতে। আগের সরকারের কারণে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে যে দুরত্ব তৈরী হয়েছিল, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই তিনি তা ঘুচিয়ে ফেলেন।  তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই তিনি চীনের সাথেও সম্পর্কের গভীরতা বাড়াতে পেরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বিরোধীতা করলেও তিনি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হননি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু বলেন, “কূটনৈতিক দিক থেকে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট। তিনি দ্বিতীয়বার এমন একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, যখন আন্তর্জাতিক কতগুলো পরিস্থিতি, বিশেষকরে উগ্রপন্থী সহিসংতার কারণে সারাবিশ্বই উদ্বিগ্ন। এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সাথে রাশিয়া, চীনেরও কোনো বিরোধ নেই; বরং তারা সবাই একাট্টা। এই ইস্যুতে বৃহৎ প্রতিবেশী (ভারত) এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘গুড বুকে’ জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন শেখ হাসিনা। উগ্র জঙ্গিবাদ দমনের ভূমিকাই তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে। এটা তাঁর অন্যতম শক্তি।” আন্তর্জাতিকমহলে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নাজুক অবস্থানও আওয়ামী লীগকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। 

ছবি: সংগ্রহিত
ড. আতাউর বলেন, “শেখ হাসিনা খুবই দক্ষতার সাথে সব সামলে নিয়েছেন। তাঁর শাসনামলের দুইটি দিক আছে, একটা রাজনৈতিক এবং অন্যটা অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক দিকে তিনি ভালো করেছেন, এটা মোটামুটি সব মহলই স্বীকার করছে। বৈষম্য, দুর্নীতি, অর্থপাচার বেড়েছে, তবুও অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শেখ হাসিনার একটি বড় অর্জন। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর কিছু নেতিবাচক অর্জনও আছে।” ২০১৪ সা‌লের ‌নির্বাচ‌নের আগে ও প‌রে বি‌রোধী দলীয় নেতাকর্মীরা গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা‌ণ্ডের শিকার হ‌য়ে‌ছেন ব‌লে অভি‌যোগ আছে। তার শাসনামলে প্রায় সাড়ে পাঁচশ গুমের ঘটনা ঘটেছে। সেইসঙ্গে ঘটেছে কয়েক হাজার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘খুব বেশী’ কথা বলাও ‘ঝূঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তাঁর ভাষ্য, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তিনি ‘জিরো-টলারেন্সের’ কথা বলেছিলেন, তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এটা ছিল। কিন্তু গত ১০ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো কমেইনি, বরং এর সাথে যুক্ত হয়েছে গুম। মানুষ আগেও ‘গুম’ হয়েছে, কিন্তু এটা মাত্রাতিরিক্ত ঘটেছে এই সময়টায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মি-সমর্থক নেতা থেকে শুরু করে সাবেক রাষ্ট্রদূত, এমনকি সেনাকর্মকর্তারাও গুম হয়েছেন। এই যে বর্বরতা, এটা বাঁধাহীন ভাবে নির্বিচারে চলেছে। এটা সরকারের বিরোধী মতের ওপর দমন পীড়নেরই বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি।” 

ছবি: সংগ্রহিত
গত বছর সরকা‌রি চাক‌রি‌তে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়‌কের দা‌বি‌তে স্কুল ক‌লেজ শিক্ষার্থী‌দের আন্দোলনও ক‌ঠোরভা‌বে দমন করার অভি‌যোগ আছে শেখ হাসিনার বিরু‌দ্ধে।  বিত‌র্কিত ধারা বহাল রে‌খে ডি‌জিটাল নিরাপত্তা আইন পাস ক‌রে মত প্রকা‌শের অধিকার ক্ষুণ্ন করার দায়ও বর্তা‌নো হয় তাঁর ওপর। এ ব্যাপারে লিটন বলেন, “তুমুল প্রতিবাদের পরও বাকস্বাধীনতা হরণকারী আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাকে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরো শক্তভাবে প্রতিস্থাপিত হতে দেখলাম। এসব আইনে অনেক ক্ষেত্রে জামিনের অধিকারও দেওয়া হয়নি।মত প্রকাশের দায়ে ইতিমধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, নারী অধিকার কর্মি, সমাজকর্মি, ছাত্রসহ অসংখ্য মানুষকে কারাবরণ করতে দেখেছি।” 
ড. শান্তনু বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখছে একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বাক-স্বাধীনতাহরনকারী আইন জারির অভিযোগ রয়েছে; অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের ঝূঁকি অসাধারণভাবে কমে গিয়েছে। যে কারণে অভ্যন্তরীন কোনো ইস্যুতে তারা শেখ হাসিনার সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, বাক-স্বাধীনতাহরন আমাদের শাসনব্যবস্থার অংশ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে বড় অভিযোগগুলো, সেগুলোও অনেকখানি ‘ব্লার’ (অস্পষ্ট) করে দিতে পেরেছে।” 
যদিও লিটনের দাবি, “রোহিঙ্গাদের বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থান অবশ্যই মানবিক। তবে তা দিয়ে আভ্যন্তরীন মানবাধিকার লংঘনকে ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা (মানবাধিকার কর্মিরা) দীর্ঘদিন ধরেই একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। যে কমিশন ২০০৪ সালের পর থেকে এখন যত বিচার বহির্ভূত হত্যা বা গুম হয়েছে তা তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করবে, বিচারের আওতায় আনবে। আওয়ামী লীগ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অর্থাৎ এই ইস্যুতে শেখ হাসিনার নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।” 

নানা ‘বিতর্ক’ থাকলেও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল উল্লেখ করে  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অরুন বলেন,  এক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা সফল হয়েছেন। বিরোধীরা সবসময় তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ বললেও তিনি তাদের সাথে সংলাপ করেছেন। রাজনৈতিক কৌশলে পরাভূত হয়ে সব রাজনৈতিক দলই এবার তাঁর সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল, তারই জেরে দীর্ঘদিন এদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন হয়নি।”
অরুন আরো বলেন, “মূলত সামরিক শাসন বারবার এই আস্থা-বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনেছে। শেখ হাসিনা এই নির্বাচন সফলভাবে সামলিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সেই আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে এনে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর এই ভূমিকা ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লেখা থাকবে।” 
তবে “শেখ হাসিনার ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা আছে,” উল্লেখ করে ড. শান্তনু বলেন, “কিছুদিন আগে আমরা দেখতে পেয়েছি তিনি ‘কওমী জননী’ উপাধিও পেয়েছেন। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁর দলটি ধর্মনিরপেক্ষ।” এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি আতাউরের অভিমত, “অনেক সময় তাঁকে (হাসিনা) আপোষও করতে হয়েছে। যেমন – ইসলামিক দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের দূরত্ব ঘোচাতে নমণীয় হয়ে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন।” 
দেশের ডানপন্থী রাজনীতির মূলশক্তি হিসেবে বিএনপির শক্তিশালী খর্ব হওয়ায় সৌদিআরবসহ মুসলিম বিশ্বের ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে বিএনপি একচেটিয়া অবস্থান টলে গেছে বলে দাবি করেছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, মুসলিম দেশগুলোর কাছে শেখ হাসিনাও এখন গ্রহনযোগ্য একটি নাম। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দেওয়াটা তাঁর জন্য খুবই ইতিবাচক হয়েছে। 
ছবি: সংগ্রহিত
২০১৭ সালে রো‌হিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর ব্রিটেনভিত্তিক গণমাধ্যম চ্যানেল ফোরের একটি প্রতিবেদনে তাঁকে ‘মাদার অফ হিউম্যা‌নি‌টি’ আখ্যায়িত করা হয়। এর আগে তাঁর শাসনামলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসান হয়েছিল।  শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং পরিবেশ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হাসিনাকে বিভিন্ন সম্মানসূচত ডিগ্রি এবং পুরস্কার প্রদান করেছে। 

ব্যক্তিগত জীবন ও স্বজন :  ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মানো শেখ হাসিনার পরিবারের সাথে ১৯৫৪ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ানরত অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার সাথে। তিনি ২০০৯ সালের ৯ মে ইন্তেকাল করেন। এই দম্পত্ত্বির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। 

ছোট বোন শেখ রেহানাকে আদর করছেন শেখ হাসিনা
ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ একজন তথ্য প্রযুক্তিবিদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টাও। মেয়ে সায়মা হোসেন ওয়াজেদ একজন মনোবিজ্ঞানী এবং তিনি অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণে কাজ করছেন।  সাধারণত অবসর পান না শেখ হা‌সিনা, পে‌লেই রান্না ক‌রেন, বই প‌ড়েন। এছাড়া তিনি তাঁর সাত না‌তি-নাত‌নি‌র স‌ঙ্গে সময় কাটা‌তে ভালবা‌সেন তি‌নি। গত বছরের নভেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া তথ্যচিত্র ‘হাসিনা: এ ডটার্স টেল’ –এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। 
চলতি মাসে নিজ দলের নেতাদের দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষ এবং দেশের সূবর্ণ জয়ন্তীতেও ক্ষমতায় থাকছে তাঁর দল। তবে  “তিনি লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকা শুধু তাঁর দল নয়, সমগ্র জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলছিলেন ড. শান্তনু।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) এই নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, “দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় বর্তমানে আওয়ামী লীগে অনেক আবর্জনা যুক্ত হয়েছে। সরকারি দল হিসেবে তাদের এখন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে আগামীতে তাদের নাম করে কেউ অপরাধ করার সাহস না পায়।”  নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন,  “চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে শেখ হাসিনা যে অপূর্ব সুযোগ পেয়েছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এরকম সুযোগ খুব কম মানুষ পেয়েছে। আশা করি, তিনি এটার সদ্বব্যবহার করবেন।”
newsreel [সংবাদচিত্র]