Powered By Blogger
একাত্তর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
একাত্তর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

০৫ মার্চ ২০২১

সেনারা ব্যারাকে ফিরেছে!

আজ  ৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পঞ্চম দিনের মত হরতাল পালনকালে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় চার শ্রমিক শহীদ হন এবং ২৫ জন শ্রমিক আহত হন। এ সংবাদে ঢাকায় জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যায় সরকারিভাবে ঘোষনা করা হয়, আজ ঢাকায় সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতালের পর ব্যাংক খোলা থাকে। মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদানের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। 

লাহোরে দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড এ ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকেলে করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছোন। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। 

রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশী বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব জনাব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকেলে কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষকবৃন্দ মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ করেন।

ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে লাঠি মিছিল বের হয়।  নিহতদের স্মরণে তারা গায়েবানা জানাজা পড়ে। আওয়ামী লীগ কর্মিরাও লাঠি হাতে বিক্ষোভ করে। 

এগার দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান।

রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পিপলস পার্টির প্রধান জেড. এ. ভুট্টোর আলোচনা বৈঠক শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, তা অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।

০৪ মার্চ ২০২১

ভেঙ্গে পড়ে প্রাদেশিক শাসন

সংগ্রহিত
আজ ৪ মার্চ। একাত্তরের এই দিনে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকা-সহ সারা বাংলায় সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দু্ইটা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ছয় জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে আজ নিয়ে দু’দিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে।
বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার্থ শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রী ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন।
রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে প্রচার শুরু করে। বেতার টেলিভিশন শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বানে সাড়া দেয়ায় তিনি বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান। তিনি ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পান নি, শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
একই দিনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অনতিবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালির অধিকার দাবি করেন।
পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন ঢাকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বান করার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিৃবতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণ-বিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দেশের সংহতির জন্য তাঁর দল যদ্দুর সম্ভব ছয় দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিষ্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবো।’ একই দিন করাচী প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

০৩ মার্চ ২০২১

শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো: বঙ্গবন্ধু

ছবি: সংগ্রহিত
আজ ৩ মার্চ। অগ্নিঝড়া একাত্তরের এই দিনটিও উত্তাল ছিল আন্দোলনে। এটিই ছিল জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার পূর্ব ঘোষিত দিন। কিন্তু এই দিন সমগ্র বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রদেশে) জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দিনের জন্য সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এ সময় দেশের সব শহরের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ও বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর এবং সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়।

রংপুওে এই দিন পাক সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুর আড়াইটা থেকে ২৪ ঘন্টাব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। সিলেটে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকায় কারফিউয়ের মেয়াদ শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ১০ মার্চ ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়, এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। 
ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই দিন বটতলায় জমায়েত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু জনতা তার কাছে তাৎক্ষণিক এবং সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার দাবি জানায়। 

এদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘স্বাধীনতার ইশতাহার’ ঘোষণা করে। ছাত্রনেতা এএসএম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাহজাহান সিরাজের যৌথ নেতৃত্বের এই পরিষদ ইস্তেহারও বিলি করে। ইস্তেহারে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এত দ্বারা ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশ এখন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।’ এতে এর তিনটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ ছিল। এগুলো হচ্ছে বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ, বৈষম্যের নিরসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। একইসঙ্গে এতে আন্দোলনের ধারা হিসেবে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলা হয়।

এর আগে সমাবেশের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বুলেটে আহতদের জীবন রক্ষার জন্য জনগণের প্রতি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলার স্বাধিকার বিরোধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে।

১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত রণতরী

মুক্তাঞ্চলে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার
মেজর রফিকুল ইসলাম।
আজ ১৫ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল বুধবার। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকে মোকাবেলায় করতে প্রস্তত হওয়া ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে এই দিন সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এরপরই মার্কিন নৌবহর নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। ফলে পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির মনে যুদ্ধে সাহায্য পাওয়ার যেটুকু আশা ছিল শেষ হয়ে যায়। তখন রণাঙ্গনে চলছে মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলায় অবরুদ্ধ ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

একাত্তরের এই দিনে চারদিক থেকে পরাজিত হতে হতে পাকিস্তানী বাহিনী বুঝে ফেলে যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। ফলে সকালে সব আশা ছেড়ে দিয়ে শর্তসাপেক্ষে আত্ম-সমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেন নিয়াজি। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরা সেই প্রস্তাব পাঠিয়ে দেয় দিল্লীর মার্কিন দূতাবাসে। সেখান থেকে পাঠানো হয় ওয়াশিংটনে। এরপর ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের কাছে জানতে চায়, নিয়াজির এই প্রস্তাবে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সমর্থন আছে কি’না। 
প্রস্তাবের মূলকথা, ‘আমরা যুদ্ধ বন্ধ করেছি। তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত গোটা পাকবাহিনীকে চলে যেতে দিতে হবে, কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না।’ কিন্তু ভারত সরকার এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে এই আশ্বাস দিতে রাজি হয় যে, যুদ্ধবন্দিরা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার পাবে। 
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা।
পাকি জেনারেল নিয়াজীর শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেয়ে ভারতীয় বাহিনী মনে করে এটি তার কৌশল। নিয়াজীর প্রস্তাবকে তাদের কাছে মনে হলো এটি যুদ্ধবিরতি, আত্মসমর্পণ নয়। কিন্তু মিত্রবাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুতেই রাজি নয়। পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজির দেয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের জবাবে বিকালে জেনারেল মানেকশ পাকিদের জানিয়ে দেন যে, শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হবে না।
প্রস্তাবের প্রতি মিত্রবাহিনীর আন্তরিকতার নিদর্শন হিসাবে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে বলেও পাকিস্তানী জেনারেলকে জানিয়ে দেয়া হয়। এমনকি আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী কোন প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না এমনটা তাকে আশ্বস্ত করা হয়। একইসঙ্গে তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে আরো বলা হয় যে, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টা থেকে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করা ছাড়া মিত্রবাহিনীর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। 
জেনারেল নিয়াজি তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে পাকিস্তান হেডকোয়ার্টারকে অবহিত করেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দেন যে, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের জন্য যে সব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেওয়া যেতে পারে। এ নির্দেশ পেয়ে সেনানিবাসে নিজের কক্ষে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিয়াজি। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রাত দুইটার মধ্যে বাংলাদেশের সব জায়গাযয় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তারবার্তা পাঠান। এদিনটি মূলত দখলদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিন-ক্ষণ নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়।

ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী বাঙালী।
একই দিনে ঢাকার বাসাবোতে ‘এস ফোর্সে’-র মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। জয়দেবপুরেও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় তারা। টঙ্গী, ডেমরা, গোদনাইল ও নারায়ণগঞ্জে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় দখলদার বাহিনী। এছাড়া এদিন সাভার পেরিয়ে গাবতলীর কাছাকাছি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয় মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট।

ভারতীয় ফৌজের একটি প্যারাট্রুপার দল পাঠিয়ে ঢাকার মিরপুর ব্রিজের পাকিস্তানী ডিফেন্স লাইন পরখ করে নেয়া হয়। রাতে যৌথ বাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদিরীয়া বাহিনী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। রাত দুইটার দিকে যৌথ বাহিনী পাক সৈন্যের মুখোমুখি হয়। যৌথ বাহিনী ব্রিজ দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। ব্রিজের ওপাশ থেকে পাকবাহিনী মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম পাড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। সারারাত তুমুল যুদ্ধ চলে। 
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যে কোন মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। চারদিক থেকে ঢাকা অবরূদ্ধ। এদিন দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়- ‘ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীকে তাড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা মুক্ত বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। দেশের ভেতর বাড়ি-ঘর থেকে বিতাড়িত লোকজনও বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করেছে।’ এ সময় জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, নেজামী ইসলামীর নেতাকর্মীরা অনেকেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। আবার অনেকেই আত্মগোপন করে।
চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী কুমিরার দক্ষিণে আরো কয়েকটি স্থান হানাদার মুক্ত করে। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম শহরের প্রথম রক্ষাব্যুহ ভাটিয়ারীতে আক্রমণ চালায়। সারারাত মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলে। ভাটিয়ারি থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। 
পাকিদের এক স্থানীয় দোসরের পরিণতি। 
ওদিকে যৌথবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হয়। রাতে তারা চারদিক থেকে রংপুর শহর ঘিরে ফেলে। পরের দিন রংপুর সেনানিবাসে আক্রমণ করার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ বিরতির ঘোষনা হওয়ায় তার আর প্রয়োজন হয়নি। 

ফরিদপুর অঞ্চলে যৌথবাহিনী কামারখালীর পাকঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। সাঁড়াশী আক্রমণের মুখে তারা অবস্থান ছেড়ে ফরিদপুর শহরের দিকে পালাতে থাকে। যৌথবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। পথে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে স্বেচ্ছায় শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী অফিসারদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল ছিলেন। 
একই দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানী কমান্ডারদের আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মত নির্দেশ দেন। জেনারেল মানেকশ বলেন, ‘আমি আবার বলছি, আর প্রতিরোধ করা নিরর্থক। ঢাকা গ্যারিসন এখন সম্পূর্ণভাবে আমাদের কামানের আওতায়।’ এই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবি ডা. আলীম চৌধুরী এবং বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর নিহত হন।
তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

পদত্যাগ করে প্রাদেশিক সরকার

পাকিস্তানী অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে মিত্রবাহিনী।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঢাকা বিজয়ে মিত্রবাহিনী আগের দিন রাত থেকেই সর্বাত্মক হামলা শুরু করে দিয়েছে। তাদের আগ্রাসী আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্তারা পদত্যাগ করে আন্তর্জাতিক সেচ্ছাসেবী সংস্থা রেডক্রস ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। 

তখন চীন-মার্কিন সামরিক সাহায্য পাওয়ার আশা নিয়ে পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি তখন প্রকাশ্যে বলছেন, ‘শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব’। আর ভেতরে ভেতরে ভারতের সেনাপ্রধান মানেকশ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপদ আত্মসমর্পণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনই প্রেক্ষাপটে রাতের অন্ধকারে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার নীল-নকশা বাস্তবায়ন করে তাদের এদেশীয় দোসরেরা। 
একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামান অবিরাম গোলা ছুঁড়ে চলে। নিয়াজিসহ পাকি হানাদারদের হৃদকম্প তখন তুঙ্গে। মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা গিয়ে পড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও। সে গোলার আওয়াজে তখন গোটা শহর কাঁপছে। 
পাকিস্তানের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর ড. আবদুল মুত্তালিব মালিক সেদিন সকালেই ‘সমগ্র পরিস্থিতি’ বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। এ বৈঠক বসানোর ব্যাপারে তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী এবং চীফ সেক্রেটারি মুজাফফর হোসেনের হাত ছিল বলে গোপন নথিপত্র সাক্ষী দেয়। পাকিস্তানি সামরিক সিগন্যাল কোড ভেঙে থেকে কয়েক ঘণ্টা আগেই এ বৈঠকের খবর পেয়ে যায় ভারতের বিমান সদর দফতর।বৈঠক চলাকালে গভর্নর ভবন আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। 
বৈঠক বসে বেলা ১১টা নাগাদ। মেঘালয়ের শিলং বিমান ঘাঁটি থেকে প্রেরিত অর্ধ ডজন মিগ-২১ সঠিক সময়ে গভর্নর ভবনের উপর নির্ভুল রকেট আক্রমণ চালায়। গোটা পাঁচেক রকেট গিয়ে পড়ে গভর্নর হাউসের ঠিক ছাদের ওপর। মালিক ও তার মন্ত্রীরা ভয়ে প্রায় কেঁদে ওঠে। চীফ সেক্রেটারি, আইজি পুলিশসহ বড় বড় অফিসারও মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তারাও ভয়ে যে যেভাবে পারলেন পালালেন। 
হামলার পর গভর্নর হাউস, যা বর্তমানে বঙ্গভবন।
বিমান হানা শেষ হওয়ার পর গভর্নর মালিক আবার বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষ হতে অবশ্য পাঁচ মিনিটও লাগেনি। তারা সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেডক্রস কমিটির ঢাকা প্রতিনিধি রেনডকে জানায় এবং তার কাছে আশ্রয় চায়। রেনড সাথে সাথে এ খবর পৌঁছায় জেনেভায়। তার বার্তায় বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছে এবং রেড ক্রস আন্তর্জাতিক অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছে। জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকারকে যেন অবিলম্বে সব ঘটনা জানানো হয়। খবরটা যেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীকেও জানানো হয়।’ 
রেডক্রস তখন ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণা করেছে। বহু বিদেশী ও পশ্চিমা পাকিস্তানীরা গিয়ে আশ্রয় নেয় সেখানে। 
মালিকের নেতৃত্বাধীর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অমন সিদ্ধান্তের পর নিয়াজির অবস্থা আরো কাহিল হয়। আত্মসমর্পণের পর হামলা নয়, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইছিলেন জেনারেল নিয়াজিসহ পাকবাহিনীর অন্যান্য জেনারেলরা। তবে গোটা দুনিয়ায় তখন সপ্তম নৌ-বহরের বঙ্গোপসাগরে আগমণ নিয়ে জোর জল্পনা-কল্পনা চলছে। 

নিয়াজি
মার্কিন সরকার যদিও ঘোষণা করেছিল যে, কিছু আমেরিকান নাগরিক অবরুদ্ধ, বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করেনি। বিশ্ববাসীর মনে তখন প্রশ্ন ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের মাঠে নামাবেন? এ নিয়ে সর্বত্র যখন তুমুল আলোচনা ঠিক তখন মিত্রবাহিনী প্রচণ্ডভাবে ঢাকার বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও এই দিনও তারা ঠিক জানে না যে, ঢাকার ভেতরের অবস্থাটা কি বা পাকবাহিনী কিভাবে ঢাকার লড়াইয়ে লড়তে চায় এবং ঢাকায় তাদের শক্তিই বা কতটা। তবে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট।
নানা চেষ্টায় কিছু খবর আসলেও আসল খবর কিছুতেই পাওয়া গেলো না। মিত্রবাহিনী মনে করল, ঢাকার ভেতরে লড়াই করার জন্য যদি সৈন্যদের এগিয়ে দেয়া যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে যদি বিমান আক্রমণ চালানো হয়, তবে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষও মরবে। মিত্রবাহিনী এটা কিছুতেই করতে চাইছিল না। তারা একদিকে যেমন ফের পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আবেদন জানায়, অন্যদিকে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের শহর ছেড়ে চলে যেতে বলে। 
মুক্তিযোদ্ধারা।
উত্তর এবং পূব দুদিকেই তখন বহু মিত্রসেনা এসে উপস্থিত হয়। চাঁদপুরেও আরো একটা বাহিনী নদীপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য তৈরী হয়। ঠিক এমন দিনেই হানাদার পাকিস্তানি ও তাদের দোসরেরা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। আজকের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় পুরো জাতি সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করছে। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১৩ ডিসেম্বর ২০১৮

ঢাকার ১৫ মাইলের মধ্যে মিত্রবাহিনী

মিত্রবাহিনীকে ঘিরে জনতার উল্লাস।
আজ ১৩ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ সোমবার। বাংলার জমিন থেকে ঔপনিবেশিক এই নাম মুছে যেতে আর মাত্র দুই দিন বাকি। এদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছায়। 
অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় ঢুকে পড়ে। এমনকি অজস্র নিরস্ত্র জনতাও রাস্তায় নেমে আসে। গা ঢাকা দেয় পাকিস্তানের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর ড. আবদুল মুত্তালিব মালিক ও তার সহচরেরা। তবে এই দিনও বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতায় সক্রিয় ছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। 
একাত্তরের এই দিনে চারদিকে উড়তে থাকে বাঙালির বিজয় নিশান। শুধু ময়ানমতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ জন। আর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা। ভারতের ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড ঢাকার দিতেক এগিয়ে যায় পূর্বদিক থেকে। উত্তর দিক থেকে আগায় জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড। 

এদিন টাঙ্গাইলে আরো ছত্রিসেনা অবতরণ করে। পশ্চিমে চার নম্বর ডিভিশন মধুমতি পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মা নদীর তীরে। রাত নয়টায় মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং সন্ধ্যা থেকে টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে নয়টায় টাঙ্গাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউজে তারা পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন। 

আলোচনার শুরুতে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। রাস্তাতেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।’ এ সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহর ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পৌঁছায়। 
সমুদ্রপথে শত্রুদের পালানোর সুযোগ কমে যাওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ঢাকা চূড়ান্ত লড়াইয়ের স্থল বলে চিহ্নিত হতে থাকায় তাদের সম্ভাব্য নিয়তির আশঙ্কাও দ্রুত বাড়তে থাকে। 
মিত্রবাহিনীকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।
চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে এগুনোর পথে নাজিরহাটে হানাদাররা বাধা দেয়। এখানে ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদের তিন কোম্পানি এবং বেশকিছু ইপিসিএএফসহ অবস্থান নিয়েছি। এখানে ব্যাপক যুদ্ধের পর পালিয়ে যায় হানাদাররা। এদিকে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ২০-ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে মুরাপাড়ায় পৌঁছায়। 

যৌথ বাহিনীর অগ্রবর্তী আরেকটি সেনাদল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার পাঁচ/ছয় মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। বালু নদীর পূর্বদিকে পাকিস্তানি বাহিনী শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার চারদিকে আগে থেকেই পাকিস্তান বাহিনী ফিল্ড ডিফেন্স বা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থাসহ অবস্থান নিয়েছিল। 

ওদিকে খুলনা এবং বগুড়ায় এই দিন হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় মানুষের অবিরাম যুদ্ধ চলে। মুজিবনগরে তখন চরম উত্তেজনা। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবর্তন ও পরিবেশন করেন। প্রতি মুহূর্তে খবর আসছে ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা মুক্ত। 
আকাশ, জলে, স্থলে সবদিকে হানাদাররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিকে জানান, ‘আরো সাহায্য চাই।’ 
কেন্দ্রের সামরিক কর্তারা ঢাকায় অবস্থানরত ঘাতকদের এই বলে আশ্বস্ত করে, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। পশ্চিম খন্ডে ভারতীয় বাহিনীকে এমন মার দেয়া হবে যে তারা নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইবে ও যুদ্ধ থেমে যাবে।’ কিন্তু তাদের জন্য সেদিন আর আসেনি। তবে এই দিনও পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে রাজী করানোর কাজে ইসলামাবাদে সারাদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায়। 
পিকিং-এ পাকিস্তানী দূতাবাসেও দেখা যায় কর্মতৎপরতা। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের এই মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সিকিম-ভুটান সীমান্তে থাকা চীনা সৈন্যবাহিনীকে কিছুটা তৎপর হতে দেখা যায়, কিন্তু ভারতে যে তা বিশেষ উদ্বেগের সঞ্চার করেছিল এমন নয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী সদর দপ্তরে বাংলাদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক অসফল প্রয়াসও ঠিক এই দিনই পরিলক্ষিত হয়। 
কলকাতায় ১৩ ডিসেম্বর সকালে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে প্রায় মাসাধিককাল যাবত অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুব আলম চাষী যুদ্ধবিরতির এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রস্তাবিত বিবৃতির প্রধান বক্তব্য ছিল- ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয় তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে।’ 

বাংলাদেশ তখন ভারতের সঙ্গে যুগ্ম-কমান্ডব্যবস্থায় আবদ্ধ, কাজেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি যদি একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতেন, তবে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে এককভাবে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া নীতিগতভাবে অসিদ্ধ হতো। সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই সৈয়দ নজরুল ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর দানে অসম্মত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের গোচরে আনেন। 

নিউইয়র্কে এই দিন নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আবারো তৃতীয় সোভিয়েট ভোটের মুখে বাতিল হয়ে যায়। যে কারণেই হোক সামরিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নে চীনের সম্মতির সম্ভাবনাকে তখনও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ বাতিল করে উঠতে পারেনি। কাজেই সেই ভরসায় চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর সপ্তম নৌবহরকে পুনরায় সচল করা হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকার আকাশ থেকে পাকিস্তানি সামরিক অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালানো হয়। ঢাকার সর্বত্র অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। এইদিন তারা প্রকাশ্যে সড়কে নেমে আসে। পাকিস্তানি সেনা নায়কদের মনোবল উঁচু রাখার সামান্যতম অবলম্বন কোথাও ছিল না। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হস্তক্ষেপ।
যুদ্ধ জয় নিশ্চিত জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশী নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সবরকমের সুযোগ-সুবিধা দেবে।’
উল্লাসিত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসী।
এই দিন শান্তি কমিটি, ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা বেশিরভাগই অবস্থা বেগতিক দেখে গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু এর মধ্যেও ঘাতক আলবদর চক্র সক্রিয় ছিল। যার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ ঘটেে দেশের কৃতী সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায়। এদিনে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় কিছু আল বদর কর্মী। পরে ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১২ ডিসেম্বর ২০১৮

যুক্তরাষ্ট্রের হুমকীর মুখেও অটল ভারত

অগ্রগামী মিত্রবাহিনী।
আজ ১২ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ রবিবার। বাংলার জমিন থেকে ঔপনিবেশিক ওই নাম মুছে যেতে তখনও তিন দিন বাকি। যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধে জড়ানোর হুমকী এদিন প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করে ভারত। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা দীর্ঘ বক্তব্য দেওয়ার পর মুলতবি হয়ে যায় অধিবেশন। একইদিনে তৈরী হয় বুদ্ধিজীবি হত্যার চূড়ান্ত নীল-নকশা। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে ৯ ডিসেম্বর রওনা করা যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর এই দিন বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘন্টার দূরত্বে এসে গভীর সমুদ্রে অবস্থান নেয়। আগের দিন ( ১১ ডিসেম্বর) প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার রাশিয়ার ওয়াশিংটন প্রতিনিধির মাধ্যমে ভারতকে একদিনের মধ্যে যুদ্ধ থামানোর আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। নয়ত যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে এ যুদ্ধে অংশ নেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তবুও এই আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ মহাসচিক উ থানকে এক বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জানান, ‘পাকিস্তান যদি শুধু বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছুতে সম্মত হয়; তবে ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পাশপাশি ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে।’ 
সপ্তম নৌবহরের সর্বশেষ অবস্থান খবর তখনও ভারতে কেবল স্বল্প সংখ্যক নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে সীমিত। তবু মার্কিন প্রশাসনের হুমকির প্রকাশ্য জবাব দেয়া ও ভারতের জনসাধারণকে আসন্ন বিপদ ও কঠোর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ১২ ডিসেম্বর দিল্লীতে বিশেষভাবে আয়োজিত এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ‘সম্মুখের অন্ধকার দিন’ ও ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের সম্ভাবনা’ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করেন। একই দিন পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন। সাংবাদিকদের সাথে আলাপে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।’ 

অন্যদিকে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানান। তিনি তার দলের সদস্য ও সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, মুক্তিসংগ্রামে জয় লাভের আর দেরি নেই। অন্যদিকে দিল্লীতে কুজনেটসভ এবং মস্কোতে ডি পি ধরের যুগপৎ আলোচনার ফলে দ্রুতগতিতে উভয় সরকার মার্কিন ও চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি মোকাবিলায় যুগ্ম ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হন। 
ভারতীয় নৌ-বাহিনী এই দিন সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য তৎপরতা বিঘ্নিত করতে চালনা থেকে কক্সবাজারের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থানরত সব ছোট-বড় নৌযান, উপকূলীয় অবকাঠামো; এমনকি কক্সবাজার বিমানবন্দরও ধ্বংস বা অকেজো করে ফেলে। 
পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজিকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান টেলিফোন করে পশতু ভাষায় জানান, পরদিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে। তিনি মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সাহায্য পাওয়ার ইঙ্গিত দেন। এরপরই নিয়াজির নির্দেশে ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রতিরক্ষার আয়োজন নিরঙ্কুশ করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার কারফিউ জারি। একইসঙ্গে ঘরে ঘরে তল্লাশী শুরু হয়। 

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল।
এরই মাঝে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশিদের সড়িয়ে নিতে তিনটি ব্রিটিশ বিমান এসেছিল। একাত্তরের দিনলিপির এই দিনে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন, “এয়ার্পোরটের দিকে দেখা যাচ্ছে তিনটা প্লেন বারবার নিচে নামার চেষ্টা করছে, আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। আমাদের ছাদের ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায়। জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা থেকে অপসারণের জন্য এই চেষ্টা। কিন্তু ভারতীয় বিমান বোমা ফেলে রানওয়েটা বেশ ভালো জখম করে রেখেছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাণান্ত চেষ্টা করে প্লেনগুলো নামল, খানিক পরে উঠেও গেল। ওরা উড়ে চলে যাবার পরপরই ফটাফট দুটো বোমা রানওয়েতে মেরে দিয়ে গেল ভারতীয় প্লেনগুলো। আরো ভালো করে দেখার জন্য সিঁড়িঘরের ছাদের টঙ্গে জামী একবার উঠেছিল। ওখানে উঠলে এলিফ্যান্ট রোডের বুকটাও দেখা যায়। জামী নেমে এসে বলল, আচ্ছা মা, সারাদিন কারফিউ অথচ এত মাইক্রোবাস যাচ্ছে কেন রাস্তা দিয়ে? এগুলো তো মিলিটারি গাড়ি নয়।”

রাতে প্রাদেশিক সরকারের উপদেষ্টা মেজর রাও ফরমান তার এ দেশীয় দোসর আল-বদর ও আল-শামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের সদর দফতরে ডেকে পাঠান। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এক গোপন বৈঠক। এই গোপন বৈঠকে বুদ্ধিজীবি হত্যার নীল-নকশা প্রণয়ন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান তাদের হাতে বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা তুলে দেন। এই নীল-নকশা অনুযায়ী দুই দিন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় জাতির মেধাবী সন্তানদের। 
এর আগে ১২ তারিখ রাতেই  এপিআই এর জেনারেল ম্যানেজার সাংবাদিক নিজামউদ্দিনকে আল-বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের দোসরা যখন নিজামউদ্দিনের বাসায় হানা দেয় তখন তিনি বিবিসি এর জন্য রিপোর্ট তৈরি করছিলেন। ওই অবস্থায় ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আ ন ম গোলাম মোস্তফাও নিজ বাসভবন থেকে অপহৃত হন। তিনিও আর কখনো ফিরে আসেননি।
মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাস, ডিসেম্বর ১৯৭১।
ওদিকে রণাঙ্গনে পাকিদের পশ্চাদপসরণের ধারা অপরিবর্তিত থাকে। এই দিন সকালে শত্রুমুক্ত হয় নরসিংদী। বিকেলে ভারতের আর একটি ইউনিট (৪ গার্ডস্) ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে রাতে প্রচ- আক্রমণ চালায়। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়া বাহিনী। সেখানে তুমুল যুদ্ধের পর ফলে ঢাকা অভিযানের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ পথের সদ্ব্যবহার শুরু হয়। 

দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী খানসামা থানা আক্রমণ করে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১৫ জন ও সাত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের হাতে এক মেজরসহ পাকবাহিনীর ১৯ জন ধরা পড়ে। তবে এদিনই দিনাজপুরের বিরল থানায় বহলা গ্রামে ঘটে গণহত্যার নৃশংস ঘটনা। এদিন নীলফামারী , গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ি, ভেড়ামারা এবং শ্রীপুরও হানাদারমুক্ত হয়। 

১১ ডিসেম্বর ২০১৮

বেসামাল প্রেসিডেন্ট, গভর্নর দিশেহারা

পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে গোলা ছুড়ছে মিত্রবাহিনী।
আজ ১১ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ শনিবার। নামটি মুছে যাওয়ার তখন আর মাত্র চার দিন বাকি। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এদিন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ তবে কিসিঞ্জার জানতেন, রণাঙ্গনে আসন্ন বিজয় দৃষ্টে ভারত এই চরমপত্র অগ্রাহ্য করবেই। 
ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তখন বেসামাল আর ঢাকায় দিশেহারা গভর্নর ড. আবদুল মোত্তালেব মালিক ও তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলি। তবুও পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো ক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া চলবে না। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে আরো উজ্জ্বল করবে।’ ঢাকা বিমান বন্দর পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়েও আলাপ করেন।
একাত্তরের এই দিনে যুদ্ধক্ষেত্রে যৌথবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই চলতে থাকে। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর হানাদাররা ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 
ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে তখন চারদিক থেকে ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বাংলার বীর মুক্তি সেনারা এগিয়ে আসছে। পথে পথে যেসব জনপদ, গ্রাম, শহর-বন্দর ছিলো সর্বত্রই মুক্তিসেনারা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। 
এদিন জামালপুর, মুন্সীগঞ্জ, লাকসাম, আশুগঞ্জ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুরের হিলিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এ সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। যদিও এসব এলাকা মুক্ত করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ব্যাপক যুদ্ধ করতে হয়। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি। 
মিত্রবাহিনীর সাতশ সৈন্যের অবতরণ।
মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী নিয়ন্ত্রিত টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে এদিনে মিত্রবাহিনীর সাতশ সৈন্য বিমান থেকে অবতরণ করে। এ সময় পাকিস্তানী ব্রিগেডের সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ হয়। অন্যদিকে পাকবাহিনীর আরেক শক্ত ঘাঁটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও উপকূলীয় অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ ব্যাপক তৎপরতা চালায়। একের পর এক বোমা ও রকেট হামলা চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয় পাক হানাদারদের সবকিছু। আকাশ ও স্থলে মুক্তি ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা পাক সৈন্যরা নদী পথে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বত্র সতর্ক প্রহরা যে আগেই বসানো হয় ছিলো তা জানা না হানাদারদের। তাই পাকি সামরিক পোশাক ছেড়ে সাধারণ বেশে নদী পথে অনেক পাক সৈন্য পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।

ঢাকায় বেলা তিনটা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। 
অন্যদিকে যশোরের মুক্ত এলাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করে কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার মধ্যে ছিলো, এক. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। দুই. ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিন. সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে এবং চার. জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী নিষিদ্ধ করা হবে। সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পারল না।’ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শিশু রাষ্ট্রটি গড়ে তোলার দায়িত্ব এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।’ পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পরস্পরের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা অক্ষুণ রেখেই ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক।’
কাদের সিদ্দিকী, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১।
আগের দিন ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা আবেদনের মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। এই দিন সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন ওই শর্তগুলো। এক. পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। দুই. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোন লিখিত চুক্তি করবে না। তিন. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে দিতে হবে। চার. এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দিতে হবে। পাঁচ. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে।

কিন্তু এই দিন ইয়াহিয়া খান এ প্রস্তাব নাকচ করেন। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানকে যুদ্ধে সহায়তা করার দাবি জানান। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র শুধু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়ার দাবি তোলে। 

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার এই দিন বলেন, ‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদেও প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ ব্যাপারে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’ এরপরই হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করেন।

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১০ ডিসেম্বর ২০১৮

পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ নিয়াজির

আটক হওয়া দুই রাজাকার।
আজ ১০ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ শুক্রবার। এই নামটি মুছে যাওয়ার তখন আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর অবিরাম আক্রমণের মুখে আত্মসমর্পনে উদ্যত হন পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা গভর্নর ড. আবদুল মোত্তালেব মালিক ও তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলি। 
পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি এই দিন পালানোরও চেষ্টা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা করা সপ্তম নৌবহর তখন মালাক্কা প্রণালীতে। 
একাত্তরের এই সময়ে ঢাকায় পরিকল্পিত চূড়ান্ত হামলা চালিয়ে শত্রুদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে যৌথবাহিনী। মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো এদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্র স্তব্ধ করে দেয়, বোমা-রকেট ছুড়ে বিধ্বস্থ করে দেয় ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। মিত্র বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। 

এক মুক্তিযোদ্ধা।
পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটি জাহাজ তীরে এসে ভীড়লেও তারা মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি জাহাজ সাদা পতাকা উড়িয়ে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে পালানোর চেষ্টা করে। সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলেও সাফল্য অর্জন করছে। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রু বাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যৌথ বাহিনী এই তিন শহর ছাড়া রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে। 

রাতে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর সময় শহরের অদূরে যৌথ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। এ যুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার পাকিস্তানী সেনা হতাহত হয়। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। এমন সময়ে নিয়াজির গোপন অভিসন্ধি ফাঁস করে দেয় বিবিসি। 

নিয়াজি স্বীয় দুর্বলতা ঢাকার জন্য ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে এসে বলেন, ‘কোথায় বিদেশি সাংবাদিকরা, আমি তাদের জানাতে চাই, আমি কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাবো না।’ 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে এক বিশাল জনসভায় ভাষণদানকালে বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান ভারত প্রত্যাখ্যান করেনি বা গ্রহণও করেনি। প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্ভব হবে যখন বাংলাদেশ সরকার কায়েম হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থী তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে।’ 

অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন ও রণকৌশল গ্রহণ করার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈযয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। ভারতের পক্ষে সই করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

হামলায় ভয়ার্ত পাক সেনা।
একই দিন গভর্নর মালিকের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্রসংবরণ কথাটি ব্যবহার করা হয়। 

এই আবেদনে আরো লেখা ছিলো যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তি পূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই। 

এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি মালিক-ফরমান আলী বার্তা হিসেবে পরিচিতি পায়। রণাঙ্গনের বাস্তব চাপে এই দিন পাকিস্তান নিজেই যখন সম্মানজনকভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে, তখন সেই উদ্যোগকে সমর্থন না করে মার্কিন সরকার বরং তা রদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। 
এদিনে দুঃখজনক একটি ঘটনাও ঘটে। খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীতে নৌবাহিনীর জাহাজ পলাশ নিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে এক ‘ভুল বোঝাবুঝির যুদ্ধে’ গোলার আঘাতে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। 
ঢাকায় কার্ফ্যু জারি করে আল-বদরবাহিনী তাদের কুখ্যাত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন ও পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার নাজমুল হককে বাসা থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

০৯ ডিসেম্বর ২০১৮

জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র

সৈন্যদের মাঝে জেনারেল নিয়াজি
আজ ৯ ডিসেম্বর। গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক দিবস। বছর দুয়েক আগে ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ এ দিনটি ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরে জাতিসংঘে প্রথমবারের মত গণহত্যা প্রতিরোধে এ সংক্রান্ত শাস্তি বিষয়ক প্রথাটি গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালের এ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। 
বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যার জন্ম দেওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে এই দিন সরাসরি সহযোগিতার পদক্ষেপ নেয় তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা করার আদেশ দেন। আর মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং আরোরাও জানিয়ে দেয় তারা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত। পাকিস্তানীরা অবশ্য তখন এ বাহিনীর আক্রমনের মুখে দ্রুত পশ্চাদপসরনে ব্যস্ত। দ্রুত শত্রুমুক্ত হতে হচ্ছে একের পর এক এলাকা।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে যে সমস্ত জায়গা শত্রুমুক্ত হয় তার মধ্যে দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাট অন্যতম। দাউদকান্দিতে পাকিস্তানীদের পতনের মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। 

এর আগে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ের। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। আর মিত্র বাহিনীও দ্রুত ঢাকা পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হয়। 

পূর্বাঞ্চলের এ বাহিনীর মতো পশ্চিমে আরেকটি বাহিনী তখন পৌঁছে গেছে মধুমতি নদীর তীরে। অন্য একটি বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে চলছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছে গেছে ময়মনসিংহের কাছাকাছি। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তুমুল যুদ্ধ হয়। সেখানে সেদিন নির্বিচারে গণহত্যাও চালায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। তবে শেষ অবধি টিকতে পারেনি তারা। ঢাকার আশপাশের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান মুক্ত হবার খবর আসে৷
এমন সময়ে ভারত কাশ্মীর দখলের ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এরই প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন অপেক্ষমাণ মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। ইউএস নেভি প্রত্যাসন্ন হামলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার করার জন্য সপ্তম নৌবহরকে পাঠানো হয় করাচীর সন্নিকটে আরব সাগরে নয়, বরং তার প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরের দিকে। 
কথিত ভারতীয় প্রচেষ্টা উদ্ঘাটিত হওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ আগেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় সপ্তম নৌবহরের এখতিয়ার বঙ্গোপসাগর অবধি সম্প্রসারিত করা হয়। বৃহত্তর যুদ্ধের ডামাডোলে চাপা পড়ে ঘটনার ও ব্যাখ্যার এই সব অসঙ্গতি। পরে এগুলো অক্ষত রেখেই নিক্সন ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার স্ব স্ব স্মৃতিকথায় দাবি করেন- ‘পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে সতর্ক করে দেবার উদ্দেশ্যে’ তখন সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়। তবে এটা স্পষ্টত ছিলো যে এই শক্তিশালী নৌবহর পাঠানোর মূল লক্ষ্য ছিলো বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ-অবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানী স্থল বাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং সেখানে আরো মার্কিন নৌসেনা অবতরণের ক্ষেত্র তৈরী করা।

একাত্তরের মা, কোলকাতা।
বিকেলে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা এখন বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’  সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, পাকিস্তানীরা যদি মাটি কাঁমড়ে ঢাকার লড়াই চালাতে চায় তাহলে আপনি কী করবেন? জেনারেল অরোরা জবাব দিলেন, ‘ওরা কী করবে জানি না। তবে আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত।’ সাংবাদিকরা ফের প্রশ্ন করলেন, ‘ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কী?’ অরোরা জানালেন, নদী। তারপর আবার বললেন, ‘নদী যদিও বড় বাধা, কিন্তু সে বাধা অতিক্রমের সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর আমাদের পি.টি.-৬৭ ট্যাঙ্কগুলো নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে।’ 

অরোরা জানান, মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী সেদিনই টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী এক এলাকায় সাতশ ছত্রীসেনা এবং ৮০ টন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এর আগে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার আরো বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুই দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে, আরেক অংশ রয়েছে দক্ষিণে। দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণ মিত্রবাহিনীর আক্রমণের গতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। জয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ এদিনও ফের বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমরা যদি বাঁচতে চাও, ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করো। নতুবা তোমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে।’ এর আগের দুই দিনও রেডিও ও লিফলেটের মাধ্যমে তার এমন আহবান প্রচার করা হয়।
এদিন সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে জেনারেল নিয়াজীর পাঠানো সঙ্কেত বার্তায় বলা হয়, ‘আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে সৈন্য পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও সঙ্কটাপূর্ণ।’ এরইমধ্যে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন রেডিও পাকিস্তান থেকে ভাষণ দেন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে ‘ভারতীয় হামলা’ মোকাবিলা ও ‘দুরভিসন্ধি নস্যাৎ’ করার আহ্বান জানান তিনি। মিত্র বাহিনীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তাদের নগ্ন হামলায় অসংখ্য বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।’
ওদিকে এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’
দুই মুক্তিযোদ্ধা
একই দিনে চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি এক ভাষণে বলেন, ‘ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’ জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানী নেতা মাহমুদ আলী এদিন দেশে ফিরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। সাংবাদিকদের কাছে মাহমুদ আলী সোভিয়েত ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, ‘সোভিয়েতের উচিত বিশ্বশান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো।’ চীন ও আমেরিকার সমর্থন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের নির্ভীক ও ঐতিহাসিক সমর্থনের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’

এছাড়া এদিনে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক ছিল এটি। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসণের ওপর জোড় দেয়া হয়।

০৮ ডিসেম্বর ২০১৮

যুদ্ধবিরতির তরে মরিয়া ইয়াহিয়া

সাদা পতাকা উচিয়ে ধরে পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পন, ১৯৭১। © Marc Riboud
আজ ৮ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল বুধবার। নিশ্চিত পরাজয়ের আশংকায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ড ইয়াহিয়া খান এই দিন যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে ধর্ণা দিতে থাকেন। ছেড়ে দিতে চান ক্ষমতাও। কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। কিন্তু সব বাঁধা পেরিয়ে মিত্রবাহিনী তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। একের পর এক এলাকা শত্রুমুক্ত করতে করতে চারিদিক থেকে ঢাকার দিকে আগাচ্ছে তারা। 

পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর জন্য রণাঙ্গনে আরো খারাপ অবস্থার তৈরী হয়। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। যশোরের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও তারা পালিয়ে যায়। কুমিল্লার এক অংশের পতন অনিবার্য হয়ে উঠে। অপর অংশ পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ-ভারত মিলিত বাহিনী বীরদর্পে এগিয়ে যেতে থাকে। পাকবাহিনী পশ্চাদপসরনের পর ঢাকায় নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এরপরও তাদের সামরিক অবস্থা ক্রমশ সঙ্গীন হতে থাকে। 

মুক্তিসেনাদের প্রবল প্রতিরোধে প্রাণভয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি ছেড়ে পাক হানাদারবাহিনী পালিয়ে যায় এদিন। মুক্তিসেনারা গর্বিত কন্ঠে দক্ষিণের এই তিনটি অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন। একই দিনে দখলদারিত্বের কবল থেকে মুক্ত হয় চাঁদপুর, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহের গৌরীপুর ফুলবাড়িয়া ও ভালুকা, চট্টগ্রামের মিরসরাই ও খাগড়াছড়ি, মাদারীপুরের কালকিনি, নড়াইলের লোহাগড়া, কুষ্টিয়ার মিরপুর, পলাশবাড়ী, বৃহত্তর হাওরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা। এ সময় সম্মিলিত বাহিনী ঢাকায় হানাদার বাহিনীর অবস্থানগুলোতে বিমান হামলা জোরদার করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পলায়নপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অজস্র নৃশংস গণহত্যা চালায়। 

পাকিস্তানের এক উপ-সামরিক আইন প্রশাসক এই তিন বাংলাদেশের সর্বত্র বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করে। পাকিস্তানী বাহিনী তখন বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ। রেডিওতে এ সময়ে তাদের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বিভিন্ন ভাষায় আত্মসমর্পণের বাণী দিতে থাকেন। তাঁর এই বাণী লিফলেট আকারে বিমান থেকেও ছড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলার পাশাপাশি আশ্বাস দেন যে আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। কিন্তু পাকি সামরিক শাসকরা কিছুতেই আত্মসমর্পণের দিকে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাংলাদেশে অবস্থানরত সেনাসদস্যদের নির্দেশ দেয়। 
সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধারা।
বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। হানাদার বাহিনীকে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করতে থাকে মুক্তিবাহিনী। এ সময় জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরাকে তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে দ্রুত হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। 
ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ৮ ডিসেম্বরের ঢাকার বর্ণনায় লিখেছেন, ‘সামনে এগিয়ে চলা ভারতীয় বাহিনীর কামানের গোলাবর্ষণের আওয়াজ এখন ঢাকা থেকে শোনা যাচ্ছে, সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ঢাকা। শুধু কয়েকটি টেলিফোন কাজ করছে এবং টেলিগ্রাফ মাঝে মধ্যে সচল হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানের রূপসী বাংলা হোটেল), যেখানে আমি রয়েছি, সেখানকার বাগানে একদল লোক ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে।’
পূর্ব সীমান্ত থেকে জেনারেল জগজিত্ সিং এর প্রায় সবকটা বাহিনী দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল। যৌথবাহিনীর এই অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্র দেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ পাস হওয়া যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবের ব্যাপারে এইদিন ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, ‘পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।’

অন্যদিকে পশ্চিম পাশেও এদিন পাকিস্তানের অগ্রগতি প্রায় থেমে যায়। ছম্ব, রাজস্থান-সিন্ধুসহ বিভিন্ন সীমান্তে বরং ভারতের কাছে তারা দখল হারায়। এ সময় করাচীর উপর নৌ ও বিমান আক্রমণ অব্যাহত রাখে ভারত। তবু ইস্টার্ন কমান্ডের বিপর্যয় দেখে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্তারা নিয়াজির মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য ‘চীনের তৎপরতা শুরু হয়েছে’ বলে তাকে জানায়। 
সেই উত্তাল সময়ের সাক্ষী, দ্য ডন।
এমন শোচনীয় সামরিক পরিস্থিতির মাঝে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে তার শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘদিনের ‘ওয়াদা’ বাস্তবায়ন শুরু করেন। তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে নুরুল আমিন ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। 
এই দিন সন্ধ্যায় ভারতের এক সরকারি মুখপাত্র ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয় তবে অন্যান্য সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে; বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই কোনো ভূখণ্ড দখল করার অভিপ্রায় ভারতের নেই।’ 

এই ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাদে ওয়াশিংটন সময় সকাল এগারটায় যখন ডব্লিউএসএজি -এর বৈঠক শুরু হয়, তখন জেসিএস-এর জেনারেল রায়ান উপমহাদেশের সর্বশেষ সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর জোর এগুবার কোনো লক্ষণ নেই। বরং পাকিস্তানের অগ্রাভিযান ঠেকিয়ে রেখেই তারা সন্তুষ্ট রয়েছে বলে মনে হয়।’ 
মুুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক দুই পাক সেনা।
ডব্লিউএসএজি সভাপতি হেনরী কিসিঞ্জার রায়ানের কাছে জানতে চান পূর্ব রণাঙ্গন থেকে ভারতীয় সৈন্যদের পশ্চিম রণাঙ্গনে নিয়ে যেতে কত সময় লাগতে পারে। জেনারেল রায়ান জানান, বেশ কিছু দিন; তবে বিমানবাহিত ব্রিগেড তাড়াতাড়িই নিয়ে যাওয়া সম্ভব, পাঁচ বা ছ’দিনের মধ্যেই। তা সত্ত্বেও এক সম্পূর্ণ নতুন আশঙ্কার অবতারণা করে কিসিঞ্জার বলেন, ‘মূল প্রশ্ন হলো ভারত যদি আজাদ কাশ্মীর দখলের চেষ্টা চালায় এবং পাকিস্তানের বিমান ও সাঁজোয়া বাহিনীর ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হয়! অবশ্য তা হবে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ভারতের ইচ্ছাকৃত উদ্যোগ।’ 

এরপর কিসিঞ্জার সমবেতদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এক মিত্রকে সম্পূর্ণ পরাভূত হতে দিতে এবং পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত রাখার জন্য ভারত যদি ভয় দেখায় তা কি আমরা মেনে নিতে পারি?’ জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি সিস্কো বলেন, ‘ভারতের এমনতর অভিপ্রায় রয়েছে কি না তা সন্দেহজনক।’ 

তবুও কিসিঞ্জার পাকিস্তানের জন্য ‘সামরিক সরবরাহ’ নিশ্চিত করার পক্ষে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আক্ষেপ করে বলেন যে, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব কিছুই আমরা প্রস্তুত করেছি। কিন্তু সবই হবে দু’সপ্তাহ বিলম্বে।’ 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

০৭ ডিসেম্বর ২০১৮

পিন্ডি-ইসলামাবাদ পায় পতনের সঙ্কেত

লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, ডিসেম্বর ১৯৭১।
আজ ৭ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এই দিন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহারের আহবান জানায়। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি তার রাওয়ালপিন্ডির প্রধান কার্যালয়ে এক গোপন বার্তায় জানায়, তাদের ‘পরিস্থিতি নাজুক’ হয়ে উঠতে পারে। পাকিস্তানের নিযুক্ত গভর্নর আবদুল মুতালেব মালেকও নিয়াজির সুরে সুর মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দুর্গত বার্তা পাঠান। 
জেনারেল নিয়াজির গোপন বার্তায় বলা হয়, ‘চারটি ট্যাংক রেজিমেন্ট সমর্থিত আট ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে ভারত। তাদের সাথে আরো আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার বিদ্রোহী (মুক্তিযোদ্ধাদেরই তখন বিদ্রোহী বলতো পাকিস্তানীরা)। স্থানীয় জনগণও আমাদের বিরুদ্ধে। দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশোর প্রবল চাপের মুখে রয়েছে। পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে।’ 
নিয়াজি আরো লিখেছেন, ‘গত নয় মাস ধরে আমাদের সৈন্যরা কার্যকর অপারেশন চালিয়েছে এবং এখন তারা তীব্র যুদ্ধে অবতীর্ণ। গত ১৭ দিনে যেসব খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে তাতে জনবল ও সম্পদের বিচারে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে। রাজাকারেরা অস্ত্রসহ শটকে পড়ার কারণে সেনা হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের নিজেদের ট্যাংক, ভারি কামান ও বিমান সমর্থন না থাকার ফলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটেছে।’ 

এই বার্তায় সম্মুখসমরের সৈন্যদের পিছিয়ে এনে প্রতিরোধ ঘাঁটিতে সমবেত করার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তাবও পেশ করা হয়। একইদিনে নিয়াজির প্রস্তাবের অনুমোদন দেয় তার হেড কোয়াটার। তবে অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকেনি যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা। ঘাঁটি ছেড়ে আগের রাতেই তারা পালিয়ে যায়। এই দিন মিত্রবাহিনী সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ ভর্তি সুরক্ষিত বাঙ্কার সম্পূর্ণ জনশূন্য। পাকি ‘বীর মুজাহিদ’ চার ব্যাটালিয়ান সৈন্যের এই অন্তর্ধানে কার্যত মুক্ত হয় দেশের পশ্চিমাঞ্চল। যশোর পলায়নপর এই পাকিরাই অন্যান্য স্থানে যুদ্ধরত স্বপক্ষীয় সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। দু-তিনটি স্থান বাদে সর্বত্রই তাদের প্রতিরক্ষার আয়োজনে ধস নামে। 

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
এরই প্রেক্ষিতে গভর্নর আবদুল মালেক এক বার্তায় নিয়াজিকে উদ্ধৃত করে ইয়াহিয়াকে বলেন, ‘যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় সম্পন্ন এবং মেঘনার পূর্বদিকের পতনও কেবল সময়ের প্রশ্ন। এই অবস্থায় আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সামরিক সহায়তা না পৌঁছায় তবে জীবন রক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়।’ 

মালেকের এই বার্তা ইসলামাবাদের জন্য অনেক বেশী দুর্ভাগ্যজনক ছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের দিকে তাদের আকাঙ্খিত অগ্রাভিযানও কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কোনো বড় বা মাঝারি ভূখ- দখল করার আগেই পূর্ব বাংলায় তাদের সামরিক নেতৃত্ব যদি আত্মসমর্পণের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ায় তারাও উদ্বেগও চরমে পৌঁছায়। 

মালেকের দুর্গত বার্তাটি সন্ধ্যাতেই ‘হোয়াইট হাউসে’ পৌঁছানো হয়। তবে ইরান বা জর্ডান থেকে পাকিস্তানকে যুদ্ধ-বিমান পাঠানোর মার্কিন প্রচেষ্টা তখনও হালে পানি পায়নি। ভারতকে চাপে ফেলতে এই দিন এদিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনৈতিক সাহায্যদান বাতিলের সিদ্ধান্দ নেয়। আর সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ কোনো প্রকার বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়্ পাক-ভারত সংঘর্ষের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানান । 

যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের জন্যেও সমস্যা তখন কম নয়। মার্কিন সিনেটে এবং হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে ডেমোক্র্যাট দলীয় কিছু সদস্য পাকিস্তানী জান্তার গণহত্যা, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী নীতির প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন এবং জাতিসংঘের বিলম্বিত ও একদেশদর্শী ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। মানবতাবাদী কারণ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরেট জাতীয় স্বার্থের হিসাব-নিকাশ থেকে উপমহাদেশের সংঘর্ষের জন্য ভারতকে এককভাবে দোষী করা ও ভারতের উন্নয়ন বরাদ্দ বন্ধ করা নিয়ে মার্কিন সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার যৌক্তিকতা সম্পর্কে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলি নানা প্রশ্ন তোলে। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার।
মার্কিন জনমতের এই প্রচণ্ড বিরুদ্ধতা দেখে ৭ ডিসেম্বর দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক হেঞ্জ আলফ্রেড হেনরি কিসিঞ্জার নিজে এক অজ্ঞাতনামা ‘সরকারী মুখপাত্র’ সেজে আস্থাভাজন কিছু সাংবাদিকদের কাছে পরিবেশিত এক সমীক্ষার দ্বারা মার্কিন জনমত পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তার এই বেনামী সমীক্ষা মার্কিন জনমতকে কতটুকু বিভ্রান্ত করতে না পারলেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ উপমহাদেশের যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে সে দিন যে রায় দেয় তা-ই মার্কিন সরকারের পরবর্তী কার্যক্রমের প্রধান মূলধনে পরিণত হয়। তবে এর ফলে যুদ্ধাবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না। কারণ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের নৈতিক গুরুত্ব থাকলেও তা অনুসরণের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।

সাধারণ পরিষদ ৭ ডিসেম্বর রাতে (উপমহাদেশে তখন ৮ ডিসেম্বর) অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার এবং শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান সম্বলিত এক প্রস্তাব ১০৪-১১ ভোটে গ্রহণ করে। ওই সময় নিউইয়র্কে অবস্থানকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণকে যখন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছিল তখন জাতিসংঘ নিষ্ক্রিয় ছিলো। আক্রমণকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের হটিয়ে বাংলাদেশ যখন সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখন জাতিসংঘ কর্তৃক যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। অথচ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। একের পর এক জেলা হচ্ছে হানাদারমুক্ত। চারদিকে উড়ছে বাংলার পতাকা। বাংলাদেশের বিজয় অনিবার্য। জয় বাংলা।’ 

অন্যদিকে এই দিন মিত্রবাহিনী সিলেটের নিকটবর্তী বিমানবন্দর শালুটিকরে অবতরণ করার পর মুক্তি বাহিনীর সহায়তয় সিলেট শহর মুক্ত করে। শরপুর, হবিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গায় ঝিনাইদহ, মৌলভীবাজার, চান্দিনা এবং জাফরগঞ্জও মুক্ত হয়। তবে কুমিল্লা ও লাকসামে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। এদিন সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে দেবহাটা উপজেলার শ্রীপুর ও ভোমরা সীমান্তের যুদ্ধে পাকবাহিনীর সাড়ে তিনশ সদস্য মারা যায়। পিরোজপুরের শরণখোলা-মঠবাড়িয়ায় পতনের পর পাকবাহিনী সুন্দরবন হয়ে পালাবার চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে তারা হুলারহাট হয়ে নৌপথে বরিশাল চলে যায়।একই দিন বিকালের দিকে বগুড়া-রংপুর সড়কের করতোয়া সেতুর দখল নিয়ে পাকি ও যৌথবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। 

রাতে ভারতীয় বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানী জওয়ান ও অফিসারদের উদ্দেশে মনস্তাত্ত্বিক অভিযান শুরু করেন ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ। আকাশবাণী থেকে হিন্দী, উর্দু ও পশতু ভাষায় জেনারেল মানেকশ বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমাদের বাঁচার কোন পথ নেই। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য তোমাদের ঘিরে রেখেছে। তোমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছ তারা তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অনেক দেরি হওয়ার আগেই তোমরা আত্মসমর্পণ কর। তোমাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও যুদ্ধাস্ত্রের শক্তি অকেজো হয়ে গেছে। এমনকি বাইরে থেকে বিমানের সাহায্য আসার সম্ভাবনাও নেই। অতএব তোমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। তোমাদের বাঁচার কোন পথ নেই। একমাত্র পথ হচ্ছে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা।’ 
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল, ১৯৭১।
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকেও বাংলা সংবাদ বুলেটিনের পাশাপাশি বার বার মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও সকাল-সন্ধ্যায় অতিরিক্ত সময় ধরে যুদ্ধ সমীক্ষা, দেশাত্মবোধক গান ও চরমপত্র প্রচার হতে থাকে। 

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলও মুক্ত হয়। একে একে নড়াইল, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও ছাতক ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলো থেকে প্রায় প্রতি রাতেই ঢাকার ভেতরে ঢুকে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকেন। ভীত-সন্ত্রস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মিলে তখন তৈরী করছিল বাংলাদেশের কৃতী সন্তানদের তালিকা।

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট
newsreel [সংবাদচিত্র]