Powered By Blogger

১২ ডিসেম্বর ২০১৮

যুক্তরাষ্ট্রের হুমকীর মুখেও অটল ভারত

অগ্রগামী মিত্রবাহিনী।
আজ ১২ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ রবিবার। বাংলার জমিন থেকে ঔপনিবেশিক ওই নাম মুছে যেতে তখনও তিন দিন বাকি। যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধে জড়ানোর হুমকী এদিন প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করে ভারত। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা দীর্ঘ বক্তব্য দেওয়ার পর মুলতবি হয়ে যায় অধিবেশন। একইদিনে তৈরী হয় বুদ্ধিজীবি হত্যার চূড়ান্ত নীল-নকশা। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে ৯ ডিসেম্বর রওনা করা যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর এই দিন বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘন্টার দূরত্বে এসে গভীর সমুদ্রে অবস্থান নেয়। আগের দিন ( ১১ ডিসেম্বর) প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার রাশিয়ার ওয়াশিংটন প্রতিনিধির মাধ্যমে ভারতকে একদিনের মধ্যে যুদ্ধ থামানোর আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। নয়ত যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে এ যুদ্ধে অংশ নেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তবুও এই আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ মহাসচিক উ থানকে এক বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জানান, ‘পাকিস্তান যদি শুধু বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছুতে সম্মত হয়; তবে ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পাশপাশি ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে।’ 
সপ্তম নৌবহরের সর্বশেষ অবস্থান খবর তখনও ভারতে কেবল স্বল্প সংখ্যক নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে সীমিত। তবু মার্কিন প্রশাসনের হুমকির প্রকাশ্য জবাব দেয়া ও ভারতের জনসাধারণকে আসন্ন বিপদ ও কঠোর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ১২ ডিসেম্বর দিল্লীতে বিশেষভাবে আয়োজিত এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ‘সম্মুখের অন্ধকার দিন’ ও ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের সম্ভাবনা’ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করেন। একই দিন পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন। সাংবাদিকদের সাথে আলাপে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।’ 

অন্যদিকে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানান। তিনি তার দলের সদস্য ও সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, মুক্তিসংগ্রামে জয় লাভের আর দেরি নেই। অন্যদিকে দিল্লীতে কুজনেটসভ এবং মস্কোতে ডি পি ধরের যুগপৎ আলোচনার ফলে দ্রুতগতিতে উভয় সরকার মার্কিন ও চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি মোকাবিলায় যুগ্ম ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হন। 
ভারতীয় নৌ-বাহিনী এই দিন সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য তৎপরতা বিঘ্নিত করতে চালনা থেকে কক্সবাজারের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থানরত সব ছোট-বড় নৌযান, উপকূলীয় অবকাঠামো; এমনকি কক্সবাজার বিমানবন্দরও ধ্বংস বা অকেজো করে ফেলে। 
পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজিকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান টেলিফোন করে পশতু ভাষায় জানান, পরদিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে। তিনি মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সাহায্য পাওয়ার ইঙ্গিত দেন। এরপরই নিয়াজির নির্দেশে ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রতিরক্ষার আয়োজন নিরঙ্কুশ করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার কারফিউ জারি। একইসঙ্গে ঘরে ঘরে তল্লাশী শুরু হয়। 

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল।
এরই মাঝে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশিদের সড়িয়ে নিতে তিনটি ব্রিটিশ বিমান এসেছিল। একাত্তরের দিনলিপির এই দিনে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন, “এয়ার্পোরটের দিকে দেখা যাচ্ছে তিনটা প্লেন বারবার নিচে নামার চেষ্টা করছে, আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। আমাদের ছাদের ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায়। জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা থেকে অপসারণের জন্য এই চেষ্টা। কিন্তু ভারতীয় বিমান বোমা ফেলে রানওয়েটা বেশ ভালো জখম করে রেখেছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাণান্ত চেষ্টা করে প্লেনগুলো নামল, খানিক পরে উঠেও গেল। ওরা উড়ে চলে যাবার পরপরই ফটাফট দুটো বোমা রানওয়েতে মেরে দিয়ে গেল ভারতীয় প্লেনগুলো। আরো ভালো করে দেখার জন্য সিঁড়িঘরের ছাদের টঙ্গে জামী একবার উঠেছিল। ওখানে উঠলে এলিফ্যান্ট রোডের বুকটাও দেখা যায়। জামী নেমে এসে বলল, আচ্ছা মা, সারাদিন কারফিউ অথচ এত মাইক্রোবাস যাচ্ছে কেন রাস্তা দিয়ে? এগুলো তো মিলিটারি গাড়ি নয়।”

রাতে প্রাদেশিক সরকারের উপদেষ্টা মেজর রাও ফরমান তার এ দেশীয় দোসর আল-বদর ও আল-শামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের সদর দফতরে ডেকে পাঠান। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এক গোপন বৈঠক। এই গোপন বৈঠকে বুদ্ধিজীবি হত্যার নীল-নকশা প্রণয়ন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান তাদের হাতে বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা তুলে দেন। এই নীল-নকশা অনুযায়ী দুই দিন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় জাতির মেধাবী সন্তানদের। 
এর আগে ১২ তারিখ রাতেই  এপিআই এর জেনারেল ম্যানেজার সাংবাদিক নিজামউদ্দিনকে আল-বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের দোসরা যখন নিজামউদ্দিনের বাসায় হানা দেয় তখন তিনি বিবিসি এর জন্য রিপোর্ট তৈরি করছিলেন। ওই অবস্থায় ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আ ন ম গোলাম মোস্তফাও নিজ বাসভবন থেকে অপহৃত হন। তিনিও আর কখনো ফিরে আসেননি।
মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাস, ডিসেম্বর ১৯৭১।
ওদিকে রণাঙ্গনে পাকিদের পশ্চাদপসরণের ধারা অপরিবর্তিত থাকে। এই দিন সকালে শত্রুমুক্ত হয় নরসিংদী। বিকেলে ভারতের আর একটি ইউনিট (৪ গার্ডস্) ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে রাতে প্রচ- আক্রমণ চালায়। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়া বাহিনী। সেখানে তুমুল যুদ্ধের পর ফলে ঢাকা অভিযানের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ পথের সদ্ব্যবহার শুরু হয়। 

দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী খানসামা থানা আক্রমণ করে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১৫ জন ও সাত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের হাতে এক মেজরসহ পাকবাহিনীর ১৯ জন ধরা পড়ে। তবে এদিনই দিনাজপুরের বিরল থানায় বহলা গ্রামে ঘটে গণহত্যার নৃশংস ঘটনা। এদিন নীলফামারী , গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ি, ভেড়ামারা এবং শ্রীপুরও হানাদারমুক্ত হয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]