Powered By Blogger

০৬ ডিসেম্বর ২০১৮

ভারত-ভুটানের স্বীকৃতি মেলে এই দিন

সৈয়দপুরের রনাঙ্গণ ছেড়ে পালাচ্ছে পাকিস্তানীরা। 
আজ ৬ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল সোমবার। দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও ভুটান এই দিন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। ভারতের কয়েক ঘণ্টা আগে এক তারবার্তার মাধ্যমে ভুটান প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বেলা এগারোটার সময় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ মারফত ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশকে তারা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 
ভারতের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ। বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে বলা যায়, গোটা বিশ্ব এখন সচেতন যে তারা জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটায়, জনগণকে প্রতিনিধিত্বকারী অনেক সরকারই যেমনটা দাবি করতে পারবে না। গভর্নর মরিসের প্রতি জেফারসনের বহু খ্যাত উক্তি অনুসারে বাংলাদেশের সরকার সমর্থিত হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত জাতির আকাঙ্খা বা উইল অব দ্য নেশন দ্বারা। এই বিচারে পাকিস্তানের সামরিক সরকার, যাদের তোষণ করতে অনেক দেশই বিশেষ উদগ্রীব, এমনকি তারা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণেরও প্রতিনিধিত্ব করে না।’
সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের সৈন্যবাহিনীর জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রুদের নির্মূল করার জন্য আজ যুদ্ধ করে চলেছে।’ 

এর আগে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যুগ্মভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র পাঠান। ডিসেম্বরের ৪ তারিখের এই পত্রের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে উদ্দেশ্য করে যে পত্র প্রেরণ করেন তার আংশিক বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ :
ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,

মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আপনি ৪ ডিসেম্বর আমাকে যে পত্র প্রেরণ করেছেন তাতে আমি ও ভারত সরকারে আমার সহকর্মীবৃন্দ গভীরভাবে অভিভূত হয়েছি। এই পত্র পাবার পর আপনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ ভারত সরকার পুনরায় বিবেচনা করেছে। আমি সানন্দে জানাই যে, বর্তমানে বিরাজিত পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি একটি অনুলিপি সংযুক্ত করছি।

আপনার বিশ্বস্ত
ইন্দিরা গান্ধী
ওদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই দিন ‘যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ব্যবস্থা একই সময় নেওয়ার’ আরো একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে রাশিয়া। কিন্তু চীনের ভেটোর কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রশ্নের সমাধান অসম্ভব, সে কথা বুঝতে পেরে বিষয়টি আলোচনার জন্য পাঠানো হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। 
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় পাকিস্তান ভারতের সাথে সব ধরণের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর ভিয়েতনামে যুদ্ধরত দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু রনাঙ্গনে ততক্ষনে পাকিরা পলায়ন শুরু করেছে ।
মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা তখন সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বেলা এগারোটার সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও মারফত ঘোষণা করা হলো যে ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ নয় মাস যাবৎ সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধীর আগ্রহে এ দিনটির জন্য প্রতীক্ষায় ছিল। সংবাদটা শুনে মন থেকে চিন্তা ও উত্তেজনা দূরীভূত হলো। হঠাৎ স্বীকৃতির এই ঘোষণা শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিধ্বস্ত অন্তর গর্বে ফুল উঠল।’

শেরপুরের পানিহাতা, নালিতাবাড়ী, বাওরামারী মুক্ত কওে ঝিনাইগাতীর আহম্মদ নগরে পাক বাহিনীর ঘাটি আক্রমন করেন মুক্তিযোদ্ধ কমান্ডার মো. রহমতুল্লাহ । তারা পৌঁছানোর আগেই অবশ্য পাকিস্তানী ঘাঁটি ছেড়ে পালায়। ভোর বেলায় আহম্মদনগর ক্যাম্প রেড করে শেরপুর সদরে আসার পথে আল বদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের বাড়ি ঘেরাও করা হয় কিন্তু তাকে ধরা যায়নি। তারা জানতে পারলেন সে আগের রাতে আহম্মদনগর ক্যাম্পের পাকবাহিনীদের সাথে জামালপুরে চলে গেছে।
পালাচ্ছে হানাদার সেনা। 
সকাল সাতটায় মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুর শহরে পৌঁছায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই হেলিকপ্টারে করে আসলেন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরোরা। রহমতুল্লাহর বাহিনীসহ হাজার হাজার মুক্তি বাহিনী ও মুক্তি পাগল মানুষ তাকে অভ্যর্থনা জানাল। সে মুহুর্তেই আদেশ জারি হলো আজ বিকাল পাঁচটায় জামালপুর আক্রমণ করতে হবে। একইদিনে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে সেদিন বীরগঞ্জ ও খানসামার পাক অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। 

এই বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন গেরিলা কমান্ডার মাহবুব আলম, পরে যিনি লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সত্যভাষ্য ‘গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে’। এদিন লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধে কুলিয়ে উঠতে না পেরে পিছু হটে বিকল্প অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগরেও যৌথবাহিনীর অবস্থান নেয়। পশ্চিম সেক্টরে ৪-৫ ডিসেম্বর টানা দুইদিন যৌথবাহিনীর আক্রমন প্রতিরোধ করার পর এই দিন পাক ৯ ডিভিশন (জেনারেল আনসারি) যশোর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় । তবে মিত্রবাহিনী শহরে প্রবেশ করে পরদিন, ৭ তারিখে । এর আগে ৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী পায়ে হেঁটে ঝিনাইদহ পৌঁছে এবং শহরটি মুক্ত করে ।
একাত্তরের এই দিনেও সক্রিয় ছিলো পাকিস্তানীদের এ দেশীয় দোসরেরা। জামায়াতে ইসলামীর আমির মওলানা মওদুদী ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করার পর তাদের উদ্দেশ্যে বলেন নাস্তিক ও বিধর্মী দুশমনদের বিরুদ্ধে জেহাদ প্রতিটি মুসলমানের জন্য শরিয়তের হুকুম। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার নুরুল আমিন সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিক ও সময়োচিত বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘অস্তিত্ববিহীন বাংলাদেশ নিয়ে ভারত পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে।’ ভারতীয় হামলা প্রতিরোধে সেনাবাহিনীর সাফল্য কামনা করে ৭ ডিসেম্বর বিশেষ মোনাজাতে সামিল হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
একই দিনে ভারতীয় হামলার কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর্তব্য নির্ধারণের জন্য গভর্নর ড. মালিকের সভাপতিত্বে মন্ত্রীপরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে যুদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের নিয়ে চারটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল কাশেম, শ্রম ও সমাজকল্যান মন্ত্রী এএসএম সোলায়মান, শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী আখতারউদ্দিন আহমেদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওবায়দুল্লা মজুমদারকে নিয়ে বেসামরিক প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। খাদ্য ও জরুরি প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নওয়াজেশ আহমদ, আখতারউদ্দিন আহমদ ও মওলানা মোহাম্মদ ইসহাককে। স্বাস্থ্য ও রিলিফ কমিটি গঠন করা হয় ওবায়দুল্লা মজুমদার, অধ্যাপক শামসুল হক, নওয়াজেশ আহমদ জসিমউদ্দিন ও একেএম মোশারফ হোসেনকে নিয়ে। আব্বাস আলী খান, তথ্যমন্ত্রী মজিবর রহমান ও এএসএম সোলায়মানকে নিয়ে গঠিত হয় তথ্য বিষয়ক কমিটি। এদিন এক ঘোষণায় প্রহসনমূলক উপ-নির্বাচন বাতিলের ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন। 
গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী ঢাকায় এক ঘরোয়া বৈঠকে সাংবাদিকদের জানান, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণকারীদের অবশ্যই পরাজিত করতে সক্ষম। সেনাবাহিনীর যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘দুশমনকে পছন্দমতো জায়গায় এনে আক্রমণ করাই আমাদের লক্ষ্য।’ 
মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা দখলের দাবি ভিত্তিহীন দাবি করে রাও ফরমান আলী বলেন, ‘দুশমনকে ঢুকতে দেওয়া আমাদের যুদ্ধকৌশলেরই অংশ।’ যশোর, হিলি, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট প্রভৃতি এলাকা সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘২৫ বছর ধরে পাকিস্তান টিকে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।’ 

উদ্বিগ্ন পাকি কমান্ডার।
তথ্যমন্ত্রী মজিবর রহমান এই দিন স্থানীয় সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের দেশপ্রেমের আদর্শ ও ত্যাগের মহিমায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও দুশমনকে পরাজিত করতে সবাই যাতে ঐক্যবদ্ধ হয় সেভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। এছাড়া রাজশাহীতে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগ নেতা আয়েনউদ্দিনের নেতৃত্বে এক প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় বক্তারা দুশমনদের বিরুদ্ধে জেহাদে যোগদানের জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। 

এপিপির বার্তা পরিবেশক আলতাফ জাওয়ার জাতিসংঘের কর্মচারি ও তাদের পরিবারবর্গের ঢাকা ত্যাগের ব্যবস্থা ভারতীয় বিমান হামলায় নস্যাত হয়ে গিয়েছে বলে সংবাদে অভিযোগ জানান। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]