মূলত সামরিক ফরমানে (১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং ৪ এর ২ তফসিল বলে) বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে প্রস্তাবণার আগে 'বিসমিল্লাহ’ সন্নিবেশিত হয়। পরের বছর এপ্রিলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে আইনসভা এর বৈধতা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটিতে পরিবর্তন এনে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একইসঙ্গে মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়।
সম্প্রতি ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তা কার্যকর করা হয়। পরবর্তী ৪৫ বছরে এটি সংশোধন করা হয়েছে মোট ১৬ বার। একই সময়ের মধ্যে দুই বার রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, দফায় দফায় সামরিক ক্যুসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছে দেশ। এসব মাথায় রেখে সংবিধানের ৪৬ বছর উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের চতুর্থ পর্বে থাকছে ঢাকায় বসবাসকারী তরুণ প্রকাশক ও সাংবাদিক সৈয়দ রিয়াদের আলাপ। তার সাথেও কথা হয় ফেসবুক চ্যাটবক্সে ।
ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দ রিয়াদ : সংবিধান সংশোধনে যখন ভোটের রাজনীতিকে প্রাধান্য দেয়া হয় তখন আসলে গণতন্ত্র সাংবিধানিক ভাবেই লংঘিত হয়। সংখ্যাগুরুদের খুশি করতে ভোটের রাজনীতিতে সেখানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও রাষ্ট্রধর্ম ব্যবহারের ফলে বিষয়টি সাম্প্রদায়িক ও দৃষ্টিকটু-তো হয়েছেই; সেইসঙ্গে সংখ্যালঘুরা তাদের পরিচয় সংকটে পড়েছে। অথচ আমাদের প্রথম সংবিধান কোনো একক ধর্মের জন্য রচিত হয়নি; হয়েছে একটি দেশের জন্য, জনগণের জন্য। তাহলে এখানে আবার ধর্ম আসছে কোথা থেকে?
ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সৈয়দ রিয়াদ : উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যাওয়া পরও যখন ‘বিসমিল্লাহ’ সংবিধানে বহাল থাকে তখন দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত সর্বোচ্চ আদলতের রায়কে আমাদের গণতন্ত্রে কিভাবে দেখা হচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত রায় নিয়ে সরকার যে ধরণের রাজনীতি করেছে তাতে স্পষ্টতেই বোঝা গেছে তারা নিজেদের আদর্শিক জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। তা না হলে আদালতের এমন রায় অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখাত না অসাম্প্রদায়িক আদর্শে এ সরকার।
ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
সৈয়দ রিয়াদ আমাদের সংবিধান, এমনকি এই রাষ্ট্র জন্মেরও আগে থেকে এ জনপদের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের কারণে সংখ্যালঘু সম্পর্কে এক শ্রেণীর স্থানীয় মুসলমানদের মজ্জাগত ভাবে ধারণা হয়ে আছে যে এরা এই দেশের কেউ নন। আদতে তারা তাদের মূর্খতাকে বোঝার পরিবেশ পাচ্ছে না। এর জন্য অবশ্যই সংবিধান দায়ী।
ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
সৈয়দ রিয়াদ : সরকার সংখ্যালঘুবান্ধব নিঃসন্দেহে। কিন্তু ওই যে ভোটের রাজনীতির সমীকরণে তারা সেটা স্পষ্ট করতে পারছে না। দৃশ্যত তাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এখানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর দায়ও তাদের নিতে হবে।সরকার মুখে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলছে আর কার্যত সাম্প্রদায়িক আচরণ করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘুদের উপর ইদানীং যে ধরণের আক্রমণ করা হয়েছে তা দেখে মনে হয়েছে এই দেশে সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নেই। আর সংবিধান থেকেই যদি জাতি ধর্মের সাথে আপস করে তাহলে সেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে স্বস্তির কিছু দেখছি না।
ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
সৈয়দ রিয়াদ : আমাদের গণতন্ত্র এখনো সুসংহত নয়। নাগরিক অধিকার তলানিতে পড়ে আছে। তাই এসব বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি নিয়ে কোনে আশার খবর নেই। বুদ্ধিচর্চা এখানে বিকল। ২০১১ পর থেকে এই অবস্থা উন্নতি হওয়ার কোনো ধরণের কারণ নেই। সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নয়নের চিত্র এখানে ভয়ংকর। আসলে এই দেশে নাগরিক অধিকার বলে কিছু নাই।
পরম্পরার অন্যান্য লেখা
সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করেছে রাষ্ট্র!
সংখ্যালঘু নয় ক্ষমতাই বিষয়..
অসাম্প্রদায়িক ছিলো বলা যাবে না!
..কিভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দাবি করবে..
কতটা স্বাধীন হয়েছে বিচার বিভাগ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন