Powered By Blogger

০৮ নভেম্বর ২০১৭

অসাম্প্রদায়িক ছিলো বলা যাবে না!


সম্প্রতি ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তা কার্যকর করা হয়। পরবর্তী ৪৫ বছরে এটি সংশোধন করা হয়েছে মোট ১৬ বার। একই সময়ের মধ্যে দুই বার রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, দফায় দফায় সামরিক ক্যুসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছে দেশ।
ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে জন্ম নেয়া এই রাষ্ট্রের সেই সূচনা সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রাহিম’ (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে) লেখা ছিলো না। ছিলো না রাষ্ট্রধর্মের কোনো বিধানও। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করা হয়। আর ১৯৮৮ সালে সাবেক সেনাশাসক এইচএম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়। পরবর্তীতে উচ্চ-আদালত ওই সংশোধনী দুটো বাতিল করলেও ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই দুটি জায়গা অপরিবর্তিত রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করে আইনসভা। সংবিধানের ৪৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে থাকছেন ভাষ্কর, চিন্তক ও গবেষক গোঁসাই পাহলভী । বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানকারী এই যুবক শিল্পীচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি এবং প্রামান্যচিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তার সাথেও ফেসবুক চ্যাটবক্সে কথা হয় ।
ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
গোঁসাই পাহলভী : সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংশয় আছে বলেই এই প্রশ্নের উত্থাপণ মনে হয়েছে। সংবিধান বাস্তবতা এবং ধর্মচর্চার বাস্তবতায় সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুদের জীবন-যাপন সংস্কৃতির বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।সংবিধানের বাস্তবতায় যে কোনও সচেতন নাগরিক আতংকিত হবেন, অস্বত্বিতে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম থাকবে আবার অপরাপর ধর্মগুলোও থাকবে, তাদের অধিকারও সমান হবে এমন নয়। সেটা হয়ওনি।যদি সমানভাবে চর্চিত হতে হয়, তবে সেটা রাষ্ট্র থেকেই হতে হবে। মানে রাষ্ট্র যদি ইদে তিন দিন ছুটি দেয় তাহলে পূজায়ও সেটা হতে হবে। পাঁচ দিনের পূজায় এক দিন ছুটি! এটা তো সাংবিধানিক আইন মানা হলো না, রাষ্ট্রকে কি এ বিষয়ে জবাবদিহি করা যায়? সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ে ধর্মের উপর এই গুরু দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায়, বাংলাদেশের সংবিধান শুরুতেই অসাম্প্রদায়িক ছিলো এমন বলা যাবে না। কারণ, সাম্প্রদায়িকতাকে এখানে আইনের দ্বারা সিদ্ধ করা হয়েছে, উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। 

ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
গোঁসাই পাহলভী : ২৭ অনুচ্ছেদ মতে. এই ধারাটি বিতর্কিত। আইনের দৃষ্টিতে সমান হলে আইনকে শুরুতেই সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করতে হবে। সম্পত্তির মতো গুরুতর বিষয়টি ধর্মের হাতে রেখে সংবিধান নিজেকে কীভাবে অসাম্প্রদায়িক ভাবে সেটাই প্রশ্ন। 

ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
গোঁসাই পাহলভী : সংবিধানের চর্চা সাধারণ মানুষর ভেতর নেই। তারা সংবিধান বুঝে এ্যাক্ট কিংবা রিএ্যাক্ট করেন, এমন নয়। জনগণের কৌমচেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনা, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই উগ্রতার পেছনে দায়ী। আরো আছে আন্তজার্তিক ঘটনাবলীর প্রভাব। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর ক্রমাগত মুসলমানদের মার খাওয়ার ইতিহাস, এবং স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে তার উপস্থাপন এখানকার মুসলমানদের উগ্রবাদীতার সাপেক্ষে তৈরী করার মনোভাব দেখা যাচ্ছে! এ বিষয়ে ‘কাভারিং ইসলাম’ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
গোঁসাই পাহলভী : নিয়োগ প্রথায় সংখ্যালঘুরা এই সরকারের কাছ থেকে আনডু ফ্যাসালিটিস পাচ্ছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু জনগণের স্তরে তাকালে ইসলামিস্টদেরকে বিভিন্ন প্রকার ছাড় দেয়া নিঃসন্দেহে বিরোধাত্মক। গ্রাসরুট বা গ্রাস লেবেলে তাকালে সংখ্যালঘুদের ভূমিদখল, বাস্তুচ্যুত করার বিষয়ে যে সমস্ত সংবাদগুলো ছাপা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর লোকদের নামই এসেছে ঘুরেফিরে। 

ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
গোঁসাই পাহলভী : বাংলাদেশের লেখক বা চিন্তুকরাই হচ্ছেন এ দেশের প্রকৃত সংখ্যালঘু। তারা এখন মার খাচ্ছেন। দেশ থেকে পালাচ্ছেন, দেশের ভেতর গুম হচ্ছেন। অধিকারের বিষয়ে সম কিংবা অসমের প্রেক্ষাপটে অধিকার বিচার বিষয়ক ধারণা সংবিধান স্বচ্ছতার সাথে লিপিবদ্ধ নয়। অর্থাৎ অধিকারের মতো দার্শনিক ধারনাকে কনটেইনড করে গড়ে ওঠা ব্যবস্থার কথা এখানকার আইনবেত্তা বা বুদ্ধিজীবীরা ভেবেছেন বা ভাবতে পেরেছেন এমন উদাহরণ আমাদের হাতে নেই। অধিকারের বিষয়ে লোকায়ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা উহ্য রেখেই বলছি। ধর্ম কতটা অধিকার দেয় মানুষকে, রাষ্ট্র কতটা অধিকার কুক্ষিগত করেছে, কতটা অধিকার ছাড় দিয়েছে এ তো বিশদ প্রশ্ন। পাঁচটি মৌলিক অধিকার চিহ্নিত হলো, নির্দিষ্ট হলো, এই অধিকারগুলো কী জনগণের দ্বারা চিহ্নিত, নাকি রাষ্ট্র নিজেকে কর্তা ভেবে জনগণের অধিকারের বিষয়ে কেবল পাঁচটি ধারণাকেই সনাক্ত এবং সূত্রবদ্ধ করেছে। এটা প্রকৃতিগতভাবে একটি ব্যত্যয়। 

ছবিটি বাংলাদেশের, আমারই তোলা। 
আরো পড়ুন :

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]