ফাইল ফটো |
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ সম্প্রতি এ নিয়ে কথা হচ্ছিলো তরুণ ভাষ্কর, চিন্তক ও গবেষক গোঁসাই পাহলভীর সাথে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ‘এই যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম; এটা শিয়া, সুন্নি, নাকি অন্য কোনো ইসলাম?’ বেশ মনে ধরেছিলো তার এ জিজ্ঞাসা। আজকের প্রেক্ষাপটে যা খুবই প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রীয় ইসলাম সুন্নি হলেও প্রশ্ন থেকে যায়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র হানাফি, মালেকি, শাফি না হানবালি মাজাহাব মানবে? আবার শিয়া হলে ইসমাইলি, জাফরি না জায়েদি? নাকি বাঙালের এই জাতিরাষ্ট্র ওহাবি-সালাফি বা খারেজিপন্থী ইবাদি মতাদর্শ মানবে?
প্রায় এক দশক ধরে উৎসবের রাত মানে জনশূণ্য রাজপথে র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দা আর গণমাধ্যম কর্মিদের টহল। নানা জুজুর ভয়ে একই দৃশ্যের পুনুরাবৃত্তি ঘটছে বার বার। ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ। বঙ্গবাসীর এই পশ্চাতযাত্রার শুরু হয়েছিলো বহু বছর আগে, সেই ১৯৪৭ সালেই। তবে দৃশ্যত ২০০৭ সালের এক-এগারোর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এর গতি বেড়ে গেছে বহুগুণ । যার আগে পরে দেশে উত্থান ঘটেছে অজস্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির। জনমনে সঞ্চারিত হয়েছে বিচিত্র সব ভয়।
‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ রাষ্ট্রের জারি করা ফরমানে পশ্চিম থেকে ধার করা থার্টিফাস্ট ডিসেম্বর শুধু নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখের মতো দেশীয় উৎসবগুলোও প্রাণহীন হয়েছে এক সময়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর থেকে তাজিয়া মিছিলের ঐতিহ্য হরণে উদ্যোগী হয়েছে রাষ্ট্র। ইতিপূর্বে জঙ্গি-হামলারও শিকার হয়েছিলো শিয়া মুসলিমদের এ উৎসব। সেবার (২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর) মিছিলের প্রস্তুতিকালে পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে বোমা হামলায় দুজন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়। যে ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি এখনো।
অথচ ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবারও (বৃহস্পতিবার) বললেন, “আশুরা উপলক্ষে মোহাররমের মিছিলে সকল প্রকার ধাতব বস্তু বহন, জিঞ্জির, দা-ছুরি-তলোয়ার, ঢোল-লাঠিখেলা এবং আগুন খেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা মিছিলে অংশ নেবেন, তারা মিছিলের শুরুর স্থানে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশির পর অংশ নেবেন। পথের মাঝখান থেকে কেউ মিছিলে যোগ দিতে পারবেন না।”
গত বছর পুলিশের নিষেধ না মেনে ধারাল অস্ত্র নিয়ে তাজিয়া মিছিলে আসায় ১৪ জন 'পাইক'কে আটক করেছিলো পুলিশ। শিয়াদের এই মিছিলে ‘হায় হোসেন’ মাতম তুলে যারা দা, ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি নিয়ে নিজেদের শরীর রক্তাক্ত করে, স্থানীয়ভাবে তাদের ‘পাইক’ বলা হয়। এরা আশুরা উৎসবের শত শত বছরের অনুসঙ্গ। ঢাকায় তাজিয়া মিছিল শুরুর সঠিক ইতিহাস না পাওয়া গেলেও মনে করা হয়, ১৬৪২ সালে সুলতান সুজার শাসনামলে মীর মুরাদ হোসেনী দালান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই শোক উৎসবের সূচনা করেন।
‘তাজিয়া’ শব্দটি আরবী হলেও উর্দু ও ফার্সী ভাষায়ও এটি ব্যবহার করা হয়। এর সাধারণ অর্থ শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। মহররমের দশম দিনে ইমাম হোসেন (রা.) [ইসলাম প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র]-এর সমাধির প্রতিকৃতি নিয়ে শিয়ারা যে মিছিল করেন, সেটাই হচ্ছে তাজিয়া মিছিল। মূলত হোসেনি দালান থেকেই সবচেয়ে বড় তাজিয়া মিছিল বের হয়। এক কালে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিবিকা রওজা (১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে পুরনো ইমামবাড়া), পুরানা পল্টন, মগবাজার, মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর থেকেও তাজিয়া মিছিল বের হতো। তখন হিজরী মহররম মাসের শুরু থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত চলত শোক উৎসব। এতে সুন্নী মুসলমানরাও যোগ দিতেন।
হিন্দু ধর্মালম্বীদের দূর্গা পূজা উৎসব শেষ হওয়ার ঠিক পরদিনই (রবিবার) আশুরা এবার। মুসলমানদের জন্য দিনটি মূলত শোকের। এদিন মুহাম্মদ (সা:)-এর দৌহিত্র হুসাইন ইবনে আলী নির্মমভাবে শহীদ হন। ইসলামের ইতিহাসে অবশ্য দিনটি আরো নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিশ্বাস, “এই ১০ মুহররম তারিখে আসমান ও যমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। একই দিনে পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ:) কে সৃষ্টি করা হয়। এই দিনে আল্লাহ নবীদেরকে স্ব স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেন। এই দিন নবী মুসা (আ:)-এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে দেয়া হয়। একই দিনে নূহ (আ:)-এর কিস্তি ঝড়ের কবল হতে রক্ষা পায় এবং তিনি জুডি পর্বতশৃংগে নোঙ্গর ফেলেন। এই দিনে দাউদ (আ:)-এর তাওবা কবুল হয়, এমনকি একই দিনে ইব্রাহীম (আ:) কে নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার করা হয়; আইয়ুব (আ:) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেন। এই দিনেই আল্লাহ ঈসা (আ:)-কে ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নেন।” এছাড়া হাদিস মতে এই তারিখেই কেয়ামত সংঘটিত হবে।
আজ দশমী, তথা শুভ বিজয়ার সকালেও খবরের কাগজে সংখ্যালঘু পীড়নের সংবাদ পড়ে দিন শুরু করলাম। অষ্টমীর রাতে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ শহরতলীর শিবপাশা এলাকার প্রয়াত ডা. বিহারী বাবুর বাড়ির সবাই গিয়েছিলেন পূজো দেখতে। তারা ফিরে এসে দেখলেন ঘরে আগুন জ্বলছে। ঘরের ভিতরে থাকা স্বর্ণালংকার, দলিল পত্রাদি ও নগদ টাকাসহ মূল্যবান মালামাল ভস্মীভূত হয়েছে। এবারের পূজোর মৌসুমে বাঙালী মুসলমানেরা মোট কতগুলো প্রতিমা ভেঙেছেন, সেই ফিরিস্তি এখানে নাই-বা দিলাম। তবে আজ বলতে চাই, আমাদের রাষ্ট্র এখনো ধর্ম পালনে সকলের ‘সমমর্যাদা ও সমঅধিকার’ নিশ্চিত করতে পারেনি। যদিও আমি বুঝিনা, একটি ধর্মকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ আখ্যা দিয়ে সকল ধর্মকে একই মর্যাদা দেয়া যায় কিভাবে! আবার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও বলা হচ্ছে! রাষ্ট্রের ধার্মিক হওয়ার বিধানটি কি তবে সংবিধানের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
বাংলাদেশের প্রথম, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম' (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে) লেখা ছিলো না। ছিলো না কোনো রাষ্ট্রধর্মের বিধানও৷ ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করা হয়৷ আর ১৯৮৮ সালে সাবেক সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়৷ পরবর্তীতে উচ্চ-আদালত ওই সংশোধনী দুটো বাতিল করলেও ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই দুটি জায়গা অপরিবর্তিত রাখে আইনসভা।
প্রথম প্রকাশঃ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন