Powered By Blogger
সংখ্যালঘু লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সংখ্যালঘু লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১৬ অক্টোবর ২০১৯

রাষ্ট্রধর্ম বাড়িয়েছে ইসলামী উগ্রবাদ

একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীর দৃশ্য
“রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের তিন দশকে বেড়েছে ইসলামী উগ্রবাদের শক্তি,” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরী করেছিলাম গত বছর, যা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। চলতি বছরের জুলাইতে প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সাহায্য চাওয়ায় যখন খুব হৈচৈ হচ্ছে, তখন অপ্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি ফের স্মরণে আসে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রিয়া সাহা ওয়াশিংটনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউজে গিয়ে ট্রাম্পকে বলছেন, “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানে তিন কোটি ৭০ লাখ (৩৭ মিলিয়ন) হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ‘উধাও’ হয়ে গেছেন। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ (১৮ মিলিয়ন) সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রয়েছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ছাড়তে চাই না। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা আমার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। জমি কেড়ে নিয়েছে। এর কোনো বিচার এখনো পাইনি।”
“কারা এসব করেছে,” প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানতে চাইলে দলিত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘শারি’ পরিচালক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংগঠক প্রিয়া সাহা আরো বলেন, “উগ্রপন্থী মুসলমানরা এটা করেছে। সব সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা এটা করে থাকে।” 
এমন বক্তব্যের জেরে সরকার-বিরোধী, ডান-বাম, বাঙালী মুসলমানদের সব পক্ষই যখন প্রিয়াকে তুলোধনো করছে, তখন খেয়াল হয় আরো ছয় বছর আগে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির এক শুনানিতে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ থেকে ২০১৩ সাল এ পর্যন্ত চার কোটি ৯০ লাখ (৪৯ মিলিয়ন) হিন্দু মিসিং হয়েছে। 

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদও বহু বছর ধরেই বলছে, গত পাঁচ দশকে আনুমানিক এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশান্তরিত হয়েছেন। সে হিসেবে গড়ে বছরে দেশ ছেড়েছেন দুই লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। তাছাড়া সরকারি পরিসংখ্যান মতে সত্তরের দশকে এ দেশে ২০ দশমিক এক শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। চলতি দশকের শুরুতে ২০১১ সালে যা কমে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক সাত শতাংশে। 
ঘাঁটতে গিয়ে জানতে পারি, নিরাপত্তহীনতায় কোটি মানুষ দেশ ছাড়লেও কমেনি সাম্প্রদায়িক পীড়নের মাত্রা; বরং রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের পর দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযুক্তকারী অষ্টম সংশোধনীর প্রস্তাব পাসের ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়েছে গত বছর। 
তৎকালীন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ১৯৮৮ সালের ১১ মে জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেছিলেন। পরে ৭ জুন এটি পাস হলে ৯ জুন ‘স্বৈরশাসক’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুমোদন পেয়ে তা আইনে পরিণত হয়। অবশ্য তার আগেই সংবিধান ইসলামীকরণ শুরু করেন আরেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। ফরমান জারি করে তিনি প্রস্তাবনার আগে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) বাক্যটি যোগ করেন। সেইসঙ্গে মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিলুপ্ত এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাংবিধানিক সুযোগ তৈরী করা হয়। 

এরই ধারাবাহিকতায় এরশাদের শাসনামলে কায়েম করা হয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ৷ ওই সময় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে সংবিধানের এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে উচ্চ-আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন লেখক সাহিত্যিক, সাবেক বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের পনেরো জন বিশিষ্ট নাগরিক। এর ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হলে মামলাটি আলোচনায় আসে। এর কিছুদিন পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হলে আরো একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওই সময় রুল ইস্যু করলেও আদালত ২০১৬ সালে রিট দুটি বাতিল করে দেয়। 

রিটকারীদের মধ্যে যারা এখনও বেঁচে রয়েছেন, তাদেরই একজন জাতীয় অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। এক আলাপে তিনি বলেছিলেন, “শেষ অবধি উচ্চ আদালত আমাদের মামলার অধিকারই স্বীকার করেনি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় থাকা প্রবীণ এই বুদ্ধিজীবীর অভিমত, “রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়েছে। এভাবে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য দেয়া উগ্রবাদীদের উৎসাহিত করে। কারণ তাদেরও বোঝানো হয় , পৃথিবীতে তাদের ধর্মই শুধু শ্রেষ্ঠ আর অন্য সব ধর্ম নিকৃষ্ট।”
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রধর্ম বিরোধী রিট বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে করেছিল জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ইসলামসহ বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভাবধারার ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো। 
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম রেখে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিয়ে বা উগ্রবাদী শক্তির সামনে মাথানত করে জঙ্গিবাদ দমনের কথা আমরা বলি কি করে! মুক্তিযুদ্ধ করার সময় আমি কি কখনো ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশে এমন একটি সময় আসবে যখন আমাদের ‘মাইনরিটি’ হিসেবে ‘সেকেন্ড গ্রেডের সিটিজেনে’ পরিণত করা হবে এবং তার থেকে উত্তরণের জন্য আবার লড়াই করতে হবে।” 

রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী দাবি করে রানা আরো বলেন, “একাত্তরে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা ফেরাতে না পারলে মৌলবাদ উৎখাত করা যাবে না।” সংখ্যাগরিষ্ঠ দেওবন্দী ওহাবী ভাবধারার কওমি মতাদর্শী মুসলিমদের চাপে থাকা প্রায় আড়াই লাখ কাদিয়ানীর সংগঠন আহমদিয়া মুসলিম জামা’তের আমির মোবাশশেরউর রহমান মনে করেন, “রাষ্ট্রধর্মের বিধান ধর্মীয় গোষ্ঠির ক্ষমতায় যাওয়ার একটা দরজা।”

অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ পরে পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটি পরিবর্তন করে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একই সংশোধনীতে সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়।

তবে “অবশিষ্ট ছয় শতাংশ সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করলে, অর্থাৎ সংখ্যালঘু শূন্য হলে কিভাবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করবে বাংলাদেশ?” এক আলাপে এমন প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও গল্পকার তুহিন দাস। মুক্তচিন্তার পক্ষে লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশ এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় থাকার কারণে ২০১৫ সালে আগস্টে ‘আনসারবিডি’ নামের এক উগ্রবাদী সংগঠনের হুমকী পেয়ে তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশ ত্যাগ করেন। 

চলতি দশকে কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা করে মহামূল্যবান প্রাচীন পুঁথি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, খ্রিস্টান গির্জাগুলোতে বোমা হামলা হয়েছে, নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে; এছাড়া রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বসতভিটা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে দাবি করে তুহিন বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার ফলে এ ধর্মের অধিকাংশ মানুষেরা মনে করে, এ দেশটা শুধু তাদের এবং সবকিছুতে তাদেরই অধিকার।” 

অবশ্য ভাষ্কর, লেখক ও গবেষক গোঁসাই পাহলভী মনে করেন, “সংবিধানের চর্চা সাধারণ মানুষর ভেতর নেই। তারা সংবিধান বুঝে ‘এ্যাক্ট’ কিংবা ‘রিএ্যাক্ট’ করেন, এমন নয়। জনগণের কৌমচেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনা, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই উগ্রতার পেছনে দায়ী। আরো আছে আন্তজার্তিক ঘটনাবলীর প্রভাব।”
তুহিন ও গোঁসাই, দুজনেই রাষ্ট্রের বৈষম্যের উদাহরণ হিসাবে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘একদিনের ঈদ’ উপলক্ষে কমপক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটির বিপরীতে হিন্দুদের প্রধান উৎসব ‘পাঁচ দিনের দূর্গা পূজা’ উপলক্ষে মাত্র একদিন ছুটি থাকা কথা বলেন। 
বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকে এই জনপদের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে, উল্লেখ করে তরুণ প্রকাশক ও সাংবাদিক সৈয়দ রিয়াদ বলেন, “দেশের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর যে ধরণের আক্রমণ করা হয় তা দেখেই মনে হয়, এই দেশে সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নেই।” 

তরুণ কবি রূমান শরীফের অভিমত, “একটি গণতান্ত্রিক দেশে সব ধর্মের মানুষ; আকি, নাস্তিক সবাই বাস করে। সেখানে রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ধর্ম থাকা মানে ওই ধর্মানুসারী বাদে বাকি নাগরিকদের অস্বিকার করা। সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করে দেয়। নাগরিকদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাঁর দাবি বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতপোষণকারীরা মোটেই নিরাপদবোধ করেন না। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, প্রকাশক, ব্লগারদের ওপর হামলার বা তাদের খুনের এখনো কোনো বিচার হয়নি।”

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ক এক আলোচনায় বক্তারা বলছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করছে। তারা আরো বলেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার না হওয়ায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
“ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আসলে খুব চালাক,” বলেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান। 
আচ্ছা প্রিয়া সাহা বা তাঁর পরিবারের সর্বশেষ অবস্থা কেউ জানেন কী? খবরে দেখেছিলাম, তাঁর স্বামী স্বামী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মলয় সাহাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, পিরোজপুরে পৈত্রিক বাড়িতে হামলা ও আগুনের ঘটনার প্রতিকার চেয়ে প্রিয়া সাহা স্থানীয় সাংসদ ও পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কাছে গেলেও তিনি অনীহা দেখিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

প্রিয়া সাহা
আরো পড়ুন:

২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

সংখ্যালঘুর কোনো উপায় নেই

মূলত সামরিক ফরমানে (১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং ৪ এর ২ তফসিল বলে) বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে প্রস্তাবণার আগে 'বিসমিল্লাহ’ সন্নিবেশিত হয়। পরের বছর এপ্রিলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে আইনসভা এর বৈধতা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটিতে পরিবর্তন এনে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একইসঙ্গে মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়।
গত নভেম্বরে ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তা কার্যকর করা হয়। পরবর্তী ৪৫ বছরে এটি সংশোধন করা হয়েছে মোট ১৬ বার। একই সময়ের মধ্যে দুই বার রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, দফায় দফায় সামরিক ক্যুসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছে দেশ। এসব মাথায় রেখে সংবিধানের ৪৬ বছর উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের ষষ্ঠ পর্বে থাকছে ঢাকায় বসবাসকারী তরুণ গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক কিম্বেল অভি এবং লন্ডন প্রবাসী কবি ও প্রকাশক তানভীর রাতুলের আলাপ। তাদের সাথেও কথা হয় ফেসবুক চ্যাটবক্সে ।

ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
কিম্বেল অভি : ক্ষেত্র ও ব্যাক্তি বিশেষে নির্ভর করে এই স্বস্তি। তবে বিশেষত্ব না থাকলে পরিস্থিতি অস্বস্তিকর।
তানভীর রাতুল : প্রচন্ড পায়ুচাপে, পাছার কাপড় নামিয়েই, অন্ধকারে না দেখে, কাঁটাবাঁশের গুড়িতে বসার মতো অস্বস্তিকর।

ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
কিম্বেল অভি : এটা একটা শিশুসুলভ আচরণ, যা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে সৃষ্ট। তবে এর ফলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি শ্রেণি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
তানভীর রাতুল : মুখ হা-সিনা টানটান করা দেশভালোর প্রতি-রাজাকার কর্তৃক আদালত অবমাননা।

ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
কিম্বেল অভি : আগের জবাবের মধ্যেই এ প্রশ্নেরও উত্তর রয়েছে।
তানভীর রাতুল : রাজনৈতিক-শুদ্ধতা আইন দিয়েই শুধু হয় না, তবে নির্ঘাত আইন থাকা উচিত।

ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
কিম্বেল অভি : সরকার সুবিধা বাদি আচরন করবে, সেটাই আসলে স্বাভাবিক।
তানভীর রাতুল : সরকার শুধু মুসলমানের দলই না, এরা মোনাফেকেরও দল।

ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
কিম্বেল অভি : এখন আর সংখ্যালঘুর কোনো উপায় নেই। হওয়ারও কোনো পথ দেখছি না।
তানভীর রাতুল : I think I do not need to reply the last question, you got my point.

পরম্পরার পূর্ববর্তী লেখাগুলো

১৬ নভেম্বর ২০১৭

রাষ্ট্রধর্মের মূলে ভোটের রাজনীতি

মূলত সামরিক ফরমানে (১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং ৪ এর ২ তফসিল বলে) বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে প্রস্তাবণার আগে 'বিসমিল্লাহ’ সন্নিবেশিত হয়। পরের বছর এপ্রিলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে আইনসভা এর বৈধতা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটিতে পরিবর্তন এনে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একইসঙ্গে মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়।
সম্প্রতি ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তা কার্যকর করা হয়। পরবর্তী ৪৫ বছরে এটি সংশোধন করা হয়েছে মোট ১৬ বার। একই সময়ের মধ্যে দুই বার রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, দফায় দফায় সামরিক ক্যুসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছে দেশ। এসব মাথায় রেখে সংবিধানের ৪৬ বছর উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের চতুর্থ পর্বে থাকছে ঢাকায় বসবাসকারী তরুণ প্রকাশক ও সাংবাদিক সৈয়দ রিয়াদের আলাপ। তার সাথেও কথা হয় ফেসবুক চ্যাটবক্সে ।
ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দ রিয়াদ : সংবিধান সংশোধনে যখন ভোটের রাজনীতিকে প্রাধান্য দেয়া হয় তখন আসলে গণতন্ত্র সাংবিধানিক ভাবেই লংঘিত হয়। সংখ্যাগুরুদের খুশি করতে ভোটের রাজনীতিতে সেখানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও রাষ্ট্রধর্ম ব্যবহারের ফলে বিষয়টি সাম্প্রদায়িক ও দৃষ্টিকটু-তো হয়েছেই; সেইসঙ্গে সংখ্যালঘুরা তাদের পরিচয় সংকটে পড়েছে। অথচ আমাদের প্রথম সংবিধান কোনো একক ধর্মের জন্য রচিত হয়নি; হয়েছে একটি দেশের জন্য, জনগণের জন্য। তাহলে এখানে আবার ধর্ম আসছে কোথা থেকে?

ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সৈয়দ রিয়াদ : উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যাওয়া পরও যখন ‘বিসমিল্লাহ’ সংবিধানে বহাল থাকে তখন দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত সর্বোচ্চ আদলতের রায়কে আমাদের গণতন্ত্রে কিভাবে দেখা হচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত রায় নিয়ে সরকার যে ধরণের রাজনীতি করেছে তাতে স্পষ্টতেই বোঝা গেছে তারা নিজেদের আদর্শিক জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। তা না হলে আদালতের এমন রায় অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখাত না অসাম্প্রদায়িক আদর্শে এ সরকার।

ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
সৈয়দ রিয়াদ আমাদের সংবিধান, এমনকি এই রাষ্ট্র জন্মেরও আগে থেকে এ জনপদের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের কারণে সংখ্যালঘু সম্পর্কে এক শ্রেণীর স্থানীয় মুসলমানদের মজ্জাগত ভাবে ধারণা হয়ে আছে যে এরা এই দেশের কেউ নন। আদতে তারা তাদের মূর্খতাকে বোঝার পরিবেশ পাচ্ছে না। এর জন্য অবশ্যই সংবিধান দায়ী।

ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
সৈয়দ রিয়াদ : সরকার সংখ্যালঘুবান্ধব নিঃসন্দেহে। কিন্তু ওই যে ভোটের রাজনীতির সমীকরণে তারা সেটা স্পষ্ট করতে পারছে না। দৃশ্যত তাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এখানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর দায়ও তাদের নিতে হবে।সরকার মুখে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলছে আর কার্যত সাম্প্রদায়িক আচরণ করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘুদের উপর ইদানীং যে ধরণের আক্রমণ করা হয়েছে তা দেখে মনে হয়েছে এই দেশে সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নেই। আর সংবিধান থেকেই যদি জাতি ধর্মের সাথে আপস করে তাহলে সেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে স্বস্তির কিছু দেখছি না।

ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
সৈয়দ রিয়াদ : আমাদের গণতন্ত্র এখনো সুসংহত নয়। নাগরিক অধিকার তলানিতে পড়ে আছে। তাই এসব বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি নিয়ে কোনে আশার খবর নেই। বুদ্ধিচর্চা এখানে বিকল। ২০১১ পর থেকে এই অবস্থা উন্নতি হওয়ার কোনো ধরণের কারণ নেই। সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নয়নের চিত্র এখানে ভয়ংকর। আসলে এই দেশে নাগরিক অধিকার বলে কিছু নাই।

পরম্পরার অন্যান্য লেখা
সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করেছে রাষ্ট্র!
সংখ্যালঘু নয় ক্ষমতাই বিষয়..
অসাম্প্রদায়িক ছিলো বলা যাবে না!
..কিভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দাবি করবে..
কতটা স্বাধীন হয়েছে বিচার বিভাগ?

১১ নভেম্বর ২০১৭

সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করেছে রাষ্ট্র!

মূলত সামরিক ফরমানে (১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং ৪ এর ২ তফসিল বলে) বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে প্রস্তাবণার আগে 'বিসমিল্লাহ’ সন্নিবেশিত হয়। পরের বছর এপ্রিলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে আইনসভা এর বৈধতা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটিতে পরিবর্তন এনে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একইসঙ্গে মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়। 
সম্প্রতি ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তা কার্যকর করা হয়। পরবর্তী ৪৫ বছরে এটি সংশোধন করা হয়েছে মোট ১৬ বার। একই সময়ের মধ্যে দুই বার রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, দফায় দফায় সামরিক ক্যুসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছে দেশ। এসব মাথায় রেখে সংবিধানের ৪৬ বছর উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের চতুর্থ পর্বে থাকছে বরিশালের তরুণ কবি রূমান শরীফের আলাপ। তার সাথেও কথা হয় ফেসবুক চ্যাটবক্সে ।

ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
রুমান শরীফ : এটা প্রত্যেক নাগরিককে অপমান করার মতো একটা বিষয়।কোন গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্র কখনোই একটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।

ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রুমান শরীফ : রাষ্ট্রের ধর্ম হয় কিভাবে! রাষ্ট্রধর্ম তো একটি হাস্যকর বিষয়।রাষ্ট্রের একটি ধর্ম থাকলে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা কি তবে রাষ্ট্রদ্রোহী! নাকি ধর্মদ্রোহী! তারা কি দেশের নাগরিক না! একটি গণতান্ত্রিক দেশে সব ধর্মের মানুষ; আস্তিক, নাস্তিক সবাই বাস করে। সেখানে রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ধর্ম থাকা মানে ওই ধর্মানুসারী বাদে বাকি নাগরিকদের অস্বিকার করা। 

ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
রুমান শরীফ : সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করে দেয়। নাগরিকদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে।
আগুনে জ্বলছে বাড়ি, সামনে সংখ্যালঘু বৃদ্ধার আহাজারি। ১০ নভেম্বর,
হরকলি ঠাকুরপাড়া, রংপুর। ছবি: মঈনুল ইসলাম (দৈনিক প্রথম আলো)
ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
রুমান শরীফ : এই সরকারের সময়কালে প্রচুর পরিমানে সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়েছে। সেগুলো সংবাদপত্র, মিডিয়ায় উঠে এসেছে। এছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা বিভিন্ন মতামতে বলেছেন, এখানে তারা মোটেই নিরাপদ বোধ করেন না।এমনকি এই সরকারের সময়কালে সংখ্যালঘুদের ওপর নানান সময়ে হামলার ঘটনার কোনো বিচার হয়নি।ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীরা এর সাথে জড়িত এমন সংবাদও মিডিয়ায় এসেছে। এখন কিভাবে বলা যায় আওয়ামীলীগ সংখ্যালঘু বান্ধব সরকার!

ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
রুমান শরীফ : বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতপোষণকারীরা মোটেই নিরাপদবোধ করেন বলে মনে হয় না।বাংলাদেশে লেখক, প্রকাশক, ব্লগারদের ওপর হামলার বা তাদের খুনের এখনো কোনো বিচার হয়নি। এমনকি সোস্যাল নেটওয়ার্কে, সংবাদপত্রে মতামত প্রকাশ করলেও ৫৭ ধারায় কারাদণ্ড হয়।

পরম্পরার অন্যান্য লেখা

০৯ নভেম্বর ২০১৭

সংখ্যালঘু নয় ক্ষমতাই বিষয়..

‘ভারতের ১৯৫২ সালের প্রথম সংবিধানের মূলনীতিতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ ছিলো না। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধানের মূলনীতি থেকে  এই শব্দ দুটো আমদানি করেন ইন্দিরা গান্ধী।ভারতীয় সংবিধানে ৪২তম সংশোধনীতে, মানে ১৯৭৬ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ঠাঁই পায়। এর পেছনে ছিলো ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম এবং ভারতজুড়ে বামপন্থীদের উত্থান।’ সাম্প্রতিক এক ফোনালাপে বলছিলেন কলকাতার তরুণ কবি ও সাংবাদিক অতনু সিংহ। 
সম্প্রতি ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে জন্ম নেয়া এই রাষ্ট্রের সেই সূচনা সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রাহিম’ (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে) লেখা ছিলো না। ছিলো না রাষ্ট্রধর্মের কোনো বিধানও। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করা হয়। আর ১৯৮৮ সালে সাবেক সেনাশাসক এইচএম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়। পরবর্তীতে উচ্চ-আদালত ওই সংশোধনী দুটো বাতিল করলেও ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই দুটি জায়গা অপরিবর্তিত রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করে আইনসভা। 
সংবিধানের ৪৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে দুই তরুণ লেখক হামিম কামাল ও শ্মশান ঠাকুরের আলাপ। তাদের সাথেও মূলত ফেসবুক চ্যাটবক্সে কথা হয় ।
ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
হামিম কামাল : একবিন্দু স্বস্তিদায়ক নয়। 
শ্মশান ঠাকুর : রাজনীতি অন্ধ ক্ষমতায়নের দিকে যাচ্ছে, এখানে স্বস্তি থাকবার কথা নয়।

ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
হামিম কামাল : বিষয়টি স্ববিরোধী। 
শ্মশান ঠাকুর : ইসলামকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, এই আর কি।

ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
হামিম কামাল : রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্বের বড় দায় আছে। তবে এখানে সরল উত্তরের অবকাশ নেই। অল্প কথায়, এটা সুরক্ষিতা রাষ্ট্রস্বর্গে এমন এক ছিদ্রপথ যার ভেতর দিয়ে অনেক বড় বড় অকল্যাণসর্প প্রবেশ করে একের পর এক। এবং এরা নিয়ত সঙ্গমাচারি। সারাক্ষণ এমনভাবে জড়াজড়ি করে থাকে যে দায় বিচারের লাঠিতে পিটিয়ে আলাদা করা কঠিন।
শ্মশান ঠাকুর : উগ্রতা যখন অর্থের সাথে সম্পর্কিত তখন আইন অবশ্যই তার জন্য দায়ী, সংবিধানও।

ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
হামিম কামাল : নীতিগত দিক থেকে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুবান্ধব। ঐতিহাসিক ভাবেও। তবে বর্তমানের প্রশ্নে দলটির নীতি, ইতিহাস; দুটোই সমাধিস্থ।
শ্মশান ঠাকুর : লীগ সরকার ক্ষমতার জন্য উন্মাদ। কোন সংখ্যালঘু তার কাছে বিষয় নয়, ক্ষমতাই বিষয়।

ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
হামিম কামাল : ভালো নেই। ধর্মবিচারে, অধিকারে অসাম্য আছে। একইসঙ্গে ধর্মাধর্ম নির্বিচারে অধিকারহীনতার আধিয়ারি জারি। দ্বিমুখী দায়। অধিকার কে কাকে দেবে।
শ্মশান ঠাকুর : অধিকার কি পাচ্ছে? মনে হয় না। সম অধিকারের বিষয়ই আসে না। ক্ষমতাধর আর সাধারণের মধ্যেই সম অধিকার নেই।
মূলত সামরিক ফরমানে (১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং ৪ এর ২ তফসিল বলে) বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে প্রস্তাবণার আগে 'বিসমিল্লাহ’ সন্নিবেশিত হয়। পরের বছর এপ্রিলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে আইনসভা এর বৈধতা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটিতে পরিবর্তন এনে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একই সংশোধনীতে মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরে এসেছে। 
বরিশালের এ দৃশ্য ২০০৬ সালের
পড়ুন :
অসাম্প্রদায়িক ছিলো বলা যাবে না!
..কিভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দাবি করবে..
কতটা স্বাধীন হয়েছে বিচার বিভাগ?
ধর্মের কল নড়ে রাষ্ট্রের বাতাসে..
সন্দেহপ্রবণ, বাঙালী মুসলমানের মন!
হুমকীতে ভারতবর্ষের সুফিভাব
দমনে দৃঢ় রাষ্ট্র কাঠামো
অস্ত্রবাজ সময় ও সমাজে ...
পুলিশ ছাড়া কেউ থাকবে না ...
ভয় পেও না, সাবধান থেকো ...
পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব নেবে কে?
ওই বেতনের কেতন উড়ে
হেফাজতের পথে ওলামা লীগ !
সানিকে ঠেকাবে হেফাজত !
নুরুলদ্বয়ের মহালোচিত পুত্রেরা
প্রবীর প্রকৃত প্রতিবাদী অগ্রজ
সময় হুমকী আর হত্যালীলার
মুক্ত সাংবাদিকতা ও আত্মরক্ষার্থে ...
সর্বোচ্চ সংকর জাতের সঙ্কট
ক্রিকেটের মওকায় সাম্প্রদায়িকতা !
সাংবিধানিক পিতা আইনে অনাত্মীয় !
রাষ্ট্রীয় শিশ্ন - ধর্ষন, খুন এবঙ ...
বাংলা জাগবেই জাগবে...
ইসলামে ‘বেপর্দা’ নারীও নিরাপদ
বর্ষবরণে বস্ত্রহরণ কী পরিকল্পিত !

০৮ নভেম্বর ২০১৭

অসাম্প্রদায়িক ছিলো বলা যাবে না!


সম্প্রতি ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তা কার্যকর করা হয়। পরবর্তী ৪৫ বছরে এটি সংশোধন করা হয়েছে মোট ১৬ বার। একই সময়ের মধ্যে দুই বার রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, দফায় দফায় সামরিক ক্যুসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছে দেশ।
ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে জন্ম নেয়া এই রাষ্ট্রের সেই সূচনা সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রাহিম’ (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে) লেখা ছিলো না। ছিলো না রাষ্ট্রধর্মের কোনো বিধানও। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করা হয়। আর ১৯৮৮ সালে সাবেক সেনাশাসক এইচএম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়। পরবর্তীতে উচ্চ-আদালত ওই সংশোধনী দুটো বাতিল করলেও ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই দুটি জায়গা অপরিবর্তিত রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করে আইনসভা। সংবিধানের ৪৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে থাকছেন ভাষ্কর, চিন্তক ও গবেষক গোঁসাই পাহলভী । বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানকারী এই যুবক শিল্পীচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি এবং প্রামান্যচিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তার সাথেও ফেসবুক চ্যাটবক্সে কথা হয় ।
ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
গোঁসাই পাহলভী : সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংশয় আছে বলেই এই প্রশ্নের উত্থাপণ মনে হয়েছে। সংবিধান বাস্তবতা এবং ধর্মচর্চার বাস্তবতায় সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুদের জীবন-যাপন সংস্কৃতির বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।সংবিধানের বাস্তবতায় যে কোনও সচেতন নাগরিক আতংকিত হবেন, অস্বত্বিতে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম থাকবে আবার অপরাপর ধর্মগুলোও থাকবে, তাদের অধিকারও সমান হবে এমন নয়। সেটা হয়ওনি।যদি সমানভাবে চর্চিত হতে হয়, তবে সেটা রাষ্ট্র থেকেই হতে হবে। মানে রাষ্ট্র যদি ইদে তিন দিন ছুটি দেয় তাহলে পূজায়ও সেটা হতে হবে। পাঁচ দিনের পূজায় এক দিন ছুটি! এটা তো সাংবিধানিক আইন মানা হলো না, রাষ্ট্রকে কি এ বিষয়ে জবাবদিহি করা যায়? সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ে ধর্মের উপর এই গুরু দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায়, বাংলাদেশের সংবিধান শুরুতেই অসাম্প্রদায়িক ছিলো এমন বলা যাবে না। কারণ, সাম্প্রদায়িকতাকে এখানে আইনের দ্বারা সিদ্ধ করা হয়েছে, উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। 

ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
গোঁসাই পাহলভী : ২৭ অনুচ্ছেদ মতে. এই ধারাটি বিতর্কিত। আইনের দৃষ্টিতে সমান হলে আইনকে শুরুতেই সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করতে হবে। সম্পত্তির মতো গুরুতর বিষয়টি ধর্মের হাতে রেখে সংবিধান নিজেকে কীভাবে অসাম্প্রদায়িক ভাবে সেটাই প্রশ্ন। 

ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
গোঁসাই পাহলভী : সংবিধানের চর্চা সাধারণ মানুষর ভেতর নেই। তারা সংবিধান বুঝে এ্যাক্ট কিংবা রিএ্যাক্ট করেন, এমন নয়। জনগণের কৌমচেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনা, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই উগ্রতার পেছনে দায়ী। আরো আছে আন্তজার্তিক ঘটনাবলীর প্রভাব। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর ক্রমাগত মুসলমানদের মার খাওয়ার ইতিহাস, এবং স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে তার উপস্থাপন এখানকার মুসলমানদের উগ্রবাদীতার সাপেক্ষে তৈরী করার মনোভাব দেখা যাচ্ছে! এ বিষয়ে ‘কাভারিং ইসলাম’ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
গোঁসাই পাহলভী : নিয়োগ প্রথায় সংখ্যালঘুরা এই সরকারের কাছ থেকে আনডু ফ্যাসালিটিস পাচ্ছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু জনগণের স্তরে তাকালে ইসলামিস্টদেরকে বিভিন্ন প্রকার ছাড় দেয়া নিঃসন্দেহে বিরোধাত্মক। গ্রাসরুট বা গ্রাস লেবেলে তাকালে সংখ্যালঘুদের ভূমিদখল, বাস্তুচ্যুত করার বিষয়ে যে সমস্ত সংবাদগুলো ছাপা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর লোকদের নামই এসেছে ঘুরেফিরে। 

ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
গোঁসাই পাহলভী : বাংলাদেশের লেখক বা চিন্তুকরাই হচ্ছেন এ দেশের প্রকৃত সংখ্যালঘু। তারা এখন মার খাচ্ছেন। দেশ থেকে পালাচ্ছেন, দেশের ভেতর গুম হচ্ছেন। অধিকারের বিষয়ে সম কিংবা অসমের প্রেক্ষাপটে অধিকার বিচার বিষয়ক ধারণা সংবিধান স্বচ্ছতার সাথে লিপিবদ্ধ নয়। অর্থাৎ অধিকারের মতো দার্শনিক ধারনাকে কনটেইনড করে গড়ে ওঠা ব্যবস্থার কথা এখানকার আইনবেত্তা বা বুদ্ধিজীবীরা ভেবেছেন বা ভাবতে পেরেছেন এমন উদাহরণ আমাদের হাতে নেই। অধিকারের বিষয়ে লোকায়ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা উহ্য রেখেই বলছি। ধর্ম কতটা অধিকার দেয় মানুষকে, রাষ্ট্র কতটা অধিকার কুক্ষিগত করেছে, কতটা অধিকার ছাড় দিয়েছে এ তো বিশদ প্রশ্ন। পাঁচটি মৌলিক অধিকার চিহ্নিত হলো, নির্দিষ্ট হলো, এই অধিকারগুলো কী জনগণের দ্বারা চিহ্নিত, নাকি রাষ্ট্র নিজেকে কর্তা ভেবে জনগণের অধিকারের বিষয়ে কেবল পাঁচটি ধারণাকেই সনাক্ত এবং সূত্রবদ্ধ করেছে। এটা প্রকৃতিগতভাবে একটি ব্যত্যয়। 

ছবিটি বাংলাদেশের, আমারই তোলা। 
আরো পড়ুন :

০৭ নভেম্বর ২০১৭

..কিভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দাবি করবে..

সম্প্রতি ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তা কার্যকর করা হয়। পরবর্তী ৪৫ বছরে এটি সংশোধন করা হয়েছে মোট ১৬ বার। একই সময়ের মধ্যে দুই বার রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, দফায় দফায় সামরিক ক্যুসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখেছে দেশ। 

ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে জন্ম নেয়া এই রাষ্ট্রের সেই সূচনা সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রাহিম’ (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে) লেখা ছিলো না। ছিলো না রাষ্ট্রধর্মের কোনো বিধানও। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করা হয়। আর ১৯৮৮ সালে সাবেক সেনাশাসক এইচএম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়। পরবর্তীতে উচ্চ-আদালত ওই সংশোধনী দুটো বাতিল করলেও ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই দুটি জায়গা অপরিবর্তিত রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করে আইনসভা।
সংবিধানের ৪৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ক ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। আলাপ হয়েছে বিভিন্ন পেশার তরুণ ও যুবকদের সাথে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের প্রথম পর্বে থাকছেন ইসলামি মৌলবাদিদের প্রাণনাশের হুমকীর মুখে দেশ ত্যাগ করা যু্বক তুহিন দাস। তিনি মূলত কবি ও গল্পকার। মুক্তচিন্তার পক্ষে লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশ এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় থাকার কারণে ২০১৫ সালে আগস্টে ‘আনসারবিডি’ নামের এক সংগঠনের হুমকী পেয়ে ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশ ত্যাগ করেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পেনসেলভিনিয়া রাজ্যের পিটসবুর্গে অবস্থানকারী সাহিত্যিক তুহিনের সাথে কথা হয় মূলত ফেসবুক চ্যাটবক্সে । 
ঈয়ন : দেশে বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক বলে আপনি মনে করেন?
তুহিন দাস : যে সমাজ বা দেশের মানুষ পরমতসহিষ্ণু, আস্থা, ভালবাসা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করে সে সমাজ বা দেশে বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষেরা একত্রে মিলেমিশে আনন্দের সঙ্গে বৈচিত্র নিয়ে বসবাস করতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ তার উদাহরণ। আর বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের ছবিগুলো দেখলে সহজেই অনুমেয় এরা কতটুকু আতঙ্কিত জীবন যাপন করছে। যেন তারা মানুষ নয়, নেহাত একটি প্রাণীবিশেষ। নাসিরনগরে হিন্দু পাড়ায় আক্রমণের মামলার প্রায় দু’শতাধিক আসামী জামিনে বেরিয়ে গেছে, তার মানে তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর তেমন জোর নেই। সংবিধানে ফাঁকফোকরগুলো তো ক্ষমতাধরদের চেনা, তারা এসব ধারার চর্চা করে। কয়েক দিন আগেও দেখলাম মৌলভীবাজারে আদিবাসী ২৭০ খাসিয়া পরিবারের জমি চা বাগান করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন স্থানীয় এক নেতাকে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছিল গত বছর গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের জমি দখলের সময়-সেখানে আগুন দিয়েছিলো পুলিশ। সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়ে রমেল চাকমা হত্যা কিংবা ছাত্রনেতা বিপুল চাকমা গ্রেফতার; এসব আতঙ্কিত করছে সংখ্যালঘুদের।

ঈয়ন : উচ্চ আদালত বাতিলের পরও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে সব ধর্মের সমান অধিকারের বিধান সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
তুহিন দাস : একটি দেশে বিভিন্ন ধর্মের ও মতের মানুষ বাস করে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান এই চারটি ধর্মের মানুষ এ দেশে বাস করে আসছে বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকেই। এ দেশের জন্মলগ্ন থেকে যেখানে চারটি ধর্মের মানুষের কথা মাথায় রেখেই সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিলো। কি এমন দরকার হয়ে পড়েছিলো যে তিনটি ধর্মের মানুষকে প্রাধান্য না দিয়ে একটি মাত্র ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ ঢোকানোর? বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার আগে মুসলিমরা কি কখনো ভিন্ন ধর্ম বা মতালম্বীর মানুষ দ্বারা কি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো? ইসলামের নাম-নিশানা কি মুছে যাচ্ছিল বাংলাদেশ নামক ভূখ- থেকে? রাষ্ট্রের কাজ সকল ধর্মমতের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা; কিন্তু রাষ্ট্র একটি মাত্র ধর্মের মানুষকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। যেমন সরকারী ছুটির বিষয়টি যদি দেখি শুক্রবার জুম্মাবার, ওই দিন সরকারী ছুটি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বা যে সব দেশের সাথে আমাদের বাণিজ্যিক লেনদেন আছে সেসব দেশ ওই দিন ছুটি নয়, ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে একটি ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে। সাহায্যের নামে অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলোতে ধনী ধর্মপ্রধান দেশগুলোর রাজনৈতিক লিপ্সা মেটানোর সুযোগ থাকে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান দেখি ঈদের ছুটি নয় দিন, কোরবানির ছুটি পাঁচ দিন, ২৭ রমজান একদিন, ঈদে-মিলাদুন নবী একদিন, শবে বরাত একদিন, শবে মেরাজ একদিন, মহররমে একদিন। বিপরীতে দুর্গাপূজায় ছুটি দুই দিন, জন্মাষ্টমীতে একদিন, বড়দিনে একদিন এবং বৌদ্ধ পূর্ণিমায় একদিন। সকল ধর্মের মানুষের অধিকার সমান হলে ইসলাম বাদে অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পালনীয় রাষ্ট্রীয় ছুটি মাত্র একদিন কিভাবে হয়?

ঈয়ন : সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের যে উগ্রবাদী মনোভাব দেখা যায়; তার পেছনে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব কতটা দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
তুহিন দাস : দায়ী যে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা ও মহামূল্যবান প্রাচীন পুঁথি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, খ্রিস্টান গির্জাগুলোতে বোমা হামলা হয়েছে, গত বছরের নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে আর সাঁওতাল পল্লীর উপর রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে; তাদের বসতভিটা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে, তারপরে আর কি বলার থাকতে পারে! সংখ্যালঘুদের জমি দখল করা হল বাঙালী মুসলমানের একটি শ্রেণীর লক্ষ্য। তাছাড়া ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে প্রকাশ্যে যেভাবে অন্য ধর্মের প্রতি উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান করে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বীজ বপন করে দেয়া হয় তাতে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষেরাও ভেতরে ভেতরে উগ্রবাদী হয়ে ওঠে। প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়, ‘হিন্দুরা মালাউন (অভিশপ্ত), বাংলাদেশ তাদের দেশ নয়, তাদের দেশ ভারত। তারা ভারত চলে যাক।’ এই ধরনের বর্ণবাদী কথা কেউ বললে বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো আইনে তাকে বাধা দেয়া যায় না। অথচ এই একই কথা যদি কোন মানুষ একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীকে বলে যে, ‘তুমি মুসলমান, তোমার দেশ সৌদি আরব; তুমি আরব দেশে চলে যাও।’ তবে কি ঘটতে পারে সহজে অনুমেয়! রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার ফলে এ ধর্মের অধিকাংশ মানুষেরা মনে করে, এ দেশটা শুধু তাদের এবং সবকিছুই তাদেরই অধিকার। আমরা পত্রিকার পাতায় দেখেছি ধর্ম অবমাননার দায়ে সারা বাংলাদেশের অসংখ্য হিন্দু শিক্ষকদের জেলে যেতে হয়েছে। জেল থেকে বেরনোর পরে তারা অনেকে চাকরী হারিয়েছেন। কেউ জায়গা-জমি বিক্রি করে নিরুদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের খবর কেউ রাখেনি। নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তির কথা মন পড়ছে, তাকে কিভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে! এমন কোন ঘটনা কি কোনো মুসলমানের সঙ্গে ঘটেছে হিন্দু ধর্ম অবমাননার অভিযোগে? ভার্চুয়াল জগতে টেকনোলজিতে অদক্ষ হিন্দু মানুষের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দিনের পর দিন এসব অসত্য অভিযোগে অভিযুক্ত করে সংখ্যালঘু মানুষদেরকে অত্যাচার ও নিপীড়ন করা হচ্ছে, ধর্মের নামে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। লালনের গান করার কারণে তাদের জানাজায় বাধা দেয়া হচ্ছে। ব্লগার, বিদেশী ও এ দেশের সাধারণ মানুষ রেহাই পায়নি উগ্রপন্থী ধর্মাবলম্বীদের হাত থেকে। কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, বিদ্বেষমূলক মনোভাব প্রকাশ করলে যথাযথ আইন ও শাস্তির প্রয়োগ থাকতো তবে হয়ত সংখ্যাগুরুর সাথে সংখ্যালঘুর ভাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠত। সংখ্যালঘুর প্রতিমাগুলো ভাঙা হতো না এবং ভাঙা প্রতিমাগুলো দ্রুত বিসর্জন দিয়ে দেয়ার জন্য প্রশাসন থেকে চাপ আসতো না।
ঈয়ন : আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কতটা সংখ্যালঘু বান্ধব?
তুহিন দাস : পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত খবরগুলোর দিকে তাকালে বলতে হয় বাংলাদেশের কোনো সরকারই সংখ্যালঘু বান্ধব নয়। কিন্তু সরকারগুলো বিদেশে গিয়ে বলে থাকে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। অবশিষ্ট ছয় শতাংশ সংখ্যালঘু আগামী ৫০ বছরে দেশত্যাগ করলে, অর্থাৎ সংখ্যালঘু শূন্য হলে কিভাবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করবে বাংলাদেশ?
ঈয়ন : বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষ, বিশেষত লেখক-বুদ্ধিজীবিরা সাম্প্রতিক সময়ে, মানে ২০১১ পরবর্তী সময়ে কেমন আছেন? গত ছয় বছর ধরে কতটা সম অধিকার পাচ্ছে সব ধর্মের মানুষ?
তুহিন দাস : যেখানে মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চলছে, সেখানে সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতের লেখক বুদ্ধিজীবীদের স্থান কোথায় হতে পারে? হেফাজতে ইসলামের দাবীর মুখে পাঠ্যপুস্তক থেকে অনেক লেখকদের লেখা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের মতোই সংখ্যালঘু ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা একজন মুক্তবুদ্ধির লেখককেও নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়। এ কাজটি করে থাকে মুখে মুখে প্রগতিশীল নামধারী লেখকেরা। কিন্তু তারা পেছন থেকে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে থাকে পদক-অর্থ-যশ-রেশন প্রাপ্তির লোভে। ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে আপনি আপনার বাক স্বাধীনতার প্রয়োগ করতে গেলে আপনার প্রাণ যেতে পারে নিমেষে। খোদ বাংলা একাডেমিতে গত বছর এক লেখকের মৃতদেহ ঢুকতে দেয়া হয়নি। অথচ তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। বাংলা তার গৌরব হারাচ্ছে। প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিককে জেলে বন্দী করা হয়েছে, একাধিক প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করা হয়েছে, বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে, চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি দেয়া হয়নি, রানা প্লাজা নিয়ে নির্মিত সিনেমা আটকে দেয়া হয়েছিলো, সুন্দরবনে কয়লা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী নাটকের শো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, অনেক সাংবাদিককে ৫৭ ধারার ফাঁদে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন করা এসেছে কোন গ্রন্থটি সর্বশ্রেষ্ঠ? তাহলে নিকৃষ্ট গ্রন্থের অনুসারী কারা? না। বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার পাচ্ছে না। আইন সবার জন্য সমান নয়।

সমগোত্রীয় ভাব

কতটা স্বাধীন হয়েছে বিচার বিভাগ?
ধর্মের কল নড়ে রাষ্ট্রের বাতাসে..

২১ আগস্ট ২০১৫

নুরুলদ্বয়ের মহালোচিত পুত্রেরা

নুরুলদ্বয়ের মহালোচিত পুত্রেরা
তাদের একজনের নাম নুরুল ইসলাম খান, অপরজনের খন্দকার নুরুল হোসেন নুরু মিয়া। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই নুরুলদ্বয় যথাক্রমে কুমিল্লা ও ফরিদপুরের প্রভাবশালী রাজাকার ছিলেন। মানবতাবিরোধী বহু অপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। তাদের পুত্রদ্বয়ও আজ বিভিন্ন অপরাধের অভিযুক্ত হয়ে মহালোচিত। প্রথম জনের পুত্র সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান। আর পরের জনের পুত্র স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল বাণিজ্য নিয়ে ইদানীং এই নুরুল পুত্রদ্বয় প্রায় একই সুরে কথা বলছেন। ওই ঘটনার প্রতিবাদকারী সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকেও তারা সমালোচনা করছেন একই তালে। তাদের এই দৃশ্যমান আঁতাত এবঙ ক্ষমতার প্রতিপত্তি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সাধারণ মানুষের মনে স্রেফ শঙ্কা জাগাচ্ছে, হয়ত হতাশাও। কারণ ওই পুত্রদ্বয়ের মধ্যে যিনি এখন মন্ত্রী - তিনি নিজেও পাকিস্তানী বাহীনির পক্ষে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তিনি আবার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই (মেয়ের শ্বশুর)।
আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের স্বামী হওয়ার সুবাদে সেই ১৯৯০-৯১ সাল থেকে ব্যাপক পরিচিত পাওয়া এক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নাঈমুল ইসলাম খান। সাম্প্রতিক এক কলামে তিনি লিখেছেন - “বাংলাদেশে অনেক সাংবাদিক অ্যাক্টিভিজম করেন। দেখা উচিত, সাংবাদিকতা এটা অনুমোদন করে কি-না। এটা নিয়ে তো কোনো আইন নাই। সাংবাদিকতা কোনো আইন মেনে করা হয় না। কিন্তু আমি বুঝি যে, এটা সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী। এটাকে বলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।” তাকে জিজ্ঞেস করতে মন চায়, সাংবাদিকরা অ্যাক্টিভিস্ট হলে কনফ্লিক্টটা মূলত কার ইন্টারেস্টে ঘটে? তিনি কি এটা একটু পরিস্কার করবেন? তার কি মনে হয় একজন সাংবাদিকের অন্য কোনো, বিশেষত প্রতিবাদী সত্ত্বা থাকা উচিত নয়? সাংবাদিক হওয়া মানেই কি প্রতিবাদের অধিকার হারিয়ে যাওয়া? প্রবীর সিকদারের যে স্ট্যাটাসটি নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, লিখেছেন - ‘এটি কি জার্নালিস্টিক স্ট্যাটাস?’; সেই স্ট্যাটাসটি মূলত কোন ঘটনার পরম্পরায় দেয়া তা কি তিনি যথেষ্ঠ ঘেঁটে জেনেছেন? নিয়মিত টকশো’তে গিয়ে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করতে তিনি যে কথার খৈ ফোটান, তা কি এক্টিভিজম নয়?
কারো বেয়াদবী মনে হলে ক্ষমা করবেন। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এই দেশে প্রকৃত সাংবাদিকরা সোচ্চার হলে সবচেয়ে বিপাকে পরে যান ধান্দাবাজ ‘সাংবাদিক সাহেব’ আর ‘সাংবাদিক নেতা’ গোষ্ঠী। তারা সব সময় চায় দেশের সকল সাংবাদিক তাদের মতো কারো না (লেওড়ার) ছায়াতলে থেকে উপর মহলের পারপাস সার্ভ করুক, নয়ত নিজেই সাংবাদিক সাহেব বা নেতা হয়ে উঠুক। বস্তুত যারা নেহাতই সাংবাদিকতার স্বার্থে সাংবাদিকতা করছেন, সোচ্চার হচ্ছেন বিভিন্ন অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে; ‘সাংবাদিক সাহেব’ আর ‘সাংবাদিক নেতা’ গোষ্ঠীই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।

এর আগে প্রাণনাশের শঙ্কায় সাংবাদিক প্রবীর শিকদার স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিবিসি’কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “তিনি (সাংবাদিক প্রবীর) যে অভিযোগ আনতেছে এটাকে পাগলের পাগলামি ছাড়া আমি আর কিছুই মনে কারি না। তার সাথে আমার কনফ্লিক্টের কোন ইস্যুই নাই।”

মুক্তিযুদ্ধে পিতাসহ পরিবারের ১৪ সদস্যকে হারানো প্রবীর শিকদার মূলত ফরিদপুরের হিন্দু সম্পত্তি দখল এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে লেখালেখির কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। এর জন্য ওই মন্ত্রীসহ আরো দুজনকে দায়ী করে ফেসবুকে লেখার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে গণদাবির মুখে তিন দিনের মাথায় রিমাণ্ড চলাকালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এ নিয়ে গত ক’দিন ধরে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে - মেইনস্ট্রিম ও সোস্যাল মিডিয়া। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন এই সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার কথাও বলেছে ভিনদেশী বেশ কয়েকটি মিডিয়া। বিব্রত ঘোর আওয়ামী সমর্থকরাও।
এ লেখাটি প্রস্তুতকালে এক লেখক ও নাট্যনির্মাতা অগ্রজ ভেতরবাক্সে বার্তা পাঠিয়ে জানতে চাইলেন - ‘প্রবীর শিকদার নিয়ে এই আলোচনায় মন্ত্রীর দখলদারির বিষয়টা চাপা পরে গেল না’তো? তিনি কি পার পেয়ে যাবেন সংখ্যালঘুদের জমি-ভিটা জোড় করে অল্প টাকায় কিনে নিয়ে তাদের দেশ ছাড়া করার ঘটনায়?’ কোনো জবাব দিতে পারিনি তাকে। কিন্তু তার প্রশ্ন দুটো সাথে সাথেই নাঈমুল ইসলাম খান -এর লেখাটির শেষাংশ পুনরায় স্মরণে এলো।
স্বঘোষিত ওই রাজাকারপুত্র লিখেছেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নানা রকম নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। এটা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। এটার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোনো দল জড়িত নয়। তবে একটা পার্টিকুলার অভিযোগ সত্যও হতে পারে। একজন হয় তো সঠিকভাবে জমিটা কিনেছেন কিন্তু আমি যদি তাকে পছন্দ না করি সে তখন তার বিরুদ্ধে লেগে গেলাম। বলে যে হিন্দুর জমি জোর করে নিয়েছে। খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে, ওই লোকটাও ওই জমিটা কিনতে চেয়েছিলেন। না পেরে মিথ্যে অভিযোগ ছড়িয়ে বিষয়টাকে ভিন্নরূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন।”

সাংবাদিকতার লেবাসে অর্থ-আত্মসাতের বহু-অভিযোগে আক্রান্ত আলোচিত ওই ‘সাংবাদিক সাহেব’ মূলত কি বোঝাতে চেয়েছেন - তা সবাই যে একই মাত্রায় বুঝবেন, এমনটা আমি আশা করি না। তবে ওনার কথার সুরের সাথে অভিযুক্ত মন্ত্রীর কথার সুরে যে মিল আছে তা বোধকরি সকলেই টের পাবেন। ফরিদপুরের ভজনডাঙার অরুণ গুহ মজুমদারের মালিকানাধীন দয়াময়ী ভবন নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়ে তাদের স্বপরিবারে দেশছাড়া করার ব্যাপারে দেয়া এক বিবৃতিতে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন - অন্যের উপকার করতে গিয়েই তিনি বিপদে পরেছেন!
যাকগে, আশার কথা হচ্ছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে তার নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুরে হিন্দু সম্পত্তি দখলের যে অভিযোগ করেছেন তার সত্যতা যাচাইয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কামরুজ্জামান সেলিমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের এই কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। অপর দুই সদস্য হলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান ও সদর উপজেলার ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার খলিলুর রহমান। এ বিষয়ে গত ১৭ অগাস্ট চিঠি পেয়েছেন জানিয়ে কমিটি প্রধান সাংবাদিকদের বলেছেন, পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
আরো একটি বিষয় উল্লেখ করছি এখানে। ২০০১ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি থাকার সময় সন্ত্রাসীর হামলায় গুরুতর আহত হয়ে একটি পা হারিয়েছিলেন দুই সন্তানের জনক প্রবীর শিকদার। তার অভিযোগ, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লেখার কারণে মুসার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ওই হামলা চালিয়েছিলো। এই মূসা আবার প্রধানমন্ত্রীর ফুপাতো ভাই ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর)। উল্লেখিত নুরুলদ্বয়ের দুই পুত্রের কর্মকাণ্ডের কল্যাণে তিনি কিন্তু আজ আর অতটা লাইম লাইটে নেই। মিডিয়ার ফোকাস ঘুরে গেছে। যদিও মুক্ত হয়ে এক সাক্ষাতকারে প্রবীর জানিয়েছেন তাকে নুলা মুসা অর্থাৎ বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের বিষয়েই বেশি প্রশ্ন করেছে পুলিশ।
মুক্তির পর পরিবার ও সমর্থকদের সাথে প্রবীর শিকদার

পূর্ববর্তী পোষ্টঃ
প্রবীর প্রকৃত প্রতিবাদী অগ্রজ

০৯ জানুয়ারী ২০১৪

বিশ্বের চেয়ে দেশের শান্তিরক্ষা কঠিন!

বিশ্ব শান্তিরক্ষায় যারা সবচে সমাদৃত, সেই পুলিশ সেনাবাহিনী নিজ দেশের শান্তি রক্ষায় কেন ব্যর্থ? জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের এসাইনমেন্টগুলোর চেয়ে নিজ দেশের নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা মিশনের এসাইনমেন্ট কি খুব বেশী কঠিন ? অথচ নির্বাচনের দিন আগেও না শুনলাম, শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য আরো দেশীয় সৈন্য চাইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন জাতিসংঘ  মহাসচিব বান কি মুন
সর্বোচ্চ সৈন্য সরবরাহকারী এই রাষ্ট্রের পুলিশ সেনাবাহিনীর ৯৮ হাজার ৯৫৯ জন সদস্য বর্তমানে চার মহাদেশে ১৫টি শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন এদিকে, জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার আগে-পরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মিশনে আজ জানুয়ারি অবধি মাঠে আছেন প্রায় ছয় লাখ সদস্য এর মধ্যে দেশের ৫৯ জেলায়  আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে একজন লে. কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তার অধীনে ৮০০ জন করে সেনাসদস্য রয়েছেন আর এদের উপস্থিতিতেই ঘটছে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস যদিও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, নির্বাচন পরবর্তী নাশকতার ঝুঁকিতে থাকা এলাকা চিহ্নিত করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে তবুও কেউ নিরাপদে নেই দেশে চলমান রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় বান কি মুনও গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছেন নির্বাচনের পর দিনই তিনি প্রতিক্রিয়া জানান

এর আগেও আমরা দেখেছি - দেশের যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়নের প্রথম শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়  এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে নির্বাচনকালীন সময়ে তারাই সবচেয়ে বেশী নাশকতার ঝুঁকিতে ছিলেন এবং সহিংসতার শিকারও হয়েছেনআতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আতঙ্কে শত শত হিন্দু পরিবার ফের দেশ ছাড়ার চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে অথচ স্বাধীনতার এই ৪২ বছর পরও কি এমনটা হওয়ার কথা ছিলো? বাংলাদেশ কি আসলেই একটি ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র


যত দূর মনে পরে, নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রায় দেড়শকোটি টাকা চেয়েছিলো পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স; আর সেনাবাহিনী চেয়েছিলো ২৬ কোটি টাকা তো জনতারই টাকাআর জনতাই আজ নিরাপত্তাহীন বিশেষ করে দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান . মিজানুর রহমান রাজধানীর বিচার, প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে গত জানুয়ারি জাতীয় আইন কমিশনের এক সেমিনারে তিনি অভিযোগ করেন

. মিজান বলেন, ‘নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সহিংসতায় দেশে হাজার হাজার সংখ্যালঘু আক্রান্ত হয়েছে নির্বাচনের আগেএক প্রিসাইডিং অফিসারকে হত্যা করা হলো নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের বাড়িতে লুটপাট, হামলা করা হলোঅথচ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী থাকবে বলে সরকার নির্বাচনের আগে আমাদেরআশ্বস্ত করেছিল" দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে এখনই দায়িত্ব নিতে হবে উল্লেখ করে . মিজান আরো বলেন, ‘ ব্যর্থতা যেন দীর্ঘায়িত না হয়, সেই বিষয়ে সরকারকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে নয়তোবা দেশবিপন্ন হয়ে যাবে
এর আগে জানুয়ারি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর  মধ্যযুগীয় কায়দায় হামলার প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সমাবেশ কালো পতাকা নিয়ে মৌন মিছিল করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান সময় মুক্তিযোদ্ধা নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে আজ লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে শুধু ভিন্নধর্মের কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী বর্বর হামলার শিকার হচ্ছে’ 

প্রবীণ অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার বলেন,  ‘প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে  এসব ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা গিয়ে সমবেদনা জানান  তারপর আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে  কিন্তু অপরাধীরা বার বারই পার পেয়ে যাচ্ছে

সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সচেতন জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধ বাড়ছে একইসঙ্গে বাড়ছে এই ইস্যুর রাজনৈতিক ব্যবহার আমাদের অভিভাবক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিন্তু নিরব নন নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে বিরোধীরাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এসব বন্ধ না করলে যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে যেসব জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে সেখানে কম্বিং অপারেশন চালানোর জন্য ইতোমধ্যে যৌথবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে জড়িত সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবেবিরোধীরা আবার সরকার প্রধানের এমন অভিযোগ মেনে নিতে নারাজ তাদের দাবি, এসব সরকারি নাটকেরই অংশ  বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘একতরফা নির্বাচন দেশবাসী স্বতঃস্ফুর্তভাবে বর্জন করায় দেশ-বিদেশে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রবল সমালোচনা চলছে। এই জনদৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার দেশব্যাপী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত হামলা করা হচ্ছে।’

আরো প্রশ্ন ও প্রতিবাদ
নির্বাচনের আগে-পরে সাম্প্রদায়িক হামলার আশঙ্কা রয়েছে জানা সত্ত্বেও কেন তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হলেন? কেন এসব আক্রান্ত জনপদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি? ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা বারবার হলেও একটিরও বিচার কেন হয়নি? রাজধানীর সেগুনবাগিচায়সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে বিক্ষুব্ধ জনতাআয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গত জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন শিপ্রা বোস তিনি বলেন, ‘মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা শোনালেও দেশের সরকার রাজনৈতিক দলগুলো আজও বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে ব্যর্থতার দায়ভার সরকার, বিরোধী দল সবার।’ লিখিত বক্তব্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মূল সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধের দাবিও জানানো হয়  একই দিনে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণে উদ্বেগ প্রতিবাদ জানিয়েছেবাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’  সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রশাসনকে সক্রিয় দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার দাবি জানানো হয় একই সঙ্গে দেশের সর্বত্র ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সর্বসাধারণকে আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ প্রাণহানির পাশাপাশি সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায় ভয়ভীতি প্রদর্শন আক্রমণ করা হয়েছে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের হাতে যশোর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, রংপুর চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রান্ত হয়েছে হিন্দুদের বাড়িঘর, দোকান মন্দিরে হামলা, অগ্নিসংযোগ লুটপাট করেছে তারা প্রাণের ভয়ে শিশু, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধরা বসতবাড়ি ছেড়ে নদী পার হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন দুর্বৃত্তরা দীর্ঘদিন ধরে ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো সত্ত্বেও প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে অভিযোগ আছে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালিয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো স্বাধীনতার সপক্ষের নেতা-কর্মী ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে শতাধিক মন্দির-বিগ্রহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের মূল লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধের রায় বানচাল করা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা

হচ্ছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত বিচার করতে -সংক্রান্ত সব মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনকারীদের বিচার করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের বিচার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের যেসব স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে, সেসব এলাকার দ্রুত বিচারযোগ্য মামলাগুলোকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে আজ ৯ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানো হবে
একই সঙ্গে সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, রামুসহ বিভিন্ন স্থানে পর্যন্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়ি লুট সম্পত্তি দখলের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত বিচার করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার প্রস্তাবও আজ আইন, বিচার সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে


রেজা ঘটকের ব্লগ থেকে
বাংলাদেশে বারবার নির্বাচনকালীন সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পরিকল্পিত এই হামলাকে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলে বারবার পাশ কাটিয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই বরং নির্বাচন কালীন সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্পদায়ের উপর বারবারই এই হামলা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত এবং সুসংগঠিতভাবেই করা হয়েছে আর এই হামলার পেছনে নির্বাচনের সময়কে বেছে নেবার পেছনেও অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই প্রধান শুধুমাত্র স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত শিবিরের লোকজন এই হামলার সঙ্গে জড়িত নয় বরং দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর লোকজনও এই হামলার পেছনে জড়িত যখন যারা ক্ষতায় থাকে তারা বিরোধী দলকে এই হামলার দায় দিয়ে নিজেরা ফেরেশতা সাজার ব্যর্থ চেষ্টা করেন কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, এই হামলার সঙ্গে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সরাসরি পরোক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান যখন যার প্রয়োজন পড়ে, তখন সে এই হামলা করে বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিন্থ করার পায়তারা করছে বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়

২০০১
সালের লা অক্টোবর নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর একই ধরনের হামলার পর, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তখন সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন, আমরা ভোটের অধিকার চাই না আমাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে নিন কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা দিন তাদের সেই আবেদনে কেউ তখন সারা দেয়নি বরং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও এবারের জানুয়ারি' নির্বাচনে সেই ঘটনা আবার আরো তীব্র আকারে ঘটলো যার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই

১৯৪১ সালের ভারতীয় আদমশুমারি অনুয়ায়ী, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তখন অন্তত শতকরা প্রায় ২৮ ভাগ মানুষ ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশ বিভাগ ১৯৪৬-৪৭ সালের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার পর সেই সংখ্যা ১৯৫১ সালে শতকরা ২২ ভাগে নেমে আসে তখন বাংলাদেশের অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতে চলে যায় কিন্তু যারা গরিব তাদের আর যাওয়ার সুযোগ রইলো না তারা এই হাজার বছরের বংশ পরম্পরার জন্ম ভিটেমাটিতেই আগলে রইলেন পাকিস্তান কায়েম হবার পর সংখ্যালঘুদের উপর নানান ধরণের চাপ নির্যাতনের ফলে তখণ থেকেই নিরবে অনেকে বাংলাদেশ ছেড়ে যান ১৯৬১ সালে সেই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৮. ভাগে নেমে আসে

ছবিটি দৈনিক কালের কণ্ঠ থেকে নেয়া।
পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নে ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়, তখনো বাংলাদেশের প্রধান টার্গেটে পরিনত হয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারি সাক্ষ্য দেয় যে, তখন বাংলাদেশে মাত্র শতকরা ১৩. ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল অন্যরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব চাপের কারণে সেই দেশ ত্যাগের ঘটনাটি নিরবে ঘটতেই থাকলো ১৯৮১ সালে সেই সংখ্য নেমে আসে শতকরা ১২.১৩ ভাগে আর ১৯৯১ সালে সেটি দাঁড়ায় শতকরা ১১.৬২ ভাগে

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নির্বাচনকালীন সময়ে এই হামলা সহিংসতা বন্ধ না হবার কারণে, ২০০১ সালে এসে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র শতকরা . ভাগে ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, তখন বাংলাদেশে অন্তত কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজারের মত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল আর ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় শতকরা ভাগে নেমে আসে কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সহিংসতা সংখ্যালঘুদের উপর বারবার হামলা নির্যাতনের ঘটনায় এই সংখ্যা এখন প্রকৃত হিসেবে কত, সেটি বলা কষ্টকর হলেও, ধারণা করা যায়, এটি শতকরা ভাগের বেশি হবার কোনো যুক্তি নেই কারণ, ২০১১ সালের আদমশুমারির পরেও দেশে নিরবে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের অনেক ঘটনাই ঘটেছে তাই বর্তমানে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা শতকরা ভাগের বেশি হবে না তাছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানোর জন্য বাংলাদেশের সরকারি তথ্য হিসেবে অনেক প্রকৃত তথ্যই এদিক সেদিক করার অভ্যাস মোটেও মিথ্যে নয়

তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে যে, বাংলাদেশে কি শেষ পর্যন্ত এভাবে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় একদিন নিশ্চিন্থ হয়ে যাবে? এখন যদি আমাকে কেউ এই প্রশ্ন করেন, আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশে আগামী বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় একটি নৃ-গোষ্ঠীতে পরিনত হতে যাচ্ছে  এর পেছনে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য যেমন দায়ী তেমনি বলপ্রয়োগ, রাজনৈতিক চাপ, নির্বাচনে হিন্দু সম্প্রদায়ের এভাবে নির্মম বলিদান, ধন সম্পদ লুটপাট, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার, দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বংশবিস্তার, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির বিস্তার, দেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দলগুলোর এসব হামলার সময় নিরব দর্শকের ভূমিকা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নির্লজ্ব ব্যর্থতা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা না দিতে পারার রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়ন, প্রতিবেশী মায়ানমারের জাতিগত দাঙ্গা, দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, দেশে বিদ্যমান অন্যের সম্পত্তি দখলের লাগাতার সংস্কৃতি, হিন্দু সম্প্রদায়ের নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতা, মিডিয়ার পক্ষপাত আচরণ, আর দেশের মানুষের মানবতা বিরোধী নির্মম ঘটনার পরেও স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি, এসব সম্মিলিত ধারার যুগপথ ধারার কারণেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় এক সময় নিশ্চিন্থ হয়ে যেতে পারে

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত নিবেদন, নির্বাচনের পর চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এখনই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় ব্যবহার করুন বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা আর যাতে বিঘ্নিত না হয়, তাদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা করুন নির্বাচন কালীন সহিংসতার সকল উপাদান সক্রিয় থাকা স্বত্ত্বেও কেন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা সরকার গঠন করলো না, সেই অযুহাত নিয়ে রাজনীতি না করে বরং এখনই অবশিষ্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যাতে আর একটি হামলাও না হয়, সেই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার অনুরোধ করছি নতুবা সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এটি আরো পাকাপাকিভাবে নিশ্চিত করে, দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু সকল সম্প্রদায়কে একটি নির্দিষ্ট সময় বেধে দিন, যে অমুক তারিখের মধ্যে সবাই নিরাপদে দেশত্যাগ করুন, নইলে অমুক তারিখে একযোগে হামলা করে সবাইকে শেষ করা হবে একটা কঠোর সিদ্ধান্তে দয়া করে আসুন বারবার সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ঘুটি হিসেবে ব্যবহার না করে, এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করুন

আর যদি বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়, তাহলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, এটা দশম সংসদের প্রথম অধিবেসনেই বর্জন করে ধর্ম নিরপেক্ষ লিখুন পাশাপাশি জাতি ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠি নির্বিশেষে সকলকে নিরাপত্তা দেবার একটি স্থায়ী কার্যকর ব্যবস্থা করুন আমরা এভাবে আর একজনও সংখ্যালঘু' উপর হামলা দেখতে চাই না আর সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতিও দেখতে চাই না অনেক বৃদ্ধ হিন্দু মহিলা কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবী করেছেন, নৌকায় ভোট দেবার পর আজ তাদের এই দশা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই নয় দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল তারা কেন এই হামলার সময় পাশে দাঁড়ালো না? সংখ্যালঘুরা কোথায় ভোট দিলেন, কেন ভোট দিলেন, সেটি একটি সুসংগঠিত সুপরিকল্পিত হামলার জন্য অন্যতম কারণ হতে পারে না আর এটি মেনে নেওয়াও যায় না একজন মুসলমান কোথায় ভোট দিলেন, তার যেহেতু কোনো জবাবদিহিতা নেই, একটি রাষ্ট্রে কেন একজন সংখ্যালঘুকে বারবার এই একই প্রশ্নে নির্মম হামলার শিকার হতে হবে?

নইলে আমার যে হিন্দু বন্ধু সে আমাকে কোন ভরসায় বিশ্বাস করবে? আমার যে হিন্দু প্রতিবেশী কোন ভরসায় তারা আমাদের পাশে বসবাস করবে? আমাদের যে হিন্দু উৎসব, কোন ভরসায় তারা সেই উৎসব করবে? ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলার পর তারা পরের বছর তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব সারদীয় দুর্গাপূজা বর্জন করেছিলেন একটি সম্প্রদায় কতো কষ্ট পেলে নিজেদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে, সেটি কি আমরা একবারও অনুমান করতে পারি? আমরা কি এই হামলার প্রতিবাদে আগামী ঈদ উৎসব বর্জন করব? ২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায় দাবী করেছিলেন, তারা ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে জীবনের নিরাপত্তা চায় যদি তাদের নিয়ে সত্যিই কোনো রাজনীতি না থাকে, তাহলে তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে নিয়ে আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক নিরাপত্তা যখন সার্বিকভাবে নিশ্চিত হবে, তখণ না হয় তারাই আবার দাবী তুলবে যে, আমাদের ভোটের অধিকার এখন ফিরিয়ে দাও একটা সমাধান দয়া্ করে বের করুন আর এভাবে মানবতার পরাজয়, সভ্যতার পরাজয়, হিংসার রাজনীতিতে ধুকে ধুকে শকুনের হিংস্র থাবার মুখে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে বারবার মুখোমুখি করার সত্যি সত্যিই কোনো অসভ্যতা আমরা দেখতে চাই না

ছবিটি ফেসবুক থেকে সংগ্রহিত

আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে আহবান জানাব, আপনারা পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যুবকদের নিয়ে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলুন যতোক্ষণ নিজেরা লড়াই করতে পারবেন, ততোক্ষণ লড়াই করুন নিজেদের বসত বাড়ি ব্যবসা সম্পত্তি ফেলে পালিয়ে শুধু আত্মরক্ষাই করা যায়, জীবন সংগ্রাম থেকে পালানো যায় না আপনাদের যুবশ্রেণী যতোক্ষণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে ততোক্ষণ, আপনারা নিশ্চিত নিরাপদ পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যদি সময় মত সারা না দেয়, মা বোনেরাও প্রতিরোধের জন্য তৈরি হোন যতোক্ষণ জীবন, ততোক্ষণ লড়াই একবার প্রতিরোধ করুন, দেখবেন হামলাকারীরা পরের হামলাটি করার জন্য একটু হলেও পিছপা নেবে বাংলাদেশে এখনো অনেক অসাম্প্রদায়িক মুসলমান আছে তারা আপনাদের প্রতিবেশী আপনাদের বন্ধু তাদেরকেও সেই প্রতিরোধ বলয়ে ডাকুন নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাড়ায়-পাড়ায় এভাবে টহল প্রতিরোধ গঠন করুন নইলে বারবার ভয় আর আতংক আপনাদের মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে দেবে আর মানসিকভাবে দুর্বল থাকলে সরকারি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বেশি দিন আপনাদের যে পাহারা দিয়ে বাঁচাতে পারবে না বা পাহারা দেবে না এটা আপনারাও হয়তো ভালো করেই জানেন পাশপাশি এই হামলার সকল ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে নানাভাবে তুলে ধরে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করুন আপনারা যতোবেশি সংগঠিত থাকবেন, ততোই আপনাদের নিরাপত্তা সবল থাকবে মনে রাখবেন, যারা হামলা করছে তারা কিন্তু দলবদ্ধ তাই আপনারাও দলবদ্ধ থাকুন এর বেশি কিছু বলার মত আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না একজন মুসলিম ঘরের সন্তান হিসেবে আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি এই হামলার দায় মুসলিমরা এড়াতে পারে না রাষ্ট্র এড়াতে পারে না রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারে না নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এড়াতে পারে না সত্যি সত্যিই কেউ এই দায় এড়াতে পারে না
newsreel [সংবাদচিত্র]