Powered By Blogger

১৬ অক্টোবর ২০১৯

রাষ্ট্রধর্ম বাড়িয়েছে ইসলামী উগ্রবাদ

একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীর দৃশ্য
“রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের তিন দশকে বেড়েছে ইসলামী উগ্রবাদের শক্তি,” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরী করেছিলাম গত বছর, যা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। চলতি বছরের জুলাইতে প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সাহায্য চাওয়ায় যখন খুব হৈচৈ হচ্ছে, তখন অপ্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি ফের স্মরণে আসে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রিয়া সাহা ওয়াশিংটনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউজে গিয়ে ট্রাম্পকে বলছেন, “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানে তিন কোটি ৭০ লাখ (৩৭ মিলিয়ন) হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ‘উধাও’ হয়ে গেছেন। এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ (১৮ মিলিয়ন) সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রয়েছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ছাড়তে চাই না। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা আমার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। জমি কেড়ে নিয়েছে। এর কোনো বিচার এখনো পাইনি।”
“কারা এসব করেছে,” প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানতে চাইলে দলিত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘শারি’ পরিচালক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংগঠক প্রিয়া সাহা আরো বলেন, “উগ্রপন্থী মুসলমানরা এটা করেছে। সব সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা এটা করে থাকে।” 
এমন বক্তব্যের জেরে সরকার-বিরোধী, ডান-বাম, বাঙালী মুসলমানদের সব পক্ষই যখন প্রিয়াকে তুলোধনো করছে, তখন খেয়াল হয় আরো ছয় বছর আগে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির এক শুনানিতে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ থেকে ২০১৩ সাল এ পর্যন্ত চার কোটি ৯০ লাখ (৪৯ মিলিয়ন) হিন্দু মিসিং হয়েছে। 

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদও বহু বছর ধরেই বলছে, গত পাঁচ দশকে আনুমানিক এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশান্তরিত হয়েছেন। সে হিসেবে গড়ে বছরে দেশ ছেড়েছেন দুই লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। তাছাড়া সরকারি পরিসংখ্যান মতে সত্তরের দশকে এ দেশে ২০ দশমিক এক শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। চলতি দশকের শুরুতে ২০১১ সালে যা কমে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক সাত শতাংশে। 
ঘাঁটতে গিয়ে জানতে পারি, নিরাপত্তহীনতায় কোটি মানুষ দেশ ছাড়লেও কমেনি সাম্প্রদায়িক পীড়নের মাত্রা; বরং রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের পর দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযুক্তকারী অষ্টম সংশোধনীর প্রস্তাব পাসের ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়েছে গত বছর। 
তৎকালীন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ১৯৮৮ সালের ১১ মে জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেছিলেন। পরে ৭ জুন এটি পাস হলে ৯ জুন ‘স্বৈরশাসক’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুমোদন পেয়ে তা আইনে পরিণত হয়। অবশ্য তার আগেই সংবিধান ইসলামীকরণ শুরু করেন আরেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। ফরমান জারি করে তিনি প্রস্তাবনার আগে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ (পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) বাক্যটি যোগ করেন। সেইসঙ্গে মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিলুপ্ত এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাংবিধানিক সুযোগ তৈরী করা হয়। 

এরই ধারাবাহিকতায় এরশাদের শাসনামলে কায়েম করা হয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ৷ ওই সময় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে সংবিধানের এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে উচ্চ-আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন লেখক সাহিত্যিক, সাবেক বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের পনেরো জন বিশিষ্ট নাগরিক। এর ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হলে মামলাটি আলোচনায় আসে। এর কিছুদিন পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হলে আরো একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওই সময় রুল ইস্যু করলেও আদালত ২০১৬ সালে রিট দুটি বাতিল করে দেয়। 

রিটকারীদের মধ্যে যারা এখনও বেঁচে রয়েছেন, তাদেরই একজন জাতীয় অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। এক আলাপে তিনি বলেছিলেন, “শেষ অবধি উচ্চ আদালত আমাদের মামলার অধিকারই স্বীকার করেনি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় থাকা প্রবীণ এই বুদ্ধিজীবীর অভিমত, “রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়েছে। এভাবে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য দেয়া উগ্রবাদীদের উৎসাহিত করে। কারণ তাদেরও বোঝানো হয় , পৃথিবীতে তাদের ধর্মই শুধু শ্রেষ্ঠ আর অন্য সব ধর্ম নিকৃষ্ট।”
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রধর্ম বিরোধী রিট বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে করেছিল জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ইসলামসহ বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভাবধারার ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো। 
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম রেখে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিয়ে বা উগ্রবাদী শক্তির সামনে মাথানত করে জঙ্গিবাদ দমনের কথা আমরা বলি কি করে! মুক্তিযুদ্ধ করার সময় আমি কি কখনো ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশে এমন একটি সময় আসবে যখন আমাদের ‘মাইনরিটি’ হিসেবে ‘সেকেন্ড গ্রেডের সিটিজেনে’ পরিণত করা হবে এবং তার থেকে উত্তরণের জন্য আবার লড়াই করতে হবে।” 

রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী দাবি করে রানা আরো বলেন, “একাত্তরে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা ফেরাতে না পারলে মৌলবাদ উৎখাত করা যাবে না।” সংখ্যাগরিষ্ঠ দেওবন্দী ওহাবী ভাবধারার কওমি মতাদর্শী মুসলিমদের চাপে থাকা প্রায় আড়াই লাখ কাদিয়ানীর সংগঠন আহমদিয়া মুসলিম জামা’তের আমির মোবাশশেরউর রহমান মনে করেন, “রাষ্ট্রধর্মের বিধান ধর্মীয় গোষ্ঠির ক্ষমতায় যাওয়ার একটা দরজা।”

অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ পরে পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটি পরিবর্তন করে লেখা হয় - ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একই সংশোধনীতে সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরিয়ে আনা হয়।

তবে “অবশিষ্ট ছয় শতাংশ সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করলে, অর্থাৎ সংখ্যালঘু শূন্য হলে কিভাবে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করবে বাংলাদেশ?” এক আলাপে এমন প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও গল্পকার তুহিন দাস। মুক্তচিন্তার পক্ষে লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশ এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় থাকার কারণে ২০১৫ সালে আগস্টে ‘আনসারবিডি’ নামের এক উগ্রবাদী সংগঠনের হুমকী পেয়ে তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশ ত্যাগ করেন। 

চলতি দশকে কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা করে মহামূল্যবান প্রাচীন পুঁথি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, খ্রিস্টান গির্জাগুলোতে বোমা হামলা হয়েছে, নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে; এছাড়া রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বসতভিটা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে দাবি করে তুহিন বলেন, “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার ফলে এ ধর্মের অধিকাংশ মানুষেরা মনে করে, এ দেশটা শুধু তাদের এবং সবকিছুতে তাদেরই অধিকার।” 

অবশ্য ভাষ্কর, লেখক ও গবেষক গোঁসাই পাহলভী মনে করেন, “সংবিধানের চর্চা সাধারণ মানুষর ভেতর নেই। তারা সংবিধান বুঝে ‘এ্যাক্ট’ কিংবা ‘রিএ্যাক্ট’ করেন, এমন নয়। জনগণের কৌমচেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনা, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই উগ্রতার পেছনে দায়ী। আরো আছে আন্তজার্তিক ঘটনাবলীর প্রভাব।”
তুহিন ও গোঁসাই, দুজনেই রাষ্ট্রের বৈষম্যের উদাহরণ হিসাবে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘একদিনের ঈদ’ উপলক্ষে কমপক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটির বিপরীতে হিন্দুদের প্রধান উৎসব ‘পাঁচ দিনের দূর্গা পূজা’ উপলক্ষে মাত্র একদিন ছুটি থাকা কথা বলেন। 
বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকে এই জনপদের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে, উল্লেখ করে তরুণ প্রকাশক ও সাংবাদিক সৈয়দ রিয়াদ বলেন, “দেশের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর যে ধরণের আক্রমণ করা হয় তা দেখেই মনে হয়, এই দেশে সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নেই।” 

তরুণ কবি রূমান শরীফের অভিমত, “একটি গণতান্ত্রিক দেশে সব ধর্মের মানুষ; আকি, নাস্তিক সবাই বাস করে। সেখানে রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ধর্ম থাকা মানে ওই ধর্মানুসারী বাদে বাকি নাগরিকদের অস্বিকার করা। সাংবিধানিক মুসলমানিত্ব সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বৈধ করে দেয়। নাগরিকদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাঁর দাবি বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতপোষণকারীরা মোটেই নিরাপদবোধ করেন না। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, প্রকাশক, ব্লগারদের ওপর হামলার বা তাদের খুনের এখনো কোনো বিচার হয়নি।”

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ক এক আলোচনায় বক্তারা বলছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করছে। তারা আরো বলেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার না হওয়ায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
“ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আসলে খুব চালাক,” বলেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান। 
আচ্ছা প্রিয়া সাহা বা তাঁর পরিবারের সর্বশেষ অবস্থা কেউ জানেন কী? খবরে দেখেছিলাম, তাঁর স্বামী স্বামী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মলয় সাহাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, পিরোজপুরে পৈত্রিক বাড়িতে হামলা ও আগুনের ঘটনার প্রতিকার চেয়ে প্রিয়া সাহা স্থানীয় সাংসদ ও পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কাছে গেলেও তিনি অনীহা দেখিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

প্রিয়া সাহা
আরো পড়ুন:

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]