Powered By Blogger
স্মরণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
স্মরণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১০ জানুয়ারী ২০২১

দীনেশ দাসকে মনে পড়ে

দেখতে দেখতে নয়টি বছর হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকার কাকরাইল মোড়ে বাস চাপায় নিহত হন সাংবাদিক দীনেশ দাস। ফেসবুকের ফিরে দেখা কর্মসূচীর কল্যাণে আজ ফের মনে এলো সেই সময়টা। যেখানে নিজের বৃত্তান্তে নিজের সম্পর্কে দাদা লিখে রেখেছিলেন, ‘আই অ্যাম রোমান্টিক পারসন।’ তাঁর মৃত্যুর চারদিন পর ‘নিশ্চিন্ত দীনেশদা’ শিরোনামে লিখেছিলাম -
হয়ত মৃত্যুই দীনেশদাকে নিশ্চিন্ত করেছে। তবে তিনি আদৌ তৃপ্ত হবেন কি? অর্থ সংকটে পরিবারের ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রীক যত উদ্বিগ্নতা তাকে মৃত্যুর পূর্ব-মুহুর্ত পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে; তা থেকে কি তিনি এভাবে মুক্ত হতে চেয়েছেন? এত শুভাকাঙ্খী, এত পরিচিত জন। কেউ কি তাকে একটি চাকরি দিতে পারতেন না? একজন সৎ সংবাদকর্মির ২৫ বছরের অভিজ্ঞতার কি কোনো মূল্যই ছিলো না? অথচ এখন তাঁর মৃত্যু কত মূল্যবান হয়ে গেল। সরকার দীনেশদার পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বৌদিকে একটি চাকরি দেয়ার পাশাপাশি তার মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্বও নিয়েছে। আবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমনকি জামায়াত নেতারাও টাকা দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ইতিমধ্যেই টাকা দিয়েছেন। অথচ শেষ কটা দিন কী অর্থ কষ্টেই না তাঁর কেটেছে। সদাহাস্যোজ্জল শিশুমনা মানুষটার মুখে হাসিও দেখিনি কত দিন। এখন হয়ত তিনি সবই দেখছেন। আর বৌদির কাছে গিয়ে বলছেন, 'বলেছিলাম না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অথৈর পড়াশুনা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।'
তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর দিনটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় লেখক ও সাংবাদিক মাহফুজ জুয়েল বলেছিলেন, “চোখে পড়ার মতো মেঠো-বিচরণ ছিলো দিনেশদার। একসময় যেখানেই যেতাম সেখানেই তাঁকে দেখতে পেতাম! মাঠে-ঘাটে দেখতে দেখতেই পরিচয়। তারপর টুকটাক গল্প হয় রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে, কর্মসূচিতে, পল্টনে, প্রেসক্লাবে, মুক্তাঙ্গনে, মুক্তিভবনে, বামপন্থীদের সংবাদসন্ধানী সাংবাদিক; শ্যামসুন্দর মায়াময় নিরীহ মুখের দিনেশদা। মনে পড়িয়ে মন খারাপ করে দিলে।আহা, দিনেশদা।” আরো দুই বছর পর কবি ও সাংবাদিক রুদ্রাক্ষ রহমান লিখেছিলেন, “দীনেশ আমার তুই-তুইবন্ধু ছিলো। আমরা অনেকটা সময় এই শহরে ভাতের জন্য হেঁটেছি। সাক্ষী আশিস সৈকত! এবং আমরা এতোটাই ব্যর্থমানুষ যে দীনেশের জন্য কিছুই করতে পারিনি! অতএব ওর কাছে ক্ষমা চাই, বার বার।”
পলিটিক্যাল রিপোর্টিং, মূলত ইসলামি ও বামদলগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল দাদার সাথে। তিনি ছাড়াও শ্রদ্ধেয় সেলিম জাহিদ,  ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ, রাশিদুল হাসান রাশেদ, বন্ধুপ্রতীম রাজীব আহমদ তখন ওই অঙ্গনের ডাকসাইটে প্রতিবেদক। দাদার সাথে আমার চেয়ে ঢের বেশী স্মৃতি আছে ওই তিনজনের। তবুও আজ এখানে ফের টুকে রাখছি নয় বছর আগের লেখাটির কিয়দাংশ। 

সত্যি কথা বলতে কি, দীনেশ'দা মারা যাওয়ার আগে নিজেও কখনো বুঝিনি যে তাকে কতটা ভালোবাসি। হয়ত আমার মত আরো অনেক সহকর্মিই তা বুঝতে পারেননি। গত বছরে (২০১১ সালে)বন্ধ হয়ে যাওয়া শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজে কাজ শুরুর সময়ে ‘পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার’ ছিলাম। আমাকে জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ বাম ও ইসলামী মিলিয়ে ৩৭টি দলের খবর রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরই বদৌলতে ওই সরল প্রাণ মানুষটির সাথে আমার পরিচয় হয়। জামায়াত-শিবিরের অফিস, মুক্তাঙ্গন, পল্টন, মুফতী আমিনীর ডেরা থেকে শুরু করে কমিউনিষ্ট পার্টির অফিস। কত জায়গায়ই না এক সাথে কত সময় কেটেছে। এরপরও ওই বিটে যতদিন ছিলাম তা ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে প্রথম দিনেই আপন করে নেয়ার গুনটি দাদার মাঝে বেশ ভালো মত ছিল। আর তাঁর রসিক চরিত্রের সচ্ছতায় মুগ্ধ না হওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক। যে কারণে ‘পার্লামেন্ট রিপোর্টিং’ শুরু করার পরও দাদার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি কখনো। ফেসবুকে খুব একটা সক্রিয় না হলেও তাঁর ইয়াহু মেইলটি প্রায় নিয়মিতই খোলা থাকত। মাঝেই মাঝেই ‘চ্যাটবক্সে’ হাজির হতেন দাদা। খুব বেশী সময়ের জন্য না হলেও বেশ জমজমাট আলাপ হতো। অবশ্য গত দেড়-দুই মাস ধরে সেখানও অনিয়মিত ছিলেন তিনি। হয়ত  দৈনিক আমাদের সময় থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর আর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগটাই পাননি। আসলে দীনেশ'দার বহুপুরানো সহকর্মী সালাম ফারুক ভাইয়ের একটি লেখা শেয়ার করার জন্য বসেছিলাম; কিন্তু নিজেই কত কিছু বলে ফেললাম। আর শুধু একটি কথাই বলি। এখন বুঝি, দাদাকে অনেক ভালোবাসি।

চাকরির টেনশনমুক্ত দীনেশদা’ শিরোনামে একটি অনলাইনে লিখেছিলেন ফারুক ভাই; যা হুবুহু তুলে দিচ্ছি -
মৃত্যুর মাত্র ১৪ ঘণ্টা আগে শনিবার রাত সাতটায় ঘনিষ্ঠজন, কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার আজিজুল পারভেজকে বলেছিলেন, 'পকেটে মাত্র ২০ টাকা আছে।' রোববার সকালে মাটির ব্যাংক ভেঙে জমানো টাকা থেকে ১০০ টাকা হাতে দিয়েছিলেন স্ত্রী। জানা গেছে তিন মাসের বাড়িভাড়াও বাকি। ২৫ বছরের সাংবাদিকতার জীবনের এই পর্যায়ে এসে এমন হালেই দিন কাটছিল তাঁর। তিনি দৈনিক আমাদের সময় থেকে 'অন্যায়ভাবে' সদ্য চাকরিচ্যুত হওয়া দীনেশ দাশ, আমার দীনেশদা। এখন আর তার সেই টাকার চিন্তা নেই, নেই বাড়িভাড়ার টেনশন, জমানো টাকা থেকে তাকে দিনের খরচ দিতে হবে না বৌদির। সাংবাদিকতা করে অর্জন করা একমাত্র সম্বল মোটরসাইকেলটি নিয়ে তাকে আর ঘুরতে হবে না কাজের খোঁজে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) গত নির্বাচনের আগের রাতে তার মোটারসাইকেলে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'দাদা, পাওনা টাকাগুলো আমাদের সময় পে (পরিশোধ) করেছে কি-না।' জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'না, টাকা-পয়সা তো কিছু দিলো না। তবে আমাদের সময় থেকে লোন নিয়ে হলেও এ মোটরসাইকেলটাই এখন আমার একমাত্র সম্বল।' সেই একমাত্র সম্বলটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। রোববার সকালে একমাত্র মেয়ে অথৈকে ভিকারুননিসা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ডিআরইউ’র দিকে যাওয়ার পথেই বাসের চাপায় নিভে গেল তার প্রাণপ্রদীপ। তার আর যাওয়া হলো না প্রিয় প্রাঙ্গণটিতে।

গত বছর আমি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর থেকে অমর একুশে বইমেলা কাভার করেছিলাম। দাদার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কালের কণ্ঠের আজিজুল পারভেজ ভাই, সমকালের মুন্না ভাই আর আমি ছিলাম নিয়মিত। তাই কখনো আসতে দেরি হলে দাদা ফোন করে বলে দিতেন, তার জন্যও যেন বইয়ের কাভার, বই ইত্যাদি কালেক্ট করে নিই। আমরা তা করতাম। মাঝেমধ্যে দাদার মোটারসাইকেলে চড়ে ফিরতাম অফিসে। আর মাত্র ২৩ দিন পরই শুরু হবে এবারের বইমেলা। দাদাকে ছাড়া বইমেলা- এখনই বিশ্বাস হতে চাইছে না। আমাদের সময়ে দীর্ঘ সময় কাজ করার সুবাদে দীনেশদা’র সান্নিধ্য পেয়েছিলাম খুব ভালোভাবেই।

শুরুতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে খানিকটা দুর্বল দাদাকে প্রায়ই সাহায্য করতে হতো আমার। ক’দিন আগেও ফেসবুকে দাদার আইডি নিয়ে একটি জটিলতার সমাধান করে দিয়েছিলাম। দাদার স্নেহমিশ্রিত আবদারে কখনোই বিরক্ত হতাম না। ঠাট্টা-মশকরা করতে করতেই তার কাজটুকু করে দিতাম। ডিআরইউ’র মিডিয়া সেন্টারে বসে দাদার সেইসব আবদার আর পূরণ করতে হবে না। বয়সে ১০/১২ বছরের বড় হতে পারেন। কিন্তু কথাবার্তা, আচার-আচরণ কোনো দিক থেকেই সেই পার্থক্য বুঝতে দিতেন না দীনেশদা। নানান ঢঙের টিটকারি, দুষ্টুমি সবই চলত তার সঙ্গে। যেন বাল্যকালের বন্ধু।

জ্ঞানপিপাসু দীনেশ দাশের সংগ্রহে ছিল দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দলিলের অনুলিপি। সামান্য বেতনে চাকরি করেও খুঁজে খুঁজে এসব যোগাড় করতেন তিনি। অনুকরণীয় চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের স্মৃতি ধরে রাখতে তিনি গঠন করেছিলেন মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ। প্রতি বছর এ সংসদ থেকে সেরা রিপোর্টার বাছাই করে পুরস্কৃত করা হতো। সর্বশেষ আয়োজনটি ছিল গত ২৯ ডিসেম্বর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতেন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সংবাদ সংগ্রহে। নিজ ধর্মের প্রতি প্রবল ঝোঁকও অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটিকে দায়িত্ব থেকে টলাতে পারেনি। ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাই তার হয়ে উঠেছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আর তাই অনেকেই মজা করে তার নাম উচ্চারণের সময় আগে ‘মাওলানা’ শব্দটি জুড়ে দিতেন।

আমি আমাদের সময় ছেড়েছি বছর তিনেক আগে। কিন্তু গুটি কয়েক সমবয়সী সহকর্মীর মতো দীনেশদা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বিলীন হয়ে যায়নি। একবার বৌদি’র অসুস্থতায় রক্তের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন আমাকেই। ছুটে গিয়েছিলাম। সব সেরে রাতে ফিরেছিলাম দুইটায়। সেই থেকে দাদার স্নেহের মাত্রা যেনে বেড়ে গিয়েছিল অনেক। 

কিছুদিন আগে আমরা সহকর্মী বন্ধু বেলাল হোসেনকে হারালাম, নিখিল ভদ্রকে পঙ্গু হতে দেখলাম। আর এবার হারালাম শান্ত-নিরীহ, বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ বন্ধুজন দীনেশদাকে। ভুয়া লাইসেন্সেধারী অদক্ষ ও বেপরোয়া বাসচালকদের হাতে আর কতো সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ খুন হলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়বে? আর কতো প্রাণহানি ঘটলে বিআরটিএ তার দায়িত্ব পালনে সচেতন হবে?

৩০ জুন ২০১৭

আহমদ ছফার পঁচাত্তর

আহমদ ছফা
‘২৭ তারিখ (মার্চ, ১৯৭১) ভোরবেলা ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনলাম। আর সেই সঙ্গে নীচে এক উন্মাদ উদভ্রান্ত চিৎকার, নেই নেই কেউ নেই। দৌড়ে বাইরে এসে দেখলাম ছফা পাগলের মত চিৎকার করে বলছে —কেউ নেই, গোবিন্দদেব নেই, জ্যোতির্ময় গৃহঠাকুরতা নেই, মনিরুজ্জামান স্যার নেই, মুকতাদির নেই। ও চেঁচাতে চেঁচাতে ক্যাম্পাস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রদক্ষিণ করে গেল।’

‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী’ শীর্ষক লেখায় এভাবেই আহমদ ছফার কথা উল্লেখ করেছেন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি তখন ঢাবির শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই থাকতেন। রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘১৯৭১ : ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয় লেখাটি। 
আজ ৩০ জুন, ২০১৭ —আহমদ ছফার ৭৫তম জন্মদিন। ১৯৪৩ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে তার জন্ম। পিতা মরহুম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে ছফা ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী লেখক, কবি ও সমাজবিজ্ঞানী। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। প্রথাবিরোধী আচরণের পাশাপাশি নির্মোহ ও অকপট দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য আলোচিত ছিলেন।
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তার পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন।

১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ছফা। একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে।পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন।

ছফার গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ সালে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যোটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যে জ্ঞান তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সাহস জুগিয়েছিল।

সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে তিরিশটির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ একটি উপন্যাস- সূর্য তুমি সাথী। প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে।স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় তার প্রবন্ধ গ্রন্থ জাগ্রত বাংলাদেশ। প্রকাশকাল শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ সালে।

১৯৭০ সালে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন।দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৭২ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ ধারাবাহিকভাবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনা প্রকাশ করেন। এর কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। ১৯৭৯ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশ পায়। ১৯৮০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। বাংলা একাডেমি থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে।

ছফা মহাকবি গ্যোতের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ সালে । মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির গোপন-রহস্য, শৌর্য মৃত্যু ও কপটতার গীতিকা এই উপন্যাস। ১৯৯৬ সালে পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ এবং অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী প্রকাশিত হয়। ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ পূর্বে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্ণিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। জাপানী ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে। পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তাঁর এই উপন্যাসে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে।
তার জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। ২০০১সালে আহমদ ছফা রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পায়। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৮০ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। ২০০২ সালে তাকে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধজীবী গোরস্থানে তার দাফন হয়।
ছবিটি কবি টোকন ঠাকুরের সংগ্রহশালা থেকে নেয়া
** লেখাটি মূলত গত বছর নিউজনেক্সটবিডি ডটকম - এর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিলো। 

০৭ মে ২০১৫

দেশত্যাগ কি নভেরার প্রতিবাদ?

১৯৭০ সালে নভেরা আহমেদ
যারা ভাস্কর নভেরা আহমেদের অবদানের চেয়ে তার আত্মগোপনের লাভ-ক্ষতি নিয়ে বেশী নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন - তাদের কাছে জানতে চাই; একজন শিল্পী বা স্রষ্টার নিজের বেছে নেয়া জীবনপ্রণালীকে কটাক্ষ করার অধিকার আপনারা কোথায় পেলেন? এ কী জ্ঞানের অহমিকা! নিজেদের জ্ঞান বা অনুধাবনকে কতটা চূড়ান্ত ভেবে আপনারা এর বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন? লাভ-ক্ষতির বাইরে গিয়েও যে ভাবা যায়, তা কি কখনো উপোলদ্ধি করেছেন? আমার এই আচরণও নিঃসন্দেহে বেয়াদবি। কিন্তু এ কালে বেয়াদবদের সাথে বেয়াদবি করা জায়েজ মনে হচ্ছে বলেই বলছি - এ নেহাতই পাতি বূ্র্জোয়াগিরি। সবই পুঁজির খেল। আপনারা কবে যে - কোথায় বিক্রি হয়ে গেছেন - তা হয়ত টেরও পাননি, বা পেয়েছেন। আর এখন সবাইকে বিক্রি হতে দেখতে চাচ্ছেন। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের তথা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি না হয়ে যারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিজস্ব দর্শন/ভাবের জগতে ডুবে থাকতে চাচ্ছেন, তাদের ‘ক্ষতিকর/অস্বাভাবিক’ ভাবাও আপনাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। থাক, বাদ দেই। তবে আজ এটুকু অন্তত ভাবুন, নভেরার এই আত্মগোপন বা দেশত্যাগ কি কোনো প্রতিবাদ ছিলো?
শাকুর মজিদের নতুন মন্তব্য
এখানে একটি সংবাদ ভাষ্য উল্লেখ করছি।
“১৯৫৮ সালে সামরিক আইনজারি হলে শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শহীদ পাক-হানাদার বাহিনী শহীদ মিনার সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর যখন আবার শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় তখন মূল নকশার অনেক কিছু বাদ পড়ে। বাদ পড়ে যায় নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য দুটি।” তথ্য সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ (১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)
- তার অভিমানের তরে আর কোনো উপলক্ষ কী দরকার আছে !! এই রাষ্ট্রই কি তাকে অভিমানী হওয়ার সুযোগ করে দেয়নি। জনকণ্ঠের ওই প্রতিবেদন থেকেই জেনেছিলাম, নভেরা আহমেদের বাবা সৈয়দ আহমেদ বনবিভাগের কর্মকতা হিসেবে যখন সুন্দরবনে অবস্থান করছিলেন, সেই সময় ১৯৩০ সালে এই তার জন্ম। শৈশব কেটেছে কলকাতায় এবং সেখানে ‘লরেট’ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুল জীবনে তিনি ভাস্কর্য গড়ার দক্ষ হয়ে উঠেন। ১৯৪৭’র দেশ বিভাগের পর কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে নভেরা ১৯৫১ সালে ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস এ্যান্ড ক্র্যাফটসের ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে কোর্স শেষ করে ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি বিবিসিতে অনুষ্ঠান করতেন। বিবিসির অনুষ্ঠান পরিচালক ছিলেন নাজির আহমদ। শহীদ মিনারের রূপকার হামিদুর রহমান লন্ডনে পড়তে গেলে ভাই নাজির আহমেদের মাধ্যমে নভেরা আহমেদের সাক্ষাত, পরে বন্ধুত্ব।
নভেরা ছিলেন ভাস্কর আর হামিদুর রহমান ছিলেন অঙ্কনশিল্পী। দুজনেই ছিলেন শিল্পানুরাগী। লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে এই দুই বন্ধু মিলে ইউরোপের বড় বড় জাদুঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। তাঁরা উভয়ে লিয়োনাদ্রো ভেঞ্চির মোনালিসা ছবি দর্শন করতে প্যারিসের ‘লুভ‘ গ্যালারি পরিদর্শন করেন। লেখক হাসনাত আবদুল হাইর লেখা ‘নভেরা’ উপন্যাসে দুই বন্ধুর প্রগাঢ় বন্ধত্ব ও শিল্পানুরাগের বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য শিল্পীদের কাছে নকশা আহ্বান করলে শিল্পী হামিদুর রাহমান সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকায় আসেন এবং শহীদ মিনারের জন্য এমন একটি নকশা প্রণয়ন করেন যেটাকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ‘আমার মায়ের মুখ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। নির্বাচন মণ্ডলির সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজ শুরু করেন হামিদুর রহমান। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে শিল্পী উপলব্ধী করেন যে শহীদ মিনারের সঙ্গে ভাস্কর্য স্থান পেলে তা পূর্ণতা পাবে। তাই তারই উদ্যোগে শিল্পী নভেরা আহমেদ ঢাকায় আসেন এবং শহীদ মিনারের মূল বেদীতে ভাস্কর্য তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯৫৫ সালের দিকে এই দুই শিল্পী যখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন তখন এদেশে শিল্প অনুরাগী খুব একটা ছিলো না। হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ শূলত ভাষা শহীদদের স্মরণে কিছু একটা করার তাড়নায় জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন।

শাকুর দর্শনের নগদ প্রভাব
দয়া করে স্মরণ করুন তার এসব অবদানের কথা। আর আমার একটা অনুধাবনের কথা বলে যাই - মানুষের বিস্মৃতিপ্রবণ চিন্তার দৈন্যতা, দর্শনের দুর্বলতা, সার্বোপরী - আত্মজ্ঞানের সংকট প্রসূত সুবোধের অভাব এ দুনিয়ায় আজও অতটাই প্রকট যতটা সত্তর হাজার বছর আগেও ছিলো।
নভেরার প্রবাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত আসলে আজও রহস্যাবৃত। প্রবাস জীবনে দেশের যে মানুষটির সাথে তার সবচেয়ে ঘনিষ্টতা বা সখ্যতা ছিলো তিনি হচ্ছেন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী আনা ইসলাম। তিনি লিখেছিলেন, “বহুদিন ধরেই নভেরা আছেন নিজস্ব আড়ালে। দেশত্যাগের এক অজানা ধোঁয়াটে অধ্যায়, তারপর স্বেচ্ছা-নির্বাসনের দীর্ঘ অন্তরাল। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, মৃদু হাসিতে বুঝিয়েছেন – অন্তরালে থাকাটা তাঁর নিজস্ব জীবনচর্যার ব্যাপার। মানুষের কোলাহল, স্তুতি, প্রশংসা থেকে আগলে রাখা তাঁর ভুবন।”

পূর্ববর্তী পোস্টঃ শাকুর মজিদের নভেরা বিদ্বেষ !

২৯ জানুয়ারী ২০১৫

স্মরণে অচিন্ত্য, রবার্ট ও পথিক

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বেদে’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯২৮ সালে। একই বছর প্রকাশিত হয় প্রথম ছোট গল্পের বই ‘টুটাফাটা’। তবে পাঠক-মহলে সবচেয়ে সাড়া জাগায় তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘কল্লোল যুগ’। এটির প্রকাশকাল ১৯৫০। ইতিমধ্যে অনেকেই বুঝে গেছেন এখানে কার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, তিনি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। আজ (২৯ জানুয়ারি, ২০১৫) এই বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদকের ৩৯তম প্রয়ান দিবস । ১৯৭৬ সালের এই দিনে কোলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
অচিন্ত্যকুমারের মৃত্যুর ঠিক তেরো বছর আগে, মানে ১৯৬৩ সালের ২৯ জানুয়ারি ম্যাসাচুসেটসে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রষ্ট। ১৮৭৪ সালের ২৬ মার্চ সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মেছিলেন তিনি। আর ২০১১ সালের এই দিনে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কলম সৈনিক পথিক সাহা। তার হয়েছিলো মাত্র ৪৫ বছর।
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কল্লোল যুগের লেখকদের মধ্য অচিন্ত্যকুমার ছিলেন অন্যতম। ১৯২১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় নীহারিকা দেবী ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে তিনি কল্লোল পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব নেন। বিচিত্রায়ও কিছুদিন কাজ করেন। তিনি উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। কাকজ্যোৎস্না ও প্রথম কদমফুল তাঁর আরো দুটি বিখ্যাত উপন্যাস। তিনি উপন্যাসাদলে আবেগপূর্ণ ভাষায় ধর্মগুরুদের জীবনীও ) লিখেছেন। এর মধ্যে যেমন- চার খণ্ডে প্রকাশিত (১৯৫২-১৯৫৭) ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’ বহু বিক্রিত একটি বই।

পিতার কর্মস্থল নোয়াখালী শহরে ১৯০৩ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর অচিন্ত্যকুমারের জন্ম। তবে তাঁর পরিবারের আদি নিবাস ছিল বর্তমান মাদারিপুর জেলায়। বাবা রাজকুমার সেনগুপ্ত নোয়াখালী আদালতের আইনজীবী ছিলেন। সেখানেই কাটে তাঁর শৈশব, শিক্ষা জীবন শুরুর সময়। ১৯১৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি কোলকাতায় অগ্রজ জিতেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের নিকট চলে যান। এরপর সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে মাধ্যমিক (১৯২০), সাউথ সাবার্বান কলেজ (বর্তমান আশুতোষ কলেজ) থেকে উচ্চমাধ্যমিক (১৯২২) এবং ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক (১৯২৪) পাস করেন। পরবর্তীতে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর (১৯২৬) ও বিএল ডিগ্রী (১৯২৯) লাভ করেন। ১৯৩১ সালে তিনি অস্থায়ী মুন্সেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন অচিন্ত্যকুমার। পর্যায়ক্রমে সাব-জজ, জেলা জজ ও ল' কমিশনের স্পেশাল অফিসার পদে উন্নীত হয়ে ১৯৬০ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন।
বিচারবিভাগে চাকরির বদৌলতে বাংলাদেশের নানা স্থানে ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে আসেন অচিন্ত্য । নিজের কবিতা, ছোট গল্প ও উপন্যাসগুলোতে তিনি নিপুণভাবে ওই পরিচিতজনদের জীবনের ছবি এঁকেছেন। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি জগত্তারিণী পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫) ও শরৎচন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫) লাভ করেন।
রবার্ট ফ্রষ্ট
এদিকে রবার্ট ফ্রস্ট সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় আমেরিকান কবি। আমেরিকান কথ্যভাষা এবং গ্রামীণ জীবনের বাস্তবানুগ বর্ণনায় তাঁর মুন্সিয়ানা ছিলো অসামান্য। জীবদ্দশাতেই তিনি নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। কবিতায় পুলিৎজার পুরস্কারই পেয়েছিলেন চারবার।
পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের সাথে সান ফ্রান্সিসকো ছেড়ে ম্যাসাচুসেটসের লরেন্সে চলে আসেন ফ্রস্ট। তখন তাঁর বয়স এগার। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি লরেন্স হাই স্কুল উত্তীর্ণ হন। এখানে পড়ার সময় কবিতা পড়া ও লেখার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এ স্কুলের একটি সাময়িকীতে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এরপর হ্যানোভারের ডার্টমাউথ কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। পড়াশুনার পাট চুকে যাওয়ার পর ফ্রস্ট মুচি থেকে শুরু করে সংবাদপত্র সম্পাদনা পর্যন্ত বিভিন্ন কাজ করে আয়-উপার্জ্জনের চেষ্টা করেছেন। তবে শেষাবধি জীবিকার জন্য তিনি শিক্ষকতাকে বেছে নেন।
১৮৯৪ সালে ফ্রস্ট নিজের কবিতা ‘মাই বাটারফ্লাই, এন এলিজি ’ বিক্রি করে দেন মাত্র ১৫ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে। পরের বছর ইলিনর মিরিয়াম হোয়াইট নামের এক মহিলার সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। এসময় তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করছিলেন। মিরিয়াম হোয়াইট ফস্ট্রের কবি জীবনে এক অনবদ্য প্রেরণা হয়ে আবির্ভুত হন। ১৯১৫ সালে‘বয়েজ উইল’ এবং ‘নর্থ অব বোস্টন ’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যুক্তরাস্ট্রের শীর্ষস্থানীয় খ্যাতিমান কবিদের একজন হয়ে ওঠেন রবার্ট ফ্রস্ট।
পথিক সাহা
অন্যদিকে পথিক সাহা ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রধান প্রতিবেদক। টানা দুই বার তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাংবাদিকতা পেশায় আসার আগে ছাত্র আন্দোলনেও সম্পৃক্ত ছিলেন পথিক। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। সংগঠনটির ৯০ পরবর্তী ভাঙনের জন্যও তাকে দায়ী করা হয়েছিলো। তিনি ইউনিয়নের বিদ্রোহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে অবশ্য তিনি আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। মৃত্যুকালেও তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
অচিন্ত্য, রবার্ট ও পথিকের আত্মা শান্তি পাক, এই কামনা।
newsreel [সংবাদচিত্র]