Powered By Blogger

১৩ মে ২০১৬

প্রফেসনাল নই, ইমোসনাল আমি

‘আপা আপনি শ্রদ্ধেয়, মহান। কিন্তু আপনার সাথে কাজ করাতো দূরের আলাপ, কথা বলার রুচিও আমার আর অবশিষ্ট নেই। টাকাটা কখনো দিতে ইচ্ছে হলে *** ভাইয়ের কাছে দিয়েন।’ – দেশের স্বনামধন্য এক নির্মাতাকে গত মঙ্গলবার (১০ মে, ২০১৬) বিকেলে এই ক্ষুদে বার্তাটা পাঠাতে হয়েছে। গত মার্চের শেষ সপ্তাহে - তার নির্মাণাধীন ধারাবাহিক নাটক / মেগা সিরিয়ালের দ্বিতীয় কিস্তির চিত্রায়ন পর্বে কাজ করতে ‍গিয়েই জেনেছিলাম, প্রথম কিস্তির চিত্রগ্রাহক টানা আট দিন কাজ করেও কোনো টাকাও পাননি। তখনই বেশ আঁতকে উঠেছিলাম যে শঙ্কায়, তা’ই সত্যি হলো। নয় দিন কাজ করিয়ে তিনি মাত্র দুই দিনের মজুরী দিলেন, তা’ও বহুবার চাওয়ার ফল। এরপর – ‘এ হপ্তায় না, ও হপ্তায়’ - টাকা দেয়ার কথা বলে বলে কালক্ষেপন শেষে সর্বশেষ আমায় জানানো হয়েছে, ওই সাত দিনের মজুরি কবে নাগাদ দেয়া হবে তা অনিশ্চিত। তবে চলতি মাসের শেষ হপ্তায় নির্মাতা ধারাবাহিক/সিরিয়ালটির তৃতীয় কিস্তির চিত্রায়ন পর্বের কাজ শুরুর পাশাপাশি আরেকটি খণ্ড নাটক নির্মাণ করবেন। ওই সময় তিনি আমার, মানে চিত্রগ্রাহকের দিনের মজুরী দিনেই দিতে পারবেন।
বকেয়া মজুরী দিতে না পারার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তার ধারাবাহিক/সিরিয়ালের প্রযোজক এখন ‘ঈদের নাটক নিয়ে প্যাঁচে আছেন’। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট চ্যানেল ক্রিকেট খেলা প্রচারের কারণে নাটকটির প্রচার আপাতত বন্ধ রাখায় তিনি প্রযোজককে ‘আগের টাকার জন্য চাপ দিতে’ পারছেন না। যদিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অনির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছেন, ‘তারা পরিচালকের আগের দুই কিস্তির সমুদয় বেকয়া পরিশোধ করে দিয়েছেন।’
নিজেরই প্রায় বছর দশ/বারো বছর আগের দশা মনে পরছে। সম্ভবত মনে করাচ্ছে এ সময়ের দায়। সেই সময়ও প্রায় একইরকম হতাশায়, ভুগতে হয়েছে হায়। তখন অবশ্য নাটক-সিনেমার পরিচালক/প্রযোজক নয়, পত্রিকা-ম্যাগাজিনের সম্পাদক/প্রকাশকের সুমতির অপেক্ষায় থাকতাম রোজ। আহা, কে-ইবা নিতে চায় এমন অতীতের খোঁজ। তখনও দেখতাম তারা ঠিকই ওড়াচ্ছেন বিজয়ের কেতন, ওদিকে বকেয়া আমার ছয় মাসের বেতন। এখন পরিচালক/প্রযোজকদের মাঝেও একই চরিত্র দেখি। এদের যত বড় বড় কথা, মানুষের জন্য দরদ বা ব্যাথা; সবই লোক দেখানো – মেকি। মালিক সর্বত্র একই। মিডিয়ার বিভিন্ন সেক্টরের মালিকদের চরিত্র - পোশাকশিল্প বা জাহাজভাঙাশিল্পের মালিকদের চেয়ে অন্তত ভালো, এমনটা ভাবার কোনোই কারণ নেই।
আন্দাজ করি, এই লেখা বা ক্ষোভ প্রকাশকে হয় ‘ছেলেমানুষী’ - নয় ‘পাকনামি’ ভাববেন অসংখ্য বিজ্ঞ সহযোদ্ধা। এর আগেও আমার এমন আচরনের বহিঃপ্রকাশে তাদের অনেকে অবাক হচ্ছেন দেখে আমি অবশ্য খুব একটা চমকাইনি। কারণ জানি এই শ্রমবাজারে তারাই কথিত প্রফেশনাল। আর আমার মতো ইমোসনালরা বরাবরই মুতে দেয় নিরবতার নিক্তিতে পরিমাপ্য অমন প্রফেসনালিজমের ওপর। যে কারণে আমরা সব জায়গায় আনফিট। মিডিয়ায়তো আরো বেশী।
আরেকটা গল্প বলে শেষ করছি। এটা ছিলো ২০১১ সালের আগস্টের ঘটনা। তখন একটা অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর সাপ্তাহিকের সংসদ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছি। সরকারের মন্ত্রীদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করে বেশ আলোচনায় আসা প্রতিষ্ঠান দুটির সম্পাদক/প্রকাশককে মাসের ২১ তারিখে গ্রেফতার করা হয়। পরদিনই সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় তার নিউজ পোর্টাল আর সাপ্তাহিক। বিনা নোটিশে বেকার হয়ে যাই প্রতিষ্ঠান দুটির শতাধিক সাংবাদিকসহ সবগুলো বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী। ওই সময় সাংবাদিকদের অনেকে আবার বেতন না পাওয়ার শঙ্কায় অফিস থেকে পাওয়া ল্যাপটপ/নোটপ্যাড জমা দেননি। আমিও একই শঙ্কায় ছিলাম। কিন্তু অফিসের জিনিস আটকে বেতন আদায়ে বিবেক সায় দিচ্ছিলো না। অথচ আয়ের অন্য কোনো উপায়ও আমার জানা ছিলো না। অবশেষে কয়েকজন সাংবাদিক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে – কিছু টাকা ধার দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেই।

পরবর্তী সরকারের সাথে সমঝোতা হওয়ার পর সেই সম্পাদক/প্রকাশক কারামুক্ত হন। প্রতিষ্ঠান দুটোও আবার চালু করেন। কিন্তু সেই বেতন আর আমার চাওয়া হয়নি, পাওয়াও যায়নি। অথচ পাঁচ বছর আগের সেই এক মাসের বেতনের ঘাটতি আজও পোষাতে পারিনি। এর আগে পরে অজস্রবার অসংখ্য প্রতিষ্ঠান স্রেফ চাকরি ছাড়ার কারণে আমায় শেষ মাসের বেতন দেয়নি। এক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকতো ক্ষুদ্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে ল্যাপটপ চুরির অভিযোগও এনেছিলেন। যাক সে আলাপ। বস্তুত জীবনে ঘাটতি বাড়ছে। এরই সাথে তা পোষানোর সুযোগ বা সামর্থ্যও কমছে কী? – এই নিয়েই চিন্তায় আছি।

পুরানো পোস্টঃ
মুক্ত সাংবাদিকতা ও আত্মরক্ষার্থে ...

‘জার্নালিজম’ বনাম ‘ক্যাপিটালিজম’!
প্রতিক্রিয়া বা স্ব-শিক্ষিত সাংবাদিকতা...

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]