Powered By Blogger
শিক্ষক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শিক্ষক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২০ মে ২০১৮

ফের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে চাই

পুত্র মুনিমের সাথে ছায়ীদুল্লাহ্ আঙ্কেলের এই ছবিটি ৪ মে দুপুরের
কিছু কিছু মৃত্যুর খবর বড় বেশী স্মৃতিকাতর করে তোলে। এই যেমন আজ ভোরে বন্ধু কানুর (লিমন কৃষ্ণ সাহা) কাছে যখন শুনলাম কলেজ পাড়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রিয়মুখ মোহাম্মদ ছায়ীদুল্লাহ্ আর নেই, কত কিছুই না মনে পড়ে গিয়েছে। যা রোমন্থনে বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। তিনি হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক হলেও এককালে বরিশালের প্রতিটি শিক্ষায়তনের শিক্ষার্থী তাঁর জ্ঞানের সান্নিধ্য পেয়েছেন।
মূলত ইংরেজীর ডাকসাইটে শিক্ষক ছিলেন ছায়ীদুল্লাহ আঙ্কেল (এমনটাই সম্বোধন করতাম তাকে)। হালিমা খাতুনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকও ছিলেন দীর্ঘদিন। মিষ্টভাষী নিপাট ভদ্রলোক, অদ্ভুত মায়াবী এক হাসির অধিকারী এই মানুষটি শৈশব ও কৈশোরে আমাদের এক অদ্ভুত ভয়ের কারণ ছিলেন। তার ছোট ছেলে মুনিমের (মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ্) সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে যার সাথে পরিচিত ছিলাম আমরা, মানে মুনিমের বন্ধুরা। আন্দাজ করি বাবু ভাইয়ের (মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ্) বন্ধুরাও একই আতঙ্কে ভুগতেন। বিষয়টা একটু খোলসা করি। একদিনের ঘটনা বললেই সবাই বুঝবেন আশাকরি। 

তখন সম্ভবত সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। বিকেলে পূর্ব নির্ধারিত ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য মুনিমকে ডাকতে গিয়েছি ওর বাসায়। আঙ্কেলই দরজা খুললেন। আসার কারণ শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এরপর প্রথমেই জানতে চাইলেন কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ি। বলার পর ফের জানতে চাইলেন, ‘টেনস’ (Tense ) কত প্রকার ও কি কি? উত্তর শেষ হতেই তাঁর পরবর্তী জিজ্ঞাসা, ‘পার্টস অব স্পিচ’ (Parts Of Speech) কাকে বলে? তা’ও বললাম। এরপর আবারও সম্পূরক প্রশ্ন, পার্টস অব স্পিচ কত প্রকার ও কি কি? সবগুলো উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারায় মহাখুশী হয়ে যান তিনি। গম্ভীরতা ঝেড়ে স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, দাঁড়াও মুনিমকে ডেকে দিচ্ছি। কিন্তু তিনি ভিতরে গিয়ে দেখেন যে তার সুপুত্রটি আর ঘরে নেই আসলে। কোলবালিশকে কাঁথায় মুড়িয়ে নিজের জায়গায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে অনেক আগেই পিছনের দরজা থেকে পালিয়েছে। বুঝুন তখন আমার কি হাল। অবস্থা বুঝে আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত ভেগে যাই। 

একটু বড় হওয়ার পর বন্ধুরা যখন প্রায়ই নিশিজাগা আড্ডায় মাতি, তখনকার আরেকটা গল্প বলি। এক শাওন রাতে আঙ্কেল ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মুনিমের বাসায় গিয়ে হাজির আমরা। তুমুল আড্ডা, তাস খেলা আর খাওয়া-দাওয়ায় আমরা যখন মত্ত ঠিক তখনই কিভাবে যেন আঙ্কেলের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি রুমের দরজায় এসে নক করতেই আমরা সব চুপ। পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি ঠিকই টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে রুমে অনেক মানুষ রয়েছে। অবশেষে অন্যদিকের দরজা খুলে আমরা যখন কেবল রাস্তায় বেড়িয়েছি, তিনিও কোন দিক দিয়ে যেন বেড়িয়ে এলেন। কি আর করা, দিলাম দৌড়। তিনিও আমাদের তাড়া করে বেশ কত দূর দৌড়ে এসেছিলেন, বলছিলেন - দাঁড়াও, দাঁড়াও। কিন্তু আমাদের কি আর তখন সেই সাহস আছে। আঙ্কেলকে আসতে দেখে পাশে থাকা এক বন্ধু থামার কথা বলতেই আরেক বন্ধুর বলেছিল, তুই ইংলিশ গ্রামারে ভালো হলে দাঁড়া; নইলে ভেগে যা। আঙ্কেলের সাথে এমন আরো কত অজস্র টুকরো স্মৃত্মি জমে আছে! শেষের দিকে তিনি বেশ নরম হয়ে গিয়েছিলেন, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত শুক্রবার দিবাগত রাতেও বন্ধু বান্নার (বাকিউল আহসান) সাথে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছিল। চুয়াত্তর কি-ইবা এমন বয়স!

কিছুক্ষণ পর, মানে বা’দ যোহর বিএম কলেজের মধ্যে আঙ্কেলের জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। বরিশালের কলেজ পাড়া এক গুণী প্রবীণকে বিদায় জানাবে আজ। আল্লাহ অবশ্যই তার এই নামাজী পরহেজগার বান্দাকে প্রাপ্য সম্মাণটুকু দেবেন। পবিত্র কোরান বলছে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব। বিদায় আঙ্কেল। তবে মহাবিশ্বের কোথাও ফের কোনো জন্মে আপনার আন্তরিক জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে চাই। অপেক্ষায় থাকলাম। আশারাখি আপনিও ভালো থাকবেন।

ঈয়ন
২০ মে ২০১৮
মিরপুর, ঢাকা।

১৪ নভেম্বর ২০১৭

রাষ্ট্র তাকে ভয় না পেলে আশ্চর্য হতাম

ছবিটি ফেসবুক থেকে নেয়া 
সরকারি নথি সেলিম রেজা নিউটনকে ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ বলায় মোটেও অবাক হইনি। বরঙ মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে তার বিরুদ্ধে ‘জঙ্গি কানেকসন’ -এর অভিযোগও উঠতে পারে। একজন নিউটনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ভাবা আসলে নতুন কিছু নয়। যে কোনো তাত্ত্বিককে সরকারের ‘বিপদজনক’ মনে হতেই পারে। এর আগে ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাক্যাম্প-স্থাপন ও সেনা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে রাষ্ট্রের রোষানলের শিকার হয়েছিলেন নিউটন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা রক্ষার দাবিতে প্রতিবাদী মৌন মিছিল করে জরুরি অবস্থা লঙ্ঘনের দায়ে সহকর্মীদের সাথে জেলও খেটেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক। তবে শঙ্কার কথা হচ্ছে ইদানীং এই রাষ্ট্রের, মানে বাংলাদেশের সরকার যদি কোনো নাগরিককে ভয় পায়, সে গুম হয়ে যায়। গত আড়াই মাসে সম্ভবত ১০ জন নিখোঁজ হয়েছেন শুধু রাজধানী থেকে। এর আগে বছরের প্রথম পাঁচ মাসে একই পরিণতির শিকার হয়েছেন ৪২ জন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব মতে বাংলাদেশে গত বছর মোট ৯০ জন মানুষ ‘গুম’ হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র বা প্রকাশক। 

দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ১০ নভেম্বর ‘রাবি ও রুয়েটে ইয়াবা ব্যবসায় ৪৪ শিক্ষক শিক্ষার্থী কর্মচারী’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘রাবি ঘিরে গড়ে ওঠা ইয়াবা ব্যবসা চক্রের ৩৪ জনকে শনাক্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাদক অধিশাখা, যা প্রধানমন্ত্রীর দফতর হয়ে ৭ নভেম্বর রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনারের (আরএমপি) হাতে পৌঁছেছে।’ তবে ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশের পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক জানান, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাদকাসক্ত চিহ্নিত করে কোনো তালিকা তৈরী করেনি। কারা করেছে তা’ও তিনি জানেন না। ওই তালিকাতেই রয়েছে সেলিম রেজা নিউটনের নাম। আরো ছয় শিক্ষককে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিউটনকে চিনি। জানি তার সহজিয়া প্রেমিক সত্ত্বার গান, কবিতা আর স্বাধীনচেতা ভাবনার গতিধারা। বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো তাকে ভয় না পেলেই হয়ত আশ্চর্য হতাম।
তথাপি রাষ্ট্র পরিচালকদের কাছে এ লেখার মাধ্যমে অনুরোধ জানাচ্ছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাদক অধিশাখায় কে বা কারা আছেন বা তারা কার নির্দেশে এই প্রতিবেদন তৈরী করে প্রধানমন্ত্রীল কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন তা একটু খতিয়ে দেখুন। নতুবা এ ঘটনা মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত করবে।তাছাড়া প্রতিবেদনটি কোনো যাচাইবাছাই না করেই রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আবদুস সোবহান যখন বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে এটি গভীর পরিতাপের বিষয়, খুবই উদ্বেগজনক।কর্তৃপক্ষ দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’ তখন মনে আরো নানা প্রশ্ন জাগে। ভিসির এই অতি উৎসাহের উৎসও খুঁজে বের করা দরকার।
ইত্তেফাকের সেই প্রতিবেদন
পাঠকদের অনেকে হয়ত খেয়াল করেছেন ‘এটুআই প্রকল্পের একাধিক ব্যক্তির জঙ্গি কানেকশন : শিক্ষক মুবাশ্বারের নিখোঁজ রহস্যের নেপথ্যে’ - শিরোনামে ১১ নভেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক ইত্তেফাক। পরে তারা অনলাইন সংস্করণ থেকে সেটি তুলে নিলেও ততক্ষণে তা সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ভাইরাল হয়ে যায়। ওই প্রতিবেদনে ইত্তেফাকের সাংবাদিক আবুল খায়ের দাবি করেন গোয়েন্দাদের কল্যাণে তিনি জানতে পেরেছেন মুবাশ্বারের সাথে জঙ্গি সংযোগ রয়েছে। এদিকে যুগান্তরের পর আরো অজস্র গণমাধ্যম ইয়াবা ব্যবসা চক্রের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। এখানে সংযুক্ত করে রাখি - গণমাধ্যমে গত আড়াই মাসে যে দশ জন লাপাত্তা হওয়ার খবর এসেছে তার মধ্যে গত ২৭ অক্টোবর থেকে হদিস নেই বাংলাদেশে জনতা পার্টি (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন ঘোষ ও তার সহকর্মি আশিষ ঘোষের। সাংবাদিক উৎপল দাস ১০ অক্টোবর এবং আরাফাত নামের এক যু্বক ৭ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ। এর আগে ২২ থেকে ২৭ আগস্টের মধ্যে নিখোঁজ হন চারজন। এরা হলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিএনপির সহ-সভাপতি ও এবিএন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সাদাত, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, ব্যবসায়ী ও বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায় এবং কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) গভীর রাতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজারের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন খিলগাঁও থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ৪৭১) করলে তার খবরটিও গণমাধ্যমে আসে।পরদিন করিম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার তানভীর ইয়াসিন করিমকে সাদাপোশাকের লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে। তারও খোঁজ মিলছে না। 

নিউটনের সাথে সর্বশেষ সাক্ষাত হয়েছিলো চলচ্চিত্র নির্মাতা
রাসেল আহমেদের মৃত্যুর ক’দিন পর, গত মে বা জুনে।
যারা নিউটনকে চেনেন না তাদের জন্য বলে রাখি, ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি রাবিতে শিক্ষকতা করছেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। আশির দশকে সামরিক-শাসন-বিরোধী ছাত্র-আন্দোলন এবং বলশেভিক-বামপন্থার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ‘রাজু ভাস্কর্য’ খ্যাত শহীদ মঈন হোসেন রাজু সন্ত্রাসবিরোধী যে ছাত্রমিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন, সেই মিছিলের অন্যতম মূথ্য সংগঠক ছিলেন নিউটন। ইউনিয়ন ছাড়ার পর ১৯৯১ সালের শেষ দিকে ‘শিক্ষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে ঢাবি’র ‘সাইনে ডাই’ (অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ) প্রথার বিরুদ্ধে স্বাধীন ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন । সেটাই ছিলো ঢাবি'তে শেষ 'সাইনে ডাই'। নিউটন সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি ছেড়েছেন মূলত নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরে। তবে ১৯৯৮ সাল অবধি জড়িত ছিলেন সিপিবি (কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশ) -এর সাথে। রাজশাহী জেলা কমিটির সহ-সভাপতিও ছিলেন। এরই মাঝে তিনি বিস্তৃত করেছেন লেখালেখির ক্ষেত্র। সম্পাদনা করছেন মানুষ ও প্রকৃতি বিষয়ক ছোটকাগজ মানুষসহ আরো অজস্র পত্রিকা।

পূর্ববর্তী পোস্ট : 

প্রশ্নবিদ্ধ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা

১১ নভেম্বর ২০১৭

প্রশ্নবিদ্ধ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা

‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ’ শিরোনামে
‘বাংলাদেশের খবর’-এর পরীক্ষামূলক সংখ্যায় লেখাটির
সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত লেখা চুরির অভিযোগে দেশের ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো’-ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশ সেরা আখ্যা পাওয়া বিদ্যায়তনের এ ঘটনা ক্ষুণ্ণ করেছে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদা, শিক্ষক সমাজের সম্মাণ। একইসঙ্গে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদিত গবেষণাপত্রের গ্রহণযোগ্যতাকে হুমকীর মুখে ফেলেছে। 

খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)-সহ একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আলাপকালে এসব জানতে পেরেছে বাংলাদেশের খবর। এই অবস্থার জন্য গবেষণাপত্র প্রণেতাদের পাশাপাশি তা রিভিউয়ের, মানে অনুমোদনের দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিদের গাফিলতিকেও দুষছেন কেউ। আবার কেউ বলেছেন, এটি শিক্ষক নিয়োগের নামে ভোটার নিয়োগের পরিণাম। এ জাতীয় ঘটনা নতুন নয় বলেও জানা গেছে। ইতিপূর্বে এমন অভিযোগ শিক্ষকদের শাস্তি দেয়া হলেও তাদের জালিয়াতির প্রবণতা রোধ করা যায়নি। 
গবেষণাপত্রে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে গত মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। অভিযুক্তরা হলেন সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান, ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিন, নুসরাত জাহান ও বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। এর মধ্যে সামিয়া রহমান একই সঙ্গে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান হিসেবেও কাজ করেন৷ সামিয়া ও মারজানের একটি যৌথ লেখা গত বছরের ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ‘সায়েন্স রিভিউ’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। যার শিরোনাম ‘এ নিউ ডাইমেনশন অফ কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্ট্যাডি অফ দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’। অভিযোগ রয়েছে তাদের দু'জনের গবেষণাপত্রের ৬১ ভাগেরও বেশী নকল। প্রথমে শিকাগো জার্নাল কর্তৃপক্ষ জানায়,ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর লেখা ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে তারা লেখা চুরি করেছেন। পরে সাঈদ একাডেমি অব প্যালেস্টাইন এক অভিযোগে জানায়, উত্তর-উপনিবেশিক গবেষক ও দার্শনিক এডওয়ার্ড সাঈদের লেখা নিবন্ধ থেকেও কিছু অংশ হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে সামিয়া ও মারজানের নিবন্ধে। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তিন শিক্ষক একইভাবে অন্যের লেখা নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছেন৷
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটছে। এ ব্যাপরে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো এখতিয়ার আমাদের নেই। তবে আমাদের অর্থায়নে যেসব গবেষণা হয়, যে জার্নালগুলো প্রকাশ করা হয়, সেখানে অনিয়ম হলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। এর আমরা অনেক চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ধরেছি। অনেক শিক্ষকের লেখা প্রত্যাহার করে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এক্ষেত্রে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও সবাই শাস্তি পায়নি।’ ইউজিসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদার প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া ঠিক না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।’ 
একই সময়ে বিদেশী একটি রেডিওকে দেয়া সাক্ষাতকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আগেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেই। কিন্তু এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে একটি নীতিমালা করা প্রয়োজন। আর তাতে এই ধরণের কোনো অপরাধে কি শাস্তি হবে তা সুনির্দষ্ট করে দেয়া দরকার। কারণ অতীতে দেখা গেছে, একই অপরাধে ভিন্ন শাস্তি হয়েছে।’ উল্লেখিত পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তকারী কমিটির এই সদস্য আরো বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’ 
জানা গেছে, গবেষণাপত্রে লেখা চুরির দায়ে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আ জ ম কুতুবুল ইসলাম নোমানীকে পদাবনতি দিয়ে সহকারি অধ্যাপক করা হয়। পিএইচডি থিসিসে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূর উদ্দিন আলোকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গবেষণা জালিয়াতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক-এর বিরুদ্ধে ‘সংখ্যাতিরিক্ত’ শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ আছে। এছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সালমা বেগমের বিরুদ্ধেও চুরির অভিযোগ ওঠে এক বছর আগে। 

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটনের সাথে আলাপ করে বাংলাদেশ খবর। তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি খুবই অনাকাঙ্খিত। বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠানটির পচনের লক্ষ্মণ। শিক্ষক নিয়োগের নামে ভোটার নিয়োগের প্রক্রিয়ার পরিণাম। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন-প্রক্রিয়া থেকে যাবতীয় ভোটাভুটি তুলে দেয়া প্রয়োজন। এ জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বনাশ করছে। ভোটাভুটির বিকল্প হতে পারে বিভাগীয় চেয়ারপার্সনের মতো জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সমস্ত পদে দায়িত্ববণ্টন। সেই সাথে দরকার, বিভিন্ন পদে দায়িত্বের মেয়াদ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।’ তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে লেখা নকল করার অভিযোগ ঠিকঠাক মতো তদন্ত করে দেখা দরকার। দোষ প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তিদেরকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা উচিত।’ 

এক প্রশ্নের জবাবে নিউটন বলেন, ‘গবেষণায় জালিয়াতির এসব ঘটনায় সাধারণভাবে আমাদের সম্পর্কে বাইরের ইম্প্রেশন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তবে ঢালাওভাবে আমাদেরকে খারিজ করার অবস্থা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে এ রকম যদি চলতেই থাকে, তাহলে চরম বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে যাব আমরা। যাবতীয় গ্রহণযোগ্যতা হারাতে হবে তখন আমাদের।’ অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজি বাংলাদেশ খবর-কে বলেন, ‘সমাজ বিজ্ঞান, বিশেষ করে গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় আমাদের এখানে গবেষণা বলে যা হয় তা নিয়ে বিশ্বের কোথাও কারও মাথাব্যথা আছে বলে আমার জানা নাই। সুতরাং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এসব ঘটনার কোনো প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থাকার কথা না।’

আলী আর রাজি বলেন, ‘এখন যাদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তাদের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। প্রশ্ন উঠলেই কাউকে দোষী বিবেচনা করা যায় না। কে, কার বিষয়ে, কখন প্রশ্ন তুলছে সে নিয়েও এ দেশে সন্দহ করার অবকাশ অনেক। কারণ নিবন্ধকারদের নিয়ে এ জাতীয় কোনো প্রশ্ন একাডেমির বাইরে আসার কথা না। তাদের নিবন্ধ, অন্তত দু জন রিভিউরার পরীক্ষা করার কথা। যিনি বা যারা সম্পাদনায় ছিলেন, তাদেরও তো দায়িত্ব ছিলো। তারা কেন কথিত চুরি ধরতে পারেন নি? তখনই তো তাদের সতর্ক করে দেয়া যেত, সেই নিবন্ধ না ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়া যেত।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে কিছু ছাপা হলে, সম্পাদককে-ই তার দায়িত্ব নিতে হয়। তারপর যারা সম্পাদনা সহকারী আছেন তাদের দায়িত্ব বিবেচনা করা হয়, সব শেষে লেখক বা সাংবাদিককের শাস্তির বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটার কথা।’ 
‘সম্প্রতি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা সকেলই ঢাবির সদ্য বিদায়ী ভিসি আআমস আরেফিন সিদ্দিকীর ঘনিষ্ট বলে জানা গেছে এর মেধ্য সামিয়া রহমানের খণ্ডকালীন কাজ চাকরির অনুমতির কোনো কাগজ নেই বলছে ঢাবির রেজিস্ট্রার দফতর। এই বিষয়টি কে কিভাবে দেখছেন?’- বাংলাদেশ খবর-এর এমন প্রশ্নের জবাবে রাজি বলেন, ‘সামিয়া রহমানের বাইরে কাজ নিয়ে আপত্তি করলে করবে বিভাগ। বিভাগ যদি মনে করে, বিভাগ তার যথাযথ সার্ভিস পাচ্ছে না, বা বাইরে কাজ করায় বিভাগ বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে বিভাগ তাকে বলতে পারে। সে গোপনে কোনো কাজ করেনি, সব প্রকাশ্যে করেছে, সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট কাজ করেছেন। বিভাগ তাতে বরং উপকৃত হওয়ার কথা।’
ঢাবির কোনো শিক্ষক কেবলমাত্র একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন কাজের অনুমতি পান। তবে শর্ত হচ্ছে, এক্ষেত্রে অবশ্যই তিনি নিজের বিভাগের নিয়মিত কাজকর্মের কোনও বিঘ্ন ঘটাবেন না। এছাড়া তাকে স্থায়ী চাকরি করতে হলে শর্তসাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমতি নিতে হবে। অভিযুক্ত সামিয়া রহমান বর্তমানে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পদে চাকরি করছেন। এর আগেও তিনি আরেকটি টেলিভিশন চ্যানেলের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এবং প্রোগ্রাম এডিটর হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তার অন্যত্র চাকরির অনুমতি বিষয়ে কোনও চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে নেই জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তার হোসেন। 

সাংবাদিকদের মোক্তার হোসেন বলেছেন, ‘তিনি (সামিয়া) আবেদন লিখেছিলেন উপাচার্য বরাবর। তাই তিনি অনুমতির চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে আনলেও সেটি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে তার কাজে অনুমতির কোনও চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে নেই। তিনি যদি অন্যত্র কাজের অনুমতি পান তাহলে তৎকালীন উপাচার্যই তা দিয়েছেন। অনুমতি পেয়েছেন কিনা তার কোনও নথি বা এ সংক্রান্ত কোনও চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে নেই।’

পড়ুন : 
পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব নেবে কে?
newsreel [সংবাদচিত্র]