Powered By Blogger
পাবলিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
পাবলিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১১ নভেম্বর ২০১৭

প্রশ্নবিদ্ধ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা

‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ’ শিরোনামে
‘বাংলাদেশের খবর’-এর পরীক্ষামূলক সংখ্যায় লেখাটির
সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত লেখা চুরির অভিযোগে দেশের ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো’-ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশ সেরা আখ্যা পাওয়া বিদ্যায়তনের এ ঘটনা ক্ষুণ্ণ করেছে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদা, শিক্ষক সমাজের সম্মাণ। একইসঙ্গে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদিত গবেষণাপত্রের গ্রহণযোগ্যতাকে হুমকীর মুখে ফেলেছে। 

খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)-সহ একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আলাপকালে এসব জানতে পেরেছে বাংলাদেশের খবর। এই অবস্থার জন্য গবেষণাপত্র প্রণেতাদের পাশাপাশি তা রিভিউয়ের, মানে অনুমোদনের দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিদের গাফিলতিকেও দুষছেন কেউ। আবার কেউ বলেছেন, এটি শিক্ষক নিয়োগের নামে ভোটার নিয়োগের পরিণাম। এ জাতীয় ঘটনা নতুন নয় বলেও জানা গেছে। ইতিপূর্বে এমন অভিযোগ শিক্ষকদের শাস্তি দেয়া হলেও তাদের জালিয়াতির প্রবণতা রোধ করা যায়নি। 
গবেষণাপত্রে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে গত মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। অভিযুক্তরা হলেন সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান, ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিন, নুসরাত জাহান ও বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। এর মধ্যে সামিয়া রহমান একই সঙ্গে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান হিসেবেও কাজ করেন৷ সামিয়া ও মারজানের একটি যৌথ লেখা গত বছরের ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ‘সায়েন্স রিভিউ’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। যার শিরোনাম ‘এ নিউ ডাইমেনশন অফ কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্ট্যাডি অফ দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’। অভিযোগ রয়েছে তাদের দু'জনের গবেষণাপত্রের ৬১ ভাগেরও বেশী নকল। প্রথমে শিকাগো জার্নাল কর্তৃপক্ষ জানায়,ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর লেখা ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে তারা লেখা চুরি করেছেন। পরে সাঈদ একাডেমি অব প্যালেস্টাইন এক অভিযোগে জানায়, উত্তর-উপনিবেশিক গবেষক ও দার্শনিক এডওয়ার্ড সাঈদের লেখা নিবন্ধ থেকেও কিছু অংশ হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে সামিয়া ও মারজানের নিবন্ধে। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তিন শিক্ষক একইভাবে অন্যের লেখা নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছেন৷
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটছে। এ ব্যাপরে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো এখতিয়ার আমাদের নেই। তবে আমাদের অর্থায়নে যেসব গবেষণা হয়, যে জার্নালগুলো প্রকাশ করা হয়, সেখানে অনিয়ম হলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। এর আমরা অনেক চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ধরেছি। অনেক শিক্ষকের লেখা প্রত্যাহার করে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এক্ষেত্রে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও সবাই শাস্তি পায়নি।’ ইউজিসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদার প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া ঠিক না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।’ 
একই সময়ে বিদেশী একটি রেডিওকে দেয়া সাক্ষাতকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আগেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেই। কিন্তু এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে একটি নীতিমালা করা প্রয়োজন। আর তাতে এই ধরণের কোনো অপরাধে কি শাস্তি হবে তা সুনির্দষ্ট করে দেয়া দরকার। কারণ অতীতে দেখা গেছে, একই অপরাধে ভিন্ন শাস্তি হয়েছে।’ উল্লেখিত পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তকারী কমিটির এই সদস্য আরো বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’ 
জানা গেছে, গবেষণাপত্রে লেখা চুরির দায়ে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আ জ ম কুতুবুল ইসলাম নোমানীকে পদাবনতি দিয়ে সহকারি অধ্যাপক করা হয়। পিএইচডি থিসিসে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূর উদ্দিন আলোকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গবেষণা জালিয়াতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক-এর বিরুদ্ধে ‘সংখ্যাতিরিক্ত’ শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ আছে। এছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সালমা বেগমের বিরুদ্ধেও চুরির অভিযোগ ওঠে এক বছর আগে। 

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটনের সাথে আলাপ করে বাংলাদেশ খবর। তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি খুবই অনাকাঙ্খিত। বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠানটির পচনের লক্ষ্মণ। শিক্ষক নিয়োগের নামে ভোটার নিয়োগের প্রক্রিয়ার পরিণাম। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন-প্রক্রিয়া থেকে যাবতীয় ভোটাভুটি তুলে দেয়া প্রয়োজন। এ জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বনাশ করছে। ভোটাভুটির বিকল্প হতে পারে বিভাগীয় চেয়ারপার্সনের মতো জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সমস্ত পদে দায়িত্ববণ্টন। সেই সাথে দরকার, বিভিন্ন পদে দায়িত্বের মেয়াদ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।’ তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে লেখা নকল করার অভিযোগ ঠিকঠাক মতো তদন্ত করে দেখা দরকার। দোষ প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তিদেরকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা উচিত।’ 

এক প্রশ্নের জবাবে নিউটন বলেন, ‘গবেষণায় জালিয়াতির এসব ঘটনায় সাধারণভাবে আমাদের সম্পর্কে বাইরের ইম্প্রেশন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তবে ঢালাওভাবে আমাদেরকে খারিজ করার অবস্থা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে এ রকম যদি চলতেই থাকে, তাহলে চরম বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে যাব আমরা। যাবতীয় গ্রহণযোগ্যতা হারাতে হবে তখন আমাদের।’ অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজি বাংলাদেশ খবর-কে বলেন, ‘সমাজ বিজ্ঞান, বিশেষ করে গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় আমাদের এখানে গবেষণা বলে যা হয় তা নিয়ে বিশ্বের কোথাও কারও মাথাব্যথা আছে বলে আমার জানা নাই। সুতরাং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এসব ঘটনার কোনো প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থাকার কথা না।’

আলী আর রাজি বলেন, ‘এখন যাদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তাদের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। প্রশ্ন উঠলেই কাউকে দোষী বিবেচনা করা যায় না। কে, কার বিষয়ে, কখন প্রশ্ন তুলছে সে নিয়েও এ দেশে সন্দহ করার অবকাশ অনেক। কারণ নিবন্ধকারদের নিয়ে এ জাতীয় কোনো প্রশ্ন একাডেমির বাইরে আসার কথা না। তাদের নিবন্ধ, অন্তত দু জন রিভিউরার পরীক্ষা করার কথা। যিনি বা যারা সম্পাদনায় ছিলেন, তাদেরও তো দায়িত্ব ছিলো। তারা কেন কথিত চুরি ধরতে পারেন নি? তখনই তো তাদের সতর্ক করে দেয়া যেত, সেই নিবন্ধ না ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়া যেত।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে কিছু ছাপা হলে, সম্পাদককে-ই তার দায়িত্ব নিতে হয়। তারপর যারা সম্পাদনা সহকারী আছেন তাদের দায়িত্ব বিবেচনা করা হয়, সব শেষে লেখক বা সাংবাদিককের শাস্তির বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটার কথা।’ 
‘সম্প্রতি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা সকেলই ঢাবির সদ্য বিদায়ী ভিসি আআমস আরেফিন সিদ্দিকীর ঘনিষ্ট বলে জানা গেছে এর মেধ্য সামিয়া রহমানের খণ্ডকালীন কাজ চাকরির অনুমতির কোনো কাগজ নেই বলছে ঢাবির রেজিস্ট্রার দফতর। এই বিষয়টি কে কিভাবে দেখছেন?’- বাংলাদেশ খবর-এর এমন প্রশ্নের জবাবে রাজি বলেন, ‘সামিয়া রহমানের বাইরে কাজ নিয়ে আপত্তি করলে করবে বিভাগ। বিভাগ যদি মনে করে, বিভাগ তার যথাযথ সার্ভিস পাচ্ছে না, বা বাইরে কাজ করায় বিভাগ বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে বিভাগ তাকে বলতে পারে। সে গোপনে কোনো কাজ করেনি, সব প্রকাশ্যে করেছে, সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট কাজ করেছেন। বিভাগ তাতে বরং উপকৃত হওয়ার কথা।’
ঢাবির কোনো শিক্ষক কেবলমাত্র একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন কাজের অনুমতি পান। তবে শর্ত হচ্ছে, এক্ষেত্রে অবশ্যই তিনি নিজের বিভাগের নিয়মিত কাজকর্মের কোনও বিঘ্ন ঘটাবেন না। এছাড়া তাকে স্থায়ী চাকরি করতে হলে শর্তসাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমতি নিতে হবে। অভিযুক্ত সামিয়া রহমান বর্তমানে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পদে চাকরি করছেন। এর আগেও তিনি আরেকটি টেলিভিশন চ্যানেলের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এবং প্রোগ্রাম এডিটর হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তার অন্যত্র চাকরির অনুমতি বিষয়ে কোনও চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে নেই জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তার হোসেন। 

সাংবাদিকদের মোক্তার হোসেন বলেছেন, ‘তিনি (সামিয়া) আবেদন লিখেছিলেন উপাচার্য বরাবর। তাই তিনি অনুমতির চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে আনলেও সেটি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে তার কাজে অনুমতির কোনও চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে নেই। তিনি যদি অন্যত্র কাজের অনুমতি পান তাহলে তৎকালীন উপাচার্যই তা দিয়েছেন। অনুমতি পেয়েছেন কিনা তার কোনও নথি বা এ সংক্রান্ত কোনও চিঠি রেজিস্ট্রার দফতরে নেই।’

পড়ুন : 
পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব নেবে কে?
newsreel [সংবাদচিত্র]