Powered By Blogger

১২ জুন ২০১৪

‘জার্নালিজম’ বনাম ‘ক্যাপিটালিজম’!

তৃপ্তি শাহানা
৩০ এপ্রিল ২০১৪।
বিকেলের দিকে ফেসবুকে ঢুকতেই চোখ আটকে যায় কার জানি শেয়ার করা মিডিয়া বার্তার একটি সংবাদে। যাতে জানানো হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় চাকরি হারিয়েছেন এশিয়ান টিভির যুগ্ম বার্তা সম্পাদক তৃপ্তি শাহানা। নড়েচরে বসলাম। পুরো প্রতিবেদনটি পরে জানলাম, গত ২৬ এপ্রিল ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তৃপ্তি। তিনি লিখেছিলেন, ‘মিডিয়ার অবস্থা কি? কি চলছে টিভি চ্যানেলগুলোতে? কি করছেন মালিক পক্ষ? প্রতি মাসের বেতন পরের মাসের শেষে দিচ্ছেন। কোনো মাসে আবার দিচ্ছেন অর্ধেক। অফিসে পিক বন্ধ। রাত ১২:৩০ -তে ড্রপ দেয়া হয়; তা’ও যেদিন চেয়ারম্যান বা এমডির পারিবারিক অনুষ্ঠান থাকে সেদিন ড্রপের নিশ্চয়তা থাকে না। কারণ গাড়ি সবগুলোই ব্যস্ত থাকে তাদের কাজে। মালিকপক্ষের কোনো প্রোগ্রাম থাকলে তার নিউজ আবার দিতে হবে মাষ্ট।’ তৃপ্তি আরো লিখেছিলেন, ‘কাজ করতে এসেছি বলে তো নিজেকে বিক্রি করে দেই নাই। মালিক পক্ষ যদি ভেবে থাকেন কিছু টাকা দিয়ে আমাদের কিনে নিয়েছেন। তবে মহা ভুল করছেন।’ মূলত এই স্ট্যাটাসটি মেনে নিতে পারেনি এশিয়ানের মালিক পক্ষ। তাই তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
খবরটি পড়ে কেন জানি তৃপ্তিকে খুব আপন মনে হচ্ছিলো। তিনি আমার গত জন্মের সহোদরা যেন। তাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো- বোন, তুমি বেক্সিমকো ফার্মার এরিয়া ম্যানেজার হও বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির জেলা প্রতিনিধি, সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারবে কি? সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজমান। প্রতিষ্ঠান, বা তারও নেপথ্যের শক্তি - মানে মালিক, শ্রমিকের সবটুকুই কেড়ে নিতে চায়। এমনকি মত প্রকাশের স্বাধীনতাটাও। মজুরীর বিনিময়ে তারা শুধু শ্রম না, পুরো সত্ত্বাই চান। সে তুমি সাংবাদিক হলেও। ওনারা মূলত কেন সাংবাদিক পোষেন তা’ও নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। কারা আজকাল টিভি-পত্রিকায় বিনিয়োগ করেন, কেন করেন- এসব’তো মূর্খেও জানে।
অবস্থাদৃস্টে যা মনে হচ্ছে তা বলতেই আজ লিখতে বসা। আমার ধারণা, মুক্ত সাংবাদিকতা শক্তিশালী না হলে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকরাও নিরাপদ হবেন না। মানে, স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশই সব সাংবাদিকের সামাজিক, নৈতিক ও পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে; টিকিয়ে রাখতে পারে বস্তুনিষ্ঠ - শুদ্ধ সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার নামে কোনো গোষ্ঠীর হয়ে তথ্য ত্রাস, বিভ্রান্তি বা প্রপাগান্ডা তৈরী যে অপ-সাংবাদিকতা; তা কিন্তু সাধারণ মানুষও বোঝে। যে কারণে গণআস্থা হারাচ্ছে বাজারী সংবাদমাধ্যমগুলো, সর্বোপরী পুরো সাংবাদিক সমাজ। এ সংকট বা সমস্যাটি কিন্তু বৈশ্বিক। যার মূলে রয়েছে জার্নালিজম আর ক্যাপিটালিজম’র সাংঘর্ষিক সহাবস্থান। এই দুটি ইজম ক্রমাগত পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যদিও মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে পুঁজিদাসের সংখ্যাই বেশী, তাই সে’ই পেরে ওঠে। তার সাথে আপোস করে সাংবাদিকতাকে কতটা শুদ্ধ বা বস্তুনিষ্ঠ রাখার সুযোগ আছে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যেতেই পারে। আমিও খুঁজেছি, আর বুঝেছি - এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কারণ সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখতে আপোস নয়, যুদ্ধই করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের অসংখ্য সাংবাদিক শুদ্ধ সাংবাদিকতাচর্চা শক্তিশালী করার এ যুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন। কেউ মূলধারা বাজারী মিডিয়ায় থেকে, কেউ স্বাধীনভাবে। মুক্ত সাংবাদিকতাচর্চার প্রয়োজনীয়তাটা অন্তত টের পেয়েছেন অনেকে।

যারা নিবিড়ভাবে বিষয়গুলো খেয়াল করছেন তারা জানেন, আজ পুঁজি ও প্রযুক্তি সংবাদকে পণ্য করে তুলেছে পুরো মাত্রায়, আর বিপন্ন করে তুলেছে সাংবাদিকতা। এরই মধ্যে পুঁজিপুষ্ট মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় থেকেও অল্টারনেটিভ মিডিয়ায় পুঁজির ভিত কাঁপানো কথা বলা মানুষের সংখ্যা হাতেগোনার মতোই বলা যায়। এর ওপরে তৃপ্তির ওই ঘটনায় এ দেশীয় বাজার সাংবাদিতায় যে ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পরার কথা, তা’ও যে কেউ কেউ অতিক্রম করতে পারছেন – সেটাই আশার কথা। 

সাইফ ইবনে রফিক
***
২৫ এপ্রিল ২০১৪।
ইন্টার্নী ডাক্তার বনাম সাংবাদিকদের বাকযুদ্ধ তখন তুমুলে। ফেসবুকে এ ইস্যুতে বেশ গণমাধ্যমকর্মিদের পক্ষেই সোচ্চার ছিলেন কবি ও সাংবাদিক সাইফ ইবনে রফিক। হটাৎ তিনি স্ট্যাটাস দিলেন- “হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধকে আমি স্বাগত জানাই। রানা প্লাজায় উদ্ধারকর্মীরা একটা ফুটো করার আগেই যদি কেউ টেলিভিশনের বুম ঢুকিয়ে দিয়ে আটকাপড়াদের জিজ্ঞাসা করে থাকে, আপনার অনুভূতি কি? তাদের জন্য পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমি লজ্জ্বিত। যে কোনো দুর্ঘটনা মোকাবেলার আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড হইলো প্রথমে একটা হলুদ টেপে ‘ডোন্ট ক্রস দ্যা লাইন’ দিয়ে জায়গাটা ঘিরে ফেলা। ব্যবস্থাপনার এই ব্যর্থতার সুযোগেই প্রতিযোগী মিডিয়ার ক্যামেরা ঘটনাস্থলের ভিতরে ঢুকে পড়ে। একই প্রতিযোগী মানসিকতার জন্যই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় সাংবাদিকরা নিজের অজান্তেই বিদ্রোহের মুখপাত্র হয়ে যান। আর হাসপাতালে সাংবাদিক কেন, ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া’তো রোগীর কোনো অ্যাটেডেন্টেরও ঢোকার কথা না। আবারও সেই ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা প্রসঙ্গ। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দুর্বলতার সুযোগে সেখানে সাংবাদিকরা ঢুকছে। জনগণের পক্ষে প্রশ্ন করার সুযোগে ঢুকছে অপসাংবাদিকতাও। তবে সাংবাদিক না ঢোকার সুযোগে হাসপাতালের ডাক্তাররা যেন প্রশ্নের ঊর্ধে না উঠে যান, এ বিষয়টাও নজরে আনা উচিত। সিসিটিভি বসানো শুরু করে যে যে উপায়ে নজরদারি বাড়ানো যায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সেই দিকেও নজর দেয়া উচিত। আশা করি ডাক্তার বন্ধুরা এতে মাইন্ড করবেন না। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স না থাকলে প্রফেশনালিজমের বিকাশ হয় না।”

১৫ মে ২০১৪।
সাংবাদিক ফাতেমা আবেদিন নাজলার ফেসবুক স্ট্যাটাস- ‘মিডিয়া হাউস হচ্ছে ছোটোলোকদের জায়গা। এইটা আজকে বুঝলাম। এখানে নিজের অবস্থান নিয়ে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা ও টাকা থাকলেই কেনা যায় মানসিকতার লোকদের সুচিকিৎসা হওয়া দরকার।’

২০ মে ২০১৪।
আরেক কবি ও সাংবাদিক আমিন আল রশীদের ফেসবুক স্ট্যাটাস, ‘টেলিভিশন মানুষকে দ্রুত তারকা বানায়, কিন্তু সাংবাদিক বানায় খুব কম জনকেই।’ তাকে সহমত জানিয়ে আরেক সাংবাদিক মন্তব্য করেন ‘প্রিন্টমিডিয়ার অনেক বড় ভাই টিভিতে ঢুকে হারিয়ে গেলেন। খুব মিস করি এমন অনেকের লেখা।’

ওপরের স্ট্যাটাসগুলোয় আত্ম-সমালোচনার যে সুর টের পাওয়া যায় তা দেশের বাজার সাংবাদিকতায় বিরল। এর মধ্যে প্রথম স্ট্যাটাসটি অবশ্য তৃপ্তি ট্রাজেডিরও আগের।

***
মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী
২৬ মে ২০১৪। 
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী এক স্ট্যাটাসে বলেন, আমাদের মেনস্ট্রিম মিডিয়াগুলার সত্য গোপনীকরণ / মিথ্যাচার / ধান্দা ফিকির দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। মেইন সুইচে হাত দিতে পারলে আপনি উনাদের দিয়ে যে কোন কিছু লিখিয়ে নিতে পারবেন। সেটা এমনকি দেশের জন্য আত্মঘাতী হলেও। এদের উপর ভর করেই দুষ্ট লোকেরা এবং বড় বড় ইমপেরিআলিস্টরা তাদের দরকার মতো জনমত বানায়। এইসব নিয়ে চমস্কি সহ মহান কুতুবেরা বিস্তর লিখেছেন। আমি আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি বিকল্প সাংবাদিকতার দিকে। ফেসবুক, ব্লগ সহ যতো রকম মাধ্যম আছে এইসব কাজে লাগিয়ে আমরা যদি আমাদের নাগরিক সাংবাদিকতার মান বাড়াতে পারি তাহলে রক্ষা। কেবল "আওয়ামী-বিএনপি পারস্পরিক নিধন প্রকল্প" হিসাবে এর ব্যবহার সীমিত রাখলে আমরা কেবল "থাকিবো বাঙালি হয়ে, মানুষ হইবো না।"

ভারতীয় ছবি আমদানি, কর কাঠামো, রিলিজ পদ্ধতি, দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাব কি, কিভাবে পরিবেশন আর প্রদর্শন নেটওয়ার্ক-ও একসময় হাতছাড়া হবে, সাফটা চুক্তি বা যৌথ প্রযোজনাকে কিভাবে হাতিয়ার বানানো হচ্ছে, কিভাবে করলে সত্যিকারের ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা সম্ভব, ভারতে আমাদের ছবি চালানো আদৌ যাচ্ছে কিনা, বাংলাদেশে বিদেশী ছবি কত পার্সেন্ট স্ক্রিনিং করা যায়, এটা মনিটরিং করবে কে- এই সব বিষয়ে “ফেসবুকেই” বিস্তারিত লেখার কথাও জানান জনপ্রিয় এই নির্মাতা।
***
ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইটগুলো। আর এগুলোর ওপর সাওয়ার হয়েই দিন দিন বড় হচ্ছে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। এরই সুবাদে তৈরী হয়েছে নানা শঙ্কা ও সম্ভাবনা। খেয়াল করলেই দেখবেন, প্রায় সবগুলো সামাজিক যোগাযোগ সাইট এমন একটি ‘অপসন’ বা সুবিধা রাখে, যার মাধ্যমে তার গ্রাহক বা ব্যবহারকারী নিজের মানুসিক অবস্খা, ভাবনা থেকে শুরু করে প্রিয়-অপ্রিয় যে কোনো ছবি, ভিডিও এবং সংযোগ সকলের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। যেমন - ফেসবুকের ‘স্ট্যাটাস’ বা টুইটারের ‘টুইট’।  এ জাতীয় ব্যাক্তিগত সাইবার প্রকাশনাও ক্রমে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এরই সাথে ব্লগ’তো আছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষ তার তথ্য, অভিমত বা বক্তব্য এক বা একাধিক কমিউনিটির সামনে উপস্থাপনের সুযোগ পাচ্ছেন। গুরুত্বানুসারে তা ছড়িয়ে পরছে কমিউনিটি থেকে কমিউনিটিতে। বর্তমানে শুধু স্ট্যাটাস বা টুইটও বড় বড় ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আমাদের দেশের গণজাগরন মঞ্চ বা তারও আগের আরব বসন্তের কথা এত দ্রুত কেউ ভুলে যাননি নিশ্চয়ই।

কার কোন ছকে এসব চলছে তা না বুঝলেও এটুকু অন্তত অনেকে বুঝতে পারছেন যে কেউ আড়ালে থেকেই অনেক কিছুই করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু কেন নিচ্ছেন বা কি নিচ্ছেন তা’ও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, বা বুঝতে দেয়া হচ্ছে না। হয়ত বোঝার ক্ষমতাই নেই আমাদের। বড় জোর একটু ঘাঁটাঘাঁটি আর আন্দাজ করতে পারবো। আসলে বৃহৎ সামাজিক সাইটগুলোর নেপথ্যের পুঁজিপতিরা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার নিয়ন্ত্রকদের চেয়েও চতুর। তাদের বদৌলতে তামাম পুঁজিবাদী গোষ্ঠীই এখন ধারণা করতে পারেন- এ বাজার সভ্যতায় পুঁজিহীন এক স্বাধীন সচেতন মানুষের দৌঁড় সর্বোচ্চ কতটা দূরত্ব টপকাতে পারে। কিংবা একজন মানুষকে স্বাধীন রেখেও তাকে, তার ভাবনাকে কি করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। হয়ত এসবেরই নিরীক্ষা চলছে, চলুক। তবুও এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়েই আশাবাদী হই মুক্ত সাংবাদিকতাচর্চা বিকাশের সম্ভাবনার কথা ভেবে। স্বপ্ন দেখি সত্য ও শুদ্ধতা বিকাশের। কারণ বোধের পরিপক্কতা নয়া পথ পয়দা করে নিতে জানে। যে পথ জন্ম দেয় অনেক নতুন গনিত । যদিও সব সূত্রই অতীতেই গাঁথা থাকে।

***
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক পঁয়ত্রিশ বছর ধরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’র সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন। নিজ বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ রুমানকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি সাংবাদিকতার সাথে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলেছেন।

জাহিদ রুমান :
বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সাংবাদিকতা প্রবর্তিত হয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতে। রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে গণমাধ্যম ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরে রাজনৈতিক সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে কথা বলা হয়েছে। এখন চলছে কর্পোরেট মালিকানার যুগ। ‘কর্পোরেট মালিকানা’র সঙ্গে ‘বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা’র যে দ্বন্দ্ব তার ফলাফল কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আরেফিন সিদ্দিক :
কর্পোরেট মালিকানার বিষয়টি এখন সময়ের সাথে সাথে বিস্তৃতি লাভ করছে। গণমাধ্যমে বিনিয়োগ এখন একটি বড় ধরনের বিনিয়োগের পর্যায়ে চলে গেছে। বড় বিনিয়োগের কারণেই কর্পোরেট মালিকানার বিষয়টি এসেছে। এটি একটি যৌক্তিক প্রশ্ন যে, কর্পোরেট মালিকানার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ সাংবদিকতার যে দ্বন্দ্ব কীভাবে তার নিরসন করা যায়। এটা খুবই স্বাভাবিক, একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করবে। কিন্তু আমি মনে করি কর্পোরেট মালিকানায় থাকা সত্ত্বেও গণমাধ্যমের একটি গ্রহণযোগ্য বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা যায়। যদি কর্পোরেট কর্তৃপক্ষ যদি অন্ততপক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেন যে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্র সেখানে সম্পাদক, সাংবাদিকরা কাজ করবেন তাদের ওপর আর কোনো কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ আনা যাবে না। যেমন আমি সবসময় বলব সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে আনা ঠিক না। বস্তুনিষ্ঠতা ও সাংবাদিকতার বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন। প্রতিদিন একটি পত্রিকা এবং তার সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠতার পরীক্ষা দিতে হয়ে এবং এই পরীক্ষায় তাদের পাশ করে আসতে হয়।

***
সম্পদ পাহারা বা স্বার্থ রক্ষায় সাংবাদিক পোষার প্রবণতা বিকশিত হওয়ার পর থেকে গণমাধ্যমের সংখ্যা ও প্রযুক্তিগত মান ক্রমাগত বাড়ছে। পুঁজিবাদী গণমাধ্যমগুলোর সুবাদে সাংবাদিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নও হচ্ছে বেশ। তবে সাংবাদিকতার মান ক্রমাগত কমছে। কমছে গণমানুষের আস্থাও। গণমাধ্যমগুলো মূলত পুঁজিবাদী প্রচারযন্ত্রের মতোই কাজ করছে। পুঁজিবাদ বা বাজারের হাত থেকে সাংবাদিকতাকে রক্ষায় মুক্ত সাংবাদিকতাচর্চা শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি আর গঠনমূলক আলাপেরও সময় এসে গেছে। ‘খাঁটি’ শিক্ষিত সাংবাদিকরা, মানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টার্স-পিএইচডিধারীরা এ ব্যাপারে আরো সোচ্চার হবেন আশাকরি। তারাও যখন এর স্বপক্ষে কলম ধরবেন, কথা বলবেন; তখন মুক্ত বুদ্ধিচর্চায়ও নবমাত্রা যুক্ত হবে নিশ্চয়ই।
‘অনেকেই বলছেন এখন তথ্য ব্যবসার যুগ। সাংবাদিকতা ম্রিয়মান। বিষয়টা সাংবাদিকদের অনেকেই বুঝতে পারলেও তারা কিছুই করতে পারছেন না। নতুন পত্রিকা বেরুচ্ছে, নতুন টিভি কেন্দ্র চালু হচ্ছে - সাংবাদিকতার মানসে নয়, শুধু মুনাফার লক্ষ্যে। মুনাফা আর্থিক এবং ব্যবসায়িক ও প্রভাব বিস্তার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ব্যবসায়িক সুবিধা গ্রহণ বা নিজের সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করা এখন মিডিয়া মালিকের প্রধান উদ্দেশ্য। এটাকে তাই বলা হচ্ছে তথ্য ব্যবসা। এতে পাঠকও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।’ লেখক ও সাংবাদিক চিন্ময় মুৎসুদ্দীরের ‘তথ্য ব্যবসা কতটা সাংবাদিকতা’ প্রবন্ধে উঠে এসেছে এই কথাগুলো।
চিন্ময় মুৎসুদ্দী
ওই প্রবন্ধে আরো বলা হয়েছে, ‘সাংবাদিকতা ও তথ্য ব্যবসার একটি সরল সোজা পার্থক্য হল: তথ্য ব্যবসায় তেমন দায়িত্ব নেই, কিন্তু সাংবাদিকতায় দায়িত্ব রয়েছে। অর্থাৎ সাংবাদিকতায় অবজেক্টিভিটি থাকবে, তথ্য ব্যবসায় যা অপরিহার্য নয়। এভাবেও বলা যায় যে-খবর মানুষ বেশি পড়বে বলে মনে হয় তা প্রকাশ করাই তথ্য ব্যবসা। আর খবর প্রকাশের পর এর কী প্রভাব সমাজের ওপর পড়বে সেটি ভেবে সংবাদ প্রকাশ করা হল সাংবাদিকতা। যৌন লাঞ্ছনার শিকার কোনো নারীর নাম প্রকাশ না করে সংবাদ প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতি। তথ্য ব্যবসায়ীরা এই নীতিমালার ধার ধারেন না। তথ্য ব্যবসা মূখ্য উদ্দেশ্য হলে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়। এখন হচ্ছেও তাই। এক পত্রিকা বা এক চ্যানেলের খবরে পাঠক-দর্শক নিশ্চিন্ত হন না, কয়েকটি মিডিয়ার খবর মিলিয়ে দেখতে চান।’

চিন্ময় মুৎসুদ্দীর লিখেছেন, ‘একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে টেকনলজি ও পুঁজির ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে । সামাজিক দায়িত্বের প্রসঙ্গটি ক্রমশ: চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতার ভাষা হয়ে উঠছে সাংবাদিকের রিপোর্টের ভাষা। এই প্রক্রিয়ায় প্রতারিত হচ্ছেন পাঠক-দর্শকরা। স্পনসরের যাঁতাকলে সংবাদ হয়ে উঠছে পুঁজি যোগানদাতার নানান কার্যক্রমের বিবরণ। হাউজিং, প্রসাধনসহ কনজিউমার প্রডাক্টস, এবং রাজনীতি জনস্বার্থের বিপক্ষেই বেশি উপস্থাপন করা হচ্ছে মিডিয়ায় । এই প্রক্রিয়াটাই মূলত তথ্য ব্যবসা, সাংবাদিকতা নয়। সে কারণেই মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা আজ কাঠগড়ায়। তবে এখনো একটি ধারা ওয়াচডগ’র ভূমিকা ধরে রেখেছে। একারণেই এখনও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, রাজনৈতিক প্রতারণা, ব্যাঙ্ক লুট ইত্যাদি মিডিয়ায় খবর হয়ে আসছে। কিন্তু ধারাটি ক্রমশ: দুর্বল হয়ে পড়ছে। শংকা এজন্যই। যারা এখনো কেবল তথ্য ব্যবসার জোয়ারে পুরোটা ভেসে যাননি, তাদের টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করছে সাংবাদিকতার মর্যাদা, সামাজিক দায়িত্ব পালনের অগ্রাধিকার।’

***
বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত আরেক প্রবন্ধে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে বিভিন্ন সময়ে কিভাবে গণবিরোধী কাজে কিংবা আইনের শাসনবিরোধী কাজে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা ইতিহাস থেকে শিখি না, শিখতে চাই না।’ খালিদীর মতে, এটা এক ক্রান্তিকাল। দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে প্রচার মাধ্যম। প্রযুক্তি পাল্টে দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার চেহারা। মেলানো হচ্ছে রাজনীতির পুরোনো কিছু হিসেব-নিকেশ। সম্পাদকীয় ব্যবস্থাপনায়, সর্বোপরি গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনায়, দায়িত্বশীল আচরণ যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন বোধহয় এখন। জাতিবৈরিতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও মানহানিকর বক্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে সতর্ক থাকবার প্রয়োজনটা শুধু আইনি নয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী
বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যার চেয়ে দেশের সবগুলো কাগজের প্রচারসংখ্যা বেশি নয়। বিভিন্ন জরিপের ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংবাদ, চলতি ঘটনার অনুষ্ঠান কিংবা জনমত পাল্টে দেবার মত অনুষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত দর্শকসংখ্যা, এই মুহূর্তেই বাংলাদেশের ইন্টারনেট জনসংখ্যার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সীমার কাছে কিছুই নয়। এমনটা জানিয়ে খালিদী আরো বলেছেন, ফিরে আসি নাগরিক সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশকে বলা হয়, সাংবাদিকতার স্বর্গরাজ্য। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার। দুর্নীতি আর বিভিন্ন রকম দুর্বৃত্তায়নের এ দেশে চারিদিকেই শুধু খবরযোগ্য ঘটনা। নাগরিক সাংবাদিকরা এ সুযোগটা নেবে না কেনো? তবে সুযোগ গ্রহণের পাশাপাশি দায়িত্ববানও হতে হবে তাদের। না হলে গণমাধ্যমের প্রতি আস্থাহীনতার সংকট আরো প্রকট হতে পারে।

***
০৬ জুন ২০১৪।
ফেসবুক ও ব্লগের সুবাদেই চোখে পরে আরেকটি সংবাদ। শিরোনাম -‘৪০ সংবাদকর্মীকে ছাঁটাই করলেন অভিনেত্রী জয়া’ । পুরো ঘটনাটি পড়ার পর মেজাজটাই বিগড়ে গেলো। জয়ার প্রতি করুণা হলো খানিকটা। প্রথম জীবনে তিনি সাংবাদিকই ছিলেন। এরপর টিভি অভিনেত্রী থেকে ফিল্ম স্টার। শুনেছি ইদানীং নাকি তিনি তরুণ নির্মাতাদের ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজও শেখান। সে বিষয়টি অবশ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক। অন্য মেকানিজমের ব্যাপার। তবে সংবাদকর্মিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন একটি প্রতিবেদন বাজারী সাংবাদিকতার পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতার নমুনা হয়ে ঝুলছে দেখে আঁতকে উঠলাম। মানে ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এটিএন টাইমস ডটকম’র পরিচালনা পর্ষদে সৈয়দ রুহুল হক, সৈয়দ সামিউল হক আর চন্দন সিনহাও রয়েছেন। কিন্তু সর্বত্র শিরোনাম হলেন শুধু জয়া আহসান।


আরো কতটা পরিপক্ক হলে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো এ প্রবণতাটুকু অন্তত এড়াতে পারবে জানি না। বিশেষত অনলাইন পত্রিকা বা পোর্টালগুলো তাদের ‘হিট’ বাড়ানোর জন্য যে ধরণের সংবাদ প্রচার করছে তা অনলাইন সাংবাদিকতাকে চটি সাংবাদিকতার মত একটি উপমা উপহার দিয়েছে। এ জাতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের একদিনের সর্বশেষ সংবাদগুলোর শিরোনামগুলো তুলে ধরছি -

* থানায় আটকে রেখে কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ
* বেড়াতে এসে হোটেলরুমে নববধূ গণধর্ষণের শিকার
* ২ মেয়েকে ভারতের পতিতালয়ে বিক্রি করেছে মা !
* ফেসবুকে গৃহবধূর অশ্লীল ছবি পোষ্ট, প্রযুক্তি আইনে মামলা
* শারীরিক সম্পর্ক ও প্রেমের বলি!
* ইলেকট্রনিক মিটার ক্রয়ে লুটপাট ডেসকোর দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র
* বিয়ের ২৪ ঘণ্টা পর স্ত্রীকে যৌনপল্লিতে বিক্রি!
* বরগুনায় আরেক পরিমল-পান্না মাস্টারের উত্থান !
* পুত্রবধূকে পর পর দুই রাত ধর্ষণ!
* বৃদ্ধের লালসার শিকার ৩য় শ্রেণীর ছাত্রী গর্ভবতী!

তারিখ : ৬ অক্টোবর ২০১৩
নৈতিকতা কোথায় গিয়ে ঠেকলে সাংবাদিকরা এ জাতীয় সংবাদ অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকে তা কি ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন আছে? শুধু স্ক্রীনসটটি রেখে যাচ্ছি - নমুনা হিসাবে।

***
এমন না যে প্রতিষ্ঠিত টিভি বা পত্রিকাগুলো সুড়সুড়ি দেয়া চটকদার সংবাদ পরিবেশন করে না।  সাম্প্রতিক উদাহরণের জন্য যমুনা টিভির অনুষ্ঠান ‘ইনভেস্টিগেশন ৩৬০ ডিগ্রি’-ই সামনে রয়েছে। সমাজজীবনের নানা ধরনের অন্যায়, কুশাসন, কুপথের নানান কুকীর্তি অনুসন্ধান রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরার এই অনুষ্ঠানটি প্রতি শুক্রবার রাত নয়টা ২০ মিনিটে যমুনা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। সিনিয়র সাংবাদিক সুপন রায়ের উপস্থাপনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানটিতে প্রচারিত বিভিন্ন আলোচিত ইস্যুর মধ্যে অন্যতম ছিলো ‘লাইট, ক্যামেরা, এ্যাকশন’ শিরোনামের একটি পর্ব।



বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বা ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি) কেন্দ্রীক প্রতারণাসহ নানা অপরাধ অনুসন্ধানী ওই পর্বে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় নায়িকা হতে গিয়ে সর্বস্ব হারানোর গল্প। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি ইউটিউবে চ্যানেল থেকে "নায়িকা হতে গিয়ে হারাতে হয় সর্বস্ব" শিরোনামেই এটি প্রকাশ করা হয়।

ওগুলো দেখার পর একবার মনে হয়েছিলো দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার দিন বোধহয় একেবারেই শেষ। নইলে সুপন রায়ের মত একজন সিনিয়র সাংবাদিকের মনিটরিংয়েও এমন চটকদার সংবাদ বের হয়! এই রিপোর্টটি দেখার পর প্রিয় ওই সাংবাদিকের কাছে খুব জিজ্ঞাসা ইচ্ছে হয়েছিলো – আপনাকেও কি সর্বস্ব খোয়াতে হয়নি? যমুনার প্রত্যেক সাংবাদিকের সবটুকু সময় ও চিন্তাই কি কিনে নেয়নি নুরুল ইসলাম বাবুল। প্রতিনিয়ত কি সে তার ‘সম্বাদিকদের’ সর্বস্ব লোটে না? এ নিয়ে কোথায় প্রতিবেদন প্রকাশ করবে কে?

যত দূর জানি, পুঁজি সেই আদি থেকেই পুরুষতান্ত্রিক। বরাবরই সে নারীকে পণ্য করে তোলার জন্য সক্রিয় থেকেছে। তাই আজকের পুঁজিবাদী গণমাধ্যমগুলোর চরিত্র কেমন হতে পারে, তা’ও সহজেই অনুমেয়। সাংবাদিকতার ওপর থেকে পুরুষতান্ত্রিকতার আছড় ছাড়াতেও মুক্ত সাংবাদিকতার বিকল্প নেই।

***
প্রবাসী লেখক ও গবেষক কূলদা রায় তার এক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন – ‘সাংবাদিক কোনো না কোনোভাবে পাঠককে মনোরঞ্জন করতে চায়। পাঠককে ধরে রাখতে চায়। সাংবাদিকরা সব সময়ই মানুষকে আঘাত দিতে চায়। যা ঘটেছে তাকে এমনভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে যে তাতে মানুষের বিবেচনাবোধ লোপ পায়। কখনো কখনো বিষাদ-রোগে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চায় তার পাঠককে। সত্যিকে মিথ্যে করে তুলতে পারে। মানুষের মনে লোভ, মোহ, রাগ, দ্বেষ, ঈর্ষা, হিংসা ঢুকিয়ে দেয়। সাংবাদিক মাত্রেই কমিটেড। কমিটেড তার উদ্দেশ্যপ্রবণ বিশ্বাসের কাছে-- অর্থ-কাম-নাম-লোভ-মোহের কাছে। সাংবাদিকতা এক ধরনের কেরানিগিরিই। তিনি তার অফিসের জন্য লেখেন । সাহিত্য তাড়াহুড়া করে লেখা হয় না। উল্লেখ করে দাদা অবশ্য আরো লিখেছেন, সাহিত্যিক কখনো পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য লেখেন না। নিজের জন্য লেখেন। নিজের দেখাটাই লেখেন। নিজের লেখাটাই লেখেন। এক্ষেত্রে তিনি নির্লোভ। উদ্দেশ্যহীন। পক্ষপাতহীন। কমিটমেন্টবিহীন। সাহিত্যিকের কোনো বিশ্বাস থাকে না। থাকে অবিশ্বাস।

দাদার লেখাটি পড়ার পরে বলেছিলাম, সাংবাদিকতায় মনোরঞ্জনের কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ নেই বিবেচনাবোধ লোপ বা বিষাদ-রোগে আচ্ছন্ন করার। সত্যিকে মিথ্যে করা, মানুষের মনে লোভ, মোহ, রাগ, দ্বেষ, ঈর্ষা, হিংসা ঢুকিয়ে দেয়া - এর কোনোটাই সাংবাদিকের কাজ নয়। তবে এ চর্চাই যে চলছে, তা’ও ঠিক। এর মূলে রয়েছে সেই বাজার। যার প্রভাবে মেইনস্ট্রিমের সাংবাদিকরা আজ আর জার্নালিজম নয়, ক্যাপিটালিজম চর্চায়ই বেশী অভ্যস্ত। সারা বিশ্বে একই অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে জার্নালিজমকে ক্যাপিটালিজমের হাত থেকে বাঁচাতে মুক্ত সাংবাদিকতাচর্চার কোনো বিকল্প নেই। আর এ জন্য দর্শক বা পাঠকের চেয়েও নিজের সাথে কমিডেট হওয়াটাই বেশী জরুরী। ভুল বললাম কিনা তা’ও জানতে চেয়েছিলাম। আর একটা কথা অবশ্য সেদিন বলা হয়নি, কিন্তু মনে মনে বলতে চেয়েছিলাম। আসলে আমার মনে হয়েছে, অনেক সাহিত্যিক তার অজ্ঞাতেই মুক্ত সাংবাদিকতারচর্চা করে গেছেন। জ্ঞাতসারেও করেছেন অনেকে। ফিল্মকেও মুক্ত সাংবাদিকতার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের নজির রয়েছে।

***
‘জ্বী-হুজুর বিদ্যা ও তেল তত্ত্ব আয়ত্ব হয়নি আজও, পারিনি হতে দক্ষ কৌশলী চাকর। তাই মনিবদের আস্থার অভাবজনিত অবমূল্যায়নে পেরিয়েছে দশক এবং রয়ে গেছি নবীশ। হয়ত হতাশা দিয়েছে শীষ, তবে এটুকু বুঝেছি- মনিব বা চাকরগিরি সবার জন্য নয়; কেউ কেউ মানুষও হয়। যারা কোনো কৌশল বা বিদ্যা চোদে না, মনের হুঁষেই চলে।’ – লেখাটি ২০১২ সালের মে মাসের, মানে প্রায় দু’বছর আগের। এটিও মূলত একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস। বাজার সাংবাদিকতা ছাড়ার আগ মুহুর্তের এই ভাবনা ‘মনের হুঁষ’ শিরোনামে সংকলিত হয়েছিলো ব্লগে। আসলে সাংবাদিকতা কখনোই আমার পেশা ছিলো না, ছিলো নেশা। এর প্রতি দায়বদ্ধতাই আমায় কথিত মূলধারা থেকে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন করেছে। বেছে নিতে হয়েছে আরো কাঠখোট্টা, ধোঁয়াটে এবং অমীমাংসিত পথ। কারণ, জেনেছি পিছু ছাড়বে না পুরানো ‘স্ব-শিক্ষিত অস্থিরতা’ – সাংবাদিকতা। সময়ের আলোড়নে সংবাদ পাগল মন - আজীবনই তৎপর হবে জানতে, জানাতে। তবে সংবাদ-চিন্তাকে কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রন করতে পারবে না আর। ক্ষিপ্রতার বাঁধও ভেঙে গেছে তাই। অবশেষে স্বাধীন সাংবাদিকের অস্থিরতা অবলীলায় পৌঁছায় কোন মাত্রায় - তার খোঁজ রাখে শুধু অধ্রুব দুরন্ত হাওয়া।

***
ইতিহাসও আমায় আশাবাদী হতে সহায়তা করে। জানেন তো, ভারতের বিখ্যাত ইংরেজী দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা প্রথম বেরিয়েছিল একটি বাংলা সাপ্তাহিক হিসেবে, ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী; বাংলাদেশের যশোর জেলার পলুয়া-মাগুরা গ্রাম থেকে। এটি ছাপা হত কাঠের টাইপের একটি প্রেসে, কলকাতা থেকে ৩২ টাকা দিয়ে যা কিনে আনা হয়েছিল। পত্রিকার জন্য কাগজও তৈরি হত যশোরের ওই গ্রামেই। সে-সময় সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ কখনো কখনো নিজ হাতে পত্রিকা কম্পোজ ও ছাপার কাজ করতেন। ব্রিটিশ-ভারতে সম্পাদক হিসেবে শিশিরকুমার ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি (রাজনীতি, সঙ্গীতসহ নানা ক্ষেত্রে ছিল যাঁর অবাধ বিচরণ) তাঁর স্বাধীনচেতা স্বভাব ও প্রখর আত্মমর্যাদাবোধের জন্য বারবার ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন। কিন্তু তিনি কখনো নতি স্বীকার করেন নি। বরং সরকারকেই বহুবার তাঁর কাছে হার মানতে হয়েছে। ‘সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ’ কথাটার সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু শিশিরকুমার তাঁর পত্রিকাকে তুলনা করতেন ক্যামেরার সঙ্গে। তিনি লিখেছিলেন, ‘এই ক্যামেরার ছবিতে যদি অন্যায়, অবিচার ও বঞ্চনার বাস্তব ছবি ফুটে ওঠে তাহলে আমি নাচার।’ সমকালে শিশিরকুমার ঘোষের মতো ও-রকম দেশজোড়া খ্যাতি বা পরিচিতি না পেলেও, তাঁরই মতো বহুমুখী প্রতিভা ও কীর্তির অধিকারী আরেকজন নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার। ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে যিনি আজ সমধিক পরিচিত। অমৃতবাজার-এরও পাঁচ বছর আগে পূর্ব বাঙলারই আরেক মফস্বল অঞ্চল কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে তিনি বের করেছিলেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। আজীবন কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করেও (জীবিকার জন্য তাঁকে কখনো স্কুল শিক্ষকতা, কখনো মহাজনের গদিতে খাতা লেখা আবার কখনো নীলকুঠিতে চাকরি করতে হয়েছে), পত্রিকার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তিনি প্রাণান্ত করেছেন। পত্রিকাকে তলোয়ার করে জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এক হাতে লড়ে গেছেন।

***
০৩ মে ২০১৪।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস।
দিনটি শুরু হয়েছিলো সিনিয়র এক গণমাধ্যম কর্মির আত্মহত্যার খবর পেয়ে। এরপর থেকে কি কি জানি ভাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শোকাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক কেন যেন মোটেই কাজ করেনি। প্রয়াত বাবর ভাই, মানে বরিশালের সিনিয়র সাংবাদিক জি এম বাবর আলীর সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো বরিশালের সদর রোডের হাবিব ভবনে- তার অফিসে। মানে বন্ধ হয়ে যাওয়া আমার দেশ পত্রিকার স্থানীয় কার্যালয়ে। কবে- তা ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে তার স্বভাব সুলভ রসিকতা আর দিল খোলা হাসি। তার স্নেহও এ প্রান ছুঁয়েছিলো নিশ্চিত। নইলে কেনই বা আজও তার কথা মনে পড়লে কিছুই ভালো লাগে না।
আত্মহত্যার দু’দিন আগে ফেসবুকে নিজের এই পুরানো ছবিটি আপলোড করেছিলেন বাবর আলী
বাজার সাংবাদিকতার নোংরামিই কি কেড়ে নেয়নি তাকে? তার এই অপমৃত্যুর পর আমার দেশ’র এক সহকর্মি লিখেছিলেন, ‘অপমান, ক্ষোভ আর অর্থ ও পরিচয় সংকটের এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তিনি চলে গেলেন।’

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]