Powered By Blogger
সাংবাদিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সাংবাদিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১০ জানুয়ারী ২০২১

দীনেশ দাসকে মনে পড়ে

দেখতে দেখতে নয়টি বছর হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকার কাকরাইল মোড়ে বাস চাপায় নিহত হন সাংবাদিক দীনেশ দাস। ফেসবুকের ফিরে দেখা কর্মসূচীর কল্যাণে আজ ফের মনে এলো সেই সময়টা। যেখানে নিজের বৃত্তান্তে নিজের সম্পর্কে দাদা লিখে রেখেছিলেন, ‘আই অ্যাম রোমান্টিক পারসন।’ তাঁর মৃত্যুর চারদিন পর ‘নিশ্চিন্ত দীনেশদা’ শিরোনামে লিখেছিলাম -
হয়ত মৃত্যুই দীনেশদাকে নিশ্চিন্ত করেছে। তবে তিনি আদৌ তৃপ্ত হবেন কি? অর্থ সংকটে পরিবারের ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রীক যত উদ্বিগ্নতা তাকে মৃত্যুর পূর্ব-মুহুর্ত পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে; তা থেকে কি তিনি এভাবে মুক্ত হতে চেয়েছেন? এত শুভাকাঙ্খী, এত পরিচিত জন। কেউ কি তাকে একটি চাকরি দিতে পারতেন না? একজন সৎ সংবাদকর্মির ২৫ বছরের অভিজ্ঞতার কি কোনো মূল্যই ছিলো না? অথচ এখন তাঁর মৃত্যু কত মূল্যবান হয়ে গেল। সরকার দীনেশদার পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বৌদিকে একটি চাকরি দেয়ার পাশাপাশি তার মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্বও নিয়েছে। আবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমনকি জামায়াত নেতারাও টাকা দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ইতিমধ্যেই টাকা দিয়েছেন। অথচ শেষ কটা দিন কী অর্থ কষ্টেই না তাঁর কেটেছে। সদাহাস্যোজ্জল শিশুমনা মানুষটার মুখে হাসিও দেখিনি কত দিন। এখন হয়ত তিনি সবই দেখছেন। আর বৌদির কাছে গিয়ে বলছেন, 'বলেছিলাম না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অথৈর পড়াশুনা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।'
তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর দিনটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় লেখক ও সাংবাদিক মাহফুজ জুয়েল বলেছিলেন, “চোখে পড়ার মতো মেঠো-বিচরণ ছিলো দিনেশদার। একসময় যেখানেই যেতাম সেখানেই তাঁকে দেখতে পেতাম! মাঠে-ঘাটে দেখতে দেখতেই পরিচয়। তারপর টুকটাক গল্প হয় রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে, কর্মসূচিতে, পল্টনে, প্রেসক্লাবে, মুক্তাঙ্গনে, মুক্তিভবনে, বামপন্থীদের সংবাদসন্ধানী সাংবাদিক; শ্যামসুন্দর মায়াময় নিরীহ মুখের দিনেশদা। মনে পড়িয়ে মন খারাপ করে দিলে।আহা, দিনেশদা।” আরো দুই বছর পর কবি ও সাংবাদিক রুদ্রাক্ষ রহমান লিখেছিলেন, “দীনেশ আমার তুই-তুইবন্ধু ছিলো। আমরা অনেকটা সময় এই শহরে ভাতের জন্য হেঁটেছি। সাক্ষী আশিস সৈকত! এবং আমরা এতোটাই ব্যর্থমানুষ যে দীনেশের জন্য কিছুই করতে পারিনি! অতএব ওর কাছে ক্ষমা চাই, বার বার।”
পলিটিক্যাল রিপোর্টিং, মূলত ইসলামি ও বামদলগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল দাদার সাথে। তিনি ছাড়াও শ্রদ্ধেয় সেলিম জাহিদ,  ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ, রাশিদুল হাসান রাশেদ, বন্ধুপ্রতীম রাজীব আহমদ তখন ওই অঙ্গনের ডাকসাইটে প্রতিবেদক। দাদার সাথে আমার চেয়ে ঢের বেশী স্মৃতি আছে ওই তিনজনের। তবুও আজ এখানে ফের টুকে রাখছি নয় বছর আগের লেখাটির কিয়দাংশ। 

সত্যি কথা বলতে কি, দীনেশ'দা মারা যাওয়ার আগে নিজেও কখনো বুঝিনি যে তাকে কতটা ভালোবাসি। হয়ত আমার মত আরো অনেক সহকর্মিই তা বুঝতে পারেননি। গত বছরে (২০১১ সালে)বন্ধ হয়ে যাওয়া শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজে কাজ শুরুর সময়ে ‘পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার’ ছিলাম। আমাকে জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ বাম ও ইসলামী মিলিয়ে ৩৭টি দলের খবর রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরই বদৌলতে ওই সরল প্রাণ মানুষটির সাথে আমার পরিচয় হয়। জামায়াত-শিবিরের অফিস, মুক্তাঙ্গন, পল্টন, মুফতী আমিনীর ডেরা থেকে শুরু করে কমিউনিষ্ট পার্টির অফিস। কত জায়গায়ই না এক সাথে কত সময় কেটেছে। এরপরও ওই বিটে যতদিন ছিলাম তা ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে প্রথম দিনেই আপন করে নেয়ার গুনটি দাদার মাঝে বেশ ভালো মত ছিল। আর তাঁর রসিক চরিত্রের সচ্ছতায় মুগ্ধ না হওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক। যে কারণে ‘পার্লামেন্ট রিপোর্টিং’ শুরু করার পরও দাদার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি কখনো। ফেসবুকে খুব একটা সক্রিয় না হলেও তাঁর ইয়াহু মেইলটি প্রায় নিয়মিতই খোলা থাকত। মাঝেই মাঝেই ‘চ্যাটবক্সে’ হাজির হতেন দাদা। খুব বেশী সময়ের জন্য না হলেও বেশ জমজমাট আলাপ হতো। অবশ্য গত দেড়-দুই মাস ধরে সেখানও অনিয়মিত ছিলেন তিনি। হয়ত  দৈনিক আমাদের সময় থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর আর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগটাই পাননি। আসলে দীনেশ'দার বহুপুরানো সহকর্মী সালাম ফারুক ভাইয়ের একটি লেখা শেয়ার করার জন্য বসেছিলাম; কিন্তু নিজেই কত কিছু বলে ফেললাম। আর শুধু একটি কথাই বলি। এখন বুঝি, দাদাকে অনেক ভালোবাসি।

চাকরির টেনশনমুক্ত দীনেশদা’ শিরোনামে একটি অনলাইনে লিখেছিলেন ফারুক ভাই; যা হুবুহু তুলে দিচ্ছি -
মৃত্যুর মাত্র ১৪ ঘণ্টা আগে শনিবার রাত সাতটায় ঘনিষ্ঠজন, কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার আজিজুল পারভেজকে বলেছিলেন, 'পকেটে মাত্র ২০ টাকা আছে।' রোববার সকালে মাটির ব্যাংক ভেঙে জমানো টাকা থেকে ১০০ টাকা হাতে দিয়েছিলেন স্ত্রী। জানা গেছে তিন মাসের বাড়িভাড়াও বাকি। ২৫ বছরের সাংবাদিকতার জীবনের এই পর্যায়ে এসে এমন হালেই দিন কাটছিল তাঁর। তিনি দৈনিক আমাদের সময় থেকে 'অন্যায়ভাবে' সদ্য চাকরিচ্যুত হওয়া দীনেশ দাশ, আমার দীনেশদা। এখন আর তার সেই টাকার চিন্তা নেই, নেই বাড়িভাড়ার টেনশন, জমানো টাকা থেকে তাকে দিনের খরচ দিতে হবে না বৌদির। সাংবাদিকতা করে অর্জন করা একমাত্র সম্বল মোটরসাইকেলটি নিয়ে তাকে আর ঘুরতে হবে না কাজের খোঁজে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) গত নির্বাচনের আগের রাতে তার মোটারসাইকেলে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'দাদা, পাওনা টাকাগুলো আমাদের সময় পে (পরিশোধ) করেছে কি-না।' জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'না, টাকা-পয়সা তো কিছু দিলো না। তবে আমাদের সময় থেকে লোন নিয়ে হলেও এ মোটরসাইকেলটাই এখন আমার একমাত্র সম্বল।' সেই একমাত্র সম্বলটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। রোববার সকালে একমাত্র মেয়ে অথৈকে ভিকারুননিসা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ডিআরইউ’র দিকে যাওয়ার পথেই বাসের চাপায় নিভে গেল তার প্রাণপ্রদীপ। তার আর যাওয়া হলো না প্রিয় প্রাঙ্গণটিতে।

গত বছর আমি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর থেকে অমর একুশে বইমেলা কাভার করেছিলাম। দাদার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কালের কণ্ঠের আজিজুল পারভেজ ভাই, সমকালের মুন্না ভাই আর আমি ছিলাম নিয়মিত। তাই কখনো আসতে দেরি হলে দাদা ফোন করে বলে দিতেন, তার জন্যও যেন বইয়ের কাভার, বই ইত্যাদি কালেক্ট করে নিই। আমরা তা করতাম। মাঝেমধ্যে দাদার মোটারসাইকেলে চড়ে ফিরতাম অফিসে। আর মাত্র ২৩ দিন পরই শুরু হবে এবারের বইমেলা। দাদাকে ছাড়া বইমেলা- এখনই বিশ্বাস হতে চাইছে না। আমাদের সময়ে দীর্ঘ সময় কাজ করার সুবাদে দীনেশদা’র সান্নিধ্য পেয়েছিলাম খুব ভালোভাবেই।

শুরুতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে খানিকটা দুর্বল দাদাকে প্রায়ই সাহায্য করতে হতো আমার। ক’দিন আগেও ফেসবুকে দাদার আইডি নিয়ে একটি জটিলতার সমাধান করে দিয়েছিলাম। দাদার স্নেহমিশ্রিত আবদারে কখনোই বিরক্ত হতাম না। ঠাট্টা-মশকরা করতে করতেই তার কাজটুকু করে দিতাম। ডিআরইউ’র মিডিয়া সেন্টারে বসে দাদার সেইসব আবদার আর পূরণ করতে হবে না। বয়সে ১০/১২ বছরের বড় হতে পারেন। কিন্তু কথাবার্তা, আচার-আচরণ কোনো দিক থেকেই সেই পার্থক্য বুঝতে দিতেন না দীনেশদা। নানান ঢঙের টিটকারি, দুষ্টুমি সবই চলত তার সঙ্গে। যেন বাল্যকালের বন্ধু।

জ্ঞানপিপাসু দীনেশ দাশের সংগ্রহে ছিল দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দলিলের অনুলিপি। সামান্য বেতনে চাকরি করেও খুঁজে খুঁজে এসব যোগাড় করতেন তিনি। অনুকরণীয় চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের স্মৃতি ধরে রাখতে তিনি গঠন করেছিলেন মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ। প্রতি বছর এ সংসদ থেকে সেরা রিপোর্টার বাছাই করে পুরস্কৃত করা হতো। সর্বশেষ আয়োজনটি ছিল গত ২৯ ডিসেম্বর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতেন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সংবাদ সংগ্রহে। নিজ ধর্মের প্রতি প্রবল ঝোঁকও অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটিকে দায়িত্ব থেকে টলাতে পারেনি। ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাই তার হয়ে উঠেছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আর তাই অনেকেই মজা করে তার নাম উচ্চারণের সময় আগে ‘মাওলানা’ শব্দটি জুড়ে দিতেন।

আমি আমাদের সময় ছেড়েছি বছর তিনেক আগে। কিন্তু গুটি কয়েক সমবয়সী সহকর্মীর মতো দীনেশদা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বিলীন হয়ে যায়নি। একবার বৌদি’র অসুস্থতায় রক্তের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন আমাকেই। ছুটে গিয়েছিলাম। সব সেরে রাতে ফিরেছিলাম দুইটায়। সেই থেকে দাদার স্নেহের মাত্রা যেনে বেড়ে গিয়েছিল অনেক। 

কিছুদিন আগে আমরা সহকর্মী বন্ধু বেলাল হোসেনকে হারালাম, নিখিল ভদ্রকে পঙ্গু হতে দেখলাম। আর এবার হারালাম শান্ত-নিরীহ, বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ বন্ধুজন দীনেশদাকে। ভুয়া লাইসেন্সেধারী অদক্ষ ও বেপরোয়া বাসচালকদের হাতে আর কতো সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ খুন হলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়বে? আর কতো প্রাণহানি ঘটলে বিআরটিএ তার দায়িত্ব পালনে সচেতন হবে?

২৮ এপ্রিল ২০২০

গণমাধ্যম: বিনিয়োগের চরিত্র বিশ্লেষণ

কয়েকজন বাংলাদেশি সংবাদকর্মী।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের করোনাকালীন সংকট বিষয়ক সাম্প্রতিক আলোচনায় রাষ্ট্রের অসহযোগীতা, সাংবাদিকদের অনৈক্যসহ আরো নানা বিষয় আলোচনায় আসছে। ঘাঁটতে গিয়ে মনে হলো, এক্ষেত্রে বিনিয়োগের চরিত্র বা মালিকদের স্বভাব বিশ্লেষণ সবচেয়ে জরুরী।

প্রবীণ সাংবাদিক আফসান চৌধুরীর মতে, দেশের গণমাধ্যমের বেশিরভাগ মালিকই এদিক সেদিক করে পয়সা বানায়, সরকারের সাথে খাতির করে। তাদের সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক নেই। স্রেফ ইজ্জত বাড়াতে বা নানা উপায়ে অর্জিত সম্পদ নিরাপদে রাখার জন্য গণমাধ্যম চালু রাখে। 
“তারা গণমাধ্যম দিয়ে মুনাফা করতে চান না, বরং সেখানে উপরি আয়টা ব্যবহার করতে চান। সেই আয় কমে গেলে তারা আর এটা টানতে আগ্রহী হন না। মালিকের দুইশ কোটি টাকা থাকলেও তখন তিনি বেতন দেবেন না। এটা আমাদের গণমাধ্যমের কাঠামোগত সমস্যা,” বলেন আফসান চৌধুরী। 
ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খণ্ডকালীন শিক্ষকের দাবি, “স্রেফ ক্ষমতাচর্চার জন্য এত গণমাধ্যম চালু রাখার বিপদটা কী হতে পারে এবার তারই বড় একটি প্রমাণ পেলাম আমরা। মূলত এ কারণেই করোনাভাইরাস জনিত সঙ্কটের প্রথম ধাক্কাতেই আক্রান্ত গণমাধ্যম।” 

এ ব্যাপারে গণমাধ্যম বিশ্লেষক খন্দকার আলী আর রাজি বলেন, “করোনা না এলেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য এই পরিণতি এড়ানো কঠিন ছিল। কারণ মানুষের সংবাদ কেনার সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে এগুলো গড়ে ওঠেনি। আবার যে ধরনের সংবাদের জন্য মানুষ মূল্য দিতে রাজি, সে ধরনের সংবাদ পরিবেশন করে না তারা।” 

“ভোক্তার চাহিদার সাথে সম্পর্কহীন সংবাদমাধ্যম যে টিকে থাকার কথা না তা এ মুহূর্তে কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদিও ইতিহাস বলে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারকে বিবিধ সেবা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব একভাবে রক্ষা করে চলবে,” যোগ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক।

সম্পর্কিত পোস্টঃ

২৭ এপ্রিল ২০২০

করোনা কালের সাংবাদিকতা

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) পরিচ্ছন্নতা 
কর্মী সুফিয়া বেগম; কাজ শেষে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে 
ফুটপাতে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কোভিড-১৯ সামলাতে 
সরকার ঘোষিত বাধ্যতামূলক ছুটির কালেও প্রতিদিন জঞ্জাল 
পরিস্কার করতে বের হয়েছেন। যদিও সাথে থাকা ব্যাগে 
ডিএনসিসির ‘ইউনিফর্ম’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। 
ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই কী তা জানেন-ই 
না তিনি। ছবিটির ঢাকার এক সাংবাদিকের তোলা। 
চাকরি আর বেতনের অনিশ্চয়তা গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের, মানে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের। যদিও বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কায় এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এর সাথে নতুনতর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি-তো আছেই। তবে ইদানীং সবচেয়ে ভয়াবহভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষমতাধরদের রোষানল। যে কারণে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। 

এই মহামারীর কালে দেশের প্রথম সাঁড়ির অনলাইন পোর্টাল বিডি নিউজের প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী এবং জাগো নিউজের সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মহিউদ্দিন সরকারসহ মোট আটজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি। 

সংগঠনটির দাবি, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে দুর্নীতি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষনা থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকরা যখন এমন দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন কিংবা প্রকাশের জন্য অনুসন্ধান করছেন, তখন তারা নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাসহ নানারকম হয়রানি, শারীরিক হামলা, ভয়ভীতি-হুমকি এবং হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। 

“মামলাগুলো অবিলম্বে তুলে নেয়ার আহবান জানিয়েছি আমরা। আমাদের দাবি নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে সরকার তাঁদের (সাংবাদিকদের) হয়রানি বা গ্রেফতার করা থেকে বিরত থাকবে,” বলা হয় বিবৃতিতে। 

এর আগে ২১ এপ্রিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের পক্ষে দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম এক বিবৃতিতে বলেন, “করোনাভাইসের মহামারি মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম যখন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের হয়রানি ও ভয় দেখানোর চেষ্টা অত্যন্ত দুঃখজনক।” 

একইদিন প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স (ডব্লিউপিএফআই), তথা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের একধাপ অবনতি হয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ১৫১ তম। টানা ছয় বছর এই অবস্থান ১৪৪ থেকে ১৪৬-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করার পর গত বছর এক ধাক্কায় চার ধাপ নেমে ১৫০ হয়েছিল। 

এ নিয়ে আলাপের জন্য যোগাযোগ করা হলে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান জানান, তিনি এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। সূচকের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরএফএস যা বলেছে, তা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য চাওয়া হলে বেনারকে তিনি বলেন, “পরে আমি এ সম্পর্কে মন্তব্য করব।” পরবর্তীতে পুনরায় যোগাযোগের পর তিনি এনিয়ে কথা বলতেই অস্বীকৃতি জানান। 

সূচকের বিশ্লেষণে আরএফএস বলেছে, ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রহণ করা কঠোরতর নীতির অন্যতম প্রধান ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে সাংবাদিকরা রয়েছেন। মাঠ পর্যায়ে সংবাদকর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ এবং সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বিচারিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে নির্বাহীরা। এই আইনে নেতিবাচক প্রচারণার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড। ফলস্বরূপ, স্ব-সেন্সরশিপ অভূতপূর্ব স্তরে পৌঁছেছে কারণ সম্পাদকরা কারাবন্দি বা তাদের মিডিয়া আউটলেট বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিতে নারাজ। এছাড়া যেসব সাংবাদিক এবং ব্লগাররা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ মত ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চান তারা উগ্রবাদী ইসলামপন্থীদের হয়রানি, এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছে। 

সার্বিক সূচক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আরএসএফ মহাসচিব ক্রিস্টোফ ডিলোয়ার বলেন, “আমরা সাংবাদিকতার জন্য এমন একটি অবধারিত দশকে প্রবেশ করছি, যা এর ভবিষ্যতের ওপর প্রভাবসঞ্চারী সঙ্কটের সাথে যুক্ত। করোনাভাইরাস মহামারীটি নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার অধিকারকে হুমকীতে ফেলা নেতিবাচক কারণগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং এটি নিজেই একটি উদ্বেগের কারণ। ২০৩০ সালে তথ্য, বহুত্ববাদ এবং নির্ভরযোগ্যতার স্বাধীনতা কেমন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আজেই নির্ধারিত হচ্ছে।” 

ঠিক তখনই এই সূচকটি প্রকাশিত হলো যখন করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কাতেই নজিরবিহীন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে দেশের সংবাদ শিল্প ও সাংবাদিকরা। কয়েকদিন আগে ঢাকার মূলধারার বেশ কিছু জাতীয় দৈনিকের মুদ্রণ বন্ধের ঘটনাসহ শীর্ষস্থানীয়পত্রিকাগুলোর কলেবর আর প্রচার কমিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলাম। ততোদিনে সরকারের কাছে সাংবাদিকদের জন্য প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে। তখনই জেনেছিলাম, আয় সঙ্কটে সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন নিয়েও জটিলতাতৈরী হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। বাড়ছে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র বিতরণকারীদের বেকারত্ব। 

“আমার ৪৭ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে এমন পরিস্থিতি কখনও দেখিনি। যেসব জায়গায় আমি লেখি, কেউই গত তিন মাসে পয়সা দিতে পারেনি। অনেক নামিদামি পত্রিকাও লেখক সম্মাণী দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু গণমাধ্যম হয়ত বন্ধই হয়ে যাবে,” বলেছিলেন ৬৮ বছর বয়সী বাংলাদেশি গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। তাঁর মতে, “এটা শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়, বেসরকারি খাতের সকল পেশার ক্ষেত্রে হচ্ছে। এই ধরণের পরিস্থিতি কেউ কোনোদিন পড়েনি। এবারের সঙ্কটটা সবার। তবে আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে এটা আরো তীব্র, কারণ এগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিকে সাংঘাতিক রকম ভর্তুকি দিয়ে চালানো হয়।”
  
এসব নিয়ে আরও লিখতে হবে, মানে লিখবো নিশ্চয়।। আজ শুধু সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা টুকে রাখছি।
২৩ এপ্রিল : নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জে চাল আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য আনতে গেলে হামলার শিকার হন এসএ টিভির প্রতিনিধি সজল ভূঁইয়া।ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ কার্যালয়ের সামনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খানের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়।  
২১ এপ্রিল : প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সে নাম উল্লেখ না করায় ব্যবসায়ী নেতার বিরুদ্ধে সাংসদপন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় নরসিংদীর স্থানীয় নিউজ পোর্টাল সময়নিউজ ডটকমের সম্পাদক হৃদয় খান ও প্রকাশক শফিকুল ইসলাম মতির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এই দুই সাংবাদিক সম্পর্কে বাবা-ছেলে। হৃদয় খান বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ ‍টুয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছেন।  
একইদিন ঠাকুরগাঁওয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজ টোয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ লিটুকে পৌর শহরের দুরামারী নামক স্থানে সদর থানার টহল পুলিশ মারধর করে। এছাড়া সিলেটের জৈন্তাপুরে সারীঘাটে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক রোগীর সংবাদ প্রকাশের জেরে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি রেজওয়ান করিম সাব্বিরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।  
১৯ এপ্রিল : গলাচিপা পৌর এলাকার কয়েকজন ছেলে কাঁটাখালী বাজার আওয়ামী লীগ অফিসে যুবলীগ সভাপতি রিয়াজ খলিফার পুলিশের ওপর হামলা চালানোর ছবি তুলতে গেলে এতে মাই টিভি ও এশিয়ান টিভির প্রতিনিধিকে মারধর করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।  
১৮ এপ্রিল : চাল চুরির সংবাদ প্রকাশের জেরে অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ ও জাগোনিউজের সম্পাদকসহ চারজনের বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি থানায় মামলা দায়ের করেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম ভাসানী। এজাহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ারও অভিযোগ আনা হয়েছে।  
একইদিন সাভারে মারধারের শিকার হন দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার প্রতিনিধি ওমর ফারুক, শরীয়তপুরে অনলাইন জয়যাত্রা টিভি ও অগ্রযাত্রা পত্রিকার জেলা প্র‌তি‌নি‌ধি মহসিন রেজা ও দৈ‌নিক আমা‌দের কন্ঠ পত্রিকার সোহাগ খান সুজন এবং বরিশালে বাংলাভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান কামাল হাওলাদার।  
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার নঈম মিয়ার বাজারে ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদদাতা এম শাহীন আল আমীন ছবি তুলতে গেলে পৌর মেয়রের লোকজন মারধর করে তাঁর ক্যামেরাও ছিনিয়ে নেয়। তবে পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম সওদাগর মারধরের বিষয়ে অস্বীকার করে বলেন, “ছবি তুলতে নিষেধ করার পরও তিনি ছবি তুলেছিলেন। তাই ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।” 
এছাড়া এই দিন সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করায় দৈনিক যুগান্তরের সাভার প্রতিনিধি মতিউর রহমান ভান্ডারিকে ফোনে হুমকি দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব। তিনি সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। সাংবাদিককে শাসিয়ে বলেন, “তোমার পেছনে আজকে থেকে মনে করবা আবার অন্য ধরনের কিছু সাংবাদিক ঘুরবে। তোমার সম্পাদককে বইলা রাখো তুমি।”
১৬ এপ্রিল : রাজধানীর দক্ষিণখান থানার মাজার এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবীতে ইনসাফ গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মালিক পক্ষের হামলার শিকার হন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ক্রাইম অনুসন্ধানের সাংবাদিক তমা। ওই গার্মেন্টসের বিষয়ে কোনও সংবাদ প্রকাশ করলে মেরে লাশ গুম করে দেওয়ারও হুমকী দেওয়া হয় তাঁকে। 
১৫ এপ্রিল : লকডাউনের মধ্যেও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা শ্রমিকদের ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ অব্যাহত থাকায় ডিসি-এসপিসহ জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় আল মামুন নামের এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করেন ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার এসআই মো. জহুরুল ইসলাম । 
১৪ এপ্রিল : গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল ওজনে কম দেয়ার প্রতিবাদ করায় আনন্দ টিভির সাংবাদিক খোরশেদ আলম খানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কাপাসিয়া থানা পুলিশ ওএমএস ডিলার মাসুদ সরকারসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে।  
একইদিন মুন্সীগঞ্জে ১০ টাকা মুল্যের চাল বিক্রিতে অনিয়মের খবর ফেসবুকে দেওয়ায় দৈনিক অধিকার পত্রিকার মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি আরফি রিয়াদ এবং তাঁর পরিবারের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।  
এছাড়া এইদিন সাতক্ষীরার তালায় খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক খুলনাঞ্চলের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি খান নাজমুল হুসাইন (২৯), এবং তাঁর ছোট ভাই দৈনিক আজকের সাতক্ষীরার তালা উপজেলা প্রতিনিধি খান আল-মাহবুব (২০) কে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্ত্বরা।  
১২ এপ্রিল : নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার জিরতলী ইউনিয়নের বড় হোসেনপুর গ্রামে ক্রাইম নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমের সাংবাদিক মো. পলাশ উদ্দিনের উপর স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন চড়াও হন, তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি ও দেওয়া হয়।  
১০ এপ্রিল : চাল চুরির প্রতিবেদন করায় যুবলীগ নেতার হুমকীতে সস্ত্রীক পালাতে বাধ্য হন আনন্দ টিভির জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা প্রতিনিধি মো. নাসিম উদ্দিন। পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন তিনি।  
৯ এপ্রিল : নারায়ণগঞ্জ থেকে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে ফিরে আসা ১৯ ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসী ও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় এশিয়ান টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার মো. গোলাম মোস্তফাকে মারধর করে তাঁর ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই দিন ফতুল্লা থানার কাশিপুর ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় নিম্নআয়ের মানুষদের বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় মেম্বার আমির হোসেনের দুর্ব্যবহারের শিকার হন সাংবাদিকরা।  
৩ এপ্রিল : হামলার শিকার হয়েছেন দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি নাজমুল সাঈদ সোহেল ও তাঁর পরিবার। 
১ এপ্রিল : হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের সংবাদ প্রচার করায় সাংবাদিক শাহ সুলতান আহমেদকে ক্রিকেট খেলার ব্যাট দিয়ে পেটান স্থানীয় চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুন। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হন আরও দুই সাংবাদিক এম মুজিবুর রহমান ও বুলবুল আহমেদ।  
৩১ মার্চ : চাল চুরির খবর ফাঁস করায় ভোলায় সাংবাদিক সাগর চৌধুরীর ওপর মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালায় বোরহানউদ্দিন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বড় মানিকা ইউপি চেয়ারম্যান জসিম হায়দারের ছেলে নাবিল হায়দার। ক্ষোভ মেটাতে মোবাইল চোর ও ছিনতাইকারী অপবাদ দিয়ে ওই সাংবাদিককে পেটানোর সময় ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে লাইভ করেছিল সে। 
২৭ মার্চ : প্রশাসনের করোনা সংক্রামণ বিষয়ক সচেতনতা তৈরীর প্রচার-প্রচারণার ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটার শিকার হন বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক দেশ জনপদ পত্রিকার শাফিন আহমেদ রাতুল ও দৈনিক দখিনের মুখ পত্রিকার নাসির উদ্দিন। এদের মধ্যে রাতুল বরিশাল ফটো সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের সাধারণ।
এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস বিষয়ক গুজব ঠেকানোর কথা বলে বেশকিছু ওয়েবসাইটের সম্প্রচার বন্ধ করেছে সরকার। সামগ্রিকভাবে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন ও বার্তা সংস্থায় কর্মরতদের কর্তব্য পালন হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। এরই মধ্যে একের পর এক গণমাধ্যমকর্মী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাচ্ছি।

৩০ জানুয়ারী ২০১৮

৩২ ধারা নিয়ে কেন উদ্বিগ্ন সাংবাদিকরা!

আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্রগুলো সেই ব্রিটিশরা দিয়ে গেছে। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো সংবাদ পেয়ে থাকলে সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। কোনো সংবাদপত্র যদি কোনো গোপন সংবাদ প্রকাশ করে তবে প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশক অপরাধী হবেন। এসব কাজে সহায়তা করা অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ একই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে।’ ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নক্সা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো বিদেশী এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা যাবে না।’ 
আবার আদালত অবমাননা আইন-১৯২৬ অনুযায়ী বিচারাধীন মামলার নিরপেক্ষ বিচারকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে কোনো প্রকাশনা প্রকাশিত হলে তা আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য যদি দায়িত্বহীনভাবে নিরপেক্ষ সমালোচনার সীমা অতিক্রম করে এবং নির্দেশিত ও পরিকল্পিত পন্থায় বিচারকাজের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বিনষ্ট করে এবং বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে বিচারকদের বাধাগ্রস্ত করে এবং মৌলিক অধিকার বলবৎ করার পথে বাধা প্রদান করে বা সংবিধান পরিপন্থী কর্মের মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি করে, তবে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। যদি কোনো ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিকে আক্রমণ করে অযৌক্তিকভাবে কোনো প্রবন্ধ লেখে ও প্রকাশ করে তাহলে সে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হবে। যদি দেখা যায় যে প্রবন্ধটি আদালতের মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তাহলে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। তবে, জনস্বার্থে বিচার কার্যের নিরপেক্ষ ও যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা আদালত অবমাননা নয়। আদালত অবমাননার শাস্তি কারাদন্ড, যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে অথবা জরিমানা, যার পরিমাণ দুই হাজার টাকা হতে পারে অথবা উভয়ই। ক্ষমা প্রার্থনা করলে অবমাননার আসামীকে মুক্তি দেওয়া যায়।
এদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ (ক) (খ) (গ) (ঘ) (ঙ) (চ) ধারায় সংবাদপত্র বিষয়ে সরকারকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সরকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতামূলক বা বিদ্রোহের উসকানিমূলক বা নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টিকারী বা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞামূলক কোনো লেখা যদি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তবে সরকার তার প্রত্যেকটি কপি বাজেয়াপ্ত করতে পারে এবং যে স্থানে ঐগুলি থাকে সেই স্থানে ম্যাজিস্ট্রেটের পরওয়ানামূলে পুলিশ যেতে পারে; তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এ বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের গোচরে আনতে পারে।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ম্যাজিস্ট্রেট সেইসব ব্যক্তিকে মুচলেকা দেবার আদেশ দিতে পারেন যারা রাষ্ট্রদ্রোহীতামূলক বা শ্রেণীর সংঘর্ষ সৃষ্টিকারক বা বিচারককে ভীতি প্রর্দশনমূলক বা অবমাননাকর কোনো কিছু প্রকাশ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিককে তার নির্দেশিত স্থানে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেন।
এসব আইন নিয়ে আমার সহযোদ্ধা সাংবাদিকরা কোনো কথা বলছেন না। তারা সরব হয়েছেন সদ্য (২৯ জানুয়ারি) মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ৩২ ধারা নিয়ে। অথচ আলোচিত এ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি ‘বেআইনিভাবে প্রবেশ করে’ কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে।এতে সাংবাদিকরা ভয় পাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। তারা কিন্তু কোথাও অবৈধভাবে প্রবেশ করেন না। খোদ সরকারও তথ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের প্রবেশপত্র (অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড) দেয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাগত গুরুত্ব বিবেচনায় অনেক দপ্তর ও স্থাপনায় যেতে অবশ্য ওই প্রবেশপত্রের পাশাপাশি আলাদা নিরাপত্তা ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বেআইনি নয়, রাষ্ট্র স্বীকৃত। অতএব তাদের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহকে গুপ্তচরবৃত্তি হিসাবে গন্য করার সুযোগ নেই। তবে সাংবাদিকতার আড়ালে যে কেউ কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করছে না, তা কি আমরা (সাংবাদিকরা) জোর গলায় বলতে পারি? সাংবাদিক সেজে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের বহু কেচ্ছা অন্তত সব্বাই জানি। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এ জাতীয় অনাচার রুখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রকৃত সাংবাদিকতাকে বাঁধা দেয়ার শক্তি কোনো বিধানের নেই। নানা আইনের বিবিধ ধারা সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের চ্যালেঞ্জটা সামান্য বাড়াবে হয়ত।
জাতীয় সংসদে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বহুল আলোচিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধগুলো নতুন আইনের কয়েকটি ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে নীতিগতভাবে অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ধারা ১৯-এ মানহানি, মিথ্যা ও অশ্লীল, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং ধারা ২০-এ শত্রুতা সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতিসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়েছিলো। এসব বিষয় একই সঙ্গে দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৯ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ধারা ৫৭-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় এ সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তিগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছে।
খসড়ার ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য প্রেরণ করে, অন্য ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ করে, মিথ্যা তথ্য জানার পরও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করে তাহলে সেটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ অপরাধের শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এসব অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’ ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিছু প্রকাশ করে তাহলে সেটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ ধরনের অপরাধ করলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’
আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে পেনাল কোডের সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ করে তাহলে তার তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এ অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’ আর ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা বিভিন্ন শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার বা বারবার এ অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এ ধারাটিকে অজামিনযোগ্য করা হয়েছে।’
এর আগে মন্ত্রিসভা ২০১৬ সালের ২২ জুলাই এ আইনের প্রাথমিক খসড়াটি নীতিগতভাবে অনুমোদন করে। সে খসড়ায় জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণার মদদ দেয়ার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিলো। কিন্তু যাবজ্জীবনের মতো কঠোর শাস্তির বিধান রাখায় সংশ্লিষ্ট সবাই একমত হতে পারেনি। সেই কঠোর অবস্থান থেকে এবার নমনীয় হয়েছে সরকার। ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি ও কারাবিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ হল ৩০ বছর কারাদণ্ড। এ অবস্থায় খসড়া আইনে অপরাধের শাস্তি কমিয়ে অনধিক ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

২৫ নভেম্বর ২০১৭

তারেকের সামনেই পেটালো ছাত্রদল

দৈনিক যুগান্তর (১০ এপ্রিল ২০০৬)

ছবিটাও বেশ আগের
গল্পটা দশক পুরানো। সেবার তারেক রহমানের সামনেই আমাদের গায়ে হাত তুলেছিলো ছাত্রদলের পাণ্ডারা। শুধুমাত্র এ কারণে ওই সময়ে দৈনিক যুগান্তর ছাড়া অন্য গণমাধ্যমগুলো বিষয়টি চেপে গিয়েছিলো। এমনকি স্থানীয় যে দৈনিকে আমি কাজ করতাম, তারাও শুধু প্লেট গ্লাস ভাংচুরের খবর দিয়ে সাংবাদিক পিটানোর ঘটনা বেমালুম গুম করে দেয়। কারণ পত্রিকার আওয়ামীপন্থী মালিকের দুই ভাই ছিলেন আবার বিএনপি নেতা।
আরিফুর রহমান
আজও যুগান্তরের বরিশাল ব্যুরো প্রধান আকতার ফারুক শাহীন (Akter Faruk Shahin), আর বর্তমানে ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারে কর্মরত আছেন আরিফুর রহমান (Arif Rahman)। তাকে স্মরণ করতে-ই মনে এলো ছাত্রদল, ছাত্রলীগ এবঙ শিবির; এই তিন সংগঠনের হাতেই আমার পিটুনি খাওয়ার ছবি তুলতে পারা একমাত্র আলোকচিত্রী তিনি। জানি না সেসব ছবি এখনো আছে কি’না!

২৯ জুন ২০১৭

লিটন বাশার : এক অদম্য চেতনা

রাজপথে লিটন বাশার
যাদের হাত ধরে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম ─ তাদেরই একজন লিটন বাশার। তিনিও অসময়ে চলে গেলেন! ঈদের পরদিন দুপুর অবধি নিদ্রাবিলাসের রেওয়াজ বদলানো হয়নি বলেই দূরালাপনীর ঘুম ভাঙানিয়া তলবে পেলাম খবরটা। জানালেন জাফর ভাই, মানে সাংবাদিক আবু জাফর সাইফুদ্দিন। তার সাথে কথা শেষ করার একটু পরই স্মরণে এলো অতীতের এক বিষাদগ্রস্থ সকাল, ঠিক সাত বছর একদিন আগের। সেদিনও জাফর ভাইয়ের কথাযন্ত্রের ডাকে জেগে উঠেছিলাম, পেয়েছিলাম সাংবাদিক এসএম সোহাগের মৃত্যু সংবাদ। সেই ২০১০ থেকে এই ২০১৭; এর মধ্যে আমরা, মানে আমি আর জাফর ভাই বহুবার পরস্পরকে খুঁজেছি শুধুমাত্র সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর সংবাদ দিতে। 
লিটন বাশার ও এসএম সোহাগ, দু’জনেই ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের কিংবদন্তীতূল্য আরেক প্রয়াত সাংবাদিক মাইনুল হাসানের স্নেহধন্য; কাছের মানুষ। আবার জাফর ভাই ছিলেন তাদের একান্ত আপন। সৌভাগ্যজনকভাবে আমি তাদের প্রত্যেকের ভালোবাসা পেয়েছি, সাথে অকৃত্রিম আস্কারাও। দক্ষিণাঞ্চল কেন্দ্রীক যে কোনো সমস্যায় উদ্ধারকর্তা হিসেবে এ নামগুলোই সর্বাগ্রে মাথায় এসেছে বছরের পর বছর।
বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকায় শিক্ষানবিশ রিপোর্টার পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে সাংবাদিকতা এসেছিলাম। এর আগে জীবনের প্রথম সাক্ষাতকারে যে তিনজন মানুষের মুখোমুখি হতে হয়; তারা হলেন পত্রিকাটির তৎকালীন মালিক ও সম্পাদক সৈয়দ দুলাল, বার্তা সম্পাদক স্বপন খন্দকার এবং যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক লিটন বাশার। তারা সেদিন পছন্দ না করলে আমার সাংবাদিকতা শুরুর পথ হয়ত এতটা সুগম হতো না। কারণ পরবর্তীতে তাদের তিনজনকে-ই দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি।
সচ্ছ ও স্পষ্টভাষী লিটন’দা কে দেখেই শিখেছিলাম ‘আক্রমনাত্বক’ (Agressive) সাংবাদিকতা। ভয় শব্দটা সম্ভবত তার অভিধানেই ছিলো না। কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলতে দেখিনি কখনো, নিজের বন্ধু-স্বজনদেরও না। সততার শক্তিতে বলীয়ান এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের কারণে তার বন্ধু, শত্রু - দুটোই হয়েছে ঢের। তবে পরম দুর্জনও তাকে অশ্রদ্ধা বা অসম্মান করতে পারেনি কখনো। 
স্মৃতিবহুল এক কোরবানীর ঈদ কাটিয়েছিলাম দাদার বুখাইনগরের গ্রামের বাড়িতে। প্রায় এক যুগ আগে, ২০০৬ এর জানুয়ারিতে। মূলত গিয়েছিলাম সাপ্তাহিক ২০০০ ─ এর এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে, চরমোনাইয়ের তৎকালীন পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীমের সাক্ষাতকার নিতে। মূলত হুজুরের বড় ছেলে, চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের সেই সময়ের চেয়ারম্যান, বর্তমান পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সাথে লিটন’দার সখ্যতার সুবাদে আমি সাক্ষাতের সুযোগ পাই। ঈদের দিন সন্ধ্যায় আমি দাদার বাড়িতে পৌঁছাই। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন তিনি। ঘন কুয়াশার সেই রাতে দু’জনে মোটরসাইকেলে চেপে চরমোনাই দরবার শরীফে পৌঁছাই। দরবারের হুজরাতে ঢুকে পীর সাহেবের সাথে কুশল বিনিময়ের পর দাদা বেশ প্রশংসাত্মক ভঙ্গিতে আমায় পরিচয় দিয়ে জানান, আজ তার কোনো জিজ্ঞাসা নেই, সব প্রশ্নই আমার। 

এরপর প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ফজলুল করীম আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। পুরোটা সময় পাশেই ছিলেন লিটন’দা। মাঝে মাঝে চোখে চোখ রেখে সাহস জাগানিয়া হাসি দিচ্ছিলেন। বের হয়ে বললেন ─ ‘তোমার আলাপের স্টাইল (ঢঙ) আমার ভাল্লাগছে।’ তার এই সামান্য প্রশংসা তখন আমার আত্মবিশ্বাস যে কতটা বাড়িয়েছিলো তা আসলে এখন খুব ভালো করে টের পাচ্ছি। হুজরা থেকে বের হওয়ার পর মাংস দিয়ে রুটি খেতে খেতে বর্তমান পীর রেজাউল করীমেরও একটি সাক্ষাতকার নেই। সেবার দেড় লাখ টাকা দিয়ে বরিশালের হাটে ওঠা সবচেয়ে বড় গরুটি কিনে কোরবানী দিয়েছিলো পীর পরিবার। সেটির মাংস আর চালের রুটি দিয়েই আমাদের আপ্যায়িত করা হয়।
সেই রাতে আর শহরে ফিরতে দেননি লিটন’দা। ফের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এর আগে সন্ধ্যায়-ই পরিচয় হয়েছিলো তার তিন ভাইয়ের সাথে। এর মধ্যে রিয়াদ ভাইয়ের (রিয়াদ আহমেদ) সাথে খুব একটা যোগাযোগ না থাকলেও তার চেহারার সাথে দাদার চেহারার অদ্ভুত মিল থাকার কথা আজও ভুলিনি। ইলিয়াস (আহমেদ ইলিয়াস) আর ইমনের (ইশতিয়াক ইমন) সাথে দুরত্বটা কমে গিয়েছিলো ফেসবুকের সুবাদে। লিটন’দার মতো তাদের সাথে কথা, এমনকী সাক্ষাতও হয়েছে মাঝে মাঝে। ভাইদের মধ্যে ইমন-ই শুধু অগ্রজকে অনুসরণ করেছেন, মানে সাংবাদিকতায় এসেছেন। দাদার দেখাদেখি আমিও তাকে ‘ছোট হুজুর’ ─ নামে ডেকেছি দীর্ঘকাল। তাদের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, পেশায় ছিলেন শিক্ষক। নামটি মনে না এলেও তার সরল হাস্যোজ্জল ব্যক্তিত্ব স্মরণে আছে বেশ। দাদার মায়ের হাতের রান্নার স্বাদও জিভে লেগে আছে। আহারে, প্রিয়পুত্রের প্রয়াণে এখন তাদের বুকে যে হাহাকারের দামামা বাজছে ─ তা শোনার সাহস আছে কার?
পীরের সেই সাক্ষাতকার জমা দেয়ার ‘ডেডলাইন মিস’─জনিত কারণে মুঠোফোন বন্ধ করে আমি যখন ফেরারী, পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মর্তুজাকে আমায় হন্যে হয়ে খুঁজছেন; তখনও লিটন’দা-ই তাকে আমার বাসার ল্যান্ডফোন নম্বর দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেই সাক্ষাতকারসহ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘চরমোনাই পীরকাহীনি’। প্রতিবেদন জুড়ে পীরের নানা অনাচারের ফিরিস্তি থাকায় ফের মহাবিপত্তি ঘটে । পীরের রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৬৪ জেলায় মানহানির মামলা করার পাশাপাশি অব্যাহত হামলার হুমকী দিয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে। শুধু আমার নয়, লিটন’দার ওপরও তারা ক্ষিপ্ত হন। তখনও তিনি আমার পাশ থেকে সরে যাননি। সব সামলে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছেন।
গত বছরের ছবি
একই বছরে, অর্থাৎ ২০০৬ সালে আজকের পরিবর্তন পত্রিকায় ‘পুরানো বরিশাল’ শিরোনামে এক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সুশান্ত ঘোষ, নজরুল বিশ্বাস আর আমার সেই যৌথ কাজ চলাকালে লিটন’দা দৈনিক ইত্তেফাকে বরিশালের পুরানো বাড়িগুলো নিয়ে একটি সিরিজ শুরু করেন। তখন তিনি পরিবর্তনের সাথেও সংযুক্ত ছিলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো দুটি সিরিজের সমন্বয়ের পাশাপাশি আরো কিছু তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত করে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ। পরবর্তীতে নানা কারণে সে উদ্যোগ আর হালে পানি পায়নি।
দক্ষিণের প্রতিটি জনপদে চষে বেড়িয়েছেন লিটন বাশার। জন্ম দিয়েছেন অজস্র সাড়া জাগানিয়া প্রতিবেদন। তবে তার উত্থান দ্বীপজেলা ভোলা থেকে। এরপর চলে গিয়েছিলেন ঢাকায়। পরে ফের বরিশালে এসে থিতু হন। তার হাত ধরেই বরিশাল, তথা বাঙলার মফস্বল সাংবাদিকতায় ঐক্য ও সম্প্রীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। 

গত দশকের শেষের দিকে ঢাকায় চলে আসার পরও দাদার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার। বরং যোগাযোগটা একটু বেশীই ছিলো। পুরানো পল্টনের রয়েল হোটেলের নাম, মালিকানা বদলে গেছে বহুদিন আগে। নতুন নামটি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না এই মুহুর্তে। তবে খুব মনে পড়ছে ২০০৮-০৯ সালে এই হোটেলে কাটানো এক রাতের গল্প। পঞ্চম তলার কোনো এক রূমে লিটন’দা এবঙ তার তিন বন্ধুর রাতভর আড্ডা শেষে খুব সকালে যখন বের হয়ে আসছি, দাদা তখন হাতে দুই হাজার টাকা গুজে দিয়ে বললেন, ‘এইটা রাখ।’ আমি ইতস্তত করে টাকাটা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করতেই তিনি ধমক দিয়ে বললেন, ‘ঢাকায় রিপোর্টার-গো শুরুর বেতন কেমন তা আমার জানা আছে। ঠিকঠাক দেয় কয় প্রতিষ্ঠান, তা’ও।’ ছোট্ট করে ‘থ্যাঙ্ক-ইউ’ বলে আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। রাতে অবশ্য বহু বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে দাদা বলেছিলেন, ‘লেগে থাকলে দুই বছরের মধ্যে তোর বেতন চারগুণ হয়ে যাবে।’ সত্যি, পরে হয়েছিলোও তা-ই ।

আমি সংসদ সাংবাদিকতা শুরুর পর দাদা বেশ খুশি হয়েছিলেন। সেই সময়ে, মানে ২০০৯-১১ সালে মাঝে মাঝে সংসদের সাংবাদিক লাউঞ্জে ফোন করে নিজের পরিচয় গোপন করে আমাকে চাইতেন। কণ্ঠ বদলে মজা করতেন। প্রতিবারই তাকে চিনে ফেলার পর শিশুদের মতো হাসতেন। কখনো আবার জানতে চাইতেন লাউঞ্জে এখন কোন কোন সাংবাদিক আছেন। পরিচিত কেউ আছে শুনলে তাদেরও ডেকে কথা বলতেন। কাজী শাহেদ, উত্তম চক্রবর্তী, সজল জাহিদ, উম্মুল ওয়ারা সুইটিসহ ঢাকার অনেক সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে তার সখ্যতার হাল দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছি ঢাকায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করার সময়েও পলিটিক্যাল রিপোর্টার (আওয়ামী লীগ বিট) হিসেবে লিটন’দা ছিলেন সবার প্রিয় সহযোদ্ধা।  

দাদার সাথে সর্বশেষ দেখা হয় ২০১৫ সালে, বরিশালে। প্রেসক্লাবের নির্বাচনের দিন বিকেলে। তখনও তিনি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। সেখানেই দেখা হয়। পরে তার সাথে কথা বলতে বলতে আগরপুর রোডে থেকে বেড়িয়ে সদর রোডের হাবীব ভবনে ইত্তেফাক অফিসে গেলাম। বেশ কিছু সময় ধরে আড্ডা দিলাম। প্রায় পুরোটা সময় আমার প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করলেন। তবে ফেরার আগে উৎসাহ দিলেন চলচ্চিত্রের কাজেও। বললেন, ‘এইডাও আবার ছাইড়া দিও না।’ এরপর দুয়েকবার ফোন ও ফেসবুকে আলাপ হয়েছে; কিন্তু সাক্ষাত হয়নি আর। তবে ‍নিয়মিত তার লেখা সংবাদ ও কলাম পড়ে বুঝতাম, তিনি আজও খুব একটা বদলে যাননি। প্রেসক্লাবের সর্বশেষ নির্বাচনে সভাপতি পদে দাঁড়িয়েছিলেন। প্যানেল জিতলেও তিনি হেরে যান। তাকে যদ্দুর জানি, এ ঘটনায় কষ্ট পেলেও কাউকে বুঝতে দেয়ার মানুষটি তিনি নন। তাই যে কোনো সাংবাদিকের জন্য নির্দ্বিধায় পথে নামার অভ্যাসও তার বদলায়নি আমৃত্যু। 

অতি-সাম্প্রতিক ছবি 
মৃত্যুর মাত্র দু’দিন আগের এক লেখায় লিটন বাশার বলেছেন ─ “বিবেকের দায় এড়াতে নিজের শূন্য পকেটেও প্রিয় সহকর্মী কিংবা প্রয়াত বন্ধুদের এতিম সন্তানের মুখে হাসি ফুটাতে শেষ রোজায় দিন-রাত দৌড়ঝাঁপ করে আমি এখন ক্লান্ত। যেটা বুঝলাম তাতে আপনি যদি সকলের আবদার পূরণ করতে চান, সবার মুখে হাসি ফুটাতে চান তবে আপনার মুখের হাসি অটুট থাকা দুরূহ ব্যাপার। আর আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষ হয়ে যদি ‘ঈদ’ নামের এক মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার কোনো কঠিন বাস্তবতা আপনার সামনে হাজির হয় তবে হাসি তো ম্লান হবেই।” বাস্তবতার চাপ প্রসঙ্গে এমন নির্লিপ্ত বয়ান সম্ভবত শুধু তার পক্ষেই দেয়া সম্ভব। তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত রসিক, খাঁটি প্রতিবাদী, রাজপথের সাহসী প্রাণ; একইসঙ্গে সাহিত্য অনুরাগী, ইতিহাস সচেতন, উদ্যমী পরোপকারী, নীতিবান সংগঠক, উদারমনা শিক্ষক এবং সর্বোপরী একজন আপোসহীন সাংবাদিক। জানি না কত জন বুঝবে কি হারালো বরিশাল বা কি হারিয়েছে বাংলাদেশ।

দাদার পুত্র শ্রেষ্ঠ’র বয়স মাত্র চার বছর। তার নিজ হাতে গড়া পত্রিকা দৈনিক দখিনের মুখ পত্রিকার বয়সও সম্ভবত বছর দেড়েক। তার এই দুই সন্তানের ভবিষ্যত পথ চলা সুগমের দায়িত্ব এখন সকলের। মনে রাখবেন, লিটন বাশার কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন; তিনি এক অদম্য চেতনা। একদিন শুধু বরিশাল নয়, সারাদেশের সাংবাদিকরা তাকে ধারণ করবেন; এটা-ই প্রত্যাশা। 
প্রয়াত বন্ধু-স্বজনদের তালিকা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে, ইদানীং একটু দ্রুতই। প্রায়শই ভাবি তাদের এলিজি লেখার জন্যই হয়ত এখনো বেঁচে আছি আমি। যদিও যমের সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না শোকার্ত মন। একজনকে নিয়ে লেখা শেষ না করতেই তিনি আরো তিনজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। গত ১৫ মে চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ, ১০ জুন আলোকচিত্রী হানের পর ২৭ জুন লিটন বাশার। একইদিন রাতে আবার সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশও! হে মহান আজরাইল, দয়া করে এবার একটু ধীরে চলেন।
“আপনার আকস্মিক মৃত্যু আমাদের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটি পর্যন্ত দিলো না। তবুও প্রত্যাশা আপনি নিশ্চয়ই আমাদের মতো অনুজদের ক্ষমা করবেন।” ─ গত ফেব্রুয়ারিতে মীর মনিরুজ্জামানের মৃত্যুর পর এক লেখায় এ কথাগুলো বলেছিলেন সদ্য প্রয়াত অগ্রজ লিটন বাশার। সেই কথাগুলো-ই আজ তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে হচ্ছে। আরো কত প্রিয়মুখ ছবি হয়ে যাবে; কত দয়িতের সাথে আর কথা হবে না কোনো দিন! আর এ সত্য বদলাতে পারবে না কেউ। অগ্রগামী বন্ধু-স্বজনদের তাই অভিনন্দন। আশারাখি দেখা হবে, নবজন্মে।

অবিশেষ
পরম শ্রদ্ধায় রাসেল স্মরণ
চিন্তা-কর্মে, স্মৃতির মর্মে অমর মনির

২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

চিন্তা-কর্মে, স্মৃতির মর্মে অমর মনির

মীর মনিরুজ্জামান
এক-এগারো পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়। দুই হাজার সাত-এর সেপ্টেম্বরের একদিন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক আজকের কাগজ। পত্রিকাটির বরিশাল প্রতিনিধি ছিলেন সদ্য প্রয়াত মীর মনিরুজ্জামান। সৎ, পরোপকারী, প্রতিবাদী ও বন্ধুবৎসল সাংবাদিক নেতা হিসেবে নিজ শহরে যার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। বেকারত্বের কারণে হতোদ্যম না হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন, আঞ্চলিক দৈনিক। তখন আমি ঢাকার এক অখ্যাত পত্রিকার বরিশাল প্রতিনিধি, একইসঙ্গে স্থানীয় আজকের পরিবর্তন পত্রিকার প্রতিবেদক। এই পরিবর্তন ছিলো আমার সাংবাদিক সত্বার জন্মস্থান। পত্রিকাটি ছেড়ে কিছুদিন দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল আর আজকের বার্তায় কাজ করে ঠিক যখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছি, তখনই মনির ভাই নিজে পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হলেন। 
এ বিষয়ক আলোচনা খুব একটা ডালপালা মেলার আগেই তিনি বিএনপি নেতা এ্যাডভোকেট মহসিন মন্টুর মালিকানাধীন দৈনিক সত্য সংবাদ পত্রিকাটি নিজ দায়িত্ব নেন। তখনও কাগজে-কলমে মালিকানা মন্টুর নামেই ছিলো। তবে চুক্তি করে পত্রিকাটিকে তার হস্তক্ষেপ মুক্ত করা হয়। এরপর সেখানে বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন তৎকালের এক আলোচিত (বিতর্কিত পড়া যেতে পারে) সাংবাদিক শাকিব বিপ্লব। তিনি আবার ছিলেন আমার পুরানো সহকর্মি যোগাযোগ করলেন, নিয়ে গেলেন মনির ভাইয়ের কাছে - অনামী লেনে সত্য সংবাদ অফিসে। সাক্ষাতে কথা শুনে এই সরল মনের মানুষটার পাশে থাকার তাগিদ জাগায় আবার পরিবর্তন ছাড়লাম। প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দিলাম তার পত্রিকায়। প্রথমবারের মতো একটি দৈনিকে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগের সুযোগও তখন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বয়স কম, তাই বিপ্লবের আকাঙ্খা চোখে-মুখে। যদিও দৈনিক সত্য সংবাদ নামটা পছন্দ হচ্ছিলো না কারো। এ নিয়ে বহু প্যাঁচালের পর সকাল-সন্ধ্যায় বসে সান্ধ্যকালীন নাস্তা করতে করতেই - ঠিক হলো পত্রিকাটির নতুন ট্যাগ লাইন ‘মিথ্যার দুয়ারে হানি আঘাত’। পছন্দ করলেন সম্পাদকও। শুরু হলো নতুন উদ্যমে পথচলা। 
প্রথম কাজ হলো পত্রিকাটির রি-ব্রান্ডিঙ। কারণ মন্টু সম্পাদনাকালে এটি একটি আন্ডারগ্রাউন্ট পার্টিজান পত্রিকা হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। যে কারণে পত্রিকার শুধু কন্টেন্ট নয়, পুরো খোল-নলচে বদলে দেয়ার পরিকল্পনা করলাম আমরা। দিন রাত আলোচনা চলছে। এমন সময় আমরা খেয়াল করি বরিশালের কোনো দৈনিকে আর্টিস্ট/শিল্প নির্দেশক নেই। পত্রিকার চেহারায় নতুনত্ব আনতে এমন একজন মানুষ সাথে থাকা কতটা জরুরী, তা আমাদের শিশুদের মতো তুমুল উৎসাহী সম্পাদককে বোঝাতেও বেগ পেতে হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় আর্টিস্ট/শিল্প নির্দেশক হিসেবে পত্রিকাটির সাথে যুক্ত হন বর্তমানের বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। তিনি তখন রক ব্যান্ড এরিডোনাসের লিড ভোকাল হিসেবেই বেশী পরিচিত। আবার মনির ভাই তাকে চিনতেন বন্ধুর ভাই হিসেবে। রাসেল ভাইয়ের নামটি আমার মাথায় এসেছিলো মূলত তার অলংকরণে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা চিরহরিৎ -এর কারণে। ততদিনে রিপোর্টিং টিম গোছানো শেষ। তবে অর্থ সঙ্কটে সম্পাদনার দায়িত্বে প্রবীণ আর কাউকে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত হলো - রিপোর্টারই সন্ধ্যায় সাব-এডিটরের দায়িত্ব পালন করবেন। একজন অন্যজনের কপি এডিট করবেন।

মীর মনিরুজ্জামান সম্পাদিত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা
নতুন লোগো/নামাঙ্কণ প্রস্তুত হলো হলো। ঠিক করা হলো সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের নতুন কৌশল। মাত্র এক মাসের প্রস্তুতিতে বের হলো মীর মনিরুজ্জামান সম্পাদিত দৈনিক সত্য সংবাদ। আমাদের জানা মতে, যা ছিলো বরিশালে প্রথমবারের মতো ছয় কলাম এ্যালাইনমেন্টের দৈনিক। যার সবগুলো সংবাদ ছিলো অখণ্ড। মানে কোনো খবরের বাকি অংশ অন্য পৃষ্ঠায় খোঁজার প্রয়োজন ছিলো না। নানা আলোচনা-সমালোচনাকে সঙ্গী করে পথ চলতে থাকে পত্রিকাটি। ওই সময় দিন-রাত কাজ করতাম আমরা। মনির ভাই আমাদের জন্য বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে ভাবির রান্না করা খাবার নিয়ে আসতেন। অন্যান্য সহকর্মিদের মধ্যে রাজু হামিদ, শামীম আহমেদ, সুখেন্দু এদবর আর রফিকুল ইসলামের নাম মাথায় আসছে এ মুহুর্তে। পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কবি তুহিন দাস। এছাড়া সুশান্ত ঘোষ, বিধান সরকার, বেলায়েত বাবলু, নজরুল বিশ্বাস, আরিফুর রহমান, প্রয়াত এসএম সোহাগের মতো অনেকে সাংবাদিক বন্ধু তখন অন্য পত্রিকায় থেকেও উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছেন। নিয়মিত অফিসে যাতায়াত ছিলো তাদের। আরো আসতেন প্রবীন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুকুল দাস এবং এমন আরো অজস্র বন্ধুরা। 
পুরানো ফাইল ঘেঁটে দেখছিলাম - মনির ভাইয়ের নেতৃত্বে কি জাতীয় রিপোর্ট করেছিলাম সেকালে। মোনায়েম এখনও ফেরেনি, বরিশালে শিবিরের রাজনীতি থেমে নেই, ফিরে দেখা ২০০৭ : পাঁচ বন্দুক যুদ্ধের রাত, আগরপুরে হিমু গ্রেফতার নাটকের শেষ পর্বে, আজও সদর্পে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা, রক্ষক যখন ভক্ষক - এমন অজস্র শিরোনামে চোখ আটকালো। কতটা সাহসী সম্পাদকের অধীনে কাজ করলে সেনা-আমলেও এ জাতীয় সংবাদ পরিবেশন করা যায় তা পাঠকেরা আন্দাজ করতে পারছেন আশাকরি। দেখলাম ওই সময় ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার অবমূল্যায়ন নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনও করেছিলাম। সক্রিয় ছিলেন অন্যান্য প্রতিবেদকরাও। প্রতিদিন-ই কোনো না কোনো চমক পয়দাকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করতাম আমরা। নিয়মিত অন্য পত্রিকার সংবাদকর্মিদের দিনলিপিও ছাপানো হতো। 

শেষের দিকে বার্তা সম্পাদক শাকিব বিপ্লবের সাথে আমার মনোমালিণ্য চরমে পৌঁছায়। আমার লেখা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তিনি নিজের নামে ছাপােনোর ঘটনায় যার সূত্রপাত। এরই জেরে পরে মনির ভাইকে না বলেই পত্রিকাটি ছেড়ে দিয়েছিলাম। এর ফলে তিনি কিছুটা অভিমানও করেছিলেন। এরপরে অবশ্য স্থানীয় কোনো দৈনিকে আর কাজ করা হয়নি। বস্তুত আমার পেশাদার সাংবাদিকতা জীবনের বরিশাল পর্বের শেষ সম্পাদক মীর মনির। পরে ২০০৯-১০ সালের দিকে বন্ধু পারভেজ অভি আমাদের বরিশাল ডটকম প্রতিষ্ঠার পর সেখানে লেখালেখি করলেও তা ছিলো অনিয়মিত। 

বগুড়া রোডে (বর্তমানে জীবনানন্দ দাশ সড়ক) মনির ভাইয়ের বাসার সামনে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের বেশ বড় একটা ভাস্কর্য ছিলো (এখনো আছে হয়ত)। যে কারণে শহরের অনেকে তাকে ‘দোয়েল মনির’ নামে চিনতেন। বাবার সাথে সালাম বিনিময়ের কারণে ছোটবেলা থেকেই ভাইকে চিনতাম। তার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম - ‘মনির খু্বই ভদ্র, ভালো মানুষ।’ গত বছরের ৩০ অক্টোবর বাবার জন্মদিনে বরিশাল গিয়েই মনির ভাইয়ের সাথে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিলো আমার। বিএম কলেজের সামনে থেকে হাসপাতাল রোডে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার পথে ইজিবাইকে চড়ে সহযাত্রীর আসনে পেয়েছিলাম তাকে। 

ছবিটি তুলেছেন মনির ভাইয়ের দীর্ঘদিনের সহচর শাহীন সুমন
যেতে যেতে খুব অল্প সময়েই আলাপ হয়েছিলো নানা কিছু নিয়ে। কি করি, কেমন আছি - সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন। শেষে নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে নেমে গেলেন। যাওয়ার আগে দিয়ে গেলেন আমার ভাড়াও; আর ছোট্ট করে বললেন - ‘আইসো।’ জবাবে আমিও বলেছিলাম, ‘শিগগির আসবো ভাই।’ সেদিনই ঢাকায় ফিরেছিলাম। যে কারণে সেবার তার সাথে আর দেখা করা হয়নি। পরবর্তী চার মাসে কাজের চাপে বরিশাল যাওয়ার ভাবতেও পারিনি। তবে এখন ভাবছি, খুব দ্রুতই যেতে হবে। কারণ মনির ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত, মানে তার কবর জিয়ারত না করা অবধি প্রাণটা অশান্ত রবে।
গত শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বরিশাল প্রেসক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটির সংগ্রামী নেতা মীর মনিরুজ্জামান। দীর্ঘদিন দৈনিক সত্য সংবাদ সম্পাদনার পর সম্প্রতি তিনি নিজ মালিকানায় দৈনিক বরিশাল কথা নামের একটি পত্রিকা চালু করেছিলেন। তার হাত ধরে সাংবাদিকতায় এসেছেন বরিশালের অসংখ্য সাংবাদিক। যাদের অনেকেই তার ত্যাগী আদর্শ লালন করেই পথ চলছেন। অতএব এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, দেহত্যাগ করলেও খুব শিগগিরই মরছেন না মীর মনির। তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন সংবাদকর্মিদের চিন্তা-কর্মে এবং তার অজস্র পাঠকের স্মৃতির মর্মে। 

০৮ ডিসেম্বর ২০১৬

সত্যও ঘেন্নায় লুকাই!

হায়রে অনলাইন, হায়রে সাংবাদিকতা ..
মাঝে মাঝে জেষ্ঠ্যদের ভয় লাগে তাই
বলে ফেলা প্রিয় সত্যও ঘেন্নায় লুকাই

বস্তুত লুকিয়ে ফেলছি প্রভাবশালী এক প্রতিবেদক বা গণমাধ্যমের পরিচয়। সদ্য প্রয়াত কবি ও রাজনীতিবিদ মাহবুবুল হক শাকিল সম্পর্কে যে বা যারা লিখেছিলো, ‘সাবেক এই ছাত্রনেতার কবিতা লেখার শখ ছিল।’ যারই প্রেক্ষিতে আমি বলেছিলাম, ‘এ আচরণ নিঃসন্দেহে বিবিসির (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিঙ করপোরেসন) খালাতো ভাই সুলভ, হতাশাজনক।’ নেহাতই নির্মোহ ক্ষোভে প্রতিবেদন প্রস্তুতকারির উদ্দেশ্যে আরো বলেছিলাম-

ওহে জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক, আপনি কি জানেন না
কবি ও কবিতা শখ বা সৌখিনতা চোদে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমনটা লেখার কিছুক্ষণের মধ্যেই (৬ ডিসেম্বর ২০১৬ বিকেলে) আলোচ্য এই প্রতিবেদক মোবাইল ফোনে কল করে আমায় রীতিমতো ধমক লাগান। পূর্বপরিচয়ের সুবাদে জেষ্ঠ্যতার অধিকার নিয়ে তিনি হয়ত এমনটা করতেই পারেন। কিন্তু বড় ভাই যখন জেরা শুরু করলেন - শাকিল ভাইকে কবে থেকে চেন? তার কয়টা কবিতা পড়েছ? তার কয়টা বই বের হয়েছে? - তখন রীতিমতো ভড়কে পেলাম। জানালাম আমি শুধু ফেসবুক আর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার লেখা পড়েছি। যে কারণে তিনি যে কবি সে ব্যাপারে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। এরপর ভাই যে স্বরে শুভকামণা জানালেন, তাতে বেশ দ্রুতই স্মরণে এলো তিনি কতটা প্রভাবশালী; আদতেই কতটা ক্ষমতাধরের সন্তান। যে কারণে তার কথাগুলোকে খুবই গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়ে লেখাটি সাথে সাথেই লুকিয়ে ফেলি। এরপর তাকে বার্তা পাঠিয়ে এ খবর জানাই। একইসঙ্গে ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়ে বলি, ‘ক্ষমতাশালীদের রাগকে আমি ভয় পাই।’ যদিও আদতে যতটা ভয় পেয়েছি তার চেয়ে ঘেন্নাই জেগেছে বেশি। পরিশেষে করুণা। ভদ্রলোক মনে হয়ত মনে করেন, কবিরা শখেই কবিতা লেখেন।
পরে অবশ্য বিতর্কিত ওই বাক্য সংশোধনও করেছে গণমাধ্যমটি। মূলত একাধিক কবির সক্রিয়তার কারণে। এসব নিয়ে ভাবতে চাইছিলাম না আর। কিন্তু পরে বুঝলাম না লেখা অবধি বিষয়টা মাথা থেকে তাড়াতে পারবো না। যে কারণে মেলা দিন পর ফের ব্লগের সরণাপন্ন হওয়া। এরই মধ্যে কবি ডাল্টন সৌভাত হীরার লেখা সূত্রে জানলাম, দেশের প্রভাবশালী আরো দৈনিক প্রথম আলো শাকিলের কবি পরিচয় বেমালুম ভুলে গেছে। সর্বত্র তার পেশাগত ও রাজনৈতিক পরিচয়ই গুরুত্ব পেয়েছে। যে কারণে ডাল্টন লিখেছেন, ‘শাকিল ভাইয়ের পরিচয় "কবি'।দ্য ট্রু পোয়েট।এ পরিচয়কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা পৃথিবীর সমস্ত কবিতার অপমান।’ 
‘ধনী কৃষকের অবৈধ সন্তান ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো’ - গত ২৬ নভেম্বর 
কিউবার জাতির পিতার মৃত্যুর পর এমন শিরোনাম দিয়ে তাকে নিয়ে 
সংবাদ পরিবেশন করেছিলো বিবিসির বাংলা বিভাগ। মূল সংস্করণে-
 এ তথ্য যদিও এতটা গুরুত্ব পায়নি। তবুও সে সময় লিখেছিলাম, 
 সংবাদের ভেতরকার একটি সংবাদ শিরোনাম দেখে কি অবাক হচ্ছেন? 
আমি কিন্তু হচ্ছি না। কারণ অনেক আগেই কে জানি বলেছিলো 
‘বিবিসি’ মানে ‘বিলাতি বাঞ্চোত চুতিয়া’! তারই প্রমাণ ইহা।
মৃত্যুর আট দিন আগে শাকিল লিখেছিলেন, ‘মূলত আমি কেউ না, না রাজনীতিবিদ, না কবি, না গল্পকার, এমনকি নই তুমুল সংসারী| এক অভিশপ্ত চরিত্র যার কিছুই থাকতে নেই| সাধু কিংবা সন্ত নই, চোখ জ্বলজ্বল করে জীবনের লোভে| চন্দ্রাহত, বিষাদ এবং ভূতগ্রস্থ, বসে থাকি ব্রহ্মপুত্র ঘাটে, শেষ খেয়ার অপেক্ষায়..’। তার এ লেখাটির কথা স্মরণে এলো আরেক কবি ও সাংবাদিক সাঈফ ইবনে রফিকের লেখা দেখে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চাকরি করার পরও শাকিল কবি ছিলেন, রাজকবি ছিলেন না। রাজকবি হওয়ার বাসনা থাকলে তিনি মরতেন না। অমরত্বের চেষ্টা চালিয়ে যেতেন।’ 

গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে শাকিলের ভূমিকার কথাও এখন প্রকাশিত হচ্ছে অনেকের লেখায়। জানা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের উচ্চমহলে কথিত ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের একমাত্র আশ্রয়টি শেষ হয়ে যাওয়ার খবরও। তাকে ঘিরে নায়োকচিত বহু গল্প, গাঁথা প্রকাশিত হচ্ছে এখন। তবে আমার বন্ধু শিমুল সালাউদ্দিনের কথাটিই মনে ধরেছে। তার মতে, ‘শাকিল প্রকৃত কবির মতোই মারা গেছেন।’ মৃতদেহ উদ্ধারের মাত্র ১৬ ঘন্টা আগে ফেসবুকে পোস্ট করা তার শেষ লেখাটিও ছিলো একটি কবিতা। 

ছবিঃ ডেইলি স্টার (বাংলাদেশ)
এলা, ভালবাসা, তোমার জন্য

কোন এক হেমন্ত রাতে অসাধারণ
সঙ্গম শেষে ক্লান্ত তুমি, পাশ ফিরে শুবে।
তৃপ্ত সময় অখন্ড যতিবিহীন ঘুম দিবে।
তার পাশে ঘুমাবে তুমি আহ্লাদী বিড়ালের মতো,
তার শরীরে শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে, মাঝরাতে।
তোমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে এক প্রগাঢ় দীর্ঘশ্বাস,
আরো একবার তোমাদের মোথিত চুম্বন দেখবে বলে।
মৃতদের কান্নার কোন শব্দ থাকে না, থাকতে নেই,
নেই কোন ভাষা, কবরের কোন ভাষা নেই।
হতভাগ্য সে মরে যায় অকস্মাৎ বুকে নিয়ে স্মৃতি,
তোমাদের উত্তপ্ত সৃষ্টিমুখর রাতে।

প্রকাশক রবীন আহসানের কথা দিয়ে শেষ করছি। তিনি লিখেছেন, ‘এদেশে কিন্তু এখনো কবির দাম বেশি বই বিক্রি না হইলেও কবির কদর বেশি! তাই হাজার হাজার মানুষ কবিতার বই ছাপাইতে আসে ট্যাকাটুকা দিয়া! কত কত কবির জীবন নষ্ট হয়-কবিতা হয় না! কবিতা হয় না তারা পুরস্কার কেনে পয়সা দিয়া সভা-সমিতি করে বেরায়! এসবের মধ্যে দিয়া আবার ও প্রকৃত কবি আত্মহত্যা করে কবি হয়ে ওঠে এদেশের মানুষের প্রিয় কণ্ঠস্বর...’

১০ আগস্ট ২০১৬

তারা গুজব রটিয়েছে না চিহ্নিত করেছে?

হে মহান রাষ্ট্র আমার, ধরার তামাম নাগরিক কবির মতো আমিও ‘বিশেষ’ ভয় পাই কাঠােমাকে আপনার। তবু ভীরু মন নিয়ে এটুকু অন্তত বলতে চাই, গত রাতে (৭ আগস্ট) আপনার ‘বিশেষ’ বাহিনী র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব) দ্বারা আক্রান্ত সংবাদমাধ্যম ‘বাংলামেইল২৪ডটকম’ গুজব রটিয়েছে না রটনাকারীকে চিহ্নিত করেছে তা দয়া করে পুনর্বিবেচনা করুন।

জানা মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদের 'মিথ্যে মৃত্যুসংবাদ' প্রচারকারী ‌টুডেনিউজ৭১ডটকম’র সংশ্লিষ্ট খবরটি যে ‘ভিত্তিহীন, গুজব’ ছিলো - তা’ই জানিয়েছে বাংলামেইল। তাদের অবস্থা অনেকটা খুনীকে ধরিয়ে দিতে গিয়ে ফেঁসে যাওয়া বাংলা সিনেমার ট্র্যাজিক হিরোদের মতোই। শনিবার (৬ আগস্ট) প্রকাশিত টুডেনিউজ৭১.কম’র সংবাদ শিরোনাম ছিলো - ‘বিমান দূর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী পুত্র “জয়” নিহত’। আর রোববার (৭ আগস্ট) দুপুরে বাংলামেইল প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিলো ‘বিমান দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয়ের মৃত্যুর গুজব!’
বাংলামেইল'র প্রতিবেদনে ওই ভুয়া খবরের সমালোচনার পাশাপাশি এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেনের বক্তব্যও ছিলো। তিনি বলেছেন, 'যারা জীবিত জয়কে মেরে ফেলেছে, তারা জয়কে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। এ ধরনের সংবাদে এটাই প্রমাণ হয়, এ চক্রটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করছে।' ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান ।
তথাপি গুজব রটনাকারী টুডেনিউজ৭১.কম’র কাউকে না ধরে র‌্যাব বাংলামেইল’র সাংবাদিকদের আটক করেছে। গুজব ছড়ানো গোষ্ঠীেকে ধরিয়ে দিতে গিয়ে কি বিপদেই না পড়েছে তারা! বাংলামেইল’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মো. সাহাদাত উল্যাহ খান, নির্বাহী সম্পাদক মাকসুদুল হায়দার চৌধুরী ও সহ-সম্পাদক প্রান্ত পলাশকে আটকের এ ঘটনায় আমি যারপরনাই উদ্বিগ্ন।

দেশ বিদেশের গণমাধ্যমে এ ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদগুলো পড়ছিলাম। দেশের একটি পত্রিকাতেই দেখলাম বাংলামেইলের এক সাংবাদিক বলেছেন, প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের এক কর্মকর্তা সংবাদটি সরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তারা তা করেননি। পরে রাত ১১টার দিকে র‌্যাব সদস্যরা অফিসে এসে ওই তিন জনকে নিয়ে যায় এবং যে কম্পিউটারে বসে সংবাদটি লেখা হয়েছিল, সেটি জব্দ করে। যাওয়ার আগে সব সাংবাদিক-কর্মচারিকে বের করে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান দরজায় তালা ঝুলিয়ে যায় তারা।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান দৈনিক সমকালকে বলেছেন, 'সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে একটি মিথ্যা খবর প্রকাশের অভিযোগে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে।' এর আগে র‌্যাব-০৩’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার গোলাম সারওয়ার বিবিসি বাংলা’কে বলেছেন, 'অনলাইন নিউজ পোর্টালটিতে প্রকাশিত একটি খবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদের 'মিথ্যে মৃত্যুসংবাদ' প্রচার করা হয়েছে।'

অভিযান চালানোর পর পত্রিকাটির কার্যালয় 'আপাতত' বন্ধ রাখা হয়েছে জানিয়ে সারওয়ার বলেেছন, 'অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের পরেই সিদ্ধান্ত হবে তাদের গ্রেফতার করা হবে, নাকি ছেড়ে দেয়া হবে।' পত্রিকাটির ব্যাপারেও জিজ্ঞাসাবাদের পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি জানান।

এর আগে গত সপ্তাহে বাংলাদেশে সরকারের নির্দেশে ৩৫টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। যার মধ্যে বেশ কিছু ডানমনা সংবাদমাধ্যমও ছিলো। বাংলামেইল'র মালিক আজিম গ্রুপের কর্ণধার ফজলুল আজিম ওয়ান এলিভেনের সময় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত রাজনীতিক, সাবেক সংসদ সদস্য (হাতিয়া)। ২০১৩ সালের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিলো বাংলামেইল২৪ডটকম। জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদের মিডিয়া সেন্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেছিলেন।

প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক আসাদুজ্জামান সম্রাটের বদৌলতে শুরুর দিকে আমিও কিছুদিন জড়িত ছিলাম এ উদ্যোগের সাথে। শুধু সে জন্য নয়, বেসিকালি বাংলামেইলকে অন্তত পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়নি কখনো। তাই আবার বলছি হে মহান রাষ্ট্র, ‘বাংলামেইল২৪ডটকম’ গুজব রটিয়েছে না রটনাকারীকে চিহ্নিত করেছে তা দয়া করে পুনর্বিবেচনা করুন। প্রকৃত অপরাধীকে ধরুন।

আর একটা একান্ত অনুরোধ; পারলে ‘প্রকৃত’ সাংবাদিকদের ব্যাপারে আরেকটু সংবেদনশীল হোন। ছদ্মদের অপকর্মের দায় যেন - এদের না নিতে হয়।

[গত ৮ আগস্ট ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলাম লেখাটি। সংরক্ষণের জন্য এখানে লিপিবদ্ধ করে রাখলাম।]
newsreel [সংবাদচিত্র]