আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্রগুলো সেই ব্রিটিশরা দিয়ে গেছে। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো সংবাদ পেয়ে থাকলে সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। কোনো সংবাদপত্র যদি কোনো গোপন সংবাদ প্রকাশ করে তবে প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশক অপরাধী হবেন। এসব কাজে সহায়তা করা অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ একই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে।’ ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নক্সা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো বিদেশী এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা যাবে না।’
আবার আদালত অবমাননা আইন-১৯২৬ অনুযায়ী বিচারাধীন মামলার নিরপেক্ষ বিচারকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে কোনো প্রকাশনা প্রকাশিত হলে তা আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য যদি দায়িত্বহীনভাবে নিরপেক্ষ সমালোচনার সীমা অতিক্রম করে এবং নির্দেশিত ও পরিকল্পিত পন্থায় বিচারকাজের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বিনষ্ট করে এবং বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে বিচারকদের বাধাগ্রস্ত করে এবং মৌলিক অধিকার বলবৎ করার পথে বাধা প্রদান করে বা সংবিধান পরিপন্থী কর্মের মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি করে, তবে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। যদি কোনো ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিকে আক্রমণ করে অযৌক্তিকভাবে কোনো প্রবন্ধ লেখে ও প্রকাশ করে তাহলে সে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হবে। যদি দেখা যায় যে প্রবন্ধটি আদালতের মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তাহলে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। তবে, জনস্বার্থে বিচার কার্যের নিরপেক্ষ ও যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা আদালত অবমাননা নয়। আদালত অবমাননার শাস্তি কারাদন্ড, যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে অথবা জরিমানা, যার পরিমাণ দুই হাজার টাকা হতে পারে অথবা উভয়ই। ক্ষমা প্রার্থনা করলে অবমাননার আসামীকে মুক্তি দেওয়া যায়।
এদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ (ক) (খ) (গ) (ঘ) (ঙ) (চ) ধারায় সংবাদপত্র বিষয়ে সরকারকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সরকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতামূলক বা বিদ্রোহের উসকানিমূলক বা নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টিকারী বা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞামূলক কোনো লেখা যদি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তবে সরকার তার প্রত্যেকটি কপি বাজেয়াপ্ত করতে পারে এবং যে স্থানে ঐগুলি থাকে সেই স্থানে ম্যাজিস্ট্রেটের পরওয়ানামূলে পুলিশ যেতে পারে; তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এ বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের গোচরে আনতে পারে।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ম্যাজিস্ট্রেট সেইসব ব্যক্তিকে মুচলেকা দেবার আদেশ দিতে পারেন যারা রাষ্ট্রদ্রোহীতামূলক বা শ্রেণীর সংঘর্ষ সৃষ্টিকারক বা বিচারককে ভীতি প্রর্দশনমূলক বা অবমাননাকর কোনো কিছু প্রকাশ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিককে তার নির্দেশিত স্থানে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেন।
এসব আইন নিয়ে আমার সহযোদ্ধা সাংবাদিকরা কোনো কথা বলছেন না। তারা সরব হয়েছেন সদ্য (২৯ জানুয়ারি) মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ৩২ ধারা নিয়ে। অথচ আলোচিত এ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি ‘বেআইনিভাবে প্রবেশ করে’ কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে।এতে সাংবাদিকরা ভয় পাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। তারা কিন্তু কোথাও অবৈধভাবে প্রবেশ করেন না। খোদ সরকারও তথ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের প্রবেশপত্র (অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড) দেয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাগত গুরুত্ব বিবেচনায় অনেক দপ্তর ও স্থাপনায় যেতে অবশ্য ওই প্রবেশপত্রের পাশাপাশি আলাদা নিরাপত্তা ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বেআইনি নয়, রাষ্ট্র স্বীকৃত। অতএব তাদের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহকে গুপ্তচরবৃত্তি হিসাবে গন্য করার সুযোগ নেই। তবে সাংবাদিকতার আড়ালে যে কেউ কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করছে না, তা কি আমরা (সাংবাদিকরা) জোর গলায় বলতে পারি? সাংবাদিক সেজে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের বহু কেচ্ছা অন্তত সব্বাই জানি। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এ জাতীয় অনাচার রুখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রকৃত সাংবাদিকতাকে বাঁধা দেয়ার শক্তি কোনো বিধানের নেই। নানা আইনের বিবিধ ধারা সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের চ্যালেঞ্জটা সামান্য বাড়াবে হয়ত।
জাতীয় সংসদে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বহুল আলোচিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধগুলো নতুন আইনের কয়েকটি ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে নীতিগতভাবে অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ধারা ১৯-এ মানহানি, মিথ্যা ও অশ্লীল, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং ধারা ২০-এ শত্রুতা সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতিসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়েছিলো। এসব বিষয় একই সঙ্গে দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৯ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ধারা ৫৭-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় এ সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তিগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছে।
খসড়ার ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য প্রেরণ করে, অন্য ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ করে, মিথ্যা তথ্য জানার পরও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করে তাহলে সেটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ অপরাধের শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এসব অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’ ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিছু প্রকাশ করে তাহলে সেটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ ধরনের অপরাধ করলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’
আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে পেনাল কোডের সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ করে তাহলে তার তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এ অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’ আর ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা বিভিন্ন শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার বা বারবার এ অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এ ধারাটিকে অজামিনযোগ্য করা হয়েছে।’
এর আগে মন্ত্রিসভা ২০১৬ সালের ২২ জুলাই এ আইনের প্রাথমিক খসড়াটি নীতিগতভাবে অনুমোদন করে। সে খসড়ায় জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণার মদদ দেয়ার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিলো। কিন্তু যাবজ্জীবনের মতো কঠোর শাস্তির বিধান রাখায় সংশ্লিষ্ট সবাই একমত হতে পারেনি। সেই কঠোর অবস্থান থেকে এবার নমনীয় হয়েছে সরকার। ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি ও কারাবিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ হল ৩০ বছর কারাদণ্ড। এ অবস্থায় খসড়া আইনে অপরাধের শাস্তি কমিয়ে অনধিক ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন