“আমার বন্ধু অমিভাত রেজা চৌধুরীর প্রথম ছবি ‘আয়নাবাজি’। বাংলাদেশের সিনেমার মানচিত্রে এক নতুন সংযোজন। কলকাতার ছবির তরঙ্গ যেভাবে ঢাকায় দোলা দেয়, উল্টোটা কখনোই ঘটে না। অমিতাভের এই ছবি শুধুমাত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই আলোড়ন সৃষ্টি করবে না, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গকেও নাড়া দেবে। এই শহরে মুক্তি পেলে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়বে অমিতাভ রেজার প্রথম ছবি আয়নাবাজি দেখতে।।” গত বছর আয়নাবাজি সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর, সম্ভবত ৮ অক্টোবর মুখবইয়ে এমনটা লিখেছিলেন ভারতের প্রথিতযশা বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিত সেন। নির্মাতা অমিতাভকে অভিনন্দন জানিয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার এই শিক্ষক আরো উল্লেখ করেছিলেন, সিনেমাটি গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আন্তর্জাতিক বিভাগে প্রদর্শণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
শীতটা তখন একদমই যাই যাই করছে, আর বসন্ত আসি আসি। মাত্র ক’দিন আগেই সেনাসমর্থিত সরকার এসেছে দেশে। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। তবে বন্ধু-স্বজন, সহকর্মিসহ আশেপাশের সবাই কেমন যেন ভীত, তটস্থ। বলছিলাম ২০০৭’র ফেব্রুয়ারির কথা। তখন আমি সাপ্তাহিক ২০০০’র বরিশাল প্রতিনিধি। দিনের বেলায় শুধু ছুট আর ছুট, সংবাদের সন্ধানে দৌড়াদৌড়ি। রাত দুপুরে ঘরে ফিরে খাবার খেতে খেতে পড়ছিলাম পত্রিকার ভালোবাসা দিবস (৯ ফেব্রুয়ারি) সংখ্যা। অমিত সেনের মুখবইয়ের লেখাটি পড়ে স্মরণে এলো সেই রাতের কথা। কারণ সেদিনই আমি প্রথম তাকে চিনেছিলাম। ২০০০’র আলোচ্য সংখ্যা প্রকাশিত এক যৌথ সাক্ষাতকারে দেখেছিলাম আলোচিত নির্মাতা অভিতাভ রেজা বলছেন, ‘অমিত সেন আমাকে প্রথম উৎসাহ দেন বিজ্ঞাপন নির্মাণের। আমি তাকে অ্যাসিস্ট করি অল্প সময়। এরপর বিজ্ঞাপন নির্মাণ শুরু করি। আর আমাকে পিছনে ফিরতে হয়নি।’ একই সাক্ষাতকারের আরেকাংশে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে মুম্বাইয়ের অনেক ভালো মেকারও কাজ করছেন। যার মধ্যে রয়েছেন অমিত সেন। আমি এটা স্বীকার করবো যে, অমিত সেনদের কাজ দেখে অনেক কিছুই শিখেছি।’ অমিতাভ আরো বলেছিলেন, ‘অমিত সেন মুম্বাইয়ের অন্যান্য নির্মাতার চেয়ে অনেক আলাদা। তিনি এ দেশে ক্লায়েন্টদের (বিজ্ঞাপনদাতাদের) কাছে গিয়ে বলেছেন, তোমরা এদেশের ছেলেদের প্রমোট করো।’ সঙ্গে থাকা আরেক বিখ্যাত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও তখন বলেছিলেন, ‘অমিতাভ যেটা বলল, এটা অমিত সেনের ভালো দিক।’ এর বহু বছর পর ২০১৪ সালে অমিত সেনের কল্যাণেই অমিতাভের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনিস্টিটিউটের বিপরীতে ঘটা সেই আচমকা সাক্ষাত অনুষ্ঠানে প্রয়াত নির্মাতা রাসেল আহমেদ, চিত্রগ্রাহক ড্যানিয়েল ড্যানিসহ আরো অনেকেই ছিলেন - যদ্দুর মনে পড়ে।
রাসেল আহমেদের পাশে অমিত সেন
চিত্রটি ড্যানিয়েল ড্যানি তুলেছিলেন
এতদিন বাদে এসব কথা যেসব কারণে স্মরণে আসছে তার সবকিছু এখন বলতে চাচ্ছি না আসলে। তবে নিশ্চয়ই বলবো কখনো সময় ও সুযোগ পেলে। আপাতত শুধু জানাই, ঠিক তার কিছু দিন আগে স্বাধীন চলচ্চিত্র ‘নৃ’ নির্মাণ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন অমিত সেন এবং তার আইলেভেল ফিল্মস। সিনেমাটির অর্থায়ন যোগাতে বিজ্ঞাপনের কাজ যোগাড়ের পাশাপাশি তিনি আরো বহুমুখী উদ্যোগ নেন। এটা নির্ধিদ্বায় বলা যায় যে তিনি পাশে না দাঁড়ালে হয়ত রাসেল আহমেদের এ চলচ্চিত্র চিত্রায়ন পর্বেই আটকে যেত। দেশের নির্মাতাদের মধ্যেও যারা ওই সময় নৃ -এর পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক ও মানুসিকভাবে আমাদের শক্তি যুগিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আনোয়ার শাহাদাত, বিজ্ঞাপন নির্মাতা পিপলু আর খান, কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুর এবং শিল্পী ও নির্মাতা অঙ রাখাইন অন্যতম। গত মে মাসে যখন এডিটিং টেবিলে সিনেমাটির চূড়ান্ত সম্পাদনা চলছে, ঠিক সেই মুহুর্তে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন রাসেল। নির্মাণ শুরুর প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় আবার থমকে যায় নৃ। আটকে যায় কাজ। তৈরী হয় নানামুখী শঙ্কা। এ নিয়ে যখন নানাবিধ হতাশায় ডুবে যাচ্ছি ঠিক তখনই আবার কাঁধে হাত রাখলেন অমিত সেন। জানতে চাইলেন সিনেমাটির সর্বশেষ অবস্থা, জানালেন তার চিন্তার কথাও। আবার আশাবাদী হলো আমার চলচ্চিত্র শ্রমিক সত্তা।
বাংলাদেশ বা বাংলাদেশী সিনেমা বা নির্মাতাদের জন্য যে মানুষটির মন এত কাঁদে তিনি এদেশে নিষিদ্ধ হয়ে আছেন সেই ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে। ওই সময় তার পিআই (পারসোনাল ইনভেস্টমেন্ট) ভিসা বাতিল করে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই থেকে আজ অবধি বাংলাদেশে কাজ করতে পারছেন না এ নির্মাতা। গত এক দশক ধরেঅমিত সেনের বাংলাদেশী বন্ধু বা সাবেক সহকর্মিরাও এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চুপ। অবশ্য তাকে নিষিদ্ধ করার কারণ জানার চেষ্টা করে একাধিক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ধমক খেয়েছেন কয়েকজন। এরপরও তিনি বহুবার ভিসার জন্য আবেদন করেছেন এবং বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। এর নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার সাংবাদিক সত্ত্বা যে ধরণের ‘ব্যক্তি-বিদ্বেষ’ খুঁজে পেয়েছে তা কিছুটা ইগো আর কিছুটা ব্যবসায়িক। মূলত প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী চাচ্ছে না অমিত বাংলাদেশে আসুক বা এখানে কাজ করুক। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই আন্তর্জাতিকমানের ‘ট্রিলজি’বানানোর চিন্তা তিনি লালন করছেন চলচ্চিত্র-জীবনের শুরু থেকে।
বাংলাদেশ আর এর স্বাধীনতার সাথে যে অমিত সেনের পরিবারের আদি ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে। বরিশাল অঞ্চলের ঝালকাঠীর বেউখির গ্রামেই শেকড় তাদের। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর দেশ ত্যাগ করা এ পরিবারের সন্তান রঞ্জিত কুমার সেনগুপ্ত আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে; আহতও হয়েছিলেন। এর আগে ১৯৬২ সালে চৈতালী সেনগুপ্তের সাথে বিয়ে হয় তার। তার বাপের বাড়ি ফরিদপুর হলেও সে’ও বড় হয়েছে বরিশালেই। যারই জেরে রঞ্জিত ও চৈতালী - দুজনেই ছিলেন প্রায়ই একই মাত্রার পূর্ববঙ্গ অন্তঃপ্রাণ। বিয়ের ক’বছর পর এমনই এক ডিসেম্বরে তারা যখনে নেপালের কাঠমুণ্ডুতে, ঠিক তখনই তাদের কোলে আসে একমাত্র সন্তান অমিত।বাংলাদেশ নিয়ে তিনি যে সিনেমাগুলো তৈরী করতে চান তার চিত্রনাট্য তৈরীর গবেষণায় সংযুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নতুন করে জানার সুযোগ হয়েছিলো আমার। যারই বদৌলতে এ লেখাটি তৈরীর সাহস পেলাম। কারণ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিই এখন দেশের ক্ষমতায়। আর এই যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র ধারাবাহিক তৈরীর জন্য অমিতের ফেরাটা খুবই জরুরী। এ কথা পড়ে আমাকে ভারতের দালাল বলে গালি দিতে পারেন অনেকে। তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি, অন্তত আমার দৃষ্টিতে তিনি মানুসিকভাবে যতটা ভারতীয় তার চেয়ে অনেক বেশী ‘বরিশাইল্যা’। এ নিয়ে ইতিপূর্বেও ব্যক্তিগত ব্লগে লিখেছিলাম। ইন্টারনেটের যে কোনো সার্চ ইঞ্জিনে সেনের প্রত্যাবর্তন বা বোলপুরে বরিশালের রান্না ঘর লিখে সন্ধান করলেও তা মিলে যাবে।
ফটোগ্রাফী : এমএসআই প্রিন্স
আজ ৬ ডিসেম্বর। নির্মাতা ও শিক্ষক অমিত সেনের জন্মদিন। বাংলাদেশের সংবাদ, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতের একজন নবীশ প্রতিনিধি হিসাবে আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাকে পরম শ্রদ্ধা জানাই। আর নিজ রাষ্ট্রের কাছে দাবি রেখে বলতে চাই, অমিত সেনকে এদেশে কাজ করার সুযোগ দেয়া হোক। প্রত্যাশায় রাখি এই লেখাটি দেখবে বর্তমান সরকারের নীতি-নির্ধারক কোনো চোখ। কাকতালীয়ভাবে একাত্তরে অমিত সেনের এই জন্মদিনেই দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও ভুটান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে।
দীপন ভাই, মানে ফয়সল আরেফিন দীপন মৃত্যুর ঠিক আগের দিন (৩০ অক্টোবর ২০১৫) বিকেলে দীর্ঘদিন পর শাহবাগ গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথেই ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে গিয়ে ভাইয়ার নতুন অফিস দেখে আসবো।কিন্তু ছবির হাটের বন্ধুদের সাথে বিবিধ আলাপে ডুবে আর যাওয়া হয়নি সেদিকে; মেতে ছিলাম আড্ডায়। পরদিন মার্কেটের তৃতীয় তলার সেই অফিসেই তিনি খুন হন।
খুব বেশীদিন আগের নয়, ২০১৩ -এর এপ্রিলের কথা। দীপন ভাইয়ের সাথে আলাপের সূত্রপাঠ হয়েছিলো সিনেমা নিয়ে। মূলত তার মুখবইয়ের ভেতরবাক্সে রাসেল আহমেদ পরিচালিত নৃ - চলচ্চিত্রের পাতার সংযোগ দেয়ার মাধ্যমে। পরে সিনেমা ছাড়াও কবিতা, ব্লগিং, প্রকাশনা থেকে শুরু করে ধর্ম, দর্শন, এমনকী জীবন বোধ নিয়েও আলাপ হয়েছে তার সাথে। তবে আমাদের প্রথম সাক্ষাত হয় অনেক পরে, ২০১৪ -এর জানুয়ারিতে; নিজস্ব প্রকাশনী কাদাখোঁচা যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে। এর নামকরণের পাশাপাশি নামাঙ্কণও করে দিয়েছিলেন নৃ -এর নির্মাতা।
কিভাবে কি করা যায় - শুধু তা’ই জানতে নয়, ‘জাগৃতি’ আমাদের প্রকাশনাগুলোর পরিবেশক হবে - এমন আবদার নিয়েই গিয়েছিলাম দীপন ভাইয়ের কাছে। সানন্দে রাজিও হয়েছিলেন তিনি এবঙ জানিয়েছিলেন - প্রকাশকের মৌলিক দায়িত্ব, কর্তব্যের কথা। আলাপ হয়েছিলো দেশের প্রকাশনা শিল্প আর সিনেমার দুরাবস্থা নিয়ে। তখনও দীপন ভাইয়ের অফিস মার্কেটের দোতলায়। সেখানে বসেই কথা বলছিলাম আমরা। যদ্দুর মনে পরে প্রিয়মুখ প্রকাশনীর প্রধান - গল্পকার আহমেদ ফারুক কে সেদিন দেখেছিলাম সেখানে ।
স্যার এবঙ আপার এ ছবিটি ফেসবুকে পাওয়া
সেই প্রথম সাক্ষাতের পরও আমাদের সামনা সামনি খুব বেশী দেখা হয়েছে, এমন নয়। কদাচিৎ দীপন ভাইয়ের অফিসে গিয়ে হানা দিয়েছি। তার তুমুল ব্যস্ততাকে তোয়াক্কা না করে জোর করে হলেও শুনিয়েছি নিজের উদ্ভট সব গ্রন্থভাবনা। তিনিও আবার মনযোগ দিয়ে শুনেছেন - পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। কখনো কখনো সেখানে গিয়ে স্যার, মানে দীপন ভাইয়ের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে পেয়েছি। কোনো এক মার্চের এক দুপুরে জলি আপা, মানে ভাইয়ার স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলির সাথেও দেখা হয়ে যায়। সেদিন মূলত আমার প্রকাশ করা বইগুলো জাগৃতির বিক্রয় কেন্দ্রের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। বইগুলোর মধ্যে একটি ছিলো আমার নিজের কবিতার বই। সেটার ফ্ল্যাপে নিজের সাম্প্রতিক কোনো ছবি না দেয়া নিয়ে ভাইয়া-আপার যৌথ অনুযোগ; আহা- কি মধুর লেগেছিলো।
এর আগে দীপন ভাই বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোর নানাবিধ সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে সেই ভুলগুলো আগামীতে আর না হয়। আহা, কী অল্প সময়ে কত অজস্র আলাপ হয়েছে আমাদের। কত ভরসা, কত প্রাণশক্তিতে ভরা মানুষটা - যার প্রয়ান সংবাদ আমায় উপহার দিয়েছে এক দীর্ঘ ট্রমা। যা আজও পুরোপুরি কেটেছে কি-না তা ঠিক ঠাওর করতে পারছি না।
দীপন ভাইকে একদিন স্বপ্নেও দেখেছিলাম। ঠিক কোথায় বুঝিনি। তবে তিনি বেশ হাসি খুশি। তাকে দেখেই আমি বোকার মতো জানতে চাইলাম - ‘ভাইয়া, আপনি মারা যান নাই?’ সে অবাক হয়ে বললো - ‘কে বলছে তোমাকে?’ আমি বললাম, ‘টিভিতে যে দেখলাম!’ ভাইয়া হেসে কিছু একটা বললেন - যা আমার ঠিক বোধগম্য হলো না। শুধু ‘মিডিয়া’ শব্দটা বুঝতে পেরেছিলাম। এরপরই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো।
সেদিনের আগে, পরে বহুদিন ভেবেছি - একদিন জাগৃতিতে যাবো। সেখানকার কী অবস্থা তা খোঁজ নেবো। কিন্তু পরক্ষণেই যখন জলি আপা বা ফজলুল হক স্যারের মুখটা মনে পরেছে; প্রচণ্ড গ্লানিতে অবসন্ন হয়েছে মন। আমার আপোষকামী নীরবতাপুষ্ট প্রতিবাদহীন বেহায়া মুখটা নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াই কী করে, তা ভেবে পাইনি আজও।
দীপন ভাই মারা যাওয়ার পর অবশ্য মাত্র দুই/তিন বার আজিজ মার্কেটে যাওয়া হয়েছে; তা’ও তারই সহযাত্রী শ্রাবণ প্রকাশনীর রবীন আহসান ভাইয়ের কাছে। সর্বশেষ গত মাসেই তার কাছে গিয়েছিলাম ‘রাসেল স্মরণ’ - পত্রিকাটি বিনামূল্যে ছাপানোর আবদার নিয়ে, ছেপেও দিয়েছেন। বুঝেছেন-তো কোন রাসেল? সেই যে সেই নৃ-এর নির্মাতা। তিনিও এখন প্রয়াত। যিনি দীপন হত্যাকাণ্ডের পর ফজলুল হক স্যারের উদ্দেশ্যে মুখবইয়ে লিখেছিলেন - ‘স্যার, আমরা সত্যি ব্যর্থ আজ দেশটাকে সুস্থ, সুন্দর করে সাজাতে। এ ব্যর্থতার দায় - সবার। আমাদের ক্ষমা করবেন।’ এর আগে এক সাক্ষাতকারে স্যার বলেছিলেন - 'আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই না। এদেশের কোর্ট-কাচারিতে বিচার হয় না। তাই বিচার চেয়ে লাভ নেই।মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।'
গত বছর, মানে ২০১৬ সালে টানা তিন মাস সাংবাদিকতা করার সময় দীপন ভাইকে দুইবার স্মরণ করার সুযোগ ছিলাম। প্রথমবার ১৯ জুন - বাবা দিবসে, পরেরবার ১২ জুলাই - তার জন্মদিনে। সেই লেখাদুটোও পাঠকদের জন্য নীচে সংযুক্ত করলাম। তবে তার আগে একটা সুখবর দিয়ে যাই।
দীপনপুরের প্রস্তুতি বৈঠক
দীপন ভাইয়ের আসন্ন জন্মদিনে, অর্থাৎ আগামী ১২ জুলাই যাত্রা শুরু করছে বইয়ের মেগাসপ দীপনপুর। জাগৃতির পক্ষ থেকে জলি আপা এবং প্রিয়মুখের ফারুক ভাই দিন-রাত খেটে চলেছেন। তাদের সাথে রয়েছে ভাইয়ার বন্ধু-স্বজনরা। ২৩২, ২৩০ এলিফেন্ট রোড হচ্ছে এই উদ্যোগের ঠিকানা। উন্নত বিশ্বের বুকসপ কাম ক্যাফে যে স্টাইলে চলে দীপনপুরও সেভাবে চলবে। এখানে থাকবে চিলড্রেন্স কর্ণার, ওল্ড সিটিজেন ক্লাব, যে কোনো বই হোম ডেলিভারীর ব্যবস্থা, মিনি অডিটোরিয়ামসহ আরো অনেক কিছু।যার কোনোটার নাম দীপনতলা, কোনোটা দীপনগঞ্জ, কোনোটা দীপাঞ্জলি বা দীপনালয়।
এটির ব্যাপারে গত বছরের নভেম্বরে আহমেদ ফারুক বলেছিলেন, ‘নতুন বছর থেকে বইয়ের এক নতুন মাইলফলকে পৌছে যাচ্ছে জাগৃতি আর প্রিয়মুখ। ইচ্ছে ছিলো এই প্রজেক্ট শুরু করবো দীপন ভাইয়ের সাথে। ২০১৪ সালে এই বিষয় নিয়ে কথাও হয়েছিলো ওনার সাথে। একটা বইয়ের মেগাসপ দেয়ার স্বপ্ন যেমন আমি দেখতাম, তেমনি দেখতেন দীপন ভাইও। আজ উনার স্বপ্ন পূরণের জন্যই মেগাসপ হচ্ছে। নামও রাখা হয়েছে তার নামেই। দীপন ভাইয়ের জাগৃতির দায়িত্ব নেয়া জলি আপাও (সবাই ওনাকে ভাবী বললেও আমি আপাই বলি) অনেক কষ্ট করছেন স্বপ্নটা পূরণ করতে। উনি উদ্যোগটা না নিলে সম্ভবই হতো না।’
ফারুক জানান তাদের প্রাথমিক টার্গেট এক লাখ বই। পাঠকের হাতের নাগালে যে কোনো পছন্দের বই পৌঁছাতেই এই উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘বই, বই আর বই- এই নিয়েই দীপনপুর। আসছে শিগগিরই...’। একই সময়ে ‘দীপন চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত রাখতে চাই’ বলে উল্লেখ করেছিলেন জলি আপা। সর্বশেষ গত এপ্রিলে তিনি মুখবই-তে লিখেছেন, ‘খুব স্বল্প ক্ষমতার একটা মানুষ যখন খুব বড় একটা কাজ হাতে নেয়, তখন পদে পদে সে ঠেকে যায়। তাই বিলম্ব হয়, তবুও হাল ছাড়েনা। দীপনপুর, আর মাত্র অল্প দূর।’
এবারই প্রথম বাবাকে ছাড়া বাবা দিবস কাটছে স্কুল পড়ুয়া রিদাত আর রিদমার। গত বছর জুনের তৃতীয় রোববারও বেঁচে ছিলেন তাদের বাবা ফয়সল আরেফিন দীপন। সেবার কিভাবে তারা এ দিনটি কাটিয়েছে বা এবার কিভাবে তাদের এ দিনটি কাটছে, জানার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু কিছু শুধানোর সাহস হয়নি। আমার প্রশ্ন ওদের কতটা কষ্ট দিতে পারে তা আন্দাজ করেই কুঁকড়ে গিয়েছি। অতটা ‘প্রফেশনাল’ হতে পারিনি বলেই প্রতিবেদনটি ঠিক প্রতিবেদন হয়ে ওঠেনি।
ফেসবুক ইনবক্সে রিদাত, রিদমার মা; মানে প্রয়াত দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলিকে বলছিলাম – ‘রিদাত আর রিদমার বাবাহীন প্রথম বাবা দিবস আজ।’ জবাবে তিনি বললেন – ‘তাতে এই নীল গ্রহটার কিছুই যাবে আসবে না যে।’ লেখক ড. জাফর ইকবালের সাথে দাঁড়ানো রিদাত আর রিদমার একটি ছবি শনিবার ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলেন জলি। ক্যাপসনে লিখেছিলেন, ‘বাবার পোশাকগুলো রিদাত পরছে ইদানীং, মাঝে মাঝে রিদমাও।’
ধারাবাহিক গুপ্তহত্যার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর নিজ প্রকাশনার কার্যালয়ে খুন হওয়া দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের কথাও স্মরণে আসে। তার দুই সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিলেন দীপন। স্মরণে আসেন অভিজিৎ রায়ের বাবা শিক্ষাবিদ অজয় রায়, তার কন্যা তৃষা আহমেদ। নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনির সন্তান মেঘের কথাও মনে পরে। বাবাকে ছাড়া কতগুলো বাবা দিবস কেটেছে তার, সে হিসাবটাও করতে ইচ্ছে করেনি আর।
‘শুভ জন্মদিন দীপ জ্বেলে যাওয়া দীপন।’ এভাবেই প্রয়াত সহযোদ্ধা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা ফয়সল আরেফিন দীপনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল। মঙ্গলবার ফেসবুক’এ জাগৃতির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা এক স্মরণ স্মারকে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
গত ৩১ অক্টোবর একই সময়ে, একই কায়দায় হামলা চালানো হয়েছিলো দীপন ও টুটুলের ওপর। এরমধ্যে টুটুল বেঁচে গেলেও দীপন বাঁচতে পারেননি। তারা দুজনেই ছিলেন ‘নাস্তিক’ আখ্যা পাওয়া লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক। শুধু তাই নয়, ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর চাপাতির আঘাতে খুন হওয়া দীপন ও অভিজিৎ ছিলেন বাল্যবন্ধু।
আজ ১২ জুলাই, দীপনের ৪৫তম জন্মদিন। মুক্তচিন্তার এই সাহসী মানুষটি ১৯৭২ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা । দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা অধ্যাপক। আর মা ছিলেন রোকেয়া হলের প্রিন্সিপাল হাউজ টিউটর। দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক। তার শ্বশুরও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
দীপনের স্কুল জীবন কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্কুল উদয়নে। ইন্টারমিডিয়েট ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। এরপর সম্মান ও স্নাতকোত্তর পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। যে কারণে তার মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, ‘দীপনের ওপর আঘাত আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ওপর আঘাত।’ আবার লেখক ও শিক্ষক জাফর ইকবাল ‘প্রিয় দীপন’ নামের এক লেখায় বলেছেন, ‘তার মতো সুদর্শন, পরিশীলিত এবং মার্জিত মানুষ আমি খুব কম দেখেছি’।
রাজধানীর শাহবাগ এলাকার আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে দীপনকে চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার পর, কার্যালয়ের সাটার তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। বিকেলে পুলিশ এসে তার লাশ উদ্ধার করে। একই সময় ও একই কায়দায় লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালায়ে দুর্বৃত্তের আঘাতে মারাত্মক আহত হন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক গবেষক রণদীপম বসু।
১৯৯২ সালে পাঁচটি বইয়ের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিলো জাগৃতি। প্রথম বছরের যে বইটি জাগৃতির জন্য এখনো মাইলফলক হয়ে আছে, সেটি ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। সেই থেকে এখন অবধি জাগৃতি থেকে প্রায় হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। ফয়সল আরেফিন দীপন খুন হওয়ার পার থেকে জাগৃতির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তার স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি। তারই তত্ত্বাবধানে বিগত বইমেলায়ও এ প্রকাশনী ২০টি নতুন বই প্রকাশ করে। এর মধ্যে দীপনকে নিয়ে প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থও রয়েছে। তবে তখন এক সাক্ষাতকারে জলি বলেছিলেন, ‘দীপনের ইচ্ছা ছিলো এবারের বইমেলায় প্রায় একশটি বই প্রকাশ করা।’
স্মৃতির এ্যালবামে..
দীপনের এবারের জন্মদিনে কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন রয়েছে কি’না, জানতে চাইলে নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে কোনো জবাব দেননি তার স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি। স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তান – রিদাত, রিদমা আর দীপনের রেখে যাওয়া অজস্র স্মৃতি – নিয়ে এই দিনটি তার কেমন কাটছে, তা বোধকরি অনেকেই অনুমান করতে পারবেন। জানেন তো, জলি শুধু দীপনের স্ত্রী নন, শৈশবের বন্ধু – কৈশোরের প্রেয়সী।
মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে (২৫ অক্টোবর) নিজের ফেসবুক দেয়ালে ওয়াহিদ ইবনে রেজার বরাত দিয়ে দীপন লিখেছিলেন, ‘নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যে খেলাটি আমরা খেলে যাই, তার নামই জীবন।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটিই ছিলো তার শেষ ‘পোস্ট’ (প্রকাশনা)। জন্মদিনের প্রথম প্রহরে এই প্রকাশনায় মন্তব্য করেও তাকে স্মরণ করেছেন অনেকে। কেউ কেউ আলাদা করেও লিখেছেন তাকে নিয়ে। আবার অনেকে দুই ভাবেই তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
যেমন – গল্পকার সার্জিল খান। দীপনের প্রকাশনায় তিনি লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন দীপন ভাই। এক বছর আগে শেষ দেখা এই দিনেই হয়েছিলো।’ পরে নিজের দেয়ালে তিনি লেখেন, ‘এই শুভেচ্ছা কিভাবে আপনি পাবেন জানি না। ওপার থেকে না কি সবই দেখা যায়। শুভেচ্ছার বিনিময়ে স্বাগতম চাচ্ছি না। আপনি যা দিয়ে গিয়েছেন, তা-ই অসীম। আর কিছুর বিনিময় চাই না। সম্পর্কের মাঝে বিনিময় থাকাও ঠিক না। তাই শুভেচ্ছাটাই রাখলে কৃতজ্ঞ হবো। শুভ জন্মদিন দীপন ভাই। আজীবন সবার হৃদয়ে এভাবেই বেঁচে থাকুন।’
নির্মাণাধীন চলচ্চিত্র ‘নৃ’ - শেষ করার দায়িত্ব এখন আমাদের সকলের। এমনটাই বলেছেন রাসেল আহমেদের সুহৃদ-বন্ধু, স্বজন ও সহকর্মিরা। শুক্রবার (২৬ মে) বিকেলে শাহবাগের ছবির হাটে ( সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারুকলা ইনিস্টিটিউট সংলগ্ন গেটের সামনে) রাসেল স্মরণ বৈঠকে তারা এ কথা বলেন। সদ্য প্রয়াত এই নির্মাতার প্রথম ও শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নৃ।
বৈঠকে বলা হয়, রাসেল আহমেদ ছিলেন এক স্বপ্নবাজ যাদুকর। শৈশব থেকেই চিন্তাশীল এই মানুষটি যে কোনো মানুষের কষ্টেই ব্যথিত হতেন। তবে তার মনের এ স্পর্শকাতরতা পরিবারের সদস্য, এমনকি বন্ধুদের অনেকেও ঠিক বোঝেনি। পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্তকেও পাগলামী ভেবেছেন কেউ কেউ। তবে এখন তাদের মনে হচ্ছে, রাসেলের জন্য অনেক কিছুই করার ছিলো। অন্তত তার সিনেমাটির পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিলো। কারণ তিনি স্রেফ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, মানুষের বোধ ও চিন্তাকে উন্নত করতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে নেমেছিলেন। আমৃত্যু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।
বক্তারা আরো বলেন, রাসেল ও তার টিমের সদস্যরা খেয়ে না খেয়ে যেভাবে নিজেদের সিনেমার করেছেন, সে ইতিহাস একসময় চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের পাঠ্য হবে নিশ্চিত। রাসেলের সহযোদ্ধারা বাংলাদেশের সিনেমায় আগামীতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে - এমনটাও আশা অনেকের। তবে সকলেই একমত যে- সবার আগে নৃ সিনেমাটিকে মুক্তির আলোয় নিয়ে আসতে হবে।
বৈঠকে বক্তব্য রাখেন কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুর, প্রকাশক রবীন আহসান, কবি ও আবৃত্তিকার সাফিয়া খন্দকার রেখা, অভিনেতা ম ম মোর্শেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা ফয়সাল রদ্দি, চলচ্চিত্র নির্মাতা অং রাখাইন, মাহবুব হোসেন, ইফতেখার শিশির, ইমতিয়াজ পাভেল, সাংবাদিক সাইফ ইবনে রফিক, ভাষ্কর ও লেখক গোঁসাই পাহলভী, কবি ও সাংবাদিক রুদ্র আরিফ, আবদুল্লাহ মাহফুজ অভি, সঙ্গীত শিল্পী সম্রাট, কিম্বেল অভি, সিনা হাসান, কবি মাহমুদ মিটুল, কিং সউদ, রাসেলের মেঝ ভাই মোহাম্মদ শফিকুল আলম মুকুল, শৈশবের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার এসএম পলাসহ আরো অনেকে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে পরম শ্রদ্ধার সাথে রাসেলকে স্মরণ করেন তারা।
রাসেল স্মরণ - সূচনা সংখ্যার প্রচ্ছদ
টোকন ঠাকুর বলেন, ‘রাসেল সিনেমাটি (নৃ) প্রায় শেষ করে এনেছিলেন, কিন্তু এর মুক্তি দেখে যেতে পারলেন না। এটি মুক্তি না পাওয়া অবধি তার আত্মা শান্তি পাবে না।’
রবীন আহসান বলেন, ‘বাজারি ধারায় সবাই যেভাবে সিনেমা বানাচ্ছে - রাসেল সেভাবে বানাতে চায়নি। নিজের মতো করেই গল্প বলতে চেয়েছে। এই প্রবণতা দেখেই বুঝেছিলাম সে আসলে শিল্পী।’
রাসেলের মেঝ ভাই মুকুল বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, সে আমাদের মাঝে বড় হলেও আমরা তাকে চিনতে পারিনি। আজ আপনাদের মাঝে এসে, কাজের কথা শুনে - তাকে নতুন করে চিনলাম।’
মা, মাটি ও মানুষের গল্প নিয়ে রচিত ‘নৃ’ চলচ্চিত্রের কারিগর নির্মাতা রাসেল আহমেদ গত ১৫ মে সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। টিজার/ট্রেইলর প্রকাশের কারণে বহুল আলোচিত চলচ্চিত্রটি যখন সম্পাদনার টেবিলে মুক্তির অপেক্ষায় শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই দুনিয়া ছাড়লেন নির্মাতা।
বয়োজেষ্ঠ্য বন্ধু সুচারু'দা ( Sucharu Das)। মূলত থিয়েটারের মানুষ। থাকেন ওপার বাংলায়, চন্দননগরে। প্রায় ৫৩ বছর ধরে মঞ্চে অভিনয় করছেন। চলচ্চিত্র নৃ'র টিজার দেখে তিনি বলেছিলেন- "osadharon laaglo. scoring... fraiming... visualisition... exoression... - besh uchu man-er."
দাদার মতো এভাবে আরো অনেকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের, মানে নৃ পরিবারের সদস্যদের উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছেন। আর তাদের সবাইকে সাথে নিয়ে সবার সিনেমা হওয়ার প্রত্যয়েই এগিয়ে চলছে নৃ বা তার বাকি অংশের কাজ।
বন্ধু ভেলিরি (Valerie Borgel) মূলত একজন আর্টিস্ট। জন্মেছেন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে; আর এখন থাকেন স্পেনের মাদ্রিদে। টিজারটি তিনিও দেখেছেন এবং বলেছেন, "the quality of image, photography, movement and colors are magical. sincere congretulation. it seems a great piece of work. Lots of luck !!!"
আরেক বন্ধু মায়া (Maya Dearth), একজন লেখিকা। জন্মেছেন টেক্সাস-মেক্সিকো সীমান্তে। বর্তমান নিবাস কানাডার ওন্টারিও'তে। ইউটিউবে চলচ্চিত্র নৃ'র টিজার দেখার পাশাপাশি ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে এর সম্পর্কে জানার পর তিনি বলেছেন - "I hope your film will be completed. It is very rich with feeling, imagery and emotion. Beautiful. So many talents must come together for something so wonderful. I believe in universal consciousness myself and hope to find some way to contribute in the grand scheme of life to further peoples awakening. What a great film I will promote!"
Filmmaker Rasel Ahmed's debut feature film NREE is about the essence of humanity, it tries to portray the message that trivial matters like race and belief are not enough to create division between people. The strongest bond that ties everyone together is the shared bond of being human.
The maker said - "Still we have to complete the shooting. Editing, dubbing, sound/music design and many other jobs are not done yet. Inspite of all these, some footages have been published in the structure of teaser as a response to the requests of many. Please do not misunderstand it by taking it as a full promotional trailor."
জানেন তো সামু, মানে বাংলা ব্লগ সামহোয়্যার ইনের বেশ পুরানো ব্লগার নির্মাতা রাসেল আহমেদ । যাদুকর... নিকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই সংগ্রামী মানুষটির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নৃ । আর্থিক সঙ্কটে স্যুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়া এ চলচ্চিত্রের অফিসিয়াল টিজার অবশ্য ভা্র্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে বেশ সাড়া ফেলেছে । বিশ্বের ৫৫টি দেশ থেকে দেখা হয়েছে এটি। বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে বেশী দেখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ভারত থেকে। ইউটিউব পরিসংখ্যান এ তথ্য জানিয়েছে। সম্প্রতি এ সাইটে নৃ’র টিজারটি আপলোড করা হয়। আরো যেসব দেশ থেকে টিজারটি বহুবার দেখা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অষ্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, ইউনাইটেড আরব আমিরাত, ইতালি, সুইডেন, ফ্রান্স, রোমানিয়া, গ্রীস, জাপান, সাউথ কোরিয়া, মালয়শিয়া ও জার্মানি অন্যতম। নৃ’র ফেসবুক পেইজে মোট ৪২ দেশের অনুসারী রয়েছে বলে জানা গেছে।
সঙ্কট কাটবে, সিনেমাটিও শেষ হবে – এমনটাই প্রত্যাশা টিজারের দর্শকদের। চলচ্চিত্রটি নিয়েও দারুণ আশাবাদী তারা। ইউটিউব থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন ব্লগেও শেয়ার হয়েছে টিজারটি। সব জায়গাতেই এটির ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত এসেছে। শেয়ার হয়েছে কয়েক হাজার বার।
নৃ’র অবস্থা নিয়ে নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক কূলদা রায় ফেসবুক এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মাধবপাশা বরিশাল শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমি বহুবার গেছি। এই পথে গুঠিয়া , চাখার, বানারীপাড়া স্বরূপকাঠি যেতে আসতে মাধবপাশায় নেমে পড়তাম। আমার পিঠে শিবকালী ভট্টাচার্যের এগার খণ্ড। আমি ঔষধী গাছ খুঁজতে বেরিয়েছি। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দুর্গাসাগর। শান্তশ্রী এই দীঘির সিঁড়িতে বসে থেকে দেখেছি--জলের উপরে পাখি এসে নামে। তার ছায়া উড়ে যায়। মাঝখানে একটুকু দ্বীপ। হাওয়ায় কাঁপে। এই মাধবপাশায় স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে অনশন করেছিল গ্রামের মানুষ। পঞ্চাশের দাঙ্গায় একদিনে মেরে ফেলা হয়েছিল ২০০ জনকে। কিন্তু দুর্গাসাগর এখনো সুন্দর হয়ে আছে। হয়তো সুন্দর এরকমই। সুন্দরকে সুন্দরই থাকতে হয়। তাকে শ্রী বলে ডাকি। দুর্গাসাগর নিয়ে একটি ফিল্ম হচ্ছে। নাম নৃ। কোনো তরুণ করছেন। আমি তাকে চিনি না। কিন্তু দুর্গাসাগরকে চিনি বলেই তাকে অচেনা মনে হয়না। ফিল্মটি আটকে আছে ৮৫ ভাগ হওয়ার পর। টাকা নেই। ভালো কাজে টাকা থাকে না- এটা খুব স্বাভাবিক। তবু তাকিয়ে আছি দুর্গাসাগরের দিকে। কেউ হয়তো আসবেন। তখন নৃ ফিল্মটি দুর্গা সাগরকে নিয়ে শ্রী হয়ে উঠবে।’
একইভাবে টিজারটি ফেসবুকে শেয়ার করতে গিয়ে নৃ’র শুভানুধ্যায়ী অনার্য তাপস লিখেছেন, ‘শুভেচ্ছা রাসেল আহমেদ এবং তার দলকে। যারা অনেক মমতা নিয়ে, অনেক যত্ন করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা এবং আগ্রহ আছে চলচ্চিত্র নৃ কে নিয়ে। এই দলটির ক্যাপ্টেন রাসেল আহমেদ, গুরুত্বপূর্ণ কাণ্ডারি ঈয়নসহ নৃ এর সাথে যুক্ত অনেকেই আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। চলচ্চিত্র নিয়ে তাদের চিন্তা, আগ্রহ, কর্মকাণ্ড আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আমি খুব কাছ থেকে তাদের প্রসব বেদনার কষ্ট প্রত্যক্ষ করেছি, করছি। দীর্ঘ দিন ল্যাপটপ বন্দী হয়ে থাকতে থাকতে নৃ যখন বিধ্বস্ত ঠিক তখনই নৃর এই অফিসিয়াল ট্রেলার আমাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে। ৮৫% স্যুটিং শেষ হওয়া এই চলচ্চিত্রটির পুরো টিম যে বিপুল জী বনী শক্তির অধিকারী সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। এখন অপেক্ষা, কবে আর্থিক দৈন্য তা কাটিয়ে এই চলচ্চিত্রটি শতভাগ কাজ শেষ করে দর্শকদের সামনে আসতে পারে- তার জন্য। কাল-কলা-কৌশলে নৃ কতটা পরিপক্ক, আধুনিক তা জানার জন্যও এর পুরো কাজ শেষ হওয়া দরকার। শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা থাকলো নৃ’র জন্য। সেই সাথে থাকলো কিছুটা দুশ্চিন্তা। কবে কাটবে আঁধার? অর্থনীতির চাকা কবে সচল হবে রাসেল আহমেদের?’
এদিকে টিজারের ব্যাপারে মো: খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘আমি অভিভূত। অসাধারণ ক্যামেরা শট, এ্যানিমেশন, অভিনয়, মেকিং। এটা বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে একটা মাইলস্টোন হতে পারে। ফুল ভার্সন দেখে পরিতৃপ্ত হতে চাই। অধীর আগ্রহে থাকলাম।’ সৈয়দ হিমু বলেছেন, ‘ওয়ান অব দ্যা বেস্ট আই এভার সিন।’ তপন গোস্বামী বলেছেন, ‘শুরু দেখে মনে হচ্ছে, একটি অসাধারণ ছবির জন্ম হতে চলেছে।’ তাওফিক নেওয়াজ বলেছেন, ‘অপু আর দূর্গার কথা মনে পড়ে গেলো।ট্রেইলার দেখে মনে হচ্ছে অসাধারণ একটা ছবি হয়েছে নৃ।দেখার অপেক্ষা রইলো। নৃ ছবির শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য শুভকামনা । মঙ্গল হোক সবার, জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের।’
আরেক দর্শক রাজীব হাসান বলেছেন, ‘কিছু ভালো কাজ হোক। জীবনের আয়তন বেড়ে হোক মহান জীবন, মানুষ মানুষকে দেখুক। দেখুক জীবন, অনাদরে ভেসে আসা ভেসে যাওয়া নিশ্চুপ, নিষ্ফল রাত-দিন, আরো আরো কাজ হোক। মানুষ প্রেরণা পাক।’ ফয়জে হাসান লিখেছেন, ‘অসাধারন সিনেমাটোগ্রাফী এং কম্পোজিসন।’ এছাড়া ওপার বাংলার দর্শক সৌমিক ঘোষ বলেছেন, ‘অসামান্য কয়েকটা শট তারকোভস্কি মনে পড়াল!’
এর আগে ইস্টিশন ব্লগের ডা. আতিকুল হক লিখেছেন, ‘নৃ মানে মানুষ। মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়ও মানুষ। সেই মানুষের গল্প, মানবতার জয়গানের গল্প নিয়ে রাসেল আহমেদ তৈরি করছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র "নৃ"। ট্রেইলার দেখে মুগ্ধ হলাম।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘এমনিতে রাসেল ভাইয়ের কাজ আগে দেখিনি। ফেসবুকে উনার কিছু কিছু স্থিরচিত্র দেখে মুগ্ধতার সূচনা। নৃ চলচ্চিত্রের ট্রেইলার দেখে আমি খুব আশাবাদী অত্যন্ত ভালো মানের একটি চলচ্চিত্র যোগ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ভাণ্ডারে। অধীর হয়ে অপেক্ষায় আছি মানুষের জয়গান দেখার জন্য। "নৃ" চলচ্চিত্রের সফলতা কামনা করছি...।’
মানুষ শুধু ‘ভা্র্চুয়ালি’ নয়, ‘একচুয়ালি’ও সাড়া দিচ্ছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নৃ’র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। এ নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘অবাক হইনি। বরং বারংবার নিষিক্ত হয়েছি ভালোবাসায়। টাকার জন্য আটকে আছে চলচ্চিত্র- নৃ এর শেষভাগের শুটিং; এরকম একটা খবর ভার্চুয়ালি প্রচার হবার পর প্রচুর মানুষের এগিয়ে আসা টের পাচ্ছি। ভালোলেগেছে তাদের মুখে- এরকম একটা ভালো কাজ আটকে থাকতে পারে না শুনে। যে যার মতো করে সাহায্যের প্রস্তাব দিচ্ছে। যার যার সামর্থ্যের সিমানায় দাঁড়িয়ে।’ নতুন করে বুঝতে পারছি- মানুষ ও মনুষত্ব্য এখনো ফুরিয়ে যায়নি। একা একা মানুষগুলো এগিয়ে আসছে একাকার হবার বাসনায়।’এর আগে টিজার প্রসঙ্গে রাসেল বলেছিলেন, ‘স্যুটিং বাকি আছে আরও। এডিটিং, ডাবিং/সাউন্ড/মিউজিক ডিজাইন ইত্যাদি আরও পরের পদক্ষেপ। এর মাঝেও টিজার এর আদলে কিছু ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হলো মূলত অনেকের দাবির প্রেক্ষিতেই। এটাকে আবার ফুল প্রোমোশনাল ট্রেইলার ভেবে ভুল করবেন না।’
আমাদের সহযোদ্ধা, মানে এক ব্লগার নির্মাতার এই সন্তান বা একটি সুস্থ-সামাজিক ধারার চলচ্ছিত্রকে বাঁচাতে আমরা কি কিছুই করতে পারি না? সকল বাংলা ব্লগের ব্লগারদের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্ন রেখেই আহবান জানাচ্ছি- আসুন, নৃ’র পাশে দাঁড়াই। সবাই মিলে চেষ্টা করলে বিদ্যমান বাঁধা নিশ্চয়ই অতি তুচ্ছ হয়ে যাবে; সঙ্কট মোচনও তরান্বিত হবে।
এখানে আরো কিছু কথা না বললে পুরো বিষয়টা পরিস্কার হবে না। চিত্রায়নের মাত্র ১৫ ভাগ কাজ বাকি। তবু স্বস্তিতে নেই নৃ’র নির্মাতা ও তার ইউনিট। কারণ - আবারো অর্থসঙ্কট। আটকে গেছে কাজ। অবশ্য দ্রুতই এ সঙ্কট কাটানোর চেষ্টা করছে প্রযোজক সংস্থা থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালী। শুদ্ধতার অঙ্গিকার আর বিভেদ ছাপিয়ে মাখামাখি হওয়ার গল্প নিয়ে নির্মানাধীণ এ চলচ্চিত্র এর আগেও একই সঙ্কটে পরেছিলো।
উইজার্ড ভ্যালীর কর্ণধার ও নির্মাতা রাসেল আহমেদের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির টাকায় ২০১২ সালের আগস্টে শুরু হয়েছিলো নৃ’র কাজ। প্রাথমিক মূলধন হিসাবে ওই টাকা ছিলো নিতান্তই অপ্রতুল। ছয় মাসের প্রস্তুতির পর ২০ দিনের স্যুটিংয়ে (গত বছরের এপ্রিলে) তা শেষ হয়ে যায়। তীব্র অর্থসঙ্কটে পরে নৃ ইউনিট। ওই সময়ে উইজার্ড ভ্যালী’কে আর্থিক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসেন সৌদি প্রবাসী ব্যবসায়ি ডা. আরিফুর রহমান। আমাদের বরিশাল ডটকম নাকম একটি অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ দেখেই তিনি নৃ সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। পরে ফেসবুক পেইজের কল্যাণে তার সাথে নৃ টিমের যোগাযোগ হয়। আর ‘বরিশাইল্যাইজম’ তাকে এই টিমের পাশে এনে দেয়। মূল ভিত্তি বরিশালকেন্দ্রিক হওয়ার কারণেই চলচ্চিত্রটির পাশে দাঁড়াবার ইচ্ছা পোষণ করেন বরিশালের সন্তান ডা. আরিফ। তার সহায়তায় গত ২৫ অক্টোবর বরিশালের বানারীপাড়ার নরোত্তমপুর গ্রামে পুনরায় চিত্রায়নের কাজ শুরু হয়।
এর আগে প্রথম দু’দফায় (গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে) মোট ২০ দিনে সিনেমার ইনডোরের অধিকাংশ কাজ শেষ করেছিলো নৃ ইউনিট। তাই শেষ দফার বেশিরভাগ কাজই ছিলো আউটডোর নির্ভর। প্রথম দু’দিন বৈরি আবহাওয়ায় বিঘ্নিত হয় কাজ। তৃতীয় দিনে বৃষ্টি কমলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। টানা ৬০ ঘন্টার হরতালে বিঘ্নিত হয় স্যুটিং। এ সময় পুলিশী হয়রানিরও স্বিকার হন নৃ ইউনিটের সদস্যরা। এসব বাঁধা পেরিয়েই বানারীপাড়াসহ বরিশাল মহানগরীর এপিফানী গির্জা, মহা-শ্মশান, নগর উপকণ্ঠের ঐতিহাসিক জলাধার দূর্গাসাগর এবং এর আশেপাশের এলাকায় কাজ চলেছে। তবে বেড়েছিলো খরচ। এরই প্রেক্ষিতে নভেম্বরে আবারো টাকা শেষ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় চিত্রায়নের কাজ। পুনরায় অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে উইজার্ড ভ্যালী। সাংবাদিকদের তারা জানিয়েছে, শিগগিরই চলচ্চিত্র নৃ’র ‘টাইটেল স্পন্সর’ ও ‘কো-স্পন্সর’ চূড়ান্ত করা হবে। নতুন কো-প্রডিউসারও খোঁজা হবে। এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও সহায়তা চাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
নৃ ইউনিটের সদস্যরা জানান, তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলেও কেউই হতাশ নন। তাদের প্রত্যাশা, ‘চলতি মাসের মধ্যেই আর্থিক সঙ্কট কেটে যাবে। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মূল্যবোধ জাগানিয়া গল্পের এই সিনেমাটি দ্রুত শেষও হবে।’
আলাপকালে নির্মাতা রাসেল আহমেদ বলেন, ‘চলচ্চিত্রটি শুরু করেই আমি টের পেয়েছি- এ অঞ্চলে স্বকীয়তা ও নিজস্ব ভাষা শৈলী নিয়ে একটি আন্তর্জাতিকমানের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র পরিস্ফূটনে রয়েছে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু সাথে সাথে আমি এটাও বুঝতে পেরেছি- লাগামছাড়া দু:সাহস ও চলচ্চিত্রের জন্য নিজস্ব উৎসর্গ ব্যতিরেকে একটা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের বিকাশ সম্ভব না। তাই জেনেবুঝেই ঝাঁপ দেয়া। প্রতিবন্ধকতাকে পথের অংশ মেনেই আগাচ্ছি। যাই হোক, অনেকখানি পথ পেরিয়ে শেষ পর্যায়ে এসে আমাদের আত্মবিশ্বাসের কোনো অভাব আছে, এটা কেউ বলতে পারবে না।’
রাসেল আরো বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমাদের ভিজুয়াল সম্পাদনার কাজ অনেকখানি এগিয়েছে। সাউন্ড ডিজাইন, গানসহ পূর্ণাঙ্গ মিউজিক ডিজাইনের কাজও চলছে। কালার গ্রেডের জন্য ইংল্যান্ডের এক কালারিস্টের সাথে কথাবার্তা চলছে। সবকিছু মিলিয়ে চলচ্চিত্র নৃ’র কাজ থেমে নেই। অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এগিয়ে চলছি আমরা।’
গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের রহমতপুরে নৃ’র চিত্রায়ন শুরু হয়। প্রায় দেড়শো মিনিটের মত হবে এ চলচ্চিত্রের শরীর। চলচ্চিত্রের মুখ্য চরিত্র বিশুর ভূমিকায় অভিনয় করছে বরিশাল জিলা স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ইয়াসিন। পুরানো এ নগরের কাউনিয়া এলাকার মহাশ্মশানের দুই চণ্ডাল দিলীপ কুমার পাল ও রাঁধা বল্লভ শীল ছাড়াও এতে আরো আছেন তাসনুভা তামান্না, সিরাজুম মুনীর টিটু, হিরা মুক্তাদির, এসএম তুষার, দুখু সুমন, হ্যাভেন খান, ওয়াহিদা রহমান আভাসহ শতাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী। ওই চণ্ডাল জুটির জীবন দর্শন ও ভাবনা নিয়ে অর্ধযুগ আগে শুরু হওয়া গবেষণার প্রেক্ষিতে প্রসূত এ চলচ্চিত্রে বরিশালের মাধবপাশার ঐতিহাসিক জলাধার দূর্গাসাগরের প্রচলিত মিথ আর বাংলার সহজিয়া, দরদিয়া এবং মরমিয়া বোধ মাখামাখি হয়েছে। গণমানুষের কাছে এ চলচ্চিত্রের বার্তা পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে গত জুনে আয়োজিত মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানে নির্মাতা দাবি করেছিলেন, বাবা-মা-দাদা-দাদী-মামা-চাচা-খালা-খালু-বন্ধু-বান্ধব-আরশী-পরশী-আন্ডা-বাচ্চাসহ পরিবারের সকলকে নিয়ে হলে গিয়ে বাদামভাজা চিবুতে চিবুতে নিশ্চিন্তে উপভোগ করার মত সিনেমা হবে নৃ।
নৃ চিত্রায়নে তিনটি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে। মূল চিত্রগ্রাহক- ড্যানিয়েল ড্যানি। সাথে আছেন ক্যামেরা সঞ্চালক শ খি আ ঈয়ন ও দঈত আন্নাহাল। সিনেমার শিল্প নির্দেশক হিসাবে আছেন থিওফিলাস স্কট মিল্টন। শব্দগ্রহণ করছেন- এমআই সাইফ। পোষাক ও পরিচ্ছদ দেখছেন শাহরিয়ার শাওন। এছাড়া সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন- সামির আহমেদ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
মনুষ্যত্ব রক্ষার যুদ্ধে বোধ প্রকাশের সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী মাধ্যম চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার হিসাবেই বেছে নিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালী। তারা মনে করে, এ দেশের সিনেমাও একদিন পৃথিবী শাসন করবে। গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে বরিশালের বিএম কলেজ এবং কলেজ রোড (বর্তমানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ সড়ক) কেন্দ্রীক সৃজনশীল আড্ডায় উইজার্ড ভ্যালীর জন্ম। স্থানীয় প্রযুক্তির সাহায্যে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, নাটিকা বা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি এ বিষয়ক তাত্ত্বিকচর্চায় সীমাবদ্ধ ছিলো এর প্রাথমিক কর্মকাণ্ড। প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হলে সিনেমা নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি নিবন্ধিত হয়। কে এই রাসেল
বরিশাল নগরীতেই ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ে রাসেল আহমেদের জন্ম। নগরীর কলেজ রোড এলাকাতে বেড়ে উঠেছেন কর্কট রাশির এ জাতক। প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসাবে অনুশাসনের পাশাপাশি পেয়েছেন এক সুস্থ সাংস্কৃতিক বলয়। বই পড়া আর আঁকাআঁকির অভ্যাস হয়েছে তখনই। খেলাঘর করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে মঞ্চ নাটকের সাথে। কৈশোর কেটেছে ব্যান্ড মিউজিক আর সাহিত্য পত্রিকা করে। তারুণ্যে এসব চর্চা অব্যাহত রেখেই মেতেছেন ক্যামেরা-কম্পিউটার নিয়ে। ফটোগাফী-ভিডিওগ্রাফীর পাশাপাশি এডিটিং, গ্রাফিক্স ও এনিমেশন চর্চা করেছেন, করিয়েছেন। এরই ফাঁকে দৈনিকে শিল্প নির্দেশক ও সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করেছেন। সংগঠক আর
আয়োজকের ভূমিকায়ও তাকে দেখা গেছে বহুবার। ক্লাবের কাজ থেকে শুরু করে ফিল্ম
ফ্যাস্টিভেল আয়োজন, সব জায়গাতেই সবচে কাজের মানুষ হিসাবে নিজেকে প্রমাণ
করেছেন। এসব করতে করতেই কখন যে চলচ্চিত্র নির্মাণের ভূতটা রাসেলে মাথায়
চেপে বসেছে, তা কেউ জানতেও পারেনি। বরিশালে বসেই তিনি নিভৃতে অডিও-ভিজুয়াল
কাজের উপযোগী একটি দল গড়ে তুলতে শুরু করেন। যাত্রা শুরু করে উইজার্ড
ভ্যালী।
রাসেল আহমেদ
২০১০ সালের শুরুতে রাসেল বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় আসেন। তিনি জানতেন, টেলিভিশনে প্রচারিত নাটক বা টেলিফিল্মে বাণিজ্যের চাপে শিল্প ভাবনা আড়ষ্ট হয় যায়। তবুও চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে নিজেকে যাচাইয়ের জন্যই নির্মাণ করেন নাটক ‘ফ্লাই-ওভার’। দেশ টিভিতে প্রচারিত এ নাটকটি প্রচুর প্রশংসা কুড়ালেও তিনি আর নাটক নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হননি। মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিজেকে এবং নিজের টিমকে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন। চলচ্চিত্র চর্চার সাথে ক্যামেরা, রিগস, লাইটস ও এডিট প্যানেল সমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ইউনিট তৈরি করেন। অবশেষে ২০১২ সালে তিনি নৃ’র কাজে হাত দেন।