Powered By Blogger
অমিভাত রেজা চৌধুরী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অমিভাত রেজা চৌধুরী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

০৬ ডিসেম্বর ২০১৭

অমিতের ফেরা যে কারণে জরুরী

অমিত সেনের এ ছবিটি ২০১৪ সালে বরিশালে তোলা
“আমার বন্ধু অমিভাত রেজা চৌধুরীর প্রথম ছবি ‘আয়নাবাজি’। বাংলাদেশের সিনেমার মানচিত্রে এক নতুন সংযোজন। কলকাতার ছবির তরঙ্গ যেভাবে ঢাকায় দোলা দেয়, উল্টোটা কখনোই ঘটে না। অমিতাভের এই ছবি শুধুমাত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই আলোড়ন সৃষ্টি করবে না, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গকেও নাড়া দেবে। এই শহরে মুক্তি পেলে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়বে অমিতাভ রেজার প্রথম ছবি আয়নাবাজি দেখতে।।” গত বছর আয়নাবাজি সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর, সম্ভবত ৮ অক্টোবর মুখবইয়ে এমনটা লিখেছিলেন ভারতের প্রথিতযশা বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিত সেন। নির্মাতা অমিতাভকে অভিনন্দন জানিয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার এই শিক্ষক আরো উল্লেখ করেছিলেন, সিনেমাটি গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আন্তর্জাতিক বিভাগে প্রদর্শণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
শীতটা তখন একদমই যাই যাই করছে, আর বসন্ত আসি আসি। মাত্র ক’দিন আগেই সেনাসমর্থিত সরকার এসেছে দেশে। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। তবে বন্ধু-স্বজন, সহকর্মিসহ আশেপাশের সবাই কেমন যেন ভীত, তটস্থ। বলছিলাম ২০০৭’র ফেব্রুয়ারির কথা। তখন আমি সাপ্তাহিক ২০০০’র বরিশাল প্রতিনিধি। দিনের বেলায় শুধু ছুট আর ছুট, সংবাদের সন্ধানে দৌড়াদৌড়ি। রাত দুপুরে ঘরে ফিরে খাবার খেতে খেতে পড়ছিলাম পত্রিকার ভালোবাসা দিবস (৯ ফেব্রুয়ারি) সংখ্যা। অমিত সেনের মুখবইয়ের লেখাটি পড়ে স্মরণে এলো সেই রাতের কথা। কারণ সেদিনই আমি প্রথম তাকে চিনেছিলাম। ২০০০’র আলোচ্য সংখ্যা প্রকাশিত এক যৌথ সাক্ষাতকারে দেখেছিলাম আলোচিত নির্মাতা অভিতাভ রেজা বলছেন, ‘অমিত সেন আমাকে প্রথম উৎসাহ দেন বিজ্ঞাপন নির্মাণের। আমি তাকে অ্যাসিস্ট করি অল্প সময়। এরপর বিজ্ঞাপন নির্মাণ শুরু করি। আর আমাকে পিছনে ফিরতে হয়নি।’ একই সাক্ষাতকারের আরেকাংশে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে মুম্বাইয়ের অনেক ভালো মেকারও কাজ করছেন। যার মধ্যে রয়েছেন অমিত সেন। আমি এটা স্বীকার করবো যে, অমিত সেনদের কাজ দেখে অনেক কিছুই শিখেছি।’ অমিতাভ আরো বলেছিলেন, ‘অমিত সেন মুম্বাইয়ের অন্যান্য নির্মাতার চেয়ে অনেক আলাদা। তিনি এ দেশে ক্লায়েন্টদের (বিজ্ঞাপনদাতাদের) কাছে গিয়ে বলেছেন, তোমরা এদেশের ছেলেদের প্রমোট করো।’ সঙ্গে থাকা আরেক বিখ্যাত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও তখন বলেছিলেন, ‘অমিতাভ যেটা বলল, এটা অমিত সেনের ভালো দিক।’ এর বহু বছর পর ২০১৪ সালে অমিত সেনের কল্যাণেই অমিতাভের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনিস্টিটিউটের বিপরীতে ঘটা সেই আচমকা সাক্ষাত অনুষ্ঠানে প্রয়াত নির্মাতা রাসেল আহমেদ, চিত্রগ্রাহক ড্যানিয়েল ড্যানিসহ আরো অনেকেই ছিলেন - যদ্দুর মনে পড়ে।

রাসেল আহমেদের পাশে অমিত সেন
চিত্রটি ড্যানিয়েল ড্যানি তুলেছিলেন
এতদিন বাদে এসব কথা যেসব কারণে স্মরণে আসছে তার সবকিছু এখন বলতে চাচ্ছি না আসলে। তবে নিশ্চয়ই বলবো কখনো সময় ও সুযোগ পেলে। আপাতত শুধু জানাই, ঠিক তার কিছু দিন আগে স্বাধীন চলচ্চিত্র ‘নৃ’ নির্মাণ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন অমিত সেন এবং তার আইলেভেল ফিল্মস। সিনেমাটির অর্থায়ন যোগাতে বিজ্ঞাপনের কাজ যোগাড়ের পাশাপাশি তিনি আরো বহুমুখী উদ্যোগ নেন। এটা নির্ধিদ্বায় বলা যায় যে তিনি পাশে না দাঁড়ালে হয়ত রাসেল আহমেদের এ চলচ্চিত্র চিত্রায়ন পর্বেই আটকে যেত। দেশের নির্মাতাদের মধ্যেও যারা ওই সময় নৃ -এর পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক ও মানুসিকভাবে আমাদের শক্তি যুগিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আনোয়ার শাহাদাত, বিজ্ঞাপন নির্মাতা পিপলু আর খান, কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুর এবং শিল্পী ও নির্মাতা অঙ রাখাইন অন্যতম। গত মে মাসে যখন এডিটিং টেবিলে সিনেমাটির চূড়ান্ত সম্পাদনা চলছে, ঠিক সেই মুহুর্তে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন রাসেল। নির্মাণ শুরুর প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় আবার থমকে যায় নৃ। আটকে যায় কাজ। তৈরী হয় নানামুখী শঙ্কা। এ নিয়ে যখন নানাবিধ হতাশায় ডুবে যাচ্ছি ঠিক তখনই আবার কাঁধে হাত রাখলেন অমিত সেন। জানতে চাইলেন সিনেমাটির সর্বশেষ অবস্থা, জানালেন তার চিন্তার কথাও। আবার আশাবাদী হলো আমার চলচ্চিত্র শ্রমিক সত্তা। 
বাংলাদেশ বা বাংলাদেশী সিনেমা বা নির্মাতাদের জন্য যে মানুষটির মন এত কাঁদে তিনি এদেশে নিষিদ্ধ হয়ে আছেন সেই ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে। ওই সময় তার পিআই (পারসোনাল ইনভেস্টমেন্ট) ভিসা বাতিল করে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই থেকে আজ অবধি বাংলাদেশে কাজ করতে পারছেন না এ নির্মাতা। গত এক দশক ধরেঅমিত সেনের বাংলাদেশী বন্ধু বা সাবেক সহকর্মিরাও এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চুপ। অবশ্য তাকে নিষিদ্ধ করার কারণ জানার চেষ্টা করে একাধিক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ধমক খেয়েছেন কয়েকজন। এরপরও তিনি বহুবার ভিসার জন্য আবেদন করেছেন এবং বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। এর নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার সাংবাদিক সত্ত্বা যে ধরণের ‘ব্যক্তি-বিদ্বেষ’ খুঁজে পেয়েছে তা কিছুটা ইগো আর কিছুটা ব্যবসায়িক। মূলত প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী চাচ্ছে না অমিত বাংলাদেশে আসুক বা এখানে কাজ করুক। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই আন্তর্জাতিকমানের ‘ট্রিলজি’বানানোর চিন্তা তিনি লালন করছেন চলচ্চিত্র-জীবনের শুরু থেকে।
বাংলাদেশ আর এর স্বাধীনতার সাথে যে অমিত সেনের পরিবারের আদি ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে। বরিশাল অঞ্চলের ঝালকাঠীর বেউখির গ্রামেই শেকড় তাদের। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর দেশ ত্যাগ করা এ পরিবারের সন্তান রঞ্জিত কুমার সেনগুপ্ত আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে; আহতও হয়েছিলেন। এর আগে ১৯৬২ সালে চৈতালী সেনগুপ্তের সাথে বিয়ে হয় তার। তার বাপের বাড়ি ফরিদপুর হলেও সে’ও বড় হয়েছে বরিশালেই। যারই জেরে রঞ্জিত ও চৈতালী - দুজনেই ছিলেন প্রায়ই একই মাত্রার পূর্ববঙ্গ অন্তঃপ্রাণ। বিয়ের ক’বছর পর এমনই এক ডিসেম্বরে তারা যখনে নেপালের কাঠমুণ্ডুতে, ঠিক তখনই তাদের কোলে আসে একমাত্র সন্তান অমিত।বাংলাদেশ নিয়ে তিনি যে সিনেমাগুলো তৈরী করতে চান তার চিত্রনাট্য তৈরীর গবেষণায় সংযুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নতুন করে জানার সুযোগ হয়েছিলো আমার। যারই বদৌলতে এ লেখাটি তৈরীর সাহস পেলাম। কারণ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিই এখন দেশের ক্ষমতায়। আর এই যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র ধারাবাহিক তৈরীর জন্য অমিতের ফেরাটা খুবই জরুরী। এ কথা পড়ে আমাকে ভারতের দালাল বলে গালি দিতে পারেন অনেকে। তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি, অন্তত আমার দৃষ্টিতে তিনি মানুসিকভাবে যতটা ভারতীয় তার চেয়ে অনেক বেশী ‘বরিশাইল্যা’। এ নিয়ে ইতিপূর্বেও ব্যক্তিগত ব্লগে লিখেছিলাম। ইন্টারনেটের যে কোনো সার্চ ইঞ্জিনে সেনের প্রত্যাবর্তন বা বোলপুরে বরিশালের রান্না ঘর লিখে সন্ধান করলেও তা মিলে যাবে।

ফটোগ্রাফী : এমএসআই প্রিন্স 
আজ ৬ ডিসেম্বর। নির্মাতা ও শিক্ষক অমিত সেনের জন্মদিন। বাংলাদেশের সংবাদ, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতের একজন নবীশ প্রতিনিধি হিসাবে আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাকে পরম শ্রদ্ধা জানাই। আর নিজ রাষ্ট্রের কাছে দাবি রেখে বলতে চাই, অমিত সেনকে এদেশে কাজ করার সুযোগ দেয়া হোক। প্রত্যাশায় রাখি এই লেখাটি দেখবে বর্তমান সরকারের নীতি-নির্ধারক কোনো চোখ। কাকতালীয়ভাবে একাত্তরে অমিত সেনের এই জন্মদিনেই দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও ভুটান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। 

সম্পর্কিত লেখাঃ
সেনের প্রত্যাবর্তন - the return of sen
newsreel [সংবাদচিত্র]