Powered By Blogger
Barisal লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Barisal লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

০৮ অক্টোবর ২০১৫

ফেরে নাই অভিজিৎ দাস

হারানোর আগে এক রাতে ...
‘বন্ধু –
আবারও এসেছে বসন্ত
ফেরা হয় নাই ঘরে-
ভাঙা পথের রাঙা ধুলো
পদচিহ্নের ভারে-
কাঁপিয়া উঠিছে মন আমার
মন আমার... মন আমার..
থরে থরে ...
ফেরা হয় নাই ঘরে’

- গানটি গাইতে গেলেই খুব চেনা এক অসহনীয় অনুভূতি ভিতর থেকে উঠে এসে গলা চেপে ধরে। অথচ আমার বার বার মনে হয় গলা চেপে ধরছেন খোদ স্রষ্টা, মানে যিনি এ গানের গীতিকার ও সুরকার। তবুও গোঙানোর মতো করে গাইতে গাইতে ভাবি – তার ঘরে ফেরা হবে কবে?
০৮ অক্টোবর, ২০১৪ খ্রি.। খুব ভোরে, সম্ভবত ছয়টা বা সাড়ে ছয়টার দিকে সহোদর (ছোট ভাই) বিশ্বজিৎ দাসের শ্যামলীর বাসা থেকে বেড়িয়ে যান বাংলাদেশের তরুণ কবি ও গণসঙ্গীত শিল্পী অভিজিৎ দাস। এরপর থেকেই তিনি লাপাত্তা। দুই বাংলাতেই তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন বন্ধু, স্বজনরা। খোঁজার কথা জানিয়েছিলো পুলিশও। কিন্ত হদিস মেলেনি। বস্তুত গত বছরের ৭ অক্টোবরের পরই তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। এমনকী ফেসবুকেও কোনো কার্যক্রম নেই তার। উধাও হওয়ার আগের রাতে ভাইয়ের পাশাপাশি বড় বোন চৈতালী দাসের সাথেও বেশ ঝগড়া হয়েছিলো অভিজিৎ’র। তাই পরদিন সকাল থেকেই অভিমানী ভাইকে খোঁজা শুরু করেন তারা। কিন্তু এক দিন, দুই দিন করে হপ্তা, মাস পেরিয়ে প্রায় বছর চলে গেলেও তার খোঁজ মেলেনি বরিশালে বেড়ে ওঠা এ কবির।
অভিজিৎ দাস নিরুদ্দেশ হওয়ার পরপরই ঢাকার শেরে বাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করা হয়। পুলিশও ঘটনাটি দ্রুত আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে। এ কবিকে খোঁজার জন্য তৎপর হয় তারা। তিন দিন পর, অর্থাৎ ২১ অক্টোবর অভিজিৎ দাসের পরিবারকে জানানো হয় দেশের সকল থানায় তার ছবি পাঠানো হয়েছে। এরপর পেরিয়ে গেছে মাসের পর মাস। আজও দাসের কোনো সন্ধান মেলেনি।

নিরুদ্দেশ হওয়ার আগের রাতে ভাইয়ের সাথে অভিজিৎ’র তর্ক হয়েছে মূলত তার দীর্ঘদিনের বোহেমিয়ান জীবনযাপন নিয়ে। মুঠোফোনে তীব্র বাগ্বিতণ্ডা হয়েছে বোনের সাথেও। কারণ বোন তাকে বলেছিলেন, চুল-দাঁড়ি কেটে ভদ্রস্থ হতে। কিন্তু অভিজিৎ তার স্বকীয়তা ভাঙতে রাজি নন। তিনি ক্ষেপে গিয়েছেন। চিল্লাপাল্লা করেছেন। সেদিনের কথা বলতে বলতে বিশ্বজিৎ জানিয়েছিলেন, এর আগে দাদাকে অতটা বিক্ষিপ্ত হতে দেখেননি কখনো। এর আগে প্রায়ই তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার কথাও বলতেন । যে কারণে খবর দেয়া হয়েছে ওপার বাংলায়ও। বলা হয়েছে সকল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে। সেখানেও কেউ অভিজিৎ’র কোনো খোঁজ পাননি। সিনিয়র, জুনিয়র বা সমবয়সী বন্ধু, দূরের - কাছের স্বজন; কেউ না। তার আরেক ঘনিষ্ট বন্ধু বলেন, ‘কোলকাতায় যাওয়ার জন্য নতুন করে পাসপোর্ট করতে তিনি ক’দিন বরিশালে দৌঁড়ঝাপও করে ছিলেন। পরে অবশ্য আর পাসপোর্টটি করতে পারেন নাই।’

গত বইমেলা চলাকালে একটি সংবাদ সম্মেলন করার কথা ভেবেছিলেন বিশ্বজিৎ এবং আরো কয়েকজন। তা’ও পরে আর হয়নি। অভিজিৎ’র নিখোঁজ হওয়াটা যে নেহাতই কোনো বাজে রসিকতা নয়, বরং যথেষ্ট শঙ্কা জাগানিয়া তা প্রথম টের পেয়েছিলাম চৈতালীদির ফোন পেয়ে। পরে একই শঙ্কা টের পেয়েছি তার আরো অনেক শুভাকাঙ্খীর কণ্ঠ বা দৃষ্টিতে। শঙ্কিত সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের চায়ের দোকানদার দুলালও। রাতের পর রাত এই দুলালের দোকানেও কাটিয়েছেন কবি। ছবির হাট সংলগ্ন ওই এলাকাতেই আ্ড্ডা দিতেন তিনি ও তার বন্ধুরা। দুলালসহ ওখানকার আরো অনেকেই অবশ্য দাবি করেছেন, নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে অভিজিৎ প্রায়ই দুই-তিন মাসের জন্য উধাও হওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু তিনি সত্যিই যে উধাও হয়ে যাবেন, এটা তারা কেউ আন্দাজও করতে পারেননি।
অভিজিৎ কি তবে তার প্রিয় অগ্রজ বিষ্ণু বিশ্বাসের মতোই স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করলেন? এম্নিতেই বিষ্ণুকে প্রচণ্ড পছন্দ করেন তিনি। তার দুটি কবিতায় সুরও দিয়েছেন। আর বিষ্ণুর মতো তিনিও ডোবেন আজব হ্যালুসিনেশনে। কাছের মানুষেরা তার ভীতিবিহবলতার মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। ১৯৬২’র ২৯ মে ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে জন্মানো বিষ্ণুও হ্যালুসিনেশনে ভীতচকিত হতেন। তিনি দেখতেন একটা সাদা গাড়ী অথবা ছুরি হাতে কেউ একজন তাকে তাড়া করে ফিরছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আরো জানিয়ে রাখি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করে ৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বিষ্ণু। কিছুটা বাউন্ডুলে হলেও তার লেখালেখি, আড্ডা - সবই চলছিলো স্বাভাবিক। ছন্দপতন ঘটলো ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায়। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা প্রসূত হিংস্রতা কবিকে বিপর্যস্ত করে মারাত্মকভাবে। করে তোলে আতঙ্কগ্রস্ত। এই আতঙ্ক নিয়েই ১৯৯৩ সালে তিনি উধাও হন। এর প্রায় ১৮ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে তার সন্ধান মেলে।
কয়েক বছর আগে অভিজিৎ জানিয়েছিলেন, বরিশালের জাগুয়া গ্রামের যে জমিতে তাদের আদি ভিটা ছিলো তা দখল করে সেখানে ক্লিনিক তৈরী করছেন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। ভেঙে ফেলা হয়েছে তাদের পুরানো বাড়ি-ঘর, পূর্বপুরুষদের সমাধি। কোনো ভাবে এটা ঠেকাতে না পারার কারণে প্রচণ্ড হতাশ ছিলেন কবি। যদিও তার জ্ঞাতিদের কয়েকজন ক্ষতিপূরন বাবদ কিছু নগদার্থও পেয়েছেন। বয়সে খানিকটা বড় হলেও অভিজিৎ দাসের সাথে আমার অন্তরঙ্গতায় কোনো ঘাটতি ছিলো না সম্ভবত। যে কারণে তার নিপাট নির্লিপ্ত অভিমানের সাথেও আমি পরিচিত। আর এ কারণেই হয়ত ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, অভিমানী কবিকে লাপাত্তা হতে বাধ্য করিনি’তো আমরা; মানে পুঁজিবাদী চমকে মোহাবিষ্ট স্বজন, বন্ধু আর সমাজ? বা সেলফিজমের যমানাই গুম করেনি তো তাকে? নানা শঙ্কা উঁকি দেয় মনে।

এত শঙ্কার মাঝে দাঁড়িয়েও কেন যেন মনে হচ্ছে, শিগগিরই ফিরে আসবেন নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ, ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগণ, মাটির চামচ মুখে, করপল্লবসঙ্গিনী এবং সারাটা আঁধার বেড়াবো মাতাল কুসুম বনে বনে -এর কবি। সাথে থাকবে তার নতুন কাব্যগ্রন্থ বা কোনো মহাকাব্যের পাণ্ডুলিপি। শূন্য দশকের কবিদের নিয়ে এক আলোচনায় পড়েছিলাম – “কবি নামের সঙ্গে নান্দনিক হতাশার যোগসূত্রতা সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই। পৃথিবীর তাবৎ কবি-শিল্পীর বহু মহিমান্বিত সৃষ্টির জন্য নান্দনিক হতাশার রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। বরং বলা চলে, কবিদের সত্ত্বার ভেতর এই নান্দনিক নামক জিনিসটি না থাকলে শিল্পের অনেক কিছুরই জন্ম হতো না। কবিতা বঞ্চিত হতো বহু বিস্ময়কর সৃষ্টি ও সৌন্দর্য থেকে। ঘটনাটা ঘটেছে কবি অভিজিৎ দাসের বেলাতেও। পৃথিবীর মহৎ শিল্পকর্মে এই সহজাত প্রক্রিয়া লক্ষ্য করি বেশ। অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের যে সংবেদন তার প্রতিটি মুহুর্তের অধিবিদ্যাকে কবি অনুভব করেন অতিসংবেদনশীলতা। যারা হতাশায় তাড়িত হয় তারা আসলে জীবনের পক্ষে যায়না। তারা আসলে এই বর্তমান হাইড্রোলিক হর্ণ সংবলিত জীবনধারাকে অস্বীকার করে এবং কাঙ্খিত, স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী স্রোতধারাময় জীবনের অপেক্ষায় থাকে। তাদের হতাশা আসলে এক নীরব প্রতিবাদ-এক নৈঃশব্দিক কাতরতার দ্বারা তারা একে একে প্রকাশ করে যায় নিজেকে। একটি কাঙ্খিত জীবনের জন্যে একটি কাম্য জীবনের জন্য তারা নিজেকে ধ্বংস করে যায়। অতএব লেখক হিসেবে তার এই cosmic pathos - আমরা বুঝি। কবি অভিজিৎ দাস-এর হৃদয় সম্ভবত জীর্ণবস্ত্রের মতো সুঁই হয়ে এ ফোঁড় ও ফোঁড় তোলে। তার আত্মপক্ষীয় লেখার মধ্যে সমুদ্র সমান অসন্তোষ আগ্নেয় উষ্ণতায় বিধৃত। সুষ্ঠু ও সুস্থ আত্মপ্রকাশের অক্ষমতা সম্পর্কে সচেনতা এবং ভয়াবহ অতৃপ্তি এর পরতে পরতে। এই গহীন অতৃপ্তি মানসিক যন্ত্রনা তার সৃষ্টিশীল নন্দন-মানসকে কুঁরে কুঁরে খায়। অতৃপ্তি অসন্তুষ্টি, নিরন্তর পরিবর্তনমানতা শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে উচ্চতর শুদ্ধির কাছে পৌঁছে দেয়। অনেক সময় স্রষ্টার অন্তরকে অক্টোপাশী প্রজননী-বেদনা ফালাফালা করে। তার অভ্যন্তরে সৃষ্টি অগ্নি আলোকিত করে। যে নিজের লাল রক্তকে কালো কালিতে রুপান্তরিত করে সেই তো কবি। আর অভিজিৎ সেই অস্থিরতার সংলাপে অম্লমধু ধারণ করে সেই পথটিকেই বেছে নিয়ে হাঁটছেন। কেননা তিনি রক্ত-মাংসের কবি।”

২০১১ সালের ১১ নভেম্বর বাবা এবং তার আগে ২০০৭ সালের ১৬ মে মাকে হারান কবি অভিজিৎ । অবশ্য তাদের মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন কাব্যিক উদাসীনতাকে। সংসারের দিকে তার খেয়াল ছিলো না কোনো। তবে জ্ঞাতসারে কখনো কারো ক্ষতির কারণ হননি আমাদের এই আত্মভোলা বন্ধু । তাই বিশ্বাস করি, তারও ক্ষতির কারণ হবেন না কেউ। যেখানেই আছেন, ভালো আছেন – সুস্থ আছেন কবি। যদিও অযন্ত-অবহেলায় তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব বেশী ভালো নেই জানি। তবুও আশা করতে দোষ কি?

নিখোঁজ হওয়ার আগে দীর্ঘ সময় কবি অভিজিৎ’র নিয়মিত আয়ের কোনো সংস্থান ছিলো না। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিলো দৈনিক আমাদের সময়। পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে শিল্পপতি নূর আলী ও সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খানের দ্বন্দ্ব চলাকালে ছাঁটাই হওয়া কর্মিদের মধ্যে ছিলেন কবিও। এরপর আর কোথাও কাজ করেননি তিনি। তবে কর্মহীন ছিলেন না কখনো। কবি বা যন্ত্রী বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন সারাদিন। আর যেখানেই নিপীরনের খবর পেয়েছেন, ছুটে গিয়েছেন। খোলা গলায় গান ধরেছেন শোষিতদের পক্ষে - ‘দুধ ভাত শুধু তোমাদের - আর আমরা কেবলই - পাথর চিবুতে বাধ্য’। শোষকদের বিরুদ্ধে গানই তার শ্লোগান। এমন অজস্র গানের স্রষ্টা তিনি। কয়েক বছর ধরে ছবি আঁকার ভুতটাও মাথায় চেপেছিলো তার । এঁকেছেন এবং হারিয়েছেন অজস্র ছবি।
অভিজিৎ বলেছিলেন, প্রায় দেড় দশক আগে বরিশালের দৈনিক প্রবাসীতে তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ওস্তাদ ছিলেন সাংবাদিক শওকত মিল্টন। এছাড়াও যদ্দুর জানি অভি বরিশালের দৈনিক আজকের বার্তা, ঢাকার দৈনিক বাংলাদেশ সময়, আর্ট ম্যাগাজিন শিল্পরূপসহ আরো অগণিত পত্রিকায় কাজ করেছেন। বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকাপন ইনিস্টিটিউট (আইআরআই) আর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথেও ছিলেন বেশ দীর্ঘ সময়। ধ্রুবতারা, শূন্য মাতাল, কালনেত্র, কাঠবিড়ালীসহ আরো অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনও বেরিয়েছে তার হাত দিয়ে।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতালকে সমর্থন জানাতে গিয়ে ২০১১ সালের জুলাইয়ে অভিজিৎ গ্রেফতারও হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে তিনি লাঠিচার্জ ও ধাওয়ার সম্মুখীনও হয়েছেন বহুবার। তবুও রাজপথ ছাড়েননি কখনো। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত - পথেই কাটিয়ে দিয়েছেন। হয়ত আজও তিনি কোথাও কোনো পথেই আছেন; গাইছেন – ‘পথে পথেই পেরিয়ে যাচ্ছি ভোর / পথে পথে পেরিয়ে আসছি রাত / পথেই হারিয়ে ফেলেছি অচেনা মুখ / তোমার সঙ্গে - পথেই সাক্ষাত’।

পুরানো পোস্টঃ অভিজিৎ দাস নিরুদ্দেশ, না গুম?

২৫ আগস্ট ২০১৫

মায়ের জন্য কবি হেলাল

ছবিটি মৃত্যুর বছর খানেক আগে, ২০০৬’র মার্চে তোলা।
ঘটনাটি ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের। নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক মনে পরছে না। জুন বা জুলাইয়ের কোনো এক সকালে বাসায় এসে ঘুম ভাঙিয়ে ঔষধ কোম্পানীর প্যাডের পৃষ্ঠায় লেখা একটি কবিতা আমার হাতে গুজে দিয়েছিলেন এক কবি। শৈশব থেকে চেনা এ মানুষটির এই সত্বার সাথেও সেদিনই প্রথম পরিচয় হয় আমার। এর আগে কখনো কল্পনায়ও আসেনি যে তিনি কখনো কবিতা লিখতে পারেন । জানালেন মায়ের জন্য লিখেছেন। কিন্তু মা বাসায় নেই, তাই তাকে শোনানো হয়নি। লেখাটি চেয়ে নিয়ে নিজেই একবার পড়ে শুনিয়ে আবার আমার হাতে দিলেন। এরপর দ্রুত বেড়িয়ে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন - ‘এটা থাকুক তোমার কাছে।’ তিনি চলে যাওয়ার পর লেখাটি নিজে একবার পড়ে নিয়ে ডায়েরীর মধ্যে রেখে আমি আবারো ঘুমিয়ে পরেছিলাম।
তখনও হিজরত করিনি। মাঝে মাঝে ঢাকায় এসে কাজ করলেও বেশীরভাগ সময় বরিশালেই থাকছি। তবে তখন চূড়ান্তভাবে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। সেদিন সন্ধ্যার কিছু সময় বাদে কি এক কাজে বন্ধু অনুপ, মানে মার্শেল অনুপ গুদাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই বাবার কাছে জানলাম অদ্য প্রতুষ্যে আবিষ্কৃত সেই কবি সিলিঙ ফ্যানের সাথে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পরেছেন। তার কক্ষের দরজা ভাঙার চেষ্টা চলছে। শুনেই ছুটলাম। অনুপও ছুটলো সাথে। আমার বাসা থেকে ঘটনাস্থল ছিলো মাত্র তিন মিনিটের এক ছুটের দুরত্বে। গিয়ে দেখি কেবলই দরজা ভাঙা হয়েছে। কবি ফ্যানের সাথে নয়, সিলিঙে লাগানো আঙটার সাথে লাগানো ফাঁসে ঝুলছেন। সম্ভবত মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে নিজেই ফ্যানটা খুলে পাশের বিছানার উপরে রেখে নিয়েছেন। পশ্চিম মুখো নিথর দেহ। হাত দুটো এহরাম বাঁধার মতো করে পরস্পরকে আলিঙ্গণ করে আছে। অবশেষে পুলিশ এসে তার ঝুলন্ত দেহ নামানোর উদ্যোগ নেয়। অনেকের মতো আমি আর অনুপও হাত লাগাই। মাথার মধ্যে তখন সকালে পড়া ও শোনা কবিতার লাইনগুলো স্মরণের প্রচণ্ড চেষ্টা চলছে। কিন্তু নাম ছাড়া একটি লাইনও মনে আসেনি কিছুতে। প্রায় আট বছর পর সেই লেখাটি কোনো রূপ সংশোধন বা পরিমার্জন ছাড়াই আজ হুবুহু তুলে দিলাম এখানে।
মা
গাজী মুশফিকুর রহমান (হেলাল)

বেঁচে থেকেও পাশে নেই আজ তার মাতা
       বুকে তার পাহাড় সমান ব্যাথা
চারিদিকে কেন এত জ্বালা?
       কেউ বুঝবে না কারো এই ব্যাথা
করো না কেউ মাকে অবহেলা
       যখন যাবে ছেড়ে মা
এই পৃথিবীর সমতূল্যেও ফিরে পারে না আর
       মা নেই যার কত ব্যাথা তার
আজ বহুদূরে থেকে বুঝি মায়ের সেই
অকৃত্রিম, নিঃস্বার্থ ভালবাসার কথা
তিনি এই জগৎ সংসারের সকল সন্তানদের
জন্য দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহর পড়ে
নেই তাঁর কোন তূলনা।
সেদিন লাশ নামিয়ে বাইরে বের হতেই দেখি আমার এক সিনিয়র সহকর্মি, মানে আজকের পরিবর্তন পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার এসএম সোহাগ এসে হাজির। তার সাথে আলাপ করতে করতে ওই বাসা থেকে অনুপকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখি দাওয়ায় উদাস হয়ে বসে আছেন সদ্য আত্মহত্যাকারী কবি হেলালের পিতা। ওই সময় তার পাশে কাকে যেন পেয়ে জিজ্ঞাসা করে জানলাম কবির মা নিজের মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। সন্তানের মৃত্যুর এই খবর এখনো দেয়া হয়নি তাকে।
বেশ প্রগাঢ় পোক্ত বন্ধুত্ব ছিলো প্রয়াত মোহম্মদ আব্দুস সামাদ গাজী আর এবিএম নূরুল হক শরীফের। বরিশাল শহরের কলেজ পাড়ার তালভিটা প্রথম ও দ্বিতীয় গলির বাসিন্দা ছিলেন এ দুজন। প্রথম গলির গাজী ভিলা আর দ্বিতীয় গলির শরীফ কটেজ তাদের স্মৃতিবহন করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে আছেন তাদের উত্তরসূরীরা। পরম্পরাসূত্রে পাওয়া পারিবারিক বন্ধুত্বও সম্ভবত টিকিয়ে রেখেছেন তারা। গাজী দাদার সহধর্মীনিও এখনো বেঁচে আছেন। মূলত আজ হঠাৎ তার কথা মনে পরতেিই তড়িঘড়ি করে  এ লেখাটি লিখতে বসেছি। কেন জানি মনে হলো তার অন্তত জানা দরকার যে তাকে ভালোবেসে এমন একজন মানুষ কবিতাও লিখেছেন, যাকে তিনিই জন্ম দিয়েছিলেন। সম্ভবত এটি ছিলো তার সে সন্তানের লেখা প্রথম ও শেষ কবিতা। কিঙবা হতে পারে এটি ছিলো এক অভিমানী পুত্রের কাব্যিক সুইসাইড নোট।
সামাদ গাজীর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন হেলাল, আর আমি হক শরীফের জেষ্ঠ্য নাতি। হেলাল কাকা বয়সে আমার চেয়ে ছয়-সাত বছরের বড় ছিলেন। তবুও শৈশবের কিছুকালে তিনিই ছিলেন আমার প্রধানমত বন্ধু। তালভিটা প্রথম গলির পূর্বপাশেই জেল বাগান। এক সময় বরিশাল কারাগারের কয়েদীদের দিয়ে এখানে নিয়মিত কৃষি কাজ করানো হতো। শৈশবে এই বাগানে গরু চড়াতে গিয়েই হেলাল কাকার সাথে আমার মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। দুর্দান্ত ডানপিটে এই কাকাই প্রথম ছিপ আর ছোট জাল, এমনকী কোনো কিছু ছাড়া স্রেফ হাত দিয়ে মাছ ধরার কৌশলও শিখিয়েছিলেন আমায়। শুকনো পাতা দিয়ে বিড়ি বানিয়ে খাওয়াসহ শিখেছিলাম আরো কত কী! তখন দেখেই দেখতাম হেলাল মা অন্তঃপ্রাণ। আর বাবার সাথে তার খালি খিটমিট। পরবর্তীতে তিনি অনেক ঘটনাবহুল সময় পার করেছেন।
বরিশালের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়েছিলেন। তারপর নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী সংগঠন হিযবুত তাওহীদের আঞ্চলিক নেতা। আবার মৃত্যুর আগে আগে সব বাদ দিয়ে মশগুল হয়েছিলেন স্রেফ আল্লাহর ইবাদতে। তালভিটা জামে মসজিদের মুয়াজ্জীন হওয়ার বাসনাও প্রকাশ করেছিলেন। আসলে এত সংক্ষেপে লিখে হেলালের মাজেজা বোঝানো কঠিন। তাকে নিয়ে একটি আস্ত উপন্যাসও লিখে ফেলা যাবে অনায়াসে।
হেলাল কাকার মৃত্যুর এক বছর না ঘুরতে প্রায় একই কায়দায় সিলিঙের সাথে ঝুলে দেহত্যাগ করেছিলো আমার সেই বন্ধু, অনুপ। তার বছর দুয়েকের মধ্যে ক্যান্সারে মারা যান সেই সহকর্মি এসএম সোহাগও। তারা, মানে মৃতরা এ জাতীয় ইহলৌকিক লেখা পড়তে পারেন কিনা জানতে পারিনি আজও।  পড়তে পারুক বা না পারুক, তারা যেখানে আছেন - ভালো থাকুক; এই যা প্রত্যাশা।

১৩ এপ্রিল ২০১৫

ভ্রাতা, বাড়ান আত্ম-সচেতনতা ...

এম. আরিফুর রহমানের ফেসবুক বৃত্তান্তের একাংশ
***
এম. আরিফুল ইসলাম, বরিশালের কোনো এক আঞ্চলিক পত্রিকার সাংবাদিক। হঠাৎ দৃষ্টি কাড়লেন আজ। বরিশালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় জুয়া ও অশ্লীল নৃত্যের আসর বসানোর খবর সম্পাদকীয় নীতির কারণে প্রকাশ করতে না পেরে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। ‘কোন শহরে আছি আমরা?’ শিরোনামে অশ্লীলনৃত্যের ছবিসহ দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন – “আমি একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় দীর্ঘদিন যাবৎ সংবাদকর্মী হিসেবে কর্মরত রয়েছি। আমি অবাক হয়ে যাই - এই যাত্রা জুয়ার দৃশ্য দেখে তাহলে আমাদের সিনিয়র দের কেমন লাগে?” অর্থাৎ পরোক্ষভাবে সিনিয়র সাংবাদিকদের দৃষ্টিআকর্ষণেরও চেষ্টা করেছেন আরিফুল। বরিশালের এক সাংবাদিকের এমন সচেতনতা দেখে বেশ ভালোই লেগেছে। এই ভালো লাগা থেকেই গিয়েছিলাম তার বৃত্তান্ত ভ্রমণে। এতে যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে তাকে বলতেই হয় – ‘হে ভ্রাতা, আগে আপন মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবুন। আপনার মতো অগ্রগামী একজন মানুষের বৃত্তান্তে গিয়ে যখন কেউ দেখবে – প্রিয় পেইজ/পাতার তালিকায় প্রদর্শিত হচ্ছে – এমন সংযোগ – যা স্খলনেরই পরিচায়ক; তখন নৈতিকতা নিয়ে আপনার প্রশ্ন তোলার এখতিয়ারটিই কী প্রশ্নবিদ্ধ হবে না? ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিজেকে লুকানো খুব সহজ, আবার কঠিনও। অতএব আগে আত্ম-সচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপরে মনোযোগী হন। আপন নৈতিকতাকে সংযত ও সুসংহত করুন।’

সাংবাদিক এম. আরিফুল ইসলাম
***
তবুও আপনাকে ধন্যবাদ এম. আরিফুল ইসলাম। কারণ, আপনার স্ট্যাটাসের কল্যাণেই আজ স্মরণে এলো – এক দুর্দান্ত পিশাচ পরিবার। দক্ষিণের ঠিকাদারী, তেল, মিডিয়া, নারী ও জুয়া ব্যবসায় যাদের অবদান সর্বজনবিদিত। বংশ পরম্পরায় তারা সমানে অবদান রেখে চলেছেন। বরিশালের প্রতিটি খাম্বাও জানে তাদের অপকীর্তির কৌলিক ইতিহাস। ‘খাম্বা’ মানে জানেন’তো? না জানলে জিজ্ঞেস করুন কাছে থাকা যে কোনো ‘বরিশাইল্যা’ -কে। বস্তুত বরিশালের কেউই ওই পরিবারের সদস্যদের নাম মুখে আনতে চায় না। এটা অবশ্য ভয়ে নয়, শঙ্কায়। তারা ভাবে, ওদের কারো নাম মুখে আনলে দিনটাই না খারাপ যায়। কোনো প্রতিহিংসার বশে লিখছি না এসব, নেহাতই নৈতিকতার দায়। সময় করে একদিন আরো অনেক কিছুই লিখতে হবে। ঠিকাদারী, তেল, মিডিয়া, নারী ও জুয়া সংমিশ্রণের ফর্মূলা জানাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। আমিও আশা করি, আরো অনেকেই লিখবেন। সবাইকে জানাবেন – ওই পরিবারের গল্প।

১২ মার্চ ২০১৫

এ কোন উগ্রবাদের মহড়া ...

লাঠিসোটা হাতে মুসলিম হলের ছাত্ররা, অদূরে পুলিশ।
দৈনিক সকালের খবর –এর শিরোনাম ‘বিএম কলেজে শিক্ষার্থী বহিরাগত ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া : আটক ৩’। দৈনিক সমকাল –এর ‘বহিরাগতদের হামলার জের : বিএম কলেজে ছাত্রদের ভাংচুর’। দৈনিক নয়া দিগন্তের শিরোনাম ‘বিএম কলেজে শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের মধ্যে ধাওয়া’। - ধ্বস, গুম, অভ্যুত্থানাশঙ্কা বা নিত্য জ্যান্ত মানুষ পোড়ানোর এই কালে আজকের ওই শিরোনামগুলো হয়ত খুব বেশী ভয়ংকর নয়, অনেকটা নিরীহ গোছের। তবে নিশ্চিত জেনে রাখুন, সংবাদমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা বরাবরের মতো আজও দুস্প্রাপ্য। তাই কোনো ঘটনার যে কারণটি প্রকাশিত হয় - তারও আড়ালে লুকিয়ে রয় ছোট-বড় আরো অজস্র গল্প।
বিএম কলেজের গতকালের (১১ মার্চ, ২০১৫ ) ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত সংবাদগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সাথে মুঠোফোনে আলাপও হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে শঙ্কিত হয়েই লিখতে বসেছি। কারণ - এ ঘটনার নেপথ্যে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উগ্রবাদের গন্ধ টের পাচ্ছি বেশ। বহিরাগতদেরও দোষ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাদের তাড়ানোর নামে বিএম কলেজের আবাসিক হলের যে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ভাংচুর চালিয়েছে এবং লাঠিসোটা নিয়ে মহড়া দিয়েছে - তারা আসলে কোন শক্তির প্রতিনিধিত্ব করেছে; তা’ও একটু খতিয়ে দেখা দরকার। এ ব্যাপারে শুধু কলেজ প্রশাসন নয়, বরিশালে কর্মরত সামরিক ও বেসমারিক গোয়েন্দাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


আমাদের বরিশাল ডটকম’র ফেসবুক পেইজের স্ক্রীনসট
খুব খেয়াল
যেখান থেকে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, সর্বাগ্রে সেখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। মুসলিম হল - নামে সমধিক পরিচিত সার্জেন্ট ফজলুল হক হলের পুকুরের পাড়ে ‘প্রেমিকা বা মেয়ে নিয়ে বসা’ নিয়ে কলহের শুরু। এটা দেখেই অতীতে ফিরতে হলো। গত বছরের জানুয়ারিতে “বিএম কলেজের একাংশে নারীরা নিষিদ্ধ !” শিরোনামে প্রকাশিত এক লেখায় জানিয়েছিলাম ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়াল, গাছ ও ল্যাম্পপোষ্টে লাগানো একটি লিফলেটের কথা। যাতে বিএম কলেজ ক্যাম্পাসের বিজ্ঞান অনুষদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘেঁষা মুসলিম হলের সামনের বিশাল পুকুর, মাঠ ও রাস্তায় নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিক্ষিকা বা ছাত্রীদের তোয়াক্কা করা হয়নি। নিজেদের ক্যাম্পাসের বিশালাংশে তাদের অবাঞ্চিত ঘোষণাকারী ওই লিফলেটে লেখা ছিলো - “বিএম কলেজ, মুসলিম হলের সামনের রাস্তায়, মাঠে এবং পুকুরপাড়ে মেয়েদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। অনুরোধক্রমে - হলের সচেতন ছাত্রবৃন্দ।”

নিজস্ব ব্লগ প্রেস এন্ড প্লেজার (pap) এবং আমাদের বরিশাল ডটকম’এ ওই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর লিফলেটটির পক্ষে সাফাই গেয়েও মন্তব্য করেছিলেন অনেকে। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম প্রিয় বিএম কলেজে ধর্মীয় মৌলবাদের আগ্রাসন কতটা তীব্র হয়েছে। গতকালের ঘটনাকেও তাই দক্ষিণবঙ্গের ওই প্রধান বিদ্যাপিঠে ইসলামি উগ্রবাদের মহড়াই মনে হয়েছে। এখানে আরো একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০১৩ সালের নভেম্বরে কীর্তনখোলার ওপারের চরকাউয়া ইউনিয়নের কালিখোলা গ্রামে হিন্দুদের ১৬টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার সাথেও ওই ‘মুসলিম হল’ -এর ছাত্রদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো।

কপিতয় মন্তব্য পড়ে দেখুন, তবেই বুঝবেন এরা কারা
মানবতার কল্যাণে ‘সত্য প্রেম পবিত্রতা’র আদর্শে সোয়াশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ওই শিক্ষালয়ের, মানে বিএম কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর এম ফজলুল হক। ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট তিনি এ পদে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাছে আজ (১২ মার্চ, ২০১৫) বিকেলে উল্লেখিত লিফলেটটির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন - “হ্যাঁ, আমিও দেখেছি ওগুলো। কাঁচা ভাবনার লেখা। কিছু দুষ্ট ছেলে মাঝে মাঝে দুষ্টুমী করে ওগুলো লাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা (কলেজ প্রশাসন) কখনো প্রশ্রয় দেই না। অমন লিফলেট দেখা মাত্র ছিড়ে ফেলতে বলা হয়েছে।”

কলেজ প্রশাসনের কাছে ছেলে আর মেয়ের কোনো তফাৎ নেই জানিয়ে এম ফজলুল হক বলেন, “আমাদের ছাত্রীরা ক্যাম্পাসের যে কোনো স্থানে যেতে পারবে। তবে ছাত্র হোস্টেলের আশাপাশে একটু সমস্যা হয় মাঝে মাঝে। এটাও কোনোমতেই কাম্য নয়।” এ প্রসঙ্গে তিনি গতকালের ঘটনাটিও উল্লেখ করেন। অধ্যক্ষ আরো বলেন, ‘আবাসিক ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধতার বিষয়টি অবশ্য ভালো। এতে উটকো লোকেরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে সাহস পাবে না।’

সংবাদ ভাষ্য
গতকালের ঘটনার ব্যাপারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে - “বহিরাগতদের হামলার জের ধরে আবাসিক হলের ছাত্ররা বরিশাল বিএম কলেজের বিভিন্ন ভবনের দরজা-জানালা ব্যাপক ভাংচুর করেছে। কলেজ ক্যাম্পাসের তিনটি আবাসিক হলের ছাত্ররা একযোগে প্রায় আধাঘণ্টাব্যাপী এ তাণ্ডব চালায়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় দুটি ধারালো অস্ত্রসহ তিন বহিরাগতকে গ্রেফতার করা হয়।”

ঘটনার কারণ হিসাবে খবরগুলোয় আরো বলা হয়েছে - “বিএম কলেজ এলাকার বহিরাগত যুবক হিরা ক্যাম্পাসের মুসলিম হলের সামনের পুকুর পাড়ে প্রেমিকার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় পুকুরে গোসলরত কয়েক ছাত্র তাদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করলে দু’ পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে হিরা কিছুক্ষণ পরে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে তন্ময়, ইমরান, শুভ রাতুলসহ বেশ কয়েকজন বহিরাগতকে নিয়ে ধারালো অস্ত্রসহ মুসলিম হলে প্রবেশ করে ওই ছাত্রদের খুঁজতে করতে থাকে। এ সময় হলের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে তাদের ধাওয়া দিলে বহিরাগতরা পালিয়ে যায়। এরপরই কলেজের তিনটি ছাত্রাবাসের কয়েকশ ছাত্র বহিরাগতদের ক্যাম্পোসে প্রবেশে নিষেজ্ঞাধা জারির দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তারা ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনসহ বিভিন্ন বিভাগের ভবনের দরজা-জানালায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে। খবর পেয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে লাঠিসোটা ও দুইটি ধারালো অস্ত্রসহ তিনজন বহিরাগত ছাত্রকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে তাদের পরিচয় শনাক্ত ও বিএম কলেজে প্রবেশ না করার শর্তে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেয়া হয়।”

ঘটনা প্রসঙ্গে বরিশাল মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর এম ফজলুল হকের নির্দেশনা অনুযায়ী আটক বহিরাগত শিক্ষার্থীর মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’ আর কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এম ফজলুল হক বলেছেন, ‘বহিরাগতদের প্রবেশ রোধে শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা করে নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়া।’
পর্যালোচনা
উত্তেজিত ছাত্ররা।
কোনো সংবাদেই অভিযুক্ত বহিরাগতদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উল্লেখিত লিফলেটটির কথাও কোথাও আসেনি। এ বিষয়ে শুধু ক্যাম্পাসের রিপোর্টাররাই নয়, বরিশালের সিনিয়র সাংবাদিকরাও ভাববেন –এমনটাই আমার প্রত্যাশা। সচেতন নাগরিক সমাজেরও সজাগ হওয়া প্রয়োজন। কারণ, ঐতিহ্যবাহী বিএম কলেজেকে মৌলবাদের আখড়ায় পড়িণত হওয়া থেকে ঠেকানো সম্ভবত সমগ্র বরিশালবাসীর দায়িত্ব। নয়ত মহাত্মা অশ্বিনীর দত্তের আত্মা তাদের ক্ষমা করবে না।
জেনে রাখুন
বাংলার শস্য ভাণ্ডার ও প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বন্দর নগরী বরিশালে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন প্রতিষ্ঠিত বিএম কলেজ এর আগেও সাম্প্রদায়িকতার কবলে পরেছে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ ও ১৯৫০ সালের দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছাত্র-শিক্ষক ভারতে চলে গিয়েছিলো। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তখন কলেজের দ্বি-বার্ষিক ও ত্রি-বার্ষিক সম্মান কোর্স তুলে দিযে় এটিকে শুধু স্নাতক পাস কলেজ হিসেবে টিকিযে় রাখা হয়েছিলো। অথচ তার আগে এ কলেজ ছিলো দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পাঁচ কলেজের একটি। পূর্ববাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের প্রথম দিকের সরকারি কলেজগুলোরও একটি এটি। এ কলেজকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়। এ কারণে বিএম কলেজের ইতিহাস মানে আধুনিক বাংলাদেশের ইতিহাস। বিশ্বের মানব সভ্যতার ইতিহাস ও বিকাশের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, আমেরিকার হারবার্ড, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া ও ভারতের নালন্দা প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় যেরূপ অবদান রেখেছে, পূর্ব বাংলায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে বিএম কলেজের ভূমিকা অনুরূপ বললেও বেশি বলা হবে না। উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে অবিভক্ত বাংলার জনজীবন যারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন এ কলেজের ছাত্র। দেশের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিএম কলেজের ছাত্ররা এককভাবে যত বড় অবদান রেখেছে এ দেশের আর কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পারেনি।

পুরানো পোষ্টের সেই ছবিটি
ঢাকা ও কলকাতা থেকে দূরে অবস্থান এবং নদী-নালা দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এখানকার ছেলেমেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক পশ্চাৎপদ ছিল। ১৮৫৪ সালে বরিশাল জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অঞ্চল আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নবজাগরণ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিন দশক পরে আধুনিক বরিশালের স্থপতি দরিদ্রবান্ধব মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮৪ সালে বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে প্রতিষ্ঠা করেন বিএম স্কুল। তখনও প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আর সুযোগ ছিলো না বরিশালে। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুরোধে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৮৯ সালে ওই স্কুল কম্পাউন্ডেই এই বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহাত্মা অশ্বিনী । ১৯১৭ সালে বিএম স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয় এই কলেজ। প্রায় ৬২.০২ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই ক্যাম্পাসে আসার পরই শুরু হয়েছিলো বিএম কলেজের বর্ণালী অধ্যায়। সে সময় স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের কারণে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি, উচ্চ শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা তরুণ ইংরেজদের গোলামী ছেড়ে চলে এসে দেশসেবা ও মানুষ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকুরি করাকে অধিক পছন্দনীয় মনে করেছিলেন। অশ্বিনী কুমার দত্ত তখন ভারতবর্ষের অনেক খ্যাতিমান শিক্ষকের সমাবেশ ঘটিয়ে এ কলেজের শিক্ষার মান অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান। তার সাথে সাথে তিনি নিজেও লাভজনক ওকালতি পেশা ছেড়ে বিনা বেতনে এ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। অধ্যক্ষ ব্রজেন্দ্রনাথ চট্টপাধ্যায়, রজনীকান্ত গুহ, বাবু সতীশচন্দ্রসহ বিএম কলেজের সে সময়কার অন্যান্য অধ্যক্ষদের পাণ্ডিত্ব্য এবং পরীক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীদের ঈর্ষণীয় সাফল্য বরিশালের জন্য প্রচুর সুনাম বয়ে এনেছিলো। এ কলেজের অধ্যাপকদের প্রজ্ঞা ও শিক্ষাপদ্ধতি উন্নত করতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

আরো জানুন
১৯২২ সনে ইংরেজি ও দর্শন, ১৯২৫ সনে সংস্কৃতি ও গণিত, ১৯২৮ সনে রসায়ন এবং ১৯২৯ সালে অর্থনীতি সম্মান অনার্স কোর্স চালু হয় বিএম কলেজে। মূলত ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল বিএম কলেজের স্বর্ণযুগ। তখন এ কলেজের শিক্ষার মান এতই উন্নত ছিল যে, অনেকে প্রতিষ্ঠানকে দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড বলে আখ্যায়িত করেন। বাংলার ছোটলাট স্যার উডবর্ন সরকারি শিক্ষা বিবরনীতে লিখেছিলেন This moffusil College promises some days to Challenge the supremacy of the Metropolitan (Presidency) College. একই সময়ে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিটসন বেল লিখেছিলেন Barisal may be said to be the Oxford of East Bengal.

মুঠোফোনে তোলা পুরানো একটি ছবি
আর্থিক অনটনের কারণে ১৯৫২ সালে কলেজের অবস্থা খুবই নাজুক আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি নিরসনে ১৯৫৯ সালে প্রয়াত অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে ডেপুটেশনে কলেজের নতুন অধ্যক্ষ নিযে়াগ করে সরকার। এর ফলে কলেজের অবস্থা পরিবর্তিত হতে থাকে। ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে মাত্র ১৫ জন ছাত্রছাত্রী নিযে় অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পাঠ্যক্রম পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। ১৯৬৫ সালের পহেলা জুলাই বিএম কলেজকে প্রাদেশীকরণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সনের পরে আরো কয়েকটি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। সর্বশেষ ২০১০-১১ শিক্ষা বর্ষে চালু হয় ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিভাগ। এ কলেজে বর্তমানে মোট ২৪টি বিষয়ে পাঠদান করা হয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ায় ১৯৯৯ সাল থেকে বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী বিলুপ্ত করা হয়।

২৫ নভেম্বর ২০১৪

তিনিও ছিলেন চলচ্চিত্রের মানুষ

ছবিটি সুনানের তোলা
ফুটবল, আইন পেশা বা রাজনীতি নয়, চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পারিবারিক ব্যবসার কারণেই তাকে খুব সহজে চিনেছিলাম শৈশবে; সেই প্রাইমেরীতে থাকতে। শাহীন আঙ্কেল, মানে সদ্য প্রয়াত কামরুল আহসান শাহীনের কথা বলছি। তার বাবার কথা জানতাম, চিনতাম পুত্রকেও। তাকে প্রথম দেখেছিলাম স্কুলের বারান্দায়। তখন অবশ্য তিনি কে, কেন এসেছেন - কিছুই জানা ছিলো না। কিন্তু কেন জানি মাথার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলেন। সম্ভবত বিশাল বপু আর আদুরে মুখাবয়বের কারণে।

আমার স্কুল ছিলো ফজলুল হক এভিনিউয়ে, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এর ঠিক উত্তর পশ্চিম কোনে সদর রোডে ছিলো কাকলী সিনেমা হল। একদিন বাসায় ফেরার সময় - ওই হলের সামনের শাহীন আঙ্কেলকে দাঁড়ানো দেখে মেঝ চাচার কাছে জানতে চেয়েছিলাম উনি কে? চাচা তাকে দেখে জানালেন, উনি হলের প্রতিষ্ঠাতা ডা. আবদুস সোবাহানের বড় ছেলে। সেই প্রথম তার নাম জানলাম। অবশ্য এর আগেই ডা. সোবাহানের নাতি সুনানের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। স্কুলের জুনিয়র হলেও আমাদের সাথে অদ্ভুত এক সখ্যতা ছিলো তার। এমনটা হয়েছিলো মূলত ওর খালাত ভাই - আদরের সুবাদে। সে ছিলো আমাদের ক্লাসমেট। আর আদর , সুনান -এই দুই ভাইয়ের সম্পর্কটা ঠিক বন্ধুর মতোই ছিলো। সেদিন বাসায় যেতে যেতেই ধারণা করেছিলাম - শাহীন আঙ্কেল বোধকরি সুনানেরই বাবা। এ জন্যই তাকে হয়ত স্কুলে দেখেছিলাম। পরে জেনেছিলাম আন্দাজ ভুল ছিলো না।

প্রাইমারী ছেড়ে হাই স্কুলে ওঠার বছর দুয়েক পরই স্কুলের বন্ধুদের বৈকালিক আড্ডা আর খেলাধূলার অন্যতম স্পট হয়ে উঠেছিলো মল্লিক রোড। মূলত নগরীর বৃহৎ দুটি গার্লস স্কুল, অর্থাৎ সরকারি বালিকা বিদ্যালয় (সদর গার্লস স্কুল) আর জগদীশ স্বারস্বত গার্লস হাই স্কুল সন্নিকটে হওয়ার কারণে টিনেজার ছেলেদের কাছে ওই এলাকাটি খুবই আকর্ষণীয় ছিলো। বিভিন্ন এলাকার, বিভিন্ন স্কুলের সমবয়সী বন্ধুরা সমবেত হতাম সেখানে। ভদ্র, বখাটে, পাগলাটে – সবাই আসত। শাহীন আঙ্কেলের বাসার ঠিক বিপরীতে পুলিশ ক্লাবের সিঁড়িতে আড্ডা দিতাম আমরা আর মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল বা ব্যাডমিন্টন খেলতাম। বয়োজেষ্ঠ্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে বিড়ি-সিগারেট ফোঁকার জন্য ক্লাবের দেয়ালের আড়াল বা অদূরবর্তী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পিছনের সিঁড়ি ছিলো আদর্শ জায়গা। ওই সময় সুনানও আড্ডা দিত, খেলত আমাদের সাথে। আর দূর থেকে বাবাকে আসতে দেখলেই লুকিয়ে যেত দেয়ালের আড়ালে। আমাদের অবশ্য তটস্থ হওয়ার কোনো কারণ ছিলো না। কারণ শাহীন আঙ্কেলও আড্ডা, খেলাধূলা – এসব বেশ পছন্দই করতেন। শুনেছিলাম, একসময়ে দুর্দান্ত ফুটবলার ছিলেন তিনি। গোলরক্ষক হিসাবে খেলেতেন ঢাকার ওয়ারী, আবহনী আর বরিশালের মোহামেডান ক্লাবে। বরিশাল জেলা  দলেরও গোলরক্ষক ছিলেন তিনি।

মৃত্যুর কিছু দিন আগে, রাজপথে...
সাংবাদিকতায় ঢোকার পর ছোটবেলার সেই শাহীন আঙ্কেলের আরো বহু পরিচয় জানা হয় আমার। চেনা হয় রাজনীতিবিদ আর আইনজীবি কামরুল আহসান শাহীনকে। এক সময়ে বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাধারন সম্পাদক ছিলেন তিনি। ছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটরও। একইসঙ্গে মূলধারার রাজনীতির সাথেও সক্রিয় ছিলেন পুরোটা সময়। ১/১১ পরবর্তী সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা যখন আত্মগোপনে, তখনও তিনি রাজপথে ছিলেন। বড় বড় পদে থাকলেও তার মদদপুষ্ট কোনো সন্ত্রাসী ছিলো না। এ কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথেও শত্রুতা ছিলো না তার।

শাহীন আঙ্কেলের সাথে আমার শেষালাপ হয়েছিলো সম্ভবত ২০০৮ সালে ঢাকার নয়াপল্টনে, জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় কারযালয়ে। পার্টির তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সাথে আলাপ করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফ্রি আছেন দেখে যেচে গিয়েই কথা বলেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম সুনানের খবরও। এরপরও তার সাথে দেখা হয়েছে বহুবার। কিন্তু কথা হয়নি আর, হবেও না। শুধু পরিবার নয়, পুরো বরিশালকে কাঁদিয়ে তিনি অসীম শূন্য ক্যানভাসে মিলিয়ে গেছেন।
কাকলী ছিলো ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যরীতিতে তৈরী এক মুভি থিয়েটার হল। পুরানো নাম ছিলো জগদীশ হল। সম্ভবত এটি বরিশাল নগরীর দ্বিতীয় সিনেমা হল। ষাটের দশকে এর প্রতিষ্ঠাতা মালিক জগদীশ বাবু দেশান্তরী হওয়ার আগে এটি কিনে রেখেছিলেন সিনেমাপ্রেমী ডা. সোবাহান। তার মৃত্যুর পর ছেলেরাই হলটির দেখভাল করতেন। পরে ঠিক কবে এটি ভেঙে ফেলা হয় তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না, মনে নেই। সম্ভবত গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সংস্কারের অভাবে তারও অনেক দিন আগে থেকেই বন্ধ ছিলো সিনেমা প্রজেকশন। তবু আজও সদর রোড আর ফজলুল হক এভিনিউয়ের সংযোগস্থলের নাম কাকলীর মোড়।
কয়েক বছর আগে এ নিয়ে আলাপকালে সুনান জানিয়েছিলো, অত্যাধুনিক মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার করার পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছেন শাহীন আঙ্কেল। সম্প্রতি জেনেছিলাম, সে কাজ এগিয়েছেও বহুদূর। কিন্তু তা শেষ করে যেতে পারলেন না তিনি। তবুও আশা করি কাজটি দ্রুতই শেষ হবে। বরিশালের প্রথম মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা থিয়েটারের রূপে পুনর্জন্ম নেবে কাকলী বা জগদীশ। তখন এর নাম শাহীন মেমোরিয়াল সিনেপ্লেক্স করলেও কেউ আপত্তি করবেন না নিশ্চয়ই। কারণ কামরুল আহসান শাহীন সেই আধুনিক স্বপ্নবাজ, যিনি বরিশালে মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা থিয়েটার গড়ার স্বগ্ন দেখেই ক্ষান্ত হননি। স্বপ্নটিকে বাস্তবায়নের দোঁড়গোরায়ও নিয়ে এসেছেন। এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে আজ আরো আপন লাগছে শাহীন আঙ্কেলকে। আহা, তিনিও যে চলচ্চিত্রের মানুষ ছিলেন।

১৮ নভেম্বর ২০১৪

কৈশোরের টেম্পু স্ট্যান্ড, বন্ধু ...

old mate | © eon's photography / pap
ছবির এই মানুষটি বহু পুরানো বন্ধুদের একজন। অথচ তার আসল নাম কখনো জানাই হয়নি। আমার কাছে আজও তার নাম ‘দাদু’। তাকে এ নামেই ডাকতাম আমরা, মানে বন্ধুরা। প্রায় ১০ বছর পর দেখা হয়েছিলো এই দাদুর সাথে, তা’ও দুই বছর আগে - ১২’র নভেম্বরে - বরিশাল মহাশ্মশানে। 
স্কুল জীবনের প্রিয় আড্ডাখানাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো নতুন বাজার টেম্পু স্ট্যান্ড। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০০-০১ সালের সেই টেম্পু স্ট্যান্ডের সাথে আজকের স্ট্যান্ডের কোনো মিলই নেই।

ওই সময় পুলিশ ফাঁড়ির ঠিক উল্টোদিকে সারি বাঁধা টিনশেড ঘরগুলোয় ছিলো ওয়ার্কসপ। সারাদিন টেম্পু মেরামতের কাজ হত। আর ওয়ার্কসপগুলোর পূর্ব প্রান্তে ছিলো সোহেল ভাইয়ের চায়ের দোকান।  আর তার দোকান ঘেঁষা রেলিঙ দেয়া কালভার্ট পেরুলেই কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি। দুঃসাহসিক ডাকাত হিসাবে বরিশাল অঞ্চলের এক ‘মিথিক্যাল ক্যারেক্টার’ ছিলেন ওই মোল্লা।  মন্ত্রবলে তিনি বিভিন্ন পশুপাখি রূপ ধারন করতে পারেন, এমন গল্পও শুনেছি।

মোল্লার বাড়ির সেই রেলিঙ দেয়া কালভার্টের অন্যপাশে ছিলো টিএন্ডটি’র দুটি ডিস্ট্রিবিউসন পয়েন্ট কেবিনেট। তারই সামনে ছিলো দাদুর সেলুন। সেলুন বলতে - ওই কেবিনেট আর বিদ্যুতের খুঁটির সাথে কসরত করে ঝুলানো পলিথিনের চালা, ছোট্ট আয়না, হাতলভাঙা চেয়ার, আর একটি টিনের বাক্সে খুর, কাঁচি, ফিটকিরি, সাদা কাপড়সহ আনুসাঙ্গিক কিছু উপাদান। চুল, দাঁড়ি কাটার চেয়ে মাথা আর শরীর মেসেজে খ্যাতি ছিলো তার। তবে খুব বেশী কাজ পেতেন না। এ নিয়ে কোনো হা-হুতাশও ছিলো না তার। তামাম অনিশ্চয়তাও ঢেকে রাখতেন পুরু মোটা চশমার আড়ালে । যদিও মাঝে মাঝে দেখতাম চেয়ারে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। কি ভাবনায় ডুবে যেন রিক্সা-গাড়ির আসা-যাওয়া দেখছেন।  আবার কখনো মুড ভালো থাকলে খুব আয়েশ করে বিড়ি ধরিয়ে তুমুল উৎসাহ নিয়ে নানান আলাপ জমাতেন,  বিশেষ আগ্রহ ছিলো স্থানীয় রাজনীতির ব্যাপারে।
সোহেল ভাইয়ের দোকান, রেলিঙ দেয়া কালভার্ট আর দাদুর সেই সেলুনের সামনে সিরিয়ালে থাকত বানারীপাড়া রুটের টেম্পুগুলো । কৈশোরের কত সকাল, দুপুর, রাত কেটেছে - ওই টেম্পুগুলোয়। অদূরেই ছিলো জগদীশ আশ্রম। সেটিও আমাদের আড্ডাখানা ছিলো দীর্ঘ দিন। লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকা বা গলা ছেড়ে গান গাওয়ার সেই মুহুর্তগুলো - আহা, কতই না অনাবিল ছিলো। 

বহুতল ভবনের নীচতলার একটি স্টলে আশ্রয় নিয়ে সোহেল ভাইয়ের চায়ের দোকান আজও টিকে আছে।  দাদু অবশ্য টিকতে পারেনি। দু’বছর আগের সে সাক্ষাতে বলেছিলেন, তার সেলুন এখন কাউনিয়ার মড়কখোলা পোল সংলগ্ন ডোমপট্টির বিপরীতে। বলেছিলাম যাব, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।  আশা করি - দাদু আজও ভালো আছেন, থাকবেন।

১৩ নভেম্বর ২০১৪

বরিশালই ‘আপন’ নায়লার

ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে
নিজের ব্যক্তিগত একাউন্টে অনুসারী ৭০ হাজার ৫৩১ জন আর অফিসিয়াল পেইজে দুই লাখ ৪০ হাজার ৪২৯ জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এই পরিসংখ্যান অবশ্য তার ‘উঠতি জশ’ বোঝানোর জন্য যথেস্ট নয়। পেশায় দন্ত চিকিৎসক হলেও স্বল্পবসনা বাংলাদেশী মডেল, আইটেম গার্ল বা নায়িকার পরিচয়ে আলোচনায় আসা এ তরুণীর পরিচিতি দিন দিনই বাড়ছে। সামাজিক গোঁঢ়ামীর পরাকাষ্ঠা ভাঙার সাহস দেখানোয় একদিকে যেমন সাধুবাদ পাচ্ছেন; অন্যদিকে আবার ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ ও ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ পরিপন্থী হিসাবেও অভিযুক্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ দেশ-বিদেশে ইতিবাচক ও নেতিবাচক, দু’ভাবেই প্রচার পাচ্ছেন তিনি। গত শতকের শেষ দশকে (১৪ ডিসেম্বর) বরিশালে জন্ম নেয়া এ তরুণীই এখন দেশী মিডিয়ার একমাত্র ‘সেক্সসিম্বল’। এতক্ষণে অধিকাংশ পাঠক তার নাম আন্দাজ করে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। সময়ের আলোচিত চরিত্র, নায়লা নাঈম। বরিশাল থেকে পরিচালিত এক অনলাইন নিউজ পোর্টাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তার এ সাক্ষাতকারটি নেয়া হয়েছিলো।

ঈয়ন : বরিশালের কোন এলাকায় জন্ম আপনার? বাবা-মাসহ পুরো পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
নায়লা নাঈম : বরিশালের পটুয়াখালিতে আমার জন্ম। বাবা, মা ও ছোট ভাইকে নিয়েই আমার পরিবার। বাবা বেসরকারী চাকরীজীবি আর মা আইনবিদ। আর ছোট ভাই পড়াশোনা করছে।

ঈয়ন : কেমন ছিলো আপনারৈ শৈশব, স্কুল জীবন?
নায়লা নাঈম : আমার শৈশব অনেক বৈচিত্রময়। বাবার চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আমার শৈশব কেটেছে। সবশেষে অবশ্য বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া হয়। আসলে স্কুল জীবনটা অনেক আনন্দময় ছিলো। অনেক বন্ধু-বান্ধবী ছিলো সেসময়। আমার স্কুল জীবনের খুব কাছের কোনো বান্ধবীর সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। অনেক মিস করি তাদের। অনেক মনে পড়ে স্কুলের স্মৃতিগুলো।

এখন তিনি
ঈয়ন : কি জাতীয় ঘটনার স্মৃতি?
নায়লা নাঈম : মনে পড়ে, আমার এক স্কুলে অনেক গাছের চারা লাগানো ছিলো । আর আমার নিজেরও বাগান করার প্রবল শখ ছিলো। বাসার টবে অনেক গাছ লাগাতাম। তখন মাঝে মাঝে স্কুল থেকেও গাছ নিয়ে এসে বাসার টবে লাগাতাম। এছাড়া আমার সেই স্কুলে একটা পুকুরও ছিলো। প্রায় প্রতিদিন স্কুলের পুকুর পাড়ের শীতল হাওয়ায় অনেকক্ষন বসে থাকা আমার শৈশবের অন্যতম আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

ঈয়ন : কুসুমকুমারী দেবী, কামীনি রায়, মনোরমা বসু মাসীমা, সুফিয়া কামাল বা মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগমের মতো যে অগ্রগামী নারীরা বরিশালে জন্মেছিলেন, তারা কি আপনার জীবন দর্শণে কোনো প্রভাব ফেলেছেন?
নায়লা নাঈম : আমি সবসময়ই বরিশালে জন্ম নেয়া কৃতি সন্তানদের অনেক শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তাঁদের আদর্শ, তাঁদের সংগ্রাম ও সফলতা আমায় এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়।

________________________________________

ঈয়ন : বলা হচ্ছে আপনি বাংলাদেশের প্রথম সেক্সসিম্বল মডেল, আইটেম গার্ল ও নায়িকা। আপনার আগে এ ক্ষেত্রে কেউ এতটা সাহসী হয়নি। এ সাহস আপনি কোথায় পেলেন? আর এ সাহস প্রদর্শন কি শুধুই খ্যাতির তাড়নায়, না নারী অগ্রযাত্রার বিষয়টিও আছে আপনার ভাবনায়?
নায়লা নাঈম : আসলে ডেণ্টিস্ট হবার পাশাপাশি, আমি যখন মডেল হিসাবে কাজ করি, আমার বিবেচনায় প্রাধান্য থাকে- যে প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছি সেই প্রোডাক্টটিকে সফলভাবে তুলে ধরা। আমার পাশাপাশি অনেকেই কিন্তু একইরকম কাজগুলো করছেন। কিন্তু তারা হয়ত আলোচনায় আসতে পারেননি। শুধুমাত্র আমার কাজগুলো নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। অনেকে হয়ত ব্যাপারটিকে সহজভাবে নিতে পারেননি এবং সমালোচনা করেছেন। কিন্তু অনেকেই আবার ওই একই কাজগুলোর প্রশংসাও করেছেন। তবে একটি ব্যাপার, কাজ করার সময় খ্যাতির ব্যাপারটা আমার কখনোই মাথায় থাকে না। আমি সব সময় বিশ্বাস করি- ভালো কাজ করলে, সঠিকভাবে মূল্যায়িত হলে- খ্যাতি পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভালো কাজের জন্যই আজ আমি এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি।
আলোকচিত্রীঃ নাসের আবু
ঈয়ন : বাঙালী মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ কাঠামো নাড়িয়ে প্রচলিত অনুশাসনের প্রতি বৃদ্ধঙ্গুলি প্রদর্শনের প্রেক্ষিতে যে প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠেছে তা কি করে সামলাচ্ছেন?
নায়লা নাঈম : আমার কাছে মনে হয়, একবিংশ শতাব্দীতে সময়ের সাথে সাথে আমাদের মূল্যবোধে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে একটা কাজ যেভাবে দেখা হত, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে সেটা এখন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হচ্ছে। এরপরও প্রতিটি কাজেরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থাকবে। যদিও ‘Different People, different thoughts’। এক্ষেত্রে আবারও বলছি, আমার যে কাজগুলো নিয়ে সমালোচনা হয়েছে, সেগুলো কিন্তু অনেক প্রশংসাও পেয়েছে। মূল ব্যাপার হচ্ছে, একটা কাজ কে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন - সেটা যার যার একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। তবুও আমি আমার কাজের প্রতিটি সমালোচনাকে অনেক গঠনমূলক ভাবে নেই। কারো সমালোচনার মাঝে সৃজনশীল কিছু পেলে তা গ্রহন করতে বা সেখান থেকে কিছু শেখার থাকলে সেটাকে ইতিবাচকভাবে নিতে আপত্তি নেই আমার।

ঈয়ন : পরিবারিক পারিপার্শ্বিকতা কতটুকু সহায়ক বা প্রতিবন্ধক হয়েছে?
নায়লা নাঈম : আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, মিডিয়ায় কাজ করার ব্যাপারে পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে এসেছি সবসময়। আমার পরিবার আমার কাজের সবচেয়ে বড় সমালোচক। তাদের সমর্থন ছাড়া কখনোই এত দূর আসা সম্ভব ছিলো না।
তন্ময় তানসেন পরিচালিত ‘রানআউট’ সিনেমার গানের দৃশ্যে
ঈয়ন : এ মুহুর্তে আপনার জীবনের লক্ষ্য কি? মানে এ জীবনে কি কি করতে চান?
নায়লা নাঈম : আপনারা জানেন যে, পেশাগত জীবনে আমি একজন ডেন্টিস্ট, মডেল এবং অভিনেত্রী। ঢাকায় আমার নিজের ক্লিনিক আছে, সেখানে আমি নিয়মিত রোগী দেখে থাকি। এই মুহূর্তে আমার লক্ষ্য, ডেন্টিস্ট হিসাবে নিজেকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এছাড়াও অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে একজন সফল অভিনেত্রী হিসাবে দেখতে চাই।
ঈয়ন : রিলেশনসিপ স্ট্যাটাস -
নায়লা নাঈম : এখনো আমি আমার মনের মত কোনো মানুষ খুঁজে পাইনি। আমি যাকে পছন্দ করবো সে দেখতে যেমনই হোক, মানুষ হিসাবে তাকে অবশ্যই অনেক ভালো, মানে সৎ ও চরিত্রবান হতে হবে।
ঈয়ন : আত্ম-সমালোচনা করুন।
নায়লা নাঈম : আসলে ডেণ্টিস্ট্রি, মডেলিং ও অভিনয়, তিনটি কাজ নিয়েই আমাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই মাঝে মাঝে আমার নিজের কাছে মনে হয় আমি যদি শুধুমাত্র একটি পেশায় নিয়োজিত থাকতাম তবে সে পেশায় আজ আরো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকতো; আরো ভালো কাজ করতে পারতাম।

সাম্প্রতিক ফটোস্যুট
ঈয়ন : বরিশাল ও বরিশালের মানুষ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
নায়লা নাঈম : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হলেও বরিশাল আমার সবচেয়ে পছন্দের শহর। বরিশাল শহরটাকে আমি অনেক মিস করি। বরিশাল শহরের সাথে আমার কৈশোরের অনেক অদ্ভুত প্রিয় স্মৃতি জড়িত। প্রথম ভালোবাসা বরিশালকে ঘিরে, প্রথম ভালোবাসার মানুষটাও ওই শহরের। তাই আমার এই ব্যস্ত জীবনের মাঝেও সময় পেলেই বরিশাল যাওয়ার ইচ্ছা থাকে আমার। ইচ্ছে করে হারানো কাছের বন্ধুদের খুঁজে পেতে। যাদের সাথে স্কুলে বসে অনেক আড্ডা দিতাম, ছুটির পরে একসাথে হেঁটে বাসায় ফিরতাম।

ঈয়ন : বরিশালবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে?
নায়লা নাঈম : বরিশালবাসীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বরিশালের মানুষ আমার অনেক আপন ও কাছের মানুষ। আমি সত্যি গর্বিত এই ভেবে যে, বরিশালবাসীরা মানুষ হিসাবে অনেক আন্তরিক ও ভালো মনের মানুষ। এই জনপদে জন্মগ্রহন করে আমি গর্ববোধ করি।
নায়লা নাঈম সম্পর্কে কৌতূহলীরা অন্তর্জালের যে কোনো খোঁজ যন্ত্রে বাংলা বা ইংরেজীতে তার নামটি লিখে অনুসন্ধান করলে নিরাশ হবেন না। খুঁজে পাবেন বহু সংযোগ। তার ওয়েবসাইটের ঠিকানা - www.nailanayembd.com আর পেইজের facebook.com/artist.nailanayem
অফিসিয়াল পেইজের স্ক্রিনসট

২১ অক্টোবর ২০১৪

অগ্নিযুগে এস এম তুষার এবং ...

© eon's photography / pap
মঠবাড়িয়া থেকে বরিশালে পড়তে আসা সৈয়দ মেহেদী হাসানের ব্যাপারে প্রথম উৎসুক হয়েছিলাম ‘অগ্নিযুগ’ পুনঃপ্রকাশ করায়। প্রথমে ধূসর আহমেদ নামের আরেক কবির সাথে যৌথ সম্পাদনায় কাজটি শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি একাই পত্রিকাটি কাঁধে নেন। এক সময় শ্রদ্ধেয় এস এম তুষার প্রকাশ করতেন ওই সাহিত্য পত্রিকা। তখন হাতে লিখে, ফটোকপি মেশিনে অনুলিপি করে বিলি হত ‘অগ্নিযুগ’। কি তুখোড় তেজে তিনি একের পর এক সংখ্যা বের করতেন তা যারা দেখেছেন, ভুলতে পারবেন না কখনো।

খুব বেশী আগের নয়, ১৯৯৯ থেকে ২০০৫’র মধ্যবর্তী সময়ের কথা। ওই সময়ে তুষারের সহচর হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তাই ভালো লেগেছিলো পত্রিকাটি পুনরায় মুদ্রণের খবরও। যদিও নতুন হাতে ‘অগ্নিযুগ’ চরিত্র বদলেছে। পরবর্তীতে জেনেছিলাম, স্থানীয় একটি দৈনিকে কাজ শুরু করেছেন মেহেদী। এরই মধ্যে গত বছরে লিটল ম্যাগাজিন আগুনমুখা’র সম্পাদক ও প্রকাশক নাজমুল শামীম আর কবি রূমান শরীফের কল্যাণে তার সাথে সাক্ষাত হয় আমার। সেদিন দুপুরে বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে তার হাতে ছিলো নিজের কবিতার বইয়ের পাণ্ডলিপি। চেয়ে নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা পড়লাম।

সেই সামান্য পাঠ, ক্ষণিকের সাক্ষাত আর আলাপে মেহেদীকে কেমন লেগেছে বা তাকে কোনো বিশেষ মতাদর্শধারী মনে হয়েছে কি’না তা নিয়ে আলোচনা এ লেখায় অপ্রাসঙ্গিক। সেদিনের পরে তার সাথে আলাপ হয়েছিলো ফেসবুকে। ইনবক্সে এস এম তুষারকে নিয়ে লেখা চেয়েছিলেন। কাজের চাপে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলাম তখন। তার উপরে যখন জানলাম লেখাটি ‘অগ্নিযুগ’ নয়, স্থানীয় একটি দৈনিকের সাহিত্য পাতার জন্য চাওয়া হচ্ছে; উৎসাহ হারালাম।

সব মিলিয়ে খানিকটা অনিচ্ছায় যে লেখাটি তৈরী হলো তা প্রকাশ করা হবে বলে আমার মনে হয়নি। কিন্তু লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। পাপ’র পাঠকদের জন্য সেটি নীচে তুলে ধরলাম।

তিনি এক বোধ জাগানিয়া বাতেনী স্রোত

যদি ঈমানদার না’ও হন, তবুও বিশ্বাস করুন- এস এম তুষার দুই লাইনের ছড়া নন; তিনি মহাকাব্য। এটা বুঝতে পারার পর থেকে তাকে আর ফরমায়েশী লেখার সংক্ষিপ্ততায় আটকানোর তাগিদ জাগে না কোনো। তার মতো আরো অনেকে আছেন এমন, যাদের নিয়ে স্বস্তালাপে আগ্রহী হয় না মন। তবুও লিখতে হয়েছে, হচ্ছে বা হবে হয়ত আরো। যদিও না লিখলেও কিছুই যাবে আসবে না কারো। সম্ভবত তারাও চায় না এমন আত্ম-প্রচার। কারণ, তারা বা তুষার মূলত বোধ জাগানিয়া এক বাতেনী স্রোত, যা অবিরত তাওয়াফ করছে আদি তীর্থভূমি চন্দ্রদ্বীপ বা পুরো বঙ্গদেশ। যার প্রভাবে সৃষ্ট দুরন্ত হাওয়ার বলয় জাগিয়ে তোলে তাদের সত্ত্বা, যারা বাজারকে পাশ কাটিয়ে চলার সাহস রাখে। অর্থাৎ তুষার ও তার সমমনারা বাজারী এ প্রচারণার উর্ধ্বে ওঠা প্রাণ। তবুও সাহিত্যকণ্ঠের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ। এ পাতার সম্পাদক কবি সৈয়দ মেহেদী হাসানের দায়িত্ববোধের কারণে একজন নতুন পাঠকও যদি এস এম তুষারকে চেনেন, তার বোধ ও কমের্র ব্যাপারে আগ্রহী হন; সেই’তো প্রাপ্তি। মেহেদীর এই বোধটাও আমার খুব চেনা। ওটা বেঁচেই যে টিকে থাকেন, মহান সাজেন বাজারী মিডিয়ার মালিকেরা। তারুণ্যের এ তাজা বোধ তাদের অন্যতম হাতিয়ার। বরিশাল থেকে বার্লিন, সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজমান। প্রতিষ্ঠান, বা তারও নেপথ্যের শক্তি - মানে মালিকেরা শ্রমিকের সবটুকুই কেড়ে নেয়, এমনকি বোধটুকুও। কর্মনিষ্ঠ শ্রমিকটি এরপরও হয়ত মাস গেলে বেতন পায় না নিয়মিত। অথবা পেলেও তার পরিমাণ প্রকাশ করতে পারেন না কখনো। এ কোনো ক্ষোভের কথা না, বাস্তবতা। বরিশালের কোনো দৈনিক পত্রিকা এ নিয়ম ভেঙে চলবে তা আজও আশা করি না। তবে আশাবাদী হই, ওই বাস্তবতায়ও স্বপ্নালু চোখগুলো দেখে। যে চোখগুলোয় জ্বলে এস এম তুষারের দৃষ্টি। আজীবন বঞ্চিতদের কথাই বলতে চেয়েছেন তিনি। চেয়েছেন তামাম মুখোশ খুলে দিতে। যে কারণে বাজারী মিডিয়ায় টিকতে পারেননি, বা আপোষ করে টিকে থাকতে চাননি। হতে চাননি কারো মুখোশের উপাদান। নিভৃতে সার্বজনীন বোধ বা আত্মপোলব্ধি জাগানিয়া সুর গাঁথায়ই ভালো লাগা তার। আজও গেঁথে যাচ্ছেন। বাতাসে কান পাতলেই শুনি তিনি গেয়ে যাচ্ছেন। সহজিয়া ঢঙে ব্যাখ্যা করছেন সব আদি পাঠ।
শোনো কালো মেয়ে...
বড় সড়কের ঘন্টা বাজানো বুড়ো
মরে গেল শেষরাতে
আফ্রিকার -
পথে পথে হাঁটবে না
বুড়ো সায়মন আর
বলবে না কোনদিনও
উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগের কথা
শোনো কালো মেয়ে..
আমি সেই কন্ঠস্বর
যা মিশে থাকে ঘনকালো
অরণ্যের লতায় পাতায়
ঝিলের ওই টোল খাওয়া পানিতে
হরিনের মুখ রাখার ভঙ্গীমায়
উটের গলার - ঘন্টার ধ্বণিতে
শোনো কালো মেয়ে..
বড় সড়কের ঘন্টা বাজানো বুড়ো...
থেমে যান তুষার। বিড়িতে সজোরে দম মারারও আওয়াজ শোনা যায়। ক্ষণিকের নিরবতা ভেঙে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করেন শুরু করেন। - ‘সভ্যের বর্বর লোভ নগ্ন করল তোমার আপন নির্লজ্জ অমানুষতা / তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকূল পঙ্কিল হল ধূলি / তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে / দস্যু পায়ের কাঁটা মারা জুতোর তলার / বিভৎস কাদার পিন্ড / চিরচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাস।’ ফের শুরু করেন গান।
শোনো কালো মেয়ে
শত্রুর বন্দুকের ছায়ায় ছায়ায়
বেড়ে ওঠা সন্তান
তোমার কন্ঠে খোঁজে
কালো নিগারের গান
যে গানের সুরে সুরে
পাথুরে পাহাড় ভাঙে
হেনরীর হাতুরী
ভার্জিনিয়ার বুকে আর
কাতাঙ্গা প্রদেশে
গনহত্যার পর
কালো মৃতদেহগুলো
জোৎস্নায় স্নান করে
শোনো কালো মেয়ে...

জয়তু এস এম তুষার, জয়তু মেহনতি জনতা।

লেখাটি প্রকাশের সাহস মুগ্ধ করেছিলো। সেই সাথে মেহেদীর চাকরির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কাও জেগেছিলো মনে। আর তা যে নেহাত অনুমান ছিলো না, তা’ও দ্রুতই টের পেলাম। গত ১৬ অক্টোবর (২০১৪) দুপুর একটার দিকে তার দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসটি নীচে তুলে ধরা হল।
“আমি লোকাল পত্রিকার সাংবাদিক। এর চেয়ে পতিতাপল্লীর দালালিও ভালো বা মর্যাদার। সাংবাদিক বলতে এখানে মালিক পক্ষের মনোরঞ্জন করে চলাটাই শেষ কথা। যে পারবে না সে সাংবাদিক না। বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক কলমের কণ্ঠর জন্ম থেকেই সাথে ছিলাম নগন্য সাংবাদিক বা দালাল হিসেবে। সর্বশেষঃ শনিবারের সাহিত্যকণ্ঠ, বুধবারের বিঞ্জান, প্রতিদিনের অবাক খবর, হুদাই বেহুদা বিভাগগুলো দেখতাম। মনে প্রাণে কষ্ট করে চালাতাম। তার উপরে দৈনিক স্পেশাল, বা ক্রাইম নিউজ দিতে হত। তবে মনোরঞ্জন করতে পারলাম না মালিক পক্ষকে। পরাজিত হলাম আমিই। ছেড়ে দিলাম দৈনিক কলমের কণ্ঠ। সাহিত্যজনরা মাফ করবেন, আপনাদের সাহিত্যকণ্ঠ আর বের হবে না। হলেও সাহিত্য সম্পাদক সৈয়দ মেহেদী হাসান থাকছে না।”
কিছুক্ষণ আগে (২১ অক্টোবর, ২০১৪) মুঠোফোনে মেহেদীর সাথে কথা বলে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। দৈনিক দেশ জনপদ নামের আরেকটি স্থানীয় পত্রিকায় তিনি চাকরি পেয়েছেন। আর ওদিকে এস এম তুষারও আবার লেখালেখি আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। পুনর্জ্জীবিত করেছেন ব্রিটিশ আমলের এক সাংবাদিক সংগঠন। সেইসঙ্গে সময় দিচ্ছেন লিটল ম্যাগাজিন ও প্রকাশণী আগুনমুখা’কে।

এস এস তুষার ও তার ভাবশিষ্যরা, ভালো থাকুক সব সময় - এই প্রত্যাশা।

স্কেচঃ রাসেল আহমেদ

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪

দুঃখিত নই, শঙ্কিত হই

গত দশকেই অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলো চলচ্চিত্র প্রদর্শন। ২০১২’র মাঝামাঝি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় প্রেক্ষাগৃহটি। অবশ্য তার আগেই এর নীচতলার সম্মুখভাগের একাংশ পরিণত হয় ‘ভিসিডি’ সেন্টারে। আর এখন মূলত সেটাই শুধু চালু আছে। অর্থাৎ সোহাগ সিনেমা হল এখন সোহাগ ভিসিডি সেন্টার। বরিশালের উপজেলা শহর বানারীপাড়ার একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ ছিলো এটি। নিজ নামের রাস্তায়, মানে সোহাগ সিনেমা হল রোডে নিজের ফসিল হয়ে সে আজও দাঁড়িয়ে আছে কি’না ঠিক বলতে পারছি না। কারণ, ছবিটি প্রায় এক বছর আগে (২০ অক্টোবর, ২০১৩) তোলা। নাম দিয়েছিলাম ‘রূপান্তর’ বা ‘the transformation’। ওই সময় স্থানীয়রা জানিয়েছিলেন, প্রশাসন ‘কাটপিস’ [চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ড অনুমোদিত চিত্রের বদলে সংযুক্ত পর্নোগ্রাফী] চালাতে না দেয়ার ব্যাপারে কাঠোর হওয়ার পরই মালিকরা হলটি বন্ধ করে দেন। তারা এটি ভেঙে এখানে একটি মার্কেট করার চিন্তা-ভাবনা করছেন বলেও অনেকে শুনেছেন। এখানে জানিয়ে রাখি, তখন ‘নৃ’ নামের একটি চলচ্চিত্র চিত্রায়নের কাজেই যাওয়া হয়েছিলো ওই এলাকায়, মানে বানারীপাড়ায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যম, ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের প্রেক্ষাগৃহ বা চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কোনো আলোচনা, বিতর্ক দেখলে এ ছবিটির কথাও মনে পরে। একইসঙ্গে স্মরণে আসে, এখানে গত ১০ বছরে কমপক্ষে সাড়ে সাতশ’ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। গত জুনে (২০১৪) এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন জানিয়েছেন, ২০০১ সালেও বাংলাদেশে ১২শ’র বেশী হল ছিলো। কিন্তু এখন টিকে আছে মাত্র সাড়ে চারশ’টি। সমিতির পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে, প্রান্তিক এলাকায় ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা প্রতিটি হলই যে কোনো মুহুর্তে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে।
ভালো সিনেমার অভাবে দেশের অনেক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাগৃহেও এখন ‘কাটপিস’ নির্ভর চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। সাধারণত ভিনদেশী জনপ্রিয় নায়ক বা নায়িকার দেহে এ দেশীয়দের ধর বসিয়ে তৈরী করা হয় ওইসব সিনেমার পোস্টার। গত জুনে (২৯ জুন, ২০১৪) পিরোজপুরের সরূপকাঠীর ইন্দ্রেরহাট থেকে নৌ-পথে সুতিয়াকাঠী যাওয়ার পথে চোখে আটকে যায় ওই জাতের এই পোস্টারে, সাথে সাথেই এটি ক্যামেরাবন্দী হয়। ছবিটির নাম দিয়েছিলাম ‘The Censored Publicity’।
শৈশবে পরিবারের সদস্যদের সাথে হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা থাকলে এমন চিত্র দেখে অস্বস্তিতে ভুগবেন হয়ত, আমিও ভুগছি। কারণ, চলচ্চিত্রের এ পশ্চাতযাত্রায় দুঃখিত নই, শঙ্কিত হই। দেশী চলচ্চিত্রের দুরাবস্থার সাক্ষ্যদানকারী ওই স্থিরদৃশ্য দুটি ধারণে ডিএসএলআর [Canon EOS 7D ক্যামেরা ও EF-S55-250mm f/4-5.6 IS লেন্স] প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিলো।

২১ আগস্ট ২০১৪

‘সাংবাদিক মারলে কিচ্ছু হয় না’

- শিরোনামের ওই সংলাপটি নানা ভাবে কত বার যে শুনতে হয়েছে জীবনে । মহল্লার ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের জাতীয় নেতা, পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, এমনকি সুহৃদ বন্ধুদের মুখেও। কেউ বলেছেন হুমকী দিয়ে, আবার কেউ শঙ্কা জানিয়ে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানও বরাবরই সমর্থন করেছে তাদের। এই যেমন গত বছরও (২০১৩ সালে) বিশ্বজুড়ে দায়িত্ব পালনকালে ১০৮ জনেরও বেশী সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। আর বিশ্বের যেসব দেশে এ জাতীয় হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ছোট্ট এ দেশে গত দেড় যুগে কমপক্ষে ৪০ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।  সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির বহুলালোচিত হত্যাকাণ্ডের মতো অধিকাংশ হতাকাণ্ডের ক্ষেত্রেই বিচার’তো দূরের আলাপ, রহস্যই উদঘাটিত হয়নি।

পুলক চ্যাটার্জী।
ছবিটি তুলেছেন আরিফুর রহমান।
দ্বিধা-বিভক্তি বা স্বার্থান্বেষণ আমাদের, মানে সাংবাদিকদের প্রতিবাদকেও বার বারই করেছে ম্রিয়মাণ। নিজেদের পায়েই কুড়াল মেরেছি আমরা। ভীরুতা আর অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদেরই করেছি নিরাপত্তাহীন। এরই জেরে এবার বরিশাল নগরীর উত্তর মল্লিক রোডে নিজের বাসার ফটকে হত্যা চেষ্টার শিকার হয়েছেন পুলক চ্যাটার্জী। বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পুলকের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে গত রাতে সাত/আটটি কোপ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভে নিবির পরিচর্যায় আছেন; মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আর সংশ্লিষ্ট - আপাত অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের এটুকু বলতে চাই - সমগ্র বাঙলা আর বাকলা, মানে বরিশাল; এক না। ওই পূণ্যভূমির মানুষেরা সামগ্রিকতার স্বার্থে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিতে জানে। অতএব তোদের বিচার হবেই হবে।



১৯ আগস্ট ২০১৪
মনসুরাবাদ, ঢাকা।

***
পুলক চ্যাটার্জী শঙ্কামুক্ত জেনে কিছুটা হালকা লাগছে। তবে এখনো এ হত্যা চেষ্টার কোনো ক্লু – বের হয়নি। ঘটনার পর এক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি পুলিশ। অথচ এ ঘটনা চাউড় হওয়ার পর শুধু বরিশাল নয়, সারা দেশেই নিন্দার ঝড় উঠেছে। ঘটনার প্রতিবাদে রাজপথেও নেমেছেন সাংবাদিকরা। গতকাল সন্ধ্যায় এক ঝটিকা মিছিল শেষে আগামীকাল বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে বরিশাল প্রেসক্লাব। বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএম কলেজ জার্নালিস্ট এসোসিয়েসনসহ সাংবাদিকদের অন্যান্য সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়েছে এই ঘটনার বিরুদ্ধে। ওদিকে জ্ঞান ফেরার পর নিজে বাদী হয়ে অজ্ঞাত তিন হামলাকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পুলক। এখন দেখা যাক এক্ষেত্রে কত দূর কি হয়। কারণ, সারাদেশের মতো বরিশালেও সাংবাদিক নিস্পেষণ’তো কোনো নতুন ঘটনা নয়।
২০ আগস্ট ২০১৪
মনসুরাবাদ, ঢাকা।
***
নিহত সাগর ও রুনির মৃতদেহ
পুলক চ্যাটার্জীকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত সংবাদ পড়তে পড়তেই নিকট অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ইচ্ছে হলো। কেউই নিশ্চয়ই ভোলেননি - ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। একই বছরের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীতে সাংবাদিক দম্পতি প্রবীণ সাংবাদিক ফরহাদ খান ও তার স্ত্রী রহিমা খানম, ৭ এপ্রিল দৈনিক আজকের প্রত্যাশা’র সাংবাদিক মাহবুব টুটুল, একই দিন সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠ’র সাংবাদিক আলতাফ হোসেন এবং ৭ ডিসেম্বর দৈনিক ভোরের ডাক’র গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রাঞ্জু হত্যার শিকার হন। এর আগে ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন সাপ্তাহিক ২০০০’র সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী, ৯ জুন এটিএন বাংলা’র সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল এবং ২৩ ডিসেম্বর মুলাদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী।

২০০৯ সালে খুন হন চার জন, ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এনটিভি’র ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, জুলাইয়ে পাক্ষিক মুক্তমন’র স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা, আগস্টে গাজীপুরে সাম্প্রতিক সময়’র নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারী এবং ডিসেম্বরে রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ। এর আগে ২০০৫ সালে খুন হন - ১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংগ্রাম’র সাংবাদিক শেখ বেলাল উদ্দিন, ২৯ মে দৈনিক কুমিল্লা মুক্তকণ্ঠ’র সম্পাদক মুহাম্মদ গোলাম মাহফুজ এবং ১৭ নভেম্বর দৈনিক সমকাল’র ফরিদপুর ব্যুরো প্রতিনিধি গৌতম দাস।

আরো একটু অতীতে গেলে আমরা দেখতে পাই - ২০০০ সালের ১৫ জানুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার বীরদর্পণ’র সাংবাদিক মীর ইলিয়াস হোসেন দিলীপ এবং ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠ’র যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবলকে হত্যা করা হয়। এর আগে ২০০১ সালে খুন হয়েছিলেন পাঁচ সাংবাদিক। ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ’র খুলনা ব্যুরো প্রধান, নিউএজ ও বিবিসি’র সাংবাদিক এবং খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা, ২ মার্চ দি নিউএজ’র সাংবাদিক আবদুল লতিফ পাপ্পু, ২১ এপ্রিল খুলনার ‘দৈনিক অনির্বাণপত্রিকার সাংবাদিক এসএম নহর আলী, ২৭ জুন খুলনার দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু, ২ অক্টোবর বগুড়ার দৈনিক দুর্জয় বাংলা’র নির্বাহী সম্পাদক এবং বিএফইউজের তৎকালীন সহ-সভাপতি দীপঙ্কর চক্রবর্তী। ২০০২ সালে ২ মার্চ খুন হন খুলনার দৈনিক পূর্বাঞ্চল’র স্টাফ রিপোর্টার হারুনার রশীদ খোকন এবং ৫ জুলাই ডুমুরিয়ার সাংবাদিক সরদার শুকুর হোসেন।

লাশটি বোমা হামলায় নিহত সাংবাদিক মানিক সাহার।
১৯৯৮ সালে ১৬ জুলাই খুন হন  কালীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা এবং ৩০ আগস্ট দৈনিক রানার’র সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল। ১৯৯৬ সালে ১২ জুন চুয়াডাঙ্গার দিনবদলের কাগজ’র সাংবাদিক বজলুর রহমান, ১৯ জুন সীতারার দৈনিক পত্রদূত’র সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম. আলাউদ্দিন এবং একই সালে নীলফামারীর নীলসাগর পত্রিকার সাংবাদিক কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়।

১৯৯৫ সালে খুন হন যশোর জেলার দৈনিক রানার পত্রিকার সাংবাদিক ফারুক হোসেন। এর আগে ১৯৯৪ সালে, যশোর জেলার দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকার সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও মানিকছড়ির সাংবাদিক কামাল হোসেনকে হত্যার করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে খুন হওয়া সাংবাদিকের তালিকায় আরো আছেন - দৈনিক জনবাণী’র রিপোর্টার বেলাল হোসেন, যশোরের দৈনিক রানার’র গোলাম মাজেদ, রাঙ্গামাটির এনটিভির প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দৈনিক যুগান্তর’র সাংবাদিক আহসান আলী, মৌলভীবাজারের ফারুক আহমেদ।

এসব হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর প্রায় সবগুলোই হিমাগারে আছে। কারণ, এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্যি যে দেশের সমাজবিরোধী অশুভ শক্তির পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি সরকারেরও শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয় সাংবাদিকরা। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রে খুনের ঘটনাগুলো দ্রুত তদন্ত করে বিচারের উদ্যোগ নিতে দেখা গেলেও সাংবাদিক হত্যার ব্যাপারে নির্লিপ্তই থেকেছে সব সরকার। গত দেড় দশকের এতগুলো সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া কি রাষ্ট্রের অমার্জনীয় ব্যর্থতা নয়? কোন সরকার এ ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবে?

২১ আগস্ট ২০১৪
মনসুরাবাদ, ঢাকা।

১৬ জুলাই ২০১৪

সেনের প্রত্যাবর্তন - the return of sen

***
দেশ ভাগের আগে বেউখির ছিলো সমৃদ্ধশালী এক গ্রাম। ওই সময় ‘সেনগুপ্ত’ আর ‘দাশগুপ্ত’ পদবীর হিন্দু ধর্মালম্বীরা ছিলো এর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা। বরিশালের ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশার এই গ্রামে তখন বারো মাসের তেরো পূজোয় ঢাক বাজত মোট চৌদ্দ বাড়িতে। সারা বছরই উৎসবের আমেজে মুখরিত থাকত বেউখির। নানা আয়োজনে সরগরম থাকত চারিদিক। চিত্রটা বদলাতে শুরু করে ১৯৪৭’র পর। ভারতবর্ষ ভাগের আগে বা পরে পুরো কীর্তিপাশায় কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হলেও দূর-দুরান্ত থেকে ভেসে আসা নানা খবর এলাকার হিন্দুদের আতঙ্কিত করে তুলেছিলো। বহিরাগত দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে পাহাড়ার ব্যবস্থা করেও সে আতঙ্ক কমাতে পারেনি স্থানীয় মুসলমানরা। বিশেষত ১৯৫০’র দাঙ্গার পর ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে শুরু করে কীর্তিপাশার প্রতিটি গ্রামের হিন্দু বাড়ি-ঘর। বেউখিরের এক একটি পরিবারও প্রাণ আর সম্ভ্রম রক্ষায় পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে শুরু করে। এমনই এক পরিবারের কর্তা ছিলেন উষাকান্ত সেনগুপ্ত। গেরস্থ বাড়ির সন্তান হলেও তিনি পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। আমৃত্যু এ দেশান্তর মেনে নিতে পারেননি। বার বার তিনি ফিরতে চেয়েছেন বেউখিরে। সহধর্মীনি প্রেমলতা সেনগুপ্তকে নিয়ে ফিরে নিজের ভিটেয় মরতে চেয়েছেন। কিন্তু তা আর হয়নি। এই অতৃপ্তিই কি তাকে ফের নিয়ে আসবে বেউখিরে? হয়ত অন্য কোনো জন্মে, অন্য কোনো পরিচয়ে – ফিরবেন কি সেই সেন? এরই সূত্র ধরে ভাবি, কোনো জন্মে লক্ষন সেনও কি নদীয়ায় ফিরেছিলেন?

*** 
ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চে অমিত সেন
অমিত’দা, মানে সময়ের ব্যস্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিত সেনের শেকড়ও যে বরিশালে তা জেনে যতটা না অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশী অবাক হয়েছিলাম তিনি কখনো এখানে আসেননি শুনে। কোলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও এ মানুষটি শুধু কাজের প্রয়োজনেই গিয়েছেন ১৫টি দেশে। সবমিলিয়ে ঘুরেছেন মোট ৩০টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশেও তার আসা-যাওয়া সেই ১৯৯০’র পর থেকেই। কিন্তু এই দুই যুগে তিনি বরিশাল যাননি কখনো। খোঁজেননি নিজের শেকড়। প্রথমে এ কথা বিশ্বাসই হয়নি। কবি বন্ধুদের কল্যানে এটা অবশ্য আগেই জানতাম যে ‘ওপারে’ এমন অনেক ‘বরিশাইল্যা’ আছেন যারা কখনো বরিশালেই আসেননি। তবে এর শহর-বন্দর-গ্রাম, হাট-বাজার, খাল-নদী, পুকুর-দীঘি, ক্ষেত-মাঠ, বন-জঙ্গল বা আলো-হাওয়া জড়ানো নানা লোক গাঁথা আর পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়ার গল্প শুনতে শুনতেই তারা বড় হয়েছেন। কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, কচা, বিষখালী বা পায়রার বাঁকে বাঁকে মিশে থাকা গান আর পুঁথির সুরও তাদের খুব চেনা। জেনেছেন দুরন্ত ঢেউয়ের আবাদী উচ্ছাস আর মাতাল প্রলয়ের কথা। চিনেছেন মায়ার শুভ্রতার সাখে মিশে থাকা অজ্ঞতা নিমজ্জিত লোলুপ হিংস্র বর্বরতাও। বুঝে নিয়েছেন ভূ-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় শেকড়হারা তারা এখন ভিনদেশী নাগরিক। ভিসা নিয়েই এদেশ, মানে বাংলাদেশে ঢুকতে হয় তাদের। তাই হয়ত তারা ভিটেয় ফেরার আশা করেন না এখন আর। কিন্তু শেকড়ের টান কি কখনো মুছে যায়? এখানে মৃদুল দাশগুপ্তের নামোল্লেখ করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে ১৯৫৫ সালে জন্মানো এ কবি যে নিজের জ্ঞাতসারেই এক কট্টর, মানে মনে-প্রাণে ‘বরিশাইল্যা’ - তা জেনেছিলাম আরেক ঘটনাচক্রে। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘চাইনিজরা যেমন যে দেশেই জন্মাক তারা চাইনিজই হয়। তেমনি বরিশাইল্যারাও যেখানেই থাকুক তারা বরিশাইল্যাই রয়।’ অন্তর্জালীয় আড্ডাঘরের দীর্ঘ আলাপের পর সাক্ষাতে অমিত’দার বিস্তারিত শুনে বুঝেছিলাম মৃদুল’দা ভুল বলেননি। সে প্রসঙ্গে না গিয়ে তখন শুধু বলেছিলাম, আমার প্রথম সিনেমার প্রেক্ষাপট পেয়ে গেছি বোধহয়। প্রাথমিক ভাবনাটা শুনে অমিত’দা-ও নারাজ হলেন না। সেই থেকে আমাদের যৌথ পরিকল্পনা শুরু। মিশন – অমিত’দার শেকড় অনুসন্ধান, বা আমার সিনেমার গল্প। এরই ধারাবাহিকতায় গত জুনের শেষ হপ্তায় আমরা দারুণ উত্তেজিত। অবশেষে শেকড়ে ফিরছেন অমিত’দা। তার যাত্রাটা শুরু হয় কোলকাতার টালিগঞ্জের প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের সাউথ সিটি কমপ্লেক্সের বাসা থেকে। সেখান থেকে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে সোজা ঢাকায়। এখানেই দাদার সাথে যোগ দেই আমরা। অর্থাৎ আমি, রাসেল ভাই (চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ) আর গানের দল ত্রিমিঙ্গিলের নাজমুল হুদা। পরিকল্পনানুযায়ী লঞ্চে চেপে আমরা সোজা বরিশাল চলে যাই। এর আগে অবশ্য ঢাকায়ও কয়েকজনের সাথে দেখা করতে হয়েছিলো অমিত’দাকে, তা খুবই অল্প সময়ের জন্য।

লঞ্চের টি-স্টলে অমিত’দার সাথে আমার এ ছবিটি তুলেছিলেন রাসেল ভাই
***
৫০’র দাঙ্গা বেশ ভালো প্রভাব ফেলেছিলো বরিশাল অঞ্চলে। লেখক ও গবেষক কুলদা রায়ের এক লেখায় পড়েছিলাম, ‘১৯৫০ সালের কোলকাতায় একটা ছোটোখাটো দাঙ্গা হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খবর রটেছিল কোলকাতায় একে ফজলুল হকের এক আত্মীয়কে হিন্দুরা মেরে ফেলেছে। ফলে তীব্রভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় আক্রান্ত হয় হিন্দুরা। এটা ছিল পাকিস্তান সরকারের একটা পরিকল্পনা। সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। সে সময় ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় মেরে ফেলা হয় নয় দিনে দশ হাজার হিন্দুকে। শুরু হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বরিশালের মাধবপাশার জমিদার বাড়ির ২০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। এ এলাকার তীব্র আক্রান্ত গ্রাম হল লাকুটিয়া এবং কাশিপুর।’ কুলদা আরো লিখেছেন, ‘সে সময়ে মুলাদীর নদী লাল হয়ে গিয়েছিল মানুষের রক্তে। বরিশালে মেরে ফেলা হয়েছিল ২৫০০ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়িঘর। লুটপাট করা হয়েছিল সহায়-সম্পদ। ধর্ষণের শিকার হয়েছিল অসংখ্য নারী। দখল করা হয়েছিল অনেকের জমিজমা।’ একে ফজলুল হকের জন্মস্থান বা নানা বাড়ি ছিলো ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামের দুরত্ব বেউখির থেকে খুব বেশী নয়। তাই ৫০’র ওই বিভৎসতায় উষাকান্ত বা অন্যান্য পরিবারের কর্তারা কেন আতঙ্কিত হয়েছিলেন, তা বোধকরি সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ভিটে ছাড়া হতে কেইবা চায়। অন্য অনেকের মতো উষাকান্তও চাননি। পরিস্থিতির চাপে ভিটে ছাড়ার পরও, ছাড়তে পারেননি মায়া। যে কারণে পুষেছিলেন ফেরার আশাও।

বরিশালের হাওয়ায় উৎফুল্ল দাদা
***
২৮ জুন ২০১৪। সকালটা ছিলো মন ভালো করা রোদে মাখা। সেই রোদ গায়ে মেখেই লঞ্চ থেকে নামি আমরা। নীলাকাশ তলের কীর্তনখোলার সামনে দাঁড়িয়ে অমিত’দা যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন। তার দৃষ্টি অনুসরন করে দেখি তা ওই দূরের বাঁকেরও ওপাড়ে মিলিয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে চলে আসি, তখনও সজাগ হয়নি বরিশাল নগরী। মসজিদে ফজরের নামাজ আদায়কারী বা প্রাতঃভ্রমণকারী ছাড়া রাস্তায় যাদের দেখা পাচ্ছিলাম, তাদের প্রত্যেকের সাথে লাগেজ। অর্থাৎ হয় লঞ্চ, নয় বাস যোগে মাত্র শহরে পৌঁছেছে। নগরের এ শোভা গিলতে গিলতেই সকাল সন্ধ্যা রেস্তোরায় গিয়ে আমরা নাস্তা করে ফেলি। এরপর গল্পচ্ছলেই নিয়ে নেই ক্ষণিকের বিশ্রাম। ভর দুপুরে আমরা যখন বরিশাল থেকে আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে রওনা হলাম তখন আকাশে মেঘের আনাগোনাও বাড়ছিলো ধীরে ধীরে। বাড়ছিলো বাতাসের বেগ, আর্দ্রতা। বাহন - ভাড়া করা মাইক্রোবাস। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছেন অমিত’দা। পেছনে আমি, রাসেল ভাই, ড্যানি (চিত্রগ্রাহক ড্যানিয়েল ড্যানি) ও নাজমুল। বরিশালে আমরা কারো বাসায় না উঠে ঘাঁটি গেরেছিলাম ছিলাম গীর্জা মহল্লা, মানে খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দিন সড়কের হোটেল ইম্পেরিয়ালে। সেখান থেকে সদর রোড, বাংলাবাজার, সাগরদী ও রূপাতলী হয়ে আমরা কালিজিরা ব্রীজ পেরিয়ে শহর ছাড়াতেই গান ধরলেন রাসেল ভাই। কফিল আহমেদের গান, ‘গঙ্গাবুড়ি’। গলা মেলালাম সবাই। গানের তালে তালে সবুজের বুক চিড়ে চলে যাওয়া কালো পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।

***
সেই উষাকান্তের উত্তরসূরী
উষাকান্ত সেনগুপ্ত তার পরিবার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের খলিশাকোটা পল্লী নামের যে গ্রামে গিয়ে ডেরা বেঁধেছিলেন, সেটিও ছিলো বেউখিরেরই মতই শান্ত-শ্যামল-সুনিবির। উষাকান্তের মৃত্যুর আগেই সেখানে পুরো পরিবারের হাল ধরেছিলেন তার মেঝো ছেলে রঞ্জিত কুমার সেনগুপ্ত। ভারতীয় সেনাবাহীনিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তার বড় ভাই অজিত কুমার সেনগুপ্তের একটা গতি অবশ্য আগেই হয়েছিলো। পুরো পরিবার কোলকাতায় আসারও আগে তিনি শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ে করে নিজের তিনি সংসার নিয়ে আলাদাই ছিলেন। তাই বাকি তিন ভাই; মানে অসিত, অধির ও তপন সেনগুপ্ত বড় হয়েছেন রঞ্জিতেরই হাড়ভাঙা খাঁটুনিতে। ১৯৬২ সালে চৈতালী দাশগুপ্তের সাথে বিয়ে হয় তার। চৈতালীর বাপের বাড়ি ফরিদপুর হলেও - তিনিও বড় হয়েছেন বরিশাল অঞ্চলে। ক’বছর পরই রঞ্জিত-চৈতালীর ঘর আলো করে আসে তাদের একমাত্র সন্তান, অমিত সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে অবশ্য কবি জীবনানন্দ দাশগুপ্তের মত সেই অমিতও তার গুপ্তটাকে গায়েব করে দিয়েছেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। সেই অমিত সেনগুপ্ত বা অমিত সেনই মানে আমাদের অমিত’দা। উষাকান্তের উত্তরসূরী। যিনি এবার এসেছেন তার পিতামহের ফেলে যাওয়া ভিটে বা নিজের শেকড়ের সন্ধানে।

***
দ্রুত ঝালকাঠির দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। গন্তব্য সেই বিউখির। এই ভূখন্ডে ঠিক কবে থেকে জনবসতি শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও নাম দেখে বোঝা যায়- এখানে কৈবর্ত জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা আবাদ করেছিলো। এক সময় কৈবর্ত জেলেদেরই ঝালো বলা হতো এবং তাদের পাড়াকে বলা হতো ঝালোপাড়া। অনেকের ধারণা এ ঝালোপাড়া থেকেই ঝালকাঠি নামের উৎপত্তি। কবি বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যেও জেলে সম্প্রদায়কে ঝালো নামে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বরুপ সেনের একখানি তাম্রলিপিতেও ঝালকাঠির নাম রয়েছে। এছাড়া একাধিক ইতিহাসগ্রন্থ মতে, চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্যতম একটি বন্দর ছিল সুতালরী। সম্রাট শাহজাহানের ফৌজদার ছবি খাঁ বাকেরগঞ্জ থেকে সুতালরী হয়ে কোটালীপাড়া পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে সুতালরী বন্দরের পার্শ্ববর্তী জঙ্গল পরিস্কার করে বাসভূমি গড়ে তোলে জেলেরা। ওই অংশের নাম হয় ঝালকাঠি। আরেক মতের দাবি, প্রতাপশালী জমিদার রামভদ্রের শাসনামলে বাজার বসে পোনাবালিয়ায়। এক সময় সে বাজার স্থানান্তরিত হয় মহারাজগঞ্জে যা আজকে ঝালকাঠি নামে পরিচিতি।

নস্টালজিক অমিত সেন
***
রঞ্জিত আর চৈতালী ইহলোক ত্যাগ করেছেন, তা’ও ১০-১৫ বছর হয়ে গেছে। জীবদ্দশায় তাদেরও কখনো ফেরা হয়নি নিজেদের দেশ, মানে বাংলাদেশে। তবে তাদের মুখে এ দেশ, বরিশাল বা ফেলে আসার গ্রামের অনেক গল্প শুনেছেন অমিত’দা। শুনেছেন পিতামহ আর অন্যান্য স্বজনদের বলা গল্পও। যে কারণে ঝালকাঠীর দিকে যত আগাচ্ছিলাম, ততই নস্টালজিক হচ্ছিলেন তিনি। শৈশবে শোনা গ্রামের গল্পগুলো বলছিলেন আমাদের। ক্রমে নরম হচ্ছিলো তার স্বর। কিছুক্ষণ পর পরই অবশ্য গল্প থামিয়ে সেলফোন দিয়ে ছবি তুলছেন, আর তা আপলোড করছেন ফেসবুকে। তাতে আবার যাদের মন্তব্য পাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশেরই শেকড়ই এপারে। কারো কারো হয়ত বরিশালে বা ঝালকাঠীতেই। অমিত’দার পোস্ট করা ছবিগুলো তাদেরও যে নাড়িয়ে দিচ্ছিলো তা মন্তব্যগুলো পড়েই বোঝা যাচ্ছিলো। আকাশে মেঘের দলও ভারী হচ্ছিলো ধীরে ধীরে। এরই মাঝে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। হালকা, গাঢ় নানা ধরনের সবুজ। এদিকে সুযোগ পেলেই গান ধরছেন রাসেল ভাই, আর তাতে গলা মিলাচ্ছি সবাই। এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলছে নানা রঙ্গও।

***
এটা মোটামুটি সকলেই নিশ্চিত যে, রাজা সত্যাচরণ ঘোষাল পরিকল্পিতভাবে আধুনিক ঝালকাঠি শহর গড়ে তুলেছিলেন। জেলেদের জঙ্গল কেটে আবাস গড়া থেকে ঘোষালের পরিকল্পিত নগরায়নের মাঝে রয়েছে অনেক ইতিহাস, উত্থান-পতন। যার কিছুটা আনন্দের, কিছুটা বেদনার। এ জেলাটি মূলত পুরাতন সেলিমাবাদ পরগনার প্রধান অংশ ছিলো। সুগন্ধা নদীর বুক চিরে জেগে উঠা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চরগুলো নিয়েই এ সেলিমাবাদের জন্ম । ষোড়শ ও সপ্তাদশ শতাব্দীতে প্রথম দিকে ঝালকাঠি ছিলো কর্দমাক্ত এক ঘন বনাঞ্চল। যেখানে বাঘ, উল্লুক, কুমির আর ভয়ংকর সব সাপেরা বাস করত। একইসঙ্গে জলদস্যুদেরও স্বর্গরাজ্য ছিলো এটা। সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ তীরে পোনাবালিয়া এবং উত্তর পাড়ে ছিলো উজিরপুর, শিকারপুর। মাঝের বিস্তীর্ণ অঞ্চলই ছিলো নদী। জানা গেছে, রায়েরকাঠীর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহনের ছেলে শ্রীনাথ রায় সম্রাটের নিকট থেকে ‘পাট্টা’ লাভ করেছিলেন পর্তুগীজ নাগরিক উড ও ইউয়াট। তারা মূলত একটি লবন স্টেটের এজেন্ট ছিলেন। । মদনমোহন পূর্বে নলছিটি থানার (বর্তমানে ঝালকাঠী থানার) নথুল্লাবাদ গ্রামে জমিদারির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। পরে মদনমোহন রায়ের পৌত্র রাজা রুদ্রনারায়ন স্বপ্নযোগে বলেশ্বর নদীর পূর্ব তীরে জঙ্গলে জগদম্বর দশভূজা পাষাণময়ী মূর্তি পেয়ে তা রায়েরকাঠী গ্রামে স্থাপন করেন এবং রায়েরকাঠীতে রাজধানী স্থাপন করেন। রুদ্র নারায়নের প্রপৌত্র জয়নারায়নের সময় আগাবাকের খাঁ নামক এক পাঠান যুবক তার জমিদারির অর্ধেক জোরপূর্বক দখল করলে এক প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। ঝালকাঠীর পূর্বদিকে সুতালরী এবং পূর্ব দক্ষিনে বারৈকরন গ্রামের ওই যুদ্ধে বাকের খাঁ ২২টি কামান ফেলে পলায়ন করেন বলেও তথ্য পাওয়া যায়। কালক্রমে রায়েরকাঠী জমিদারির অর্ধেকের মালিক হন এক ঘোষাল। ঝালকাঠীতে তিনি কাছারি স্থাপন করেন। ওই সময় তিনি রাজা বাহাদুর খেতাব প্রাপ্ত হন। তার প্রজারা তাঁকে মহারাজ সম্বোধন করত। এই মহারাজ সম্বোধন থেকেই কাছারিবাড়ী সংলগ্ন এলাকার নাম হয় মহারাজগঞ্জ। ঝালকাঠীর পূর্ব নাম মহারাজগঞ্জ । তারই পুত্র ছিলেন রাজা সত্যচরন ঘোষাল। তার ঝালকাঠী বন্দর তৎকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠতম বানিজ্য বন্দর হিসেবে গড়ে উঠেছিলো।

***
কীর্তিপাশার রাস্তায় ঢোকার আগে আমরা আরেকটু এগিয়ে গেলাম গাবখান, সুগন্ধা ও ধানসিঁড়ি নদীর সঙ্গম স্থল দেখতে। সেখান থেকে ফিরে বাউখির যাওয়ার পথটা চিনে নিতে আমরা যখন কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, খুব চেনা মনে হলো জায়গাটিকে। গাড়ি থেকে নেমে কেন জানি মনে হলো, এর আগেও আমি এসেছি এখানে। এ বাড়িটির কথা প্রথম জেনেছিলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভিশপ্ত’ গল্পে। জমিদার কীর্তি নারায়ণ রায় আর তার মিথ নিয়ে লেখা সে গল্প। ঝালকাঠি শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে এ বাড়ির অবস্থান। সরূপকাঠির দিক দিয়ে, মানে সন্ধ্যা নদী থেকে ভীমরুলি খাল ধরেও চলে আসা যায় এখানে। রোহিনী রায় চৌধুরী ও তাঁর নাতি তপন রায় চৌধুরী এখানকার জমিদার বংশের দুটি পরিচিত নাম। বর্তমানে জমিদার বাড়ির সম্পত্তিতে তৈরি হয়েছে প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মূল জমিদার বাড়ি এবং দুর্গামন্দির এখন পরিত্যক্ত। জমিদার বাড়ির নাট্যশালার চিহ্ন রয়েছে এখনো। নাট্যমঞ্চের গ্রিনরুম এবং হলরুমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কমলিকন্দর নবীন চন্দ্র বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পারিবারিক শিবমন্দির এবং একটি শিবমূর্তিও এখনো আছে । পুরাতন জমিদার বাড়িতে রয়েছে অন্ধকূপসহ আরো নানা নিদর্শন। ইট-সুরকির ভবন তৈরি হয়েছে অসামান্য স্থাপত্যশৈলীতে। তবে এসবের দিকে চোখ নেই আমাদের। আমরা খুঁজছি সেই কাঙ্খিত গ্রাম, যেখানে ছিলো উষাকান্তের ফেলে আসা ভিটে। আমাদের বেউখিরের পথ দেখিয়ে দিতে গিয়ে এক বয়োবৃদ্ধ দাদা, আরেক পৌঢ়া দিদি নিজেদের মধ্যে প্রায় তর্ক বাঁধিয়ে দিলেন। তর্কের বিষয় হচ্ছে – আমাদের গাড়ি নিয়ে যাওয়া, না যাওয়া। দিদি বলছেন, ‘রাস্তা যে পিছলার পিছলা (পিচ্ছিল); গাড়ি লইয়া যাওন ঠিক হইবে না।’ আর দাদা বলছেন, ‘আরে নাহ। কিচ্ছু হইবে না। যায় না, কত্ত গাড়ি যায়।’ তাদের তর্ক থামিয়ে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা টের পেলাম, দিদির কথাই ঠিক। রাস্তাটা যতক্ষণ পিচের ছিলো, ততক্ষণ ভালোই ছিলো। কিন্তু হেরিংবনের রাস্তা শুরু হতেই শুরু হয় বিপত্তি। রাস্তাটা শুধু পিচ্ছিলই নয়, বেশ সরুও। ড্রাইভার তাই ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। উপায়ন্ত না পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে আমরা হাঁটাই শুরু করলাম।

***
উষাকান্ত সেনগুপ্তের সাথে লক্ষন সেনের প্রথম সাদৃশ্যটি পেয়েছিলাম তাদের ভয়ে। দু’জনেরই ভয়ের কারণ ছিলো এমন একটি ধর্ম, যার শাব্দিক অর্থ শান্তি। যদিও শান্তি, তথা ইসলামের নামে এমন ভীতি ছড়ানোর নির্দেশ মুসলিম ধর্মগ্রন্থ কোরআনের কোথাও দেয়া আছে বলে আমার অন্তত চোখে পড়েনি। গদি বা ভূমি দখলের চেষ্টায় ওই ভীতি সৃষ্টিকারীরা আদতে কোন ধরনের মুসলমান, সে আলোচনাও এখানে করতে চাইছি না। তার চেয়ে বরং মহারাজা লক্ষন সেনের কথা বলি। বলা হয়, তিনি ছিলেন ছিলেন বাংলার প্রকৃত শেষ স্বাধীন নরপতি। বর্তমান মালদহ জেলার গৌড় ছিল তার প্রধান রাজধানী। এর অপর নাম ছিল লক্ষণাবতী। পিতার ন্যায় তিনি একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। তাই গঙ্গা নদীর সান্নিধ্য কামনা করে তিনি নদীয়ায় দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে (১২০১ খ্রি.) মুহম্মদ ঘুরীর সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর বিহার বিজয় সমাপ্ত করে অতর্কিতে লক্ষণ সেনের রাজনিবাস নদীয়া বা নবদ্বীপ নগরী দ্বারদেশে এসে উপস্থিত হন। এই অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব মনে করে রাজা লক্ষণ সেন পলায়ন করেন এবং এই পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নেন। উষাকান্ত সেনগুপ্তও আলবৎ রাজা ছিলেন। সব বরিশাইল্যাই যে আপন মনে রাজা তা কে’না জানে।

বেউখির আর মাত্র তিন মিনিটের পথ !!
***
বাংলার দশটি গ্রামের মতই ছায়া ঘেরা সুনিবির গ্রাম বেউখির এখন এতটাই শান্ত যে কল কল করে বয়ে চলা জলস্রোত, বা তা কেটে ছুটে চলা নৌকার শব্দও সুতীব্র তিক্ষ্ণতায় কানে লাগে। ঘোর লাগা এক গভীর নিরবতা ভাঙে আমাদের হাঁটার শব্দ, কথোপকথন। অবাক প্রশান্ত মন নিয়ে এগিয়ে চলি আমরা। সুনশান পথের দু’ধারে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। ছবির মতো সুন্দর সব খাল। পথে শুধু এক কিশোরের দেখা পেলাম। সে বললো, মাত্র তিন মিনিট হাঁটলেই বেউখির। আমরা যখন বেউখির প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে দৃষ্টি সীমায় পেলাম, ঠিক তখনই ঝুম করে বৃষ্টি নামলো আকাশ ভেঙে। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম পুরানো জীর্ণ স্কুল ভবনের খোলা বারান্দায়। দু’জন শিক্ষিকার দেখা পেলাম সেখানে। তাদের কাছ থেকে সোনা সেন আর পুলক দাশগুপ্তের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিলাম আমরা। বারান্দায় দাঁড়িয়েই অমিত’দা ফোন করেছিলেন তার ছোটকাকা, মানে তপন সেনগুপ্তকে। কাকাই জানলেন, পুলক দাশের বংশধররা এখন যে বাড়িতে থাকে, সেটিই ছিলো তাদের আদি বাড়ি। এরপরই বৃষ্টির কাছে হার মানলো আমাদের অপেক্ষা। শেকড়ের এত কাছে এসে অমিত’দারও যে আর তর সইছিলো না। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা রওনা হই সেন বাড়ির পথে। স্কুল ছাড়িয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে কিছু দূর এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে এক শতবর্ষী তেঁতুল গাছ। তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটি চলে গেছে সেন বাড়ির দিকে। শিক্ষিকা দ্বয় এই নির্দেশনা দিয়েই ক্ষাণ্ত হলেন না। তাদের একজন পথ চিনিয়ে দিতে সাথেও এলেন। অবশ্য তার বাড়ি ফেরার পথটিও ছিলো একই পথে।

***
কোনো কোনো ঐতিহাসিক লক্ষন সেনকে কাপুরুষ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের এ বর্ণনার কোনো সত্যতা নেই। লক্ষন সেন জীবনে বহু শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তার পুত্রদের লিপি থেকে জানা যায়, তিনি পুরী, বারানসি ও প্রয়াগে বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। 'তাবাকাত-ই-নাসিরী নামক গ্রন্থের লেখক মিনহাজ উদ্দীন তাকে ‘রায় (রাজা) লখমানিয়া' ও 'হিন্দুস্তানের খলিফা' বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি কাপুরুষ হলে তার সম্বন্ধে এমন উক্তি কখনো সম্ভব ছিলো না। একাধিক ইতিহাস গ্রন্থে রয়েছে, বখতিয়ার খলজীর বিহার অধিকারের কথা শুনে রাজ্যের বহুলোক যখন সন্ত্রস্ত এবং নদীয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত তখনো লক্ষন সেন রাজধানী ত্যাগ করেননি। পরে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে তিনি পূর্ববঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করা সমীচীন মনে করেছিলেন। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে লক্ষন সেনের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন আরও প্রায় ২৫ বছর ঢাকার অন্তর্গত বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন।

***
পরিত্যাক্ত সিঁড়ি
অতীতের ছায়া
ভিটের মাটিতে
শেকড়ের মায়া
অতঃপর আমরা যখন উষা সেনের সেই বাড়ির উঠোনে গিয়ে পৌঁছাই, খুব কাছেই কোথায় যেন একটা অচেনা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে যায়। দোচালা কাঠের ঘরের, মাটির মেঝেতে শুয়ে থাকা কুকুরটিও অপরিচিত মানুষের ঘ্রাণ পেয়ে নড়েচরে বসে। ঘেউ করে উঠেই আবার থেমে যায়। একটি মোরগও ডেকে ওঠে। ওরা সবাই কাকে যেন আমাদের আগমনী বার্তা পাঠায়। চার/পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে দৌড়ে ঘরের দরজায় এসে আমাদের দেখেই আবার ভিতরে চলে যায়। এমন সময় আমরা এক জানালায় দেখি স্বর্গীয় পুলক দাশগুপ্তের বিধবা স্ত্রী বন্দনা দেবীর মুখ। তিনি জানতে চান, আমরা কাকে খোঁজ করছি। ঠিক এ সময় সেই বাচ্চাটিকে নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ায় তার ছেলে মিঠু দাসগুপ্ত। তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় জানান অমিত’দা। সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন মা-ছেলে। আমাদের সবাইকে নিয়ে বারান্দায় বসান। ঘর থেকে একটু দূরের একটি উঁচু মাটির ঢিবি দেখিয়ে মিঠু অমিত’দাকে জানান, ওখানেই ছিলো তাদের পুরানো ভিটে। দাদার চোখে তখন অদ্ভুত এক ঘোর। সে ওই জায়গাটায় ছুটে গিয়ে ভিটের মাটি তুলে নিলেন খানিকটা। এরপর এসে বসেন উঠোনে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত এক পুরানো সিঁড়ির উপর। ফেরার পথে নিতাই নামের এক লোক অবশ্য আমাদের জানিয়ে দেন, ওই সিঁড়িটিও ছিলো সেন বাড়ির। ভিটের শেষ চিহ্ন হিসাবে ওটাই শুধু রয়ে গেছে। প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেন বাড়ির ভিটে ভাঙা হয়, তখন সিঁড়িটি গড়িয়ে নিয়ে ওখানে রাখা হয়েছিলো। ভিটে ভাঙা সেই শ্রমিকদের দলে ছিলেন বলেই তিনি এটা জানাতে পেরেছিলেন। অবশ্য কিছু না জেনেও ওই সিঁড়িতে বসার পর দাদার চোখে মুখে তার যে প্রশান্তি খেলা করছিলো, তা ছুয়ে যাচ্ছিলো আমাদের সবাইকে। ভিটের মাটিটুকু পলিথিনের ব্যাগে পুড়ে সযন্তে নিজের কাছেই রাখলেন অমিত’দা। এরই মধ্যে মিঠু গিয়ে তার কাকা, শান্তি দাসগুপ্তকে ডেকে নিয়ে এলেন। বন্দনা দেবী আমাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তার হাতে ভাজা গরম মুড়ি আর ডিম ভাজিকে মনে হচ্ছিলো স্বর্গের মেন্যু। গল্পে গল্পে রাতও এগিয়ে আসছিলো। তবুও অনেকটা তাড়াহুরো করেই উঠতে হয় আমাদের। আবারো ফেরার কথা জানিয়ে ফিরে আসি আমরা। সাথে নিয়ে আসি অমিত’দার শেকড়ের মাটি আর আমার চলচ্চিত্রের গল্প। যার নাম হতে পারে ‘সেনের প্রত্যাবর্তন’ বা ‘the return of sen’ অথবা ‘ফেরা না ফেরা’। ওহ, ফেরার পথে ওপারের, মানে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বাম নেতা শৈলেন দাশগুপ্তের পাশের বাড়িও চিনে আসি আমরা। তার গল্পও শোনবো অন্য কোনো দিন।

এখনকার অমিত’দার কথা’তো তেমন কিছুই বললাম না। শুধু এটুকু জানাই - তিনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, একইসঙ্গে একজন শিক্ষক। আর সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল অবলম্বনে তার হাতেই তৈরী হচ্ছে বাংলা ভাষার প্রথম ত্রিমাত্রিক (থ্রি ডি) চলচ্চিত্র।
newsreel [সংবাদচিত্র]