ছবিটি মৃত্যুর বছর খানেক আগে, ২০০৬’র মার্চে তোলা। |
ঘটনাটি ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের। নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক মনে পরছে না। জুন বা জুলাইয়ের কোনো এক সকালে বাসায় এসে ঘুম ভাঙিয়ে ঔষধ কোম্পানীর প্যাডের পৃষ্ঠায় লেখা একটি কবিতা আমার হাতে গুজে দিয়েছিলেন এক কবি। শৈশব থেকে চেনা এ মানুষটির এই সত্বার সাথেও সেদিনই প্রথম পরিচয় হয় আমার। এর আগে কখনো কল্পনায়ও আসেনি যে তিনি কখনো কবিতা লিখতে পারেন । জানালেন মায়ের জন্য লিখেছেন। কিন্তু মা বাসায় নেই, তাই তাকে শোনানো হয়নি। লেখাটি চেয়ে নিয়ে নিজেই একবার পড়ে শুনিয়ে আবার আমার হাতে দিলেন। এরপর দ্রুত বেড়িয়ে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন - ‘এটা থাকুক তোমার কাছে।’ তিনি চলে যাওয়ার পর লেখাটি নিজে একবার পড়ে নিয়ে ডায়েরীর মধ্যে রেখে আমি আবারো ঘুমিয়ে পরেছিলাম।
তখনও হিজরত করিনি। মাঝে মাঝে ঢাকায় এসে কাজ করলেও বেশীরভাগ সময় বরিশালেই থাকছি। তবে তখন চূড়ান্তভাবে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। সেদিন সন্ধ্যার কিছু সময় বাদে কি এক কাজে বন্ধু অনুপ, মানে মার্শেল অনুপ গুদাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই বাবার কাছে জানলাম অদ্য প্রতুষ্যে আবিষ্কৃত সেই কবি সিলিঙ ফ্যানের সাথে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পরেছেন। তার কক্ষের দরজা ভাঙার চেষ্টা চলছে। শুনেই ছুটলাম। অনুপও ছুটলো সাথে। আমার বাসা থেকে ঘটনাস্থল ছিলো মাত্র তিন মিনিটের এক ছুটের দুরত্বে। গিয়ে দেখি কেবলই দরজা ভাঙা হয়েছে। কবি ফ্যানের সাথে নয়, সিলিঙে লাগানো আঙটার সাথে লাগানো ফাঁসে ঝুলছেন। সম্ভবত মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে নিজেই ফ্যানটা খুলে পাশের বিছানার উপরে রেখে নিয়েছেন। পশ্চিম মুখো নিথর দেহ। হাত দুটো এহরাম বাঁধার মতো করে পরস্পরকে আলিঙ্গণ করে আছে। অবশেষে পুলিশ এসে তার ঝুলন্ত দেহ নামানোর উদ্যোগ নেয়। অনেকের মতো আমি আর অনুপও হাত লাগাই। মাথার মধ্যে তখন সকালে পড়া ও শোনা কবিতার লাইনগুলো স্মরণের প্রচণ্ড চেষ্টা চলছে। কিন্তু নাম ছাড়া একটি লাইনও মনে আসেনি কিছুতে। প্রায় আট বছর পর সেই লেখাটি কোনো রূপ সংশোধন বা পরিমার্জন ছাড়াই আজ হুবুহু তুলে দিলাম এখানে।
মা
গাজী মুশফিকুর রহমান (হেলাল)
বেঁচে থেকেও পাশে নেই আজ তার মাতা
বুকে তার পাহাড় সমান ব্যাথা
চারিদিকে কেন এত জ্বালা?
কেউ বুঝবে না কারো এই ব্যাথা
করো না কেউ মাকে অবহেলা
যখন যাবে ছেড়ে মা
এই পৃথিবীর সমতূল্যেও ফিরে পারে না আর
মা নেই যার কত ব্যাথা তার
আজ বহুদূরে থেকে বুঝি মায়ের সেই
অকৃত্রিম, নিঃস্বার্থ ভালবাসার কথা
তিনি এই জগৎ সংসারের সকল সন্তানদের
জন্য দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহর পড়ে
নেই তাঁর কোন তূলনা।
সেদিন লাশ নামিয়ে বাইরে বের হতেই দেখি আমার এক সিনিয়র সহকর্মি, মানে আজকের পরিবর্তন পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার এসএম সোহাগ এসে হাজির। তার সাথে আলাপ করতে করতে ওই বাসা থেকে অনুপকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখি দাওয়ায় উদাস হয়ে বসে আছেন সদ্য আত্মহত্যাকারী কবি হেলালের পিতা। ওই সময় তার পাশে কাকে যেন পেয়ে জিজ্ঞাসা করে জানলাম কবির মা নিজের মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। সন্তানের মৃত্যুর এই খবর এখনো দেয়া হয়নি তাকে।
বেশ প্রগাঢ় পোক্ত বন্ধুত্ব ছিলো প্রয়াত মোহম্মদ আব্দুস সামাদ গাজী আর এবিএম নূরুল হক শরীফের। বরিশাল শহরের কলেজ পাড়ার তালভিটা প্রথম ও দ্বিতীয় গলির বাসিন্দা ছিলেন এ দুজন। প্রথম গলির গাজী ভিলা আর দ্বিতীয় গলির শরীফ কটেজ তাদের স্মৃতিবহন করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে আছেন তাদের উত্তরসূরীরা। পরম্পরাসূত্রে পাওয়া পারিবারিক বন্ধুত্বও সম্ভবত টিকিয়ে রেখেছেন তারা। গাজী দাদার সহধর্মীনিও এখনো বেঁচে আছেন। মূলত আজ হঠাৎ তার কথা মনে পরতেিই তড়িঘড়ি করে এ লেখাটি লিখতে বসেছি। কেন জানি মনে হলো তার অন্তত জানা দরকার যে তাকে ভালোবেসে এমন একজন মানুষ কবিতাও লিখেছেন, যাকে তিনিই জন্ম দিয়েছিলেন। সম্ভবত এটি ছিলো তার সে সন্তানের লেখা প্রথম ও শেষ কবিতা। কিঙবা হতে পারে এটি ছিলো এক অভিমানী পুত্রের কাব্যিক সুইসাইড নোট।সামাদ গাজীর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন হেলাল, আর আমি হক শরীফের জেষ্ঠ্য নাতি। হেলাল কাকা বয়সে আমার চেয়ে ছয়-সাত বছরের বড় ছিলেন। তবুও শৈশবের কিছুকালে তিনিই ছিলেন আমার প্রধানমত বন্ধু। তালভিটা প্রথম গলির পূর্বপাশেই জেল বাগান। এক সময় বরিশাল কারাগারের কয়েদীদের দিয়ে এখানে নিয়মিত কৃষি কাজ করানো হতো। শৈশবে এই বাগানে গরু চড়াতে গিয়েই হেলাল কাকার সাথে আমার মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। দুর্দান্ত ডানপিটে এই কাকাই প্রথম ছিপ আর ছোট জাল, এমনকী কোনো কিছু ছাড়া স্রেফ হাত দিয়ে মাছ ধরার কৌশলও শিখিয়েছিলেন আমায়। শুকনো পাতা দিয়ে বিড়ি বানিয়ে খাওয়াসহ শিখেছিলাম আরো কত কী! তখন দেখেই দেখতাম হেলাল মা অন্তঃপ্রাণ। আর বাবার সাথে তার খালি খিটমিট। পরবর্তীতে তিনি অনেক ঘটনাবহুল সময় পার করেছেন।
হেলাল কাকার মৃত্যুর এক বছর না ঘুরতে প্রায় একই কায়দায় সিলিঙের সাথে ঝুলে দেহত্যাগ করেছিলো আমার সেই বন্ধু, অনুপ। তার বছর দুয়েকের মধ্যে ক্যান্সারে মারা যান সেই সহকর্মি এসএম সোহাগও। তারা, মানে মৃতরা এ জাতীয় ইহলৌকিক লেখা পড়তে পারেন কিনা জানতে পারিনি আজও। পড়তে পারুক বা না পারুক, তারা যেখানে আছেন - ভালো থাকুক; এই যা প্রত্যাশা।বরিশালের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়েছিলেন। তারপর নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী সংগঠন হিযবুত তাওহীদের আঞ্চলিক নেতা। আবার মৃত্যুর আগে আগে সব বাদ দিয়ে মশগুল হয়েছিলেন স্রেফ আল্লাহর ইবাদতে। তালভিটা জামে মসজিদের মুয়াজ্জীন হওয়ার বাসনাও প্রকাশ করেছিলেন। আসলে এত সংক্ষেপে লিখে হেলালের মাজেজা বোঝানো কঠিন। তাকে নিয়ে একটি আস্ত উপন্যাসও লিখে ফেলা যাবে অনায়াসে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন