পাকিস্তানী অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে মিত্রবাহিনী। |
আজ ১৪ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঢাকা বিজয়ে মিত্রবাহিনী আগের দিন রাত থেকেই সর্বাত্মক হামলা শুরু করে দিয়েছে। তাদের আগ্রাসী আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্তারা পদত্যাগ করে আন্তর্জাতিক সেচ্ছাসেবী সংস্থা রেডক্রস ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নেয়।
তখন চীন-মার্কিন সামরিক সাহায্য পাওয়ার আশা নিয়ে পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি তখন প্রকাশ্যে বলছেন, ‘শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব’। আর ভেতরে ভেতরে ভারতের সেনাপ্রধান মানেকশ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপদ আত্মসমর্পণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনই প্রেক্ষাপটে রাতের অন্ধকারে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার নীল-নকশা বাস্তবায়ন করে তাদের এদেশীয় দোসরেরা।
একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামান অবিরাম গোলা ছুঁড়ে চলে। নিয়াজিসহ পাকি হানাদারদের হৃদকম্প তখন তুঙ্গে। মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা গিয়ে পড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও। সে গোলার আওয়াজে তখন গোটা শহর কাঁপছে।
পাকিস্তানের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর ড. আবদুল মুত্তালিব মালিক সেদিন সকালেই ‘সমগ্র পরিস্থিতি’ বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। এ বৈঠক বসানোর ব্যাপারে তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী এবং চীফ সেক্রেটারি মুজাফফর হোসেনের হাত ছিল বলে গোপন নথিপত্র সাক্ষী দেয়। পাকিস্তানি সামরিক সিগন্যাল কোড ভেঙে থেকে কয়েক ঘণ্টা আগেই এ বৈঠকের খবর পেয়ে যায় ভারতের বিমান সদর দফতর।বৈঠক চলাকালে গভর্নর ভবন আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠক বসে বেলা ১১টা নাগাদ। মেঘালয়ের শিলং বিমান ঘাঁটি থেকে প্রেরিত অর্ধ ডজন মিগ-২১ সঠিক সময়ে গভর্নর ভবনের উপর নির্ভুল রকেট আক্রমণ চালায়। গোটা পাঁচেক রকেট গিয়ে পড়ে গভর্নর হাউসের ঠিক ছাদের ওপর। মালিক ও তার মন্ত্রীরা ভয়ে প্রায় কেঁদে ওঠে। চীফ সেক্রেটারি, আইজি পুলিশসহ বড় বড় অফিসারও মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তারাও ভয়ে যে যেভাবে পারলেন পালালেন।
হামলার পর গভর্নর হাউস, যা বর্তমানে বঙ্গভবন। |
বিমান হানা শেষ হওয়ার পর গভর্নর মালিক আবার বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষ হতে অবশ্য পাঁচ মিনিটও লাগেনি। তারা সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেডক্রস কমিটির ঢাকা প্রতিনিধি রেনডকে জানায় এবং তার কাছে আশ্রয় চায়। রেনড সাথে সাথে এ খবর পৌঁছায় জেনেভায়। তার বার্তায় বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছে এবং রেড ক্রস আন্তর্জাতিক অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছে। জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকারকে যেন অবিলম্বে সব ঘটনা জানানো হয়। খবরটা যেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীকেও জানানো হয়।’
রেডক্রস তখন ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণা করেছে। বহু বিদেশী ও পশ্চিমা পাকিস্তানীরা গিয়ে আশ্রয় নেয় সেখানে।
মালিকের নেতৃত্বাধীর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অমন সিদ্ধান্তের পর নিয়াজির অবস্থা আরো কাহিল হয়। আত্মসমর্পণের পর হামলা নয়, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইছিলেন জেনারেল নিয়াজিসহ পাকবাহিনীর অন্যান্য জেনারেলরা। তবে গোটা দুনিয়ায় তখন সপ্তম নৌ-বহরের বঙ্গোপসাগরে আগমণ নিয়ে জোর জল্পনা-কল্পনা চলছে।
নিয়াজি |
মার্কিন সরকার যদিও ঘোষণা করেছিল যে, কিছু আমেরিকান নাগরিক অবরুদ্ধ, বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করেনি। বিশ্ববাসীর মনে তখন প্রশ্ন ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের মাঠে নামাবেন? এ নিয়ে সর্বত্র যখন তুমুল আলোচনা ঠিক তখন মিত্রবাহিনী প্রচণ্ডভাবে ঢাকার বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও এই দিনও তারা ঠিক জানে না যে, ঢাকার ভেতরের অবস্থাটা কি বা পাকবাহিনী কিভাবে ঢাকার লড়াইয়ে লড়তে চায় এবং ঢাকায় তাদের শক্তিই বা কতটা। তবে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট।
নানা চেষ্টায় কিছু খবর আসলেও আসল খবর কিছুতেই পাওয়া গেলো না। মিত্রবাহিনী মনে করল, ঢাকার ভেতরে লড়াই করার জন্য যদি সৈন্যদের এগিয়ে দেয়া যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে যদি বিমান আক্রমণ চালানো হয়, তবে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষও মরবে। মিত্রবাহিনী এটা কিছুতেই করতে চাইছিল না। তারা একদিকে যেমন ফের পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আবেদন জানায়, অন্যদিকে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের শহর ছেড়ে চলে যেতে বলে।
মুক্তিযোদ্ধারা। |
উত্তর এবং পূব দুদিকেই তখন বহু মিত্রসেনা এসে উপস্থিত হয়। চাঁদপুরেও আরো একটা বাহিনী নদীপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য তৈরী হয়। ঠিক এমন দিনেই হানাদার পাকিস্তানি ও তাদের দোসরেরা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। আজকের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় পুরো জাতি সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করছে।
তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট