মিত্রবাহিনীকে ঘিরে জনতার উল্লাস। |
আজ ১৩ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ সোমবার। বাংলার জমিন থেকে ঔপনিবেশিক এই নাম মুছে যেতে আর মাত্র দুই দিন বাকি। এদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছায়।
অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় ঢুকে পড়ে। এমনকি অজস্র নিরস্ত্র জনতাও রাস্তায় নেমে আসে। গা ঢাকা দেয় পাকিস্তানের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর ড. আবদুল মুত্তালিব মালিক ও তার সহচরেরা। তবে এই দিনও বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতায় সক্রিয় ছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
একাত্তরের এই দিনে চারদিকে উড়তে থাকে বাঙালির বিজয় নিশান। শুধু ময়ানমতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ জন। আর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা। ভারতের ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড ঢাকার দিতেক এগিয়ে যায় পূর্বদিক থেকে। উত্তর দিক থেকে আগায় জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড।
এদিন টাঙ্গাইলে আরো ছত্রিসেনা অবতরণ করে। পশ্চিমে চার নম্বর ডিভিশন মধুমতি পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মা নদীর তীরে। রাত নয়টায় মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং সন্ধ্যা থেকে টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে নয়টায় টাঙ্গাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউজে তারা পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন।
আলোচনার শুরুতে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। রাস্তাতেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।’ এ সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহর ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পৌঁছায়।
সমুদ্রপথে শত্রুদের পালানোর সুযোগ কমে যাওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ঢাকা চূড়ান্ত লড়াইয়ের স্থল বলে চিহ্নিত হতে থাকায় তাদের সম্ভাব্য নিয়তির আশঙ্কাও দ্রুত বাড়তে থাকে।
মিত্রবাহিনীকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। |
চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে এগুনোর পথে নাজিরহাটে হানাদাররা বাধা দেয়। এখানে ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদের তিন কোম্পানি এবং বেশকিছু ইপিসিএএফসহ অবস্থান নিয়েছি। এখানে ব্যাপক যুদ্ধের পর পালিয়ে যায় হানাদাররা। এদিকে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ২০-ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে মুরাপাড়ায় পৌঁছায়।
যৌথ বাহিনীর অগ্রবর্তী আরেকটি সেনাদল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার পাঁচ/ছয় মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। বালু নদীর পূর্বদিকে পাকিস্তানি বাহিনী শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার চারদিকে আগে থেকেই পাকিস্তান বাহিনী ফিল্ড ডিফেন্স বা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থাসহ অবস্থান নিয়েছিল।
ওদিকে খুলনা এবং বগুড়ায় এই দিন হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় মানুষের অবিরাম যুদ্ধ চলে। মুজিবনগরে তখন চরম উত্তেজনা। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবর্তন ও পরিবেশন করেন। প্রতি মুহূর্তে খবর আসছে ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা মুক্ত।
আকাশ, জলে, স্থলে সবদিকে হানাদাররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিকে জানান, ‘আরো সাহায্য চাই।’
কেন্দ্রের সামরিক কর্তারা ঢাকায় অবস্থানরত ঘাতকদের এই বলে আশ্বস্ত করে, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। পশ্চিম খন্ডে ভারতীয় বাহিনীকে এমন মার দেয়া হবে যে তারা নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইবে ও যুদ্ধ থেমে যাবে।’ কিন্তু তাদের জন্য সেদিন আর আসেনি। তবে এই দিনও পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে রাজী করানোর কাজে ইসলামাবাদে সারাদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায়।
পিকিং-এ পাকিস্তানী দূতাবাসেও দেখা যায় কর্মতৎপরতা। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের এই মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সিকিম-ভুটান সীমান্তে থাকা চীনা সৈন্যবাহিনীকে কিছুটা তৎপর হতে দেখা যায়, কিন্তু ভারতে যে তা বিশেষ উদ্বেগের সঞ্চার করেছিল এমন নয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী সদর দপ্তরে বাংলাদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক অসফল প্রয়াসও ঠিক এই দিনই পরিলক্ষিত হয়।
কলকাতায় ১৩ ডিসেম্বর সকালে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে প্রায় মাসাধিককাল যাবত অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুব আলম চাষী যুদ্ধবিরতির এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রস্তাবিত বিবৃতির প্রধান বক্তব্য ছিল- ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয় তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে।’
বাংলাদেশ তখন ভারতের সঙ্গে যুগ্ম-কমান্ডব্যবস্থায় আবদ্ধ, কাজেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি যদি একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতেন, তবে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে এককভাবে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া নীতিগতভাবে অসিদ্ধ হতো। সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই সৈয়দ নজরুল ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর দানে অসম্মত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের গোচরে আনেন।
নিউইয়র্কে এই দিন নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আবারো তৃতীয় সোভিয়েট ভোটের মুখে বাতিল হয়ে যায়। যে কারণেই হোক সামরিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নে চীনের সম্মতির সম্ভাবনাকে তখনও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ বাতিল করে উঠতে পারেনি। কাজেই সেই ভরসায় চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর সপ্তম নৌবহরকে পুনরায় সচল করা হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকার আকাশ থেকে পাকিস্তানি সামরিক অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালানো হয়। ঢাকার সর্বত্র অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। এইদিন তারা প্রকাশ্যে সড়কে নেমে আসে। পাকিস্তানি সেনা নায়কদের মনোবল উঁচু রাখার সামান্যতম অবলম্বন কোথাও ছিল না। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হস্তক্ষেপ।
যুদ্ধ জয় নিশ্চিত জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশী নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সবরকমের সুযোগ-সুবিধা দেবে।’
উল্লাসিত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসী। |
এই দিন শান্তি কমিটি, ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা বেশিরভাগই অবস্থা বেগতিক দেখে গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু এর মধ্যেও ঘাতক আলবদর চক্র সক্রিয় ছিল। যার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ ঘটেে দেশের কৃতী সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায়। এদিনে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় কিছু আল বদর কর্মী। পরে ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন