একাত্তরের ডিসেম্বরে সৈয়দপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয়
বাহিনীর যৌথ হামলায় গুলিবিদ্ধ পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন ইত্তেফাক।
|
একাত্তরের দোসরা ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে এই দিন চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় তারা গণহত্যা চালায়।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজি তার রাজাকার, আলবদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। কিন্তু তখনও হানাদার বাহিনী বুঝতে পারেনি তাদের পতন অত্যাসন্ন। তবে এই দিন পরাজয়ের আভাস পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন মরিয়া হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে যুদ্ধকালীন সাহায্যের আশায় ১৯৫৯ সালের পাকি-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এক অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়।
সীমান্ত এলাকায় পাকি জান্তারা সমরসজ্জা বাড়ানোয় ভারতও তা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়। বেশ কিছু সীমান্তে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। এদিন দিনাজপুরেও হুট করে হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। যার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান বাহিনী। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। পঞ্চগড় শত্রুমুক্ত করে তারা এগিয়ে চলে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে।
একাত্তরের ডিসেম্বরে সৈয়দপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীরহামলায় গুলিবিদ্ধ পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনকে সামলাচ্ছে সহযোদ্ধারা।ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় রামপুরা ও মালিবাগের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন নষ্ট হয়ে যায়। নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আখাউড়া রেল স্টেশনেও মুক্তিবাহিনীর মুখোমুখি হয় পাকবাহিনী। সর্বত্র কোনঠাসা হতে থাকে তারা। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোও ফলাও করে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর প্রচার করে।
একাত্তরের এই দিনেও সক্রিয় ছিলো স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত গোলাম আজম সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় সরকার গঠিত হলে সে সরকারের নেতা অবশ্যই নুরুল আমিন হবেন। তিনি জাতীয় সরকারের পররাষ্ট্র, শিক্ষা এবং অর্থ দপ্তরের ভার পূর্ব পাকিস্তানীদের হাতে দেওয়ার দাবি জানান। কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, এতে করে পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হবে। তাছাড়া পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বে কোনো পূর্ব পাকিস্তানী থাকলে শত্রুদের ‘বাংলাদেশ’ তামাশার উপযুক্ত জবাব দিতে পারবে।
জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে যোগ দিতে আব্দুল জব্বার খদ্দর, নুরুল্লাহ ও মশিউল ইসলাম পশ্চিম পাকিস্তান যান এদিন। জসিমউদ্দিন আহমেদসহ বেশ কজন এমএলএ বিমানবন্দরে তাদের বিদায় জানান। মৌলিক গনতন্ত্র মন্ত্রী মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক পাবনায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ঢাকা জেলা কাউন্সিল হলে শ্রমিক কর্মচারী সমাবেশে বক্তৃতা করেন শ্রমমন্ত্রী এএসএম সোলায়মান। ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেহাদী স্লোগানসহ মিছিল বের করে গাইবান্ধার স্বাধীনতা বিরোধীরা। মিছিলে নেতৃত্ব দেন কাইয়ুম মুসলিম লিগের সভাপতি সাইদুর রহমান এবং শান্তি কমিটির আহবায়ক মওলানা আবদুল গফুর।
পালাচ্ছে পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন ইত্তেফাক। |
বানিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী আখতারউদ্দিন আহমেদ বরিশালে প্রতিনিধিত্বশীল দেশপ্রেমিকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে সবাইকে ভারতীয় হামলার মুখে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান। বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সদস্য এবিএম নুরুল ইসলাম ও এসবি জামান জানান, পাকিস্তান আজ ভেতর ও বাইরে উভয় দিক থেকে সংকটের মুখে। এই সংকট মোকাবেলার জন্য তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে যুগপত কাজ করার অঙ্গীকার করেন।
একইদিনে আমেরিকায় নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগাশাহী নিউইয়র্কে এক টিভি সাক্ষাতকারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ভারতীয় দাবিকে অদ্ভুত বলে উল্লেখ করেন। এদিকে এক সরকারী মুখপাত্র বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাব করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে যে চিঠি দিয়েছেন তা নিরাপত্তা পরিষদে বিবেচনাধীন।
এছাড়া পাকিস্তান সরকার এই দিন নির্দেশ দেয় যে কোনো এলাকায় বোমা বিস্ফোরন, হত্যা, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি ঘটলে ঘটনার ৫০০ গজের মধ্যেকার বাসিন্দাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে হবে। ধরিয়ে না দিলে তাদের পিটুনি, চড় দিতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট'
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন