Powered By Blogger

০৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ঢাকায় ১২ ঘন্টায় ২৩২ বিমান হামলা!

একাত্তরে বাংলার আকাশে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান।
আজ ৫ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল রবিবার। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হিসাব মতে এই দিন তারা ১২ ঘন্টায় ২৩২ বার হামলা চালিয়ে প্রায় ৫০ টন বোমা ফেলে ঢাকার তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিতে। বিধ্বস্থ হয় বাংলাদেশে থাকা পাকিস্তানীদের অধিকাংশ বিমান। ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো সারাদিন অবাধে আকাশ উড়ে প্রতিপক্ষের সামরিক জমায়েতগুলোতে আক্রমন চালায়, সম্পূর্ণ অকেজো করে দেয় সবগুলো বিমান ঘাঁটি। 

একাত্তরের এই দিনেই পাকিস্তানী বাহিনীর এক সামরিক কনভয়েও ভারতীয় জঙ্গি বিমান আক্রমন চালায়। এতে পাক বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই কয়কেটি লঞ্চও ধ্বংস হয়। এদিন নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের অবস্থানকারী সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এ সময় যৌথ কমান্ড তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও তাদের অপরাগতা প্রকাশ করে। প্রধান হুশিয়ারী ছিল চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে। 
তাদের সতর্কবানীতে দুটি কাজ হলো। প্রথমত, বিশ্বের সব দেশ বুঝলো বংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার কোন ক্ষমতা পাক বাহিনীর নেই। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলো সব বন্দরকে ঘায়েল করার সুযোগ পেল। ওদিকে তখন স্থলে মিত্রবাহিনীও এগিয়ে চলছে।
পাক বাহিনীর বিভন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তারা। ভারতীয় বাহিনী প্রধান সড়কগুলোয় অবরোধ সৃষ্টির ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর আর যশোরের এবং নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকবাহিনী মিত্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণ রূপে শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আর ১৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হন। 

যৌথ টহল
এই দিন বখশীগঞ্জে যৌথবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। মুক্ত হয় পীরগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পচাগড়, বোদা, ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ। আর জীবননগর, দর্শনা ও কোটচাঁদপুরেও হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এছাড়া এ দিনে মিত্রবাহিনীর আক্রমণে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী হানাদাররা। বিচ্ছিন্নভাবে পাকসেনাদের সঙ্গে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয় চৌগাছা ও ঝিকরগাছার জগন্নাথপুর, গরীবপুর, আড়পাড়া, দিঘলসিংহা, ঢেকিপোতা, হুদোপাড়া, কদমতলা, মাশিলা, যাত্রাপুর ও সিংহঝুলি এলাকায়। 

একাত্তরের এই দিনটিও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র জাতিসংঘ উত্তপ্ত ছিল বাংলাদেশ ইস্যুতে। এদিনও নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে তৎপরতা অব্যাহত রাখে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত। আর বিরোধীতায় সক্রিয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই সময়ে এক বিবৃতিতে সোভিয়েত সরকার ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানায়। আর চীনের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় হামলার শিকার হওয়া পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত অবস্থা ক্রমাগত চিন্তা বাড়ায় প্রবাসী সরকারের। কারণ এদিনও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কেবি লাল ‘বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা বলে’ উল্লেখ করে ‘ স্বীকৃতি দেয়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার’ বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। 

রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে দুর্বল না করে তোলে তাই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন। অন্যদিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শাসক গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, ‘দেশ আক্রান্ত। ভারতীয়দের সহযোগিতায় কিছু বিশ্বাসঘাতক দেশ আক্রমণ করেছে। এ দেশের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করছে। তাদের সাহায্য করার জন্য প্রতিরক্ষা তহবিল করা হয়েছে।’ এই তহবিলে মুক্তহস্তে সাহায্য করার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। 
একই সময়ে পাকিস্তানে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলামি পার্টির প্রধান মওলানা আতাহার আলী এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে কঠোরহাতে শত্রু দমন এবং সেইসঙ্গে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের আহবান জানান। বিবৃতিতে তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেন। 
ভারতের তৎকালীন সরকার প্রধান ইন্দিরা গান্ধী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আজ ভারতীয় হামলার প্রতিবাদে ও পাকিস্তান রক্ষায় সংকল্প ঘোষণা করে মিছিল বের করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। মিছিল শেষে লতিফ হোসেনের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভাও অনুষ্ঠিত হয়া। খুলনায় থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের শান্তি কমিটির নেতারা সমবেত হয়ে ভারতীয় হামলার প্রতিবাদ জানায়। একইরকম প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল বের হয় সিলেটেও। সিরাজগঞ্জের প্রতিবাদসভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা আসাদৌল্লাহ। 

শান্তি কমিটি চেয়ারম্যান এমএ সালামের নেতৃত্বে ভারতীয় আক্রমণের প্রতিবাদ জানায় চাঁদপুর শান্তি কমিটির সদস্যরা। টাঙ্গাইলে চেয়ারম্যান মৌলভী হাকিম হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে জেলা শান্তি কমিটি জেহাদের ডাক দেয়। ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় গাইবান্ধা শান্তি কমিটি আহবায়ক ম ওলানা আবদুল গফুর ও পরিষদ সদস্য সাইদুর রহমান। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]