Powered By Blogger
ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বিজয়ের ৪৮

ঢাকায় আত্মসমর্পণের পূর্ব মুহুর্তে 
আরোরা, নিয়াজিসহ অন্যান্যরা।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের ৪৮তম বিজয় দিবস। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের ৪৭ বছর পূর্ণ হলো আজ। একাত্তরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে এই দিনে আসে কাঙ্খিত বিজয়। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ঔপনিবেশিক শত্রুমুক্ত হয় বাংলার মাটি। পৃথিবীর বুকে মাথা তোলে বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশ। মুক্তির জয়গানে মুখর কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আজ স্মরণ করেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সেই অকুতোভয় বীরদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
জাতীয় জীবনে নানা সংকট আর অনিশ্চয়তা থাকলেও আজ ভোরে পুব আকাশে যে নতুন সূর্য উঠেছে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এ দিনটি গৌরব ও আনন্দের। বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা ড. নীহার রায় রচিত ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ থেকে জানা যায় যে, একমাত্র রাজা শশাঙ্ক এবং জালালুদ্দিন যদু ছাড়া আর কোনো বাঙ্গালীই বঙ্গ বা বাংলাদেশ শাসন করেননি । পাল ও সেন বংশও ছিল বহিরাগত। মুসলিম আমলের ইসলাম খাঁ, শায়েস্তা খাঁ, মীর জুমলাসহ সকল শাসকই ছিলেন অবাঙ্গালী। নবাব আলীর্বদী খাঁ ও এসেছিলেন দাক্ষিণাত্য থেকে। নবাব সিরাজউদ্দৌলারও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে কোন সংযোগ ছিল না।’ 
এরপর ১৯০ বছরের উপনিবেশবাদী বৃটিশ শাসন । ১৯৪৭ সালে মুক্তির খোয়াবে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনি তুলে এই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ও আমজনতা ‘পাকিস্তান’ নামক এক বিচিত্র ও বিষম রাষ্ট্র গঠনে কায়েদে আজমের সহযোগী হলেও প্রকৃত স্বাধীনতা পেলেন না । তাই তারা আবার ধ্বনি তুলল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা’।
বৃটিশ শাসকরা যেভাবে ভারতবর্ষকে শাসন-শোষন করেছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ কায়দায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে তাদের নির্মম উপনিবেশ শোষনের লীলাক্ষেত্রে পরিনত করেছিলো। এই শোষন -বৈষম্যের ভয়াবহতা সর্বপ্রথম বিধৃত হয় লন্ডন থেকে ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত পাকিস্তানে নিষিদ্ধকৃত ‘আন হ্যাপি ইস্ট-পাকিস্তান’ শীর্ষক বইয়ে। 
বিজয়ের পর ঢাকার জনতাকে অভিনন্দন
জানাচ্ছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা ‍মুজিব।
অর্থনৈতিক শোষন বৈষম্যের পাশাপাশি চলছিল বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ ও তথাকথিত মুসলমানিকরন প্রকল্প। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তাদের এই কাজে সহযোগী ছিল এদেশেরই কিছু কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী । বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শোষক গোষ্ঠীর এই ক্রমবর্ধমান শোষন-বৈষম্য ও বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নগ্ন হস্তক্ষেপের একমাত্র ও অনিবার্য পরিনতিই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব। তাদের সে অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে দামাল বাঙালি। ধাপে ধাপে আঘাত হানতে থাকে শাসনযন্ত্রে। 

’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ’৫৭-র স্বায়ত্তশাসন দাবি, ’৬২ ও ’৬৯-এর গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মার্চে দুরন্ত বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী শুরু করে নির্মম নিধনযজ্ঞ। এরপর আসে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা। দখলদার বাহিনীকে বিতাড়নে শুরু হয় অদম্য সংগ্রাম। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে জীবন দান করেন লাখ বাঙালি। অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর আসে সেই কাঙ্খিত বিজয়। সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৪৬ বছর আগের এদিনে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী হাতের অস্ত্র ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল বিজয়ী বীর বাঙালির সামনে। স্বাক্ষর করে পরাজয়ের সনদে। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয়ের দিনটিতে আনন্দের পাশাপাশি বেদনাও বাজবে বাঙালির বুকে। 

আত্মসমর্পণের খণ্ডচিত্র।
স্বাধীনতা অর্জিত হলেও গত ৪৭ বছর জাতির চলার পথ মসৃণ ছিলো না কখনো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি একইভাবে চলেছে সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধের বিচার, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ আন্দোলন। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রবল বন্যা, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের। এই বন্ধুর পথপরিক্রমায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু শত বাধা-প্রতিবন্ধকতাতেও হতোদ্যম হয়নি এ দেশের সংগ্রামী মানুষ। হারায়নি সাহস। লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে অব্যাহত আছে বাঙালির এগিয়ে যাওয়া।
বিজয় উদযাপনে আজ সকাল থেকেই সারা দেশে পথে নেমেছে উৎসবমুখর মানুষ। শহীদদের স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধায় দেশের সব স্মৃতিসৌধ ভরিয়ে দিয়েছে ফুলে ফুলে। সব বয়সী মানুষ সমবেত হয়েছে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। শ্রদ্ধার ফুলে ঢেকে গেছে সৌধের বেদি।
আত্মসমর্পণের খণ্ডচিত্র।
বিজয় দিবস বাংলাদেশে বিশেষ দিন হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সর্বত্র পালন করা হয়। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে এই দিনটিকে বাংলাদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রথম বছরের বিজয় দিবস থেকেই কার্যকর হয়েছিলো ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়া এ দেশের প্রথম সংবিধান।

আজ সরকারি ছুটি। লাল-সবুজ পতাকা উড়েছে বাড়িতে-গাড়িতে, দেশের সব প্রতিষ্ঠানে। অনেকের মাথায় থাকবে পতাকার রঙে রাঙা ফিতা। পতাকার রঙের পোশাকও ছিল উৎসবে শামিল অনেকের পরনে। পতাকায় সজ্জিত ছিল রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ। বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে গত কয়েক দিন আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভবনে করা হয়েছে আলোকসজ্জা। 

রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলোকে সাজানো হয়েছে জাতীয় ও রঙ-বেরঙের পতাকা দিয়ে। হাসপাতাল, শিশুসদন ও কারাগারগুলোতে পরিবেশন করা হয়েছে বিশেষ খাবার। বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে জাতীয় সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাংলাদেশ বেতার, বিটিভি, বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। 

ফিরে দেখা : ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
জয় বাংলা ধ্বণিতে মুখরিত চারিদিক

১৯৭১ সালের এ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সকালে বিমানাক্রমণ বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলির মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরো ছয় ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে দিয়ে ভারতের একজন স্টাফ অফিসারকে তাদের কাছে পাঠানোর অনুরোধ জানান। যাতে তার সাথে আলাপ করে অস্ত্র সমর্পণের ব্যবস্থাদি স্থির করা সম্ভব হয়।
এই বার্তা পাঠানোর কিছু আগে মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকী বাহিনীকে সঙ্গে করে মিরপুর ব্রীজে হাজির হন এবং সেখান থেকে নাগরা পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। নিয়াজি আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত করার পর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে নাগরার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ করে।
আত্মসমর্পণ দৃশ্য।
পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব মধ্যাহ্নে ঢাকা এসে পৌঁছান। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ান সৈন্য ঢাকা প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বণিতে মুখরিত চারিদিক। বিকেল চারটয় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিরা ঢাকা অবতরণ করেন। 
রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিকেলে চারটা ৩১ মিনিটে পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন-বি এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ পাক হানাদার বাহিনী। এ কারণেই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ -বাঙ্গালীর হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জল দিন। 
বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বিশ্বের সর্বকালের দখলদার বা স্বৈরাচারের কবল থেকে নিপীড়িত জাতির মুক্তির ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ ঘটনা । পৃথিবীর আর কোন জাতি স্বাধীনতার জন্য মাত্র নয় মাসে এত রক্ত দেয়নি বা এত কম সময়ে ছিনিয়ে আনতে পারেনি স্বাধীনতা। 

ঢাকা টু রাওয়ালপিন্ডি
কী ঘটছিলো পর্দার আড়ালে

আত্মসমর্পণের পরে নিয়াজি।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। বিশ্বের বুকে স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী নিয়ে স্বাধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তা পূর্ণতা পায় ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যপী মুক্তিযুদ্ধে। যে যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। যে যুদ্ধ তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। এ যুদ্ধাবস্থার শেষ অধ্যায়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছিল চীনকে সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে। এটা বুঝতে পেরে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন সীমান্তে সেনা মোতায়েন শুরু করে। তখন চীনের তাদেরকে আটকানোর শক্তি ছিলো না। তাই চীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে।
১৪ ডিসেম্বরই বোঝা গিয়েছিল যে পাকিস্তানি বাহিনীর মরণঘণ্টা বেজে গেছে। ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে বার্তা পাঠানোর সংখ্যা সেদিন থেকেই অনেক বেড়ে গিয়েছিলো আকস্মিক ভাবে। এই সব বার্তায় ফুটে উঠছিলো চরম হতাশার সুর। সকাল ১০টায় প্রেরিত এক বার্তায় বলা হয়, ‘আমরা আশ্বাসের ওপর বেঁচে আছি। কিছু ঘটবে কী না অনুগ্রহ করে জানান, যা ঘটবার সেটা অতি দ্রুত হতে হবে।’ আরেক বার্তায় বলা হয়, ‘আমাদের কোনো মিসাইল নেই, আমরা কীভাবে গোলা নিক্ষেপ করব? কোনো বিমানবাহিনী নেই। বিমান হামলা হয়ে উঠেছে দুশ্চিন্তার কারণ।’
আত্মসমর্পণের খণ্ডচিত্র।
১৫ ডিসেম্বর দিনটি শুরু হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিহীন পরিস্থিতিতে এবং বাতাসে পাওয়া যাচ্ছিল আত্মসমর্পণের গন্ধ। ভেতরের খবর অবশ্য সবার জানা ছিলো না। আগের দিন বিকেলে গভর্নর ও নিয়াজির কাছে প্রেরিত বার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানান, ‘আপনারা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যখন আর প্রতিরোধ কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সেটা কোনো কাজের কথাও হবে না। এখন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা আপনাদের নেওয়া উচিত।’ তবে সর্বশেষ এই বার্তাতে আত্মসমর্পণ কথাটা ঊহ্য রাখা হয় এবং দায়-দায়িত্ব চাপানো হয় প্রাদেশিক সরকার ও সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ডের ওপর।
সে সময় কী ঘটছিল পর্দার অন্তরালে তার এক বিবরণ দিয়েছেন ঢাকাস্থ জাতিসংঘ উদ্বাস্তু বিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি। ইস্টার্ন কম্যান্ডের হেডকোয়ার্টারসে জেনারেল নিয়াজি চাইছিলেন রাওয়ালপিন্ডি থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ আসুক আত্মসমর্পণের জন্য। ১৫ ডিসেম্বর সকালে তিনি গভর্নর ড. আব্দুল মুত্তালিব মালিকের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। 
গভর্নর লিখেছিলেন, ‘আপনার ও আমার কাছে প্রেসিডেন্ট প্রেরিত বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার দিক থেকে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সেটা আমি জানতে চাইছি। বার্তায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে আপনি সংঘাত বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিন এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পশ্চিম পাকিস্তানের ও এখানকার বিশ্বস্তজনদের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যা দরকার সেটা করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’ 

যুদ্ধবন্দী পাকসেনারা। 
নিয়াজি পিন্ডিতে জেনারেল হামিদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। জেনারেল হামিদ তাকে ‘নির্দেশমতো কাজ করতে’ বলেন। নিয়াজি আকুল হয়ে প্র্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে চান। দেশের এই গুরুতর পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়ার তখন অন্য দশা। 
নিয়াজি লিখেছেন, ‘জেনারেল হামিদ বললেন তিনি (ইয়াহিয়া) বাথরুমে গেছেন। আদতে তিনি বাথরুমে ছিলেন না, অতিরিক্ত মদ্যপানে তার তখন বেসামাল অবস্থা। এরপর এয়ার মার্শাল রহিম খান আমার সঙ্গে কথা বলেন, তাকেও মনে হচ্ছিলো মাতাল। তিনি চাপ দেন আমি যেন প্রেসিডেন্টের হুকুম তামিল করি।’ এরপরই মালিক-ফারমান আলীর তৈরী করা লড়াইয়ে ক্ষান্ত দেওয়ার বার্তা ভারতীয়দের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন নিয়াজি।
১৬ ডিসেম্বর, সকাল ১০ টা বেজে ৪০ মিনিট। যৌথবাহিনী ঢাকাতে প্রবেশ করে। এর আগেই অবশ্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েন। একাত্তরের এই দিনে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি সকাল বেলায় ঢাকা সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে পৌঁছান। সেখানে নিয়জিকে পাওয়া না গেলেও তিনি বিধ্বস্ত জেনারেল রাও ফরমানকে পেলেন। 

হতাশ বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানীরা।
রাও ফরমান জন কেলিকে বলেন, ‘মিত্রবাহিনীর কাছ থেকে তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সাথে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় এই খবরটি তাদের জানাতে পারছে না। এই সময় জন কেলি রাও ফরমানকে জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা। অভ্যুদয় হলো বাংলাদেশের। 

পাকিস্তানীরা ভেবেছিল যুদ্ধবিরতি - আত্মসমর্পণ নয়
‘জ্যাকবের অনড় অবস্থানে শর্ত মেনে নেয় নিয়াজি’

মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি ও এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আবদুল করিম (এ কে) খন্দকার বীরউত্তম তার ভেতরে বাইরে বইয়ে লিখেছেন, ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আলোচনার জন্য দুপুর একটার দিকে হেলিকপ্টারযোগে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী এবং জাতিসংঘের ঢাকা প্রতিনিধি জন কেলি তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। ব্রিগেডিয়ার বাকের জেনারেল জ্যাকব ও কর্নেল খারাকে (ভারতীয়) নিয়ে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছান। এয়ার কমোডর পুরুষোত্তম বিমানবন্দরে থেকে যান জেনারেল আরোরাসহ আমাদের অভ্যর্থনার আয়োজন করতে।

জেনারেল নিয়াজির অফিসে এসে জেনারেল জ্যাকব লক্ষ্য করেন যে, নিয়াজি আর জেনারেল নাগরা পাঞ্জাবী ভাষায় পরস্পরকে একটার পর একটা স্থুল ও আদি রসাত্মক কৌতুক উপহার দিচ্ছেন। সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ খান, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ ও এয়ার ভাইস মার্শাল ইনাম উল হক। 
নিয়াজির সঙ্গে আলোচনার আগে জ্যাকব জেনারেল জি সি নাগরাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈনিক ঢাকায় আনার নির্দেশ দেন এবং ঢাকার নিরাপত্তা, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি যেমন গার্ড অফ অনার, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে দেন। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। 
আত্মসমর্পণের খণ্ডচিত্র।
পিনপতন নীরবতার মধ্যে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান এবং খসড়া কপিটি জেনারেল নিয়াজিকে দেন। পাকিস্তানিরা ধারণা করেছিলেন যে আত্মসমর্পণ নয়, যুদ্ধবিরতি হবে। আত্মসমর্পণের সংবাদ পেয়ে তারা বেশ হতাশ হয়ে পড়ে। জেনারেল ফরমান আলী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বিরোধিতা করেন। তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পক্ষে মত দেন। জেনারেল নিয়াজি দলিলটি অন্যদের দেখার জন্য দেন। কেউ কেউ কিছু পরিবর্তনের কথা বলেন।

নতজানু নিয়াজি।
দলিলে পাকিস্তানিদের পক্ষে বেশকিছু শর্ত ছিল, যেমন পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হবে এবং সার্বিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হবে। এমনকি পাকিস্তানপন্থী সব বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ও দলিলে উল্লেখ ছিল। যা আগে কখনও কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পাকিস্তানীরা আরো কিছু সময় নেওয়ার পর আত্মসমর্পণের দলিলে সম্মতি দেয়। এরপর আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শুরু হয়। 
জেনারেল জ্যাকব জানান, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল আরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এরপর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর হবে এবং জেনারেল নিয়াজি তার অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করবেন।
আত্মসমর্পণের পদ্ধতির কিছু কিছু ব্যবস্থায় জেনারেল নিয়াজি গররাজি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান তার অফিসেই হোক। শর্তগুলোর বিষয়ে জেনারেল জ্যাকবের অনড় অবস্থানের কারণে শেষে জেনারেল নিয়াজি সবই মেনে নেন। তবে আত্মসমর্পণের পরও নিরাপত্তার জন্য তার অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি চান। 
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাধারণত বিজিত সেনাপতি বিজয়ী সেনাপতির সদর দপ্তরে গিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দেন ও অস্ত্র সমর্পণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এর ব্যতিক্রম ঘটানো হয়। এখানে বিজয়ী সেনাপতি বিজিত সেনাপতির এলাকায় গিয়ে জনসমক্ষে অত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন।
বিজয়োল্লাস।
আবদুল করিম (এ কে) খন্দকার আরো লিখেছেন, হেলিকপ্টারে করে পড়ন্ত বিকেলে আমরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করি। অবতরণ করার সময় দেখি হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জ্যাকব এবং আরো কিছু পাকিস্তানি ও মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তা আমাদের অভ্যর্থনা জানান। এরপর জিপে করে আমরা রমনা রেসকোর্স ময়দানে রওনা হই। রেসকোর্সে আমি জেনারেল আরোরার সঙ্গে তার জিপে করে যাই। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, মানুষের মুখচ্ছবিতে প্রশান্তির ছায়া। রমনার চারপাশে মানুষের ব্যাপক ভিড়। এমন পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে আমরা উপস্থিত হলাম রমনা ময়দানের সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে। 
অনুষ্ঠানটি ছিল অনাড়ম্বর এবং এটি অল্পসময়ে শেষ হয়। অনুষ্ঠানে মাত্র দুটি চেয়ার আর একটি টেবিল ছিল। একটি চেয়ারে জেনারেল নিয়াজি ও অন্যটিতে জেনারেল আরোরা বসলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি খুব সুশৃঙ্খলভাবে হয়নি। মানুষের ভিড়ে অতিথিদের দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন ছিল। আমি, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরার এসএম নন্দ ও পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর পাশেই ছিলেন পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এফ আর জ্যাকব। আমি জেনারেল আরোরার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অশোক রায় আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যদিও ভিড়ের চাপে আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছিলাম না।
বিজয়ের আবেগ।
আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আসার পর প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজি এবং পরে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরোরা দলিলে স্বাক্ষর করলেন। স্বাক্ষরের জন্য নিয়াজিকে কলম এগিয়ে দেন আরোরা। প্রথমে কলমটি দিয়ে লেখা যাচ্ছিল না। আরোরা কলমটি নিয়ে ঝাড়াঝাড়ি করে পুনরায় নিয়াজিকে দেন। এ দফায় কলমটি আর অসুবিধা করেনি। স্বাক্ষর শেষ হলে উভয়ই উঠে দাঁড়ান। তারপর আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী জেনারেল নিয়াজী নিজের রিভালভারটি কাঁপা কাঁপা হাতে অত্যন্ত বিষণ্নতার সঙ্গে জেনারেল আরোরার কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের কর্ডন করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান। এভাবে বাঙালি জাতির বিজয় সূচিত হয়।

যা লেখা ছিল আত্মসমর্পণ দলিলে

আত্মসমর্পণ দলিলের লেখা ছিল, ‘পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।’ 
দলিলে বলা হয়, ‘দলিলটি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।’
দলিলে আরো লেখা ছিলো যে, ‘লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।’

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

বিজয়োল্লাস।
আরো পড়ুনঃ 

১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত রণতরী

মুক্তাঞ্চলে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার
মেজর রফিকুল ইসলাম।
আজ ১৫ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল বুধবার। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকে মোকাবেলায় করতে প্রস্তত হওয়া ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে এই দিন সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এরপরই মার্কিন নৌবহর নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। ফলে পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির মনে যুদ্ধে সাহায্য পাওয়ার যেটুকু আশা ছিল শেষ হয়ে যায়। তখন রণাঙ্গনে চলছে মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলায় অবরুদ্ধ ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

একাত্তরের এই দিনে চারদিক থেকে পরাজিত হতে হতে পাকিস্তানী বাহিনী বুঝে ফেলে যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। ফলে সকালে সব আশা ছেড়ে দিয়ে শর্তসাপেক্ষে আত্ম-সমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেন নিয়াজি। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরা সেই প্রস্তাব পাঠিয়ে দেয় দিল্লীর মার্কিন দূতাবাসে। সেখান থেকে পাঠানো হয় ওয়াশিংটনে। এরপর ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের কাছে জানতে চায়, নিয়াজির এই প্রস্তাবে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সমর্থন আছে কি’না। 
প্রস্তাবের মূলকথা, ‘আমরা যুদ্ধ বন্ধ করেছি। তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত গোটা পাকবাহিনীকে চলে যেতে দিতে হবে, কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না।’ কিন্তু ভারত সরকার এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে এই আশ্বাস দিতে রাজি হয় যে, যুদ্ধবন্দিরা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার পাবে। 
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা।
পাকি জেনারেল নিয়াজীর শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেয়ে ভারতীয় বাহিনী মনে করে এটি তার কৌশল। নিয়াজীর প্রস্তাবকে তাদের কাছে মনে হলো এটি যুদ্ধবিরতি, আত্মসমর্পণ নয়। কিন্তু মিত্রবাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুতেই রাজি নয়। পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজির দেয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের জবাবে বিকালে জেনারেল মানেকশ পাকিদের জানিয়ে দেন যে, শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হবে না।
প্রস্তাবের প্রতি মিত্রবাহিনীর আন্তরিকতার নিদর্শন হিসাবে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে বলেও পাকিস্তানী জেনারেলকে জানিয়ে দেয়া হয়। এমনকি আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী কোন প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না এমনটা তাকে আশ্বস্ত করা হয়। একইসঙ্গে তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে আরো বলা হয় যে, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টা থেকে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করা ছাড়া মিত্রবাহিনীর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। 
জেনারেল নিয়াজি তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে পাকিস্তান হেডকোয়ার্টারকে অবহিত করেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দেন যে, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের জন্য যে সব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেওয়া যেতে পারে। এ নির্দেশ পেয়ে সেনানিবাসে নিজের কক্ষে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিয়াজি। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রাত দুইটার মধ্যে বাংলাদেশের সব জায়গাযয় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তারবার্তা পাঠান। এদিনটি মূলত দখলদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিন-ক্ষণ নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়।

ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী বাঙালী।
একই দিনে ঢাকার বাসাবোতে ‘এস ফোর্সে’-র মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। জয়দেবপুরেও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় তারা। টঙ্গী, ডেমরা, গোদনাইল ও নারায়ণগঞ্জে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় দখলদার বাহিনী। এছাড়া এদিন সাভার পেরিয়ে গাবতলীর কাছাকাছি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয় মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট।

ভারতীয় ফৌজের একটি প্যারাট্রুপার দল পাঠিয়ে ঢাকার মিরপুর ব্রিজের পাকিস্তানী ডিফেন্স লাইন পরখ করে নেয়া হয়। রাতে যৌথ বাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদিরীয়া বাহিনী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। রাত দুইটার দিকে যৌথ বাহিনী পাক সৈন্যের মুখোমুখি হয়। যৌথ বাহিনী ব্রিজ দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। ব্রিজের ওপাশ থেকে পাকবাহিনী মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম পাড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। সারারাত তুমুল যুদ্ধ চলে। 
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যে কোন মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। চারদিক থেকে ঢাকা অবরূদ্ধ। এদিন দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়- ‘ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীকে তাড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা মুক্ত বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। দেশের ভেতর বাড়ি-ঘর থেকে বিতাড়িত লোকজনও বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করেছে।’ এ সময় জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, নেজামী ইসলামীর নেতাকর্মীরা অনেকেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। আবার অনেকেই আত্মগোপন করে।
চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী কুমিরার দক্ষিণে আরো কয়েকটি স্থান হানাদার মুক্ত করে। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম শহরের প্রথম রক্ষাব্যুহ ভাটিয়ারীতে আক্রমণ চালায়। সারারাত মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলে। ভাটিয়ারি থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। 
পাকিদের এক স্থানীয় দোসরের পরিণতি। 
ওদিকে যৌথবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হয়। রাতে তারা চারদিক থেকে রংপুর শহর ঘিরে ফেলে। পরের দিন রংপুর সেনানিবাসে আক্রমণ করার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ বিরতির ঘোষনা হওয়ায় তার আর প্রয়োজন হয়নি। 

ফরিদপুর অঞ্চলে যৌথবাহিনী কামারখালীর পাকঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। সাঁড়াশী আক্রমণের মুখে তারা অবস্থান ছেড়ে ফরিদপুর শহরের দিকে পালাতে থাকে। যৌথবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। পথে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে স্বেচ্ছায় শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী অফিসারদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল ছিলেন। 
একই দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানী কমান্ডারদের আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মত নির্দেশ দেন। জেনারেল মানেকশ বলেন, ‘আমি আবার বলছি, আর প্রতিরোধ করা নিরর্থক। ঢাকা গ্যারিসন এখন সম্পূর্ণভাবে আমাদের কামানের আওতায়।’ এই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবি ডা. আলীম চৌধুরী এবং বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর নিহত হন।
তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

পদত্যাগ করে প্রাদেশিক সরকার

পাকিস্তানী অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে মিত্রবাহিনী।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঢাকা বিজয়ে মিত্রবাহিনী আগের দিন রাত থেকেই সর্বাত্মক হামলা শুরু করে দিয়েছে। তাদের আগ্রাসী আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্তারা পদত্যাগ করে আন্তর্জাতিক সেচ্ছাসেবী সংস্থা রেডক্রস ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। 

তখন চীন-মার্কিন সামরিক সাহায্য পাওয়ার আশা নিয়ে পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি তখন প্রকাশ্যে বলছেন, ‘শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব’। আর ভেতরে ভেতরে ভারতের সেনাপ্রধান মানেকশ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপদ আত্মসমর্পণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনই প্রেক্ষাপটে রাতের অন্ধকারে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার নীল-নকশা বাস্তবায়ন করে তাদের এদেশীয় দোসরেরা। 
একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামান অবিরাম গোলা ছুঁড়ে চলে। নিয়াজিসহ পাকি হানাদারদের হৃদকম্প তখন তুঙ্গে। মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা গিয়ে পড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও। সে গোলার আওয়াজে তখন গোটা শহর কাঁপছে। 
পাকিস্তানের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর ড. আবদুল মুত্তালিব মালিক সেদিন সকালেই ‘সমগ্র পরিস্থিতি’ বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। এ বৈঠক বসানোর ব্যাপারে তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী এবং চীফ সেক্রেটারি মুজাফফর হোসেনের হাত ছিল বলে গোপন নথিপত্র সাক্ষী দেয়। পাকিস্তানি সামরিক সিগন্যাল কোড ভেঙে থেকে কয়েক ঘণ্টা আগেই এ বৈঠকের খবর পেয়ে যায় ভারতের বিমান সদর দফতর।বৈঠক চলাকালে গভর্নর ভবন আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। 
বৈঠক বসে বেলা ১১টা নাগাদ। মেঘালয়ের শিলং বিমান ঘাঁটি থেকে প্রেরিত অর্ধ ডজন মিগ-২১ সঠিক সময়ে গভর্নর ভবনের উপর নির্ভুল রকেট আক্রমণ চালায়। গোটা পাঁচেক রকেট গিয়ে পড়ে গভর্নর হাউসের ঠিক ছাদের ওপর। মালিক ও তার মন্ত্রীরা ভয়ে প্রায় কেঁদে ওঠে। চীফ সেক্রেটারি, আইজি পুলিশসহ বড় বড় অফিসারও মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তারাও ভয়ে যে যেভাবে পারলেন পালালেন। 
হামলার পর গভর্নর হাউস, যা বর্তমানে বঙ্গভবন।
বিমান হানা শেষ হওয়ার পর গভর্নর মালিক আবার বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষ হতে অবশ্য পাঁচ মিনিটও লাগেনি। তারা সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেডক্রস কমিটির ঢাকা প্রতিনিধি রেনডকে জানায় এবং তার কাছে আশ্রয় চায়। রেনড সাথে সাথে এ খবর পৌঁছায় জেনেভায়। তার বার্তায় বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছে এবং রেড ক্রস আন্তর্জাতিক অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছে। জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকারকে যেন অবিলম্বে সব ঘটনা জানানো হয়। খবরটা যেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীকেও জানানো হয়।’ 
রেডক্রস তখন ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণা করেছে। বহু বিদেশী ও পশ্চিমা পাকিস্তানীরা গিয়ে আশ্রয় নেয় সেখানে। 
মালিকের নেতৃত্বাধীর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অমন সিদ্ধান্তের পর নিয়াজির অবস্থা আরো কাহিল হয়। আত্মসমর্পণের পর হামলা নয়, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইছিলেন জেনারেল নিয়াজিসহ পাকবাহিনীর অন্যান্য জেনারেলরা। তবে গোটা দুনিয়ায় তখন সপ্তম নৌ-বহরের বঙ্গোপসাগরে আগমণ নিয়ে জোর জল্পনা-কল্পনা চলছে। 

নিয়াজি
মার্কিন সরকার যদিও ঘোষণা করেছিল যে, কিছু আমেরিকান নাগরিক অবরুদ্ধ, বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করেনি। বিশ্ববাসীর মনে তখন প্রশ্ন ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের মাঠে নামাবেন? এ নিয়ে সর্বত্র যখন তুমুল আলোচনা ঠিক তখন মিত্রবাহিনী প্রচণ্ডভাবে ঢাকার বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও এই দিনও তারা ঠিক জানে না যে, ঢাকার ভেতরের অবস্থাটা কি বা পাকবাহিনী কিভাবে ঢাকার লড়াইয়ে লড়তে চায় এবং ঢাকায় তাদের শক্তিই বা কতটা। তবে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট।
নানা চেষ্টায় কিছু খবর আসলেও আসল খবর কিছুতেই পাওয়া গেলো না। মিত্রবাহিনী মনে করল, ঢাকার ভেতরে লড়াই করার জন্য যদি সৈন্যদের এগিয়ে দেয়া যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে যদি বিমান আক্রমণ চালানো হয়, তবে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষও মরবে। মিত্রবাহিনী এটা কিছুতেই করতে চাইছিল না। তারা একদিকে যেমন ফের পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আবেদন জানায়, অন্যদিকে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের শহর ছেড়ে চলে যেতে বলে। 
মুক্তিযোদ্ধারা।
উত্তর এবং পূব দুদিকেই তখন বহু মিত্রসেনা এসে উপস্থিত হয়। চাঁদপুরেও আরো একটা বাহিনী নদীপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য তৈরী হয়। ঠিক এমন দিনেই হানাদার পাকিস্তানি ও তাদের দোসরেরা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। আজকের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় পুরো জাতি সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করছে। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১৩ ডিসেম্বর ২০১৮

ঢাকার ১৫ মাইলের মধ্যে মিত্রবাহিনী

মিত্রবাহিনীকে ঘিরে জনতার উল্লাস।
আজ ১৩ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ সোমবার। বাংলার জমিন থেকে ঔপনিবেশিক এই নাম মুছে যেতে আর মাত্র দুই দিন বাকি। এদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছায়। 
অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় ঢুকে পড়ে। এমনকি অজস্র নিরস্ত্র জনতাও রাস্তায় নেমে আসে। গা ঢাকা দেয় পাকিস্তানের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর ড. আবদুল মুত্তালিব মালিক ও তার সহচরেরা। তবে এই দিনও বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতায় সক্রিয় ছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। 
একাত্তরের এই দিনে চারদিকে উড়তে থাকে বাঙালির বিজয় নিশান। শুধু ময়ানমতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ জন। আর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা। ভারতের ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড ঢাকার দিতেক এগিয়ে যায় পূর্বদিক থেকে। উত্তর দিক থেকে আগায় জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড। 

এদিন টাঙ্গাইলে আরো ছত্রিসেনা অবতরণ করে। পশ্চিমে চার নম্বর ডিভিশন মধুমতি পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মা নদীর তীরে। রাত নয়টায় মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং সন্ধ্যা থেকে টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে নয়টায় টাঙ্গাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউজে তারা পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন। 

আলোচনার শুরুতে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। রাস্তাতেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।’ এ সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহর ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পৌঁছায়। 
সমুদ্রপথে শত্রুদের পালানোর সুযোগ কমে যাওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ঢাকা চূড়ান্ত লড়াইয়ের স্থল বলে চিহ্নিত হতে থাকায় তাদের সম্ভাব্য নিয়তির আশঙ্কাও দ্রুত বাড়তে থাকে। 
মিত্রবাহিনীকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।
চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে এগুনোর পথে নাজিরহাটে হানাদাররা বাধা দেয়। এখানে ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদের তিন কোম্পানি এবং বেশকিছু ইপিসিএএফসহ অবস্থান নিয়েছি। এখানে ব্যাপক যুদ্ধের পর পালিয়ে যায় হানাদাররা। এদিকে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ২০-ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে মুরাপাড়ায় পৌঁছায়। 

যৌথ বাহিনীর অগ্রবর্তী আরেকটি সেনাদল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার পাঁচ/ছয় মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। বালু নদীর পূর্বদিকে পাকিস্তানি বাহিনী শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার চারদিকে আগে থেকেই পাকিস্তান বাহিনী ফিল্ড ডিফেন্স বা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থাসহ অবস্থান নিয়েছিল। 

ওদিকে খুলনা এবং বগুড়ায় এই দিন হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় মানুষের অবিরাম যুদ্ধ চলে। মুজিবনগরে তখন চরম উত্তেজনা। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবর্তন ও পরিবেশন করেন। প্রতি মুহূর্তে খবর আসছে ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা মুক্ত। 
আকাশ, জলে, স্থলে সবদিকে হানাদাররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিকে জানান, ‘আরো সাহায্য চাই।’ 
কেন্দ্রের সামরিক কর্তারা ঢাকায় অবস্থানরত ঘাতকদের এই বলে আশ্বস্ত করে, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। পশ্চিম খন্ডে ভারতীয় বাহিনীকে এমন মার দেয়া হবে যে তারা নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইবে ও যুদ্ধ থেমে যাবে।’ কিন্তু তাদের জন্য সেদিন আর আসেনি। তবে এই দিনও পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে রাজী করানোর কাজে ইসলামাবাদে সারাদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায়। 
পিকিং-এ পাকিস্তানী দূতাবাসেও দেখা যায় কর্মতৎপরতা। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের এই মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সিকিম-ভুটান সীমান্তে থাকা চীনা সৈন্যবাহিনীকে কিছুটা তৎপর হতে দেখা যায়, কিন্তু ভারতে যে তা বিশেষ উদ্বেগের সঞ্চার করেছিল এমন নয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী সদর দপ্তরে বাংলাদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক অসফল প্রয়াসও ঠিক এই দিনই পরিলক্ষিত হয়। 
কলকাতায় ১৩ ডিসেম্বর সকালে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে প্রায় মাসাধিককাল যাবত অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুব আলম চাষী যুদ্ধবিরতির এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রস্তাবিত বিবৃতির প্রধান বক্তব্য ছিল- ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয় তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে।’ 

বাংলাদেশ তখন ভারতের সঙ্গে যুগ্ম-কমান্ডব্যবস্থায় আবদ্ধ, কাজেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি যদি একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতেন, তবে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে এককভাবে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া নীতিগতভাবে অসিদ্ধ হতো। সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই সৈয়দ নজরুল ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর দানে অসম্মত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের গোচরে আনেন। 

নিউইয়র্কে এই দিন নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আবারো তৃতীয় সোভিয়েট ভোটের মুখে বাতিল হয়ে যায়। যে কারণেই হোক সামরিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নে চীনের সম্মতির সম্ভাবনাকে তখনও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ বাতিল করে উঠতে পারেনি। কাজেই সেই ভরসায় চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর সপ্তম নৌবহরকে পুনরায় সচল করা হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকার আকাশ থেকে পাকিস্তানি সামরিক অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালানো হয়। ঢাকার সর্বত্র অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। এইদিন তারা প্রকাশ্যে সড়কে নেমে আসে। পাকিস্তানি সেনা নায়কদের মনোবল উঁচু রাখার সামান্যতম অবলম্বন কোথাও ছিল না। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হস্তক্ষেপ।
যুদ্ধ জয় নিশ্চিত জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশী নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সবরকমের সুযোগ-সুবিধা দেবে।’
উল্লাসিত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসী।
এই দিন শান্তি কমিটি, ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা বেশিরভাগই অবস্থা বেগতিক দেখে গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু এর মধ্যেও ঘাতক আলবদর চক্র সক্রিয় ছিল। যার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ ঘটেে দেশের কৃতী সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায়। এদিনে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় কিছু আল বদর কর্মী। পরে ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১২ ডিসেম্বর ২০১৮

যুক্তরাষ্ট্রের হুমকীর মুখেও অটল ভারত

অগ্রগামী মিত্রবাহিনী।
আজ ১২ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ রবিবার। বাংলার জমিন থেকে ঔপনিবেশিক ওই নাম মুছে যেতে তখনও তিন দিন বাকি। যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধে জড়ানোর হুমকী এদিন প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করে ভারত। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা দীর্ঘ বক্তব্য দেওয়ার পর মুলতবি হয়ে যায় অধিবেশন। একইদিনে তৈরী হয় বুদ্ধিজীবি হত্যার চূড়ান্ত নীল-নকশা। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে ৯ ডিসেম্বর রওনা করা যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর এই দিন বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘন্টার দূরত্বে এসে গভীর সমুদ্রে অবস্থান নেয়। আগের দিন ( ১১ ডিসেম্বর) প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার রাশিয়ার ওয়াশিংটন প্রতিনিধির মাধ্যমে ভারতকে একদিনের মধ্যে যুদ্ধ থামানোর আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। নয়ত যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে এ যুদ্ধে অংশ নেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তবুও এই আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ মহাসচিক উ থানকে এক বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জানান, ‘পাকিস্তান যদি শুধু বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছুতে সম্মত হয়; তবে ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পাশপাশি ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে।’ 
সপ্তম নৌবহরের সর্বশেষ অবস্থান খবর তখনও ভারতে কেবল স্বল্প সংখ্যক নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে সীমিত। তবু মার্কিন প্রশাসনের হুমকির প্রকাশ্য জবাব দেয়া ও ভারতের জনসাধারণকে আসন্ন বিপদ ও কঠোর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ১২ ডিসেম্বর দিল্লীতে বিশেষভাবে আয়োজিত এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ‘সম্মুখের অন্ধকার দিন’ ও ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের সম্ভাবনা’ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করেন। একই দিন পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন। সাংবাদিকদের সাথে আলাপে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।’ 

অন্যদিকে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানান। তিনি তার দলের সদস্য ও সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, মুক্তিসংগ্রামে জয় লাভের আর দেরি নেই। অন্যদিকে দিল্লীতে কুজনেটসভ এবং মস্কোতে ডি পি ধরের যুগপৎ আলোচনার ফলে দ্রুতগতিতে উভয় সরকার মার্কিন ও চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি মোকাবিলায় যুগ্ম ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হন। 
ভারতীয় নৌ-বাহিনী এই দিন সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য তৎপরতা বিঘ্নিত করতে চালনা থেকে কক্সবাজারের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থানরত সব ছোট-বড় নৌযান, উপকূলীয় অবকাঠামো; এমনকি কক্সবাজার বিমানবন্দরও ধ্বংস বা অকেজো করে ফেলে। 
পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজিকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান টেলিফোন করে পশতু ভাষায় জানান, পরদিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে। তিনি মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সাহায্য পাওয়ার ইঙ্গিত দেন। এরপরই নিয়াজির নির্দেশে ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রতিরক্ষার আয়োজন নিরঙ্কুশ করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার কারফিউ জারি। একইসঙ্গে ঘরে ঘরে তল্লাশী শুরু হয়। 

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল।
এরই মাঝে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশিদের সড়িয়ে নিতে তিনটি ব্রিটিশ বিমান এসেছিল। একাত্তরের দিনলিপির এই দিনে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন, “এয়ার্পোরটের দিকে দেখা যাচ্ছে তিনটা প্লেন বারবার নিচে নামার চেষ্টা করছে, আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। আমাদের ছাদের ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায়। জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা থেকে অপসারণের জন্য এই চেষ্টা। কিন্তু ভারতীয় বিমান বোমা ফেলে রানওয়েটা বেশ ভালো জখম করে রেখেছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাণান্ত চেষ্টা করে প্লেনগুলো নামল, খানিক পরে উঠেও গেল। ওরা উড়ে চলে যাবার পরপরই ফটাফট দুটো বোমা রানওয়েতে মেরে দিয়ে গেল ভারতীয় প্লেনগুলো। আরো ভালো করে দেখার জন্য সিঁড়িঘরের ছাদের টঙ্গে জামী একবার উঠেছিল। ওখানে উঠলে এলিফ্যান্ট রোডের বুকটাও দেখা যায়। জামী নেমে এসে বলল, আচ্ছা মা, সারাদিন কারফিউ অথচ এত মাইক্রোবাস যাচ্ছে কেন রাস্তা দিয়ে? এগুলো তো মিলিটারি গাড়ি নয়।”

রাতে প্রাদেশিক সরকারের উপদেষ্টা মেজর রাও ফরমান তার এ দেশীয় দোসর আল-বদর ও আল-শামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের সদর দফতরে ডেকে পাঠান। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এক গোপন বৈঠক। এই গোপন বৈঠকে বুদ্ধিজীবি হত্যার নীল-নকশা প্রণয়ন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান তাদের হাতে বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা তুলে দেন। এই নীল-নকশা অনুযায়ী দুই দিন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় জাতির মেধাবী সন্তানদের। 
এর আগে ১২ তারিখ রাতেই  এপিআই এর জেনারেল ম্যানেজার সাংবাদিক নিজামউদ্দিনকে আল-বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের দোসরা যখন নিজামউদ্দিনের বাসায় হানা দেয় তখন তিনি বিবিসি এর জন্য রিপোর্ট তৈরি করছিলেন। ওই অবস্থায় ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আ ন ম গোলাম মোস্তফাও নিজ বাসভবন থেকে অপহৃত হন। তিনিও আর কখনো ফিরে আসেননি।
মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাস, ডিসেম্বর ১৯৭১।
ওদিকে রণাঙ্গনে পাকিদের পশ্চাদপসরণের ধারা অপরিবর্তিত থাকে। এই দিন সকালে শত্রুমুক্ত হয় নরসিংদী। বিকেলে ভারতের আর একটি ইউনিট (৪ গার্ডস্) ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে রাতে প্রচ- আক্রমণ চালায়। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়া বাহিনী। সেখানে তুমুল যুদ্ধের পর ফলে ঢাকা অভিযানের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ পথের সদ্ব্যবহার শুরু হয়। 

দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী খানসামা থানা আক্রমণ করে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১৫ জন ও সাত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের হাতে এক মেজরসহ পাকবাহিনীর ১৯ জন ধরা পড়ে। তবে এদিনই দিনাজপুরের বিরল থানায় বহলা গ্রামে ঘটে গণহত্যার নৃশংস ঘটনা। এদিন নীলফামারী , গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ি, ভেড়ামারা এবং শ্রীপুরও হানাদারমুক্ত হয়। 

১১ ডিসেম্বর ২০১৮

বেসামাল প্রেসিডেন্ট, গভর্নর দিশেহারা

পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে গোলা ছুড়ছে মিত্রবাহিনী।
আজ ১১ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ শনিবার। নামটি মুছে যাওয়ার তখন আর মাত্র চার দিন বাকি। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এদিন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ তবে কিসিঞ্জার জানতেন, রণাঙ্গনে আসন্ন বিজয় দৃষ্টে ভারত এই চরমপত্র অগ্রাহ্য করবেই। 
ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তখন বেসামাল আর ঢাকায় দিশেহারা গভর্নর ড. আবদুল মোত্তালেব মালিক ও তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলি। তবুও পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো ক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া চলবে না। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে আরো উজ্জ্বল করবে।’ ঢাকা বিমান বন্দর পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়েও আলাপ করেন।
একাত্তরের এই দিনে যুদ্ধক্ষেত্রে যৌথবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই চলতে থাকে। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর হানাদাররা ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 
ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে তখন চারদিক থেকে ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বাংলার বীর মুক্তি সেনারা এগিয়ে আসছে। পথে পথে যেসব জনপদ, গ্রাম, শহর-বন্দর ছিলো সর্বত্রই মুক্তিসেনারা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। 
এদিন জামালপুর, মুন্সীগঞ্জ, লাকসাম, আশুগঞ্জ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুরের হিলিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এ সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। যদিও এসব এলাকা মুক্ত করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ব্যাপক যুদ্ধ করতে হয়। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি। 
মিত্রবাহিনীর সাতশ সৈন্যের অবতরণ।
মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী নিয়ন্ত্রিত টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে এদিনে মিত্রবাহিনীর সাতশ সৈন্য বিমান থেকে অবতরণ করে। এ সময় পাকিস্তানী ব্রিগেডের সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ হয়। অন্যদিকে পাকবাহিনীর আরেক শক্ত ঘাঁটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও উপকূলীয় অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ ব্যাপক তৎপরতা চালায়। একের পর এক বোমা ও রকেট হামলা চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয় পাক হানাদারদের সবকিছু। আকাশ ও স্থলে মুক্তি ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা পাক সৈন্যরা নদী পথে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বত্র সতর্ক প্রহরা যে আগেই বসানো হয় ছিলো তা জানা না হানাদারদের। তাই পাকি সামরিক পোশাক ছেড়ে সাধারণ বেশে নদী পথে অনেক পাক সৈন্য পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।

ঢাকায় বেলা তিনটা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। 
অন্যদিকে যশোরের মুক্ত এলাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করে কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার মধ্যে ছিলো, এক. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। দুই. ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিন. সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে এবং চার. জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী নিষিদ্ধ করা হবে। সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পারল না।’ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শিশু রাষ্ট্রটি গড়ে তোলার দায়িত্ব এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।’ পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পরস্পরের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা অক্ষুণ রেখেই ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক।’
কাদের সিদ্দিকী, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১।
আগের দিন ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা আবেদনের মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। এই দিন সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন ওই শর্তগুলো। এক. পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। দুই. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোন লিখিত চুক্তি করবে না। তিন. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে দিতে হবে। চার. এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দিতে হবে। পাঁচ. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে।

কিন্তু এই দিন ইয়াহিয়া খান এ প্রস্তাব নাকচ করেন। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানকে যুদ্ধে সহায়তা করার দাবি জানান। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র শুধু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়ার দাবি তোলে। 

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার এই দিন বলেন, ‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদেও প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ ব্যাপারে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’ এরপরই হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করেন।

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১০ ডিসেম্বর ২০১৮

পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ নিয়াজির

আটক হওয়া দুই রাজাকার।
আজ ১০ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ শুক্রবার। এই নামটি মুছে যাওয়ার তখন আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর অবিরাম আক্রমণের মুখে আত্মসমর্পনে উদ্যত হন পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা গভর্নর ড. আবদুল মোত্তালেব মালিক ও তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলি। 
পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি এই দিন পালানোরও চেষ্টা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা করা সপ্তম নৌবহর তখন মালাক্কা প্রণালীতে। 
একাত্তরের এই সময়ে ঢাকায় পরিকল্পিত চূড়ান্ত হামলা চালিয়ে শত্রুদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে যৌথবাহিনী। মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো এদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্র স্তব্ধ করে দেয়, বোমা-রকেট ছুড়ে বিধ্বস্থ করে দেয় ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। মিত্র বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। 

এক মুক্তিযোদ্ধা।
পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটি জাহাজ তীরে এসে ভীড়লেও তারা মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি জাহাজ সাদা পতাকা উড়িয়ে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে পালানোর চেষ্টা করে। সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলেও সাফল্য অর্জন করছে। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রু বাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যৌথ বাহিনী এই তিন শহর ছাড়া রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে। 

রাতে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর সময় শহরের অদূরে যৌথ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। এ যুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার পাকিস্তানী সেনা হতাহত হয়। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। এমন সময়ে নিয়াজির গোপন অভিসন্ধি ফাঁস করে দেয় বিবিসি। 

নিয়াজি স্বীয় দুর্বলতা ঢাকার জন্য ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে এসে বলেন, ‘কোথায় বিদেশি সাংবাদিকরা, আমি তাদের জানাতে চাই, আমি কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাবো না।’ 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে এক বিশাল জনসভায় ভাষণদানকালে বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান ভারত প্রত্যাখ্যান করেনি বা গ্রহণও করেনি। প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্ভব হবে যখন বাংলাদেশ সরকার কায়েম হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থী তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে।’ 

অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন ও রণকৌশল গ্রহণ করার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈযয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। ভারতের পক্ষে সই করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

হামলায় ভয়ার্ত পাক সেনা।
একই দিন গভর্নর মালিকের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্রসংবরণ কথাটি ব্যবহার করা হয়। 

এই আবেদনে আরো লেখা ছিলো যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তি পূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই। 

এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি মালিক-ফরমান আলী বার্তা হিসেবে পরিচিতি পায়। রণাঙ্গনের বাস্তব চাপে এই দিন পাকিস্তান নিজেই যখন সম্মানজনকভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে, তখন সেই উদ্যোগকে সমর্থন না করে মার্কিন সরকার বরং তা রদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। 
এদিনে দুঃখজনক একটি ঘটনাও ঘটে। খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীতে নৌবাহিনীর জাহাজ পলাশ নিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে এক ‘ভুল বোঝাবুঝির যুদ্ধে’ গোলার আঘাতে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। 
ঢাকায় কার্ফ্যু জারি করে আল-বদরবাহিনী তাদের কুখ্যাত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন ও পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার নাজমুল হককে বাসা থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। 

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

০৯ ডিসেম্বর ২০১৮

জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র

সৈন্যদের মাঝে জেনারেল নিয়াজি
আজ ৯ ডিসেম্বর। গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক দিবস। বছর দুয়েক আগে ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ এ দিনটি ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরে জাতিসংঘে প্রথমবারের মত গণহত্যা প্রতিরোধে এ সংক্রান্ত শাস্তি বিষয়ক প্রথাটি গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালের এ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। 
বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যার জন্ম দেওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে এই দিন সরাসরি সহযোগিতার পদক্ষেপ নেয় তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা করার আদেশ দেন। আর মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং আরোরাও জানিয়ে দেয় তারা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত। পাকিস্তানীরা অবশ্য তখন এ বাহিনীর আক্রমনের মুখে দ্রুত পশ্চাদপসরনে ব্যস্ত। দ্রুত শত্রুমুক্ত হতে হচ্ছে একের পর এক এলাকা।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে যে সমস্ত জায়গা শত্রুমুক্ত হয় তার মধ্যে দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাট অন্যতম। দাউদকান্দিতে পাকিস্তানীদের পতনের মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। 

এর আগে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ের। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। আর মিত্র বাহিনীও দ্রুত ঢাকা পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হয়। 

পূর্বাঞ্চলের এ বাহিনীর মতো পশ্চিমে আরেকটি বাহিনী তখন পৌঁছে গেছে মধুমতি নদীর তীরে। অন্য একটি বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে চলছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছে গেছে ময়মনসিংহের কাছাকাছি। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তুমুল যুদ্ধ হয়। সেখানে সেদিন নির্বিচারে গণহত্যাও চালায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। তবে শেষ অবধি টিকতে পারেনি তারা। ঢাকার আশপাশের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান মুক্ত হবার খবর আসে৷
এমন সময়ে ভারত কাশ্মীর দখলের ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এরই প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন অপেক্ষমাণ মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। ইউএস নেভি প্রত্যাসন্ন হামলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার করার জন্য সপ্তম নৌবহরকে পাঠানো হয় করাচীর সন্নিকটে আরব সাগরে নয়, বরং তার প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরের দিকে। 
কথিত ভারতীয় প্রচেষ্টা উদ্ঘাটিত হওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ আগেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় সপ্তম নৌবহরের এখতিয়ার বঙ্গোপসাগর অবধি সম্প্রসারিত করা হয়। বৃহত্তর যুদ্ধের ডামাডোলে চাপা পড়ে ঘটনার ও ব্যাখ্যার এই সব অসঙ্গতি। পরে এগুলো অক্ষত রেখেই নিক্সন ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার স্ব স্ব স্মৃতিকথায় দাবি করেন- ‘পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে সতর্ক করে দেবার উদ্দেশ্যে’ তখন সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়। তবে এটা স্পষ্টত ছিলো যে এই শক্তিশালী নৌবহর পাঠানোর মূল লক্ষ্য ছিলো বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ-অবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানী স্থল বাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং সেখানে আরো মার্কিন নৌসেনা অবতরণের ক্ষেত্র তৈরী করা।

একাত্তরের মা, কোলকাতা।
বিকেলে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা এখন বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’  সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, পাকিস্তানীরা যদি মাটি কাঁমড়ে ঢাকার লড়াই চালাতে চায় তাহলে আপনি কী করবেন? জেনারেল অরোরা জবাব দিলেন, ‘ওরা কী করবে জানি না। তবে আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত।’ সাংবাদিকরা ফের প্রশ্ন করলেন, ‘ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কী?’ অরোরা জানালেন, নদী। তারপর আবার বললেন, ‘নদী যদিও বড় বাধা, কিন্তু সে বাধা অতিক্রমের সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর আমাদের পি.টি.-৬৭ ট্যাঙ্কগুলো নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে।’ 

অরোরা জানান, মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী সেদিনই টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী এক এলাকায় সাতশ ছত্রীসেনা এবং ৮০ টন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এর আগে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার আরো বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুই দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে, আরেক অংশ রয়েছে দক্ষিণে। দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণ মিত্রবাহিনীর আক্রমণের গতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। জয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ এদিনও ফের বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমরা যদি বাঁচতে চাও, ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করো। নতুবা তোমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে।’ এর আগের দুই দিনও রেডিও ও লিফলেটের মাধ্যমে তার এমন আহবান প্রচার করা হয়।
এদিন সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে জেনারেল নিয়াজীর পাঠানো সঙ্কেত বার্তায় বলা হয়, ‘আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে সৈন্য পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও সঙ্কটাপূর্ণ।’ এরইমধ্যে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন রেডিও পাকিস্তান থেকে ভাষণ দেন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে ‘ভারতীয় হামলা’ মোকাবিলা ও ‘দুরভিসন্ধি নস্যাৎ’ করার আহ্বান জানান তিনি। মিত্র বাহিনীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তাদের নগ্ন হামলায় অসংখ্য বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।’
ওদিকে এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’
দুই মুক্তিযোদ্ধা
একই দিনে চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি এক ভাষণে বলেন, ‘ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’ জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানী নেতা মাহমুদ আলী এদিন দেশে ফিরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। সাংবাদিকদের কাছে মাহমুদ আলী সোভিয়েত ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, ‘সোভিয়েতের উচিত বিশ্বশান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো।’ চীন ও আমেরিকার সমর্থন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের নির্ভীক ও ঐতিহাসিক সমর্থনের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’

এছাড়া এদিনে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক ছিল এটি। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসণের ওপর জোড় দেয়া হয়।
newsreel [সংবাদচিত্র]