Powered By Blogger

১১ ডিসেম্বর ২০১৮

বেসামাল প্রেসিডেন্ট, গভর্নর দিশেহারা

পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে গোলা ছুড়ছে মিত্রবাহিনী।
আজ ১১ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ শনিবার। নামটি মুছে যাওয়ার তখন আর মাত্র চার দিন বাকি। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এদিন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ তবে কিসিঞ্জার জানতেন, রণাঙ্গনে আসন্ন বিজয় দৃষ্টে ভারত এই চরমপত্র অগ্রাহ্য করবেই। 
ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তখন বেসামাল আর ঢাকায় দিশেহারা গভর্নর ড. আবদুল মোত্তালেব মালিক ও তার সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলি। তবুও পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো ক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া চলবে না। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে আরো উজ্জ্বল করবে।’ ঢাকা বিমান বন্দর পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়েও আলাপ করেন।
একাত্তরের এই দিনে যুদ্ধক্ষেত্রে যৌথবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই চলতে থাকে। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর হানাদাররা ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 
ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে তখন চারদিক থেকে ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বাংলার বীর মুক্তি সেনারা এগিয়ে আসছে। পথে পথে যেসব জনপদ, গ্রাম, শহর-বন্দর ছিলো সর্বত্রই মুক্তিসেনারা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। 
এদিন জামালপুর, মুন্সীগঞ্জ, লাকসাম, আশুগঞ্জ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুরের হিলিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এ সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। যদিও এসব এলাকা মুক্ত করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ব্যাপক যুদ্ধ করতে হয়। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি। 
মিত্রবাহিনীর সাতশ সৈন্যের অবতরণ।
মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী নিয়ন্ত্রিত টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে এদিনে মিত্রবাহিনীর সাতশ সৈন্য বিমান থেকে অবতরণ করে। এ সময় পাকিস্তানী ব্রিগেডের সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ হয়। অন্যদিকে পাকবাহিনীর আরেক শক্ত ঘাঁটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও উপকূলীয় অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ ব্যাপক তৎপরতা চালায়। একের পর এক বোমা ও রকেট হামলা চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয় পাক হানাদারদের সবকিছু। আকাশ ও স্থলে মুক্তি ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা পাক সৈন্যরা নদী পথে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বত্র সতর্ক প্রহরা যে আগেই বসানো হয় ছিলো তা জানা না হানাদারদের। তাই পাকি সামরিক পোশাক ছেড়ে সাধারণ বেশে নদী পথে অনেক পাক সৈন্য পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।

ঢাকায় বেলা তিনটা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। 
অন্যদিকে যশোরের মুক্ত এলাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করে কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার মধ্যে ছিলো, এক. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। দুই. ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিন. সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে এবং চার. জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী নিষিদ্ধ করা হবে। সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পারল না।’ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শিশু রাষ্ট্রটি গড়ে তোলার দায়িত্ব এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।’ পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পরস্পরের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা অক্ষুণ রেখেই ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক।’
কাদের সিদ্দিকী, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১।
আগের দিন ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা আবেদনের মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। এই দিন সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন ওই শর্তগুলো। এক. পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। দুই. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোন লিখিত চুক্তি করবে না। তিন. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে দিতে হবে। চার. এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দিতে হবে। পাঁচ. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে।

কিন্তু এই দিন ইয়াহিয়া খান এ প্রস্তাব নাকচ করেন। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানকে যুদ্ধে সহায়তা করার দাবি জানান। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র শুধু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়ার দাবি তোলে। 

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার এই দিন বলেন, ‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদেও প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ ব্যাপারে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’ এরপরই হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করেন।

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]