সাদা পতাকা উচিয়ে ধরে পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পন, ১৯৭১। © Marc Riboud |
আজ ৮ ডিসেম্বর। একাত্তরের এ দিনটি ছিল বুধবার। নিশ্চিত পরাজয়ের আশংকায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ড ইয়াহিয়া খান এই দিন যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে ধর্ণা দিতে থাকেন। ছেড়ে দিতে চান ক্ষমতাও। কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। কিন্তু সব বাঁধা পেরিয়ে মিত্রবাহিনী তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। একের পর এক এলাকা শত্রুমুক্ত করতে করতে চারিদিক থেকে ঢাকার দিকে আগাচ্ছে তারা।
পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর জন্য রণাঙ্গনে আরো খারাপ অবস্থার তৈরী হয়। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। যশোরের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও তারা পালিয়ে যায়। কুমিল্লার এক অংশের পতন অনিবার্য হয়ে উঠে। অপর অংশ পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ-ভারত মিলিত বাহিনী বীরদর্পে এগিয়ে যেতে থাকে। পাকবাহিনী পশ্চাদপসরনের পর ঢাকায় নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এরপরও তাদের সামরিক অবস্থা ক্রমশ সঙ্গীন হতে থাকে।
মুক্তিসেনাদের প্রবল প্রতিরোধে প্রাণভয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি ছেড়ে পাক হানাদারবাহিনী পালিয়ে যায় এদিন। মুক্তিসেনারা গর্বিত কন্ঠে দক্ষিণের এই তিনটি অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন। একই দিনে দখলদারিত্বের কবল থেকে মুক্ত হয় চাঁদপুর, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহের গৌরীপুর ফুলবাড়িয়া ও ভালুকা, চট্টগ্রামের মিরসরাই ও খাগড়াছড়ি, মাদারীপুরের কালকিনি, নড়াইলের লোহাগড়া, কুষ্টিয়ার মিরপুর, পলাশবাড়ী, বৃহত্তর হাওরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা। এ সময় সম্মিলিত বাহিনী ঢাকায় হানাদার বাহিনীর অবস্থানগুলোতে বিমান হামলা জোরদার করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পলায়নপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অজস্র নৃশংস গণহত্যা চালায়।
পাকিস্তানের এক উপ-সামরিক আইন প্রশাসক এই তিন বাংলাদেশের সর্বত্র বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করে। পাকিস্তানী বাহিনী তখন বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ। রেডিওতে এ সময়ে তাদের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বিভিন্ন ভাষায় আত্মসমর্পণের বাণী দিতে থাকেন। তাঁর এই বাণী লিফলেট আকারে বিমান থেকেও ছড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলার পাশাপাশি আশ্বাস দেন যে আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। কিন্তু পাকি সামরিক শাসকরা কিছুতেই আত্মসমর্পণের দিকে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাংলাদেশে অবস্থানরত সেনাসদস্যদের নির্দেশ দেয়।
সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধারা। |
বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। হানাদার বাহিনীকে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করতে থাকে মুক্তিবাহিনী। এ সময় জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরাকে তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে দ্রুত হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ ৮ ডিসেম্বরের ঢাকার বর্ণনায় লিখেছেন, ‘সামনে এগিয়ে চলা ভারতীয় বাহিনীর কামানের গোলাবর্ষণের আওয়াজ এখন ঢাকা থেকে শোনা যাচ্ছে, সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ঢাকা। শুধু কয়েকটি টেলিফোন কাজ করছে এবং টেলিগ্রাফ মাঝে মধ্যে সচল হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানের রূপসী বাংলা হোটেল), যেখানে আমি রয়েছি, সেখানকার বাগানে একদল লোক ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে।’
পূর্ব সীমান্ত থেকে জেনারেল জগজিত্ সিং এর প্রায় সবকটা বাহিনী দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল। যৌথবাহিনীর এই অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্র দেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ পাস হওয়া যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবের ব্যাপারে এইদিন ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, ‘পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।’
অন্যদিকে পশ্চিম পাশেও এদিন পাকিস্তানের অগ্রগতি প্রায় থেমে যায়। ছম্ব, রাজস্থান-সিন্ধুসহ বিভিন্ন সীমান্তে বরং ভারতের কাছে তারা দখল হারায়। এ সময় করাচীর উপর নৌ ও বিমান আক্রমণ অব্যাহত রাখে ভারত। তবু ইস্টার্ন কমান্ডের বিপর্যয় দেখে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্তারা নিয়াজির মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য ‘চীনের তৎপরতা শুরু হয়েছে’ বলে তাকে জানায়।
সেই উত্তাল সময়ের সাক্ষী, দ্য ডন। |
এমন শোচনীয় সামরিক পরিস্থিতির মাঝে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে তার শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘদিনের ‘ওয়াদা’ বাস্তবায়ন শুরু করেন। তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে নুরুল আমিন ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।
এই দিন সন্ধ্যায় ভারতের এক সরকারি মুখপাত্র ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয় তবে অন্যান্য সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে; বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই কোনো ভূখণ্ড দখল করার অভিপ্রায় ভারতের নেই।’
এই ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাদে ওয়াশিংটন সময় সকাল এগারটায় যখন ডব্লিউএসএজি -এর বৈঠক শুরু হয়, তখন জেসিএস-এর জেনারেল রায়ান উপমহাদেশের সর্বশেষ সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর জোর এগুবার কোনো লক্ষণ নেই। বরং পাকিস্তানের অগ্রাভিযান ঠেকিয়ে রেখেই তারা সন্তুষ্ট রয়েছে বলে মনে হয়।’
মুুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক দুই পাক সেনা। |
ডব্লিউএসএজি সভাপতি হেনরী কিসিঞ্জার রায়ানের কাছে জানতে চান পূর্ব রণাঙ্গন থেকে ভারতীয় সৈন্যদের পশ্চিম রণাঙ্গনে নিয়ে যেতে কত সময় লাগতে পারে। জেনারেল রায়ান জানান, বেশ কিছু দিন; তবে বিমানবাহিত ব্রিগেড তাড়াতাড়িই নিয়ে যাওয়া সম্ভব, পাঁচ বা ছ’দিনের মধ্যেই। তা সত্ত্বেও এক সম্পূর্ণ নতুন আশঙ্কার অবতারণা করে কিসিঞ্জার বলেন, ‘মূল প্রশ্ন হলো ভারত যদি আজাদ কাশ্মীর দখলের চেষ্টা চালায় এবং পাকিস্তানের বিমান ও সাঁজোয়া বাহিনীর ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হয়! অবশ্য তা হবে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ভারতের ইচ্ছাকৃত উদ্যোগ।’
এরপর কিসিঞ্জার সমবেতদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এক মিত্রকে সম্পূর্ণ পরাভূত হতে দিতে এবং পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত রাখার জন্য ভারত যদি ভয় দেখায় তা কি আমরা মেনে নিতে পারি?’ জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি সিস্কো বলেন, ‘ভারতের এমনতর অভিপ্রায় রয়েছে কি না তা সন্দেহজনক।’
তবুও কিসিঞ্জার পাকিস্তানের জন্য ‘সামরিক সরবরাহ’ নিশ্চিত করার পক্ষে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আক্ষেপ করে বলেন যে, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব কিছুই আমরা প্রস্তুত করেছি। কিন্তু সবই হবে দু’সপ্তাহ বিলম্বে।’
তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতকের দিনলিপিসহ বিবিধ তথ্যভাণ্ডার।
ছবিঃ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন