সৈন্যদের মাঝে জেনারেল নিয়াজি |
আজ ৯ ডিসেম্বর। গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক দিবস। বছর দুয়েক আগে ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ এ দিনটি ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরে জাতিসংঘে প্রথমবারের মত গণহত্যা প্রতিরোধে এ সংক্রান্ত শাস্তি বিষয়ক প্রথাটি গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালের এ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার।
বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যার জন্ম দেওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে এই দিন সরাসরি সহযোগিতার পদক্ষেপ নেয় তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা করার আদেশ দেন। আর মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং আরোরাও জানিয়ে দেয় তারা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত। পাকিস্তানীরা অবশ্য তখন এ বাহিনীর আক্রমনের মুখে দ্রুত পশ্চাদপসরনে ব্যস্ত। দ্রুত শত্রুমুক্ত হতে হচ্ছে একের পর এক এলাকা।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে যে সমস্ত জায়গা শত্রুমুক্ত হয় তার মধ্যে দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাট অন্যতম। দাউদকান্দিতে পাকিস্তানীদের পতনের মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
এর আগে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ের। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। আর মিত্র বাহিনীও দ্রুত ঢাকা পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হয়।
পূর্বাঞ্চলের এ বাহিনীর মতো পশ্চিমে আরেকটি বাহিনী তখন পৌঁছে গেছে মধুমতি নদীর তীরে। অন্য একটি বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে চলছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছে গেছে ময়মনসিংহের কাছাকাছি। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তুমুল যুদ্ধ হয়। সেখানে সেদিন নির্বিচারে গণহত্যাও চালায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। তবে শেষ অবধি টিকতে পারেনি তারা। ঢাকার আশপাশের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান মুক্ত হবার খবর আসে৷
এমন সময়ে ভারত কাশ্মীর দখলের ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এরই প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন অপেক্ষমাণ মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। ইউএস নেভি প্রত্যাসন্ন হামলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার করার জন্য সপ্তম নৌবহরকে পাঠানো হয় করাচীর সন্নিকটে আরব সাগরে নয়, বরং তার প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরের দিকে।
কথিত ভারতীয় প্রচেষ্টা উদ্ঘাটিত হওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ আগেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় সপ্তম নৌবহরের এখতিয়ার বঙ্গোপসাগর অবধি সম্প্রসারিত করা হয়। বৃহত্তর যুদ্ধের ডামাডোলে চাপা পড়ে ঘটনার ও ব্যাখ্যার এই সব অসঙ্গতি। পরে এগুলো অক্ষত রেখেই নিক্সন ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার স্ব স্ব স্মৃতিকথায় দাবি করেন- ‘পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে সতর্ক করে দেবার উদ্দেশ্যে’ তখন সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়। তবে এটা স্পষ্টত ছিলো যে এই শক্তিশালী নৌবহর পাঠানোর মূল লক্ষ্য ছিলো বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ-অবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানী স্থল বাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং সেখানে আরো মার্কিন নৌসেনা অবতরণের ক্ষেত্র তৈরী করা।
একাত্তরের মা, কোলকাতা। |
বিকেলে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা এখন বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’ সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, পাকিস্তানীরা যদি মাটি কাঁমড়ে ঢাকার লড়াই চালাতে চায় তাহলে আপনি কী করবেন? জেনারেল অরোরা জবাব দিলেন, ‘ওরা কী করবে জানি না। তবে আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত।’ সাংবাদিকরা ফের প্রশ্ন করলেন, ‘ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কী?’ অরোরা জানালেন, নদী। তারপর আবার বললেন, ‘নদী যদিও বড় বাধা, কিন্তু সে বাধা অতিক্রমের সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর আমাদের পি.টি.-৬৭ ট্যাঙ্কগুলো নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে।’
অরোরা জানান, মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী সেদিনই টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী এক এলাকায় সাতশ ছত্রীসেনা এবং ৮০ টন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এর আগে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার আরো বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুই দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে, আরেক অংশ রয়েছে দক্ষিণে। দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণ মিত্রবাহিনীর আক্রমণের গতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। জয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ এদিনও ফের বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমরা যদি বাঁচতে চাও, ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করো। নতুবা তোমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে।’ এর আগের দুই দিনও রেডিও ও লিফলেটের মাধ্যমে তার এমন আহবান প্রচার করা হয়।
এদিন সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে জেনারেল নিয়াজীর পাঠানো সঙ্কেত বার্তায় বলা হয়, ‘আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে সৈন্য পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও সঙ্কটাপূর্ণ।’ এরইমধ্যে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন রেডিও পাকিস্তান থেকে ভাষণ দেন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে ‘ভারতীয় হামলা’ মোকাবিলা ও ‘দুরভিসন্ধি নস্যাৎ’ করার আহ্বান জানান তিনি। মিত্র বাহিনীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তাদের নগ্ন হামলায় অসংখ্য বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।’
ওদিকে এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’
দুই মুক্তিযোদ্ধা |
একই দিনে চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি এক ভাষণে বলেন, ‘ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’ জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানী নেতা মাহমুদ আলী এদিন দেশে ফিরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। সাংবাদিকদের কাছে মাহমুদ আলী সোভিয়েত ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, ‘সোভিয়েতের উচিত বিশ্বশান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো।’ চীন ও আমেরিকার সমর্থন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের নির্ভীক ও ঐতিহাসিক সমর্থনের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’
এছাড়া এদিনে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক ছিল এটি। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসণের ওপর জোড় দেয়া হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন