Powered By Blogger

০২ জানুয়ারী ২০১৮

স্মরণে সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার
সিরাজ সিকদার নিহত হয়েছেন। আজ থেকে ঠিক ৪৩ বছর আগের এই দিনে, অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি সরকারি এক প্রেসনোটে এভাবেই এ বামপন্থী বিপ্লবী নেতার মৃত্যুর খবর দিয়েছিলো রাষ্ট্র। এ ঘটনার ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জুন এই বিষয়ে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়, যা ২৫ বছর ধরে ঝুলে আছে। তবে এত দিনেও মানুষের মন থেকে বিস্মৃত হননি সিরাজ। আজও বিভিন্ন আলোচনায় সগৌবরবে তার নাম উচ্চারিত হয়। বিশেষত রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবেই তার কথা চলে আসে। 

সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হন ১৯৭৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তিনি ধরা পড়েছিলেন পুলিশের হাতে। পরে রক্ষী বাহিনীর হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে ৯২ সালে যে মামলা দায়ের করেন সেখানে মোট ৭ জনকে আসামী করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন বর্তমান সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিম। অন্যান্য আসামিরা হলেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, সাবেক পুলিশ প্রধান আইজিপি ই এ চৌধুরী এবং সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান। 

বিএনপির শাসনামলে দায়ের করা ওই মামলার আর্জিতে বলা হয়, ‘আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) সহচর ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং আসামিরা আসামি তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন। তারা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার ও হত্যার ঘটনা বর্ণনায় আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উল্লেখিত আসামিরা তাঁদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ই এ চৌধুরীর একজন নিকটাত্মীয়কেও চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করে ওই দিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দিদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় মামলার এক নম্বর আসামি এসপি মাহবুব তার রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই ওই সময় সিরাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এরপর শেখ মুজিব, মনসুর আলীসহ দুই জন অভিযুক্ত সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এসপি মাহবুবকে নির্দেশ দেন। তিনি ও অন্য আসামীরা বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। এরপর তার ওপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে এসপি মাহবুবের সাথে থাকা বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায়। সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ সালের ১১ জুলাই ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ নামের একটি বই প্রকাশিত হয়। এটি লিখেছেন আনোয়ার উল আলম। তিনি ছিলেন রক্ষী বাহিনীর একজন উপ পরিচালক। এই বইতে বলা হয়- ‘আসলে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কিছুটা নারীঘটিত কারণে সিরাজ সিকদার ধরা পড়েন।’ এর আগে একাত্তরে পর সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “পূর্ব বাংলার বীর জনগণ, আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান”। এ সময় তিনি একটি রাজনৈতিক দলিল হাজির করেন। যেখানে আওয়ামীলীগকে জাতীয় বিশ্বাস ঘাতক ও বেঈমান হিসেবে উল্লেখ করে তাদেরকে ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৬ ডিসেম্বরকে কালো দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। সিরাজের আহবানে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের এই দিনে দেশব্যাপী হরতাল পালন করার কালে মাওলানা ভাসানীও বিবৃতি দিয়ে তা সমর্থন করেছিলেন। সবমিলিয়ে শেখ মুজিবকে তখন বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিলো সিরাজ সিকদার ও তার সর্বহারা পার্টি। তাকে হত্যার তার বোন ভাস্কর শামীম সিকদার বেশ কয়েকবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। 

সিরাজ সিকদারের পিতার নাম আবদুর রাজ্জাক সিকদার। তিনি ১৯৫৯ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (বর্তমান এসএসসি) পাশ করেন। এরপর ১৯৬১ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রকৌশলবিদ্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন । ছাত্র অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত তিনি ১৯৬৫ সালে মিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির কংগ্রেসে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি সরকারের নির্মাণ (সিঅ্যান্ডবি) বিভাগের কনিষ্ঠ প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন। মাত্র তিন মাসের মাথায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে টেকনাফের ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি বেসরকারী কোম্পানীতে যোগদান করেন। 

সিরাজ সিকদার ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে উপস্থিত করেন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের এক খসড়া থিসিস। এই থিসিসে তিনি পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বলে অভিহিত করেন। একই বছরের শেষের দিকে তিনি ঢাকা শহরে মাও সেতুং গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। আইয়ুব সরকার এটি পরবর্তীকালে বন্ধ করে দেয়। মওদুদীর জামায়াতে ইসলামীও প্রথম থেকে তাদের বিরোধীতা করে আসছিলো। এরপর ১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা ওড়ায়। পরে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এর চার নম্বর দফাটি ছিল, ‘পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ বা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করেন।’ পরে ৩০ এপ্রিল তিনি বরিশালের সরূপকাঠীর পেয়ারাবাগানে গড়ে তোলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী। এরপর ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি। ওই কংগ্রেসে সিরাজ সিকদারকে সভাপতি করে একটি অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]