Powered By Blogger
live life লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
live life লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১৬ জুলাই ২০১৪

সেনের প্রত্যাবর্তন - the return of sen

***
দেশ ভাগের আগে বেউখির ছিলো সমৃদ্ধশালী এক গ্রাম। ওই সময় ‘সেনগুপ্ত’ আর ‘দাশগুপ্ত’ পদবীর হিন্দু ধর্মালম্বীরা ছিলো এর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা। বরিশালের ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশার এই গ্রামে তখন বারো মাসের তেরো পূজোয় ঢাক বাজত মোট চৌদ্দ বাড়িতে। সারা বছরই উৎসবের আমেজে মুখরিত থাকত বেউখির। নানা আয়োজনে সরগরম থাকত চারিদিক। চিত্রটা বদলাতে শুরু করে ১৯৪৭’র পর। ভারতবর্ষ ভাগের আগে বা পরে পুরো কীর্তিপাশায় কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হলেও দূর-দুরান্ত থেকে ভেসে আসা নানা খবর এলাকার হিন্দুদের আতঙ্কিত করে তুলেছিলো। বহিরাগত দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে পাহাড়ার ব্যবস্থা করেও সে আতঙ্ক কমাতে পারেনি স্থানীয় মুসলমানরা। বিশেষত ১৯৫০’র দাঙ্গার পর ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে শুরু করে কীর্তিপাশার প্রতিটি গ্রামের হিন্দু বাড়ি-ঘর। বেউখিরের এক একটি পরিবারও প্রাণ আর সম্ভ্রম রক্ষায় পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে শুরু করে। এমনই এক পরিবারের কর্তা ছিলেন উষাকান্ত সেনগুপ্ত। গেরস্থ বাড়ির সন্তান হলেও তিনি পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। আমৃত্যু এ দেশান্তর মেনে নিতে পারেননি। বার বার তিনি ফিরতে চেয়েছেন বেউখিরে। সহধর্মীনি প্রেমলতা সেনগুপ্তকে নিয়ে ফিরে নিজের ভিটেয় মরতে চেয়েছেন। কিন্তু তা আর হয়নি। এই অতৃপ্তিই কি তাকে ফের নিয়ে আসবে বেউখিরে? হয়ত অন্য কোনো জন্মে, অন্য কোনো পরিচয়ে – ফিরবেন কি সেই সেন? এরই সূত্র ধরে ভাবি, কোনো জন্মে লক্ষন সেনও কি নদীয়ায় ফিরেছিলেন?

*** 
ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চে অমিত সেন
অমিত’দা, মানে সময়ের ব্যস্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিত সেনের শেকড়ও যে বরিশালে তা জেনে যতটা না অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশী অবাক হয়েছিলাম তিনি কখনো এখানে আসেননি শুনে। কোলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও এ মানুষটি শুধু কাজের প্রয়োজনেই গিয়েছেন ১৫টি দেশে। সবমিলিয়ে ঘুরেছেন মোট ৩০টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশেও তার আসা-যাওয়া সেই ১৯৯০’র পর থেকেই। কিন্তু এই দুই যুগে তিনি বরিশাল যাননি কখনো। খোঁজেননি নিজের শেকড়। প্রথমে এ কথা বিশ্বাসই হয়নি। কবি বন্ধুদের কল্যানে এটা অবশ্য আগেই জানতাম যে ‘ওপারে’ এমন অনেক ‘বরিশাইল্যা’ আছেন যারা কখনো বরিশালেই আসেননি। তবে এর শহর-বন্দর-গ্রাম, হাট-বাজার, খাল-নদী, পুকুর-দীঘি, ক্ষেত-মাঠ, বন-জঙ্গল বা আলো-হাওয়া জড়ানো নানা লোক গাঁথা আর পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়ার গল্প শুনতে শুনতেই তারা বড় হয়েছেন। কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, কচা, বিষখালী বা পায়রার বাঁকে বাঁকে মিশে থাকা গান আর পুঁথির সুরও তাদের খুব চেনা। জেনেছেন দুরন্ত ঢেউয়ের আবাদী উচ্ছাস আর মাতাল প্রলয়ের কথা। চিনেছেন মায়ার শুভ্রতার সাখে মিশে থাকা অজ্ঞতা নিমজ্জিত লোলুপ হিংস্র বর্বরতাও। বুঝে নিয়েছেন ভূ-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় শেকড়হারা তারা এখন ভিনদেশী নাগরিক। ভিসা নিয়েই এদেশ, মানে বাংলাদেশে ঢুকতে হয় তাদের। তাই হয়ত তারা ভিটেয় ফেরার আশা করেন না এখন আর। কিন্তু শেকড়ের টান কি কখনো মুছে যায়? এখানে মৃদুল দাশগুপ্তের নামোল্লেখ করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে ১৯৫৫ সালে জন্মানো এ কবি যে নিজের জ্ঞাতসারেই এক কট্টর, মানে মনে-প্রাণে ‘বরিশাইল্যা’ - তা জেনেছিলাম আরেক ঘটনাচক্রে। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘চাইনিজরা যেমন যে দেশেই জন্মাক তারা চাইনিজই হয়। তেমনি বরিশাইল্যারাও যেখানেই থাকুক তারা বরিশাইল্যাই রয়।’ অন্তর্জালীয় আড্ডাঘরের দীর্ঘ আলাপের পর সাক্ষাতে অমিত’দার বিস্তারিত শুনে বুঝেছিলাম মৃদুল’দা ভুল বলেননি। সে প্রসঙ্গে না গিয়ে তখন শুধু বলেছিলাম, আমার প্রথম সিনেমার প্রেক্ষাপট পেয়ে গেছি বোধহয়। প্রাথমিক ভাবনাটা শুনে অমিত’দা-ও নারাজ হলেন না। সেই থেকে আমাদের যৌথ পরিকল্পনা শুরু। মিশন – অমিত’দার শেকড় অনুসন্ধান, বা আমার সিনেমার গল্প। এরই ধারাবাহিকতায় গত জুনের শেষ হপ্তায় আমরা দারুণ উত্তেজিত। অবশেষে শেকড়ে ফিরছেন অমিত’দা। তার যাত্রাটা শুরু হয় কোলকাতার টালিগঞ্জের প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের সাউথ সিটি কমপ্লেক্সের বাসা থেকে। সেখান থেকে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে সোজা ঢাকায়। এখানেই দাদার সাথে যোগ দেই আমরা। অর্থাৎ আমি, রাসেল ভাই (চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ) আর গানের দল ত্রিমিঙ্গিলের নাজমুল হুদা। পরিকল্পনানুযায়ী লঞ্চে চেপে আমরা সোজা বরিশাল চলে যাই। এর আগে অবশ্য ঢাকায়ও কয়েকজনের সাথে দেখা করতে হয়েছিলো অমিত’দাকে, তা খুবই অল্প সময়ের জন্য।

লঞ্চের টি-স্টলে অমিত’দার সাথে আমার এ ছবিটি তুলেছিলেন রাসেল ভাই
***
৫০’র দাঙ্গা বেশ ভালো প্রভাব ফেলেছিলো বরিশাল অঞ্চলে। লেখক ও গবেষক কুলদা রায়ের এক লেখায় পড়েছিলাম, ‘১৯৫০ সালের কোলকাতায় একটা ছোটোখাটো দাঙ্গা হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খবর রটেছিল কোলকাতায় একে ফজলুল হকের এক আত্মীয়কে হিন্দুরা মেরে ফেলেছে। ফলে তীব্রভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় আক্রান্ত হয় হিন্দুরা। এটা ছিল পাকিস্তান সরকারের একটা পরিকল্পনা। সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। সে সময় ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় মেরে ফেলা হয় নয় দিনে দশ হাজার হিন্দুকে। শুরু হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বরিশালের মাধবপাশার জমিদার বাড়ির ২০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। এ এলাকার তীব্র আক্রান্ত গ্রাম হল লাকুটিয়া এবং কাশিপুর।’ কুলদা আরো লিখেছেন, ‘সে সময়ে মুলাদীর নদী লাল হয়ে গিয়েছিল মানুষের রক্তে। বরিশালে মেরে ফেলা হয়েছিল ২৫০০ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়িঘর। লুটপাট করা হয়েছিল সহায়-সম্পদ। ধর্ষণের শিকার হয়েছিল অসংখ্য নারী। দখল করা হয়েছিল অনেকের জমিজমা।’ একে ফজলুল হকের জন্মস্থান বা নানা বাড়ি ছিলো ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামের দুরত্ব বেউখির থেকে খুব বেশী নয়। তাই ৫০’র ওই বিভৎসতায় উষাকান্ত বা অন্যান্য পরিবারের কর্তারা কেন আতঙ্কিত হয়েছিলেন, তা বোধকরি সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ভিটে ছাড়া হতে কেইবা চায়। অন্য অনেকের মতো উষাকান্তও চাননি। পরিস্থিতির চাপে ভিটে ছাড়ার পরও, ছাড়তে পারেননি মায়া। যে কারণে পুষেছিলেন ফেরার আশাও।

বরিশালের হাওয়ায় উৎফুল্ল দাদা
***
২৮ জুন ২০১৪। সকালটা ছিলো মন ভালো করা রোদে মাখা। সেই রোদ গায়ে মেখেই লঞ্চ থেকে নামি আমরা। নীলাকাশ তলের কীর্তনখোলার সামনে দাঁড়িয়ে অমিত’দা যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন। তার দৃষ্টি অনুসরন করে দেখি তা ওই দূরের বাঁকেরও ওপাড়ে মিলিয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে চলে আসি, তখনও সজাগ হয়নি বরিশাল নগরী। মসজিদে ফজরের নামাজ আদায়কারী বা প্রাতঃভ্রমণকারী ছাড়া রাস্তায় যাদের দেখা পাচ্ছিলাম, তাদের প্রত্যেকের সাথে লাগেজ। অর্থাৎ হয় লঞ্চ, নয় বাস যোগে মাত্র শহরে পৌঁছেছে। নগরের এ শোভা গিলতে গিলতেই সকাল সন্ধ্যা রেস্তোরায় গিয়ে আমরা নাস্তা করে ফেলি। এরপর গল্পচ্ছলেই নিয়ে নেই ক্ষণিকের বিশ্রাম। ভর দুপুরে আমরা যখন বরিশাল থেকে আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে রওনা হলাম তখন আকাশে মেঘের আনাগোনাও বাড়ছিলো ধীরে ধীরে। বাড়ছিলো বাতাসের বেগ, আর্দ্রতা। বাহন - ভাড়া করা মাইক্রোবাস। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছেন অমিত’দা। পেছনে আমি, রাসেল ভাই, ড্যানি (চিত্রগ্রাহক ড্যানিয়েল ড্যানি) ও নাজমুল। বরিশালে আমরা কারো বাসায় না উঠে ঘাঁটি গেরেছিলাম ছিলাম গীর্জা মহল্লা, মানে খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দিন সড়কের হোটেল ইম্পেরিয়ালে। সেখান থেকে সদর রোড, বাংলাবাজার, সাগরদী ও রূপাতলী হয়ে আমরা কালিজিরা ব্রীজ পেরিয়ে শহর ছাড়াতেই গান ধরলেন রাসেল ভাই। কফিল আহমেদের গান, ‘গঙ্গাবুড়ি’। গলা মেলালাম সবাই। গানের তালে তালে সবুজের বুক চিড়ে চলে যাওয়া কালো পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।

***
সেই উষাকান্তের উত্তরসূরী
উষাকান্ত সেনগুপ্ত তার পরিবার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের খলিশাকোটা পল্লী নামের যে গ্রামে গিয়ে ডেরা বেঁধেছিলেন, সেটিও ছিলো বেউখিরেরই মতই শান্ত-শ্যামল-সুনিবির। উষাকান্তের মৃত্যুর আগেই সেখানে পুরো পরিবারের হাল ধরেছিলেন তার মেঝো ছেলে রঞ্জিত কুমার সেনগুপ্ত। ভারতীয় সেনাবাহীনিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তার বড় ভাই অজিত কুমার সেনগুপ্তের একটা গতি অবশ্য আগেই হয়েছিলো। পুরো পরিবার কোলকাতায় আসারও আগে তিনি শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ে করে নিজের তিনি সংসার নিয়ে আলাদাই ছিলেন। তাই বাকি তিন ভাই; মানে অসিত, অধির ও তপন সেনগুপ্ত বড় হয়েছেন রঞ্জিতেরই হাড়ভাঙা খাঁটুনিতে। ১৯৬২ সালে চৈতালী দাশগুপ্তের সাথে বিয়ে হয় তার। চৈতালীর বাপের বাড়ি ফরিদপুর হলেও - তিনিও বড় হয়েছেন বরিশাল অঞ্চলে। ক’বছর পরই রঞ্জিত-চৈতালীর ঘর আলো করে আসে তাদের একমাত্র সন্তান, অমিত সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে অবশ্য কবি জীবনানন্দ দাশগুপ্তের মত সেই অমিতও তার গুপ্তটাকে গায়েব করে দিয়েছেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। সেই অমিত সেনগুপ্ত বা অমিত সেনই মানে আমাদের অমিত’দা। উষাকান্তের উত্তরসূরী। যিনি এবার এসেছেন তার পিতামহের ফেলে যাওয়া ভিটে বা নিজের শেকড়ের সন্ধানে।

***
দ্রুত ঝালকাঠির দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। গন্তব্য সেই বিউখির। এই ভূখন্ডে ঠিক কবে থেকে জনবসতি শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও নাম দেখে বোঝা যায়- এখানে কৈবর্ত জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা আবাদ করেছিলো। এক সময় কৈবর্ত জেলেদেরই ঝালো বলা হতো এবং তাদের পাড়াকে বলা হতো ঝালোপাড়া। অনেকের ধারণা এ ঝালোপাড়া থেকেই ঝালকাঠি নামের উৎপত্তি। কবি বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যেও জেলে সম্প্রদায়কে ঝালো নামে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বরুপ সেনের একখানি তাম্রলিপিতেও ঝালকাঠির নাম রয়েছে। এছাড়া একাধিক ইতিহাসগ্রন্থ মতে, চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্যতম একটি বন্দর ছিল সুতালরী। সম্রাট শাহজাহানের ফৌজদার ছবি খাঁ বাকেরগঞ্জ থেকে সুতালরী হয়ে কোটালীপাড়া পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে সুতালরী বন্দরের পার্শ্ববর্তী জঙ্গল পরিস্কার করে বাসভূমি গড়ে তোলে জেলেরা। ওই অংশের নাম হয় ঝালকাঠি। আরেক মতের দাবি, প্রতাপশালী জমিদার রামভদ্রের শাসনামলে বাজার বসে পোনাবালিয়ায়। এক সময় সে বাজার স্থানান্তরিত হয় মহারাজগঞ্জে যা আজকে ঝালকাঠি নামে পরিচিতি।

নস্টালজিক অমিত সেন
***
রঞ্জিত আর চৈতালী ইহলোক ত্যাগ করেছেন, তা’ও ১০-১৫ বছর হয়ে গেছে। জীবদ্দশায় তাদেরও কখনো ফেরা হয়নি নিজেদের দেশ, মানে বাংলাদেশে। তবে তাদের মুখে এ দেশ, বরিশাল বা ফেলে আসার গ্রামের অনেক গল্প শুনেছেন অমিত’দা। শুনেছেন পিতামহ আর অন্যান্য স্বজনদের বলা গল্পও। যে কারণে ঝালকাঠীর দিকে যত আগাচ্ছিলাম, ততই নস্টালজিক হচ্ছিলেন তিনি। শৈশবে শোনা গ্রামের গল্পগুলো বলছিলেন আমাদের। ক্রমে নরম হচ্ছিলো তার স্বর। কিছুক্ষণ পর পরই অবশ্য গল্প থামিয়ে সেলফোন দিয়ে ছবি তুলছেন, আর তা আপলোড করছেন ফেসবুকে। তাতে আবার যাদের মন্তব্য পাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশেরই শেকড়ই এপারে। কারো কারো হয়ত বরিশালে বা ঝালকাঠীতেই। অমিত’দার পোস্ট করা ছবিগুলো তাদেরও যে নাড়িয়ে দিচ্ছিলো তা মন্তব্যগুলো পড়েই বোঝা যাচ্ছিলো। আকাশে মেঘের দলও ভারী হচ্ছিলো ধীরে ধীরে। এরই মাঝে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। হালকা, গাঢ় নানা ধরনের সবুজ। এদিকে সুযোগ পেলেই গান ধরছেন রাসেল ভাই, আর তাতে গলা মিলাচ্ছি সবাই। এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলছে নানা রঙ্গও।

***
এটা মোটামুটি সকলেই নিশ্চিত যে, রাজা সত্যাচরণ ঘোষাল পরিকল্পিতভাবে আধুনিক ঝালকাঠি শহর গড়ে তুলেছিলেন। জেলেদের জঙ্গল কেটে আবাস গড়া থেকে ঘোষালের পরিকল্পিত নগরায়নের মাঝে রয়েছে অনেক ইতিহাস, উত্থান-পতন। যার কিছুটা আনন্দের, কিছুটা বেদনার। এ জেলাটি মূলত পুরাতন সেলিমাবাদ পরগনার প্রধান অংশ ছিলো। সুগন্ধা নদীর বুক চিরে জেগে উঠা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চরগুলো নিয়েই এ সেলিমাবাদের জন্ম । ষোড়শ ও সপ্তাদশ শতাব্দীতে প্রথম দিকে ঝালকাঠি ছিলো কর্দমাক্ত এক ঘন বনাঞ্চল। যেখানে বাঘ, উল্লুক, কুমির আর ভয়ংকর সব সাপেরা বাস করত। একইসঙ্গে জলদস্যুদেরও স্বর্গরাজ্য ছিলো এটা। সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ তীরে পোনাবালিয়া এবং উত্তর পাড়ে ছিলো উজিরপুর, শিকারপুর। মাঝের বিস্তীর্ণ অঞ্চলই ছিলো নদী। জানা গেছে, রায়েরকাঠীর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহনের ছেলে শ্রীনাথ রায় সম্রাটের নিকট থেকে ‘পাট্টা’ লাভ করেছিলেন পর্তুগীজ নাগরিক উড ও ইউয়াট। তারা মূলত একটি লবন স্টেটের এজেন্ট ছিলেন। । মদনমোহন পূর্বে নলছিটি থানার (বর্তমানে ঝালকাঠী থানার) নথুল্লাবাদ গ্রামে জমিদারির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। পরে মদনমোহন রায়ের পৌত্র রাজা রুদ্রনারায়ন স্বপ্নযোগে বলেশ্বর নদীর পূর্ব তীরে জঙ্গলে জগদম্বর দশভূজা পাষাণময়ী মূর্তি পেয়ে তা রায়েরকাঠী গ্রামে স্থাপন করেন এবং রায়েরকাঠীতে রাজধানী স্থাপন করেন। রুদ্র নারায়নের প্রপৌত্র জয়নারায়নের সময় আগাবাকের খাঁ নামক এক পাঠান যুবক তার জমিদারির অর্ধেক জোরপূর্বক দখল করলে এক প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। ঝালকাঠীর পূর্বদিকে সুতালরী এবং পূর্ব দক্ষিনে বারৈকরন গ্রামের ওই যুদ্ধে বাকের খাঁ ২২টি কামান ফেলে পলায়ন করেন বলেও তথ্য পাওয়া যায়। কালক্রমে রায়েরকাঠী জমিদারির অর্ধেকের মালিক হন এক ঘোষাল। ঝালকাঠীতে তিনি কাছারি স্থাপন করেন। ওই সময় তিনি রাজা বাহাদুর খেতাব প্রাপ্ত হন। তার প্রজারা তাঁকে মহারাজ সম্বোধন করত। এই মহারাজ সম্বোধন থেকেই কাছারিবাড়ী সংলগ্ন এলাকার নাম হয় মহারাজগঞ্জ। ঝালকাঠীর পূর্ব নাম মহারাজগঞ্জ । তারই পুত্র ছিলেন রাজা সত্যচরন ঘোষাল। তার ঝালকাঠী বন্দর তৎকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠতম বানিজ্য বন্দর হিসেবে গড়ে উঠেছিলো।

***
কীর্তিপাশার রাস্তায় ঢোকার আগে আমরা আরেকটু এগিয়ে গেলাম গাবখান, সুগন্ধা ও ধানসিঁড়ি নদীর সঙ্গম স্থল দেখতে। সেখান থেকে ফিরে বাউখির যাওয়ার পথটা চিনে নিতে আমরা যখন কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, খুব চেনা মনে হলো জায়গাটিকে। গাড়ি থেকে নেমে কেন জানি মনে হলো, এর আগেও আমি এসেছি এখানে। এ বাড়িটির কথা প্রথম জেনেছিলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভিশপ্ত’ গল্পে। জমিদার কীর্তি নারায়ণ রায় আর তার মিথ নিয়ে লেখা সে গল্প। ঝালকাঠি শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে এ বাড়ির অবস্থান। সরূপকাঠির দিক দিয়ে, মানে সন্ধ্যা নদী থেকে ভীমরুলি খাল ধরেও চলে আসা যায় এখানে। রোহিনী রায় চৌধুরী ও তাঁর নাতি তপন রায় চৌধুরী এখানকার জমিদার বংশের দুটি পরিচিত নাম। বর্তমানে জমিদার বাড়ির সম্পত্তিতে তৈরি হয়েছে প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মূল জমিদার বাড়ি এবং দুর্গামন্দির এখন পরিত্যক্ত। জমিদার বাড়ির নাট্যশালার চিহ্ন রয়েছে এখনো। নাট্যমঞ্চের গ্রিনরুম এবং হলরুমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কমলিকন্দর নবীন চন্দ্র বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পারিবারিক শিবমন্দির এবং একটি শিবমূর্তিও এখনো আছে । পুরাতন জমিদার বাড়িতে রয়েছে অন্ধকূপসহ আরো নানা নিদর্শন। ইট-সুরকির ভবন তৈরি হয়েছে অসামান্য স্থাপত্যশৈলীতে। তবে এসবের দিকে চোখ নেই আমাদের। আমরা খুঁজছি সেই কাঙ্খিত গ্রাম, যেখানে ছিলো উষাকান্তের ফেলে আসা ভিটে। আমাদের বেউখিরের পথ দেখিয়ে দিতে গিয়ে এক বয়োবৃদ্ধ দাদা, আরেক পৌঢ়া দিদি নিজেদের মধ্যে প্রায় তর্ক বাঁধিয়ে দিলেন। তর্কের বিষয় হচ্ছে – আমাদের গাড়ি নিয়ে যাওয়া, না যাওয়া। দিদি বলছেন, ‘রাস্তা যে পিছলার পিছলা (পিচ্ছিল); গাড়ি লইয়া যাওন ঠিক হইবে না।’ আর দাদা বলছেন, ‘আরে নাহ। কিচ্ছু হইবে না। যায় না, কত্ত গাড়ি যায়।’ তাদের তর্ক থামিয়ে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা টের পেলাম, দিদির কথাই ঠিক। রাস্তাটা যতক্ষণ পিচের ছিলো, ততক্ষণ ভালোই ছিলো। কিন্তু হেরিংবনের রাস্তা শুরু হতেই শুরু হয় বিপত্তি। রাস্তাটা শুধু পিচ্ছিলই নয়, বেশ সরুও। ড্রাইভার তাই ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। উপায়ন্ত না পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে আমরা হাঁটাই শুরু করলাম।

***
উষাকান্ত সেনগুপ্তের সাথে লক্ষন সেনের প্রথম সাদৃশ্যটি পেয়েছিলাম তাদের ভয়ে। দু’জনেরই ভয়ের কারণ ছিলো এমন একটি ধর্ম, যার শাব্দিক অর্থ শান্তি। যদিও শান্তি, তথা ইসলামের নামে এমন ভীতি ছড়ানোর নির্দেশ মুসলিম ধর্মগ্রন্থ কোরআনের কোথাও দেয়া আছে বলে আমার অন্তত চোখে পড়েনি। গদি বা ভূমি দখলের চেষ্টায় ওই ভীতি সৃষ্টিকারীরা আদতে কোন ধরনের মুসলমান, সে আলোচনাও এখানে করতে চাইছি না। তার চেয়ে বরং মহারাজা লক্ষন সেনের কথা বলি। বলা হয়, তিনি ছিলেন ছিলেন বাংলার প্রকৃত শেষ স্বাধীন নরপতি। বর্তমান মালদহ জেলার গৌড় ছিল তার প্রধান রাজধানী। এর অপর নাম ছিল লক্ষণাবতী। পিতার ন্যায় তিনি একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। তাই গঙ্গা নদীর সান্নিধ্য কামনা করে তিনি নদীয়ায় দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে (১২০১ খ্রি.) মুহম্মদ ঘুরীর সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর বিহার বিজয় সমাপ্ত করে অতর্কিতে লক্ষণ সেনের রাজনিবাস নদীয়া বা নবদ্বীপ নগরী দ্বারদেশে এসে উপস্থিত হন। এই অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব মনে করে রাজা লক্ষণ সেন পলায়ন করেন এবং এই পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নেন। উষাকান্ত সেনগুপ্তও আলবৎ রাজা ছিলেন। সব বরিশাইল্যাই যে আপন মনে রাজা তা কে’না জানে।

বেউখির আর মাত্র তিন মিনিটের পথ !!
***
বাংলার দশটি গ্রামের মতই ছায়া ঘেরা সুনিবির গ্রাম বেউখির এখন এতটাই শান্ত যে কল কল করে বয়ে চলা জলস্রোত, বা তা কেটে ছুটে চলা নৌকার শব্দও সুতীব্র তিক্ষ্ণতায় কানে লাগে। ঘোর লাগা এক গভীর নিরবতা ভাঙে আমাদের হাঁটার শব্দ, কথোপকথন। অবাক প্রশান্ত মন নিয়ে এগিয়ে চলি আমরা। সুনশান পথের দু’ধারে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। ছবির মতো সুন্দর সব খাল। পথে শুধু এক কিশোরের দেখা পেলাম। সে বললো, মাত্র তিন মিনিট হাঁটলেই বেউখির। আমরা যখন বেউখির প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে দৃষ্টি সীমায় পেলাম, ঠিক তখনই ঝুম করে বৃষ্টি নামলো আকাশ ভেঙে। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম পুরানো জীর্ণ স্কুল ভবনের খোলা বারান্দায়। দু’জন শিক্ষিকার দেখা পেলাম সেখানে। তাদের কাছ থেকে সোনা সেন আর পুলক দাশগুপ্তের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিলাম আমরা। বারান্দায় দাঁড়িয়েই অমিত’দা ফোন করেছিলেন তার ছোটকাকা, মানে তপন সেনগুপ্তকে। কাকাই জানলেন, পুলক দাশের বংশধররা এখন যে বাড়িতে থাকে, সেটিই ছিলো তাদের আদি বাড়ি। এরপরই বৃষ্টির কাছে হার মানলো আমাদের অপেক্ষা। শেকড়ের এত কাছে এসে অমিত’দারও যে আর তর সইছিলো না। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা রওনা হই সেন বাড়ির পথে। স্কুল ছাড়িয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে কিছু দূর এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে এক শতবর্ষী তেঁতুল গাছ। তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটি চলে গেছে সেন বাড়ির দিকে। শিক্ষিকা দ্বয় এই নির্দেশনা দিয়েই ক্ষাণ্ত হলেন না। তাদের একজন পথ চিনিয়ে দিতে সাথেও এলেন। অবশ্য তার বাড়ি ফেরার পথটিও ছিলো একই পথে।

***
কোনো কোনো ঐতিহাসিক লক্ষন সেনকে কাপুরুষ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের এ বর্ণনার কোনো সত্যতা নেই। লক্ষন সেন জীবনে বহু শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তার পুত্রদের লিপি থেকে জানা যায়, তিনি পুরী, বারানসি ও প্রয়াগে বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। 'তাবাকাত-ই-নাসিরী নামক গ্রন্থের লেখক মিনহাজ উদ্দীন তাকে ‘রায় (রাজা) লখমানিয়া' ও 'হিন্দুস্তানের খলিফা' বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি কাপুরুষ হলে তার সম্বন্ধে এমন উক্তি কখনো সম্ভব ছিলো না। একাধিক ইতিহাস গ্রন্থে রয়েছে, বখতিয়ার খলজীর বিহার অধিকারের কথা শুনে রাজ্যের বহুলোক যখন সন্ত্রস্ত এবং নদীয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত তখনো লক্ষন সেন রাজধানী ত্যাগ করেননি। পরে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে তিনি পূর্ববঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করা সমীচীন মনে করেছিলেন। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে লক্ষন সেনের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন আরও প্রায় ২৫ বছর ঢাকার অন্তর্গত বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন।

***
পরিত্যাক্ত সিঁড়ি
অতীতের ছায়া
ভিটের মাটিতে
শেকড়ের মায়া
অতঃপর আমরা যখন উষা সেনের সেই বাড়ির উঠোনে গিয়ে পৌঁছাই, খুব কাছেই কোথায় যেন একটা অচেনা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে যায়। দোচালা কাঠের ঘরের, মাটির মেঝেতে শুয়ে থাকা কুকুরটিও অপরিচিত মানুষের ঘ্রাণ পেয়ে নড়েচরে বসে। ঘেউ করে উঠেই আবার থেমে যায়। একটি মোরগও ডেকে ওঠে। ওরা সবাই কাকে যেন আমাদের আগমনী বার্তা পাঠায়। চার/পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে দৌড়ে ঘরের দরজায় এসে আমাদের দেখেই আবার ভিতরে চলে যায়। এমন সময় আমরা এক জানালায় দেখি স্বর্গীয় পুলক দাশগুপ্তের বিধবা স্ত্রী বন্দনা দেবীর মুখ। তিনি জানতে চান, আমরা কাকে খোঁজ করছি। ঠিক এ সময় সেই বাচ্চাটিকে নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ায় তার ছেলে মিঠু দাসগুপ্ত। তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় জানান অমিত’দা। সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন মা-ছেলে। আমাদের সবাইকে নিয়ে বারান্দায় বসান। ঘর থেকে একটু দূরের একটি উঁচু মাটির ঢিবি দেখিয়ে মিঠু অমিত’দাকে জানান, ওখানেই ছিলো তাদের পুরানো ভিটে। দাদার চোখে তখন অদ্ভুত এক ঘোর। সে ওই জায়গাটায় ছুটে গিয়ে ভিটের মাটি তুলে নিলেন খানিকটা। এরপর এসে বসেন উঠোনে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত এক পুরানো সিঁড়ির উপর। ফেরার পথে নিতাই নামের এক লোক অবশ্য আমাদের জানিয়ে দেন, ওই সিঁড়িটিও ছিলো সেন বাড়ির। ভিটের শেষ চিহ্ন হিসাবে ওটাই শুধু রয়ে গেছে। প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেন বাড়ির ভিটে ভাঙা হয়, তখন সিঁড়িটি গড়িয়ে নিয়ে ওখানে রাখা হয়েছিলো। ভিটে ভাঙা সেই শ্রমিকদের দলে ছিলেন বলেই তিনি এটা জানাতে পেরেছিলেন। অবশ্য কিছু না জেনেও ওই সিঁড়িতে বসার পর দাদার চোখে মুখে তার যে প্রশান্তি খেলা করছিলো, তা ছুয়ে যাচ্ছিলো আমাদের সবাইকে। ভিটের মাটিটুকু পলিথিনের ব্যাগে পুড়ে সযন্তে নিজের কাছেই রাখলেন অমিত’দা। এরই মধ্যে মিঠু গিয়ে তার কাকা, শান্তি দাসগুপ্তকে ডেকে নিয়ে এলেন। বন্দনা দেবী আমাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তার হাতে ভাজা গরম মুড়ি আর ডিম ভাজিকে মনে হচ্ছিলো স্বর্গের মেন্যু। গল্পে গল্পে রাতও এগিয়ে আসছিলো। তবুও অনেকটা তাড়াহুরো করেই উঠতে হয় আমাদের। আবারো ফেরার কথা জানিয়ে ফিরে আসি আমরা। সাথে নিয়ে আসি অমিত’দার শেকড়ের মাটি আর আমার চলচ্চিত্রের গল্প। যার নাম হতে পারে ‘সেনের প্রত্যাবর্তন’ বা ‘the return of sen’ অথবা ‘ফেরা না ফেরা’। ওহ, ফেরার পথে ওপারের, মানে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বাম নেতা শৈলেন দাশগুপ্তের পাশের বাড়িও চিনে আসি আমরা। তার গল্পও শোনবো অন্য কোনো দিন।

এখনকার অমিত’দার কথা’তো তেমন কিছুই বললাম না। শুধু এটুকু জানাই - তিনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, একইসঙ্গে একজন শিক্ষক। আর সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল অবলম্বনে তার হাতেই তৈরী হচ্ছে বাংলা ভাষার প্রথম ত্রিমাত্রিক (থ্রি ডি) চলচ্চিত্র।

১৯ ডিসেম্বর ২০১৩

প্রত্যাশা - the expectation


শঙ্কা আর দীর্ঘশ্বাস জাগে। তবু বড় প্রিয় এ ‍দৃশ্য জেলে পল্লীর নারীদের কাছে। তীরের কাছাকাছি মৎস শিকারী নৌযান আসার শব্দ শুনলেই সেদিকে ছুটে যায় ঘরের ছোট্ট বাচ্চারা। ভাবে, সমুদ্রে মাছ শিকারে যাওয়া বাবা ফিরলো বুঝি । তাদের ছুটে যেতে দেখে মায়েদের মনেও আশা আর নিরাশা জাগে একই সাথে। তারা একবার ভাবে, কত দিন কেটে গেছে। স্বামী হয়ত আজই বাড়ি ফিরবে। আবার ভাবে, নাহ - দু সপ্তাহের কথা বলে গিয়েছিলো। তা হতে এখনো তিন দিন বাকি। ছেলেটা আজও বাবার কাছে যাওয়ার বায়না ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়বে। এসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই মৃদু বা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। তাদের নিথর প্রত্যাশা বড় জীবন্ত হয়ে ফুটে থাকে সন্তানদের চোখে । ছবিটি বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর সমুদ্র ঘেঁষা গ্রাম কুয়াকাটা থেকে তোলা।
[Here rises uncertainty and deep sigh. Still this view is very satisfying to the women of fishermen’s quarter. Kids rush to the seashore from their home as soon as they hear the sound of a fishermen's boat near the beach. They think their fisherman father may have returned. While watching them rushing toward the seashore, their mothers also seem hopeful and despair at the same time. They think long time have passed their husbands went to work. May be he will return today. Again they think- No, He said he will return within a couple of weeks. Still three days are left to that couple of weeks to be over. The son insists to go to his father yet and sleeps crying. A long breath comes out while thinking all these. Their tranquil expectations remain lively in the eyes of their kids. This picture was taken at the village ‘Kuakata’ adjoining to the seashore in the coastal district ‘Patuakhali’ of Bangladesh.]
newsreel [সংবাদচিত্র]