Powered By Blogger

০৬ এপ্রিল ২০১৯

নিজেরই প্রতিবিম্বগণ যার হন্তারক

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নৈশ আড্ডায় অভিজিৎ দাস, ৭ জুলাই ২০১৩।..
কবি রাসেল রায়হানের সম্পাদক সম্পাদিত শিল্প সাহিত্যের সংবাদ বিষয়ক ওয়েবজিন ‘কালকুট’ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করেছিল এই লেখাটি।  নিখোঁজ কবি অভিজিৎ দাসের জন্মদিন উপলক্ষে আজ পুনরায় প্রকাশ করছি লেখাটি।  
“যোগেন মণ্ডলের বাঙলায় আজও থামেনি নমঃশূদ্র পীড়ন। ১৪’র অক্টোবরে গুম হন কবি অভিজিৎ দাস, ১৭’তে লাপাত্তা সাংবাদিক উৎপল দাস।” – গত বছর নভেম্বরে এক মুখবই প্রকাশনায় লিখেছিলাম এমনটা । আসলে উৎপলের ঘটনা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে অভিজিৎ-কে। তিনি সেই কবি, নিজেরই প্রতিবিম্বগণ যার হন্তারক। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটি বছর; কোথাও মেলেনি আমাদের এই বন্ধুর খবর। উৎপল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার যেভাবে সরব হয়েছে তা আশাব্যঞ্জক। তাকে নিয়ে জাতীয় সংসদে অবধি আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই সংবাদ-আলোচনা বা তার সহযোদ্ধা সাংবাদিকদের তামাম, প্রচেষ্টা কত দিন জারি থাকবে তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে মনে। কারণ অভিজিৎ-কে ফিরে পাওয়ার সকল প্রচেষ্টা কিন্তু এরই মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। কবি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে যাচ্ছেন স্বজন-বান্ধবদের স্মৃত্মির অতল গহবরে।

[উল্লেখ্য, নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস ১০ দিন পর উৎপল ফিরে এসেছিল।]
সেবার উত্তরের হওয়া একটু আগেভাগেই বইছিলো। হিম হিম ভাব চলে এসেছিলো উষ্ণনগরী ঢাকার ভোরগুলোয়ও। ২০১৪-এর অক্টোবরের এমনই এক ভোরে, সম্ভবত ছয়টা বা সাড়ে ছয়টার দিকে সহোদর (ছোট ভাই) বিশ্বজিৎ দাসের শ্যামলীর বাসা থেকে বেড়িয়ে যান বাংলাদেশের তরুণ কবি ও গণসঙ্গীত শিল্পী অভিজিৎ দাস। এরপর থেকেই তিনি লাপাত্তা। দুই বাংলাতেই তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন বন্ধু, স্বজনরা। খোঁজার কথা জানিয়েছিলো পুলিশও। কিন্ত হদিস মেলেনি। প্রায়ই স্মরণ করি - কত গান কত স্মৃতি; ভাবি অভিজিৎ আদৌ ফিরবেন কি?
এরই মধ্যে কত কি ঘটে গেছে। চলতি বছরের মে মাসে চলে গেলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে কত মানুষ খবর নিতে মুঠোফোনে আওয়াজ দিয়েছিলো তার ইয়াত্তা নেই। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি আসলে মনে মনে অভিজিৎ দাসের কণ্ঠ শোনার অপেক্ষা করছিলাম। 
গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালী জন্মের কালে আতুঁর করে রাসেলের সাথে মাত্র দুই জন মানুষ ছিলেন। যার একজন অভিজিৎ দাস। রাতের পর রাত আমরা বরিশালের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে, শ্মশান, কবর আর মানুষের বাজার ঘেঁটে শেষ অবধি একটু নিস্তব্ধতা খুঁজে নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। 
২০০৭ সালের সেই সংবাদ, আজকের পরিবর্তন।..
সাহিত্যের সংবাদনির্ভর অনলাইন ম্যাগাজিন ‘কালকূট সম্পাদক কবি রাসেল রায়হান যখন অভিজিৎ দাসকে নিয়ে লেখার কথা বললেন, সাথে সাথেই কেন যেন মনে পড়ে গেলো বহু পুরানো এক সংবাদের শিরোনাম - ‘পুলিশী হয়রানীতে দুই সাংস্কৃতিককর্মি’। সে বছর মহাশ্মশানে এক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজ চলছিলো। যেখানে সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন কবি অভিজিৎ, আর তার কাজ দেখতে গিয়েছিলেন - প্রয়াত নির্মাতা রাসেল। রাত তিনটার দিকে তারা যখন বাড়ি ফিরছিলো তখন পুলিশের অসদাচরণের শিকার হন তারা। তাদের সাথে তখন পুলিশের কি বাহাস হয়েছিলো তার বিস্তারিত উল্লেখ ছিলো ওই প্রতিবেদনে। 
ঠিক দশ বছর আগের, ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বরে প্রকাশিত হয় ওই সংবাদ। তখন আমি সাপ্তাহিক ২০০০ -এর বরিশাল প্রতিনিধি, একইসঙ্গে স্থানীয় দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকার প্রতিবেদক। দুটো পত্রিকাই তখন প্রগতিশীল চিন্তাচর্চার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। সময় কত দ্রুতই না বয়ে যায়। ব্যক্তিগত ব্লগে অভিজিৎ দাস নিরুদ্দেশ, না গুম?- শিরোনামে প্রথম লিখেছিলাম ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর। পরের বছর অক্টোবরে লিখেছিলাম ফেরে নাই অভিজিৎ দাস। নতুন পাঠকদের জন্য প্রথম লেখাটির কিয়দাংশ সংযুক্ত করতে চাই।
অভিজিৎ কি তবে তার প্রিয় অগ্রজ বিষ্ণু বিশ্বাসের মতোই স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করলেন? এম্নিতেই বিষ্ণুকে প্রচণ্ড পছন্দ করেন তিনি। তার দুটি কবিতায় সুরও দিয়েছেন। আর বিষ্ণুর মতো তিনিও ডোবেন আজব হ্যালুসিনেশনে। কাছের মানুষেরা তার ভীতিবিহবলতার মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। ১৯৬২’র ২৯ মে ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে জন্মানো বিষ্ণুও হ্যালুসিনেশনে ভীতচকিত হতেন। তিনি দেখতেন একটা সাদা গাড়ী অথবা ছুরি হাতে কেউ একজন তাকে তাড়া করে ফিরছে।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আরো জানিয়ে রাখি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করে ৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বিষ্ণু। কিছুটা বাউন্ডুলে হলেও তার লেখালেখি, আড্ডা - সবই চলছিলো স্বাভাবিক। ছন্দপতন ঘটলো ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায়। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা প্রসূত হিংস্রতা কবিকে বিপর্যস্ত করে মারাত্মকভাবে। করে তোলে আতঙ্কগ্রস্ত। এই আতঙ্ক নিয়েই ১৯৯৩ সালে তিনি উধাও হন। এর প্রায় ১৮ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে তার সন্ধান মেলে।
নিখোঁজ হওয়ার কয়েক বছর আগে অভিজিৎ জানিয়েছিলেন, বরিশালের জাগুয়া গ্রামের যে জমিতে তাদের আদি ভিটা ছিলো তা দখল করে সেখানে ক্লিনিক তৈরী করছেন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। ভেঙে ফেলা হয়েছে তাদের পুরানো বাড়ি-ঘর, পূর্বপুরুষদের সমাধি। কোনো ভাবে এটা ঠেকাতে না পারার কারণে প্রচণ্ড হতাশ ছিলেন কবি। যদিও তার জ্ঞাতিদের কয়েকজন ক্ষতিপূরন বাবদ কিছু নগদার্থও পেয়েছেন।
বয়সে খানিকটা বড় হলেও অভিজিৎ দাসের সাথে আমার অন্তরঙ্গতায় কোনো ঘাটতি নেই সম্ভবত। যে কারণে তার নিপাট নির্লিপ্ত অভিমানের সাথেও আমি পরিচিত। আর এ কারণেই হয়ত ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, অভিমানী কবিকে লাপাত্তা হতে বাধ্য করিনি’তো আমরা; মানে পুঁজিবাদী চমকে মোহাবিষ্ট স্বজন, বন্ধু আর সমাজ? বা সেলফিজমের যমানাই গুম করেনি’তো তাকে? এ জাতীয় নানা শঙ্কার মাঝে দাঁড়িয়েও মনে হয়, বইমেলার আগেই ফিরে আসবেন কবি। সাথে থাকবে তার নতুন কাব্যগ্রন্থ। নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ, ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগণ, মাটির চামচ মুখে এবং করপল্লবসঙ্গিনী, সারাটা আঁধার বেড়াবো মাতাল কুসুম বনে বনে -এর সঙ্গে যুক্ত হবে আরেকটি নাম। শেষ বইটির পুরো কাজটুকু নিজ হাতে করেছিলেন কবি। করিয়েছিলেন প্রচ্ছদও। তিনি লাপাত্তা হওয়ার পরে বইটি প্রকাশ করা হলেও সেখানে কবির করিয়ে যাওয়া প্রচ্ছদটি ব্যবহার করা হয়নি। এ ঘটনায় মনে পড়ে যায় প্রয়াত কবি রকিবুল হক ইবনকে-ও। মূলত তার সাথে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মাদারীপুর সফরে অভিজিৎ যে গানটি বেঁধেছেন তার কথাগুলো; গোঁসাইয়ের কপাল এমন/ফলে সাড়ে তিন মন/দুই মনের বিক্রি শেষে/আধ মন যায় খাজনা দিতে/এক মন যায় পশুপক্ষীর পেটে/ ও ভোলা মন …

অভিজিৎ দাসকে চেনেন না, এমন পাঠকদের জন্য এখানে আরো কিছু তথ্য টুকে রাখা দরকার। আপাদমস্তক এই কবি ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর বাবা এবং তার আগে ২০০৭ সালের ১৬ মে মা’কে হারান। অবশ্য তাদের মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন কাব্যিক উদাসীনতা। সংসারের দিকে তার খেয়াল ছিলো না কোনো। তবে জ্ঞাতসারে কখনো কারো ক্ষতির কারণ হননি আমাদের এই আত্মভোলা বন্ধু । তাই বিশ্বাস করি, তারও ক্ষতির কারণ হবেন না কেউ। যেখানেই আছেন, ভালো আছেন – সুস্থ আছেন কবি। যদিও অযন্ত-অবহেলায় তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব বেশী ভালো নেই মনে হয়। তবুও আশা করতে দোষ কি?

রাসেল আহমেদ ও অভিজিৎ দাস।..
নিখোঁজ হওয়ার আগে দীর্ঘ সময় কবি অভিজিৎ-এর কোনো আয় ছিলো না। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিলো দৈনিক আমাদের সময়। পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে শিল্পপতি নূর আলী ও সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খানের দ্বন্দ্ব চলাকালে ছাঁটাই হওয়া কর্মিদের মধ্যে ছিলেন কবিও। এরপর আর কোথাও কাজ করেননি তিনি। তবে কর্মহীন ছিলেন না কখনো। কবি বা যন্ত্রী বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন সারাদিন। আর যেখানেই নিপীরনের খবর পেয়েছেন, ছুটে গিয়েছেন। খোলা গলায় গান ধরেছেন শোষিতদের পক্ষে - ‘দুধ ভাত শুধু তোমাদের আর আমরা কেবলই পাথর চিবুতে বাধ্য’। শোষকদের বিরুদ্ধে গানই তার শ্লোগান। এমন অজস্র গানের স্রষ্টা তিনি। কয়েক বছর ধরে ছবি আঁকার ভুতটাও মাথায় চেপেছে তার । এঁকেছেন এবং হারিয়েছেন অজস্র ছবি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতালকে সমর্থন জানাতে গিয়ে ২০১১ সালের জুলাইয়ে অভিজিৎ গ্রেফতারও হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে তিনি লাঠিচার্জ ও ধাওয়ার সম্মুখীনও হয়েছেন বহুবার। তবুও রাজপথ ছাড়েননি কখনো। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত - পথেই কাটিয়ে দিয়েছেন। 
অভিজিৎ বলেছিলেন, প্রায় দেড় দশক আগে বরিশালের দৈনিক প্রবাসীতে তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ওস্তাদ ছিলেন সাংবাদিক শওকত মিল্টন। এছাড়াও যদ্দুর জানি অভি বরিশালের দৈনিক আজকের বার্তা, ঢাকার দৈনিক বাংলাদেশ সময়, আর্ট ম্যাগাজিন শিল্পরূপসহ আরো অগণিত পত্রিকায় কাজ করেছেন। বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকাপন ইনিস্টিটিউট (আইআরআই) আর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথেও ছিলেন বেশ দীর্ঘ সময়। ধ্রুবতারা, শূন্য মাতাল, কালনেত্র, কাঠবিড়ালীসহ আরো অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনও বেরিয়েছে তার হাত দিয়ে।


আজকাল মুখবইয়ের নতুন আয়োজন নিত্যই প্রাত্যহিক স্মৃত্মি মনে করিয়ে দেয়। অভিজিৎ দাসের সাথেও যে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তা তিনি এভাবে না লুকোলে হয়ত খেয়ালই করতাম না। তিনি আজ কোথায় যে আছেন, জানতে ইচ্ছে করছে খুব। তিনি ফিরলে কত স্পৃহা ফিরবে আবার; মাঝে মাঝে তা ভাবতেও ভালো লাগে। যদিও পেরিয়ে গেছে বছর, পেরিয়ে যাচ্ছে মাস; তবু ফিরলেন না অভিমানী অভিজিৎ দাস। হারিয়ে যাওয়ার আগের রাতে আগের রাতে ছোট ভাই বিশ্ব ও বড় বোন চৈতালী দাসের সাথেও বেশ ঝগড়া হয়েছিলো অভিজিৎ-এর। তাই পরদিন সকাল থেকেই অভিমানী ভাইকে খোঁজা শুরু করেন তারা। কিন্তু এক দিন, দুই দিন করে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও আর খোঁজ মেলে না জীবনানন্দের শহরে বেড়ে ওঠা এই কবির।

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]