Powered By Blogger

২১ আগস্ট ২০১৪

‘সাংবাদিক মারলে কিচ্ছু হয় না’

- শিরোনামের ওই সংলাপটি নানা ভাবে কত বার যে শুনতে হয়েছে জীবনে । মহল্লার ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের জাতীয় নেতা, পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, এমনকি সুহৃদ বন্ধুদের মুখেও। কেউ বলেছেন হুমকী দিয়ে, আবার কেউ শঙ্কা জানিয়ে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানও বরাবরই সমর্থন করেছে তাদের। এই যেমন গত বছরও (২০১৩ সালে) বিশ্বজুড়ে দায়িত্ব পালনকালে ১০৮ জনেরও বেশী সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। আর বিশ্বের যেসব দেশে এ জাতীয় হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ছোট্ট এ দেশে গত দেড় যুগে কমপক্ষে ৪০ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।  সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির বহুলালোচিত হত্যাকাণ্ডের মতো অধিকাংশ হতাকাণ্ডের ক্ষেত্রেই বিচার’তো দূরের আলাপ, রহস্যই উদঘাটিত হয়নি।

পুলক চ্যাটার্জী।
ছবিটি তুলেছেন আরিফুর রহমান।
দ্বিধা-বিভক্তি বা স্বার্থান্বেষণ আমাদের, মানে সাংবাদিকদের প্রতিবাদকেও বার বারই করেছে ম্রিয়মাণ। নিজেদের পায়েই কুড়াল মেরেছি আমরা। ভীরুতা আর অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদেরই করেছি নিরাপত্তাহীন। এরই জেরে এবার বরিশাল নগরীর উত্তর মল্লিক রোডে নিজের বাসার ফটকে হত্যা চেষ্টার শিকার হয়েছেন পুলক চ্যাটার্জী। বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পুলকের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে গত রাতে সাত/আটটি কোপ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভে নিবির পরিচর্যায় আছেন; মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আর সংশ্লিষ্ট - আপাত অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের এটুকু বলতে চাই - সমগ্র বাঙলা আর বাকলা, মানে বরিশাল; এক না। ওই পূণ্যভূমির মানুষেরা সামগ্রিকতার স্বার্থে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিতে জানে। অতএব তোদের বিচার হবেই হবে।



১৯ আগস্ট ২০১৪
মনসুরাবাদ, ঢাকা।

***
পুলক চ্যাটার্জী শঙ্কামুক্ত জেনে কিছুটা হালকা লাগছে। তবে এখনো এ হত্যা চেষ্টার কোনো ক্লু – বের হয়নি। ঘটনার পর এক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি পুলিশ। অথচ এ ঘটনা চাউড় হওয়ার পর শুধু বরিশাল নয়, সারা দেশেই নিন্দার ঝড় উঠেছে। ঘটনার প্রতিবাদে রাজপথেও নেমেছেন সাংবাদিকরা। গতকাল সন্ধ্যায় এক ঝটিকা মিছিল শেষে আগামীকাল বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে বরিশাল প্রেসক্লাব। বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএম কলেজ জার্নালিস্ট এসোসিয়েসনসহ সাংবাদিকদের অন্যান্য সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়েছে এই ঘটনার বিরুদ্ধে। ওদিকে জ্ঞান ফেরার পর নিজে বাদী হয়ে অজ্ঞাত তিন হামলাকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পুলক। এখন দেখা যাক এক্ষেত্রে কত দূর কি হয়। কারণ, সারাদেশের মতো বরিশালেও সাংবাদিক নিস্পেষণ’তো কোনো নতুন ঘটনা নয়।
২০ আগস্ট ২০১৪
মনসুরাবাদ, ঢাকা।
***
নিহত সাগর ও রুনির মৃতদেহ
পুলক চ্যাটার্জীকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত সংবাদ পড়তে পড়তেই নিকট অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ইচ্ছে হলো। কেউই নিশ্চয়ই ভোলেননি - ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। একই বছরের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীতে সাংবাদিক দম্পতি প্রবীণ সাংবাদিক ফরহাদ খান ও তার স্ত্রী রহিমা খানম, ৭ এপ্রিল দৈনিক আজকের প্রত্যাশা’র সাংবাদিক মাহবুব টুটুল, একই দিন সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠ’র সাংবাদিক আলতাফ হোসেন এবং ৭ ডিসেম্বর দৈনিক ভোরের ডাক’র গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রাঞ্জু হত্যার শিকার হন। এর আগে ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন সাপ্তাহিক ২০০০’র সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী, ৯ জুন এটিএন বাংলা’র সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল এবং ২৩ ডিসেম্বর মুলাদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী।

২০০৯ সালে খুন হন চার জন, ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এনটিভি’র ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, জুলাইয়ে পাক্ষিক মুক্তমন’র স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা, আগস্টে গাজীপুরে সাম্প্রতিক সময়’র নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারী এবং ডিসেম্বরে রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ। এর আগে ২০০৫ সালে খুন হন - ১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংগ্রাম’র সাংবাদিক শেখ বেলাল উদ্দিন, ২৯ মে দৈনিক কুমিল্লা মুক্তকণ্ঠ’র সম্পাদক মুহাম্মদ গোলাম মাহফুজ এবং ১৭ নভেম্বর দৈনিক সমকাল’র ফরিদপুর ব্যুরো প্রতিনিধি গৌতম দাস।

আরো একটু অতীতে গেলে আমরা দেখতে পাই - ২০০০ সালের ১৫ জানুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার বীরদর্পণ’র সাংবাদিক মীর ইলিয়াস হোসেন দিলীপ এবং ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠ’র যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবলকে হত্যা করা হয়। এর আগে ২০০১ সালে খুন হয়েছিলেন পাঁচ সাংবাদিক। ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ’র খুলনা ব্যুরো প্রধান, নিউএজ ও বিবিসি’র সাংবাদিক এবং খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা, ২ মার্চ দি নিউএজ’র সাংবাদিক আবদুল লতিফ পাপ্পু, ২১ এপ্রিল খুলনার ‘দৈনিক অনির্বাণপত্রিকার সাংবাদিক এসএম নহর আলী, ২৭ জুন খুলনার দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু, ২ অক্টোবর বগুড়ার দৈনিক দুর্জয় বাংলা’র নির্বাহী সম্পাদক এবং বিএফইউজের তৎকালীন সহ-সভাপতি দীপঙ্কর চক্রবর্তী। ২০০২ সালে ২ মার্চ খুন হন খুলনার দৈনিক পূর্বাঞ্চল’র স্টাফ রিপোর্টার হারুনার রশীদ খোকন এবং ৫ জুলাই ডুমুরিয়ার সাংবাদিক সরদার শুকুর হোসেন।

লাশটি বোমা হামলায় নিহত সাংবাদিক মানিক সাহার।
১৯৯৮ সালে ১৬ জুলাই খুন হন  কালীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা এবং ৩০ আগস্ট দৈনিক রানার’র সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল। ১৯৯৬ সালে ১২ জুন চুয়াডাঙ্গার দিনবদলের কাগজ’র সাংবাদিক বজলুর রহমান, ১৯ জুন সীতারার দৈনিক পত্রদূত’র সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম. আলাউদ্দিন এবং একই সালে নীলফামারীর নীলসাগর পত্রিকার সাংবাদিক কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়।

১৯৯৫ সালে খুন হন যশোর জেলার দৈনিক রানার পত্রিকার সাংবাদিক ফারুক হোসেন। এর আগে ১৯৯৪ সালে, যশোর জেলার দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকার সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও মানিকছড়ির সাংবাদিক কামাল হোসেনকে হত্যার করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে খুন হওয়া সাংবাদিকের তালিকায় আরো আছেন - দৈনিক জনবাণী’র রিপোর্টার বেলাল হোসেন, যশোরের দৈনিক রানার’র গোলাম মাজেদ, রাঙ্গামাটির এনটিভির প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দৈনিক যুগান্তর’র সাংবাদিক আহসান আলী, মৌলভীবাজারের ফারুক আহমেদ।

এসব হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর প্রায় সবগুলোই হিমাগারে আছে। কারণ, এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্যি যে দেশের সমাজবিরোধী অশুভ শক্তির পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি সরকারেরও শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয় সাংবাদিকরা। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রে খুনের ঘটনাগুলো দ্রুত তদন্ত করে বিচারের উদ্যোগ নিতে দেখা গেলেও সাংবাদিক হত্যার ব্যাপারে নির্লিপ্তই থেকেছে সব সরকার। গত দেড় দশকের এতগুলো সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া কি রাষ্ট্রের অমার্জনীয় ব্যর্থতা নয়? কোন সরকার এ ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবে?

২১ আগস্ট ২০১৪
মনসুরাবাদ, ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]