Powered By Blogger
বরিশাল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বরিশাল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২৫ নভেম্বর ২০১৭

তারেকের সামনেই পেটালো ছাত্রদল

দৈনিক যুগান্তর (১০ এপ্রিল ২০০৬)

ছবিটাও বেশ আগের
গল্পটা দশক পুরানো। সেবার তারেক রহমানের সামনেই আমাদের গায়ে হাত তুলেছিলো ছাত্রদলের পাণ্ডারা। শুধুমাত্র এ কারণে ওই সময়ে দৈনিক যুগান্তর ছাড়া অন্য গণমাধ্যমগুলো বিষয়টি চেপে গিয়েছিলো। এমনকি স্থানীয় যে দৈনিকে আমি কাজ করতাম, তারাও শুধু প্লেট গ্লাস ভাংচুরের খবর দিয়ে সাংবাদিক পিটানোর ঘটনা বেমালুম গুম করে দেয়। কারণ পত্রিকার আওয়ামীপন্থী মালিকের দুই ভাই ছিলেন আবার বিএনপি নেতা।
আরিফুর রহমান
আজও যুগান্তরের বরিশাল ব্যুরো প্রধান আকতার ফারুক শাহীন (Akter Faruk Shahin), আর বর্তমানে ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারে কর্মরত আছেন আরিফুর রহমান (Arif Rahman)। তাকে স্মরণ করতে-ই মনে এলো ছাত্রদল, ছাত্রলীগ এবঙ শিবির; এই তিন সংগঠনের হাতেই আমার পিটুনি খাওয়ার ছবি তুলতে পারা একমাত্র আলোকচিত্রী তিনি। জানি না সেসব ছবি এখনো আছে কি’না!

২৯ জুন ২০১৭

লিটন বাশার : এক অদম্য চেতনা

রাজপথে লিটন বাশার
যাদের হাত ধরে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম ─ তাদেরই একজন লিটন বাশার। তিনিও অসময়ে চলে গেলেন! ঈদের পরদিন দুপুর অবধি নিদ্রাবিলাসের রেওয়াজ বদলানো হয়নি বলেই দূরালাপনীর ঘুম ভাঙানিয়া তলবে পেলাম খবরটা। জানালেন জাফর ভাই, মানে সাংবাদিক আবু জাফর সাইফুদ্দিন। তার সাথে কথা শেষ করার একটু পরই স্মরণে এলো অতীতের এক বিষাদগ্রস্থ সকাল, ঠিক সাত বছর একদিন আগের। সেদিনও জাফর ভাইয়ের কথাযন্ত্রের ডাকে জেগে উঠেছিলাম, পেয়েছিলাম সাংবাদিক এসএম সোহাগের মৃত্যু সংবাদ। সেই ২০১০ থেকে এই ২০১৭; এর মধ্যে আমরা, মানে আমি আর জাফর ভাই বহুবার পরস্পরকে খুঁজেছি শুধুমাত্র সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর সংবাদ দিতে। 
লিটন বাশার ও এসএম সোহাগ, দু’জনেই ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের কিংবদন্তীতূল্য আরেক প্রয়াত সাংবাদিক মাইনুল হাসানের স্নেহধন্য; কাছের মানুষ। আবার জাফর ভাই ছিলেন তাদের একান্ত আপন। সৌভাগ্যজনকভাবে আমি তাদের প্রত্যেকের ভালোবাসা পেয়েছি, সাথে অকৃত্রিম আস্কারাও। দক্ষিণাঞ্চল কেন্দ্রীক যে কোনো সমস্যায় উদ্ধারকর্তা হিসেবে এ নামগুলোই সর্বাগ্রে মাথায় এসেছে বছরের পর বছর।
বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকায় শিক্ষানবিশ রিপোর্টার পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে সাংবাদিকতা এসেছিলাম। এর আগে জীবনের প্রথম সাক্ষাতকারে যে তিনজন মানুষের মুখোমুখি হতে হয়; তারা হলেন পত্রিকাটির তৎকালীন মালিক ও সম্পাদক সৈয়দ দুলাল, বার্তা সম্পাদক স্বপন খন্দকার এবং যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক লিটন বাশার। তারা সেদিন পছন্দ না করলে আমার সাংবাদিকতা শুরুর পথ হয়ত এতটা সুগম হতো না। কারণ পরবর্তীতে তাদের তিনজনকে-ই দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি।
সচ্ছ ও স্পষ্টভাষী লিটন’দা কে দেখেই শিখেছিলাম ‘আক্রমনাত্বক’ (Agressive) সাংবাদিকতা। ভয় শব্দটা সম্ভবত তার অভিধানেই ছিলো না। কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলতে দেখিনি কখনো, নিজের বন্ধু-স্বজনদেরও না। সততার শক্তিতে বলীয়ান এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের কারণে তার বন্ধু, শত্রু - দুটোই হয়েছে ঢের। তবে পরম দুর্জনও তাকে অশ্রদ্ধা বা অসম্মান করতে পারেনি কখনো। 
স্মৃতিবহুল এক কোরবানীর ঈদ কাটিয়েছিলাম দাদার বুখাইনগরের গ্রামের বাড়িতে। প্রায় এক যুগ আগে, ২০০৬ এর জানুয়ারিতে। মূলত গিয়েছিলাম সাপ্তাহিক ২০০০ ─ এর এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে, চরমোনাইয়ের তৎকালীন পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীমের সাক্ষাতকার নিতে। মূলত হুজুরের বড় ছেলে, চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের সেই সময়ের চেয়ারম্যান, বর্তমান পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সাথে লিটন’দার সখ্যতার সুবাদে আমি সাক্ষাতের সুযোগ পাই। ঈদের দিন সন্ধ্যায় আমি দাদার বাড়িতে পৌঁছাই। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন তিনি। ঘন কুয়াশার সেই রাতে দু’জনে মোটরসাইকেলে চেপে চরমোনাই দরবার শরীফে পৌঁছাই। দরবারের হুজরাতে ঢুকে পীর সাহেবের সাথে কুশল বিনিময়ের পর দাদা বেশ প্রশংসাত্মক ভঙ্গিতে আমায় পরিচয় দিয়ে জানান, আজ তার কোনো জিজ্ঞাসা নেই, সব প্রশ্নই আমার। 

এরপর প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ফজলুল করীম আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। পুরোটা সময় পাশেই ছিলেন লিটন’দা। মাঝে মাঝে চোখে চোখ রেখে সাহস জাগানিয়া হাসি দিচ্ছিলেন। বের হয়ে বললেন ─ ‘তোমার আলাপের স্টাইল (ঢঙ) আমার ভাল্লাগছে।’ তার এই সামান্য প্রশংসা তখন আমার আত্মবিশ্বাস যে কতটা বাড়িয়েছিলো তা আসলে এখন খুব ভালো করে টের পাচ্ছি। হুজরা থেকে বের হওয়ার পর মাংস দিয়ে রুটি খেতে খেতে বর্তমান পীর রেজাউল করীমেরও একটি সাক্ষাতকার নেই। সেবার দেড় লাখ টাকা দিয়ে বরিশালের হাটে ওঠা সবচেয়ে বড় গরুটি কিনে কোরবানী দিয়েছিলো পীর পরিবার। সেটির মাংস আর চালের রুটি দিয়েই আমাদের আপ্যায়িত করা হয়।
সেই রাতে আর শহরে ফিরতে দেননি লিটন’দা। ফের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এর আগে সন্ধ্যায়-ই পরিচয় হয়েছিলো তার তিন ভাইয়ের সাথে। এর মধ্যে রিয়াদ ভাইয়ের (রিয়াদ আহমেদ) সাথে খুব একটা যোগাযোগ না থাকলেও তার চেহারার সাথে দাদার চেহারার অদ্ভুত মিল থাকার কথা আজও ভুলিনি। ইলিয়াস (আহমেদ ইলিয়াস) আর ইমনের (ইশতিয়াক ইমন) সাথে দুরত্বটা কমে গিয়েছিলো ফেসবুকের সুবাদে। লিটন’দার মতো তাদের সাথে কথা, এমনকী সাক্ষাতও হয়েছে মাঝে মাঝে। ভাইদের মধ্যে ইমন-ই শুধু অগ্রজকে অনুসরণ করেছেন, মানে সাংবাদিকতায় এসেছেন। দাদার দেখাদেখি আমিও তাকে ‘ছোট হুজুর’ ─ নামে ডেকেছি দীর্ঘকাল। তাদের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, পেশায় ছিলেন শিক্ষক। নামটি মনে না এলেও তার সরল হাস্যোজ্জল ব্যক্তিত্ব স্মরণে আছে বেশ। দাদার মায়ের হাতের রান্নার স্বাদও জিভে লেগে আছে। আহারে, প্রিয়পুত্রের প্রয়াণে এখন তাদের বুকে যে হাহাকারের দামামা বাজছে ─ তা শোনার সাহস আছে কার?
পীরের সেই সাক্ষাতকার জমা দেয়ার ‘ডেডলাইন মিস’─জনিত কারণে মুঠোফোন বন্ধ করে আমি যখন ফেরারী, পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মর্তুজাকে আমায় হন্যে হয়ে খুঁজছেন; তখনও লিটন’দা-ই তাকে আমার বাসার ল্যান্ডফোন নম্বর দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেই সাক্ষাতকারসহ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘চরমোনাই পীরকাহীনি’। প্রতিবেদন জুড়ে পীরের নানা অনাচারের ফিরিস্তি থাকায় ফের মহাবিপত্তি ঘটে । পীরের রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৬৪ জেলায় মানহানির মামলা করার পাশাপাশি অব্যাহত হামলার হুমকী দিয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে। শুধু আমার নয়, লিটন’দার ওপরও তারা ক্ষিপ্ত হন। তখনও তিনি আমার পাশ থেকে সরে যাননি। সব সামলে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছেন।
গত বছরের ছবি
একই বছরে, অর্থাৎ ২০০৬ সালে আজকের পরিবর্তন পত্রিকায় ‘পুরানো বরিশাল’ শিরোনামে এক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সুশান্ত ঘোষ, নজরুল বিশ্বাস আর আমার সেই যৌথ কাজ চলাকালে লিটন’দা দৈনিক ইত্তেফাকে বরিশালের পুরানো বাড়িগুলো নিয়ে একটি সিরিজ শুরু করেন। তখন তিনি পরিবর্তনের সাথেও সংযুক্ত ছিলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো দুটি সিরিজের সমন্বয়ের পাশাপাশি আরো কিছু তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত করে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ। পরবর্তীতে নানা কারণে সে উদ্যোগ আর হালে পানি পায়নি।
দক্ষিণের প্রতিটি জনপদে চষে বেড়িয়েছেন লিটন বাশার। জন্ম দিয়েছেন অজস্র সাড়া জাগানিয়া প্রতিবেদন। তবে তার উত্থান দ্বীপজেলা ভোলা থেকে। এরপর চলে গিয়েছিলেন ঢাকায়। পরে ফের বরিশালে এসে থিতু হন। তার হাত ধরেই বরিশাল, তথা বাঙলার মফস্বল সাংবাদিকতায় ঐক্য ও সম্প্রীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। 

গত দশকের শেষের দিকে ঢাকায় চলে আসার পরও দাদার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার। বরং যোগাযোগটা একটু বেশীই ছিলো। পুরানো পল্টনের রয়েল হোটেলের নাম, মালিকানা বদলে গেছে বহুদিন আগে। নতুন নামটি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না এই মুহুর্তে। তবে খুব মনে পড়ছে ২০০৮-০৯ সালে এই হোটেলে কাটানো এক রাতের গল্প। পঞ্চম তলার কোনো এক রূমে লিটন’দা এবঙ তার তিন বন্ধুর রাতভর আড্ডা শেষে খুব সকালে যখন বের হয়ে আসছি, দাদা তখন হাতে দুই হাজার টাকা গুজে দিয়ে বললেন, ‘এইটা রাখ।’ আমি ইতস্তত করে টাকাটা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করতেই তিনি ধমক দিয়ে বললেন, ‘ঢাকায় রিপোর্টার-গো শুরুর বেতন কেমন তা আমার জানা আছে। ঠিকঠাক দেয় কয় প্রতিষ্ঠান, তা’ও।’ ছোট্ট করে ‘থ্যাঙ্ক-ইউ’ বলে আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। রাতে অবশ্য বহু বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে দাদা বলেছিলেন, ‘লেগে থাকলে দুই বছরের মধ্যে তোর বেতন চারগুণ হয়ে যাবে।’ সত্যি, পরে হয়েছিলোও তা-ই ।

আমি সংসদ সাংবাদিকতা শুরুর পর দাদা বেশ খুশি হয়েছিলেন। সেই সময়ে, মানে ২০০৯-১১ সালে মাঝে মাঝে সংসদের সাংবাদিক লাউঞ্জে ফোন করে নিজের পরিচয় গোপন করে আমাকে চাইতেন। কণ্ঠ বদলে মজা করতেন। প্রতিবারই তাকে চিনে ফেলার পর শিশুদের মতো হাসতেন। কখনো আবার জানতে চাইতেন লাউঞ্জে এখন কোন কোন সাংবাদিক আছেন। পরিচিত কেউ আছে শুনলে তাদেরও ডেকে কথা বলতেন। কাজী শাহেদ, উত্তম চক্রবর্তী, সজল জাহিদ, উম্মুল ওয়ারা সুইটিসহ ঢাকার অনেক সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে তার সখ্যতার হাল দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছি ঢাকায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করার সময়েও পলিটিক্যাল রিপোর্টার (আওয়ামী লীগ বিট) হিসেবে লিটন’দা ছিলেন সবার প্রিয় সহযোদ্ধা।  

দাদার সাথে সর্বশেষ দেখা হয় ২০১৫ সালে, বরিশালে। প্রেসক্লাবের নির্বাচনের দিন বিকেলে। তখনও তিনি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। সেখানেই দেখা হয়। পরে তার সাথে কথা বলতে বলতে আগরপুর রোডে থেকে বেড়িয়ে সদর রোডের হাবীব ভবনে ইত্তেফাক অফিসে গেলাম। বেশ কিছু সময় ধরে আড্ডা দিলাম। প্রায় পুরোটা সময় আমার প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করলেন। তবে ফেরার আগে উৎসাহ দিলেন চলচ্চিত্রের কাজেও। বললেন, ‘এইডাও আবার ছাইড়া দিও না।’ এরপর দুয়েকবার ফোন ও ফেসবুকে আলাপ হয়েছে; কিন্তু সাক্ষাত হয়নি আর। তবে ‍নিয়মিত তার লেখা সংবাদ ও কলাম পড়ে বুঝতাম, তিনি আজও খুব একটা বদলে যাননি। প্রেসক্লাবের সর্বশেষ নির্বাচনে সভাপতি পদে দাঁড়িয়েছিলেন। প্যানেল জিতলেও তিনি হেরে যান। তাকে যদ্দুর জানি, এ ঘটনায় কষ্ট পেলেও কাউকে বুঝতে দেয়ার মানুষটি তিনি নন। তাই যে কোনো সাংবাদিকের জন্য নির্দ্বিধায় পথে নামার অভ্যাসও তার বদলায়নি আমৃত্যু। 

অতি-সাম্প্রতিক ছবি 
মৃত্যুর মাত্র দু’দিন আগের এক লেখায় লিটন বাশার বলেছেন ─ “বিবেকের দায় এড়াতে নিজের শূন্য পকেটেও প্রিয় সহকর্মী কিংবা প্রয়াত বন্ধুদের এতিম সন্তানের মুখে হাসি ফুটাতে শেষ রোজায় দিন-রাত দৌড়ঝাঁপ করে আমি এখন ক্লান্ত। যেটা বুঝলাম তাতে আপনি যদি সকলের আবদার পূরণ করতে চান, সবার মুখে হাসি ফুটাতে চান তবে আপনার মুখের হাসি অটুট থাকা দুরূহ ব্যাপার। আর আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষ হয়ে যদি ‘ঈদ’ নামের এক মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার কোনো কঠিন বাস্তবতা আপনার সামনে হাজির হয় তবে হাসি তো ম্লান হবেই।” বাস্তবতার চাপ প্রসঙ্গে এমন নির্লিপ্ত বয়ান সম্ভবত শুধু তার পক্ষেই দেয়া সম্ভব। তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত রসিক, খাঁটি প্রতিবাদী, রাজপথের সাহসী প্রাণ; একইসঙ্গে সাহিত্য অনুরাগী, ইতিহাস সচেতন, উদ্যমী পরোপকারী, নীতিবান সংগঠক, উদারমনা শিক্ষক এবং সর্বোপরী একজন আপোসহীন সাংবাদিক। জানি না কত জন বুঝবে কি হারালো বরিশাল বা কি হারিয়েছে বাংলাদেশ।

দাদার পুত্র শ্রেষ্ঠ’র বয়স মাত্র চার বছর। তার নিজ হাতে গড়া পত্রিকা দৈনিক দখিনের মুখ পত্রিকার বয়সও সম্ভবত বছর দেড়েক। তার এই দুই সন্তানের ভবিষ্যত পথ চলা সুগমের দায়িত্ব এখন সকলের। মনে রাখবেন, লিটন বাশার কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন; তিনি এক অদম্য চেতনা। একদিন শুধু বরিশাল নয়, সারাদেশের সাংবাদিকরা তাকে ধারণ করবেন; এটা-ই প্রত্যাশা। 
প্রয়াত বন্ধু-স্বজনদের তালিকা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে, ইদানীং একটু দ্রুতই। প্রায়শই ভাবি তাদের এলিজি লেখার জন্যই হয়ত এখনো বেঁচে আছি আমি। যদিও যমের সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না শোকার্ত মন। একজনকে নিয়ে লেখা শেষ না করতেই তিনি আরো তিনজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। গত ১৫ মে চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ, ১০ জুন আলোকচিত্রী হানের পর ২৭ জুন লিটন বাশার। একইদিন রাতে আবার সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশও! হে মহান আজরাইল, দয়া করে এবার একটু ধীরে চলেন।
“আপনার আকস্মিক মৃত্যু আমাদের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটি পর্যন্ত দিলো না। তবুও প্রত্যাশা আপনি নিশ্চয়ই আমাদের মতো অনুজদের ক্ষমা করবেন।” ─ গত ফেব্রুয়ারিতে মীর মনিরুজ্জামানের মৃত্যুর পর এক লেখায় এ কথাগুলো বলেছিলেন সদ্য প্রয়াত অগ্রজ লিটন বাশার। সেই কথাগুলো-ই আজ তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে হচ্ছে। আরো কত প্রিয়মুখ ছবি হয়ে যাবে; কত দয়িতের সাথে আর কথা হবে না কোনো দিন! আর এ সত্য বদলাতে পারবে না কেউ। অগ্রগামী বন্ধু-স্বজনদের তাই অভিনন্দন। আশারাখি দেখা হবে, নবজন্মে।

অবিশেষ
পরম শ্রদ্ধায় রাসেল স্মরণ
চিন্তা-কর্মে, স্মৃতির মর্মে অমর মনির

২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

চিন্তা-কর্মে, স্মৃতির মর্মে অমর মনির

মীর মনিরুজ্জামান
এক-এগারো পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়। দুই হাজার সাত-এর সেপ্টেম্বরের একদিন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক আজকের কাগজ। পত্রিকাটির বরিশাল প্রতিনিধি ছিলেন সদ্য প্রয়াত মীর মনিরুজ্জামান। সৎ, পরোপকারী, প্রতিবাদী ও বন্ধুবৎসল সাংবাদিক নেতা হিসেবে নিজ শহরে যার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। বেকারত্বের কারণে হতোদ্যম না হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন, আঞ্চলিক দৈনিক। তখন আমি ঢাকার এক অখ্যাত পত্রিকার বরিশাল প্রতিনিধি, একইসঙ্গে স্থানীয় আজকের পরিবর্তন পত্রিকার প্রতিবেদক। এই পরিবর্তন ছিলো আমার সাংবাদিক সত্বার জন্মস্থান। পত্রিকাটি ছেড়ে কিছুদিন দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল আর আজকের বার্তায় কাজ করে ঠিক যখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছি, তখনই মনির ভাই নিজে পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হলেন। 
এ বিষয়ক আলোচনা খুব একটা ডালপালা মেলার আগেই তিনি বিএনপি নেতা এ্যাডভোকেট মহসিন মন্টুর মালিকানাধীন দৈনিক সত্য সংবাদ পত্রিকাটি নিজ দায়িত্ব নেন। তখনও কাগজে-কলমে মালিকানা মন্টুর নামেই ছিলো। তবে চুক্তি করে পত্রিকাটিকে তার হস্তক্ষেপ মুক্ত করা হয়। এরপর সেখানে বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন তৎকালের এক আলোচিত (বিতর্কিত পড়া যেতে পারে) সাংবাদিক শাকিব বিপ্লব। তিনি আবার ছিলেন আমার পুরানো সহকর্মি যোগাযোগ করলেন, নিয়ে গেলেন মনির ভাইয়ের কাছে - অনামী লেনে সত্য সংবাদ অফিসে। সাক্ষাতে কথা শুনে এই সরল মনের মানুষটার পাশে থাকার তাগিদ জাগায় আবার পরিবর্তন ছাড়লাম। প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দিলাম তার পত্রিকায়। প্রথমবারের মতো একটি দৈনিকে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগের সুযোগও তখন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বয়স কম, তাই বিপ্লবের আকাঙ্খা চোখে-মুখে। যদিও দৈনিক সত্য সংবাদ নামটা পছন্দ হচ্ছিলো না কারো। এ নিয়ে বহু প্যাঁচালের পর সকাল-সন্ধ্যায় বসে সান্ধ্যকালীন নাস্তা করতে করতেই - ঠিক হলো পত্রিকাটির নতুন ট্যাগ লাইন ‘মিথ্যার দুয়ারে হানি আঘাত’। পছন্দ করলেন সম্পাদকও। শুরু হলো নতুন উদ্যমে পথচলা। 
প্রথম কাজ হলো পত্রিকাটির রি-ব্রান্ডিঙ। কারণ মন্টু সম্পাদনাকালে এটি একটি আন্ডারগ্রাউন্ট পার্টিজান পত্রিকা হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। যে কারণে পত্রিকার শুধু কন্টেন্ট নয়, পুরো খোল-নলচে বদলে দেয়ার পরিকল্পনা করলাম আমরা। দিন রাত আলোচনা চলছে। এমন সময় আমরা খেয়াল করি বরিশালের কোনো দৈনিকে আর্টিস্ট/শিল্প নির্দেশক নেই। পত্রিকার চেহারায় নতুনত্ব আনতে এমন একজন মানুষ সাথে থাকা কতটা জরুরী, তা আমাদের শিশুদের মতো তুমুল উৎসাহী সম্পাদককে বোঝাতেও বেগ পেতে হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় আর্টিস্ট/শিল্প নির্দেশক হিসেবে পত্রিকাটির সাথে যুক্ত হন বর্তমানের বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। তিনি তখন রক ব্যান্ড এরিডোনাসের লিড ভোকাল হিসেবেই বেশী পরিচিত। আবার মনির ভাই তাকে চিনতেন বন্ধুর ভাই হিসেবে। রাসেল ভাইয়ের নামটি আমার মাথায় এসেছিলো মূলত তার অলংকরণে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা চিরহরিৎ -এর কারণে। ততদিনে রিপোর্টিং টিম গোছানো শেষ। তবে অর্থ সঙ্কটে সম্পাদনার দায়িত্বে প্রবীণ আর কাউকে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত হলো - রিপোর্টারই সন্ধ্যায় সাব-এডিটরের দায়িত্ব পালন করবেন। একজন অন্যজনের কপি এডিট করবেন।

মীর মনিরুজ্জামান সম্পাদিত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা
নতুন লোগো/নামাঙ্কণ প্রস্তুত হলো হলো। ঠিক করা হলো সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের নতুন কৌশল। মাত্র এক মাসের প্রস্তুতিতে বের হলো মীর মনিরুজ্জামান সম্পাদিত দৈনিক সত্য সংবাদ। আমাদের জানা মতে, যা ছিলো বরিশালে প্রথমবারের মতো ছয় কলাম এ্যালাইনমেন্টের দৈনিক। যার সবগুলো সংবাদ ছিলো অখণ্ড। মানে কোনো খবরের বাকি অংশ অন্য পৃষ্ঠায় খোঁজার প্রয়োজন ছিলো না। নানা আলোচনা-সমালোচনাকে সঙ্গী করে পথ চলতে থাকে পত্রিকাটি। ওই সময় দিন-রাত কাজ করতাম আমরা। মনির ভাই আমাদের জন্য বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে ভাবির রান্না করা খাবার নিয়ে আসতেন। অন্যান্য সহকর্মিদের মধ্যে রাজু হামিদ, শামীম আহমেদ, সুখেন্দু এদবর আর রফিকুল ইসলামের নাম মাথায় আসছে এ মুহুর্তে। পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কবি তুহিন দাস। এছাড়া সুশান্ত ঘোষ, বিধান সরকার, বেলায়েত বাবলু, নজরুল বিশ্বাস, আরিফুর রহমান, প্রয়াত এসএম সোহাগের মতো অনেকে সাংবাদিক বন্ধু তখন অন্য পত্রিকায় থেকেও উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছেন। নিয়মিত অফিসে যাতায়াত ছিলো তাদের। আরো আসতেন প্রবীন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুকুল দাস এবং এমন আরো অজস্র বন্ধুরা। 
পুরানো ফাইল ঘেঁটে দেখছিলাম - মনির ভাইয়ের নেতৃত্বে কি জাতীয় রিপোর্ট করেছিলাম সেকালে। মোনায়েম এখনও ফেরেনি, বরিশালে শিবিরের রাজনীতি থেমে নেই, ফিরে দেখা ২০০৭ : পাঁচ বন্দুক যুদ্ধের রাত, আগরপুরে হিমু গ্রেফতার নাটকের শেষ পর্বে, আজও সদর্পে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা, রক্ষক যখন ভক্ষক - এমন অজস্র শিরোনামে চোখ আটকালো। কতটা সাহসী সম্পাদকের অধীনে কাজ করলে সেনা-আমলেও এ জাতীয় সংবাদ পরিবেশন করা যায় তা পাঠকেরা আন্দাজ করতে পারছেন আশাকরি। দেখলাম ওই সময় ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার অবমূল্যায়ন নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনও করেছিলাম। সক্রিয় ছিলেন অন্যান্য প্রতিবেদকরাও। প্রতিদিন-ই কোনো না কোনো চমক পয়দাকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করতাম আমরা। নিয়মিত অন্য পত্রিকার সংবাদকর্মিদের দিনলিপিও ছাপানো হতো। 

শেষের দিকে বার্তা সম্পাদক শাকিব বিপ্লবের সাথে আমার মনোমালিণ্য চরমে পৌঁছায়। আমার লেখা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তিনি নিজের নামে ছাপােনোর ঘটনায় যার সূত্রপাত। এরই জেরে পরে মনির ভাইকে না বলেই পত্রিকাটি ছেড়ে দিয়েছিলাম। এর ফলে তিনি কিছুটা অভিমানও করেছিলেন। এরপরে অবশ্য স্থানীয় কোনো দৈনিকে আর কাজ করা হয়নি। বস্তুত আমার পেশাদার সাংবাদিকতা জীবনের বরিশাল পর্বের শেষ সম্পাদক মীর মনির। পরে ২০০৯-১০ সালের দিকে বন্ধু পারভেজ অভি আমাদের বরিশাল ডটকম প্রতিষ্ঠার পর সেখানে লেখালেখি করলেও তা ছিলো অনিয়মিত। 

বগুড়া রোডে (বর্তমানে জীবনানন্দ দাশ সড়ক) মনির ভাইয়ের বাসার সামনে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের বেশ বড় একটা ভাস্কর্য ছিলো (এখনো আছে হয়ত)। যে কারণে শহরের অনেকে তাকে ‘দোয়েল মনির’ নামে চিনতেন। বাবার সাথে সালাম বিনিময়ের কারণে ছোটবেলা থেকেই ভাইকে চিনতাম। তার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম - ‘মনির খু্বই ভদ্র, ভালো মানুষ।’ গত বছরের ৩০ অক্টোবর বাবার জন্মদিনে বরিশাল গিয়েই মনির ভাইয়ের সাথে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিলো আমার। বিএম কলেজের সামনে থেকে হাসপাতাল রোডে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার পথে ইজিবাইকে চড়ে সহযাত্রীর আসনে পেয়েছিলাম তাকে। 

ছবিটি তুলেছেন মনির ভাইয়ের দীর্ঘদিনের সহচর শাহীন সুমন
যেতে যেতে খুব অল্প সময়েই আলাপ হয়েছিলো নানা কিছু নিয়ে। কি করি, কেমন আছি - সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন। শেষে নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে নেমে গেলেন। যাওয়ার আগে দিয়ে গেলেন আমার ভাড়াও; আর ছোট্ট করে বললেন - ‘আইসো।’ জবাবে আমিও বলেছিলাম, ‘শিগগির আসবো ভাই।’ সেদিনই ঢাকায় ফিরেছিলাম। যে কারণে সেবার তার সাথে আর দেখা করা হয়নি। পরবর্তী চার মাসে কাজের চাপে বরিশাল যাওয়ার ভাবতেও পারিনি। তবে এখন ভাবছি, খুব দ্রুতই যেতে হবে। কারণ মনির ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত, মানে তার কবর জিয়ারত না করা অবধি প্রাণটা অশান্ত রবে।
গত শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বরিশাল প্রেসক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটির সংগ্রামী নেতা মীর মনিরুজ্জামান। দীর্ঘদিন দৈনিক সত্য সংবাদ সম্পাদনার পর সম্প্রতি তিনি নিজ মালিকানায় দৈনিক বরিশাল কথা নামের একটি পত্রিকা চালু করেছিলেন। তার হাত ধরে সাংবাদিকতায় এসেছেন বরিশালের অসংখ্য সাংবাদিক। যাদের অনেকেই তার ত্যাগী আদর্শ লালন করেই পথ চলছেন। অতএব এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, দেহত্যাগ করলেও খুব শিগগিরই মরছেন না মীর মনির। তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন সংবাদকর্মিদের চিন্তা-কর্মে এবং তার অজস্র পাঠকের স্মৃতির মর্মে। 

৩০ জুলাই ২০১৬

কাপ্তাই হ্রদের কুবের

কাপ্তাই হ্রদের কুবের
শৈশবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাছ ধরা আর ভেলা বা নৌকা চালানোটা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয়নি। এমনকী সাঁতারও। কিভাবে কিভাবে যেন শিখে গিয়েছিলাম। এটা বোধকরি এলাকার গুনে। পুকুর, নদী, খালের শহর বরিশালের যে মহল্লায় আমি বেড়ে উঠেছি, সেখানেই ছিলো কমপক্ষে দেড় ডজন বিশালায়তনের পুকুর। আর বাসার ঠিক পেছনই ছিলো শহরের সুপ্রসিদ্ধ জীবন্ত জলাধার ‘জেল খাল’। নব্বইয়ের দশকেও  এ খাল ছিলো ছোট-বড় নৌকা, ট্রলার আর মিঠা পানির বিভিন্ন জাতের মাছের ঝাঁকের দাপুটে বিচরণে মুখরিত। এরই সুবাদে হরেক প্রকৃতির মাঝি  আর মৎস শিকারীর দেখা পেয়েছিলাম সেকালে। তারাই ছিলো আমার শৈশবের হিরো।
সেই যে তুস/কুড়া ফেরি করে বেরানো বড় নৌকার দাঁড়টানা পৌঢ় মাঝির নীল চোখের শূন্য দৃষ্টি,  পোক্ত পেশী বা ছোট ডিঙি নৌকায় সবজী ফেরি করে বেড়ানো যুবকের উচ্ছল উদ্যমতা,  কিছুই ভুলিনি আজও। ভুলিনি ছুটির দিনে ছই তোলা নৌকায় করে আমাদের শহরের বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে, মাঝিরা কুমির আর শুশুকের যে গল্প শোনাতেন, তা’ও।
একই গল্প বার বার পড়ার মতো শুনতে চাওয়ার বাতিকও আমার ছিলো। সবচেয়ে ভালো লাগতো মনে হয় খোয়াজ খিজিরের মিথ। মাছ শিকারীদের কথা আর খুব বেশী না-ইবা বলি। অজস্র দক্ষ শিকারী দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কেউ নদীতে, কেউ পুুকুরে, কেউ খালে, কেউবা কাঁদা পানিতে মাছ ধরার ব্যাপারে এক্সপার্ট । নানা পদের ছোট-বড় জাল, চাঁই, কোচ, বর্শি, আরো কত কী দিয়েই না মাছ ধরায় মাততেন তারা।
হারিয়েই গেছে আমার জলমগ্ন শৈশবের জলাভূমিগুলোর একাংশ। নদীগুলো কোনো মতে টিকে রইলেও সে খাল আজ ভাগার এবং নগরের ময়লার ভারে নিমজ্জিত। আর অধিকাংশ পুকুর কবর দিয়ে তার উপরে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবনের সাম্রাজ্য। তবু মননে লুকানো কৈবর্ত স্বভাবে আজও জলজ ভাব। যে কারণে জলে বসবাসকারী বেঁদে বা বৈড়ালদের মতো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জীবনও আমায় আকৃষ্ট করেছে আশৈশব।
গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাংবাদিকতা শুরুর কালে এদের নিয়ে লেখার আগ্রহ ছিলো তুঙ্গে। ঘুরে বেড়িয়েছি নদী থেকে নদীতে। বিভিন্ন নদী মাঝি ও জেলেদের নৌকায় রাত কাটানো অভিজ্ঞতাও হয়েছে সেই দিন গুলোতে। ইলিশ শিকারীদের সাথে চলে গিয়ে ছিলাম সাগরেও ।


কত গল্প শুনেছি। তবুও সাধ মেটেনি। তার ওপরে সেই কবে থেকে মনে হচ্ছে জলের দেশের এমন গল্পের স্বাদ সারা দুনিয়াকে চেনানোও বেশ জরুরী। এই ভাবনার জেরেই একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার জলাভূমির শত শত মাঝি আর জেলেদের সাক্ষাতকার সংগ্রহের পরিকল্পনা নিয়েছি । এগুলোর ‘লুক এন্ড ফিল’ কেমন হবে – সহযোদ্ধাদের তা বোঝাতেই এই নাই কাজ তো খৈ ভাজ নির্মাণ। এমন টাইটেল দেয়ার কারণ, এটাকে সিরিয়াসলি নেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা ।

প্রথম প্রকাশঃ বানান

১৮ নভেম্বর ২০১৪

কৈশোরের টেম্পু স্ট্যান্ড, বন্ধু ...

old mate | © eon's photography / pap
ছবির এই মানুষটি বহু পুরানো বন্ধুদের একজন। অথচ তার আসল নাম কখনো জানাই হয়নি। আমার কাছে আজও তার নাম ‘দাদু’। তাকে এ নামেই ডাকতাম আমরা, মানে বন্ধুরা। প্রায় ১০ বছর পর দেখা হয়েছিলো এই দাদুর সাথে, তা’ও দুই বছর আগে - ১২’র নভেম্বরে - বরিশাল মহাশ্মশানে। 
স্কুল জীবনের প্রিয় আড্ডাখানাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো নতুন বাজার টেম্পু স্ট্যান্ড। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০০-০১ সালের সেই টেম্পু স্ট্যান্ডের সাথে আজকের স্ট্যান্ডের কোনো মিলই নেই।

ওই সময় পুলিশ ফাঁড়ির ঠিক উল্টোদিকে সারি বাঁধা টিনশেড ঘরগুলোয় ছিলো ওয়ার্কসপ। সারাদিন টেম্পু মেরামতের কাজ হত। আর ওয়ার্কসপগুলোর পূর্ব প্রান্তে ছিলো সোহেল ভাইয়ের চায়ের দোকান।  আর তার দোকান ঘেঁষা রেলিঙ দেয়া কালভার্ট পেরুলেই কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি। দুঃসাহসিক ডাকাত হিসাবে বরিশাল অঞ্চলের এক ‘মিথিক্যাল ক্যারেক্টার’ ছিলেন ওই মোল্লা।  মন্ত্রবলে তিনি বিভিন্ন পশুপাখি রূপ ধারন করতে পারেন, এমন গল্পও শুনেছি।

মোল্লার বাড়ির সেই রেলিঙ দেয়া কালভার্টের অন্যপাশে ছিলো টিএন্ডটি’র দুটি ডিস্ট্রিবিউসন পয়েন্ট কেবিনেট। তারই সামনে ছিলো দাদুর সেলুন। সেলুন বলতে - ওই কেবিনেট আর বিদ্যুতের খুঁটির সাথে কসরত করে ঝুলানো পলিথিনের চালা, ছোট্ট আয়না, হাতলভাঙা চেয়ার, আর একটি টিনের বাক্সে খুর, কাঁচি, ফিটকিরি, সাদা কাপড়সহ আনুসাঙ্গিক কিছু উপাদান। চুল, দাঁড়ি কাটার চেয়ে মাথা আর শরীর মেসেজে খ্যাতি ছিলো তার। তবে খুব বেশী কাজ পেতেন না। এ নিয়ে কোনো হা-হুতাশও ছিলো না তার। তামাম অনিশ্চয়তাও ঢেকে রাখতেন পুরু মোটা চশমার আড়ালে । যদিও মাঝে মাঝে দেখতাম চেয়ারে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। কি ভাবনায় ডুবে যেন রিক্সা-গাড়ির আসা-যাওয়া দেখছেন।  আবার কখনো মুড ভালো থাকলে খুব আয়েশ করে বিড়ি ধরিয়ে তুমুল উৎসাহ নিয়ে নানান আলাপ জমাতেন,  বিশেষ আগ্রহ ছিলো স্থানীয় রাজনীতির ব্যাপারে।
সোহেল ভাইয়ের দোকান, রেলিঙ দেয়া কালভার্ট আর দাদুর সেই সেলুনের সামনে সিরিয়ালে থাকত বানারীপাড়া রুটের টেম্পুগুলো । কৈশোরের কত সকাল, দুপুর, রাত কেটেছে - ওই টেম্পুগুলোয়। অদূরেই ছিলো জগদীশ আশ্রম। সেটিও আমাদের আড্ডাখানা ছিলো দীর্ঘ দিন। লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকা বা গলা ছেড়ে গান গাওয়ার সেই মুহুর্তগুলো - আহা, কতই না অনাবিল ছিলো। 

বহুতল ভবনের নীচতলার একটি স্টলে আশ্রয় নিয়ে সোহেল ভাইয়ের চায়ের দোকান আজও টিকে আছে।  দাদু অবশ্য টিকতে পারেনি। দু’বছর আগের সে সাক্ষাতে বলেছিলেন, তার সেলুন এখন কাউনিয়ার মড়কখোলা পোল সংলগ্ন ডোমপট্টির বিপরীতে। বলেছিলাম যাব, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।  আশা করি - দাদু আজও ভালো আছেন, থাকবেন।
newsreel [সংবাদচিত্র]