|
মীর মনিরুজ্জামান |
এক-এগারো পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়। দুই হাজার সাত-এর সেপ্টেম্বরের একদিন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক আজকের কাগজ। পত্রিকাটির বরিশাল প্রতিনিধি ছিলেন সদ্য প্রয়াত মীর মনিরুজ্জামান। সৎ, পরোপকারী, প্রতিবাদী ও বন্ধুবৎসল সাংবাদিক নেতা হিসেবে নিজ শহরে যার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। বেকারত্বের কারণে হতোদ্যম না হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন, আঞ্চলিক দৈনিক। তখন আমি ঢাকার এক অখ্যাত পত্রিকার বরিশাল প্রতিনিধি, একইসঙ্গে স্থানীয় আজকের পরিবর্তন পত্রিকার প্রতিবেদক। এই পরিবর্তন ছিলো আমার সাংবাদিক সত্বার জন্মস্থান। পত্রিকাটি ছেড়ে কিছুদিন দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল আর আজকের বার্তায় কাজ করে ঠিক যখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছি, তখনই মনির ভাই নিজে পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হলেন।
এ বিষয়ক আলোচনা খুব একটা ডালপালা মেলার আগেই তিনি বিএনপি নেতা এ্যাডভোকেট মহসিন মন্টুর মালিকানাধীন দৈনিক সত্য সংবাদ পত্রিকাটি নিজ দায়িত্ব নেন। তখনও কাগজে-কলমে মালিকানা মন্টুর নামেই ছিলো। তবে চুক্তি করে পত্রিকাটিকে তার হস্তক্ষেপ মুক্ত করা হয়। এরপর সেখানে বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন তৎকালের এক আলোচিত (বিতর্কিত পড়া যেতে পারে) সাংবাদিক শাকিব বিপ্লব। তিনি আবার ছিলেন আমার পুরানো সহকর্মি যোগাযোগ করলেন, নিয়ে গেলেন মনির ভাইয়ের কাছে - অনামী লেনে সত্য সংবাদ অফিসে। সাক্ষাতে কথা শুনে এই সরল মনের মানুষটার পাশে থাকার তাগিদ জাগায় আবার পরিবর্তন ছাড়লাম। প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দিলাম তার পত্রিকায়। প্রথমবারের মতো একটি দৈনিকে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগের সুযোগও তখন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বয়স কম, তাই বিপ্লবের আকাঙ্খা চোখে-মুখে। যদিও দৈনিক সত্য সংবাদ নামটা পছন্দ হচ্ছিলো না কারো। এ নিয়ে বহু প্যাঁচালের পর সকাল-সন্ধ্যায় বসে সান্ধ্যকালীন নাস্তা করতে করতেই - ঠিক হলো পত্রিকাটির নতুন ট্যাগ লাইন ‘মিথ্যার দুয়ারে হানি আঘাত’। পছন্দ করলেন সম্পাদকও। শুরু হলো নতুন উদ্যমে পথচলা।
প্রথম কাজ হলো পত্রিকাটির রি-ব্রান্ডিঙ। কারণ মন্টু সম্পাদনাকালে এটি একটি আন্ডারগ্রাউন্ট পার্টিজান পত্রিকা হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। যে কারণে পত্রিকার শুধু কন্টেন্ট নয়, পুরো খোল-নলচে বদলে দেয়ার পরিকল্পনা করলাম আমরা। দিন রাত আলোচনা চলছে। এমন সময় আমরা খেয়াল করি বরিশালের কোনো দৈনিকে আর্টিস্ট/শিল্প নির্দেশক নেই। পত্রিকার চেহারায় নতুনত্ব আনতে এমন একজন মানুষ সাথে থাকা কতটা জরুরী, তা আমাদের শিশুদের মতো তুমুল উৎসাহী সম্পাদককে বোঝাতেও বেগ পেতে হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় আর্টিস্ট/শিল্প নির্দেশক হিসেবে পত্রিকাটির সাথে যুক্ত হন বর্তমানের বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। তিনি তখন রক ব্যান্ড এরিডোনাসের লিড ভোকাল হিসেবেই বেশী পরিচিত। আবার মনির ভাই তাকে চিনতেন বন্ধুর ভাই হিসেবে। রাসেল ভাইয়ের নামটি আমার মাথায় এসেছিলো মূলত তার অলংকরণে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা চিরহরিৎ -এর কারণে। ততদিনে রিপোর্টিং টিম গোছানো শেষ। তবে অর্থ সঙ্কটে সম্পাদনার দায়িত্বে প্রবীণ আর কাউকে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত হলো - রিপোর্টারই সন্ধ্যায় সাব-এডিটরের দায়িত্ব পালন করবেন। একজন অন্যজনের কপি এডিট করবেন।
|
মীর মনিরুজ্জামান সম্পাদিত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা |
নতুন লোগো/নামাঙ্কণ প্রস্তুত হলো হলো। ঠিক করা হলো সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের নতুন কৌশল। মাত্র এক মাসের প্রস্তুতিতে বের হলো মীর মনিরুজ্জামান সম্পাদিত দৈনিক সত্য সংবাদ। আমাদের জানা মতে, যা ছিলো বরিশালে প্রথমবারের মতো ছয় কলাম এ্যালাইনমেন্টের দৈনিক। যার সবগুলো সংবাদ ছিলো অখণ্ড। মানে কোনো খবরের বাকি অংশ অন্য পৃষ্ঠায় খোঁজার প্রয়োজন ছিলো না। নানা আলোচনা-সমালোচনাকে সঙ্গী করে পথ চলতে থাকে পত্রিকাটি। ওই সময় দিন-রাত কাজ করতাম আমরা। মনির ভাই আমাদের জন্য বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে ভাবির রান্না করা খাবার নিয়ে আসতেন। অন্যান্য সহকর্মিদের মধ্যে রাজু হামিদ, শামীম আহমেদ, সুখেন্দু এদবর আর রফিকুল ইসলামের নাম মাথায় আসছে এ মুহুর্তে। পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কবি তুহিন দাস। এছাড়া সুশান্ত ঘোষ, বিধান সরকার, বেলায়েত বাবলু, নজরুল বিশ্বাস, আরিফুর রহমান, প্রয়াত এসএম সোহাগের মতো অনেকে সাংবাদিক বন্ধু তখন অন্য পত্রিকায় থেকেও উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছেন। নিয়মিত অফিসে যাতায়াত ছিলো তাদের। আরো আসতেন প্রবীন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুকুল দাস এবং এমন আরো অজস্র বন্ধুরা।
পুরানো ফাইল ঘেঁটে দেখছিলাম - মনির ভাইয়ের নেতৃত্বে কি জাতীয় রিপোর্ট করেছিলাম সেকালে। মোনায়েম এখনও ফেরেনি, বরিশালে শিবিরের রাজনীতি থেমে নেই, ফিরে দেখা ২০০৭ : পাঁচ বন্দুক যুদ্ধের রাত, আগরপুরে হিমু গ্রেফতার নাটকের শেষ পর্বে, আজও সদর্পে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা, রক্ষক যখন ভক্ষক - এমন অজস্র শিরোনামে চোখ আটকালো। কতটা সাহসী সম্পাদকের অধীনে কাজ করলে সেনা-আমলেও এ জাতীয় সংবাদ পরিবেশন করা যায় তা পাঠকেরা আন্দাজ করতে পারছেন আশাকরি। দেখলাম ওই সময় ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার অবমূল্যায়ন নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনও করেছিলাম। সক্রিয় ছিলেন অন্যান্য প্রতিবেদকরাও। প্রতিদিন-ই কোনো না কোনো চমক পয়দাকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করতাম আমরা। নিয়মিত অন্য পত্রিকার সংবাদকর্মিদের দিনলিপিও ছাপানো হতো।
শেষের দিকে বার্তা সম্পাদক শাকিব বিপ্লবের সাথে আমার মনোমালিণ্য চরমে পৌঁছায়। আমার লেখা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তিনি নিজের নামে ছাপােনোর ঘটনায় যার সূত্রপাত। এরই জেরে পরে মনির ভাইকে না বলেই পত্রিকাটি ছেড়ে দিয়েছিলাম। এর ফলে তিনি কিছুটা অভিমানও করেছিলেন। এরপরে অবশ্য স্থানীয় কোনো দৈনিকে আর কাজ করা হয়নি। বস্তুত আমার পেশাদার সাংবাদিকতা জীবনের বরিশাল পর্বের শেষ সম্পাদক মীর মনির। পরে ২০০৯-১০ সালের দিকে বন্ধু পারভেজ অভি আমাদের বরিশাল ডটকম প্রতিষ্ঠার পর সেখানে লেখালেখি করলেও তা ছিলো অনিয়মিত।
বগুড়া রোডে (বর্তমানে জীবনানন্দ দাশ সড়ক) মনির ভাইয়ের বাসার সামনে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের বেশ বড় একটা ভাস্কর্য ছিলো (এখনো আছে হয়ত)। যে কারণে শহরের অনেকে তাকে ‘দোয়েল মনির’ নামে চিনতেন। বাবার সাথে সালাম বিনিময়ের কারণে ছোটবেলা থেকেই ভাইকে চিনতাম। তার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম - ‘মনির খু্বই ভদ্র, ভালো মানুষ।’ গত বছরের ৩০ অক্টোবর বাবার জন্মদিনে বরিশাল গিয়েই মনির ভাইয়ের সাথে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিলো আমার। বিএম কলেজের সামনে থেকে হাসপাতাল রোডে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার পথে ইজিবাইকে চড়ে সহযাত্রীর আসনে পেয়েছিলাম তাকে।
|
ছবিটি তুলেছেন মনির ভাইয়ের দীর্ঘদিনের সহচর শাহীন সুমন |
যেতে যেতে খুব অল্প সময়েই আলাপ হয়েছিলো নানা কিছু নিয়ে। কি করি, কেমন আছি - সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন। শেষে নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে নেমে গেলেন। যাওয়ার আগে দিয়ে গেলেন আমার ভাড়াও; আর ছোট্ট করে বললেন - ‘আইসো।’ জবাবে আমিও বলেছিলাম, ‘শিগগির আসবো ভাই।’ সেদিনই ঢাকায় ফিরেছিলাম। যে কারণে সেবার তার সাথে আর দেখা করা হয়নি। পরবর্তী চার মাসে কাজের চাপে বরিশাল যাওয়ার ভাবতেও পারিনি। তবে এখন ভাবছি, খুব দ্রুতই যেতে হবে। কারণ মনির ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত, মানে তার কবর জিয়ারত না করা অবধি প্রাণটা অশান্ত রবে।
গত শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বরিশাল প্রেসক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটির সংগ্রামী নেতা মীর মনিরুজ্জামান। দীর্ঘদিন দৈনিক সত্য সংবাদ সম্পাদনার পর সম্প্রতি তিনি নিজ মালিকানায় দৈনিক বরিশাল কথা নামের একটি পত্রিকা চালু করেছিলেন। তার হাত ধরে সাংবাদিকতায় এসেছেন বরিশালের অসংখ্য সাংবাদিক। যাদের অনেকেই তার ত্যাগী আদর্শ লালন করেই পথ চলছেন। অতএব এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, দেহত্যাগ করলেও খুব শিগগিরই মরছেন না মীর মনির। তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন সংবাদকর্মিদের চিন্তা-কর্মে এবং তার অজস্র পাঠকের স্মৃতির মর্মে।