ছবি: সংগ্রহিত |
মা–বাবার কাছে না থাকায় যাঁর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল, স্বজন হারিয়েও যিনি অর্ধযুগ দেশে ফিরতে পারেননি, যাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে—সেই হতভাগা নারী আর কেউ নন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ ৭২ পেরুনো এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলাপকালে দেশের প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বলেছিলেন, “খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য থেকে তাঁর উত্থান। সহজাত ব্যক্তিত্ব আর নেতৃত্বের গুনেই নিজেকে তিনি আজকের উচ্চতায় নিয়ে আসতে পেরেছেন।”
চার মেয়াদে দেড় দশকের বেশী সময় ধরে ক্ষমতাসীন এই মানুষটির পরিবারের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস। তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই এসেছে স্বাধীনতা । সাংবিধানিকভাবে তাঁকে ‘জাতির জনক’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলনেরও অন্যতম নেতা ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যা পাওয়া উপমহাদেশের এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। দেশের মূলধারার রাজনীতিতে তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা হাসিনার পদার্পণও মূলত ‘শেখের বেটি’ হিসেবেই।
বঙ্গবন্ধুর সাখে শেখ হাসিনা |
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “রাজনীতিতে আসার প্রথম কয়েক বছরের জন্য শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেওয়ার দরকার নেই। সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু’ ম্যাজিক কাজ করেছে। পিতা ও পরিবার হারানোর বেশ কয়েকবছর পর তিনি যখন আওয়ামী লীগ প্রধান হয়ে দেশে আসলেন, তখন ‘বঙ্গবন্ধু-কন্যা’ হওয়ার কারণে প্রাথমিকভাবে অনেক সুবিধা পেয়েছেন।” আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অরুন কুমার গোস্বামী বলেন, “যদিও আওয়ামী বিরোধীরা বলে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জনগণ রাজপথে নামেনি। এটা দালিলিকভাবে সত্য হলেও ‘ফ্যাক্ট’ (প্রকৃত সত্য) হচ্ছে, মানুষ তখন সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এতে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সহানুভুতি বেড়েছে।”
ড. শান্তনু বলেন, “স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে তাঁর (শেখ হাসিনা) স্বতন্ত্র রাজনৈতিক গুনাবলী বিকশিতে হতে শুরু করে। সেই থেকে তাঁর গত তিন দশকের রাজনৈতিক জীবন যদি আমরা দেখি, তা খুবই সমৃদ্ধ।” ড. অরুনের দাবি, “তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আজকের অবস্থানে পৌঁছানোর একটি ইতিবাচক সংযোগ রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়েছে। বিষ্ময়কর অগ্রগতি দেখে আন্তর্জাতিক মহলও অবাক। সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন ‘টেকসই’ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রতিটি সূচকে এগিয়েছি আমরা।”
অরুন আরো বলেন, “শেখ হাসিনা যেভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, তা এর আগে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান করেননি। তিনি জাতীয় মাইলফলকগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ২০২১, ২০৪১, ২১০০ ও ২১২১ এগুলো পেরুবে।” ড. আতাউরও মনে করেন, হাসিনা যেভাবে শক্ত হাতে দেশকে ‘টেকসই’ উন্নয়নের দিকে পরিচালনা করেছেন, তা আর কখনো হয়নি। তিনি অনেক বেশী সক্ষমতা ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। “দেশের ইতিহাসে তিনি রাজনৈতিক নেতার চেয়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বেশী উজ্জল হয়ে থাকবেন,” বলেন এই বিশ্লেষক। এ ব্যাপারে ড. শান্তনুর বক্তব্য, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি যে ‘রকেট’ গতিতে এগিয়েছে, তাঁর দলের ভোট কিন্তু একই গতিতে বাড়েনি।”
৭৩ তম জন্মদিনের প্রাক্কালে (২৬ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল (ইউনিসেফ)। তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি এই সম্মাননা অর্জনের মাত্র দুই দিন আগে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অপর এক অনুষ্ঠানে তাঁকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ আখ্যা দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)। এই সম্মাননাটি শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতে সাফল্যের স্বীকৃতি।
এর আগে গত বছর এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। নেতা ক্যাটাগরিতে তালিকায় জায়গা পাওয়া ২৭ জনের মধ্য তিনি ছিলেন ২১ নম্বরে। ফোর্বস, সিএনএন, ফরচুনসহ একাধিক গণমাধ্যমের জরিপে বিশ্ব, এশিয়া এবং মুসলিম জাহানের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায়ও ছিলেন তিনি।
ছবি: সংগ্রহিত |
জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সর্বাধিককাল দায়িত্ব-পালনকারী হাসিনাকে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে নানাজনের সাথে, মূলত সাংবাদিকতার সুবাদে। যার কিছু প্রকাশিত হয়েছে, কিছুটা হয়নি। নিজের মত প্রকাশের সুযোগ না থাকায় কোথাও বলতে পরিনি, তিনি বাংলার আদ্যাশক্তিরই প্রতিরূপ। প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনেই আজ এই লেখার অবতারণা।
পথটা সহজ ছিল না : শেখ হাসিনার এই সাফল্য একদিনে অর্জিত হয়নি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারও আগে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের প্রথমে সহসভাপতি, পরে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থান করায় বেঁচে যান।পরিবারের সদস্যদের শেষকৃত্যে করার অনুমতিও সে সময়কার সরকার তাঁদের দেয়নি। পরের ছয় বছর ভারতে ছিলেন তাঁরা। নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে তাঁর অনুপস্থিতিতেই সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের পর ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোট সাতবার তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখে শাসকগোষ্ঠী। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাঁকে সাবজেলে থাকতে হয়।
ছবি: সংগ্রহিত |
এর আগে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে একইদিনে দুবার তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হয়। ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালেও তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়েছিল। ২০০১ সালেও তাঁকে দুইবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে স্বীকার করেছেন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (বর্তমানে বিলুপ্ত) শীর্ষনেতা মুফতি হান্নান।
শেখ হাসিনার ৩৬ বছরের (১৯৮১-২০১৭) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসের সংকলন “জননেত্রীর জয়যাত্রা” সম্পাদনাকারী আসিফ কবীর বলেন, “পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের মানসিক আঘাতের পাশাপাশি স্বজন হারানোর সুতীব্র বেদনা ও বিচারহীনতার সংক্ষুব্ধতা- এই তিন নিদারুণ চাপ সয়েই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। সামরিক ও ছায়া সামরিক শাসকরা আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের জন্য নানা চক্রান্ত, কূটকৌশল ও নিষ্পেষণ চালিয়েছে। তা সত্ত্বেও জননেত্রীর (শেখ হাসিনা) নেতৃত্বে তারা বারবার পুর্নগঠিত ও পুনরুজ্জীবিত হয়ে অগ্রসর হয়েছেন। প্রধানের দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস এবং অপরিসীম সাহসের কারণেই দলটি এত বছরেও অতীত হয়নি।”
শেখ হাসিনার ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।গত বছরের অক্টোবরে এ সংক্রান্ত মামলার রায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। ফাঁসির আদেশ হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ আরো ১৯ জনের।
২১ আগস্টের হামলার পর |
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে সবচেয়ে নিন্দনীয়, নৃশংস ও নারকীয় ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী প্রেস সচিব আসিফ বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করায় রাষ্টধীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইতিহাসে বিরল। তবুও পিছপা হয়নি শেখ হাসিনা বা তাঁর দল। খুব কাছ থেকেই তাঁকে দেখছি শাসনব্যবস্থার সংস্কার, জনগণকে যুপোপযোগী সুরক্ষা দান এবং নগর থেকে প্রান্তিক পর্যায় অবধি উন্নয়নের কাজে নিবেদিন থাকতে।তাঁর নেতৃত্বে দেশের অবকাঠামো খাতে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়েছে তা অচিরেই সম্পন্ন হয়ে জনগণের দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ হবে।”
বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অভিযোগ, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসিত করেছেন। একইসঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দিয়ে গেছেন। বিএনপিকে নিয়ে গড়া রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে হারিয়েই তিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এটিকে ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন দাবি করা ওই দলটি ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা দুই দফায় মোট ১০ বছর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বও পালন করেছেন। এর আগে বিএনপির বয়কটে ‘বিতর্কিত’ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয় অর্জনের পর হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিএনপিকে হারিয়েই তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ও ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার এই দায়িত্বগ্রহণ করেছিলেন।
আসিফ বলেন, “রাজপথের দল থেকে সংসদের বিরোধী বা সরকারি দল, সব ভূমিকাতে আওয়ামী লীগের সাফল্যের কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।” বিগত কয়েক বছরে দলীয় ফোরামে বেশ কয়েকবার শেখ হসিনা নিজেই অবসরে যাওয়ার বিষয়টি তুলেছেন। প্রতিবারই দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সমস্বরে জানিয়েছে, তাঁকে আমৃত্যু দলের প্রধান হিসেবে চায় তারা। ড. আতাউর বলেন, “শেখ হাসিনা খুবই বাস্তববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। যে কারণে অনেক কঠিন সময় পার করেও তিনি নিজেকে, নিজের দলকে এবং বাংলাদেশকে একটা ভালো অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছেন।”
ড. শান্তনু বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার কোনো বড় রাজনৈতিক দলে শেখ হাসিনার মতো এত লম্বা সময় ধরে কেউ নেতৃত্বে নেই। তাঁর কারণেই আওয়ামী লীগ আজ শুধু দেশ নয়, পুরো উপ-মহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। যখন ভারতের কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগসহ শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের পুরানো দলগুলোও ক্রমে দুর্বল হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের এই দলটি ক্রমে আরো সামর্থ্যবান হচ্ছে। এটা নিশ্চিত যে তিনি (হাসিনা) না থাকলে আওয়ামী লীগ এখন যেরকম অবস্থায় আছে, সেটা থাকত না।”
শান্তনু আরো বলেন, “তাঁর রাজনীতি কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে দক্ষিণ-এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জায়গা থেকে যদি দেখলে বলতে হয়, এটা এমনই হওয়ার কথা। বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন যে এতদিন ধরে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, এটা শেখ হাসিনার বড় একটি কৃতিত্ব। দলকে তিনি ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। কখনো শক্ত হাতে, আবার কখনো প্রজ্ঞার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলেছেন।”
ছবি: সংগ্রহিত |
শাসনে সাফল্য-ব্যর্থতা : বিশ্লেষকদের মতে, বিগত দশকে শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশী সফল কূটনীতিতে। আগের সরকারের কারণে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে যে দুরত্ব তৈরী হয়েছিল, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই তিনি তা ঘুচিয়ে ফেলেন। তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই তিনি চীনের সাথেও সম্পর্কের গভীরতা বাড়াতে পেরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বিরোধীতা করলেও তিনি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু বলেন, “কূটনৈতিক দিক থেকে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট। তিনি দ্বিতীয়বার এমন একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, যখন আন্তর্জাতিক কতগুলো পরিস্থিতি, বিশেষকরে উগ্রপন্থী সহিসংতার কারণে সারাবিশ্বই উদ্বিগ্ন। এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সাথে রাশিয়া, চীনেরও কোনো বিরোধ নেই; বরং তারা সবাই একাট্টা। এই ইস্যুতে বৃহৎ প্রতিবেশী (ভারত) এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘গুড বুকে’ জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন শেখ হাসিনা। উগ্র জঙ্গিবাদ দমনের ভূমিকাই তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে। এটা তাঁর অন্যতম শক্তি।” আন্তর্জাতিকমহলে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নাজুক অবস্থানও আওয়ামী লীগকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ছবি: সংগ্রহিত |
ড. আতাউর বলেন, “শেখ হাসিনা খুবই দক্ষতার সাথে সব সামলে নিয়েছেন। তাঁর শাসনামলের দুইটি দিক আছে, একটা রাজনৈতিক এবং অন্যটা অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক দিকে তিনি ভালো করেছেন, এটা মোটামুটি সব মহলই স্বীকার করছে। বৈষম্য, দুর্নীতি, অর্থপাচার বেড়েছে, তবুও অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শেখ হাসিনার একটি বড় অর্জন। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর কিছু নেতিবাচক অর্জনও আছে।” ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তার শাসনামলে প্রায় সাড়ে পাঁচশ গুমের ঘটনা ঘটেছে। সেইসঙ্গে ঘটেছে কয়েক হাজার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা।
শেখ হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘খুব বেশী’ কথা বলাও ‘ঝূঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তাঁর ভাষ্য, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তিনি ‘জিরো-টলারেন্সের’ কথা বলেছিলেন, তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এটা ছিল। কিন্তু গত ১০ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো কমেইনি, বরং এর সাথে যুক্ত হয়েছে গুম। মানুষ আগেও ‘গুম’ হয়েছে, কিন্তু এটা মাত্রাতিরিক্ত ঘটেছে এই সময়টায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মি-সমর্থক নেতা থেকে শুরু করে সাবেক রাষ্ট্রদূত, এমনকি সেনাকর্মকর্তারাও গুম হয়েছেন। এই যে বর্বরতা, এটা বাঁধাহীন ভাবে নির্বিচারে চলেছে। এটা সরকারের বিরোধী মতের ওপর দমন পীড়নেরই বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি।”
ছবি: সংগ্রহিত |
গত বছর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও কঠোরভাবে দমন করার অভিযোগ আছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। বিতর্কিত ধারা বহাল রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন করার দায়ও বর্তানো হয় তাঁর ওপর। এ ব্যাপারে লিটন বলেন, “তুমুল প্রতিবাদের পরও বাকস্বাধীনতা হরণকারী আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাকে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরো শক্তভাবে প্রতিস্থাপিত হতে দেখলাম। এসব আইনে অনেক ক্ষেত্রে জামিনের অধিকারও দেওয়া হয়নি।মত প্রকাশের দায়ে ইতিমধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, নারী অধিকার কর্মি, সমাজকর্মি, ছাত্রসহ অসংখ্য মানুষকে কারাবরণ করতে দেখেছি।”
ড. শান্তনু বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখছে একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বাক-স্বাধীনতাহরনকারী আইন জারির অভিযোগ রয়েছে; অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের ঝূঁকি অসাধারণভাবে কমে গিয়েছে। যে কারণে অভ্যন্তরীন কোনো ইস্যুতে তারা শেখ হাসিনার সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, বাক-স্বাধীনতাহরন আমাদের শাসনব্যবস্থার অংশ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে বড় অভিযোগগুলো, সেগুলোও অনেকখানি ‘ব্লার’ (অস্পষ্ট) করে দিতে পেরেছে।”
যদিও লিটনের দাবি, “রোহিঙ্গাদের বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থান অবশ্যই মানবিক। তবে তা দিয়ে আভ্যন্তরীন মানবাধিকার লংঘনকে ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা (মানবাধিকার কর্মিরা) দীর্ঘদিন ধরেই একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। যে কমিশন ২০০৪ সালের পর থেকে এখন যত বিচার বহির্ভূত হত্যা বা গুম হয়েছে তা তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করবে, বিচারের আওতায় আনবে। আওয়ামী লীগ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অর্থাৎ এই ইস্যুতে শেখ হাসিনার নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।”
নানা ‘বিতর্ক’ থাকলেও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল উল্লেখ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অরুন বলেন, এক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা সফল হয়েছেন। বিরোধীরা সবসময় তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ বললেও তিনি তাদের সাথে সংলাপ করেছেন। রাজনৈতিক কৌশলে পরাভূত হয়ে সব রাজনৈতিক দলই এবার তাঁর সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল, তারই জেরে দীর্ঘদিন এদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন হয়নি।”
অরুন আরো বলেন, “মূলত সামরিক শাসন বারবার এই আস্থা-বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনেছে। শেখ হাসিনা এই নির্বাচন সফলভাবে সামলিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সেই আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে এনে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর এই ভূমিকা ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লেখা থাকবে।”
তবে “শেখ হাসিনার ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা আছে,” উল্লেখ করে ড. শান্তনু বলেন, “কিছুদিন আগে আমরা দেখতে পেয়েছি তিনি ‘কওমী জননী’ উপাধিও পেয়েছেন। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁর দলটি ধর্মনিরপেক্ষ।” এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি আতাউরের অভিমত, “অনেক সময় তাঁকে (হাসিনা) আপোষও করতে হয়েছে। যেমন – ইসলামিক দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের দূরত্ব ঘোচাতে নমণীয় হয়ে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন।”
দেশের ডানপন্থী রাজনীতির মূলশক্তি হিসেবে বিএনপির শক্তিশালী খর্ব হওয়ায় সৌদিআরবসহ মুসলিম বিশ্বের ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে বিএনপি একচেটিয়া অবস্থান টলে গেছে বলে দাবি করেছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, মুসলিম দেশগুলোর কাছে শেখ হাসিনাও এখন গ্রহনযোগ্য একটি নাম। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দেওয়াটা তাঁর জন্য খুবই ইতিবাচক হয়েছে।
ছবি: সংগ্রহিত |
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর ব্রিটেনভিত্তিক গণমাধ্যম চ্যানেল ফোরের একটি প্রতিবেদনে তাঁকে ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ আখ্যায়িত করা হয়। এর আগে তাঁর শাসনামলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসান হয়েছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং পরিবেশ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হাসিনাকে বিভিন্ন সম্মানসূচত ডিগ্রি এবং পুরস্কার প্রদান করেছে।
ব্যক্তিগত জীবন ও স্বজন : ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মানো শেখ হাসিনার পরিবারের সাথে ১৯৫৪ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ানরত অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার সাথে। তিনি ২০০৯ সালের ৯ মে ইন্তেকাল করেন। এই দম্পত্ত্বির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
ছোট বোন শেখ রেহানাকে আদর করছেন শেখ হাসিনা |
ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ একজন তথ্য প্রযুক্তিবিদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টাও। মেয়ে সায়মা হোসেন ওয়াজেদ একজন মনোবিজ্ঞানী এবং তিনি অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণে কাজ করছেন। সাধারণত অবসর পান না শেখ হাসিনা, পেলেই রান্না করেন, বই পড়েন। এছাড়া তিনি তাঁর সাত নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে ভালবাসেন তিনি। গত বছরের নভেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া তথ্যচিত্র ‘হাসিনা: এ ডটার্স টেল’ –এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
চলতি মাসে নিজ দলের নেতাদের দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষ এবং দেশের সূবর্ণ জয়ন্তীতেও ক্ষমতায় থাকছে তাঁর দল। তবে “তিনি লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকা শুধু তাঁর দল নয়, সমগ্র জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলছিলেন ড. শান্তনু।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) এই নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, “দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় বর্তমানে আওয়ামী লীগে অনেক আবর্জনা যুক্ত হয়েছে। সরকারি দল হিসেবে তাদের এখন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে আগামীতে তাদের নাম করে কেউ অপরাধ করার সাহস না পায়।” নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে শেখ হাসিনা যে অপূর্ব সুযোগ পেয়েছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এরকম সুযোগ খুব কম মানুষ পেয়েছে। আশা করি, তিনি এটার সদ্বব্যবহার করবেন।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন