Powered By Blogger
চাঁপাইনবাবগঞ্জ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
চাঁপাইনবাবগঞ্জ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১৬ এপ্রিল ২০১৯

নয়াখোলার শেষ কম্বল শিল্পীর গল্প

সালামত উল্লাহ।
‘ছয় ভাই, এক বোনের সকলে; এমনকি বোন জামাই আর ভাইয়ের বউরাও ভেড়ার লোমের কাজ করতেন। আমার ওস্তাদ ছিলেন বড়ভাবী। তিনিই আমাকে কাজ শিখিয়েছেন। এখন অবশ্য আমি ছাড়া আর কেউই এ কাজ করেন না। বড় ভাই আর তার মেয়ে করতেন। তারাও ছেড়ে দিয়েছেন। বড় ভাই এখন গ্রাম ডাক্তার।’ আঞ্চলিকতার সাথে খানিকটা বিহারী মেশানো ভাষায় একটু থেমে কিছুটা গল্পচ্ছলে কথাগুলো বলছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের নয়াখোলা এলাকার সালামত উল্লাহ। 
২০১৪ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহের বর্ষাস্নাত এক সকালে তাঁর সাথে কথা হয়। কৈশোরে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভেড়ার লোমের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন নিজের জীবন। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে অর্ধশতক। গত ৫০ বছরে কত ঘটনার মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছে তাঁকে। এই পেশার আয়েই নিজের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তাও প্রায় ১৭ বছর হয়ে গেছে। 
সালামত বলতে থাকেন, ‘১৫-১৬ বছর আগেও এই নয়াখোলার ২০ পরিবারের ৫০-৬০ জন মানুষ ভেড়ার লোমের কম্বল তৈরীর কাজে জড়িত ছিলেন। আর এখন আমি ছাড়া আর কেউ নাই।’ ভেড়ার লোম কাটা থেকে শুরু করে, লোম বাছাই, জাত অনুযায়ী আলাদা করা, ধুনানোর পর তুলা তৈরী, তুলা থেকে সুতা আর সুতা দিয়ে কম্বল বুনানো, বুনন করা কম্বল পানিতে ভিজিয়ে জমাট করে তা শুকানো, এসব তিনি একাই করেন। আগে কিছু কাজে সহধর্মীনির সাহায্য পেতেন। তাঁরও বয়স হয়ে গেছে। ‘এখন আর আগের মত পারে না’- বলে থেমে, একটু হাসলেন সালামত। 

সালামতের পূর্বপুরুষের বাড়ি ভারতের মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর। দেশভাগের পর আরো অনেক মুসলমান পরিবারের সাথে তারাও এ পাড়ে চলে আসেন। ওই সময় থেকেই বংশ পরম্পরায় পাওয়া ভেড়ার লোমের কাজ ছেড়ে পেশা বদলাতে শুরু করেন তাঁর জ্ঞাতিদের অনেকে। তবে কিছু মানুষ তাদের পুরানো পেশা আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তেমন চেষ্টাই ছিলো সালামতের পিতার। যা জারি রেখেছেন সালামতও। 

‘শুধু কম্বল না, এককালে কার্পেটও তৈরী হত এখানে’ - এমনটা উল্লেখ করে সালামত জানান, ভেড়ার লোম সংগ্রহে তাঁর কোনো খরচ হয় না। সারাদেশের ভেড়া মালিকরাই তাঁর কথা জানেন। তারা কোনো দাম-তো রাখেনই না, উল্টো নিজেদের খরচেই তাঁকে ভেড়ার লোম কাটাতে নিয়ে যান। লোম বাছাই করতে করতে পাশে রাখা দুটি বস্তা দেখিয়ে তিনি জানান, ওখানে মোট দেড়শো ভেড়ার লোম রয়েছে। সম্প্রতি তিনি নোয়াখালী থেকে কেটে এনেছেন। এভাবে সারা দেশ থেকেই তিনি ভেড়ার লোম সংগ্রহ করে বেড়ান। 
২০টি ভেড়ার লোম দিয়ে যে সুতা তৈরী হয়, তা দিয়ে অনায়াসে পাঁচ দৈর্ঘ আর তিন হাত প্রস্থের একটি কম্বল তৈরী করা সম্ভব। সালামত তাঁর প্রতিটি কম্বল বর্তমানে (২০১৪ সালে) মাত্র সাতশ টাকা করে বিক্রি করেন। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতি মাসে তিনি গড়ে ১০-১২ টি কম্বল তৈরী করতে পারেন। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিরও সহায়তা নিচ্ছেন খানিকটা। ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরী তুলো এখন আর তিনি হাতে ধুনন করেন না। শিবগঞ্জ তুলোধুনোর মেশিনে ধুনন করিয়ে আনেন। সেখানে প্রতি কেজি তুলো ধুননে ১২ টাকা করে নেয়।
আলাপ ও ছবি তোলা শেষে ফেরার সময় খাদে নামানো অদ্ভুত নিঃসঙ্গ স্বরে সালামত শুধু জানতে চেয়েছিলেন ‘আবার আসবেন তো?’ নয়াখোলার শেষ কম্বল শিল্পীর চোখে তখন রাজ্যের বিষাদ। পরক্ষণেই মায়াভরা হাসিতে বিষন্নতা লুকিয়ে বলেন, ‘আমি মরলে তো এখানকার কেউ আর এই কাজ দেখাতে পারবে না।’ 

নিজের তৈরী কম্বল দেখাচ্ছেন সালামত।
বাংলাদেশ-জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাস্তবায়িত এক প্রকল্পের আওতায় শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সেতুচি ক্যাটালগ - বাংলাদেশ ক্রাফটস’ শীর্ষক প্রকাশনায় আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেছিলাম বছর চারেক আগে। যে কাজে সংযুক্ত করার পাশাপাশি আমায় পথ দেখিয়েছেন লেখক ও গবেষক অনার্য তাপস, আর চাঁপাইয়ে গিয়ে পেয়েছি গম্ভীরা শিল্পী ফাইজুর রহমান মানি, সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং তরুণ আইনজীবী মেরাজ হোসেনের সহায়তা । ছবি তুলতে তুলতে সেবার যেসব গল্পের সন্ধান পেয়েছিলাম, তার কয়েকটি ব্লগ পাঠকদের জন্য এখানে টুকে রাখার তাগিদ অনুভব করছি।
newsreel [সংবাদচিত্র]