Powered By Blogger
আত্মঘাতী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
আত্মঘাতী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২৫ এপ্রিল ২০১৯

হিমু ভাই, দেখা হবেই - ‘মিস’ নাই ..

“ছবিটা সম্ভবত ২৫ এপ্রিল দুপুরের দিকে রানা প্লাজার পিছনে তোলা। তার কিছুক্ষণ আগে
পৌঁছানোর পর আমি কাঁকন, সাদিকসহ আরও কয়েকজন মিলে অর্ধেক মাটির নিচে থাকা এক
মহিলার লাশ টেনে বের করি,” এমন ক্যাপসন দিয়ে ফেসবুকে এই ছবিটি প্রকাশ করেছিলেন হিমু।
বাংলাদেশী গণমাধ্যমের তৎপরতার প্রসংশা এখন সর্বজন বিদিত। যে কোনো ঘটনায় আমাদের, মানে সাংবাদিকদের ‘ব্রেকিং’ দেওয়ার প্রতিযোগীতা এখানে বিশ্বমানের। অথচ হিমালয় হিমু ওরফে নওশাদ হাসান হিমুর মৃত্যুর ১২ ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে নিয়ে সংবাদ দেখলাম শুধুমাত্র ডেইলি স্টারে, যার শিরোনাম “গায়ে আগুন দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ রানা প্লাজা স্বেচ্ছাসেবকের।” এছাড়া প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে “তুই পাগল না মুই পাগল” শিরোনামে প্রকাশিত ফারুক ওয়াসিফের লেখা এক মতামতের মধ্যে খবরটি উল্লেখ রয়েছে। 
ফারুক লিখেছেন, “তার সঙ্গে দেখা রানা প্লাজা ধসের দিন। কী এক উন্মাদনার বশে ধ্বংসস্তূপ থেকে আহত ও নিহত লোকজনকে সরিয়ে আনছিল। হাতুড়ি-ছেনি-করাত দিয়ে উদ্ধার করছিল। হয়তো তার জন্য কারও হাত বা পা-ও কাটতে হচ্ছিল। পাগলটা কবিতাও লিখত। কিন্তু মৃত্যুপুরীর সেই দুঃসহ স্মৃতি সে আর ভুলতে পারেনি।” 
“রানা প্লাজার নিহত ব্যক্তিদের মতো তাকেও ভুলে যাচ্ছিল সবাই। দিনে দিনে অবসাদের চোরাবালি ঘিরে ধরে তাকে। ফেসবুকে একের পর এক স্ট্যাটাস দেখেও কেউ বুঝতে পারেনি যে রানা প্লাজা ধসের দিন ঘটবে আরেকটি ধস। গতকাল ২৪ এপ্রিল গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে সে,” যোগ করেন তিনি। 

সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক আসগর আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, “এটি আত্মহত্যার ঘটনা। তবে তার মৃত্যুর পেছনে কারণগুলো এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।” 

এর আগে বুধবার দিবাগত রাতে হিমুর মৃত্যুর খবরটি চাউড় হলে সাংবাদিক এম জে ফেরদৌস ফেসবুকে লেখেন, “রানা প্লাজায় যারা উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলো তারা সবাই কমবেশি হিমুকে চেনে। হিমালয় হিমু, উদ্ধারকাজে ওর তৎপরতার কারণেই কিনা জানি না, অনেকেই ওরে ‘কালাপাহাড়’ বলে ডাকতো। কয়েকঘন্টা আগে হিমু গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ২৪ এপ্রিল, তাও সেটা সাভারেই।” 

বন্ধুরা জানাচ্ছে, সহস্রাধিক প্রাণ কেড়ে নেওয়া রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনার পর থেকে গত ছয় বছর হিমু আর কাঁচা মাংস ধরতে পারত না, কোনো সুগন্ধিও সহ্য হতো না তাঁর। এই ডগ ট্রেইনার ও আইনজীবি এক সময়ে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর এই মৃত্যুকে প্রতিবাদও ভাবছেন অনেকে। 
ফেসবুকে পশ্চিমবঙ্গের কবি অতনু সিংহ লিখেছেন, “আত্মহত্যা কখনো কখনো ব্যক্তির রাজনৈতিক বিদ্রোহ৷ দার্শনিক একটি কাজও বটে। হিমালয় হিমুর মৃত্যু তাই আমাদের অপরাধী করে দেয়!” 
কাল রাতে যখন খবরটি পেলাম ফেসবুক মেসেঞ্জারে হিমায়ল হিমুকে তখনও ‘অনলাইন’ দেখাচ্ছে, অথচ তাঁর বন্ধুরা বলছিলেন তিনি চিরতরে ‘অফলাইনে’ চলে গেছেন। মাত্র তিন-চার দিন আগে এই মানুষটির সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার। 

সাভারের বিরুলিয়ার সাদুল্লাপুর গ্রামে গিয়ে তাঁর দেখা হয়েছিল মূলত বন্ধু রাজীব আশরাফের কল্যাণে। কুকুরের প্রতি হিমুর অকৃত্রিম মমত্ত্ব বোধ দেখে সেদিন আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম। সাদুল্লাপুর থেকে একইসঙ্গে ঢাকায় ফিরেছিলাম আমরা, সাথে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ধার করে আনা একটি মুমূর্ষ কুকুর। সেটিকে কোলে করে মোহাম্মদপুরের এক পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন হিমু। দিয়া বাড়ি ট্রলার ঘাট থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাঁকে বলেছিলাম, “শিগগিরই ফের দেখা হবে।” হিমু বলেছিলেন, “অবশ্যই ভাই।” 

তিনি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন শুনে তাঁর প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম মাত্র দুই ঘন্টা আগে ‘হ্যাশট্যাগ’ দিয়ে লিখেছেন, ‘জয়বাংলা - প্যারা নাই’। তার সামান্য আগে লিখেছেন, ‘কোনো মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’। এর ঘন্টাখানেক আগে হিমু একইভাবে লিখেছেন, ‘আগুন সর্বগ্রাসী, তাই ভালোবাসি’। তারও আগে মোটা চার ঘন্টায় চারটি ‘স্ট্যাটাস’ দিয়েছেন তিনি। এক ও দুই ঘন্টা আগে লেখেন একইকথা, ‘ছোটকাল হৈতেই আগুন আমার অনেক পছন্দ’। এর ঠিক আগের দুই ঘন্টায় তিনি লিখেছেন, ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে *দাইতে লাগিল’ এবং ‘এমনি করেই হয় যদি শেষ হোক না’। 

হিমু’২০১৫
হিমুর বাড়ি উজিরপুরে হলেও বেড়ে উঠেছেন পটুয়াখালীতে। আমি বরিশাল শহরে বড় হয়েছি জেনে বলেছিলেন, তিনিও একে স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। আরো কি কি নিয়ে জানি কথা হয়েছিল আমাদের, যা খুব সামান্য সময়ের হলেও তাঁর অসাধারণ সারল্য অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল। যে কারণে তাঁর হলদে হাসিটা স্মরণে আসতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার। রাজীব বলছিল, হিমু কুকুরদের জন্য একটা সেবাকেন্দ্র খুলতে চায়। তাঁর এই পশুপ্রেম নিয়ে হয়ত লিখতাম কখনো, কিন্তু হায় মানুষ কত দ্রুত হারিয়ে যায়। 

হিমুর আরো দুটি লেখা খুব মনে লেগেছে। গত পরশু তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিদিন মনে মনে শখানেক মানুষ খুন করি’। আরো লিখেছেন, আত্মহত্যাকারী যদি কাপুরুষ হয় তাইলে যারা স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে তাঁরা বোকা*দা।” 

আপাতত বিদায় হিমু ভাই, তবে আপনার সাথে দেখা হবেই, ‘মিস’ নাই। 

১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

হুমকীতে ভারতবর্ষের সুফিভাব

[খবর: পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে একটি মাজারে আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৭৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) সন্ধ্যায় শেহওয়ান এলাকার ইন্দুস হাইওয়ের কাছে এ বোমা হামলার ঘটনাটি ঘটে। লাল শাহবাজ কালান্দার মাজারে এই হামলার দায় স্বীকার করে আমাক নিউজ এজেন্সিতে বিবৃতি দিয়েছে আইএস।]

‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ - গানটির কল্যাণে সিন্ধী সুফি ঝুলেলাল শাহবাজ কালান্দার (১১৪৯-১২৭৪ খ্রি.) শুধু পাকিস্তানে নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেই কমবেশী পরিচিত, সাধক সমাজে বেশ জনপ্রিয়ও। তার মাজারের মতো ভারত-বাংলাদেশের বহু মাজার আর আখড়ায়ও প্রতি বৃহস্পতিবার স্থানীয় ভক্তরা জড়ো হন। এমন একটি দিনে অত বিখ্যাত মাজারে এই আত্মঘাতী হামলা আদতে ভারতীয় সুফি দর্শনকে মধ্যপ্রাচ্যের আইএস (ইসলামিক এস্টেট) দর্শনের হিংস্রতম হুমকী বলেই মনে হচ্ছে। 
বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো পরিচালনাকারিদের কাছে বাংলাসহ সারা ভারতের সকল মাযার, আখড়া, সাধন গৃহসহ সব ধর্মের তামাম ধর্মালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। মনে রাখবেন হে রাষ্ট্রনায়কেরা, আপনাদের ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কাই জনগণকে আতঙ্কিত করে।
‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ মূলত উর্দূ আর পাঞ্জাবি মিশ্রিত ভাষার একটি গান। যদ্দুর জানা যায়, এটি প্রথম লিখেছেন আমীর খসরু (রা)। পরে সামান্য পরিবর্তন করে গানটিকে উপাসনার জন্য তৈরি করেন বুল্লে শাহ (রা)। এরপর সিন্ধী কবিরা গানটিকে আরো পরিবর্তন করে ঝুলেলাল শাহবাজ কালানান্দারের স্তুতি সঙ্গীতে পরিণত করেন। 
সোহরাওয়ার্দিয়া ত্বরিকার অনুসারী এই সুফি দার্শনিক ও কবির আসল নাম ছিলো সৈয়দ মুহাম্মদ উসমান মারওয়ান্দি। তিনি মারওয়েন্দের দরবেশ সৈয়দ ইব্রাহিম কবিরউদ্দিনের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ বাগদাদ থেকে চলে আসেন। মারওয়েন্দে স্থায়ী হওয়ার আগে তারা মাশহাদে বসতি স্থাপন করেছিলেন।

বেশ প্রাসঙ্গিকভাবে, সম্ভবত ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ - গানটির কারণেই আজ স্মরণে এলেন প্রখ্যাত কাওয়ালি শিল্পী আমজাদ সাবরি। গত বছরের (২০১৬ খ্রি.) জুনে পাকিস্তানের করাচির লিয়াকতবাদ এলাকায় গুলি করে হত্যা হয়। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে কাওয়ালি অর্থাৎ সুফি ঘরানার ভক্তি সঙ্গীতের জগতে শীর্ষ একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমজাদ সাবরি। তার প্রয়াত বাবা গুলাম ফরিদ সাবরি সাবরি ব্রাদার্স নামে কাওয়াল সঙ্গীত দলের প্রধান গায়ক ছিলেন। সত্তর দশক থেকে সাবরি ব্রাদার্স উপমহাদেশের সুফি সঙ্গীতের জগতে ঝড় তুলেছিলো। শুধু তারাই নন - নূরজাহান, নুসরাত ফতেহ আলী খান, ওয়ার্দি ব্রাদার্স মতো উপমহাদেশের আরো অনেক প্রখ্যাত শিল্পী ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ গেয়েছিলেন। আবিদা পারভিন, রুনা লায়লারা গানটি এখনো গেয়ে থাকেন। 
অনেক পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, বাংলাদেশে ইসলামের নামে চলমান ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়কদের টার্গেডে শুধু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, সংখ্যালঘু বা বিদেশীরা নন, সুফিভাবের অনুসারীরাও আছেন । 
ঢাকার একটি মাজারের চিত্র
২০১৬ সালের মে মাসেই কুষ্টিয়ায় বাউল সাধক লালনের ভক্ত, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক মীর সানাউর রহমানকে কুপিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস। একই সময়ে রাজশাহীর তানোর উপজেলার সুফি সাধক, মুদি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে হত্যা করা হয়। তার আগের মাসে, মানে এপ্রিলে একই কায়দায় খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মুক্তমনা অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম। চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতপ্রেমী হিসেবে পরিচিতি ছিলো তার। আরো আগে ২০১৪ সালের নভেম্বরে প্রকাশ্য সড়কে খুন হয়েছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলাম , যিনিও লালন ভক্ত ছিলেন।

এর আগে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ঢাকায় মধ্য বাড্ডার নিজ বাসায় সুফিবাদী পীর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খানকে জবাই করে হত্যা করা হয়। একই মাসে আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলার সময় পুরনো ঢাকা হোসেনী দালান চত্বরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় একজন নিহত হন। তার আগের মাসে চট্টগ্রাম নগরের আকবর টিলা এলাকায় ‘ল্যাংটা ফকিরের মাজারে’ রহমতউল্লাহ ওরফে ল্যাংটা ফকির ও তার খাদেম আবদুল কাদেরকে জবাই করা হয়। আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালের আগস্টে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে  ইমাম মাহদির প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুক, তাঁর বড় ছেলে ও চার অনুসারীকে গোপীবাগের বাসায় ঢুকে  জবাই করে দুর্বৃত্তরা।
এসব দেখেশুনেও কেন যে সুদিনের আশায় থাকি! ঠিক বুঝি না কি করে ভাবি একদিন এই দুনিয়ায় আর কোনো মতাদর্শিক হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। বোধকরি - সেদিন এ ধরায় কোনো মানুষই থাকবে না। 
লালনের মাজারে ভক্তকূল
newsreel [সংবাদচিত্র]