Powered By Blogger
১৪ ডিসেম্বর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
১৪ ডিসেম্বর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

যেদিনের ক্ষত ঘুচবে না কখনো

বধ্যভূমি, ১৯৭১
শোকাবহ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ। বাঙাল জাতির চিন্তা ও দর্শনে গভীর ক্ষত তৈরী হওয়ার দিন। একাত্তরে এই দিন রাতেই বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। নয় মাসের রক্তগঙ্গা পেরিয়ে গোটা জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে, দেশের পূর্ব দিগন্তে বিজয়র লাল সূর্য উদিত হচ্ছে; ঠিক সেই সময় আসে নির্মম এই দিন। 
শত শত জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তচিন্তার মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সাথে ছিল তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। তাদের নির্মমতার শিকার হওয়া জ্ঞানীগুণি ও মুক্তচিন্তা মানুষদের স্মরণ করতেই প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এই বিশেষ দিবসটি ঘোষণা করেছিলেন। আজও যথাযোগ্য মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্য সহকারে দিনটি উদযাপন করছে জাতি। 
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর স্বজনেরা তাদের লাশ খুঁজে পায়। বর্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। তাদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা। অনেকের শরীরে ছিল অজস্র। অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকে তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। 

১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা সূত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মোট সংখ্যা এক হাজার ৭০ জন। বাংলা একাডেমির ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) থেকে জানা যায়, ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন। তবে তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও গ্রন্থে সরাসরি স্বীকার করা হয়েছে। 

একাডেমি এ গ্রন্থে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কন্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারি, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। মূলত মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চ কাল রাত থেকেই শুরু হয়েছিলো বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। 

সর্বোচ্চ শহীদ শিক্ষাবিদেরা

একাত্তরে বৃহত্তম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এর আগে ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে স্বল্পসময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। 
মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। ওই দিন রাতে শুধু ঢাকাতেই প্রায় দুইশ বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী সারাদেশে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক এবং ১৬ জন অন্যান্য পেশার (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলী) মানুষ ছিলেন। 
লাশের স্তুপ, ১৯৭১।
তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের উপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। এমনকি আত্মসমর্পণ ও যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পরেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তার সহযোগীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। 

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৮, মতান্তরে ২৯ তারিখে বেসরকারিভাবে একটি বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশনের আহবায়ক ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। তার প্রস্তুত করা প্রতিবেদনটি পরে আর প্রকাশিত হয়নি। পরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী এদেশের হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারেনি তারা।’ 

ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিলো একের পর এক শীর্ষ বুদ্ধিজীবীকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা। জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করেই আঘাত হেনেছে।’ পরে জহিরও ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি যিনি নিখোঁজ হন। তার আগে তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর একটি সরকারি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু তার ওই সিদ্ধান্তও কার্যকর হয়নি। 

২৫ বছর পর মামলা দায়ের

স্বাধীনতার ২৫ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর ১৫)। ওই হত্যা মামলায় আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। 
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের মুখ্য ভূমিকায় ছিল জামায়াতে ইসলামির গঠিত আল বদর বাহিনীর।
মামলাটি দায়ের করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু। মামলার তিনি এজাহারে বলেছেন, তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও মুহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঘাতকরা মুহসীন হল সংলগ্ন বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে হলের দিকে যায়। হলের সামনে তাকে পেয়ে দারোয়ান আবদুর রহিমের গামছা নিয়ে চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির একটি মাইক্রোবাস যোগে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। 

আরো দুটি লাশ।
ঘাতকরা অন্যান্য হাউস টিউটরের বাসায়ও যায়। এ সময় ওই হলের ছাত্র ছিলেন বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। পরে তারা জানতে পারেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালরে শিক্ষকদের মধ্যে ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সিরাজুল হক ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ আরো অনেককে ধরে নিয়ে গেছে আলবদররা। 
শহীদ বুদ্ধিজীবী মো. মুর্তজার ও সিরাজুল হকের ছেলে এনামুল হক অপহরণকারীদের দু’জনকে চিনতে পারেন। তারা হলেন চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। দু’জনই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাইনুদ্দীন দৈনিক পূর্বদেশ এব আশরাফুজ্জামান তৎকালীন অবজারভার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। 
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর ফরিদা বানু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছেড়ে আজিমপুরে ভাড়া বাসায় চলে যান। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তিনি তার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ড. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ দেখতে পান। ৫ জানুয়ারি মিরপুরের বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে গিয়ে তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদের গলিত লাশ পান। লুঙ্গি ও জামা দেখে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন তিনি। 

বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন-১৯৭১ একটি দলিলে এই তালিকা প্রণয়নে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ভূমিকা রয়েছে বলেও জানতে পারে।  টার্গেড তালিকা প্রণয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও হাত ছিল । অপারেশন ইন-চার্জ ছিলেন মঈনুদ্দীন আর আশরাফুজ্জামান প্রধান জল্লাদ। প্রথমজন লন্ডন এবং অপরজন নিউইয়র্ক প্রবাসী। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনারও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
লাশ আর লাশ।
১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেওয়া সাক্ষ্য মতে রায়েরবাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি হতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায়, যাদের সে নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল। 

চৌধুরী মঈনুদ্দীন ৭১ সালে জামায়াতে ইসলামির কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে পৌঁছে দিতেন। এছাড়া আরো ছিলেন এ বি এম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আবদুল মান্নান (ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী), আবদুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ।

চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং গিয়াস কাদের চৌধুরী।

আরো পড়ুনঃ
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রকাশিত ডাকটিকিট।
newsreel [সংবাদচিত্র]