Powered By Blogger

৩০ জুন ২০১৭

আহমদ ছফার পঁচাত্তর

আহমদ ছফা
‘২৭ তারিখ (মার্চ, ১৯৭১) ভোরবেলা ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনলাম। আর সেই সঙ্গে নীচে এক উন্মাদ উদভ্রান্ত চিৎকার, নেই নেই কেউ নেই। দৌড়ে বাইরে এসে দেখলাম ছফা পাগলের মত চিৎকার করে বলছে —কেউ নেই, গোবিন্দদেব নেই, জ্যোতির্ময় গৃহঠাকুরতা নেই, মনিরুজ্জামান স্যার নেই, মুকতাদির নেই। ও চেঁচাতে চেঁচাতে ক্যাম্পাস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রদক্ষিণ করে গেল।’

‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী’ শীর্ষক লেখায় এভাবেই আহমদ ছফার কথা উল্লেখ করেছেন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি তখন ঢাবির শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই থাকতেন। রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘১৯৭১ : ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয় লেখাটি। 
আজ ৩০ জুন, ২০১৭ —আহমদ ছফার ৭৫তম জন্মদিন। ১৯৪৩ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে তার জন্ম। পিতা মরহুম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে ছফা ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী লেখক, কবি ও সমাজবিজ্ঞানী। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। প্রথাবিরোধী আচরণের পাশাপাশি নির্মোহ ও অকপট দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য আলোচিত ছিলেন।
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তার পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন।

১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ছফা। একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে।পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন।

ছফার গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ সালে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যোটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যে জ্ঞান তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সাহস জুগিয়েছিল।

সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে তিরিশটির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ একটি উপন্যাস- সূর্য তুমি সাথী। প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে।স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় তার প্রবন্ধ গ্রন্থ জাগ্রত বাংলাদেশ। প্রকাশকাল শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ সালে।

১৯৭০ সালে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন।দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৭২ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ ধারাবাহিকভাবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনা প্রকাশ করেন। এর কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। ১৯৭৯ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশ পায়। ১৯৮০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। বাংলা একাডেমি থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে।

ছফা মহাকবি গ্যোতের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ সালে । মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির গোপন-রহস্য, শৌর্য মৃত্যু ও কপটতার গীতিকা এই উপন্যাস। ১৯৯৬ সালে পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ এবং অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী প্রকাশিত হয়। ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ পূর্বে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্ণিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। জাপানী ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে। পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তাঁর এই উপন্যাসে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে।
তার জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। ২০০১সালে আহমদ ছফা রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পায়। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৮০ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। ২০০২ সালে তাকে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধজীবী গোরস্থানে তার দাফন হয়।
ছবিটি কবি টোকন ঠাকুরের সংগ্রহশালা থেকে নেয়া
** লেখাটি মূলত গত বছর নিউজনেক্সটবিডি ডটকম - এর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিলো। 

২৯ জুন ২০১৭

লিটন বাশার : এক অদম্য চেতনা

রাজপথে লিটন বাশার
যাদের হাত ধরে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম ─ তাদেরই একজন লিটন বাশার। তিনিও অসময়ে চলে গেলেন! ঈদের পরদিন দুপুর অবধি নিদ্রাবিলাসের রেওয়াজ বদলানো হয়নি বলেই দূরালাপনীর ঘুম ভাঙানিয়া তলবে পেলাম খবরটা। জানালেন জাফর ভাই, মানে সাংবাদিক আবু জাফর সাইফুদ্দিন। তার সাথে কথা শেষ করার একটু পরই স্মরণে এলো অতীতের এক বিষাদগ্রস্থ সকাল, ঠিক সাত বছর একদিন আগের। সেদিনও জাফর ভাইয়ের কথাযন্ত্রের ডাকে জেগে উঠেছিলাম, পেয়েছিলাম সাংবাদিক এসএম সোহাগের মৃত্যু সংবাদ। সেই ২০১০ থেকে এই ২০১৭; এর মধ্যে আমরা, মানে আমি আর জাফর ভাই বহুবার পরস্পরকে খুঁজেছি শুধুমাত্র সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর সংবাদ দিতে। 
লিটন বাশার ও এসএম সোহাগ, দু’জনেই ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের কিংবদন্তীতূল্য আরেক প্রয়াত সাংবাদিক মাইনুল হাসানের স্নেহধন্য; কাছের মানুষ। আবার জাফর ভাই ছিলেন তাদের একান্ত আপন। সৌভাগ্যজনকভাবে আমি তাদের প্রত্যেকের ভালোবাসা পেয়েছি, সাথে অকৃত্রিম আস্কারাও। দক্ষিণাঞ্চল কেন্দ্রীক যে কোনো সমস্যায় উদ্ধারকর্তা হিসেবে এ নামগুলোই সর্বাগ্রে মাথায় এসেছে বছরের পর বছর।
বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকায় শিক্ষানবিশ রিপোর্টার পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে সাংবাদিকতা এসেছিলাম। এর আগে জীবনের প্রথম সাক্ষাতকারে যে তিনজন মানুষের মুখোমুখি হতে হয়; তারা হলেন পত্রিকাটির তৎকালীন মালিক ও সম্পাদক সৈয়দ দুলাল, বার্তা সম্পাদক স্বপন খন্দকার এবং যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক লিটন বাশার। তারা সেদিন পছন্দ না করলে আমার সাংবাদিকতা শুরুর পথ হয়ত এতটা সুগম হতো না। কারণ পরবর্তীতে তাদের তিনজনকে-ই দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি।
সচ্ছ ও স্পষ্টভাষী লিটন’দা কে দেখেই শিখেছিলাম ‘আক্রমনাত্বক’ (Agressive) সাংবাদিকতা। ভয় শব্দটা সম্ভবত তার অভিধানেই ছিলো না। কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলতে দেখিনি কখনো, নিজের বন্ধু-স্বজনদেরও না। সততার শক্তিতে বলীয়ান এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের কারণে তার বন্ধু, শত্রু - দুটোই হয়েছে ঢের। তবে পরম দুর্জনও তাকে অশ্রদ্ধা বা অসম্মান করতে পারেনি কখনো। 
স্মৃতিবহুল এক কোরবানীর ঈদ কাটিয়েছিলাম দাদার বুখাইনগরের গ্রামের বাড়িতে। প্রায় এক যুগ আগে, ২০০৬ এর জানুয়ারিতে। মূলত গিয়েছিলাম সাপ্তাহিক ২০০০ ─ এর এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে, চরমোনাইয়ের তৎকালীন পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীমের সাক্ষাতকার নিতে। মূলত হুজুরের বড় ছেলে, চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের সেই সময়ের চেয়ারম্যান, বর্তমান পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সাথে লিটন’দার সখ্যতার সুবাদে আমি সাক্ষাতের সুযোগ পাই। ঈদের দিন সন্ধ্যায় আমি দাদার বাড়িতে পৌঁছাই। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন তিনি। ঘন কুয়াশার সেই রাতে দু’জনে মোটরসাইকেলে চেপে চরমোনাই দরবার শরীফে পৌঁছাই। দরবারের হুজরাতে ঢুকে পীর সাহেবের সাথে কুশল বিনিময়ের পর দাদা বেশ প্রশংসাত্মক ভঙ্গিতে আমায় পরিচয় দিয়ে জানান, আজ তার কোনো জিজ্ঞাসা নেই, সব প্রশ্নই আমার। 

এরপর প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ফজলুল করীম আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। পুরোটা সময় পাশেই ছিলেন লিটন’দা। মাঝে মাঝে চোখে চোখ রেখে সাহস জাগানিয়া হাসি দিচ্ছিলেন। বের হয়ে বললেন ─ ‘তোমার আলাপের স্টাইল (ঢঙ) আমার ভাল্লাগছে।’ তার এই সামান্য প্রশংসা তখন আমার আত্মবিশ্বাস যে কতটা বাড়িয়েছিলো তা আসলে এখন খুব ভালো করে টের পাচ্ছি। হুজরা থেকে বের হওয়ার পর মাংস দিয়ে রুটি খেতে খেতে বর্তমান পীর রেজাউল করীমেরও একটি সাক্ষাতকার নেই। সেবার দেড় লাখ টাকা দিয়ে বরিশালের হাটে ওঠা সবচেয়ে বড় গরুটি কিনে কোরবানী দিয়েছিলো পীর পরিবার। সেটির মাংস আর চালের রুটি দিয়েই আমাদের আপ্যায়িত করা হয়।
সেই রাতে আর শহরে ফিরতে দেননি লিটন’দা। ফের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এর আগে সন্ধ্যায়-ই পরিচয় হয়েছিলো তার তিন ভাইয়ের সাথে। এর মধ্যে রিয়াদ ভাইয়ের (রিয়াদ আহমেদ) সাথে খুব একটা যোগাযোগ না থাকলেও তার চেহারার সাথে দাদার চেহারার অদ্ভুত মিল থাকার কথা আজও ভুলিনি। ইলিয়াস (আহমেদ ইলিয়াস) আর ইমনের (ইশতিয়াক ইমন) সাথে দুরত্বটা কমে গিয়েছিলো ফেসবুকের সুবাদে। লিটন’দার মতো তাদের সাথে কথা, এমনকী সাক্ষাতও হয়েছে মাঝে মাঝে। ভাইদের মধ্যে ইমন-ই শুধু অগ্রজকে অনুসরণ করেছেন, মানে সাংবাদিকতায় এসেছেন। দাদার দেখাদেখি আমিও তাকে ‘ছোট হুজুর’ ─ নামে ডেকেছি দীর্ঘকাল। তাদের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, পেশায় ছিলেন শিক্ষক। নামটি মনে না এলেও তার সরল হাস্যোজ্জল ব্যক্তিত্ব স্মরণে আছে বেশ। দাদার মায়ের হাতের রান্নার স্বাদও জিভে লেগে আছে। আহারে, প্রিয়পুত্রের প্রয়াণে এখন তাদের বুকে যে হাহাকারের দামামা বাজছে ─ তা শোনার সাহস আছে কার?
পীরের সেই সাক্ষাতকার জমা দেয়ার ‘ডেডলাইন মিস’─জনিত কারণে মুঠোফোন বন্ধ করে আমি যখন ফেরারী, পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মর্তুজাকে আমায় হন্যে হয়ে খুঁজছেন; তখনও লিটন’দা-ই তাকে আমার বাসার ল্যান্ডফোন নম্বর দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেই সাক্ষাতকারসহ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘চরমোনাই পীরকাহীনি’। প্রতিবেদন জুড়ে পীরের নানা অনাচারের ফিরিস্তি থাকায় ফের মহাবিপত্তি ঘটে । পীরের রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৬৪ জেলায় মানহানির মামলা করার পাশাপাশি অব্যাহত হামলার হুমকী দিয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে। শুধু আমার নয়, লিটন’দার ওপরও তারা ক্ষিপ্ত হন। তখনও তিনি আমার পাশ থেকে সরে যাননি। সব সামলে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছেন।
গত বছরের ছবি
একই বছরে, অর্থাৎ ২০০৬ সালে আজকের পরিবর্তন পত্রিকায় ‘পুরানো বরিশাল’ শিরোনামে এক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সুশান্ত ঘোষ, নজরুল বিশ্বাস আর আমার সেই যৌথ কাজ চলাকালে লিটন’দা দৈনিক ইত্তেফাকে বরিশালের পুরানো বাড়িগুলো নিয়ে একটি সিরিজ শুরু করেন। তখন তিনি পরিবর্তনের সাথেও সংযুক্ত ছিলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো দুটি সিরিজের সমন্বয়ের পাশাপাশি আরো কিছু তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত করে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ। পরবর্তীতে নানা কারণে সে উদ্যোগ আর হালে পানি পায়নি।
দক্ষিণের প্রতিটি জনপদে চষে বেড়িয়েছেন লিটন বাশার। জন্ম দিয়েছেন অজস্র সাড়া জাগানিয়া প্রতিবেদন। তবে তার উত্থান দ্বীপজেলা ভোলা থেকে। এরপর চলে গিয়েছিলেন ঢাকায়। পরে ফের বরিশালে এসে থিতু হন। তার হাত ধরেই বরিশাল, তথা বাঙলার মফস্বল সাংবাদিকতায় ঐক্য ও সম্প্রীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। 

গত দশকের শেষের দিকে ঢাকায় চলে আসার পরও দাদার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার। বরং যোগাযোগটা একটু বেশীই ছিলো। পুরানো পল্টনের রয়েল হোটেলের নাম, মালিকানা বদলে গেছে বহুদিন আগে। নতুন নামটি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না এই মুহুর্তে। তবে খুব মনে পড়ছে ২০০৮-০৯ সালে এই হোটেলে কাটানো এক রাতের গল্প। পঞ্চম তলার কোনো এক রূমে লিটন’দা এবঙ তার তিন বন্ধুর রাতভর আড্ডা শেষে খুব সকালে যখন বের হয়ে আসছি, দাদা তখন হাতে দুই হাজার টাকা গুজে দিয়ে বললেন, ‘এইটা রাখ।’ আমি ইতস্তত করে টাকাটা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করতেই তিনি ধমক দিয়ে বললেন, ‘ঢাকায় রিপোর্টার-গো শুরুর বেতন কেমন তা আমার জানা আছে। ঠিকঠাক দেয় কয় প্রতিষ্ঠান, তা’ও।’ ছোট্ট করে ‘থ্যাঙ্ক-ইউ’ বলে আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। রাতে অবশ্য বহু বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে দাদা বলেছিলেন, ‘লেগে থাকলে দুই বছরের মধ্যে তোর বেতন চারগুণ হয়ে যাবে।’ সত্যি, পরে হয়েছিলোও তা-ই ।

আমি সংসদ সাংবাদিকতা শুরুর পর দাদা বেশ খুশি হয়েছিলেন। সেই সময়ে, মানে ২০০৯-১১ সালে মাঝে মাঝে সংসদের সাংবাদিক লাউঞ্জে ফোন করে নিজের পরিচয় গোপন করে আমাকে চাইতেন। কণ্ঠ বদলে মজা করতেন। প্রতিবারই তাকে চিনে ফেলার পর শিশুদের মতো হাসতেন। কখনো আবার জানতে চাইতেন লাউঞ্জে এখন কোন কোন সাংবাদিক আছেন। পরিচিত কেউ আছে শুনলে তাদেরও ডেকে কথা বলতেন। কাজী শাহেদ, উত্তম চক্রবর্তী, সজল জাহিদ, উম্মুল ওয়ারা সুইটিসহ ঢাকার অনেক সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে তার সখ্যতার হাল দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছি ঢাকায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করার সময়েও পলিটিক্যাল রিপোর্টার (আওয়ামী লীগ বিট) হিসেবে লিটন’দা ছিলেন সবার প্রিয় সহযোদ্ধা।  

দাদার সাথে সর্বশেষ দেখা হয় ২০১৫ সালে, বরিশালে। প্রেসক্লাবের নির্বাচনের দিন বিকেলে। তখনও তিনি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। সেখানেই দেখা হয়। পরে তার সাথে কথা বলতে বলতে আগরপুর রোডে থেকে বেড়িয়ে সদর রোডের হাবীব ভবনে ইত্তেফাক অফিসে গেলাম। বেশ কিছু সময় ধরে আড্ডা দিলাম। প্রায় পুরোটা সময় আমার প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করলেন। তবে ফেরার আগে উৎসাহ দিলেন চলচ্চিত্রের কাজেও। বললেন, ‘এইডাও আবার ছাইড়া দিও না।’ এরপর দুয়েকবার ফোন ও ফেসবুকে আলাপ হয়েছে; কিন্তু সাক্ষাত হয়নি আর। তবে ‍নিয়মিত তার লেখা সংবাদ ও কলাম পড়ে বুঝতাম, তিনি আজও খুব একটা বদলে যাননি। প্রেসক্লাবের সর্বশেষ নির্বাচনে সভাপতি পদে দাঁড়িয়েছিলেন। প্যানেল জিতলেও তিনি হেরে যান। তাকে যদ্দুর জানি, এ ঘটনায় কষ্ট পেলেও কাউকে বুঝতে দেয়ার মানুষটি তিনি নন। তাই যে কোনো সাংবাদিকের জন্য নির্দ্বিধায় পথে নামার অভ্যাসও তার বদলায়নি আমৃত্যু। 

অতি-সাম্প্রতিক ছবি 
মৃত্যুর মাত্র দু’দিন আগের এক লেখায় লিটন বাশার বলেছেন ─ “বিবেকের দায় এড়াতে নিজের শূন্য পকেটেও প্রিয় সহকর্মী কিংবা প্রয়াত বন্ধুদের এতিম সন্তানের মুখে হাসি ফুটাতে শেষ রোজায় দিন-রাত দৌড়ঝাঁপ করে আমি এখন ক্লান্ত। যেটা বুঝলাম তাতে আপনি যদি সকলের আবদার পূরণ করতে চান, সবার মুখে হাসি ফুটাতে চান তবে আপনার মুখের হাসি অটুট থাকা দুরূহ ব্যাপার। আর আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষ হয়ে যদি ‘ঈদ’ নামের এক মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার কোনো কঠিন বাস্তবতা আপনার সামনে হাজির হয় তবে হাসি তো ম্লান হবেই।” বাস্তবতার চাপ প্রসঙ্গে এমন নির্লিপ্ত বয়ান সম্ভবত শুধু তার পক্ষেই দেয়া সম্ভব। তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত রসিক, খাঁটি প্রতিবাদী, রাজপথের সাহসী প্রাণ; একইসঙ্গে সাহিত্য অনুরাগী, ইতিহাস সচেতন, উদ্যমী পরোপকারী, নীতিবান সংগঠক, উদারমনা শিক্ষক এবং সর্বোপরী একজন আপোসহীন সাংবাদিক। জানি না কত জন বুঝবে কি হারালো বরিশাল বা কি হারিয়েছে বাংলাদেশ।

দাদার পুত্র শ্রেষ্ঠ’র বয়স মাত্র চার বছর। তার নিজ হাতে গড়া পত্রিকা দৈনিক দখিনের মুখ পত্রিকার বয়সও সম্ভবত বছর দেড়েক। তার এই দুই সন্তানের ভবিষ্যত পথ চলা সুগমের দায়িত্ব এখন সকলের। মনে রাখবেন, লিটন বাশার কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন; তিনি এক অদম্য চেতনা। একদিন শুধু বরিশাল নয়, সারাদেশের সাংবাদিকরা তাকে ধারণ করবেন; এটা-ই প্রত্যাশা। 
প্রয়াত বন্ধু-স্বজনদের তালিকা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে, ইদানীং একটু দ্রুতই। প্রায়শই ভাবি তাদের এলিজি লেখার জন্যই হয়ত এখনো বেঁচে আছি আমি। যদিও যমের সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না শোকার্ত মন। একজনকে নিয়ে লেখা শেষ না করতেই তিনি আরো তিনজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। গত ১৫ মে চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ, ১০ জুন আলোকচিত্রী হানের পর ২৭ জুন লিটন বাশার। একইদিন রাতে আবার সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশও! হে মহান আজরাইল, দয়া করে এবার একটু ধীরে চলেন।
“আপনার আকস্মিক মৃত্যু আমাদের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটি পর্যন্ত দিলো না। তবুও প্রত্যাশা আপনি নিশ্চয়ই আমাদের মতো অনুজদের ক্ষমা করবেন।” ─ গত ফেব্রুয়ারিতে মীর মনিরুজ্জামানের মৃত্যুর পর এক লেখায় এ কথাগুলো বলেছিলেন সদ্য প্রয়াত অগ্রজ লিটন বাশার। সেই কথাগুলো-ই আজ তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে হচ্ছে। আরো কত প্রিয়মুখ ছবি হয়ে যাবে; কত দয়িতের সাথে আর কথা হবে না কোনো দিন! আর এ সত্য বদলাতে পারবে না কেউ। অগ্রগামী বন্ধু-স্বজনদের তাই অভিনন্দন। আশারাখি দেখা হবে, নবজন্মে।

অবিশেষ
পরম শ্রদ্ধায় রাসেল স্মরণ
চিন্তা-কর্মে, স্মৃতির মর্মে অমর মনির

২৪ জুন ২০১৭

গল্পটা নেহাল কোরাইশীর

ছবিটি ‍কুষ্টিয়া থেকে তোলা 
সিনেমাটোগ্রাফারস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রথম নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক নেহাল কোরাইশীরকে নিয়ে গত বছরের এই দিনেই লিখেছিলাম অনলাইন গণমাধ্যম নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’এ। আজ, মানে ২৪ জুন তার জন্মদিন। 
দেশের টিভি ও বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রির দাপুটে এই মানুষটি আদ্যপান্তে ঢাকারই ছেলে। জন্ম ১৯৭৯ সালে, মোহম্মদপুরের নূরজাহান রোডে পৈত্রিক বাড়িতে। বেড়ে ওঠাও সেখানে। মাঝে কয়েক বছর এদিক সেদিক থেকে গত বছর থেকে আবার সেখানেই তিনি থিতু হয়েছেন। এর আগে পড়াশুনাও করতেন বাসার পাশেরই স্কুল-কলেজে।

গত বছর এক আলাপে চিত্রগ্রাহক নেহাল তার পথ চলার গল্প শোনান। জানান আপন আকাঙ্খার কথাও। ছায়ানটে তবলায় তালিম নেয়া নেহাল তখন থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এরই সুবাদে ১৯৯৬ সালে একটি প্যাকেজ নাটকে তার অভিনয়ের সুযোগ জোটে। দেওয়ান বাচ্চু পরিচালিত ওই নাটকে কাজ করতে গিয়েই তিনি প্রথমবারের মতো অডিও ভিজুয়াল মিডিয়ায় কাজের স্বাদ পান। তুমুল আগ্রহে তখনই বাচ্চুকে জানান, তিনি পর্দার সামনে নয়– পিছনে কাজ করতে চান। এরপর টানা দু’বছর তিনি বাচ্চুর সহকারি হিসেবে কাজ করেন।

সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করতে করতেই নেহাল বুঝতে পারেন, ক্যামেরা যন্ত্রটার প্রতি তার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। যারই প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে বাচ্চুকে তিনি তার এ আগ্রহের কথাও জানান। এ সময় বাচ্চু তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। গণ সাহায্য সংস্থা (জেএসএস) নামের একটি এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) পরিচালিত এক প্রশিক্ষণে অংশ নেন নেহাল। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন পঙ্কজ পালিতকে। যিনি এখন তার সভাপতি। যে কারণে সিনেমাটোগ্রাফারস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রথম নির্বাহী কমিটিকে কেউ গুরু-শিষ্যের কমিটি বলতে চাইলেও তা ভুল হবে না।

প্রশিক্ষণ শেষে জেএসএস’র সাথেই নেহাল দু বছর কাটিয়ে দেন। এরপর যুক্ত হন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সাবলাইম মিডিয়ার সঙ্গে। সেখানে কাজ করেন আরো প্রায় দু’বছর। অবশেষে ২০০২ সালে তিনি ফ্রিল্যান্স সিনেমাটোগ্রাফার (স্বাধীন চিত্রগ্রাহক) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেই থেকে এখন অবধি স্বাধীন ভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তার কাজের তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে অজস্র নাটক, প্রামাণ্যচিত্র আর বিজ্ঞাপন।
‘না মানুষ’ আর ‘জিরো ডিগ্রী’ নামের দুটি সিনেমায় পালন করেছেন ডিওপি (ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফী)’র দায়িত্ব। দুটি চলচ্চিত্রেরই পরিচালক ছিলেন আলোচিত নির্মাতা অনিমেষ আইচ। এর মধ্যে ২০১১ সালে চিত্রায়িত প্রথম চলচ্চিত্রটি প্রযোজক আর পরিচালকের সমন্বয়হীনতার কারণে মুক্তির মুখ দেখেনি। এছাড়া এক নারী পরিচালকের নতুন সিনেমায় তার কাজ করার কথা ছিলো।
সিনেমাটোগ্রাফারস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নির্বাহী কমিটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক নেহাল বলেছিলেন, ‘চিত্র্রগ্রাহকদের পেশাগত যে কোনো সমস্যায় আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে তার পাশে থাকতে চাই।’

১২ জুন ২০১৭

সময়টা-ই পতনগামী

ছবি : সংগ্রহিত
প্রিয় এক অগ্রজ আজ বললেন, ‘তোমার বন্ধু হওয়া-তো আসলেই দুশ্চিন্তার!' একই কথা আরেক ঘনিষ্ট স্বজন গতকাল একটু অন্যভাবে বলেছিলেন । তার প্রশ্ন - ‘তুই বেছে বেছে শুধু এমন মানুষদের সাথেই কিভাবে বন্ধুত্ব করিস যারা অকালে চলে যায়?’ ভেবে দেখলাম বন্ধুত্বও আদতে প্রেমের মতো। করা যায় না, হয়; আর মনে মন মিলে গেলে তা টিকেও যায়। যাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব এভাবে টিকে গেছে; চেয়ে দেখি তাদের কেউই ছাপোষা জীবনে অভ্যস্ত নন। প্রত্যেকের পথ ভিন্ন হলেও সকলেই পুড়েছেন বা পুড়ছেন; নানাবিধ দহনে। যার একমাত্র কারণ তারা প্রত্যেকই প্রচণ্ড স্পর্শকাতর। মূলত প্রখর অনুভূতি-ই তাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে, করছে। গত দেড় দশকে আমি যে দুই ডজন বন্ধু-সহযোদ্ধা হারিয়েছি তাদের সিংহভাগ-ই মূলত আত্মহত্যাকারী। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের ‘ম্যাক্সিম’ সিরিজের একটা লেখা এখানে প্রাসঙ্গিক; যার শিরোনাম - ‘আত্মহত্যা’। যেখানে লেখা হয়েছে - ‘পৃথিবীর মানুষেরা আত্মহত্যার অনেক কৌশল আবিষ্কার করেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালোটি হচ্ছে মরবার অপেক্ষা করতে করতে একদিন মরে যাওয়া।’ হয়ত আমাদের সময়টা-ই পতনগামী।

০৮ জুন ২০১৭

খ্রিষ্টীয় মতে মহানবীর ওফাত দিবস আজ

মসজিদে নববী
খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা মতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.) -এর ওফাত দিবস আজ। তিনি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন (১১ হিজরী সালের ১২ রবিউল আউয়াল) সন্ধ্যায় বর্তমান সৌদি আরবের মদিনায় নিজ স্ত্রী আয়েশার ঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জানাযার পর সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদের আমলে মসজিদে নববীকে সম্প্রসারণ কালে মুহাম্মদ (স.)’র রওজাটিও সম্প্রসারিত এলাকার ভেতরে নিয়ে নেয়া হয়।
মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে জন্ম গ্রহণকারী মহানবী (স.) প্রচলিত ধারণা মতে, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগষ্ট আরবি রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্মেছেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মন্টগোমারি ওয়াট তার পুস্তকে এই সালের উল্লেখ করেছেন; তবে প্রকৃত তারিখ উদঘাটন সম্ভবপর হয়নি বলে জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মুহম্মদ (স.) নিজে কোনো মন্তব্য করেছেন বলে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মূলত এ কারণেই তারিখটি নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়ে গেছে। যেমন সাইয়েদ সোলাইমান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকির গবেষণায় এটি ছিলো ৫৭১ সালের এপ্রিল ২৬ হবে বা ৯ রবিউল আওয়াল। তবে তার জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটে এবং সে সময় সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহনের ৪০ বছর পূর্তি ছিল এ নিয়ে কারো মাঝে দ্বিমত নেই।
মোহাম্মদ, মুহম্মদ বা মুহাম্মেদ পরিচিত মহানবী (স.)-এর পূর্ণাঙ্গ নাম আবু আল-কাশিম মুহাম্মাদ ইবনে ʿআব্দ আল্লাহ ইবনে ʿআব্দ আল-মুত্তালিব ইবনে হাশিম। তিনি ইসলামের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। মুসলিম বিশ্বাসমতে তিনি আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ নবী। যার উপর ইসলামী ধর্মগ্রন্থ ‘আল-কুরআন’ অবতীর্ণ হয়েছে। অমুসলিমদের মতে তিনি ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রবর্তক।
রওজা
উইকিপিডিয়া বলছে, ‘অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে মুহাম্মাদ (স.) ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য। বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সফলতা।’

আরো পড়ুন :
স্মরণে আজ আলীর শাহাদাত

০৫ জুন ২০১৭

দীপনপুর, আর মাত্র অল্প দূর..

দীপন ভাই, মানে ফয়সল আরেফিন দীপন মৃত্যুর ঠিক আগের দিন (৩০ অক্টোবর ২০১৫) বিকেলে দীর্ঘদিন পর শাহবাগ গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথেই ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে গিয়ে ভাইয়ার নতুন অফিস দেখে আসবো।কিন্তু ছবির হাটের বন্ধুদের সাথে বিবিধ আলাপে ডুবে আর যাওয়া হয়নি সেদিকে; মেতে ছিলাম আড্ডায়। পরদিন মার্কেটের তৃতীয় তলার সেই অফিসেই তিনি খুন হন। 
খুব বেশীদিন আগের নয়, ২০১৩ -এর এপ্রিলের কথা। দীপন ভাইয়ের সাথে আলাপের সূত্রপাঠ হয়েছিলো সিনেমা নিয়ে। মূলত তার মুখবইয়ের ভেতরবাক্সে রাসেল আহমেদ পরিচালিত নৃ - চলচ্চিত্রের পাতার সংযোগ দেয়ার মাধ্যমে। পরে সিনেমা ছাড়াও কবিতা, ব্লগিং, প্রকাশনা থেকে শুরু করে ধর্ম, দর্শন, এমনকী জীবন বোধ নিয়েও আলাপ হয়েছে তার সাথে। তবে আমাদের প্রথম সাক্ষাত হয় অনেক পরে, ২০১৪ -এর জানুয়ারিতে; নিজস্ব প্রকাশনী কাদাখোঁচা যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে। এর নামকরণের পাশাপাশি নামাঙ্কণও করে দিয়েছিলেন নৃ -এর নির্মাতা।
কিভাবে কি করা যায় - শুধু তা’ই জানতে নয়, ‘জাগৃতি’ আমাদের প্রকাশনাগুলোর পরিবেশক হবে - এমন আবদার নিয়েই গিয়েছিলাম দীপন ভাইয়ের কাছে। সানন্দে রাজিও হয়েছিলেন তিনি এবঙ জানিয়েছিলেন - প্রকাশকের মৌলিক দায়িত্ব, কর্তব্যের কথা। আলাপ হয়েছিলো দেশের প্রকাশনা শিল্প আর সিনেমার দুরাবস্থা নিয়ে। তখনও দীপন ভাইয়ের অফিস মার্কেটের দোতলায়। সেখানে বসেই কথা বলছিলাম আমরা। যদ্দুর মনে পরে প্রিয়মুখ প্রকাশনীর প্রধান - গল্পকার আহমেদ ফারুক কে সেদিন দেখেছিলাম সেখানে ।
স্যার এবঙ আপার এ ছবিটি ফেসবুকে পাওয়া
সেই প্রথম সাক্ষাতের পরও আমাদের সামনা সামনি খুব বেশী দেখা হয়েছে, এমন নয়। কদাচিৎ দীপন ভাইয়ের অফিসে গিয়ে হানা দিয়েছি। তার তুমুল ব্যস্ততাকে তোয়াক্কা না করে জোর করে হলেও শুনিয়েছি নিজের উদ্ভট সব গ্রন্থভাবনা। তিনিও আবার মনযোগ দিয়ে শুনেছেন - পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। কখনো কখনো সেখানে গিয়ে স্যার, মানে দীপন ভাইয়ের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে পেয়েছি। কোনো এক মার্চের এক দুপুরে জলি আপা, মানে ভাইয়ার স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলির সাথেও দেখা হয়ে যায়। সেদিন মূলত আমার প্রকাশ করা বইগুলো জাগৃতির বিক্রয় কেন্দ্রের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। বইগুলোর মধ্যে একটি ছিলো আমার নিজের কবিতার বই। সেটার ফ্ল্যাপে নিজের সাম্প্রতিক কোনো ছবি না দেয়া নিয়ে ভাইয়া-আপার যৌথ অনুযোগ; আহা- কি মধুর লেগেছিলো।
এর আগে দীপন ভাই বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোর নানাবিধ সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে সেই ভুলগুলো আগামীতে আর না হয়। আহা, কী অল্প সময়ে কত অজস্র আলাপ হয়েছে আমাদের। কত ভরসা, কত প্রাণশক্তিতে ভরা মানুষটা - যার প্রয়ান সংবাদ আমায় উপহার দিয়েছে এক দীর্ঘ ট্রমা। যা আজও পুরোপুরি কেটেছে কি-না তা ঠিক ঠাওর করতে পারছি না।
দীপন ভাইকে একদিন স্বপ্নেও দেখেছিলাম। ঠিক কোথায় বুঝিনি। তবে তিনি বেশ হাসি খুশি। তাকে দেখেই আমি বোকার মতো জানতে চাইলাম - ‘ভাইয়া, আপনি মারা যান নাই?’ সে অবাক হয়ে বললো - ‘কে বলছে তোমাকে?’ আমি বললাম, ‘টিভিতে যে দেখলাম!’ ভাইয়া হেসে কিছু একটা বললেন - যা আমার ঠিক বোধগম্য হলো না। শুধু ‘মিডিয়া’ শব্দটা বুঝতে পেরেছিলাম। এরপরই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো।
সেদিনের আগে, পরে বহুদিন ভেবেছি - একদিন জাগৃতিতে যাবো। সেখানকার কী অবস্থা তা খোঁজ নেবো। কিন্তু পরক্ষণেই যখন জলি আপা বা ফজলুল হক স্যারের মুখটা মনে পরেছে; প্রচণ্ড গ্লানিতে অবসন্ন হয়েছে মন। আমার আপোষকামী নীরবতাপুষ্ট প্রতিবাদহীন বেহায়া মুখটা নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াই কী করে, তা ভেবে পাইনি আজও।
দীপন ভাই মারা যাওয়ার পর অবশ্য মাত্র দুই/তিন বার আজিজ মার্কেটে যাওয়া হয়েছে; তা’ও তারই সহযাত্রী শ্রাবণ প্রকাশনীর রবীন আহসান ভাইয়ের কাছে। সর্বশেষ গত মাসেই তার কাছে গিয়েছিলাম ‘রাসেল স্মরণ’ - পত্রিকাটি বিনামূল্যে ছাপানোর আবদার নিয়ে, ছেপেও দিয়েছেন। বুঝেছেন-তো কোন রাসেল? সেই যে সেই নৃ-এর নির্মাতা। তিনিও এখন প্রয়াত। যিনি দীপন হত্যাকাণ্ডের পর ফজলুল হক স্যারের উদ্দেশ্যে মুখবইয়ে লিখেছিলেন - ‘স্যার, আমরা সত্যি ব্যর্থ আজ দেশটাকে সুস্থ, সুন্দর করে সাজাতে। এ ব্যর্থতার দায় - সবার। আমাদের ক্ষমা করবেন।’ এর আগে এক সাক্ষাতকারে স্যার বলেছিলেন - 'আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই না। এদেশের কোর্ট-কাচারিতে বিচার হয় না। তাই বিচার চেয়ে লাভ নেই।মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।'
গত বছর, মানে ২০১৬ সালে টানা তিন মাস সাংবাদিকতা করার সময় দীপন ভাইকে দুইবার স্মরণ করার সুযোগ ছিলাম। প্রথমবার ১৯ জুন - বাবা দিবসে, পরেরবার ১২ জুলাই - তার জন্মদিনে। সেই লেখাদুটোও পাঠকদের জন্য নীচে সংযুক্ত করলাম। তবে তার আগে একটা সুখবর দিয়ে যাই। 
দীপনপুরের প্রস্তুতি বৈঠক
দীপন ভাইয়ের আসন্ন জন্মদিনে, অর্থাৎ আগামী ১২ জুলাই যাত্রা শুরু করছে বইয়ের মেগাসপ দীপনপুর। জাগৃতির পক্ষ থেকে জলি আপা এবং প্রিয়মুখের ফারুক ভাই দিন-রাত খেটে চলেছেন। তাদের সাথে রয়েছে ভাইয়ার বন্ধু-স্বজনরা। ২৩২, ২৩০ এলিফেন্ট রোড হচ্ছে এই উদ্যোগের ঠিকানা। উন্নত বিশ্বের বুকসপ কাম ক্যাফে যে স্টাইলে চলে দীপনপুরও সেভাবে চলবে। এখানে থাকবে চিলড্রেন্স কর্ণার, ওল্ড সিটিজেন ক্লাব, যে কোনো বই হোম ডেলিভারীর ব্যবস্থা, মিনি অডিটোরিয়ামসহ আরো অনেক কিছু।যার কোনোটার নাম দীপনতলা, কোনোটা দীপনগঞ্জ, কোনোটা দীপাঞ্জলি বা দীপনালয়।

এটির ব্যাপারে গত বছরের নভেম্বরে আহমেদ ফারুক বলেছিলেন, ‘নতুন বছর থেকে বইয়ের এক নতুন মাইলফলকে পৌছে যাচ্ছে জাগৃতি আর প্রিয়মুখ। ইচ্ছে ছিলো এই প্রজেক্ট শুরু করবো দীপন ভাইয়ের সাথে। ২০১৪ সালে এই বিষয় নিয়ে কথাও হয়েছিলো ওনার সাথে। একটা বইয়ের মেগাসপ দেয়ার স্বপ্ন যেমন আমি দেখতাম, তেমনি দেখতেন দীপন ভাইও। আজ উনার স্বপ্ন পূরণের জন্যই মেগাসপ হচ্ছে। নামও রাখা হয়েছে তার নামেই। দীপন ভাইয়ের জাগৃতির দায়িত্ব নেয়া জলি আপাও (সবাই ওনাকে ভাবী বললেও আমি আপাই বলি) অনেক কষ্ট করছেন স্বপ্নটা পূরণ করতে। উনি উদ্যোগটা না নিলে সম্ভবই হতো না।’

ফারুক জানান তাদের প্রাথমিক টার্গেট এক লাখ বই। পাঠকের হাতের নাগালে যে কোনো পছন্দের বই পৌঁছাতেই এই উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘বই, বই আর বই- এই নিয়েই দীপনপুর। আসছে শিগগিরই...’। একই সময়ে ‘দীপন চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত রাখতে চাই’ বলে উল্লেখ করেছিলেন জলি আপা। সর্বশেষ গত এপ্রিলে তিনি মুখবই-তে লিখেছেন, ‘খুব স্বল্প ক্ষমতার একটা মানুষ যখন খুব বড় একটা কাজ হাতে নেয়, তখন পদে পদে সে ঠেকে যায়। তাই বিলম্ব হয়, তবুও হাল ছাড়েনা। দীপনপুর, আর মাত্র অল্প দূর।’

সংযুক্তি : ১৯ জুন ২০১৬
এবারই প্রথম বাবাকে ছাড়া বাবা দিবস কাটছে স্কুল পড়ুয়া রিদাত আর রিদমার। গত বছর জুনের তৃতীয় রোববারও বেঁচে ছিলেন তাদের বাবা ফয়সল আরেফিন দীপন। সেবার কিভাবে তারা এ দিনটি কাটিয়েছে বা এবার কিভাবে তাদের এ দিনটি কাটছে, জানার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু কিছু শুধানোর সাহস হয়নি। আমার প্রশ্ন ওদের কতটা কষ্ট দিতে পারে তা আন্দাজ করেই কুঁকড়ে গিয়েছি। অতটা ‘প্রফেশনাল’ হতে পারিনি বলেই প্রতিবেদনটি ঠিক প্রতিবেদন হয়ে ওঠেনি।
ফেসবুক ইনবক্সে রিদাত, রিদমার মা; মানে প্রয়াত দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলিকে বলছিলাম – ‘রিদাত আর রিদমার বাবাহীন প্রথম বাবা দিবস আজ।’ জবাবে তিনি বললেন – ‘তাতে এই নীল গ্রহটার কিছুই যাবে আসবে না যে।’ লেখক ড. জাফর ইকবালের সাথে দাঁড়ানো রিদাত আর রিদমার একটি ছবি শনিবার ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলেন জলি। ক্যাপসনে লিখেছিলেন, ‘বাবার পোশাকগুলো রিদাত পরছে ইদানীং, মাঝে মাঝে রিদমাও।’

ধারাবাহিক গুপ্তহত্যার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর নিজ প্রকাশনার কার্যালয়ে খুন হওয়া দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের কথাও স্মরণে আসে। তার দুই সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিলেন দীপন। স্মরণে আসেন অভিজিৎ রায়ের বাবা শিক্ষাবিদ অজয় রায়, তার কন্যা তৃষা আহমেদ। নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনির সন্তান মেঘের কথাও মনে পরে। বাবাকে ছাড়া কতগুলো বাবা দিবস কেটেছে তার, সে হিসাবটাও করতে ইচ্ছে করেনি আর। 

সংযুক্তি : ১২ জুলাই ২০১৬
‘শুভ জন্মদিন দীপ জ্বেলে যাওয়া দীপন।’ এভাবেই প্রয়াত সহযোদ্ধা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা ফয়সল আরেফিন দীপনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল। মঙ্গলবার ফেসবুক’এ জাগৃতির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা এক স্মরণ স্মারকে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
গত ৩১ অক্টোবর একই সময়ে, একই কায়দায় হামলা চালানো হয়েছিলো দীপন ও টুটুলের ওপর। এরমধ্যে টুটুল বেঁচে গেলেও দীপন বাঁচতে পারেননি। তারা দুজনেই ছিলেন ‘নাস্তিক’ আখ্যা পাওয়া লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক। শুধু তাই নয়, ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর চাপাতির আঘাতে খুন হওয়া দীপন ও অভিজিৎ ছিলেন বাল্যবন্ধু।

আজ ১২ জুলাই, দীপনের ৪৫তম জন্মদিন। মুক্তচিন্তার এই সাহসী মানুষটি ১৯৭২ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা । দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা অধ্যাপক। আর মা ছিলেন রোকেয়া হলের প্রিন্সিপাল হাউজ টিউটর। দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক। তার শ্বশুরও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

দীপনের স্কুল জীবন কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্কুল উদয়নে। ইন্টারমিডিয়েট ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। এরপর সম্মান ও স্নাতকোত্তর পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। যে কারণে তার মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, ‘দীপনের ওপর আঘাত আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ওপর আঘাত।’ আবার লেখক ও শিক্ষক জাফর ইকবাল ‘প্রিয় দীপন’ নামের এক লেখায় বলেছেন, ‘তার মতো সুদর্শন, পরিশীলিত এবং মার্জিত মানুষ আমি খুব কম দেখেছি’।

রাজধানীর শাহবাগ এলাকার আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে দীপনকে চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার পর, কার্যালয়ের সাটার তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। বিকেলে পুলিশ এসে তার লাশ উদ্ধার করে। একই সময় ও একই কায়দায় লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালায়ে দুর্বৃত্তের আঘাতে মারাত্মক আহত হন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক গবেষক রণদীপম বসু।
১৯৯২ সালে পাঁচটি বইয়ের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিলো জাগৃতি। প্রথম বছরের যে বইটি জাগৃতির জন্য এখনো মাইলফলক হয়ে আছে, সেটি ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। সেই থেকে এখন অবধি জাগৃতি থেকে প্রায় হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। ফয়সল আরেফিন দীপন খুন হওয়ার পার থেকে জাগৃতির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তার স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি। তারই তত্ত্বাবধানে বিগত বইমেলায়ও এ প্রকাশনী ২০টি নতুন বই প্রকাশ করে। এর মধ্যে দীপনকে নিয়ে প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থও রয়েছে। তবে তখন এক সাক্ষাতকারে জলি বলেছিলেন, ‘দীপনের ইচ্ছা ছিলো এবারের বইমেলায় প্রায় একশটি বই প্রকাশ করা।’
স্মৃতির এ্যালবামে..
দীপনের এবারের জন্মদিনে কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন রয়েছে কি’না, জানতে চাইলে নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে কোনো জবাব দেননি তার স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি। স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তান – রিদাত, রিদমা আর দীপনের রেখে যাওয়া অজস্র স্মৃতি – নিয়ে এই দিনটি তার কেমন কাটছে, তা বোধকরি অনেকেই অনুমান করতে পারবেন। জানেন তো, জলি শুধু দীপনের স্ত্রী নন, শৈশবের বন্ধু – কৈশোরের প্রেয়সী।
মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে (২৫ অক্টোবর) নিজের ফেসবুক দেয়ালে ওয়াহিদ ইবনে রেজার বরাত দিয়ে দীপন লিখেছিলেন, ‘নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যে খেলাটি আমরা খেলে যাই, তার নামই জীবন।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটিই ছিলো তার শেষ ‘পোস্ট’ (প্রকাশনা)। জন্মদিনের প্রথম প্রহরে এই প্রকাশনায় মন্তব্য করেও তাকে স্মরণ করেছেন অনেকে। কেউ কেউ আলাদা করেও লিখেছেন তাকে নিয়ে। আবার অনেকে দুই ভাবেই তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

যেমন – গল্পকার সার্জিল খান। দীপনের প্রকাশনায় তিনি লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন দীপন ভাই। এক বছর আগে শেষ দেখা এই দিনেই হয়েছিলো।’ পরে নিজের দেয়ালে তিনি লেখেন, ‘এই শুভেচ্ছা কিভাবে আপনি পাবেন জানি না। ওপার থেকে না কি সবই দেখা যায়। শুভেচ্ছার বিনিময়ে স্বাগতম চাচ্ছি না। আপনি যা দিয়ে গিয়েছেন, তা-ই অসীম। আর কিছুর বিনিময় চাই না। সম্পর্কের মাঝে বিনিময় থাকাও ঠিক না। তাই শুভেচ্ছাটাই রাখলে কৃতজ্ঞ হবো। শুভ জন্মদিন দীপন ভাই। আজীবন সবার হৃদয়ে এভাবেই বেঁচে থাকুন।’

পড়ুন :
ভয় পেও না, সাবধান থেকো ...
পরম শ্রদ্ধায় রাসেল স্মরণ
newsreel [সংবাদচিত্র]