১৯৭০ সালে নভেরা আহমেদ |
যারা ভাস্কর নভেরা আহমেদের অবদানের চেয়ে তার আত্মগোপনের লাভ-ক্ষতি নিয়ে বেশী নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন - তাদের কাছে জানতে চাই; একজন শিল্পী বা স্রষ্টার নিজের বেছে নেয়া জীবনপ্রণালীকে কটাক্ষ করার অধিকার আপনারা কোথায় পেলেন? এ কী জ্ঞানের অহমিকা! নিজেদের জ্ঞান বা অনুধাবনকে কতটা চূড়ান্ত ভেবে আপনারা এর বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন? লাভ-ক্ষতির বাইরে গিয়েও যে ভাবা যায়, তা কি কখনো উপোলদ্ধি করেছেন? আমার এই আচরণও নিঃসন্দেহে বেয়াদবি। কিন্তু এ কালে বেয়াদবদের সাথে বেয়াদবি করা জায়েজ মনে হচ্ছে বলেই বলছি - এ নেহাতই পাতি বূ্র্জোয়াগিরি। সবই পুঁজির খেল। আপনারা কবে যে - কোথায় বিক্রি হয়ে গেছেন - তা হয়ত টেরও পাননি, বা পেয়েছেন। আর এখন সবাইকে বিক্রি হতে দেখতে চাচ্ছেন। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের তথা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি না হয়ে যারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিজস্ব দর্শন/ভাবের জগতে ডুবে থাকতে চাচ্ছেন, তাদের ‘ক্ষতিকর/অস্বাভাবিক’ ভাবাও আপনাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। থাক, বাদ দেই। তবে আজ এটুকু অন্তত ভাবুন, নভেরার এই আত্মগোপন বা দেশত্যাগ কি কোনো প্রতিবাদ ছিলো?
এখানে একটি সংবাদ ভাষ্য উল্লেখ করছি।
“১৯৫৮ সালে সামরিক আইনজারি হলে শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শহীদ পাক-হানাদার বাহিনী শহীদ মিনার সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর যখন আবার শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় তখন মূল নকশার অনেক কিছু বাদ পড়ে। বাদ পড়ে যায় নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য দুটি।” তথ্য সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ (১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)
নভেরা ছিলেন ভাস্কর আর হামিদুর রহমান ছিলেন অঙ্কনশিল্পী। দুজনেই ছিলেন শিল্পানুরাগী। লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে এই দুই বন্ধু মিলে ইউরোপের বড় বড় জাদুঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। তাঁরা উভয়ে লিয়োনাদ্রো ভেঞ্চির মোনালিসা ছবি দর্শন করতে প্যারিসের ‘লুভ‘ গ্যালারি পরিদর্শন করেন। লেখক হাসনাত আবদুল হাইর লেখা ‘নভেরা’ উপন্যাসে দুই বন্ধুর প্রগাঢ় বন্ধত্ব ও শিল্পানুরাগের বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য শিল্পীদের কাছে নকশা আহ্বান করলে শিল্পী হামিদুর রাহমান সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকায় আসেন এবং শহীদ মিনারের জন্য এমন একটি নকশা প্রণয়ন করেন যেটাকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ‘আমার মায়ের মুখ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। নির্বাচন মণ্ডলির সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজ শুরু করেন হামিদুর রহমান। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে শিল্পী উপলব্ধী করেন যে শহীদ মিনারের সঙ্গে ভাস্কর্য স্থান পেলে তা পূর্ণতা পাবে। তাই তারই উদ্যোগে শিল্পী নভেরা আহমেদ ঢাকায় আসেন এবং শহীদ মিনারের মূল বেদীতে ভাস্কর্য তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯৫৫ সালের দিকে এই দুই শিল্পী যখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন তখন এদেশে শিল্প অনুরাগী খুব একটা ছিলো না। হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ শূলত ভাষা শহীদদের স্মরণে কিছু একটা করার তাড়নায় জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন।
দয়া করে স্মরণ করুন তার এসব অবদানের কথা। আর আমার একটা অনুধাবনের কথা বলে যাই - মানুষের বিস্মৃতিপ্রবণ চিন্তার দৈন্যতা, দর্শনের দুর্বলতা, সার্বোপরী - আত্মজ্ঞানের সংকট প্রসূত সুবোধের অভাব এ দুনিয়ায় আজও অতটাই প্রকট যতটা সত্তর হাজার বছর আগেও ছিলো।
নভেরার প্রবাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত আসলে আজও রহস্যাবৃত। প্রবাস জীবনে দেশের যে মানুষটির সাথে তার সবচেয়ে ঘনিষ্টতা বা সখ্যতা ছিলো তিনি হচ্ছেন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী আনা ইসলাম। তিনি লিখেছিলেন, “বহুদিন ধরেই নভেরা আছেন নিজস্ব আড়ালে। দেশত্যাগের এক অজানা ধোঁয়াটে অধ্যায়, তারপর স্বেচ্ছা-নির্বাসনের দীর্ঘ অন্তরাল। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, মৃদু হাসিতে বুঝিয়েছেন – অন্তরালে থাকাটা তাঁর নিজস্ব জীবনচর্যার ব্যাপার। মানুষের কোলাহল, স্তুতি, প্রশংসা থেকে আগলে রাখা তাঁর ভুবন।”
পূর্ববর্তী পোস্টঃ শাকুর মজিদের নভেরা বিদ্বেষ !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন