Powered By Blogger

১২ মে ২০২১

পরকীয়ার কারণে বাদি থেকে আসামি

বাম থেকে ছালমা, বাবুল ও মিন্নি
বাবা বা মায়ের পরকীয়ার বলি হওয়া, তথা অবৈধ সম্পর্কে কথা জেনে যাওয়ায় খুন হওয়া সন্তানদের একটি তালিকা তৈরী শুরু করেছিলাম 
গত দশকে; শেষ করতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে পরকীয়ার কারণে বাদি থেকে আসামি হওয়া স্বামী-স্ত্রীদের একটি তালিকাও তৈরী করা যেতে পারে। 
২০১৬ সালের মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যা মামলার বাদি নিহতের স্বামী চট্টগ্রামে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার প্রায় পাঁচ বছর পর আজ তাঁর শ্বশুরের দায়ের করা নতুন মামলায় প্রধান আসামি হলেন। ঘটনাটি ২০১৯ সালের বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির এক নম্বর সাক্ষী থেকে সাত নম্বর আসামি হওয়ার ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয়। একই বছর ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।তাঁর স্ত্রী উম্মে ছালমা মরদেহটি শনাক্ত করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে ঠিক এক বছর নতুন মামলা দায়ের করে আসামি হিসেবে সেই ছালমাকে আটক করে পুলিশ।
এই তিন হত্যাকাণ্ডই পরকীয়া প্রসূত; কীয়েক্টাবস্থা!

০৫ মার্চ ২০২১

সেনারা ব্যারাকে ফিরেছে!

আজ  ৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পঞ্চম দিনের মত হরতাল পালনকালে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় চার শ্রমিক শহীদ হন এবং ২৫ জন শ্রমিক আহত হন। এ সংবাদে ঢাকায় জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যায় সরকারিভাবে ঘোষনা করা হয়, আজ ঢাকায় সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতালের পর ব্যাংক খোলা থাকে। মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদানের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। 

লাহোরে দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড এ ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকেলে করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছোন। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। 

রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশী বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব জনাব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকেলে কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষকবৃন্দ মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ করেন।

ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে লাঠি মিছিল বের হয়।  নিহতদের স্মরণে তারা গায়েবানা জানাজা পড়ে। আওয়ামী লীগ কর্মিরাও লাঠি হাতে বিক্ষোভ করে। 

এগার দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান।

রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পিপলস পার্টির প্রধান জেড. এ. ভুট্টোর আলোচনা বৈঠক শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, তা অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।

০৪ মার্চ ২০২১

ভেঙ্গে পড়ে প্রাদেশিক শাসন

সংগ্রহিত
আজ ৪ মার্চ। একাত্তরের এই দিনে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকা-সহ সারা বাংলায় সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দু্ইটা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ছয় জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে আজ নিয়ে দু’দিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে।
বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার্থ শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রী ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন।
রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে প্রচার শুরু করে। বেতার টেলিভিশন শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বানে সাড়া দেয়ায় তিনি বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান। তিনি ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পান নি, শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
একই দিনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অনতিবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালির অধিকার দাবি করেন।
পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন ঢাকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বান করার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিৃবতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণ-বিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দেশের সংহতির জন্য তাঁর দল যদ্দুর সম্ভব ছয় দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিষ্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবো।’ একই দিন করাচী প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

০৩ মার্চ ২০২১

শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো: বঙ্গবন্ধু

ছবি: সংগ্রহিত
আজ ৩ মার্চ। অগ্নিঝড়া একাত্তরের এই দিনটিও উত্তাল ছিল আন্দোলনে। এটিই ছিল জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার পূর্ব ঘোষিত দিন। কিন্তু এই দিন সমগ্র বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রদেশে) জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দিনের জন্য সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এ সময় দেশের সব শহরের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ও বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর এবং সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়।

রংপুওে এই দিন পাক সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুর আড়াইটা থেকে ২৪ ঘন্টাব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। সিলেটে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকায় কারফিউয়ের মেয়াদ শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ১০ মার্চ ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়, এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। 
ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই দিন বটতলায় জমায়েত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু জনতা তার কাছে তাৎক্ষণিক এবং সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার দাবি জানায়। 

এদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘স্বাধীনতার ইশতাহার’ ঘোষণা করে। ছাত্রনেতা এএসএম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাহজাহান সিরাজের যৌথ নেতৃত্বের এই পরিষদ ইস্তেহারও বিলি করে। ইস্তেহারে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এত দ্বারা ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশ এখন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।’ এতে এর তিনটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ ছিল। এগুলো হচ্ছে বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ, বৈষম্যের নিরসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। একইসঙ্গে এতে আন্দোলনের ধারা হিসেবে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলা হয়।

এর আগে সমাবেশের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বুলেটে আহতদের জীবন রক্ষার জন্য জনগণের প্রতি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলার স্বাধিকার বিরোধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে।

০২ মার্চ ২০২১

কারফিউ ভঙ্গ করে বাঙালীর ব্যারিকেড

আলোকচিত্রঃ জগলুল হায়দার

আজ ২ মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিন। একাত্তরের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক ছাত্রসমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। 

ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলেন। এ ঘটনা তখন সামরিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডকে নাড়িয়ে দেয়। সেদিন রবের সঙ্গে ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং নূরে আলম সিদ্দিকী। বিশাল সেই সভাতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার এবং শেষ অবধি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়।

সভার শুরুতে সমবেত ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করে। সভা শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতে বায়তুল মোকাররম গমন করে।

একই দিন দুপুরে সচিবালয়ের পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়ানো হয়। এরই জেরে গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসানের পরিবর্তে প্রাদেশিক সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেনেন্ট-জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সরকার সামরিক আইন বিধি জারি করে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এছাড়া সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। রাতে হঠাৎ বেতার মারফত ঢাকা শহরে কারফিউ জারির ঘোষণা করা হয়।

কারফিউ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা কারফিউ-বিরোধী প্রবল শ্লোগান তুলে সরকারি নির্দেশ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। তাদের শ্লোগান ছিলো ‘সান্ধ্য আইন মানি না’, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”।

এমন সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে পরদিন থেকে সকল সরকারি অফিস, সচিবালয়, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালত, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পিআইএ, রেলওয়ে এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠনে হরতাল ঘোষিত হয়। শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে একটি প্রচারপত্রে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার আহবান জানায়।

সমস্ত শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড রচনা করা হয়। ডিআইটি এভিনিউর মোড়, মনিং-নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে রাত সাড়ে নয়টায় সামরিক বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। বিরাট এক জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানেও গুলি চালানো হয়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে কারফিউ ভঙ্গকারীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চলে।

এর আগে আ স ম আবদুর রব যে পতাকা উত্তোলন করেন তা মূলত ১৯৭০ সালেন ৭ জুন ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ‘জয়বাংলা বাহিনী’র ফ্ল্যাগ হিসেবে নকশা তৈরি করে পরিকল্পনাকারীরা, যা পরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে গৃহীত হয় এ পরিকল্পনায়। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্তেই পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনের সময় রব ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এই পতাকাই আজ থেকে স্বাধীন বাংলা দেশের পতাকা।’

এছাড়া এই দিন ন্যাপ, জাতীয় শ্রমিক লীগ আন্দোলনে একাত্মতা জানায়। ন্যাপ (মো) পল্টনে এবং জাতীয় লীগ বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সভা করে।

০১ মার্চ ২০২১

ইয়াহিয়ায় ঘোষণায় ঢাকায় প্রতিরোধ

বঙ্গবন্ধু’১৯৭১ / সূত্র: mujib100.gov.bd
বছর ঘুরে আবারো এসেছে বাঙালীর গৌরবজ্জল সংগ্রামের মাস। একাত্তরের এই মার্চে হাজার বছরের ঔপনিবেশিক পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার জোয়ার এনেছিল নদীমাতায়। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো শ্লোগানগুলো ছড়িয়ে পড়েছিলো সারাবাংলায়। কী এক যাদুর পরশে বাংলাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন এক অগ্নিপুরুষ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মাসেই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহওে গ্রেফতার হবার একটু আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন, যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআর -এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। 

ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’

এই ঘোষণাপত্রটি প্রথমে বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেমসহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েক কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান প্রচার করেন। পরে বাঙালি সেনা অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

জিয়ার ভাষ্য ছিল, ‘আমি, মেজর জিয়া। বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

জিয়া আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। 

এর আগে একাত্তরের এই দিনে, অর্থাৎ পহেলা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ হোটেল পূর্বানীর সামনে জমায়েত হয়। সেখানে তখন বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল বৈঠক চলছিল। উত্তেজিত জনতা বঙ্গবন্ধুর কাছে অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানান। তিনি এই এ সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দেন এবং এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। বঙ্গবন্ধু জনতাকে সংযত থাকতে উপদেশ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ঘোষণা দেবেন। 

পরে ১৯৭৩ সালের ১ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জয় লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। 

১০ জানুয়ারী ২০২১

দীনেশ দাসকে মনে পড়ে

দেখতে দেখতে নয়টি বছর হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকার কাকরাইল মোড়ে বাস চাপায় নিহত হন সাংবাদিক দীনেশ দাস। ফেসবুকের ফিরে দেখা কর্মসূচীর কল্যাণে আজ ফের মনে এলো সেই সময়টা। যেখানে নিজের বৃত্তান্তে নিজের সম্পর্কে দাদা লিখে রেখেছিলেন, ‘আই অ্যাম রোমান্টিক পারসন।’ তাঁর মৃত্যুর চারদিন পর ‘নিশ্চিন্ত দীনেশদা’ শিরোনামে লিখেছিলাম -
হয়ত মৃত্যুই দীনেশদাকে নিশ্চিন্ত করেছে। তবে তিনি আদৌ তৃপ্ত হবেন কি? অর্থ সংকটে পরিবারের ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রীক যত উদ্বিগ্নতা তাকে মৃত্যুর পূর্ব-মুহুর্ত পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে; তা থেকে কি তিনি এভাবে মুক্ত হতে চেয়েছেন? এত শুভাকাঙ্খী, এত পরিচিত জন। কেউ কি তাকে একটি চাকরি দিতে পারতেন না? একজন সৎ সংবাদকর্মির ২৫ বছরের অভিজ্ঞতার কি কোনো মূল্যই ছিলো না? অথচ এখন তাঁর মৃত্যু কত মূল্যবান হয়ে গেল। সরকার দীনেশদার পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বৌদিকে একটি চাকরি দেয়ার পাশাপাশি তার মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্বও নিয়েছে। আবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমনকি জামায়াত নেতারাও টাকা দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ইতিমধ্যেই টাকা দিয়েছেন। অথচ শেষ কটা দিন কী অর্থ কষ্টেই না তাঁর কেটেছে। সদাহাস্যোজ্জল শিশুমনা মানুষটার মুখে হাসিও দেখিনি কত দিন। এখন হয়ত তিনি সবই দেখছেন। আর বৌদির কাছে গিয়ে বলছেন, 'বলেছিলাম না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অথৈর পড়াশুনা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।'
তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর দিনটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় লেখক ও সাংবাদিক মাহফুজ জুয়েল বলেছিলেন, “চোখে পড়ার মতো মেঠো-বিচরণ ছিলো দিনেশদার। একসময় যেখানেই যেতাম সেখানেই তাঁকে দেখতে পেতাম! মাঠে-ঘাটে দেখতে দেখতেই পরিচয়। তারপর টুকটাক গল্প হয় রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে, কর্মসূচিতে, পল্টনে, প্রেসক্লাবে, মুক্তাঙ্গনে, মুক্তিভবনে, বামপন্থীদের সংবাদসন্ধানী সাংবাদিক; শ্যামসুন্দর মায়াময় নিরীহ মুখের দিনেশদা। মনে পড়িয়ে মন খারাপ করে দিলে।আহা, দিনেশদা।” আরো দুই বছর পর কবি ও সাংবাদিক রুদ্রাক্ষ রহমান লিখেছিলেন, “দীনেশ আমার তুই-তুইবন্ধু ছিলো। আমরা অনেকটা সময় এই শহরে ভাতের জন্য হেঁটেছি। সাক্ষী আশিস সৈকত! এবং আমরা এতোটাই ব্যর্থমানুষ যে দীনেশের জন্য কিছুই করতে পারিনি! অতএব ওর কাছে ক্ষমা চাই, বার বার।”
পলিটিক্যাল রিপোর্টিং, মূলত ইসলামি ও বামদলগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল দাদার সাথে। তিনি ছাড়াও শ্রদ্ধেয় সেলিম জাহিদ,  ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ, রাশিদুল হাসান রাশেদ, বন্ধুপ্রতীম রাজীব আহমদ তখন ওই অঙ্গনের ডাকসাইটে প্রতিবেদক। দাদার সাথে আমার চেয়ে ঢের বেশী স্মৃতি আছে ওই তিনজনের। তবুও আজ এখানে ফের টুকে রাখছি নয় বছর আগের লেখাটির কিয়দাংশ। 

সত্যি কথা বলতে কি, দীনেশ'দা মারা যাওয়ার আগে নিজেও কখনো বুঝিনি যে তাকে কতটা ভালোবাসি। হয়ত আমার মত আরো অনেক সহকর্মিই তা বুঝতে পারেননি। গত বছরে (২০১১ সালে)বন্ধ হয়ে যাওয়া শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজে কাজ শুরুর সময়ে ‘পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার’ ছিলাম। আমাকে জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ বাম ও ইসলামী মিলিয়ে ৩৭টি দলের খবর রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরই বদৌলতে ওই সরল প্রাণ মানুষটির সাথে আমার পরিচয় হয়। জামায়াত-শিবিরের অফিস, মুক্তাঙ্গন, পল্টন, মুফতী আমিনীর ডেরা থেকে শুরু করে কমিউনিষ্ট পার্টির অফিস। কত জায়গায়ই না এক সাথে কত সময় কেটেছে। এরপরও ওই বিটে যতদিন ছিলাম তা ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে প্রথম দিনেই আপন করে নেয়ার গুনটি দাদার মাঝে বেশ ভালো মত ছিল। আর তাঁর রসিক চরিত্রের সচ্ছতায় মুগ্ধ না হওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক। যে কারণে ‘পার্লামেন্ট রিপোর্টিং’ শুরু করার পরও দাদার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি কখনো। ফেসবুকে খুব একটা সক্রিয় না হলেও তাঁর ইয়াহু মেইলটি প্রায় নিয়মিতই খোলা থাকত। মাঝেই মাঝেই ‘চ্যাটবক্সে’ হাজির হতেন দাদা। খুব বেশী সময়ের জন্য না হলেও বেশ জমজমাট আলাপ হতো। অবশ্য গত দেড়-দুই মাস ধরে সেখানও অনিয়মিত ছিলেন তিনি। হয়ত  দৈনিক আমাদের সময় থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর আর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগটাই পাননি। আসলে দীনেশ'দার বহুপুরানো সহকর্মী সালাম ফারুক ভাইয়ের একটি লেখা শেয়ার করার জন্য বসেছিলাম; কিন্তু নিজেই কত কিছু বলে ফেললাম। আর শুধু একটি কথাই বলি। এখন বুঝি, দাদাকে অনেক ভালোবাসি।

চাকরির টেনশনমুক্ত দীনেশদা’ শিরোনামে একটি অনলাইনে লিখেছিলেন ফারুক ভাই; যা হুবুহু তুলে দিচ্ছি -
মৃত্যুর মাত্র ১৪ ঘণ্টা আগে শনিবার রাত সাতটায় ঘনিষ্ঠজন, কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার আজিজুল পারভেজকে বলেছিলেন, 'পকেটে মাত্র ২০ টাকা আছে।' রোববার সকালে মাটির ব্যাংক ভেঙে জমানো টাকা থেকে ১০০ টাকা হাতে দিয়েছিলেন স্ত্রী। জানা গেছে তিন মাসের বাড়িভাড়াও বাকি। ২৫ বছরের সাংবাদিকতার জীবনের এই পর্যায়ে এসে এমন হালেই দিন কাটছিল তাঁর। তিনি দৈনিক আমাদের সময় থেকে 'অন্যায়ভাবে' সদ্য চাকরিচ্যুত হওয়া দীনেশ দাশ, আমার দীনেশদা। এখন আর তার সেই টাকার চিন্তা নেই, নেই বাড়িভাড়ার টেনশন, জমানো টাকা থেকে তাকে দিনের খরচ দিতে হবে না বৌদির। সাংবাদিকতা করে অর্জন করা একমাত্র সম্বল মোটরসাইকেলটি নিয়ে তাকে আর ঘুরতে হবে না কাজের খোঁজে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) গত নির্বাচনের আগের রাতে তার মোটারসাইকেলে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'দাদা, পাওনা টাকাগুলো আমাদের সময় পে (পরিশোধ) করেছে কি-না।' জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'না, টাকা-পয়সা তো কিছু দিলো না। তবে আমাদের সময় থেকে লোন নিয়ে হলেও এ মোটরসাইকেলটাই এখন আমার একমাত্র সম্বল।' সেই একমাত্র সম্বলটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। রোববার সকালে একমাত্র মেয়ে অথৈকে ভিকারুননিসা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ডিআরইউ’র দিকে যাওয়ার পথেই বাসের চাপায় নিভে গেল তার প্রাণপ্রদীপ। তার আর যাওয়া হলো না প্রিয় প্রাঙ্গণটিতে।

গত বছর আমি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর থেকে অমর একুশে বইমেলা কাভার করেছিলাম। দাদার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কালের কণ্ঠের আজিজুল পারভেজ ভাই, সমকালের মুন্না ভাই আর আমি ছিলাম নিয়মিত। তাই কখনো আসতে দেরি হলে দাদা ফোন করে বলে দিতেন, তার জন্যও যেন বইয়ের কাভার, বই ইত্যাদি কালেক্ট করে নিই। আমরা তা করতাম। মাঝেমধ্যে দাদার মোটারসাইকেলে চড়ে ফিরতাম অফিসে। আর মাত্র ২৩ দিন পরই শুরু হবে এবারের বইমেলা। দাদাকে ছাড়া বইমেলা- এখনই বিশ্বাস হতে চাইছে না। আমাদের সময়ে দীর্ঘ সময় কাজ করার সুবাদে দীনেশদা’র সান্নিধ্য পেয়েছিলাম খুব ভালোভাবেই।

শুরুতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে খানিকটা দুর্বল দাদাকে প্রায়ই সাহায্য করতে হতো আমার। ক’দিন আগেও ফেসবুকে দাদার আইডি নিয়ে একটি জটিলতার সমাধান করে দিয়েছিলাম। দাদার স্নেহমিশ্রিত আবদারে কখনোই বিরক্ত হতাম না। ঠাট্টা-মশকরা করতে করতেই তার কাজটুকু করে দিতাম। ডিআরইউ’র মিডিয়া সেন্টারে বসে দাদার সেইসব আবদার আর পূরণ করতে হবে না। বয়সে ১০/১২ বছরের বড় হতে পারেন। কিন্তু কথাবার্তা, আচার-আচরণ কোনো দিক থেকেই সেই পার্থক্য বুঝতে দিতেন না দীনেশদা। নানান ঢঙের টিটকারি, দুষ্টুমি সবই চলত তার সঙ্গে। যেন বাল্যকালের বন্ধু।

জ্ঞানপিপাসু দীনেশ দাশের সংগ্রহে ছিল দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দলিলের অনুলিপি। সামান্য বেতনে চাকরি করেও খুঁজে খুঁজে এসব যোগাড় করতেন তিনি। অনুকরণীয় চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের স্মৃতি ধরে রাখতে তিনি গঠন করেছিলেন মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ। প্রতি বছর এ সংসদ থেকে সেরা রিপোর্টার বাছাই করে পুরস্কৃত করা হতো। সর্বশেষ আয়োজনটি ছিল গত ২৯ ডিসেম্বর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতেন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সংবাদ সংগ্রহে। নিজ ধর্মের প্রতি প্রবল ঝোঁকও অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটিকে দায়িত্ব থেকে টলাতে পারেনি। ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাই তার হয়ে উঠেছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আর তাই অনেকেই মজা করে তার নাম উচ্চারণের সময় আগে ‘মাওলানা’ শব্দটি জুড়ে দিতেন।

আমি আমাদের সময় ছেড়েছি বছর তিনেক আগে। কিন্তু গুটি কয়েক সমবয়সী সহকর্মীর মতো দীনেশদা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বিলীন হয়ে যায়নি। একবার বৌদি’র অসুস্থতায় রক্তের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন আমাকেই। ছুটে গিয়েছিলাম। সব সেরে রাতে ফিরেছিলাম দুইটায়। সেই থেকে দাদার স্নেহের মাত্রা যেনে বেড়ে গিয়েছিল অনেক। 

কিছুদিন আগে আমরা সহকর্মী বন্ধু বেলাল হোসেনকে হারালাম, নিখিল ভদ্রকে পঙ্গু হতে দেখলাম। আর এবার হারালাম শান্ত-নিরীহ, বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ বন্ধুজন দীনেশদাকে। ভুয়া লাইসেন্সেধারী অদক্ষ ও বেপরোয়া বাসচালকদের হাতে আর কতো সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ খুন হলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়বে? আর কতো প্রাণহানি ঘটলে বিআরটিএ তার দায়িত্ব পালনে সচেতন হবে?

newsreel [সংবাদচিত্র]