Powered By Blogger

২৫ নভেম্বর ২০১৪

তিনিও ছিলেন চলচ্চিত্রের মানুষ

ছবিটি সুনানের তোলা
ফুটবল, আইন পেশা বা রাজনীতি নয়, চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পারিবারিক ব্যবসার কারণেই তাকে খুব সহজে চিনেছিলাম শৈশবে; সেই প্রাইমেরীতে থাকতে। শাহীন আঙ্কেল, মানে সদ্য প্রয়াত কামরুল আহসান শাহীনের কথা বলছি। তার বাবার কথা জানতাম, চিনতাম পুত্রকেও। তাকে প্রথম দেখেছিলাম স্কুলের বারান্দায়। তখন অবশ্য তিনি কে, কেন এসেছেন - কিছুই জানা ছিলো না। কিন্তু কেন জানি মাথার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলেন। সম্ভবত বিশাল বপু আর আদুরে মুখাবয়বের কারণে।

আমার স্কুল ছিলো ফজলুল হক এভিনিউয়ে, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এর ঠিক উত্তর পশ্চিম কোনে সদর রোডে ছিলো কাকলী সিনেমা হল। একদিন বাসায় ফেরার সময় - ওই হলের সামনের শাহীন আঙ্কেলকে দাঁড়ানো দেখে মেঝ চাচার কাছে জানতে চেয়েছিলাম উনি কে? চাচা তাকে দেখে জানালেন, উনি হলের প্রতিষ্ঠাতা ডা. আবদুস সোবাহানের বড় ছেলে। সেই প্রথম তার নাম জানলাম। অবশ্য এর আগেই ডা. সোবাহানের নাতি সুনানের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। স্কুলের জুনিয়র হলেও আমাদের সাথে অদ্ভুত এক সখ্যতা ছিলো তার। এমনটা হয়েছিলো মূলত ওর খালাত ভাই - আদরের সুবাদে। সে ছিলো আমাদের ক্লাসমেট। আর আদর , সুনান -এই দুই ভাইয়ের সম্পর্কটা ঠিক বন্ধুর মতোই ছিলো। সেদিন বাসায় যেতে যেতেই ধারণা করেছিলাম - শাহীন আঙ্কেল বোধকরি সুনানেরই বাবা। এ জন্যই তাকে হয়ত স্কুলে দেখেছিলাম। পরে জেনেছিলাম আন্দাজ ভুল ছিলো না।

প্রাইমারী ছেড়ে হাই স্কুলে ওঠার বছর দুয়েক পরই স্কুলের বন্ধুদের বৈকালিক আড্ডা আর খেলাধূলার অন্যতম স্পট হয়ে উঠেছিলো মল্লিক রোড। মূলত নগরীর বৃহৎ দুটি গার্লস স্কুল, অর্থাৎ সরকারি বালিকা বিদ্যালয় (সদর গার্লস স্কুল) আর জগদীশ স্বারস্বত গার্লস হাই স্কুল সন্নিকটে হওয়ার কারণে টিনেজার ছেলেদের কাছে ওই এলাকাটি খুবই আকর্ষণীয় ছিলো। বিভিন্ন এলাকার, বিভিন্ন স্কুলের সমবয়সী বন্ধুরা সমবেত হতাম সেখানে। ভদ্র, বখাটে, পাগলাটে – সবাই আসত। শাহীন আঙ্কেলের বাসার ঠিক বিপরীতে পুলিশ ক্লাবের সিঁড়িতে আড্ডা দিতাম আমরা আর মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল বা ব্যাডমিন্টন খেলতাম। বয়োজেষ্ঠ্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে বিড়ি-সিগারেট ফোঁকার জন্য ক্লাবের দেয়ালের আড়াল বা অদূরবর্তী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পিছনের সিঁড়ি ছিলো আদর্শ জায়গা। ওই সময় সুনানও আড্ডা দিত, খেলত আমাদের সাথে। আর দূর থেকে বাবাকে আসতে দেখলেই লুকিয়ে যেত দেয়ালের আড়ালে। আমাদের অবশ্য তটস্থ হওয়ার কোনো কারণ ছিলো না। কারণ শাহীন আঙ্কেলও আড্ডা, খেলাধূলা – এসব বেশ পছন্দই করতেন। শুনেছিলাম, একসময়ে দুর্দান্ত ফুটবলার ছিলেন তিনি। গোলরক্ষক হিসাবে খেলেতেন ঢাকার ওয়ারী, আবহনী আর বরিশালের মোহামেডান ক্লাবে। বরিশাল জেলা  দলেরও গোলরক্ষক ছিলেন তিনি।

মৃত্যুর কিছু দিন আগে, রাজপথে...
সাংবাদিকতায় ঢোকার পর ছোটবেলার সেই শাহীন আঙ্কেলের আরো বহু পরিচয় জানা হয় আমার। চেনা হয় রাজনীতিবিদ আর আইনজীবি কামরুল আহসান শাহীনকে। এক সময়ে বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাধারন সম্পাদক ছিলেন তিনি। ছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটরও। একইসঙ্গে মূলধারার রাজনীতির সাথেও সক্রিয় ছিলেন পুরোটা সময়। ১/১১ পরবর্তী সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা যখন আত্মগোপনে, তখনও তিনি রাজপথে ছিলেন। বড় বড় পদে থাকলেও তার মদদপুষ্ট কোনো সন্ত্রাসী ছিলো না। এ কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথেও শত্রুতা ছিলো না তার।

শাহীন আঙ্কেলের সাথে আমার শেষালাপ হয়েছিলো সম্ভবত ২০০৮ সালে ঢাকার নয়াপল্টনে, জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় কারযালয়ে। পার্টির তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সাথে আলাপ করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফ্রি আছেন দেখে যেচে গিয়েই কথা বলেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম সুনানের খবরও। এরপরও তার সাথে দেখা হয়েছে বহুবার। কিন্তু কথা হয়নি আর, হবেও না। শুধু পরিবার নয়, পুরো বরিশালকে কাঁদিয়ে তিনি অসীম শূন্য ক্যানভাসে মিলিয়ে গেছেন।
কাকলী ছিলো ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যরীতিতে তৈরী এক মুভি থিয়েটার হল। পুরানো নাম ছিলো জগদীশ হল। সম্ভবত এটি বরিশাল নগরীর দ্বিতীয় সিনেমা হল। ষাটের দশকে এর প্রতিষ্ঠাতা মালিক জগদীশ বাবু দেশান্তরী হওয়ার আগে এটি কিনে রেখেছিলেন সিনেমাপ্রেমী ডা. সোবাহান। তার মৃত্যুর পর ছেলেরাই হলটির দেখভাল করতেন। পরে ঠিক কবে এটি ভেঙে ফেলা হয় তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না, মনে নেই। সম্ভবত গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সংস্কারের অভাবে তারও অনেক দিন আগে থেকেই বন্ধ ছিলো সিনেমা প্রজেকশন। তবু আজও সদর রোড আর ফজলুল হক এভিনিউয়ের সংযোগস্থলের নাম কাকলীর মোড়।
কয়েক বছর আগে এ নিয়ে আলাপকালে সুনান জানিয়েছিলো, অত্যাধুনিক মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার করার পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছেন শাহীন আঙ্কেল। সম্প্রতি জেনেছিলাম, সে কাজ এগিয়েছেও বহুদূর। কিন্তু তা শেষ করে যেতে পারলেন না তিনি। তবুও আশা করি কাজটি দ্রুতই শেষ হবে। বরিশালের প্রথম মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা থিয়েটারের রূপে পুনর্জন্ম নেবে কাকলী বা জগদীশ। তখন এর নাম শাহীন মেমোরিয়াল সিনেপ্লেক্স করলেও কেউ আপত্তি করবেন না নিশ্চয়ই। কারণ কামরুল আহসান শাহীন সেই আধুনিক স্বপ্নবাজ, যিনি বরিশালে মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা থিয়েটার গড়ার স্বগ্ন দেখেই ক্ষান্ত হননি। স্বপ্নটিকে বাস্তবায়নের দোঁড়গোরায়ও নিয়ে এসেছেন। এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে আজ আরো আপন লাগছে শাহীন আঙ্কেলকে। আহা, তিনিও যে চলচ্চিত্রের মানুষ ছিলেন।

১৯ নভেম্বর ২০১৪

অভিজিৎ দাস নিরুদ্দেশ, না গুম?

কোথায় গেলেন কবি ...
বাংলাদেশের তরুণ কবি ও গণসঙ্গীত শিল্পী অভিজিৎ দাস নিরুদ্দেশ, না গুম? – প্রশ্নটি খুব একটা জোড়ালো হয়ে উঠছে না কেন যেন। অথচ প্রায় দেড় মাস ধরে তার কোনো হদিশ নেই । অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের পর তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। ওই মাসের সাত তারিখের পর ফেসবুকেও আর কোনো কার্যক্রম নেই তার। পরবর্তী দিনের শুরুতে, সম্ভবত ভোর ছয়টা বা সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি সহোদর (ছোট ভাই) বিশ্বজিৎ দাসের শ্যামলীর বাসা থেকে বেড়িয়ে যান। এরপর থেকেই লাপাত্তা।

আগের রাতে ভাইয়ের পাশাপাশি বড় বোন চৈতালী দাসের সাথেও বেশ ঝগড়া হয়েছিলো অভিজিৎ’র। তাই পরদিন সকাল থেকেই অভিমানী ভাইকে খোঁজা শুরু করেন তারা। কিন্তু এক দিন, দুই দিন করে হপ্তা পেরিয়ে গেলেও তার আর খোঁজ মেলে না বরিশালে বেড়ে ওঠা এ কবির। অবশেষে গত ১৮ অক্টোবর ঢাকার শেরে বাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করা হয়। পুলিশও ঘটনাটি দ্রুত আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে। এ কবিকে খোঁজার জন্য তৎপর হয় তারা। তিন দিন পর, অর্থাৎ ২১ অক্টোবর অভিজিৎ দাসের পরিবারকে জানানো হয় দেশের সকল থানায় তার ছবি পাঠানো হয়েছে। এরপর আরো একটি মাস পেরিয়ে গেছে। আজও দাসের কোনো সন্ধান মেলেনি।

ভিন্ন রূপে...
নিরুদ্দেশ হওয়ার আগের রাতে ভাইয়ের সাথে অভিজিৎ’র তর্ক হয়েছে মূলত তার দীর্ঘদিনের বোহেমিয়ান জীবনযাপন নিয়ে। মুঠোফোনে তীব্র বাগ্বিতণ্ডা হয়েছে বোনের সাথেও। কারণ বোন তাকে বলেছিলো, চুল-দাঁড়ি কেটে ভদ্রস্থ হতে। কিন্তু অভিজিৎ তার স্বকীয়তা ভাঙতে রাজি নন। তিনি ক্ষেপে গিয়েছেন। চিল্লাপাল্লা করেছেন। সেদিনের কথা বলতে বলতে বিশ্বজিৎ জানান, এর আগে দাদাকে অতটা বিক্ষিপ্ত হতে দেখেননি কখনো।

বিশ্বজিৎ আরো জানান, দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার কথাও বলতেন অভি। যে কারণে খবর দেয়া হয়েছে ওপার বাংলায়ও। বলা হয়েছে সকল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে। কিন্তু কেউ অভিজিৎ’র কোনো খোঁজ জানেন না। সিনিয়র, জুনিয়র বা সমবয়সী বন্ধু, দূরের - কাছের স্বজন; কেউ না। তার আরেক ঘনিষ্ট বন্ধু বলেন, ‘কোলকাতায় যাওয়ার জন্য নতুন করে পাসপোর্ট করতে তিনি ক’দিন বরিশালে দৌঁড়ঝাপও করে ছিলেন। পরে অবশ্য আর পাসপোর্টটি করতে পারেন নাই।’
অভিজিৎ কি তবে তার প্রিয় অগ্রজ বিষ্ণু বিশ্বাসের মতোই স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করলেন? এম্নিতেই বিষ্ণুকে প্রচণ্ড পছন্দ করেন তিনি। তার দুটি কবিতায় সুরও দিয়েছেন। আর বিষ্ণুর মতো তিনিও ডোবেন আজব হ্যালুসিনেশনে। কাছের মানুষেরা তার ভীতিবিহবলতার মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। ১৯৬২’র ২৯ মে ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে জন্মানো বিষ্ণুও হ্যালুসিনেশনে ভীতচকিত হতেন। তিনি দেখতেন একটা সাদা গাড়ী অথবা ছুরি হাতে কেউ একজন তাকে তাড়া করে ফিরছে।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আরো জানিয়ে রাখি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করে ৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বিষ্ণু। কিছুটা বাউন্ডুলে হলেও তার লেখালেখি, আড্ডা - সবই চলছিলো স্বাভাবিক। ছন্দপতন ঘটলো ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায়। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা প্রসূত হিংস্রতা কবিকে বিপর্যস্ত করে মারাত্মকভাবে। করে তোলে আতঙ্কগ্রস্ত। এই আতঙ্ক নিয়েই ১৯৯৩ সালে তিনি উধাও হন। এর প্রায় ১৮ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে তার সন্ধান মেলে।

ফিরবেন জানি...
কয়েক বছর আগে অভিজিৎ জানিয়েছিলেন, বরিশালের জাগুয়া গ্রামের যে জমিতে তাদের আদি ভিটা ছিলো তা দখল করে সেখানে ক্লিনিক তৈরী করছেন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। ভেঙে ফেলা হয়েছে তাদের পুরানো বাড়ি-ঘর, পূর্বপুরুষদের সমাধি। কোনো ভাবে এটা ঠেকাতে না পারার কারণে প্রচণ্ড হতাশ ছিলেন কবি। যদিও তার জ্ঞাতিদের কয়েকজন ক্ষতিপূরন বাবদ কিছু নগদার্থও পেয়েছেন।

বয়সে খানিকটা বড় হলেও অভিজিৎ দাসের সাথে আমার অন্তরঙ্গতায় কোনো ঘাটতি নেই সম্ভবত। যে কারণে তার নিপাট নির্লিপ্ত অভিমানের সাথেও আমি পরিচিত। আর এ কারণেই হয়ত ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, অভিমানী কবিকে লাপাত্তা হতে বাধ্য করিনি’তো আমরা; মানে পুঁজিবাদী চমকে মোহাবিষ্ট স্বজন, বন্ধু আর সমাজ? বা সেলফিজমের যমানাই গুম করেনি’তো তাকে? নানা শঙ্কা উঁকি দেয় মনে।

অভিজিৎ’র নিখোঁজ হওয়াটা যে কোনো বাজে রসিকতা নয়, বরং যথেষ্ট শঙ্কা জাগানিয়া তা প্রথম টের পেয়েছিলাম চৈতালী’দির ফোন পেয়ে। পরে একই শঙ্কা টের পেয়েছি কফিল আহমেদ, টোকন ঠাকুর, কামরুজ্জামান কামু, বিপ্লব মোস্তাফিজ, মাহফুজ জুয়েল, ওয়াহিদ রনি, তপু আহমেদ মুনিরুদ্দিন, দয়িত আন্নাহাল, রোকসানা আমিন, হাসিবা আলি বর্না, প্রবর রিপন, মুয়ীয মাহফুজ, অতনু শর্মা, পদ্ম, ইমরান মাঝি, মহিবুল্লাহ শাওয়াল, রাসেল আহমেদ, আমিনুল এহসান, শ্মশান ঠাকুর, হীরা মুক্তাদির, গালিব হাসান, আসাদ ইকবাল সুমন, আবু বরকত, মিছিল খন্দকার, ধীরা আনান, ফারজানা খান নীপা, অনার্য তাপস, শাহরিয়ার শাওন, হিশাম খান সেতু, মাসুদ পথিক, আনিস রায়হান, দুখু সুমন, সৈয়দ বৃন্ত, আহমেদ হাসান সানি, তাসনোভা তামান্নাসহ তার আরো অনেক শুভাকাঙ্খীর কণ্ঠ বা দৃষ্টিতে। শঙ্কিত সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের চায়ের দোকানদার দুলালও। রাতের পর রাত এই তার দোকানেও কাটিয়েছেন কবি। ছবির হাট সংলগ্ন ওই এলাকাতেই আ্ড্ডা দেন তিনি ও তার বন্ধুরা। দুলালসহ ওখানকার আরো অনেকেই অবশ্য দাবি করেছেন, অভিজিৎ প্রায়ই দুই-তিন মাসের জন্য উধাও হওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু তিনি সত্যিই যে উধাও হয়ে যাবেন, এটা তারা কেউ আন্দাজও করতে পারেননি।

এত শঙ্কার মাঝে দাঁড়িয়েও কেন যেন  মনে হচ্ছে, বইমেলার আগেই ফিরে আসবেন কবি। সাথে থাকবে তার নতুন কাব্যগ্রন্থ। নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ, ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগণ, মাটির চামচ মুখে এবং করপল্লবসঙ্গিনী’র সঙ্গে যুক্ত হবে আরেকটি নাম।
শূন্য দশকের কবিদের নিয়ে এক আলোচনায় পড়েছিলাম – “কবি নামের সঙ্গে নান্দনিক হতাশার যোগসূত্রতা সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই। পৃথিবীর তাবৎ কবি-শিল্পীর বহু মহিমান্বিত সৃষ্টির জন্য নান্দনিক হতাশার রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। বরং বলা চলে, কবিদের সত্ত্বার ভেতর এই নান্দনিক নামক জিনিসটি না থাকলে শিল্পের অনেক কিছুরই জন্ম হতো না। কবিতা বঞ্চিত হতো বহু বিস্ময়কর সৃষ্টি ও সৌন্দর্য থেকে। ঘটনাটা ঘটেছে কবি অভিজিৎ দাসের বেলাতেও। পৃথিবীর মহৎ শিল্পকর্মে এই সহজাত প্রক্রিয়া লক্ষ্য করি বেশ। অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের যে সংবেদন তার প্রতিটি মুহুর্তের অধিবিদ্যাকে কবি অনুভব করেন অতিসংবেদনশীলতা। যারা হতাশায় তাড়িত হয় তারা আসলে জীবনের পক্ষে যায়না। তারা আসলে এই বর্তমান হাইড্রোলিক হর্ণ সংবলিত জীবনধারাকে অস্বীকার করে এবং কাঙ্খিত, স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী স্রোতধারাময় জীবনের অপেক্ষায় থাকে। তাদের হতাশা আসলে এক নীরব প্রতিবাদ-এক নৈঃশব্দিক কাতরতার দ্বারা তারা একে একে প্রকাশ করে যায় নিজেকে। একটি কাঙ্খিত জীবনের জন্যে একটি কাম্য জীবনের জন্য তারা নিজেকে ধ্বংস করে যায়। অতএব লেখক হিসেবে তার এই cosmic pathos - আমরা বুঝি। কবি অভিজিৎ দাস-এর হৃদয় সম্ভবত জীর্ণবস্ত্রের মতো সুঁই হয়ে এ ফোঁড় ও ফোঁড় তোলে। তার আত্মপক্ষীয় লেখার মধ্যে সমুদ্র সমান অসন্তোষ আগ্নেয় উষ্ণতায় বিধৃত। সুষ্ঠু ও সুস্থ আত্মপ্রকাশের অক্ষমতা সম্পর্কে সচেনতা এবং ভয়াবহ অতৃপ্তি এর পরতে পরতে। এই গহীন অতৃপ্তি মানসিক যন্ত্রনা তার সৃষ্টিশীল নন্দন-মানসকে কুঁরে কুঁরে খায়। অতৃপ্তি অসন্তুষ্টি, নিরন্তর পরিবর্তনমানতা শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে উচ্চতর শুদ্ধির কাছে পৌঁছে দেয়। অনেক সময় স্রষ্টার অন্তরকে অক্টোপাশী প্রজননী-বেদনা ফালাফালা করে। তার অভ্যন্তরে সৃষ্টি অগ্নি আলোকিত করে। যে নিজের লাল রক্তকে কালো কালিতে রুপান্তরিত করে সেই তো কবি। আর অভিজিৎ সেই অস্থিরতার সংলাপে অম্লমধু ধারণ করে সেই পথটিকেই বেছে নিয়ে হাঁটছেন। কেননা তিনি রক্ত-মাংসের কবি।”
আন্দোলনে...
কবি অভিজিৎ ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর বাবা এবং তার আগে ২০০৭ সালের ১৬ মে মা’কে হারান। অবশ্য তাদের মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন কাব্যিক উদাসীনতা। সংসারের দিকে তার খেয়াল ছিলো না কোনো। তবে জ্ঞাতসারে কখনো কারো ক্ষতির কারণ হননি আমাদের এই আত্মভোলা বন্ধু । তাই বিশ্বাস করি, তারও ক্ষতির কারণ হবেন না কেউ। যেখানেই আছেন, ভালো আছেন – সুস্থ আছেন কবি। যদিও অযন্ত-অবহেলায় তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব বেশী ভালো নেই জানি। তবুও আশা করতে দোষ কি?

নিখোঁজ হওয়ার আগে দীর্ঘ সময় কবি অভিজিৎ’র কোনো আয় ছিলো না। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিলো দৈনিক আমাদের সময়। পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে শিল্পপতি নূর আলী ও সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খানের দ্বন্দ্ব চলাকালে ছাঁটাই হওয়া কর্মিদের মধ্যে ছিলেন কবিও। এরপর আর কোথাও কাজ করেননি তিনি। তবে কর্মহীন ছিলেন না কখনো। কবি বা যন্ত্রী বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন সারাদিন। আর যেখানেই নিপীরনের খবর পেয়েছেন, ছুটে গিয়েছেন। খোলা গলায় গান ধরেছেন শোষিতদের পক্ষে - ‘দুধ ভাত শুধু তোমাদের আর আমরা কেবলই পাথর চিবুতে বাধ্য’। শোষকদের বিরুদ্ধে গানই তার শ্লোগান। এমন অজস্র গানের স্রষ্টা তিনি। কয়েক বছর ধরে ছবি আঁকার ভুতটাও মাথায় চেপেছে তার । এঁকেছেন এবং হারিয়েছেন অজস্র ছবি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতালকে সমর্থন জানাতে গিয়ে ২০১১ সালের জুলাইয়ে অভিজিৎ গ্রেফতারও হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে তিনি লাঠিচার্জ ও ধাওয়ার সম্মুখীনও হয়েছেন বহুবার। তবুও রাজপথ ছাড়েননি কখনো। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত - পথেই কাটিয়ে দিয়েছেন।
রাজপথে...
অভিজিৎ বলেছিলেন, প্রায় দেড় দশক আগে বরিশালের দৈনিক প্রবাসীতে তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ওস্তাদ ছিলেন সাংবাদিক শওকত মিল্টন। এছাড়াও যদ্দুর জানি অভি বরিশালের দৈনিক আজকের বার্তা, ঢাকার দৈনিক বাংলাদেশ সময়, আর্ট ম্যাগাজিন শিল্পরূপসহ আরো অগণিত পত্রিকায় কাজ করেছেন। বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকাপন ইনিস্টিটিউট (আইআরআই) আর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথেও ছিলেন বেশ দীর্ঘ সময়। ধ্রুবতারা, শূন্য মাতাল, কালনেত্র, কাঠবিড়ালীসহ আরো অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনও বেরিয়েছে তার হাত দিয়ে।

অভিজিৎ দাসের কবিতা

মনোবিকলন
আমার ভাবনার পেরেক
আমি ঠুকতে চাইনি কোনোমতেই
তোমাদের সম্পর্ককেন্দ্রের গোপনীয়তায়
ঘুমের অসমাপ্ত রেখাচিত্র
পাথরে খোদাই হোক
তাও দেখতে চাইনি কখনো
অথচ যখন আজ আমার দিকেই
তেড়ে আসছে তোমাদের ছুড়ে দেয়া
মনোবৈকল্যের বিষাক্ত তীর
অনুভূতির সকল জটপাকানো
শিমুল তুলোকে আমি
টংকারে উড়িয়ে দেখতে চাই
ধুনুরির মত তাই
আজ একবার...

ফেরার পথ
ফেরার পথগুলো কেন এত ঢালময়
যাবার সময় এ কথা তো বলে দাওনি কেউ !

যাত্রাকালে যাকিছু দিয়েছ সাথে ঠিকঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে
গড়িয়ে নেমেছে সেতো পথের ধুলোয়

এ কেমন খাড়া পথে আমাকে পাঠালে
পাহাড়ে ওঠাও সহজসাধ্য এর চেয়ে
ঝরাফুল , একা সে পথের শীর্ষে দাড়িয়ে থেকে তো
তোমাতে আমাতে হয়েছিল পরিমিত পতন সংলাপ !

আমি তাই সমতলে নেমে আসি
না গিয়েই ফিরে এসে বলি:
"ঝরা পাতা গো ,আমি তোমারি দলে"

কফিল আহমেদ, মুয়ীয মাহফুজ ও পদ্ম’র সাথে...
পোশাক
সেলাই মেশিন ছুটছে তুমুল গতি
লজ্জারা যত লুকোচ্ছে এসে
পোশাকের আবডালে
তোমার কণ্ঠে এনে দিতে পরিমিতি
রাষ্ট্র নেমেছে; আধপেটে বাঁচো
কোনোমতে চালেডালে

সকালে এসেছ, রাত হলে হবে ছুটি
ক্যারিয়ার ভরা টিফিন ছিল যা সাথে
তাই ভাগ করে কোনোমতে ডাল-রুটি
‘কাজে হাত লাগা…চুপ যা ! হাড়হাভাতে’…
তবুও এমন কারখানাতেই তুমি
দিন আনো- রাতে খেতে পাওনাতো রোজ
শিশুর কপালে পোড়াচাঁদ যায় চুমি
সাহেবের ঘরে পার্টি, পানীয়, ভোজ !

এ্যাম্বুলেন্স
আমাদের মাঝে কে আছে এমন
একটি ব্যক্তিগত বেদনার নীল এ্যাম্বুলেন্স
সাথে নেই যার!
আমরা প্রত্যেকেই গোপনে বা প্রকাশ্যে
একটি গমগমে নিস্তব্ধ এ্যাম্বুলেন্স
সাথে নিয়ে ঘোরাফেরা করছি
মহাকাশগামী এক এ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে
প্রায়শই আবর্তিত হয় আমাদের ঘিরে
গতরাতে দেখি
মুমূর্ষু স্বপ্নদের নিয়ে গানের ক্লাশে যাচ্ছে
মৃত্যুর স্বরলিপি শিখতে
বেসুরো কণ্ঠে যে কিছু ইস্পাতের
ধ্বনিরাগ ছুঁড়ে দিয়েই খালাস!
আমি আমার দেহের গ্যারেজে ঐ ব্যক্তিগত বেদনার্ত নীল
এ্যাম্বুলেন্সটিকে রেখে পথে নেমেছি
আগামীকাল ওকে সঙ্গে নিয়ে যখন ঘুরতে বেড়োব
রঙ পাল্টে কৃষ্ণচূড়া বর্ণের এই লেলিহান এ্যাম্বুলেন্সটি
তখন ব্রহ্মাণ্ডের সকল মানবযানের পথে
জ্যামের কারণ হয়ে উঠবে
ভেতরে গুমরে চলা বিভৎস স্বপ্ন
যারা আপাত নিস্ফল
কুণ্ডুলি পাকিয়ে উঠবে
বিস্ফোরণের এক মুহূর্ত আগে
আমি আমার ব্যক্তিগত লাল এ্যাম্বুলেন্সের সাথে
একবার লিপ্ত হতে চাই সহবাসে

ভাঙ্গা আয়নার প্রতিবিম্বগণ
একটি ভাঙ্গা আয়না তোমাকে শিখিয়েছে
কিভাবে প্রতিবিম্বগণ নিজেরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে
প্রকাশ্য ময়দানে ইহলৌকিকতার দুর্নাম রটায় ।

যে সকল অপবাদকে তুমি প্রশংসা
পদবাচ্য মেনে গভীর রাতের পথে গেয়ে গেছ উন্মাদগীতি ,
তাতে প্রশাখাবহুল নক্ষত্রও
মাথার ওপরে ফেলেছে তীর্যক রশ্মির ফলা
আর নগরের সমাধিস্হ তন্দ্রাহীন প্রেতেরাও
তোমার বেসুরো কন্ঠের বৈতালিক লয়ে
বিদ্রুপে ইঙ্গিত ছোড়ে ,
তুমি কি এখনো তবে গেয়ে যাবে
পুরোনো সে শুকনো পাতার সুরে শীতের সংগীত ?

আহা ! বসন্ত জাগ্রত দ্বারে ...

ভোরবেলা দেখো যদি পরিত্যক্ত প্রতিবিম্বগণ
তোমারই শবাধার কাঁধে নিয়ে
সবুজ পাতায় ঢেকে রেখে গেছে তোমারই দুয়ারে,
তবে গোপনতাকামী স্মৃতির পোকারা
যেন শতচ্ছিন্ন তোমার শরীর খোদাই করে লিখে রাখে
"তিনি, কবি, নিজেরই প্রতিবিমম্বগণ যার হন্তারক"।

কবি ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ - এই ছবিটি আপলোড করেছিলেন।
এই পোস্টের সকল ছবি ও কবিতা তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে নেয়া।

১৮ নভেম্বর ২০১৪

কৈশোরের টেম্পু স্ট্যান্ড, বন্ধু ...

old mate | © eon's photography / pap
ছবির এই মানুষটি বহু পুরানো বন্ধুদের একজন। অথচ তার আসল নাম কখনো জানাই হয়নি। আমার কাছে আজও তার নাম ‘দাদু’। তাকে এ নামেই ডাকতাম আমরা, মানে বন্ধুরা। প্রায় ১০ বছর পর দেখা হয়েছিলো এই দাদুর সাথে, তা’ও দুই বছর আগে - ১২’র নভেম্বরে - বরিশাল মহাশ্মশানে। 
স্কুল জীবনের প্রিয় আড্ডাখানাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো নতুন বাজার টেম্পু স্ট্যান্ড। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০০-০১ সালের সেই টেম্পু স্ট্যান্ডের সাথে আজকের স্ট্যান্ডের কোনো মিলই নেই।

ওই সময় পুলিশ ফাঁড়ির ঠিক উল্টোদিকে সারি বাঁধা টিনশেড ঘরগুলোয় ছিলো ওয়ার্কসপ। সারাদিন টেম্পু মেরামতের কাজ হত। আর ওয়ার্কসপগুলোর পূর্ব প্রান্তে ছিলো সোহেল ভাইয়ের চায়ের দোকান।  আর তার দোকান ঘেঁষা রেলিঙ দেয়া কালভার্ট পেরুলেই কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি। দুঃসাহসিক ডাকাত হিসাবে বরিশাল অঞ্চলের এক ‘মিথিক্যাল ক্যারেক্টার’ ছিলেন ওই মোল্লা।  মন্ত্রবলে তিনি বিভিন্ন পশুপাখি রূপ ধারন করতে পারেন, এমন গল্পও শুনেছি।

মোল্লার বাড়ির সেই রেলিঙ দেয়া কালভার্টের অন্যপাশে ছিলো টিএন্ডটি’র দুটি ডিস্ট্রিবিউসন পয়েন্ট কেবিনেট। তারই সামনে ছিলো দাদুর সেলুন। সেলুন বলতে - ওই কেবিনেট আর বিদ্যুতের খুঁটির সাথে কসরত করে ঝুলানো পলিথিনের চালা, ছোট্ট আয়না, হাতলভাঙা চেয়ার, আর একটি টিনের বাক্সে খুর, কাঁচি, ফিটকিরি, সাদা কাপড়সহ আনুসাঙ্গিক কিছু উপাদান। চুল, দাঁড়ি কাটার চেয়ে মাথা আর শরীর মেসেজে খ্যাতি ছিলো তার। তবে খুব বেশী কাজ পেতেন না। এ নিয়ে কোনো হা-হুতাশও ছিলো না তার। তামাম অনিশ্চয়তাও ঢেকে রাখতেন পুরু মোটা চশমার আড়ালে । যদিও মাঝে মাঝে দেখতাম চেয়ারে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। কি ভাবনায় ডুবে যেন রিক্সা-গাড়ির আসা-যাওয়া দেখছেন।  আবার কখনো মুড ভালো থাকলে খুব আয়েশ করে বিড়ি ধরিয়ে তুমুল উৎসাহ নিয়ে নানান আলাপ জমাতেন,  বিশেষ আগ্রহ ছিলো স্থানীয় রাজনীতির ব্যাপারে।
সোহেল ভাইয়ের দোকান, রেলিঙ দেয়া কালভার্ট আর দাদুর সেই সেলুনের সামনে সিরিয়ালে থাকত বানারীপাড়া রুটের টেম্পুগুলো । কৈশোরের কত সকাল, দুপুর, রাত কেটেছে - ওই টেম্পুগুলোয়। অদূরেই ছিলো জগদীশ আশ্রম। সেটিও আমাদের আড্ডাখানা ছিলো দীর্ঘ দিন। লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকা বা গলা ছেড়ে গান গাওয়ার সেই মুহুর্তগুলো - আহা, কতই না অনাবিল ছিলো। 

বহুতল ভবনের নীচতলার একটি স্টলে আশ্রয় নিয়ে সোহেল ভাইয়ের চায়ের দোকান আজও টিকে আছে।  দাদু অবশ্য টিকতে পারেনি। দু’বছর আগের সে সাক্ষাতে বলেছিলেন, তার সেলুন এখন কাউনিয়ার মড়কখোলা পোল সংলগ্ন ডোমপট্টির বিপরীতে। বলেছিলাম যাব, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।  আশা করি - দাদু আজও ভালো আছেন, থাকবেন।

১৩ নভেম্বর ২০১৪

বরিশালই ‘আপন’ নায়লার

ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে
নিজের ব্যক্তিগত একাউন্টে অনুসারী ৭০ হাজার ৫৩১ জন আর অফিসিয়াল পেইজে দুই লাখ ৪০ হাজার ৪২৯ জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এই পরিসংখ্যান অবশ্য তার ‘উঠতি জশ’ বোঝানোর জন্য যথেস্ট নয়। পেশায় দন্ত চিকিৎসক হলেও স্বল্পবসনা বাংলাদেশী মডেল, আইটেম গার্ল বা নায়িকার পরিচয়ে আলোচনায় আসা এ তরুণীর পরিচিতি দিন দিনই বাড়ছে। সামাজিক গোঁঢ়ামীর পরাকাষ্ঠা ভাঙার সাহস দেখানোয় একদিকে যেমন সাধুবাদ পাচ্ছেন; অন্যদিকে আবার ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ ও ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ পরিপন্থী হিসাবেও অভিযুক্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ দেশ-বিদেশে ইতিবাচক ও নেতিবাচক, দু’ভাবেই প্রচার পাচ্ছেন তিনি। গত শতকের শেষ দশকে (১৪ ডিসেম্বর) বরিশালে জন্ম নেয়া এ তরুণীই এখন দেশী মিডিয়ার একমাত্র ‘সেক্সসিম্বল’। এতক্ষণে অধিকাংশ পাঠক তার নাম আন্দাজ করে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। সময়ের আলোচিত চরিত্র, নায়লা নাঈম। বরিশাল থেকে পরিচালিত এক অনলাইন নিউজ পোর্টাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তার এ সাক্ষাতকারটি নেয়া হয়েছিলো।

ঈয়ন : বরিশালের কোন এলাকায় জন্ম আপনার? বাবা-মাসহ পুরো পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
নায়লা নাঈম : বরিশালের পটুয়াখালিতে আমার জন্ম। বাবা, মা ও ছোট ভাইকে নিয়েই আমার পরিবার। বাবা বেসরকারী চাকরীজীবি আর মা আইনবিদ। আর ছোট ভাই পড়াশোনা করছে।

ঈয়ন : কেমন ছিলো আপনারৈ শৈশব, স্কুল জীবন?
নায়লা নাঈম : আমার শৈশব অনেক বৈচিত্রময়। বাবার চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আমার শৈশব কেটেছে। সবশেষে অবশ্য বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া হয়। আসলে স্কুল জীবনটা অনেক আনন্দময় ছিলো। অনেক বন্ধু-বান্ধবী ছিলো সেসময়। আমার স্কুল জীবনের খুব কাছের কোনো বান্ধবীর সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। অনেক মিস করি তাদের। অনেক মনে পড়ে স্কুলের স্মৃতিগুলো।

এখন তিনি
ঈয়ন : কি জাতীয় ঘটনার স্মৃতি?
নায়লা নাঈম : মনে পড়ে, আমার এক স্কুলে অনেক গাছের চারা লাগানো ছিলো । আর আমার নিজেরও বাগান করার প্রবল শখ ছিলো। বাসার টবে অনেক গাছ লাগাতাম। তখন মাঝে মাঝে স্কুল থেকেও গাছ নিয়ে এসে বাসার টবে লাগাতাম। এছাড়া আমার সেই স্কুলে একটা পুকুরও ছিলো। প্রায় প্রতিদিন স্কুলের পুকুর পাড়ের শীতল হাওয়ায় অনেকক্ষন বসে থাকা আমার শৈশবের অন্যতম আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

ঈয়ন : কুসুমকুমারী দেবী, কামীনি রায়, মনোরমা বসু মাসীমা, সুফিয়া কামাল বা মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগমের মতো যে অগ্রগামী নারীরা বরিশালে জন্মেছিলেন, তারা কি আপনার জীবন দর্শণে কোনো প্রভাব ফেলেছেন?
নায়লা নাঈম : আমি সবসময়ই বরিশালে জন্ম নেয়া কৃতি সন্তানদের অনেক শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তাঁদের আদর্শ, তাঁদের সংগ্রাম ও সফলতা আমায় এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়।

________________________________________

ঈয়ন : বলা হচ্ছে আপনি বাংলাদেশের প্রথম সেক্সসিম্বল মডেল, আইটেম গার্ল ও নায়িকা। আপনার আগে এ ক্ষেত্রে কেউ এতটা সাহসী হয়নি। এ সাহস আপনি কোথায় পেলেন? আর এ সাহস প্রদর্শন কি শুধুই খ্যাতির তাড়নায়, না নারী অগ্রযাত্রার বিষয়টিও আছে আপনার ভাবনায়?
নায়লা নাঈম : আসলে ডেণ্টিস্ট হবার পাশাপাশি, আমি যখন মডেল হিসাবে কাজ করি, আমার বিবেচনায় প্রাধান্য থাকে- যে প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছি সেই প্রোডাক্টটিকে সফলভাবে তুলে ধরা। আমার পাশাপাশি অনেকেই কিন্তু একইরকম কাজগুলো করছেন। কিন্তু তারা হয়ত আলোচনায় আসতে পারেননি। শুধুমাত্র আমার কাজগুলো নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। অনেকে হয়ত ব্যাপারটিকে সহজভাবে নিতে পারেননি এবং সমালোচনা করেছেন। কিন্তু অনেকেই আবার ওই একই কাজগুলোর প্রশংসাও করেছেন। তবে একটি ব্যাপার, কাজ করার সময় খ্যাতির ব্যাপারটা আমার কখনোই মাথায় থাকে না। আমি সব সময় বিশ্বাস করি- ভালো কাজ করলে, সঠিকভাবে মূল্যায়িত হলে- খ্যাতি পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভালো কাজের জন্যই আজ আমি এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি।
আলোকচিত্রীঃ নাসের আবু
ঈয়ন : বাঙালী মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ কাঠামো নাড়িয়ে প্রচলিত অনুশাসনের প্রতি বৃদ্ধঙ্গুলি প্রদর্শনের প্রেক্ষিতে যে প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠেছে তা কি করে সামলাচ্ছেন?
নায়লা নাঈম : আমার কাছে মনে হয়, একবিংশ শতাব্দীতে সময়ের সাথে সাথে আমাদের মূল্যবোধে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে একটা কাজ যেভাবে দেখা হত, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে সেটা এখন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হচ্ছে। এরপরও প্রতিটি কাজেরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থাকবে। যদিও ‘Different People, different thoughts’। এক্ষেত্রে আবারও বলছি, আমার যে কাজগুলো নিয়ে সমালোচনা হয়েছে, সেগুলো কিন্তু অনেক প্রশংসাও পেয়েছে। মূল ব্যাপার হচ্ছে, একটা কাজ কে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন - সেটা যার যার একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। তবুও আমি আমার কাজের প্রতিটি সমালোচনাকে অনেক গঠনমূলক ভাবে নেই। কারো সমালোচনার মাঝে সৃজনশীল কিছু পেলে তা গ্রহন করতে বা সেখান থেকে কিছু শেখার থাকলে সেটাকে ইতিবাচকভাবে নিতে আপত্তি নেই আমার।

ঈয়ন : পরিবারিক পারিপার্শ্বিকতা কতটুকু সহায়ক বা প্রতিবন্ধক হয়েছে?
নায়লা নাঈম : আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, মিডিয়ায় কাজ করার ব্যাপারে পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে এসেছি সবসময়। আমার পরিবার আমার কাজের সবচেয়ে বড় সমালোচক। তাদের সমর্থন ছাড়া কখনোই এত দূর আসা সম্ভব ছিলো না।
তন্ময় তানসেন পরিচালিত ‘রানআউট’ সিনেমার গানের দৃশ্যে
ঈয়ন : এ মুহুর্তে আপনার জীবনের লক্ষ্য কি? মানে এ জীবনে কি কি করতে চান?
নায়লা নাঈম : আপনারা জানেন যে, পেশাগত জীবনে আমি একজন ডেন্টিস্ট, মডেল এবং অভিনেত্রী। ঢাকায় আমার নিজের ক্লিনিক আছে, সেখানে আমি নিয়মিত রোগী দেখে থাকি। এই মুহূর্তে আমার লক্ষ্য, ডেন্টিস্ট হিসাবে নিজেকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এছাড়াও অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে একজন সফল অভিনেত্রী হিসাবে দেখতে চাই।
ঈয়ন : রিলেশনসিপ স্ট্যাটাস -
নায়লা নাঈম : এখনো আমি আমার মনের মত কোনো মানুষ খুঁজে পাইনি। আমি যাকে পছন্দ করবো সে দেখতে যেমনই হোক, মানুষ হিসাবে তাকে অবশ্যই অনেক ভালো, মানে সৎ ও চরিত্রবান হতে হবে।
ঈয়ন : আত্ম-সমালোচনা করুন।
নায়লা নাঈম : আসলে ডেণ্টিস্ট্রি, মডেলিং ও অভিনয়, তিনটি কাজ নিয়েই আমাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই মাঝে মাঝে আমার নিজের কাছে মনে হয় আমি যদি শুধুমাত্র একটি পেশায় নিয়োজিত থাকতাম তবে সে পেশায় আজ আরো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকতো; আরো ভালো কাজ করতে পারতাম।

সাম্প্রতিক ফটোস্যুট
ঈয়ন : বরিশাল ও বরিশালের মানুষ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
নায়লা নাঈম : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হলেও বরিশাল আমার সবচেয়ে পছন্দের শহর। বরিশাল শহরটাকে আমি অনেক মিস করি। বরিশাল শহরের সাথে আমার কৈশোরের অনেক অদ্ভুত প্রিয় স্মৃতি জড়িত। প্রথম ভালোবাসা বরিশালকে ঘিরে, প্রথম ভালোবাসার মানুষটাও ওই শহরের। তাই আমার এই ব্যস্ত জীবনের মাঝেও সময় পেলেই বরিশাল যাওয়ার ইচ্ছা থাকে আমার। ইচ্ছে করে হারানো কাছের বন্ধুদের খুঁজে পেতে। যাদের সাথে স্কুলে বসে অনেক আড্ডা দিতাম, ছুটির পরে একসাথে হেঁটে বাসায় ফিরতাম।

ঈয়ন : বরিশালবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে?
নায়লা নাঈম : বরিশালবাসীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বরিশালের মানুষ আমার অনেক আপন ও কাছের মানুষ। আমি সত্যি গর্বিত এই ভেবে যে, বরিশালবাসীরা মানুষ হিসাবে অনেক আন্তরিক ও ভালো মনের মানুষ। এই জনপদে জন্মগ্রহন করে আমি গর্ববোধ করি।
নায়লা নাঈম সম্পর্কে কৌতূহলীরা অন্তর্জালের যে কোনো খোঁজ যন্ত্রে বাংলা বা ইংরেজীতে তার নামটি লিখে অনুসন্ধান করলে নিরাশ হবেন না। খুঁজে পাবেন বহু সংযোগ। তার ওয়েবসাইটের ঠিকানা - www.nailanayembd.com আর পেইজের facebook.com/artist.nailanayem
অফিসিয়াল পেইজের স্ক্রিনসট

০৮ নভেম্বর ২০১৪

দেশী ধানের ১০ হাজার জাত বিলুপ্ত!

বাংলায় ধান চাষ কবে শুরু হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকীল। তবে- পন্ডিতদের
অনুমান খৃষ্টের জন্মের ২৫০০ বছর আগে থেকে এখানে ধান চাষ হয়ে আসছে।
মাত্র ৫০ বছর আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাদৃত সুস্বাদু ও সুগন্ধি ঝারাবাদল, বাঁশফুল, বর্ণজিরা, তুলসিমালা, মধুমাধব, দুধজ্বর এখন আর দেখা যায় না। প্রবীণদের ভাষায়, এসব ধানের চালে তৈরি সুস্বাদু পিঠা-পায়েস, খই-মুড়ি ও ভাতের গন্ধ এবং স্বাদ ছিল অসাধারণ। ঐতিহ্যবাহী রাজভোগ, দুধরাজ, পঙ্খিরাজ ধানের আলাদা-আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। রাজভোগ ধানের চাল চিকন, বেশ লম্বা এবং ভাত হতো ধবধবে সাদা। আবার দুধরাজ ধানের চাল ব্যবহার হতো পিঠা-পায়েস তৈরিতে। পঙ্খিরাজ ধানের চাল খৈ, মুড়ি, চিড়া তৈরির জন্য ব্যবহার হতো। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় রাঁধুনি পাগলু নামে এক ধরনের ধানের আবাদ হতো। এ ধানের চালের ভাত রান্নার সময় এর সুগন্ধে পাশে বসে থাকা রাঁধুনিদের পাগল হওয়ার উপক্রম হতো। গ্রামের এক বাড়িতে রান্না করা হলে আশপাশের বাড়ি থেকেও এর সুগন্ধ পাওয়া যেত। দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ চাল দিয়ে দেবতাকে ভোগ দেয়া হতো। তৎকালীন জমিদার বা শাসকরা উপঢৌকন হিসেবে হীরা, পান্না, স্বর্ণ মুদ্রা পেয়ে যত না খুশি হতেন, তার চেয়ে বেশি খুশি হতেন কাটারিভোগ চাল পেয়ে।

স্বাধীনতার পরও দেশের অনেক জেলাতেই আবাদ হতো হাসবুয়ালে, রঙ্গিলা, জোয়ালকোট, ধলাবায়রা, বিদিন, নোড়াই সাটো, পরাঙ্গি দীঘা, ভোরানটা, খৈয়ামটর, দলকচু, বাঁশিরাজ, ঝিঙেঝাল, দেবমনি, লতাটেপি, দুধমনি, কালাবায়রা, গন্ধকোস্তের, গোয়াই, আশ্বিন দীঘা, আশ্বিন মালভোগ, বানাজিরা, সাধু টেপি, ঠাকুরভোগ, নলবিরণ, মানিকদীঘা, গৌরীকাজল, সোনা রাতা, চন্দী, কলারাজা, বাঁশফুল, তুলসিমালা, ময়নাশাইল, মধুবাধব, ফুলমালতি, খাসিয়া বিন্নি, ঠাকরি, পঙ্খিরাজ, লালটেপি, বিকিন, গজারি, কচুশাইল, দুমাই, বগি, অসিম, বর্ণজিরা, ফটকা, ঘোটক, কাউলি, দুধজ্বর, বাজলা, বিরল, আশা, গাজী, কইতাখামা, মাতিয়ারি, মুগবাদল, চেংরামুরি, পুঁথিবিরণ, ঝরাবাদল, মধুবিরণ, গান্ধিশাইল, সানাঝুরি, হাতকড়া, চাপরাস, মুরালি, ময়নামতি, লতাবোরো, দুধকলম। এসব ধান এখন খুব কম পরিমাণ জমিতেই আবাদ হয়। আউশ, রোপা আমন এবং বোনা আমন প্রজাতির ধানের মধ্যে নাজিমুদ্দিন, বাউরস, চেংড়ি, লাটিসাইল, মুরালী, বালাম, ভুতুবালাম, কাতিছিনি, নিহি, ছিরমইন, খৈসা, পাখবিরনী পশুআইল, দুধকাতারী ও আড়াইসহ কয়েক হাজার প্রজাতির ধানের নাম ঢাকা পড়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে। নেত্রকোনা জেলার উপজাতি হাজং, গারো, রাংসা, সাংমা, মান্দা ও দারিংরা এক সময় বিন্নি ধান চাষাবাদ করতেন। এ ধানের আবাদ কমতে শুরু করেছে। বরিশালের বানারীপাড়ার ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বালাম ধানের চালের সুখ্যাতি ছিল দেশ-বিদেশে। বানারীপাড়ার মলঙ্গা, নলেশ্রী ও ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামগুলোতে চাষ হতো বালাম ধান। তাই বালাম চালের জন্য বিখ্যাত ছিল এসব এলাকা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চাল ব্যবসায়ীরা বানারীপাড়ায় এসে চাল ক্রয় করে তাদের এলাকায় নিয়ে যেতেন। বালামের স্থানীয় জাতের মধ্যে সীতাভোগ, জয়না, নলডোক, রূপের শাইল, লোতরমোটা, কুরিয়ারগালী, কুরিশাইল, কাজল শাইল, রাজশাইল, কুটিআগনি, বেতিচিকন, কেয়া মৌ, কেরাঙ্গাল, বাঁশফুল, ডিঙ্গামনি ও লক্ষমীবিলাসের নাম এখন অনেকেই জানে না। এদিকে হাওরাঞ্চলে সুস্বাদু ও সুগন্ধি কাব্যিক ধান বাঁশফুল, বর্ণজিরা, ঝরাবাদল, তুলসীমালা, খাসিয়া বিন্নি, গাজী, জোয়ালকোট, দুধজ্বর, মধুমাধব, হলিনদামেথি, স্থানীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল। এসব ধানের অধিকাংশ আর দেখা যায় না।

বেশ মুগ্ধতা নিয়েই পড়েছিলাম সাংবাদিক শফিক বাশারের লেখাটি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে (৪ জুলাই, ২০১৩) এটি প্রকাশ করে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ। শিরোনাম ছিলো - ‘হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের ধান : বাড়ছে উচ্চ ফলনশীন জাতের চাষ’। শুরুতেই শফিক লিখেছিলেন - ‘টোপা চাউলের ভাত রান্না করলে মৌ মৌ গন্ধে চাইর দিক ভইররা যাইত। এই ভাত এমনি এমনিই খাওয়া যাইত। টোপা চাউলের ভাতের স্বাদের কথা জীবনেও ভুলতে পারতাম না’- এভাবেই টোপা নামক ধানের চালের স্বাদ ও সুগন্ধের কথা বলছিলেন কিশোরগঞ্জের ইসলামপাড়া গ্রামের কৃষক গেন্দু মিয়া। এক সময় এ এলাকার কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় ছিল টোপা ধান। ৩০ বছরের ব্যবধানে এ ধানের জায়গা দখল করে নিয়েছে উফশী জাতের ধান। শুধু টোপা নয়, ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা মিটাতে সারাদেশ থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিবান্ধব হাজারও জাতের দেশি ধান।
খবরটি নিঃসন্দেহে শঙ্কার। একই বিষয় নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো আজ (৮ নভেম্বর, ২০১৪) ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি মজিবর রহমান খানের তৈরী এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম - ‘হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের ধান’। যাতে উল্লেখিত তথ্যানুযায়ী, গত একশ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার জাতের দেশি ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাসের বরাত দিয়ে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, ১৯১১ সালে ১৮ হাজার জাতের ধানের একটি রেকর্ড আছে। ১৯৮৪ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে করা একটি জরিপে ১২ হাজার ৪৮৭ জাতের হিসাব পাওয়া যায়। সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে আট হাজার জাতের ধান আছে।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইরি) বিশেষজ্ঞ ড. জে পি হেক্টর ধানের জাতের একটি ক্যাটালগ তৈরি করেছিলেন। ওই ক্যাটালগে বলা হয়েছে, সে সময় অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ২০ হাজার জাতের ধানের চাষ হতো। এদিকে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, হারিয়ে যাওয়া ধানের জাত সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ভূপেশ কুমার মণ্ডল। তবে মানবকল্যাণ পরিষদ (এমকেপি) নামের স্থানীয় একটি সংস্থার পরিচালক রবিউল আযম তাদের প্রতিবেদককে জানান, একটি দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ঠাকুরগাঁওয়ে ১৬টি প্রায় বিলুপ্ত ধানের জাত কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করতে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তাঁরা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন সীমিত আকারে বিলুপ্তপ্রায় দেশি জাতের ধান সংরক্ষণে কাজ চলছে।

চাষ করা জমিতে ধানের চারা রোপণ করা হচ্ছে। ছবি: আনিস মাহমুদ, সিলেট
বিতর্কিত তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহারের এক সাক্ষাতকারে জেনেছিলাম, তার প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) কথা। শুনেছিলাম, তারা দেশি জাতের ধান সংরক্ষণের পাশাপাশি হাইব্রীডাইজেশনের দৌরাত্ম্যরোধে কাজ শুরু করেছে। এই ব্যাপারে মঞ্জুর মোর্শেদ নামের এক ব্লগারের মন্তব্য - ‘ফরহাদ মজহার বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে একজন পথিকৃৎ। শাইখ সিরাজদের হাইব্রিড যুগে উনি বায়ো পাইরেসি বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।’ তবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে সন্ধান পাই আরেক ফরহাদের। তিনি টাঙ্গাইলের ফরহাদ আহাম্মেদ। জেলা শহরের সদর রোডের বটতলা এলাকার এই বাসিন্দা একজন কৃষি সাংবাদিক ও কলেজ শিক্ষক। দেশী জাতের ধান বিলুপ্তি নিয়ে তিনি এক প্রতিবেদনে লিখেছেন - ‘এ দেশ থেকে অসংখ্য ধানের জাত বিলুপ্ত হওয়ায় উদ্বেগের কারণ হয়েছে। উফশী ও হাইব্রিডের দাপটে এসব দেশি জাতের ধান এখন খুব কম চাষ হয়। মূলত ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য দেশি জাতের ধান বিলুপ্ত হচ্ছে।’

ফরহাদ আহাম্মেদ আরো লিখেছেন, গত ৭০ বছরেই সাড়ে নয় হাজার জাতের ধান এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার জাতের ধান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জার্মপ্লাজম সেন্টারে সংরক্ষণ আছে। আর কৃষক চাষাবাদ করছে ৫০-৬০টি দেশি জাতের ধান। হাইব্রিডের দাপটে এগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। দেশি ও উফশী জাতের চাষাবাদ কমে গেলে আস্তে আস্তে এগুলোও বিলুপ্ত হবে। এতে কৃষকের কাছে কোন বীজ থাকবে না। দেশ বীজ শূণ্য হয়ে যাবে। বীজের জন্য বহুজাতিক কোম্পানীর উপর নির্ভর করতে হবে। দেশের উৎপাদিত ধানের জাত বিলুপ্ত হলে আমাদের প্রধান খাদ্য ভাতের বৈচিত্রতা থাকবে না। এছাড়াও দেশ কৌলি সম্পদ হারাবে। প্যাটেন্ট না করলে এগুলোর মালিকানাও হারাবে বাংলাদেশ। এজন্য দেশি জাতের ধান-বীজ শুধু জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করলেই হবে না। মাঠ পর্যায়ে সবসময় চাষাবাদের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে কৃষকদের ভর্তুকি দিতে পারে। প্রদর্শনী প্লট করে কৃষকদের দেশি জাতের ধান চাষে আগ্রহী করতে হবে। যাহোক, ধানের জাত বিলুপ্ত থেকে রক্ষার জন্য কৃষক, কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গবেষণা ইন্সটিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট সত্তর দশকে সারা দেশে জরিপ চালিয়ে ১৯৮২ সালে ৩৫৯টি উপজেলার সব ইউনিয়ন থেকে ১২ হাজার ৪৮৭টি ধান জাতের তালিকা তৈরি করে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে তিন হাজার ১৮৫টি, রাজশাহী বিভাগে তিন হাজার ৯৯২টি, চট্রগ্রাম বিভাগে তিন হাজার ৩০টি ও খুলনা বিভাগে দুই হাজার ৯৯২টি জাতের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে থেকে যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট জার্মপ্লাজম সেন্টারের জিন ব্যাংকে আট হাজার ৪৫১ জাতের ধান রক্ষিত আছে। এর মধ্যে তিন হাজার রোপা আমন, এক হাজার বোনা আমন, এক হাজার ১০০ আউশ ও ৫০০ বোরোজাত রয়েছে। ১৯১৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক হাজার ৪৪২টি জাতের ধান সংগ্রহ করা হয়। ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এর পরামর্শে ও সহায়তায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধানের জাত সংগ্রহ করেন। ১৯৭০ সালে ধানের জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেও ১৯৮৫ সালে আধুনিকায়ন করা হয়। সংগৃহীত সব জাতের বৈশিষ্ট্য নিবন্ধন করা হয়েছে। কলেররোডে র্ফোট কালিং জিন ব্যাংকে মাটির নীচে এ উপমহাদেশের প্রায় ৪০ হাজার ধানের জাত সংরক্ষণ আছে বলে জানা যায়। রাজশাহীর হেরিটেজ বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থার কাছে ১০০-১৫০ ও সিলেটের আব্দুল বাছিত নামের এক ব্যক্তির কাছে ৬০-৬৫টি জাতের সুগন্ধি ধানের বীজ সংরক্ষিত আছে।
এছাড়া প্রবীণ ব্যক্তিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব ধানের জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করা হয়েছে; সেগুলো হলো- পারাঙ্গী, সোনামুখী, দাদখানি, চিত্তরাঙি, চন্দ্রকুলি, লক্ষ্মীবিলাস, আকাশপালি, বনকামিনী, মাগুরডিমে, মুগিবালাম, দুধেশ্বর, পালকশাইল, পঙ্খীরাজ, ময়ূরলতা, কাজল, সূর্যমণি, কটকতারা, রাঁধুনিপাগল, হনুমানজটা, হলুদগোটা, গেরুমুড়ি, নোনাকুর্চি, কালোমেঘি, সূর্যমুখি, খেজুরঝুপি, বাদকলসকাটি, দোলাভোগ, লক্ষ্মীদীঘা, গদ্যলাকী, চিংড়িমুড়ি, পোড়াবিন্নি, শিলগুড়ি, কাটারিভোগ, মহিষদল, মাটিচাক, বটেশ্বর, ফুলবাদাম, হরিলক্ষ্মি, সরিষাজুড়ি, মধুশাইল, ফুলমালা, বাশঁফুল, সরিষাফুলি, বৈলাম, গিগজ, মধুমালতি, যাত্রামুকুট, বাবুইঝাঁক, জলকুমারি, গান্ধিভোগ, লেচুশাইল, ফুলমুক্তা, বেনামুড়ি, বেগুনবিচি, রায়দা, চান্দাবিন্নি, খুরমা, সাগরধান, পুড়াবিন্নি, কাচরা, গোচিবোরো, চিনিসাগর, রাজভোগ, বিরই, পটকা, পাথরনাতী, ফুলকাটি, ঠাকুরভোগ, সাইটা, তুলশিমালা, দুলাই, ভাতুরি, মুগি, চাপালি, বরণ, চামারাসাদা, চামারা লাল, কাইকা, ভাওইলা, কাতিকাইকা, পাজরা, ঢেপা, গাইঞ্জা, খামা, পূর্বাচি, বাইশবিশ, গাবুরা, বাজাইল, দিঘা, জোয়ালভাঙ্গা, কাশকাখি, কার্তিকাশাইল, রবিশাইল, লতিশাইল, আইআর ৮, ঝাউলতা, আশমতিয়া, হিজলিকামা, লোহাগড়া, মুইরল, গরফা, ধরিয়ান, বাদল, কার্তিকা, তিলকাচারি, আশ্বিণা, ভদোইয়া, বাদশাভোগ ইত্যাদি।
প্রতিটি ধানের নামের পেছনে রয়েছে বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস। আর প্রতিটি চালের স্বাদ ও গন্ধ বৈচিত্রময়। ধানের ইতিহাস থেকে জানা যায় - রায়েদা এ দেশের প্রথম ধান, যা খুলনা অঞ্চলে প্রথম পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে ধান আবাদ হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে থেকে। পাজাম ধানটি পাকিস্তান আমলে এ দেশে আনা হয়। ধানটির জন্মস্থান জাপান। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ধানটির নাম দেয় পাজাম। পাকিস্তানের পা জাপানের জা এবং মালয়েশিয়ার ম দিয়ে পাজাম নাম হয়েছে। সুগন্ধি জাতের ধান হচ্ছে কালিজিরা, বাদশাভোগ, চিনিগুড়, কাশকাখি, রাধুনিপাগল, বাশমতি, বেগুনবিচি ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিটির রয়েছে উপজাত। যশোর এলাকা থেকে বিলুপ্ত ধান হচ্ছে-শালকোল, কলামোচা, মেহেরফল, বাবুই, কেরশাল, ভাড়াল, হলদি গিরে, মনহর, গাম্ভির, হলদানি, মাসকালি, চিনিআলো, পাটনাই, রহমত, খাসকানি, এইচআরবি, শ্রাবনী, চিনিকাই, মানিকাদিগে, কাচেরি, মুরারি, বিরুইন, উরিচেদড়া, আপছায়া, কয়েসাবিন্নী, জসা, স্বর্ণপুটি, মোহনভোগ, দুধশাইল, স্বর্ণা, সুন্দরশাল ইত্যাদি। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর-ঘাটাইল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে দুলাই, ভাতুরি, সাইটা, মুগি, চাপালি, বরণ, ঢেপা, গাইনজা, বাঁশিরাজ, কাতিকাইকা, ইত্যাদি। এর অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর স্থান করে নিয়েছে ৫৬ জাতের উফশী ও ৮-১০ জাতের দেশি-বিদেশি হাইব্রিড জাত।

ধানক্ষেতে সার দিচ্ছেন এক কৃষক। ছবিটি সংগ্রহিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০-৫১ সালে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৬২ লাখ টন। তখন এই পরিমাণ ধান থেকে চালের প্রাপ্যতা ছিল ৫৫ লাখ ৮০ হাজার টন। সে সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি ২১ লাখ। দৈনিক মাথাপিছু ৪৫৪ গ্রাম হিসাবে খাদ্যের চাহিদা ছিল ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টন। পরবর্তী দশ বছরে দেশে চালের উৎপাদনের বার্ষিক পরিমাণ ছিল এক কোটি সাত লাখ টন। পরর্তী সময়ে দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে খাদ্যের চাহিদা। গত ২০১১-২০১২ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার ১০১ টন। ১৯৫১ থেকে ২০১২ সাল ৬১ বছরে আবাদি জমির পরিমাণ না বাড়লেও উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কার ও চাষাবাদে নতুন প্রযুক্তির ফলে চালের উৎপাদন বেড়েছে দুই কোটি ৭৩ লাখ ৪১ হাজার ১০১ টন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দাবি, যদি স্থানীয় জাতের ধান আবাদ হতো তাহলে বর্তমানে এ পরিমাণ চাল উৎপাদন করা সম্ভব হতো না। যেখানে দেশি জাতের ধানের বিঘাপ্রতি ফলন হতো চার-পাঁচ মণ; সেখানে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের বিঘা প্রতি ফলন ২০-২২ মণ। তাই চাষিরা দেশি জাতগুলো ছেড়ে উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। তাছাড়া আগে এক জমিতে বছরে একবার মাত্র ধান ফলানো হতো, এখন বছরে দুই থেকে তিনবারও ধান চাষ করা যায়।

সূত্রঃ The Financial Express
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. মোঃ ইসলাম উদ্দীন মোল্লা বলেন, ‘পুরনো ধান হারিয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক নয়, পুরনো জাতগুলো থেকেই নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিদেশ থেকে আট হাজার প্রজাতির ধান সংগ্রহ করা আছে এই প্রতিষ্ঠানের জিন ব্যাংকে। এর মধ্যে ছয় হাজার দেশি জাতের এবং দুই হাজার বিদেশি জাতের। ঐতিহ্যবাহী এসব ধানের মধ্য থেকে ভালো গুণের অধিকারী ধানগুলো গবেষণা করেই উচ্চফলনশীল জাতগুলো উদ্ভাবন করা হচ্ছে। আর এই জিন ব্যাংকে সংগৃহীত জাতগুলো একশ বছরেও নষ্ট হবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) গবেষক ড. এমএ ছালাম সাংবাদিকদের জানান, তারা খাসালাত নামক একটি ধান নিয়ে সিলেট অঞ্চলে কাজ করছেন। এছাড়া কালোজিরা ধানের একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে কালোজিরা ধান একই সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ উৎপাদন সম্ভব হবে।

হারাচ্ছি মালিকানাও

দেশি প্রজাতির সাড়ে নয় হাজার ধানের জিন কোড, ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও পাসপোর্ট বা বংশপরিচয় তৈরি না করায় এসব ধানের মালিকানা হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এসব ধান বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভিন্ন নামে পেটেন্ট করে বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই বাসমতি চাল টেকনোমতি নামে পেটেন্ট করে বাজারজাত করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ চালের মালিকানা আমরা আর দাবি করতে পারব না। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘বায়োপাইরেসি’। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী নিজস্ব সম্পদের অধিকার বা মালিকানা পেতেও ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনে (আইপিআর) পেটেন্ট জমা দিতে হয়। আইপিআর বিশ্বের সব দেশকে তাদের খাদ্যসামগ্রী, ফসল, লতাপাতা ও গাছের নিজস্ব পেটেন্ট তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলো। যা তালিকা জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিলো ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক সম্পদের নামও জমা দেয়নি। তবে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় চেয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার খাদ্যশস্যের মালিকানা চুক্তির ২৭ (৩) টি ধারা অনুযায়ী সব দেশকে নিজস্ব আইন তৈরির মাধ্যমে নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের পেটেন্ট তৈরির সুযোগ দিয়েছে। কোনো দেশের পেটেন্টভুক্ত খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, আমদানি ও রফতানি করা হলে মালিকানা দেশের অনুমতি লাগবে এবং রয়ালিটি দিতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিআর ২৯ জাতের ধান সিনজেনটা কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে ভিটামিন ‘এ’ প্রবেশ করানেরা জন্য। সিনজেনটা বিআর২৯ জাতে ভিটামিন ‘এ’ প্রবেশ করিয়ে ‘গোল্ডেন রাইস’ নামে বাজারজাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 গোলা ভরা ধান ছিলো বাংলার সমৃদ্ধির অন্যতম প্রতীক। ছবিটি সংগ্রহিত।
newsreel [সংবাদচিত্র]