Powered By Blogger
উচ্চ ফলনশীন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
উচ্চ ফলনশীন লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

০৮ নভেম্বর ২০১৪

দেশী ধানের ১০ হাজার জাত বিলুপ্ত!

বাংলায় ধান চাষ কবে শুরু হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকীল। তবে- পন্ডিতদের
অনুমান খৃষ্টের জন্মের ২৫০০ বছর আগে থেকে এখানে ধান চাষ হয়ে আসছে।
মাত্র ৫০ বছর আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাদৃত সুস্বাদু ও সুগন্ধি ঝারাবাদল, বাঁশফুল, বর্ণজিরা, তুলসিমালা, মধুমাধব, দুধজ্বর এখন আর দেখা যায় না। প্রবীণদের ভাষায়, এসব ধানের চালে তৈরি সুস্বাদু পিঠা-পায়েস, খই-মুড়ি ও ভাতের গন্ধ এবং স্বাদ ছিল অসাধারণ। ঐতিহ্যবাহী রাজভোগ, দুধরাজ, পঙ্খিরাজ ধানের আলাদা-আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। রাজভোগ ধানের চাল চিকন, বেশ লম্বা এবং ভাত হতো ধবধবে সাদা। আবার দুধরাজ ধানের চাল ব্যবহার হতো পিঠা-পায়েস তৈরিতে। পঙ্খিরাজ ধানের চাল খৈ, মুড়ি, চিড়া তৈরির জন্য ব্যবহার হতো। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় রাঁধুনি পাগলু নামে এক ধরনের ধানের আবাদ হতো। এ ধানের চালের ভাত রান্নার সময় এর সুগন্ধে পাশে বসে থাকা রাঁধুনিদের পাগল হওয়ার উপক্রম হতো। গ্রামের এক বাড়িতে রান্না করা হলে আশপাশের বাড়ি থেকেও এর সুগন্ধ পাওয়া যেত। দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ চাল দিয়ে দেবতাকে ভোগ দেয়া হতো। তৎকালীন জমিদার বা শাসকরা উপঢৌকন হিসেবে হীরা, পান্না, স্বর্ণ মুদ্রা পেয়ে যত না খুশি হতেন, তার চেয়ে বেশি খুশি হতেন কাটারিভোগ চাল পেয়ে।

স্বাধীনতার পরও দেশের অনেক জেলাতেই আবাদ হতো হাসবুয়ালে, রঙ্গিলা, জোয়ালকোট, ধলাবায়রা, বিদিন, নোড়াই সাটো, পরাঙ্গি দীঘা, ভোরানটা, খৈয়ামটর, দলকচু, বাঁশিরাজ, ঝিঙেঝাল, দেবমনি, লতাটেপি, দুধমনি, কালাবায়রা, গন্ধকোস্তের, গোয়াই, আশ্বিন দীঘা, আশ্বিন মালভোগ, বানাজিরা, সাধু টেপি, ঠাকুরভোগ, নলবিরণ, মানিকদীঘা, গৌরীকাজল, সোনা রাতা, চন্দী, কলারাজা, বাঁশফুল, তুলসিমালা, ময়নাশাইল, মধুবাধব, ফুলমালতি, খাসিয়া বিন্নি, ঠাকরি, পঙ্খিরাজ, লালটেপি, বিকিন, গজারি, কচুশাইল, দুমাই, বগি, অসিম, বর্ণজিরা, ফটকা, ঘোটক, কাউলি, দুধজ্বর, বাজলা, বিরল, আশা, গাজী, কইতাখামা, মাতিয়ারি, মুগবাদল, চেংরামুরি, পুঁথিবিরণ, ঝরাবাদল, মধুবিরণ, গান্ধিশাইল, সানাঝুরি, হাতকড়া, চাপরাস, মুরালি, ময়নামতি, লতাবোরো, দুধকলম। এসব ধান এখন খুব কম পরিমাণ জমিতেই আবাদ হয়। আউশ, রোপা আমন এবং বোনা আমন প্রজাতির ধানের মধ্যে নাজিমুদ্দিন, বাউরস, চেংড়ি, লাটিসাইল, মুরালী, বালাম, ভুতুবালাম, কাতিছিনি, নিহি, ছিরমইন, খৈসা, পাখবিরনী পশুআইল, দুধকাতারী ও আড়াইসহ কয়েক হাজার প্রজাতির ধানের নাম ঢাকা পড়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে। নেত্রকোনা জেলার উপজাতি হাজং, গারো, রাংসা, সাংমা, মান্দা ও দারিংরা এক সময় বিন্নি ধান চাষাবাদ করতেন। এ ধানের আবাদ কমতে শুরু করেছে। বরিশালের বানারীপাড়ার ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বালাম ধানের চালের সুখ্যাতি ছিল দেশ-বিদেশে। বানারীপাড়ার মলঙ্গা, নলেশ্রী ও ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামগুলোতে চাষ হতো বালাম ধান। তাই বালাম চালের জন্য বিখ্যাত ছিল এসব এলাকা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চাল ব্যবসায়ীরা বানারীপাড়ায় এসে চাল ক্রয় করে তাদের এলাকায় নিয়ে যেতেন। বালামের স্থানীয় জাতের মধ্যে সীতাভোগ, জয়না, নলডোক, রূপের শাইল, লোতরমোটা, কুরিয়ারগালী, কুরিশাইল, কাজল শাইল, রাজশাইল, কুটিআগনি, বেতিচিকন, কেয়া মৌ, কেরাঙ্গাল, বাঁশফুল, ডিঙ্গামনি ও লক্ষমীবিলাসের নাম এখন অনেকেই জানে না। এদিকে হাওরাঞ্চলে সুস্বাদু ও সুগন্ধি কাব্যিক ধান বাঁশফুল, বর্ণজিরা, ঝরাবাদল, তুলসীমালা, খাসিয়া বিন্নি, গাজী, জোয়ালকোট, দুধজ্বর, মধুমাধব, হলিনদামেথি, স্থানীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল। এসব ধানের অধিকাংশ আর দেখা যায় না।

বেশ মুগ্ধতা নিয়েই পড়েছিলাম সাংবাদিক শফিক বাশারের লেখাটি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে (৪ জুলাই, ২০১৩) এটি প্রকাশ করে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ। শিরোনাম ছিলো - ‘হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের ধান : বাড়ছে উচ্চ ফলনশীন জাতের চাষ’। শুরুতেই শফিক লিখেছিলেন - ‘টোপা চাউলের ভাত রান্না করলে মৌ মৌ গন্ধে চাইর দিক ভইররা যাইত। এই ভাত এমনি এমনিই খাওয়া যাইত। টোপা চাউলের ভাতের স্বাদের কথা জীবনেও ভুলতে পারতাম না’- এভাবেই টোপা নামক ধানের চালের স্বাদ ও সুগন্ধের কথা বলছিলেন কিশোরগঞ্জের ইসলামপাড়া গ্রামের কৃষক গেন্দু মিয়া। এক সময় এ এলাকার কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় ছিল টোপা ধান। ৩০ বছরের ব্যবধানে এ ধানের জায়গা দখল করে নিয়েছে উফশী জাতের ধান। শুধু টোপা নয়, ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা মিটাতে সারাদেশ থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিবান্ধব হাজারও জাতের দেশি ধান।
খবরটি নিঃসন্দেহে শঙ্কার। একই বিষয় নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো আজ (৮ নভেম্বর, ২০১৪) ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি মজিবর রহমান খানের তৈরী এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম - ‘হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের ধান’। যাতে উল্লেখিত তথ্যানুযায়ী, গত একশ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার জাতের দেশি ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাসের বরাত দিয়ে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, ১৯১১ সালে ১৮ হাজার জাতের ধানের একটি রেকর্ড আছে। ১৯৮৪ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে করা একটি জরিপে ১২ হাজার ৪৮৭ জাতের হিসাব পাওয়া যায়। সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে আট হাজার জাতের ধান আছে।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইরি) বিশেষজ্ঞ ড. জে পি হেক্টর ধানের জাতের একটি ক্যাটালগ তৈরি করেছিলেন। ওই ক্যাটালগে বলা হয়েছে, সে সময় অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ২০ হাজার জাতের ধানের চাষ হতো। এদিকে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, হারিয়ে যাওয়া ধানের জাত সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ভূপেশ কুমার মণ্ডল। তবে মানবকল্যাণ পরিষদ (এমকেপি) নামের স্থানীয় একটি সংস্থার পরিচালক রবিউল আযম তাদের প্রতিবেদককে জানান, একটি দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ঠাকুরগাঁওয়ে ১৬টি প্রায় বিলুপ্ত ধানের জাত কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করতে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তাঁরা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন সীমিত আকারে বিলুপ্তপ্রায় দেশি জাতের ধান সংরক্ষণে কাজ চলছে।

চাষ করা জমিতে ধানের চারা রোপণ করা হচ্ছে। ছবি: আনিস মাহমুদ, সিলেট
বিতর্কিত তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহারের এক সাক্ষাতকারে জেনেছিলাম, তার প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) কথা। শুনেছিলাম, তারা দেশি জাতের ধান সংরক্ষণের পাশাপাশি হাইব্রীডাইজেশনের দৌরাত্ম্যরোধে কাজ শুরু করেছে। এই ব্যাপারে মঞ্জুর মোর্শেদ নামের এক ব্লগারের মন্তব্য - ‘ফরহাদ মজহার বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে একজন পথিকৃৎ। শাইখ সিরাজদের হাইব্রিড যুগে উনি বায়ো পাইরেসি বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।’ তবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে সন্ধান পাই আরেক ফরহাদের। তিনি টাঙ্গাইলের ফরহাদ আহাম্মেদ। জেলা শহরের সদর রোডের বটতলা এলাকার এই বাসিন্দা একজন কৃষি সাংবাদিক ও কলেজ শিক্ষক। দেশী জাতের ধান বিলুপ্তি নিয়ে তিনি এক প্রতিবেদনে লিখেছেন - ‘এ দেশ থেকে অসংখ্য ধানের জাত বিলুপ্ত হওয়ায় উদ্বেগের কারণ হয়েছে। উফশী ও হাইব্রিডের দাপটে এসব দেশি জাতের ধান এখন খুব কম চাষ হয়। মূলত ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য দেশি জাতের ধান বিলুপ্ত হচ্ছে।’

ফরহাদ আহাম্মেদ আরো লিখেছেন, গত ৭০ বছরেই সাড়ে নয় হাজার জাতের ধান এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার জাতের ধান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জার্মপ্লাজম সেন্টারে সংরক্ষণ আছে। আর কৃষক চাষাবাদ করছে ৫০-৬০টি দেশি জাতের ধান। হাইব্রিডের দাপটে এগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। দেশি ও উফশী জাতের চাষাবাদ কমে গেলে আস্তে আস্তে এগুলোও বিলুপ্ত হবে। এতে কৃষকের কাছে কোন বীজ থাকবে না। দেশ বীজ শূণ্য হয়ে যাবে। বীজের জন্য বহুজাতিক কোম্পানীর উপর নির্ভর করতে হবে। দেশের উৎপাদিত ধানের জাত বিলুপ্ত হলে আমাদের প্রধান খাদ্য ভাতের বৈচিত্রতা থাকবে না। এছাড়াও দেশ কৌলি সম্পদ হারাবে। প্যাটেন্ট না করলে এগুলোর মালিকানাও হারাবে বাংলাদেশ। এজন্য দেশি জাতের ধান-বীজ শুধু জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করলেই হবে না। মাঠ পর্যায়ে সবসময় চাষাবাদের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে কৃষকদের ভর্তুকি দিতে পারে। প্রদর্শনী প্লট করে কৃষকদের দেশি জাতের ধান চাষে আগ্রহী করতে হবে। যাহোক, ধানের জাত বিলুপ্ত থেকে রক্ষার জন্য কৃষক, কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গবেষণা ইন্সটিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট সত্তর দশকে সারা দেশে জরিপ চালিয়ে ১৯৮২ সালে ৩৫৯টি উপজেলার সব ইউনিয়ন থেকে ১২ হাজার ৪৮৭টি ধান জাতের তালিকা তৈরি করে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে তিন হাজার ১৮৫টি, রাজশাহী বিভাগে তিন হাজার ৯৯২টি, চট্রগ্রাম বিভাগে তিন হাজার ৩০টি ও খুলনা বিভাগে দুই হাজার ৯৯২টি জাতের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে থেকে যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট জার্মপ্লাজম সেন্টারের জিন ব্যাংকে আট হাজার ৪৫১ জাতের ধান রক্ষিত আছে। এর মধ্যে তিন হাজার রোপা আমন, এক হাজার বোনা আমন, এক হাজার ১০০ আউশ ও ৫০০ বোরোজাত রয়েছে। ১৯১৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক হাজার ৪৪২টি জাতের ধান সংগ্রহ করা হয়। ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এর পরামর্শে ও সহায়তায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধানের জাত সংগ্রহ করেন। ১৯৭০ সালে ধানের জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেও ১৯৮৫ সালে আধুনিকায়ন করা হয়। সংগৃহীত সব জাতের বৈশিষ্ট্য নিবন্ধন করা হয়েছে। কলেররোডে র্ফোট কালিং জিন ব্যাংকে মাটির নীচে এ উপমহাদেশের প্রায় ৪০ হাজার ধানের জাত সংরক্ষণ আছে বলে জানা যায়। রাজশাহীর হেরিটেজ বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থার কাছে ১০০-১৫০ ও সিলেটের আব্দুল বাছিত নামের এক ব্যক্তির কাছে ৬০-৬৫টি জাতের সুগন্ধি ধানের বীজ সংরক্ষিত আছে।
এছাড়া প্রবীণ ব্যক্তিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব ধানের জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করা হয়েছে; সেগুলো হলো- পারাঙ্গী, সোনামুখী, দাদখানি, চিত্তরাঙি, চন্দ্রকুলি, লক্ষ্মীবিলাস, আকাশপালি, বনকামিনী, মাগুরডিমে, মুগিবালাম, দুধেশ্বর, পালকশাইল, পঙ্খীরাজ, ময়ূরলতা, কাজল, সূর্যমণি, কটকতারা, রাঁধুনিপাগল, হনুমানজটা, হলুদগোটা, গেরুমুড়ি, নোনাকুর্চি, কালোমেঘি, সূর্যমুখি, খেজুরঝুপি, বাদকলসকাটি, দোলাভোগ, লক্ষ্মীদীঘা, গদ্যলাকী, চিংড়িমুড়ি, পোড়াবিন্নি, শিলগুড়ি, কাটারিভোগ, মহিষদল, মাটিচাক, বটেশ্বর, ফুলবাদাম, হরিলক্ষ্মি, সরিষাজুড়ি, মধুশাইল, ফুলমালা, বাশঁফুল, সরিষাফুলি, বৈলাম, গিগজ, মধুমালতি, যাত্রামুকুট, বাবুইঝাঁক, জলকুমারি, গান্ধিভোগ, লেচুশাইল, ফুলমুক্তা, বেনামুড়ি, বেগুনবিচি, রায়দা, চান্দাবিন্নি, খুরমা, সাগরধান, পুড়াবিন্নি, কাচরা, গোচিবোরো, চিনিসাগর, রাজভোগ, বিরই, পটকা, পাথরনাতী, ফুলকাটি, ঠাকুরভোগ, সাইটা, তুলশিমালা, দুলাই, ভাতুরি, মুগি, চাপালি, বরণ, চামারাসাদা, চামারা লাল, কাইকা, ভাওইলা, কাতিকাইকা, পাজরা, ঢেপা, গাইঞ্জা, খামা, পূর্বাচি, বাইশবিশ, গাবুরা, বাজাইল, দিঘা, জোয়ালভাঙ্গা, কাশকাখি, কার্তিকাশাইল, রবিশাইল, লতিশাইল, আইআর ৮, ঝাউলতা, আশমতিয়া, হিজলিকামা, লোহাগড়া, মুইরল, গরফা, ধরিয়ান, বাদল, কার্তিকা, তিলকাচারি, আশ্বিণা, ভদোইয়া, বাদশাভোগ ইত্যাদি।
প্রতিটি ধানের নামের পেছনে রয়েছে বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস। আর প্রতিটি চালের স্বাদ ও গন্ধ বৈচিত্রময়। ধানের ইতিহাস থেকে জানা যায় - রায়েদা এ দেশের প্রথম ধান, যা খুলনা অঞ্চলে প্রথম পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে ধান আবাদ হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে থেকে। পাজাম ধানটি পাকিস্তান আমলে এ দেশে আনা হয়। ধানটির জন্মস্থান জাপান। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ধানটির নাম দেয় পাজাম। পাকিস্তানের পা জাপানের জা এবং মালয়েশিয়ার ম দিয়ে পাজাম নাম হয়েছে। সুগন্ধি জাতের ধান হচ্ছে কালিজিরা, বাদশাভোগ, চিনিগুড়, কাশকাখি, রাধুনিপাগল, বাশমতি, বেগুনবিচি ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিটির রয়েছে উপজাত। যশোর এলাকা থেকে বিলুপ্ত ধান হচ্ছে-শালকোল, কলামোচা, মেহেরফল, বাবুই, কেরশাল, ভাড়াল, হলদি গিরে, মনহর, গাম্ভির, হলদানি, মাসকালি, চিনিআলো, পাটনাই, রহমত, খাসকানি, এইচআরবি, শ্রাবনী, চিনিকাই, মানিকাদিগে, কাচেরি, মুরারি, বিরুইন, উরিচেদড়া, আপছায়া, কয়েসাবিন্নী, জসা, স্বর্ণপুটি, মোহনভোগ, দুধশাইল, স্বর্ণা, সুন্দরশাল ইত্যাদি। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর-ঘাটাইল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে দুলাই, ভাতুরি, সাইটা, মুগি, চাপালি, বরণ, ঢেপা, গাইনজা, বাঁশিরাজ, কাতিকাইকা, ইত্যাদি। এর অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর স্থান করে নিয়েছে ৫৬ জাতের উফশী ও ৮-১০ জাতের দেশি-বিদেশি হাইব্রিড জাত।

ধানক্ষেতে সার দিচ্ছেন এক কৃষক। ছবিটি সংগ্রহিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০-৫১ সালে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৬২ লাখ টন। তখন এই পরিমাণ ধান থেকে চালের প্রাপ্যতা ছিল ৫৫ লাখ ৮০ হাজার টন। সে সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি ২১ লাখ। দৈনিক মাথাপিছু ৪৫৪ গ্রাম হিসাবে খাদ্যের চাহিদা ছিল ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টন। পরবর্তী দশ বছরে দেশে চালের উৎপাদনের বার্ষিক পরিমাণ ছিল এক কোটি সাত লাখ টন। পরর্তী সময়ে দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে খাদ্যের চাহিদা। গত ২০১১-২০১২ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার ১০১ টন। ১৯৫১ থেকে ২০১২ সাল ৬১ বছরে আবাদি জমির পরিমাণ না বাড়লেও উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কার ও চাষাবাদে নতুন প্রযুক্তির ফলে চালের উৎপাদন বেড়েছে দুই কোটি ৭৩ লাখ ৪১ হাজার ১০১ টন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দাবি, যদি স্থানীয় জাতের ধান আবাদ হতো তাহলে বর্তমানে এ পরিমাণ চাল উৎপাদন করা সম্ভব হতো না। যেখানে দেশি জাতের ধানের বিঘাপ্রতি ফলন হতো চার-পাঁচ মণ; সেখানে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের বিঘা প্রতি ফলন ২০-২২ মণ। তাই চাষিরা দেশি জাতগুলো ছেড়ে উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। তাছাড়া আগে এক জমিতে বছরে একবার মাত্র ধান ফলানো হতো, এখন বছরে দুই থেকে তিনবারও ধান চাষ করা যায়।

সূত্রঃ The Financial Express
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. মোঃ ইসলাম উদ্দীন মোল্লা বলেন, ‘পুরনো ধান হারিয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক নয়, পুরনো জাতগুলো থেকেই নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিদেশ থেকে আট হাজার প্রজাতির ধান সংগ্রহ করা আছে এই প্রতিষ্ঠানের জিন ব্যাংকে। এর মধ্যে ছয় হাজার দেশি জাতের এবং দুই হাজার বিদেশি জাতের। ঐতিহ্যবাহী এসব ধানের মধ্য থেকে ভালো গুণের অধিকারী ধানগুলো গবেষণা করেই উচ্চফলনশীল জাতগুলো উদ্ভাবন করা হচ্ছে। আর এই জিন ব্যাংকে সংগৃহীত জাতগুলো একশ বছরেও নষ্ট হবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) গবেষক ড. এমএ ছালাম সাংবাদিকদের জানান, তারা খাসালাত নামক একটি ধান নিয়ে সিলেট অঞ্চলে কাজ করছেন। এছাড়া কালোজিরা ধানের একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে কালোজিরা ধান একই সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ উৎপাদন সম্ভব হবে।

হারাচ্ছি মালিকানাও

দেশি প্রজাতির সাড়ে নয় হাজার ধানের জিন কোড, ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও পাসপোর্ট বা বংশপরিচয় তৈরি না করায় এসব ধানের মালিকানা হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এসব ধান বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভিন্ন নামে পেটেন্ট করে বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই বাসমতি চাল টেকনোমতি নামে পেটেন্ট করে বাজারজাত করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ চালের মালিকানা আমরা আর দাবি করতে পারব না। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘বায়োপাইরেসি’। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী নিজস্ব সম্পদের অধিকার বা মালিকানা পেতেও ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনে (আইপিআর) পেটেন্ট জমা দিতে হয়। আইপিআর বিশ্বের সব দেশকে তাদের খাদ্যসামগ্রী, ফসল, লতাপাতা ও গাছের নিজস্ব পেটেন্ট তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলো। যা তালিকা জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিলো ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক সম্পদের নামও জমা দেয়নি। তবে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় চেয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার খাদ্যশস্যের মালিকানা চুক্তির ২৭ (৩) টি ধারা অনুযায়ী সব দেশকে নিজস্ব আইন তৈরির মাধ্যমে নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের পেটেন্ট তৈরির সুযোগ দিয়েছে। কোনো দেশের পেটেন্টভুক্ত খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, আমদানি ও রফতানি করা হলে মালিকানা দেশের অনুমতি লাগবে এবং রয়ালিটি দিতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিআর ২৯ জাতের ধান সিনজেনটা কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে ভিটামিন ‘এ’ প্রবেশ করানেরা জন্য। সিনজেনটা বিআর২৯ জাতে ভিটামিন ‘এ’ প্রবেশ করিয়ে ‘গোল্ডেন রাইস’ নামে বাজারজাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 গোলা ভরা ধান ছিলো বাংলার সমৃদ্ধির অন্যতম প্রতীক। ছবিটি সংগ্রহিত।
newsreel [সংবাদচিত্র]