লিফলেটটি প্রথম দেখেছিলাম ২০১২’ র ডিসেম্বরে। সযন্তে সাঁটানো ছিলো ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক হলের মূল ফটক সংলগ্ন দেয়ালে। বরিশালের বিএম কলেজের এ ছাত্রাবাসটি ‘মুসলিম হল’ নামেই সমধিক পরিচিত। মানবতার কল্যাণে ‘সত্য প্রেম পবিত্রতা’র আদর্শে সোয়াশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ওই শিক্ষালয়ের মুসলিম ছাত্ররাই শুধু এ হলের বাসিন্দা। যে কারণে উগ্র ডানপন্থীদের আদর্শ বিস্তারের জন্য এটি বরাবরই আকর্ষনীয়। পাশেই আবার হিন্দু ছাত্রাবাস কবি জীবনানন্দ দাশ হল। - এ জাতীয় বিভিন্ন কারণে লিফলেটটি মাথায় গাঁথলেও নানা ব্যস্ততায় তা ভুলে থাকতে হয়েছে। ঘাঁটাঘাঁটি করার আর সুযোগ হয়নি। কিন্তু গত বছরের মাঝ নভেম্বরে কীর্তনখোলার ওপারের চরকাউয়া ইউনিয়নের কালিখোলা গ্রামে হিন্দুদের ১৬টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা শোনার পর লিফলেটটির কথাই প্রথম মাথায় আসে। পরদিন ঘটনার সাথে ওই হলের শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার কথাও জানতে পারি। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাস্পে ঘোলাটে হতে থাকা পরিস্থিতি বিষয়টি ঘাঁটাতে বাধ্য করে। খুঁজতে গিয়ে দেখলাম – হলের সেই দেয়ালসহ আশেপাশের কয়েকটি গাছ আর ল্যাম্পপোস্টে যে লিফলেটগুলো রয়েছে, সেগুলোর একটিও আস্ত নেই। প্রতিটিরই কোনো না কোনো অংশ ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। তবুও সবগুলো মিলিয়ে যে লেখাটুকু আমার সামনে পরিস্কার হয়, তা হচ্ছে - ‘বিএম কলেজ, মুসলিম হলের সামনের রাস্তায়, মাঠে এবং পুকুরপাড়ে মেয়েদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। অনুরোধক্রমে - হলের সচেতন ছাত্রবৃন্দ।’
|
ছবিটি ২০১৩’র পহেলা ডিসেম্বর তোলা |
‘এরা মূল্যবোধ সচেতন, না যৌনতা সচেতন?’- লিফলেট প্রচাকারী ‘সচেতন ছাত্রবৃন্দ’ সম্পর্কে এ প্রশ্ন তোলেন এসএম তুষার। কলেজ পাড়ায় বসবাসকারি এই লেখক-গবেষকের সাথে গত ৩০ নভেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিলো। কলেজের পুরানো প্রশাসনিক ভবন, মানে এখনকার পদার্থ বিজ্ঞান ভবনের সামনে বসে তার সাথে আলাপকালেই চোখে পরে দু’জন ছাত্র মুসলিম হলে যাওয়ার রাস্তার পাশের গাছে আর ল্যাম্পপোস্টে আঠা দিয়ে কিছু একটা লাগাচ্ছে। এগিয়ে দেখলাম, আবারো সেই লিফলেটটি লাগানো হচ্ছে।
আলাপ করে জানা গেলো – যারা লিফলেট লাগাচ্ছেন তারা দু’জনে কলেজের বিজ্ঞান অনুষদের পৃথক দু’টি বিষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এদেরই একজন মেহেদী হাসান। তিনি জানান, প্রায় দু’বছর ধরে লিফলেটটি প্রচার করা হচ্ছে। ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মিসহ প্রায় সকল ছাত্রই এটি প্রচারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘হলের পুকুরে ছাত্ররা খালি গায়ে গোসল করে। অথচ অনেক সময়ই মেয়েরা এসে পুকুরের আশেপাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। আবার হলে যাওয়ার রাস্তার পাশের মাঠে অনেক ছেলে-মেয়েকে আপত্তিকর অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। মানা করলে আবার তারা ক্ষেপে যায়। এর জেরে হলের ছেলেদের সাথে বহুবার গণ্ডগোলও হয়েছে। এসব চিন্তা করেই বড় ভাইয়েরা এই লিফলেট প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে লিফলেটে কিন্তু আদেশ দেয়া, অনুরোধ করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ‘অনুরোধক্রমে’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও লিফলেটে বিএম কলেজ ক্যাম্পাসের বিজ্ঞান অনুষদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘেঁষা মুসলিম হলের সামনের বিশাল পুকুর, মাঠ ও রাস্তায় নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিক্ষিকা বা ছাত্রীদের তোয়াক্কা করা হয়নি। নিজেদের ক্যাম্পাসের বিশালাংশে তারা আজ অবাঞ্চিত।
মেহেদী ও তার সহযোগী আরো জানায়, কলেজের ডানপিটে অনেক মেয়ে আর প্রেমিক-প্রেমিকারা বার বার এই লিফলেটগুলো ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু তারাও দমবে না। যত ছেঁড়া হবে তত লাগানো হবে। তারা আরো জানায়, এই হলে চরমোনাই পীরের ভক্তের সংখ্যা অনেক বেশী। বর্তমান পীরও এখানে এসে ওয়াজ করেছেন। অবশ্য কলেজ ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের একাধিক সাবেক নেতা জানান, পীর ভক্তদের আড়ালে শিবিরের সমর্থকরাও লুকিয়ে আছে। ওখানে ওরাই সব সময় ‘স্ট্রং’ ছিলো, আজও আছে। এ আমলে ছাত্রলীগ আর ও আমলে ছাত্রদলের মিছিল-মিটিঙে অংশ নিলেও তলে তলে ওরা উগ্র ইসলামি মৌলবাদকেই লালন করে।
ওদিকে কালিখোলা গ্রামের ঘটনার ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (মুসলিম হল) হলের অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারাই নৌপথে শহর থেকে ওই গ্রামের পেছন দিয়ে গিয়ে আগুন দিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছে বলে খবর প্রকাশ করেছে দৈনিক কালের কণ্ঠ। ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের এ পত্রিকার বরিশাল অফিসের সাংবাদিকরা তাদের পাঠানো সংবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন ছাত্রের নামও জানিয়েছেন। তারা সবাই ছাত্রলীগের সাথে জড়িত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কালিখোলা থেকে ফিরে কবি-গল্পকার অদিতি ফাল্গুনীও লিখেলেন, ‘কেউ বলছেন - এটা স্থানীয় আওয়ামি লীগের চেয়ারম্যানের কাজ হতে পারে, যেহেতু গতবার তিনি এই গ্রামে বেশি ভোট পাননি। আর বরিশাল বিএম কলেজের যে ছেলেরা হিন্দু গ্রামে হামলার অগ্রভাগে ছিলো, তারা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগেরই কর্মী।’
বাংলার শস্য ভাণ্ডার ও প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বন্দর নগরী বরিশালে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন প্রতিষ্ঠিত বিএম কলেজ এর আগেও সাম্প্রদায়িকতার কবলে পরেছে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ ও ১৯৫০ সালের দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছাত্র-শিক্ষক ভারতে চলে গিয়েছিলো। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তখন কলেজের দ্বি-বার্ষিক ও ত্রি-বার্ষিক সম্মান কোর্স তুলে দিযে় এটিকে শুধু স্নাতক পাস কলেজ হিসেবে টিকিযে় রাখা হয়েছিলো। অথচ তার আগে এ কলেজ ছিলো দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পাঁচ কলেজের একটি। পূর্ববাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের প্রথম দিকের সরকারি কলেজগুলোরও একটি এটি। এ কলেজকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়। এ কারণে বিএম কলেজের ইতিহাস মানে আধুনিক বাংলাদেশের ইতিহাস। বিশ্বের মানব সভ্যতার ইতিহাস ও বিকাশের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, আমেরিকার হারবার্ড, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া ও ভারতের নালন্দা প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় যেরূপ অবদান রেখেছে, পূর্ব বাংলায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে বিএম কলেজের ভূমিকা অনুরূপ বললেও বেশি বলা হবে না। উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে অবিভক্ত বাংলার জনজীবন যারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন এ কলেজের ছাত্র। দেশের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিএম কলেজের ছাত্ররা এককভাবে যত বড় অবদান রেখেছে এ দেশের আর কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পারেনি।
ঢাকা ও কলকাতা থেকে দূরে অবস্থান এবং নদী-নালা দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এখানকার ছেলেমেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক পশ্চাৎপদ ছিল। ১৮৫৪ সালে বরিশাল জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অঞ্চল আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নবজাগরণ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিন দশক পরে আধুনিক বরিশালের স্থপতি দরিদ্রবান্ধব মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮৪ সালে বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে প্রতিষ্ঠা করেন বিএম স্কুল। তখনও প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আর সুযোগ ছিলো না বরিশালে। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুরোধে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৮৯ সালে ওই স্কুল কম্পাউন্ডেই এই বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহাত্মা অশ্বিনী । ১৯১৭ সালে বিএম স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয় এই কলেজ।
প্রায় ৬২.০২ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই ক্যাম্পাসে আসার পরই শুরু হয়েছিলো বিএম কলেজের বর্ণালী অধ্যায়। সে সময় স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের কারণে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি, উচ্চ শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা তরুণ ইংরেজদের গোলামী ছেড়ে চলে এসে দেশসেবা ও মানুষ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকুরি করাকে অধিক পছন্দনীয় মনে করেছিলেন। অশ্বিনী কুমার দত্ত তখন ভারতবর্ষের অনেক খ্যাতিমান শিক্ষকের সমাবেশ ঘটিয়ে এ কলেজের শিক্ষার মান অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান। তার সাথে সাথে তিনি নিজেও লাভজনক ওকালতি পেশা ছেড়ে বিনা বেতনে এ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। অধ্যক্ষ ব্রজেন্দ্রনাথ চট্টপাধ্যায়, রজনীকান্ত গুহ, বাবু সতীশচন্দ্রসহ বিএম কলেজের সে সময়কার অন্যান্য অধ্যক্ষদের পাণ্ডিত্ব্য এবং পরীক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীদের ঈর্ষণীয় সাফল্য বরিশালের জন্য প্রচুর সুনাম বয়ে এনেছিলো। এ কলেজের অধ্যাপকদের প্রজ্ঞা ও শিক্ষাপদ্ধতি উন্নত করতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
১৯২২ সনে ইংরেজি ও দর্শন, ১৯২৫ সনে সংস্কৃতি ও গণিত, ১৯২৮ সনে রসায়ন এবং ১৯২৯ সালে অর্থনীতি সম্মান অনার্স কোর্স চালু হয় বিএম কলেজে। মূলত ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল বিএম কলেজের স্বর্ণযুগ। তখন এ কলেজের শিক্ষার মান এতই উন্নত ছিল যে, অনেকে প্রতিষ্ঠানকে দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড বলে আখ্যায়িত করেন। বাংলার ছোটলাট স্যার উডবর্ন সরকারি শিক্ষা বিবরনীতে লিখেছিলেন This moffusil College promises some
days to Challenge the supremacy of the Metropolitan (Presidency) College. একই সময়ে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিটসন বেল লিখেছিলেন Barisal may be said to be the Oxford
of East Bengal.
আর্থিক অনটনের কারণে ১৯৫২ সালে কলেজের অবস্থা খুবই নাজুক আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি নিরসনে ১৯৫৯ সালে প্রয়াত অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে ডেপুটেশনে কলেজের নতুন অধ্যক্ষ নিযে়াগ করে সরকার। এর ফলে কলেজের অবস্থা পরিবর্তিত হতে থাকে। ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে মাত্র ১৫ জন ছাত্রছাত্রী নিযে় অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পাঠ্যক্রম পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। ১৯৬৫ সালের পহেলা জুলাই বিএম কলেজকে প্রাদেশীকরণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সনের পরে আরো কয়েকটি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। সর্বশেষ ২০১০-১১ শিক্ষা বর্ষে চালু হয় ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিভাগ। এ কলেজে বর্তমানে মোট ২৪টি বিষয়ে পাঠদান করা হয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ায় ১৯৯৯ সাল থেকে বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী বিলুপ্ত করা হয়।
কলেজ নিয়ে এত কথা বললাম শুধু প্রশ্নের প্রেক্ষাপট পরিস্কার করতে। আজ এ মনে অনেক প্রশ্ন। ওই লিফলেটটি কি আমাদের পশ্চাতপদতারই নিদর্শন নয়? জাতির চিন্তার এ দৈন্যতা কাটবে কবে? এর দায় কে বা কারা নেবে? কে ভাই - আদি বিভেদ মেটানোর মন্ত্র শেখাবে?
* লেখাটি আমাদের বরিশাল ডটকম’এ প্রকাশিত হয়েছে।