Powered By Blogger

৩১ জুলাই ২০১৭

কোথায় আমি নাই, আমিই-তো সবাই

অদ্বিতীয় মূলত কবি ও কবিতা বিষয়ক ফেসবুক গ্রুপ
এমন অনেক কবিতা, গান, চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র, এমনকি সিনেমাও আমরা পেয়ে থাকি - যেগুলো প্রাণহীন। অর্থাৎ নানা কৌশলে বাজারে স্পন্দন সৃষ্টি করতে পারলেও কারো মনে কোনো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বা অনুধাবন তৈরী করতে না। আর একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কাজগুলো আসলে আরোপিত বা ফরমায়েশী। কিংবা স্রেফ জোর করে লেখা, গাওয়া, আঁকা, তোলা বা বানানো। আবার অনেক সময় সামান্য পঙতি, বা কাঠখোট্টা প্রবন্ধতেও আমরা বিপুল প্রাণের সন্ধান পাই। এখন কথা হচ্ছে - এই প্রাণটা আসে কোথা থেকে? সাধারণত আমরা জানি - সঙ্গমের চূড়ান্ত ফসলই হচ্ছে প্রাণ। যেমন মানুষের প্রাণ তৈরী হয় স্বামী-স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গমে। যার আদিতে থাকে প্রেম, তামাম সৃষ্টির আদিতেও ছিলো যা। অর্থাৎ প্রেমেই সৃষ্টির সূত্রপাত। তাই আজও তা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।

প্রেম থাকলে সঙ্গম হবে, প্রাণও জন্মাবে। যে কারণে কোনো উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নে নয়, নেহাতই সৃষ্টির প্রেমে মত্ত হয়ে যে কবি, সুরকার, শিল্পী, আলোকচিত্রী বা নির্মাতা সঙ্গমী হন, তার কাজে প্রাণ থাকে। আর কে না জানে, সকল ঐশী কিতাবও বলে সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা বিরাজে। হয়ত এমন সৃষ্টিশীলদের মাঝে স্রষ্টার আপন সত্বা অনেক বেশী ক্রিয়াশীল। যে কারণে তারা পার্থিব গণিতের বাইরে গিয়েও ভাবতে পারেন। থাকতে পারে মোহ মুক্ত । এরাই স্রষ্টার প্রকৃত দিদারকামী। খোদার সেই আশরাফুল মাখলুকাত বা ভগবানের দেবতা। এদের সংখ্যা আজ মোটেই ছয়-সাতশ কোটি নয়। বড় জোড় ষাট-সত্তর বা ছয়-সাতশ। অথবা এর কম-বেশী। আসলে এটা ধারণার ক্ষমতা আমার জ্ঞান কাঠামোয় সংযুক্ত হয়নি। তবে এ আমার নিশ্চিত অনুধাবন - এরাই তামাম সৃষ্টির কারণ। খোদ স্রষ্টার সাথে এদের সঙ্গমে প্রসূতরাও তাই প্রকৃতির অংশ হয়ে কালান্তরেও বেঁচে থাকে।

আগেও বহুবার বলেছি, ফের বলছি – ‘আমার অমুক, আমার তমুক – জাতীয় যে আমিত্ব নিয়ে মানুষ ঘুরে বেড়ায়, তাকে হত্যা করে তামাম নিজস্বতাকে সার্বজনীন করার চেষ্টাই করে যায় কবিরা। আর সেই চেষ্টায় জন্ম নেয় কবিতা।’ তবে নিশ্চয় কবি ভেদে কবিতা লেখার উদ্দেশ্য আলাদা; তাই আলাদা প্রত্যেকের দায়ভাবও । যেমন – আমি কোনো দায়বোধ থেকে কবিতা লেখি না। এই ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততাকে গুরুত্ব দেই, স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজি। অবশ্য অন্যভাবেও ভাবা যায়। হয়ত বিভিন্ন দায়ের গ্লানিমুক্ত হতেই লেখি। লিখতে গিয়ে নিজের মাঝে লুকাই। মানবাত্মার জন্মদায় মেটাতেই হয়ত পয়দা হয় কবিতা। যদিও আমি কখনোই শুধু কবি হতে চাইনি, বা অন্যকিছু।

ব্যক্তিগতভাবে কাব্যচর্চা বা কবিতা লেখাকে একটি সহজাত প্রবণতা ছাড়া বিশেষ কিছু ভাবতে পারিনি। তবু জীবনের বিস্তীর্ণকাল জুড়ে দৈনন্দিন ভাবনার পরম্পরাই মননে কবিতা আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। কখনো তা লেখা হয়েছে, কখনো হয়নি। তবে হ্যাঁ, আমি কথা বলতে চেয়েছি। প্রথমের নিজের সাথে, পরবর্তীতে স্ব-জাতির তথা মানুষের সাথে। অনেক সময় অমানুষ, অপার্থিবতার সাথেও হয়ত। এমন তাগিদ থেকেই জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে স্রেফ কথা বলার মাধ্যম হিসেবেই কবিতা, গল্প, প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, গান, চিত্রকলা, আলোকচিত্র বা চলচ্চিত্রের মতো নানা ভাষা ব্যবহার করেছি। নিশ্চিত থাকুন এর কিছুই বিশেষ কোনো দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তা বা বোধ প্রচার ও প্রসারের খায়েসে ব্যবহৃত হয়নি। ভাব আদান-প্রদানই মুখ্য আমার কাছে। আর এ কাজে যে কোনো শিল্পমাধ্যম বা ভাষাই দুর্দান্ত। আবারো বলি, আমি কবি বা কিছুই হতে চাই না আসলে । স্রেফ মন যখন যা চায় তাই-ই করতে চাই। মানে আমৃত্যু শুধু মনের কথাই শুনতে চাই।

দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায়, মানে ১৯৯২ সালে প্রথম স্বপ্রণোদিত হয়ে লেখার ইচ্ছে জাগে। স্কুলের খাতার পেছনে লিখেছিলাম - ‘আসবে যত/যাবেও তত/কিছুই থাকবে না/তাই বলে কী/সেই কবুতর/ আর আসবে না.../কবুতরটি/এখন না হয়/ পরেও আসতে পারে/তাই বলে কী/বলবে তুমি/আর আসবে নারে...’। পরের বছর এ লেখাটি বরিশালের স্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক প্রবাসী’-তে ছাপা হয়েছিলো । প্রথম লেখার ইচ্ছে জাগার ঠিক আগের বছর বাবা-মায়ের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ আমায় অজস্র কৌতূহলী দৃষ্টিসংকুল ও বহু প্রশ্নবহুল একটি কাল উপহার দেয়। বস্তুত ওই সময়টায় যে বোধ জন্ম নেয় তা আমায় হুট করেই কিছুটা বড় করে দেয়। সমবয়সী বন্ধু বা মুরুব্বী স্বজনেরা যা একদমই টের পায়নি। কারণ আমি সবার কাছে থেকে একটু লুকিয়ে - দূরে দূরে থাকতে পছন্দ করতাম। আবার কাছে থাকলেও তাদের কারো সাথে খুব একটা কথা বলতাম না। মনে মনে নিজের সাথেই শুধু কথা বলতাম, অনেক কথা। একদিন হঠাৎ সেই কথাগুলোই লিখতে ইচ্ছে হলো।

খেয়াল করে দেখেছি, বিভিন্ন লেখায় আমি একই কথা বার বার বলেছি। সময় অনুযায়ী বলার কৌশল বা ধরণ বদলেছি মাত্র। কবিতাকে সাধারণের কাছে ফেরানোর তাগিদ অনুভব করেছি খুব। সমকালীন অসংখ্য কবির কবিতা আমায় এ ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলেছে। যাদের লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা শূণ্যে ভাসছেন না।যারা জানেন এই মাটি ও মানুষের সাথে কবিতার সম্পর্ক আজকের নয়; বহু পুরানো। এক সময় ছন্দে ছন্দে কথা বলা ছিলো বাঙালের স্বাভাবিক প্রবণতা। পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক শিক্ষা বা পাশ্চত্যের প্রভাব – বাংলার সাহিত্যকে একদিকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে করেছে বিভেদাক্রান্ত। অশিক্ষিত কবিয়ালদের সহজবোধ্য দেশজ ঢঙ বা ছন্দের চেয়ে শিক্ষিত মহাকবিদের গণবিচ্ছিন্ন দুর্বোধ্য উপমার সামাজিক কদর বাড়িয়েছে পশ্চিমা চেতনা। সমকালীন কবিতা পড়ে মনে হচ্ছে এই ‘কলোনিয়াল ট্রমা’ কাটিয়ে ওঠার সময় চলছে। ফের মাটি ও মানুষের কাছেই ফিরছে কবিতা; এবং তা এখনকার কবিদেরই হাত ধরে। যে কারণে আমার সময়ের কোনো কোনো কবি যদি স্টান্টবাজিও করেন, তাও আমার ভালো লাগে। তাছাড়া - ‘কোথায় আমি নাই/আমিই-তো সবাই।’

প্রথম প্রকাশ : অদ্বিতীয় / ২২ মার্চ ২০১৭

পুরানো আলাপ
* কথাবলি নির্বচন
* ঘুমঘোরে কথোপকথন
* অলস দুপুরে আলাপ...

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]