Powered By Blogger

২০ মার্চ ২০১৭

কথাবলি নির্বচন

একুশে বইমেলা’১৭ চলাকালে কথাবলি ডটকম প্রকাশিত
 সাক্ষাতকারটি ব্লগ পাঠকদের জন্য সংরক্ষিত রইলো
[ঈয়ন। মূলত একজন আপাদমস্তক কবি। পেশায় সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক ও প্রকাশক। দাপ্তরিক নাম শরীফ খিয়াম আহমেদ। জন্মেছেন খুলনায়। শেকড় ও বেড়ে ওঠা বরিশালে। বর্তমানে থাকছেন ঢাকায়। ২০১৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভাবনাংশ’ প্রকাশিত হয়। আর এই বছর বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে তার নতুন কবিতার বই ‘গাধার গয়না’। তার সঙ্গে কথাবলির পক্ষ থেকে কথা হলো। — নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।]
আপনার নতুন কবিতার বই ‘গাধার গয়না’ নিয়ে কিছু বলেন।
নিজস্ব প্রকাশনী কাদাখোঁচা প্রকাশিত আমার (গাধার) এ গ্রন্থের (গয়নার) সত্ত্ব উন্মুক্ত। অর্থাৎ যে কেউ এর যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় ব্যবহার করতে পারবেন। বইটির মূল পরিবেশক র‌্যামন পাবলিশার্স। সাদাকালো মলাটের চার ফর্মার এ গ্রন্থটি ‘শ্রেষ্ঠত্বের প্রত্যাশাবিমুখ বিশ্বাসীদের উৎসর্গকৃত’। যেখানে একই পরম্পরার ৬২টি লেখা রয়েছে। ২০১৩ সালে শুরু করেছিলাম সিরিজটি । প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে এই পরম্পরার ভূমিকা লিখেছিলাম ২০১৫-এর জুলাইয়ে। যেখানে বলছি ‘জ্ঞানকাঠামোর অনমনীয়তাই হচ্ছে মৌলবাদিতা। আর মৌলবাদিরা মূলত দু’প্রকার এক. ছাগু প্রকৃতির (ডান) দুই. চুতিয়া প্রকৃতির (বাম); অর্থাৎ লেফট-রাইট করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে মৌলবাদ।’

নিজের বই নিয়ে অনুভূতি কী?
বই প্রকাশের পর নিজেকে সার্বজনীন, মানে সকলের মনে হয়। কারণ প্রতিটি বই আসলে এক একটা সময়ের চিন্তা, দর্শন ও প্রবণতার দলিল। পাঠকের উদ্দেশ্যে উত্থাপনের আগ মুহুর্ত অবধি যার সব লেখাই একান্ত নিজস্ব বা ব্যক্তিগত। তবে গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর তা পাঠকের, মানে সবার হয়ে যায়। তখন যে কেউ সেই লেখার ভাব, দর্শন বা বোধ গ্রহন ও প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ পায়।

ছোটোবেলায় কিছু হতে চাইতেন?
অনেক কিছু। পাইলট, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, চকোলেট বা আইসক্রিম ব্যবসায়ি থেকে শুরু করে ক্রিকেটার, সন্ত্রাসী, রকস্টার, নেতা এমন আরো অনেক কিছুই হতে চেয়েছি।

আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে মানে কতোদিন ধরে লেখালিখি করছেন?
দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায়, মানে ১৯৯২ সালে প্রথম স্বপ্রণোদিত হয়ে লেখার ইচ্ছে জাগে। স্কুলের খাতার পেছনে লিখেছিলাম - ‘আসবে যত/যাবেও তত/কিছুই থাকবে না/তাই বলে কী/সেই কবুতর/ আর আসবে না.../কবুতরটি/এখন না হয়/ পরেও আসতে পারে/তাই বলে কী/বলবে তুমি/আর আসবে নারে...’। পরের বছর এ লেখাটি বরিশালের স্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক প্রবাসী’-তে ছাপা হয়েছিলো ।

আপনার লেখালেখির শুরু কেনো বলে মনে হয়?
প্রথম লেখার ইচ্ছে জাগার ঠিক আগের বছর বাবা-মায়ের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ আমায় অজস্র কৌতূহলী দৃষ্টিসংকুল ও বহু প্রশ্নবহুল একটি কাল উপহার দেয়। বস্তুত ওই সময়টায় যে বোধ জন্ম নেয় তা আমায় হুট করেই কিছুটা বড় করে দেয়। সমবয়সী বন্ধু বা মুরুব্বী স্বজনেরা যা একদমই টের পায়নি। কারণ আমি সবার কাছে থেকে একটু লুকিয়ে - দূরে দূরে থাকতে পছন্দ করতাম। আবার কাছে থাকলেও তাদের কারো সাথে খুব একটা কথা বলতাম না। মনে মনে নিজের সাথেই শুধু কথা বলতাম, অনেক কথা। একদিন হঠাৎ সেই কথাগুলোই লিখতে ইচ্ছে হলো।

আপনি কি শেষ পর্যন্ত কবি হতে চান, নাকি অন্যকিছু?
সত্যি কথা বলতে আমি কখনোই শুধু কবি হতে চাইনি, বা অন্যকিছু। কাব্যচর্চা বা কবিতা লেখাকে একটি সহজাত প্রবণতা ছাড়া বিশেষ কিছু ভাবতে পারিনি। জীবনের বিস্তীর্ণকাল জুড়ে দৈনন্দিন ভাবনার পরম্পরাই মননে কবিতা আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। কখনো তা লেখা হয়েছে, কখনো হয়নি। তবে হ্যাঁ, আমি কথা বলতে চেয়েছি। প্রথমের নিজের সাথে, পরবর্তীতে স্ব-জাতির তথা মানুষের সাথে। অনেক সময় অমানুষ, অপার্থিবতার সাথেও হয়ত। এমন তাগিদ থেকেই জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে স্রেফ কথা বলার মাধ্যম হিসেবেই কবিতা, গল্প, প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, গান, চিত্রকলা, আলোকচিত্র বা চলচ্চিত্রের মতো নানা ভাষা ব্যবহার করেছি। নিশ্চিত থাকুন এর কিছুই বিশেষ কোনো দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তা বা বোধ প্রচার ও প্রসারের খায়েসে ব্যবহৃত হয়নি। ভাব আদান-প্রদানই মুখ্য আমার কাছে। আর এ কাজে যে কোনো শিল্পমাধ্যম বা ভাষাই দুর্দান্ত। আবারো বলি, আমি কবি বা কিছুই হতে চাই না আসলে । স্রেফ মন যখন যা চায় তাই-ই করতে চাই। মানে আমৃত্যু শুধু মনের কথাই শুনতে চাই।

আপনার কাছে কবিতা কী?
এটা আগেও এক সাক্ষাতকারে বলেছি। আমার অমুক, আমার তমুক – জাতীয় যে আমিত্ব নিয়ে মানুষ ঘুরে বেড়ায়, তাকে হত্যা করে তামাম নিজস্বতাকে সার্বজনীন করার চেষ্টাই করে যায় কবিরা। আর সেই চেষ্টায় জন্ম নেয় কবিতা।

আপনার মাথার মধ্যে কবিতার ইমেজ কেমন করে আসে?
বস্তুত নানাবিধ বোধ থেকে।

বিশেষ কারো কবিতা কি আপনাকে প্রভাবিত করে?
আশৈশব ‘মানুষ ও গ্রন্থ – দুটোই যে পাঠ্য' ছিলো। তাই চিন্তায় ও প্রকাশে বিভিন্ন মানুষ ও গ্রন্থের প্রভাব অনিবার্য। বাঙলাদেশের সংবিধান থেকে কুরান, ডারউইন থেকে ভগবান—সবই প্রভাবিত করেছে আমাকে। অতএব কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেও আমার যে ভাষাভঙ্গী দাঁড়িয়েছে তা নিশ্চয়ই প্রভাবমুক্ত নয়। তবে বিশেষ কারো মতো করে কবিতা লেখার চেষ্টা করি নাই কখনো। আবার খুব সচেতনভাবে নিজস্বতা আরোপেরও চেষ্টা করা হয় নাই। বাকিটা পাঠক, তাত্ত্বিকরাই ভালো বুঝবেন – বলতে পারবেন।

আপনার নিয়মিত কার কার কবিতা পড়তে ভালো লাগে, কেনো লাগে?
সবার কবিতাই ভালো লাগে। কারণ - ‘কোথায় আমি নাই/আমিই’তো সবাই।’

কবি এরং কবিতার দায় সম্পর্কে আপনার মত কী?
কবি ভেদে কবিতা লেখার উদ্দেশ্যই আলাদা; তাই আলাদা প্রত্যেকের দায়ভাবও । আমি কোনো দায়বোধ থেকে কবিতা লেখি না। এই ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততাকে গুরুত্ব দেই, স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজি। অবশ্য অন্যভাবেও ভাবা যায়। হয়ত বিভিন্ন দায়ের গ্লানিমুক্ত হতেই লেখি। লিখতে গিয়ে নিজের মাঝে লুকাই। মানবাত্মার জন্মদায় মেটাতেই হয়ত পয়দা হয় কবিতা। 

আপনার সমকালীন কবিদের লেখা কবিতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
সমকালের যাদের কবিতা পড়া হয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো কবিতা ভালো লেগেছে। আবার কোনো কোনোটা খারাপ লেগেছে। এটা মূলত পাঠকালীন সময়ের মানুসিকাবস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন। এই মুহুর্তে একটি লাইন আমাকে যে ইমেজ দেবে, একটু পরই তা ভিন্নতর হতে বাধ্য। এ কারণে একই কবিতা কখনো খুবই ভালো, আবার কখনো খুবই ফালতু লেগেছে।

এই সময়ে যারা কবিতা লিখেন তাদের কবিতা বিষয়ে বলেন। তাদের অনেকের মাঝে কি স্টান্টবাজি লক্ষ করেন না?
ব্যক্তিগতভাবে আমি কবিতাকে সাধারণের কাছে ফেরানোর তাগিদ অনুভব করেছি খুব। সমকালীন অসংখ্য কবির কবিতা আমায় এ ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলেছে। যাদের লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা শূণ্যে ভাসছেন না।যারা জানেন এই মাটি ও মানুষের সাথে কবিতার সম্পর্ক আজকের নয়; বহু পুরানো। এক সময় ছন্দে ছন্দে কথা বলা ছিলো বাঙালের স্বাভাবিক প্রবণতা। পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক শিক্ষা বা পাশ্চত্যের প্রভাব – বাংলার সাহিত্যকে একদিকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে করেছে বিভেদাক্রান্ত। অশিক্ষিত কবিয়ালদের সহজবোধ্য দেশজ ঢঙ বা ছন্দের চেয়ে শিক্ষিত মহাকবিদের গণবিচ্ছিন্ন দুর্বোধ্য উপমার সামাজিক কদর বাড়িয়েছে পশ্চিমা চেতনা। সমকালীন কবিতা পড়ে মনে হচ্ছে এই ‘কলোনিয়াল ট্রমা’ কাটিয়ে ওঠার সময়ট চলছে। ফের মাটি ও মানুষের কাছেই ফিরছে কবিতা; এবং তা এখনকার কবিদেরই হাত ধরে। যে কারণে আমার সময়ের কোনো কোনো কবি যদি স্টান্টবাজিও করেন, তাও আমার ভালো লাগে।

দশক বিভাজন বিষয়ে আপনার মত কী?
এটা সাহিত্য শিক্ষক, সমালোচক বা সম্পাদকদের ভাবার বিষয়, আমার মতো দায়হীন কাব্যচর্চাকারী কবি বা অকবির নয়। নিজেকে কখনো দশকাক্রান্ত দেখতে চাই না। 

শিল্প-সাহিত্যেক্ষেত্রে পুরস্কার প্রকৃতপক্ষে কী কোনো ভূমিকা রাখে?
যেহেতু আমরা এখন বাজার সভ্যতার বাসিন্দা সেহেতু অর্থ-পুরস্কার কোনো শিল্প-সাহিত্যচর্চাকারীর কয়েকটা দিন বা ঘন্টাকে আনন্দময় করে নিশ্চয়ই। তবে প্রকৃত শিল্প-সাহিত্যচর্চাকারী, অর্থাৎ যারা শুধু চর্চার আনন্দে শিল্প-সাহিত্য করেন; তাদের পুরস্কারের আশা করতে দেখিনি কখনো। 

সবশেষে আপনি আপানার এমন একটা স্বপ্নের কথা আমাদের বলেন, যেটা বাস্তবায়ন করতে আপনার চেষ্টা আছে।
আপাতত তামাম স্বপ্নেরা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা শিল্প কেন্দ্রীক। যেগুলো বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এই মুহুর্তে মূলত চলচ্চিত্র নির্মাণের পথে হাঁটছি। ইতিমধ্যে শুরু করেছি নিজের প্রথম সিনেমার কাজ। এছাড়া বেশ কিছু নতুন প্রকাশনার কাজও হাতে নিয়েছি। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা - দুটো ক্ষেত্রেই আমি মূলত শিশুদের জন্যই বেশী কাজ করতে চাই। আর এ জন্য শুধু চেষ্টা নয় - আমি যুদ্ধ করতেও রাজি।

পুরানো সাক্ষাতকার
ঘুমঘোরে কথোপকথন
অলস দুপুরে আলাপ...

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]