Powered By Blogger

০৪ জানুয়ারী ২০২৩

ঢাকা লিট ফেস্ট কী বা কেন?

ঢাকা লিট ফেস্টের নবম আয়োজনের একটি অধিবেশনের দৃশ্য।

প্রথমবারের মতো সর্বজনের বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে শুরুর আগেই বেশ হইচই ফেলে দিয়েছে দশম ঢাকা লিটারারি ফেস্ট, যা লিট ফেস্ট নামেেই বেশি পরিচিত। শুধু নবজাতক থেকে ১২ বছর বয়সী ছাড়া বাকি দর্শনার্থীদের জন্য টিকিট ক্রয় বাধ্যতামূলক।
টিকিটের মূল্য দৈনিক জনপ্রতি পাঁচশ টাকা। তবে একসঙ্গে চার দিনের টিকিট নিলে ছাড় মিলবে পাঁচশ টাকা। শিক্ষার্থীরা দু্ইশ টাকায় একদিনের টিকিট কিনতে পারবেন। আর তারা একসঙ্গে চার দিনের টিকিট কিনলে লাগবে ৫০০ টাকা। এছাড়া কেউ তিন হাজার টাকা মূল্যের টিকিট কিনলে তিনি উৎসবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচিত হবেন বলেও উল্লেখ করেছে আয়োজকরা। এক্ষেত্রে একসঙ্গে চার দিনের টিকিট পাওয়া যাবে ১০ হাজার টাকায়। সাথে ফ্রি পার্কিং সুবিধা, ভিআইপি আইডি কার্ডসহ ঢাকা লিট ফেস্টের বিশেষ লাউঞ্জে প্রবেশের সুযোগ, যেখানে থাকছে লাঞ্চের ব্যবস্থা।
কোভিড মহামারির কারণে তিন বছর স্থগিত থাকার পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হতে যাচ্ছে দেশি-বিদেশি সাহিত্য-সংস্কৃতির এই আসর। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, ২০২১ সালে নোবেলজয়ী তাঞ্জানীয় ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ, ভারতীয় লেখক ও সাহিত্য সমালোচক অমিতাভ ঘোষ সকালে উৎসবটি উদ্বোধনের পর চার দিনে এই আয়োজনে অংশ নেবেন পাঁচ মহাদেশের পাঁচ শতাধিক বক্তা। যার মধ্যে থাকবেন ২০২২ সালের বুকারজয়ী শ্রীলঙ্কার কথাশিল্পী শেহান কারুনাতিলাকা এবং হিন্দি ভাষার ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার গীতাঞ্জলি শ্রী।

নিঃসন্দেহে বিশাল আয়োজন। এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে লিট ফেস্টের নবম আয়োজনে আমার যাওয়া হয়েছিল পেশাগত কারণে। সেবার উৎসবের শতাধিক অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলেন পাঁচ মহাদেশের ১৮ দেশের প্রায় তিনশ লেখক-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ, যার প্রায় একশজন ছিলেন ভিন্নভাষী।
“মুক্তচিন্তা প্রকাশের ভীতি কাটাবে লিট ফেস্ট” শিরোনামে তখন যে প্রতিবেদনটি তৈরী করেছিলাম, তারই কিয়দাংশ আজ এই ব্লগে টুকে রাখছি। শুরুটা ছিল এমন- “চলতি দশকে উগ্রবাদীদের হাতে লেখক-প্রকাশক খুন, রাষ্ট্রীয় চাপসহ সামাজিক নানা কারণে বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতাচর্চা ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে যে ভীতি তৈরী হয়েছে তা কাটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে ঢাকা লিটার‌্যারি ফেস্টিভ্যাল (ঢাকা লিট ফেস্ট); এমনটাই মনে করছেন আয়োজকরা।”
বিষয়টি নিয়ে উৎসব প্রাঙ্গণেেই আলাপ হয়েছিল ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম উদ্যোক্তা ও পরিচালক কবি সাদাফ সায্‌ সিদ্দিকীর সাথে। “এ রকম আয়োজন নিয়মিত করতে পারলে ওই (শঙ্কামুক্ত) জায়গায় অবশ্যই পৌঁছানে যাবে,” উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, “আশাকরি, আমরা এই উৎসব অব্যাহত রাখতে পারবো।” সেবার বাক স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ, রাজনীতির বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও মুক্তচিন্তাকে গুরুত্ব নিয়ে সাজানো হয়েছিল ফেস্টের বিভিন্ন অধিবেশন।

“এই উৎসবে আমরা বিভিন্ন ধরনের মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করি। নির্দিষ্ট একটি বিষয়কে এখানে বিভিন্ন দিক থেকে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এটি একটি নিরপেক্ষ মঞ্চ। এখানে স্বাধীনভাবে কথা বলা যায়,” বলছিলেন সাদাফ। “যখন আমরা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারবো, তখনই আমাদের নিজস্ব মতামত তৈরী হবে,” উল্লেখ করে তিনি দাবি করেছিলেন, বাংলাভাষী বুদ্ধিজীবীরা এই আয়োজনের সুফল পাচ্ছেন।
যদিও সেসময় বাংলাদেশি কবি ব্রাত্য রাইসুর ভাষ্য ছিল, বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন বার্তা দেওয়ার সরকারি উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন করছে লিট ফেস্ট। তিনিও উৎসব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েই বলেছিলেন, “এ ধরনের আয়োজনের মধ্যে যখন আপনি বাকস্বাধীনতার চর্চা করেন, তখন এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে; সরকার কারো বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে না। এই বার্তাটিই আন্তর্জাতিকভাবে পৌঁছানো হচ্ছে।”
“সরকারের সংস্থাগুলো আরো শক্তিশালী এবং কৌশলী হয়েছে। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিদ্রোহী বা লেখকরা খুব বেশী আগাতে পারেনি। সরকার এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গিয়েছে,” ‍উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, “বাকস্বাধীনতাচর্চার কোনো জায়গাতো তৈরী করছেই না, বরং দেশে বাকস্বাধীনতা যে কম আছে, সেটাও বুঝতে দিচ্ছে না এই লিট ফেস্ট।” রাইসু আরো বলেছিলেন, “যে রাষ্ট্রে ক্রসফায়ারে হত্যার উদাহরণ আছে, সেখানে একজন লেখক বা সাহিত্যিক যখন কথা বলতে পারেন না, তাঁর ভীতিকে অমূলক বা ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ বলা যায় না। এটা রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপেরই বহিঃপ্রকাশ।”

উৎসবে অংশ নেওয়া ইন্ডিয়ান স্টাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং ভাষা অধিকার আন্দোলনের কর্মী গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের সাথেও তখন আলাপ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “আমি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, আবার এই যে ঢাকা লিট ফেস্টে কয়েকবছর ধরে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আসছি; তারই প্রেক্ষিতে বলতে পারি পূর্ণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কোথাও নেই।”
“এর মধ্যে এটাই বীর বুদ্ধিজীবীর চ্যালেঞ্জ যে সে কোন রূপক ব্যবহার করবে, বা কোন প্রতিস্পর্ধা দেখাবে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতে রূপক আর প্রতিস্পর্ধা শানিত না করে যদি শুধু নালিশ ঠোকা হয়, সেটাও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একভাবে বৈধতা দেওয়া,” যোগ করেছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মস্তিষ্ক বিজ্ঞানে পিএইচডি করা এই তাত্ত্বিক। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে ‘জনসম্পৃক্ততাই প্রতিস্পর্ধিতার সবচেয়ে বড় অস্ত্র’ উল্লেখ করে গর্গ বলেছিলেন, “বর্তমানের সাহিত্যিকরা নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। তাদের লেখায় বাঙালী গণমানুষের ইস্যুগুলো ব্যাপকভাবে উঠে আসছে না।”
“মূলত বাংলা সাহিত্য কার প্রতিনিধিত্ব করবে তার সাথেই জড়িত, এখানকার লেখক-সাহিত্যিক নানাভাবে আক্রান্ত হলে কে তাদের রক্ষা করবে,” বলছিলেন বাংলা ও বাঙালীর অধিকার আদায়ে সক্রিয় অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন বাংলা পক্ষের এই অন্যতম নেতা। “পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সাহিত্য হেরে যাচ্ছে না, হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে,” উল্লেখ করে তিনি এজন্য হিন্দী পুঁজির আগ্রাসনকে দায়ী করছিলেন।

সেবার বরিশাল থেকে এই উৎসবে অংশ নিতে আসা কবি হেনরী স্বপন বলেছিলেন, “আমরা যারা বাংলায় লেখালেখি করি, এই উৎসবের আমাদের অবস্থানও আসলে খুবই গৌন। এখানে যারা আসেন, পাঠক বা উৎসুক দর্শক; তারা আমাদের ধারেকাছেও ঘেঁষে না।”
“এটা নিঃসন্দেহে ‘এলিটদের ফেস্ট’ নিঃসন্দেহে। ইংরেজী সাহিত্য আমরা কজনই-বা পড়তে চাই বা পড়ি। ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলোতেও আমাদের এলিটদের ছেলেমেয়েরাই পড়ে। যে কারণে এই উৎসবে ওদের আধিপাত্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক,” বলছিলেন তিনি। হেনরীর দাবি, “প্রতিনিয়ত এই আয়োজনের ব্যাপ্তি বাড়ছে। দেশী-বিদেশী লেখকদের সম্মিলন এবং উৎসাহী পাঠক, বিশেষ করে ইংরেজীমাধ্যমে পড়ুয়া অতি তরুণদের আগ্রহও বাড়ছে। তারা সাহিত্যের নানাকিছু জানতে বা বুঝতে চাচ্ছে।”
“ইংরেজী সাহিত্যের বড় বড় লেখকরা, যারা ইতিমধ্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিংবা আগামীতে পাঁচ বছরে পাবেন, এমন লেখকরাও এই উৎসবে এসেছেন। এর গ্রহণযোগ্যতাও দারূনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে,” যোগ করে তিনি বলেছিলেন, “বিভিন্ন দেশের উঁচুমাপের এই লেখক-সাহিত্যিকদের সাথে ভাববিনিময় আমাদের সমৃদ্ধ ও উজ্জীবিত করছে।”

কথাসাহিত্যিক কাজী আনিস আহমেদ, কবি সাদাফ সায্ সিদ্দিকী ও কবি আহসান আকবরের পরিচালনায় ২০১১ সালে ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ নাম দিয়ে এ উৎসবের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১৫ সাল থেকে এটি ঢাকা লিট ফেস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে

নবম লিট ফেস্টের একটি অধিবেশনে কথা বলছেন গর্গ চট্টোপাধ্যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]