Powered By Blogger

০৮ এপ্রিল ২০১৪

কার সোনার ভারে ডোবে সোনার বাংলা?

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি উড়োজাহাজ থেকে
২৫ মার্চ ১০৫ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। ছবি: জুয়েল শীল / প্রথম আলো
মহান সুফি সাধক দ্বয়ের নামের এমন কুদরত বোধকরি তার চরম আশিক বা মুরিদও দেখতে চাননি; নাকি চেয়েছেন? চান বা না চান ঢাকার হযরত শাহজালাল আর চট্টগ্রামের শাহ আমানত, এ দুটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ওই দুই খনি থেকে প্রায় নিয়মিতই উদ্ধার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সোনা। ইদানীং এর মাত্রাটা যে হারে বেড়েছে তা বেশ আশাব্যঞ্জকই বটে। কারণ – উদ্ধার হওয়া চোরাই সোনায় রিজার্ভ বাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। জানেন তো, বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ ২০১০ সালের ০৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ১০ টন সোনা কেনে। সেই কেনা সোনার সঙ্গে যোগ হচ্ছে পাচারকালে ধরা পড়া সোনা। মানে চোরাই সোনায় বাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। বিনামূল্যে পাওয়া এই সোনা আগে নিলাম করে বিক্রি করে দেয়া হত। কিন্ত ২০১১ সাল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা নিলাম স্থগিত রেখেছে। এদিকে গত বছর বাংলাদেশে অবৈধ পথে এসে আটক সোনার পরিমাণ তার আগের বছর ২০১২-এর চেয়ে ২২ গুণ বেশি। আবার চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ-এ তিন মাসে যে পরিমাণ চোরাই সোনা আটক হয়েছে তা ২০১২ সালে সারা বছরের আটক হওয়া সোনার চেয়ে প্রায় নয় গুণ বেশি।

গতকাল, মানে ০৭ এপ্রিল সোনা সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বিভিন্ন সংবাদ দেখতে ও পড়তে গিয়ে দুটি লাইনই মাথায় এলো – ‘হায় - ভারতীয় চাহিদায় / সোনার বাংলা ডোবে সোনায় ।’ ওই সোনা হাতাতে হাতাতে, মানে এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই সবার জন্য এই সংবাদ কোলাজটি করার ইচ্ছা জাগে। সময় করে পুরোটায় একবার চোখ বুলালে যে কেউই হয়ত এ বিষয়ে একটি সম্যক ধারনা পাবেন। এনিয়ে ভাবতে গিয়ে আরো মনে হলো হায়, যে সময়ে চারিদিকে এত সোনার ছড়াছড়ি তখন আমরা কি’না বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্ট দিলাম ভেজাল মিশ্রিত স্বর্ণের! তাহলে এত সোনা আটকেই বা লাভ কি? রিজার্ভ তো এম্নিতেই নেই। আজ ০৮ এপ্রিল প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধি বোঝাতে একসময় গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরু—এমন অবস্থাকেই বোঝানো হতো। সেই অতি সরল সমৃদ্ধির মাপকাঠিটা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, উপচে পড়া সম্পদ আগলে বসে থাকা এখন আর অর্থনৈতিক সুবিবেচনার পরিচয় বহন করে না। কয়েক বছর ধরে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সিন্দুকভরা এই ডলার নিয়ে আমরা কী করব, আমাদের কতখানি মজুত থাকা উচিত—এসব প্রশ্ন উঠে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়। ইতিমধ্যে (ফেব্রুয়ারি ২০১৪) আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, এই প্রবণতায় জুন নাগাদ দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের এই রিজার্ভের বিষয়টি শুধু একাডেমিক বিতর্কে থেমে নেই। এমনও বলা হচ্ছে, বিনিয়োগবিহীন এই রিজার্ভ ধরে রাখা অর্থনীতির দুর্বলতা, সরকারের অদক্ষতা ইত্যাদি। এ অবস্থার জন্য দায়ী করা হচ্ছে বিনিয়োগের মন্দাকে, যে কারণে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানি প্রত্যাশা মোতাবেক হচ্ছে না। ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সমস্যা, ব্যাংকঋণের চড়া সুদ, দেশে শিল্পায়নের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবের কারণে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না বলেই আমদানি খরচ কমে গিয়ে রিজার্ভ বেড়ে যাচ্ছে।


সংগ্রহিত চিত্র
এদিকে শুল্ক সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো বলছে, মূলত প্রতিবেশি দেশ ভারতে সোনা পাচারের ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীদের সঙ্গে জড়িত কিছু বাংলাদেশিও এ কাজে জড়িত। তারা সোনা পাচারে সহায়তা করে বড় অংকের অর্থ পাচ্ছে। কিন্তু পাচারকারীদের মূল হোতারা ধরা পড়ছে না। শুধু বহনকারী হিসেবে কাজ করছে তাদেরই আটক করা সম্ভব হচ্ছে। তারাও আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যাচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(খ) ধারানুযায়ী সোনা চোরাচালানকারীর সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন (৩০ বছর) সশ্রম কারাদণ্ড। কিন্তু সাজা দূরে থাক, স্বর্ণ চোরাচালানিরা গ্রেফতার হওয়ার পর এক-দু’মাসেই জামিনে বেরিয়ে আসে অদৃশ্য শক্তির ইশারায়। নতুন করে আবারো তারা শুরু করে তাদের ‘স্বর্ণবাণিজ্য’।
সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের দুই প্রধান বিমানবন্দরে অবৈধ স্বর্ণের চালান ধরা পড়েছে প্রায় চারশ কেজি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বিগত বছরে ৫২০ কেজি সোনা উদ্ধার কার হয়। এর আগে ২০১২ সালে ২৫ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। আর বিগত তিন মাসে ঢাকা ও চট্রগ্রাম বিমান বন্দর থেকে ২২০ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। আর গত তিন বছরে তিন হাজার ৬০০-এর বেশি ব্যক্তিকে সোনা চোরাচালানের অভিযোগে বিমানবন্দর থেকে আটক করে কাস্টমস, সিভিল এভিয়েশন, ইমিগ্রেশন, এনএসআই ও পুলিশ সদস্যরা।
বাংলাদেশে স্বর্ণ ব্যবসার সাথে জড়িতরা সাধারণত বলছেন, দেশে এত সোনার চাহিদা নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাচারের জন্যই চোরাইপথে এসব স্বর্ণের চালান আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেনাপোল সীমান্তে ভারতে পাচারের সময় স্বর্ণের একটি চালান ধরা পড়েছে। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও নিশ্চিত হয়েছে চোরাইপথে আসা স্বর্ণের চালান প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের প্রবীণ একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, ভারতে বিশ্বমানের সোনার অলঙ্কার তৈরি হয় এবং এসব অলঙ্কারের চাহিদা মধ্যপ্রাচ্যেই বেশি। তার মতে চোরাপথে বাংলাদেশ হয়ে আসা স্বর্ণের বার ভারতে গিয়ে অলঙ্কার হয়ে ফের ফিরে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু ভারতের বিমানবন্দর গুলোতে নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে চোরাচালানিরা সরাসরি সেদেশে স্বর্ণ চোরাচালানের সাহস করছে না। অপেক্ষাকৃত দুর্বল নিরাপত্তার সুযোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। কাস্টমের গোয়েন্দা শাখার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশে ব্যাপকহারে সোনার চালান আসছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয় যে বিপুল পরিমাণ সোনার চালান আসছে তার চাহিদা বাংলাদেশে নেই। মূলত ভারতের বাজারকে টার্গেট করে আšতর্জাতিক অপরাধীরা এসব চালান আনছে।

চট্টগ্রামের জুয়েলারি সমিতির নেতা সাধন ধর বলেন, ‘যে বিপুল পরিমাণ সোনা আসছে তার চাহিদা বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজারে নেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বৈধপথে আনা অলঙ্কারের একটি অংশ স্বর্ণের দোকানগুলোর চাহিদা পূরণ করে আসছে। আর তাতেই বাজার স্থিতিশীল থাকছে। বাজারে কখনও বড় ধরনের স্বর্ণের ঘাটতি দেখা যায়নি।’ চোরাইপথে আসা এসব স্বর্ণের গন্তব্য প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন বিশ্বের দেশও হতে পারে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখনও পর্যন্ত দেশে সরকারিভাবে কোনো স্বর্ণ আমদানি করা হয় না। অথচ এ দেশে তৈরি স্বর্ণালঙ্কারের মান অনেক উন্নত। সরকার বৈধপথে স্বর্ণ আমদানি করে তা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করলে বাংলাদেশ থেকেও স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানি করা সম্ভব ।’ বৈধপথে আমদানি হলে অবৈধপথে চোরাচালান কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।

ওদিকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ডানপন্থী এক দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু ভারতে পাচারই নয়, রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ কিছু এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী চোরাকারবারীদের কাছ থেকে স্বর্ণের বার সংগ্রহ করছে। এ চক্র দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণ পাচারের পর সড়কপথে ভারতেও উচ্চমূল্যে পাচার করছে। সম্প্রতি কয়েকটি চালান আটকের পর পুলিশ, র‌্যাব ও শুল্ক গোয়েন্দারা এ তথ্য জানিয়েছেন। ডিবি পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছে, ‘সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা পাওয়ার কারণে পুরান ঢাকা, বায়তুল মোকারমসহ অর্ধশত স্বর্ণের ব্যবসায়ীর ওপর এখন নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’

ডিবির আরেক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীজুড়ে প্রায় অর্ধশত দোকান চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা স্বর্ণ চোরাইচক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এসব দোকান পল্টন, বায়তুল মোকাররম মার্কেট, মিরপুর-১০ নম্বর, শাহ আলী, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, কো-অপারেটিভ মার্কেট, উত্তরা নর্থ টাওয়ার, শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারসহ পুরান ঢাকার কয়েকটি স্থানে অবস্থিত। অভিযুক্ত ওই সব ব্যবসায়ী চুরি করা স্বর্ণালংকার কেনে। আবার তারা নিজেরাই চোরাকারবারীদের সহায়তা করে। কয়েকটি ঘটনায় এমন ১১ ব্যবসায়ীকে শনাক্ত করার পাশাপাশি অর্ধশত ব্যবসায়ী আছে গোয়েন্দা নজরদারিতে।

এদিকে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘কিছু অসাধু জুয়েলারি মালিক চোরাই স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে আমরাও শুনি। প্রমাণের অভাবে এসব মালিকদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।’ সংরগঠনের সভাপতি ডা. দিলীপ রায় বলেন, ‘যারা চোরাই স্বর্ণ কেনার সঙ্গে জড়িত, আমরা তাদের শাস্তি চাই। তবে নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারীরা। তাদের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা লোকসানের সম্মুখিন হচ্ছেন। কারণ চোরাকারবারীরা বাজারে সল্পমূল্যে সোনা বিক্রি করছেন।
তবে আরেক অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিককে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক স্বর্ণ ব্যবসায়ী আবার জানিয়েছেন, সোনা আমদানির ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তা তাদের জন্য ‘জটিল’ ও ‘অলাভজনক’। এ কারণে তারা অবৈধপথে আসা সোনার ওপর নির্ভর করেন অথবা সমর্থন করেন। দেশের আইনানুযায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে সোনার বার বা ‘বিস্কুট’ আমদানি করা যায়। তবে এ আমদানি বাবদ প্রতি ভরির দাম ৪০ হাজার টাকা ধরে (১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম) এর ভ্যাট দিতে হয় চার হাজার টাকার বেশি। ব্যবসায়ীদের দাবি, এ পরিমাণ ভ্যাট দিয়ে গয়না আমদানি করে ব্যবসা করাটা অলাভজনক। স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘দেশের আট থেকে ১০ হাজার গয়নার দোকানে প্রতিদিন প্রায় ২৫ কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কার কেনাবেচা হয়। এ পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কারের চাহিদা অন্যের গয়না ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিলাম থেকে মেটানো সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল জানান, পুরনো গয়না, প্রবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নিলাম করলে সেখান থেকে সোনা কেনেন তারা। সভাপতি দীলিপ রায় বলেন, ‘বাংলাদেশে সোনা ব্যবহারের নির্দিষ্ট কোন হিসাব নেই। তাছাড়া বিশ্ব বাজারে হরহমেশাই সোনার দাম উঠা নামা করার কারণে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা আমদানি কম করে থাকেন। কারণ বাংলাদেশের সোনার বাজার খুব বড়ও নয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিদেশি যাত্রীদের বহন করা বৈধ সোনার উপরই নির্ভর করে থাকে।’ বাংলাদেশ রত্ন পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দীলিপ কুমার আগারওয়াল বলেন, ‘দুটি বিমান বন্দর থেকে প্রতি দিন প্রায় ১২ থেকে ১৭ হাজার যাত্রী বাংলাদেশে আসেন। তারা যদি অনুমোদিত সোনা ও অথবা একশ গ্রাম করেও সোনা নিয়ে আসেন তবে প্রতিদিন সোনার পরিমান দাড়ায় ৪০ কেজিতে। তাই সোনা আমদানি করার প্রয়োজন হয় না।’

ঢাকা কাস্টমস হাউসের শুল্ক কমিশনার জাকিয়া সুলতানা জানান, গত দুই বছরে এক রতি সোনারও আমদানি শুল্ক পায়নি সরকার। তবে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত ২১০ কেজি স্বর্ণ আটক করা হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দরে। ২০১২ সালে একই বিমানবন্দর থেকে পাঁচ কোটি টাকার সমপরিমাণ ১১ দশমিক ৬৯ কেজি সোনা উদ্ধার করেছিল শুল্ক কর্তৃপক্ষ। উদ্ধার করা সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে যাওয়ায় কাস্টমস বিভাগের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা সদস্যদের আরো তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুরো বিমানবন্দরকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে বলা হয়েছে।’

আরো একটি পত্রিকা লিখেছে, জুয়েলারি ব্যবসার আড়ালে চোরাই স্বর্ণ কেনাবেচা করছে একটি চক্র। তারা দাবি করেছে - পুরান ঢাকায় কিছু স্পট ও জুয়েলারির দোকানে অবাধে চোরাই স্বর্ণ বেচাকেনা হয়। এসব স্বর্ণের প্রধান ক্রেতা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা জুয়েলারির ব্যবসায়ীরা। বাকি স্বর্ণের বারের রূপ বদলে বা অলংকার আকারে ভারতে পাচার করা হয়। এ কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। দিনের পর দিন প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অসাধু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা অবৈধ পথে সোনার বার নিয়ে আসছে। চোরাই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ ও আর্মড পুলিশের কিছু অসাধু কর্মচারী ও কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। এসব ব্যবসায়ী চোর ও ডাকাতদলের কাছ থেকে লুট হওয়া স্বর্ণালংকারও কিনে থাকে। ২০১২ মাল থেকে স্বর্ণ চোরাচালান ও ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার পর এসব চক্রে জড়িত অন্তত ১১ কথিত ব্যবসায়ীকে শনাক্ত করেছে তারা। গত দুই বছরে শুধু রাজধানীতেই অন্তত ১২ হাজার ভরি স্বর্ণালংকার চুরি ও ডাকাতি হয়েছে। এর বেশির ভাগ স্বর্ণই উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে কয়েকটি ঘটনা তদন্তে এবং আসামী গ্রেপ্তারে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

প্রেক্ষাপট : শাহজালাল

গত ২২ মার্চ ভোরের পাতা নামক একটি দৈনিকে ‘কোত্থেকে আসে এত সোনা’ - শিরোনামে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সাংবাদিক তালুকদার রিপনের লেখা ওই প্রতিবেদনটি ছিলো মূলত শুধু হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কেন্দ্রীক। সে লিখেছে, ওই বিমান বন্দরটি এখন স্বর্ণ চোরাকারবারিদের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। মাঝে মধ্যে দুয়েকটি চালান ধরা পড়লেও সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে বেশিরভাগ অবৈধ স্বর্ণের চালান। আর সেসব স্বর্ণ দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বাজারে। অথচ গত দুই বছরে এক রতি সোনারও আমদানি শুল্ক পায়নি সরকার। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে সম্প্রতি আটক হন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের এক নিরাপত্তাকর্মীসহ তিনজন। অভিযোগ রয়েছে- বিমান, সিভিল এভিয়েশন ও নিরাপত্তা কর্মীদের যোগসাজশে অবৈধ এসব স্বর্ণের চালান ঢুকছে। স্বর্ণ পাচারকারীদের সঙ্গে বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকারী সিভিল এভিয়েশন, শুল্ক বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থার এক শ্রেণির প্রভাবশালী কর্মকর্তা জড়িত। তাদের নির্দেশনা মোতাবেক বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে বড় বড় স্বর্ণের চালান বিমানবন্দর হয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে। পাচারকারী সিন্ডিকেটের প্রলোভনে পড়ে বিমানবালা, কেবিন ক্রু, প্রকৌশলী ও যাত্রীবেশী পাচারকারীরা স্বর্ণের চালান বহন করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় প্রতিদিনই সোনা চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। ধরা পড়ছে কালেভদ্রে একটা-দুইটা।

ঢাকা কাস্টমস হাউসের হিসাব মতে, গত ১৩ মাসে বিমানবন্দরে ১০৭টি স্বর্ণের চালান আটকের ঘটনায় থানা ও বিভাগীয়সহ ৭০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক মামলা ধামাচাপা পড়ে গেছে। এসব ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই আদালত থেকে জামিনে মুক্তিলাভ করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আজ পর্যন্ত স্বর্ণ চোরাচালান মামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি হওয়া দূরের কথা, মূল হোতাদেরই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা বরাবরই রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর বাহক হিসেবে যারা ধরা পড়েন, আইনের ফাঁকফোকরে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারো চোরাচালানে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এছাড়া চোরাকারবারিদের সহযোগী বিমানবন্দরে কর্মরত যে কয়েকটি চক্র রয়েছে এসব চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। গোয়েন্দারা বলছে, দেশি-বিদেশি চক্র হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে সোনা পাচারের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে মনে করছে। যে কারণে প্রায় প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ চোরাচালান করছে। বাংলাদেশে পাচারের পর একইভাবে স্বর্ণের একটি বড় অংশ ফের পাচার হয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। চক্রের মূল হোতারা সিঙ্গাপুর, দুবাই, পাকিস্তান ও ভারতে বসে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। গত এক বছরে চোরাচালানের ঘটনা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি ধরাও পড়েছে প্রচুর স্বর্ণের চালান।

ঢাকা কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার কেএম অহিদুল আলম বলেন, ‘আটক ব্যক্তিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে তারা থানায় মামলা করেন। কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলার আসামিরা কীভাবে জামিনে মুক্তি পান, তা তাদের বোধগম্য নয়। কাস্টমসের নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ না থাকায় এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পুলিশের মতো কাস্টমসকে যদি এসব মামলার তদন্তের ক্ষমতা দেয়া হতো, তাহলে হয়তো এ সমস্যা দূর হতো। আসামিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে মামলা দায়ের করার পর পুরো বিষয়টি পুলিশের কাছে চলে যায়। তদন্তে কোনো ফাঁকফোকর থাকে কি না, তা কাস্টমসের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে যখন পর্যালোচনা করা হয়, তখনই আমরা জানতে পারি আসামিরা জামিনে রয়েছেন।’

পুলিশ, কাস্টমস (শুল্ক) বিভাগ ও আদালত সূত্রের তথ্যানুযায়ী গত বছরের ২৯ জুলাই হংকং থেকে আসা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জনতা হাউজিংয়ের বাসিন্দা কাইয়ুম মিয়া বিমানবন্দরে ৫২টি স্বর্ণের বারসহ আটক হলেও তিনি এখন জামিনে মুক্ত। একইভাবে জামিনে রয়েছেন সিঙ্গাপুর থেকে আসা ফ্লাইটের যাত্রী মজিবুর রহমান। গত জুনে সাত কেজি স্বর্ণসহ আটক মোর্শেদ আলম এখন জামিনে রয়েছেন। জুনে ১৭টি বারসহ আটক মিজানুর রহমান, জুলাইয়ে মালয়েশিয়া থেকে আসা ৩ কেজি সোনাসহ আটক নজরুল ইসলাম, ৮ কেজি সোনাসহ দীপক কুমার, সাড়ে পাঁচ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের মামলায় মো. হাবিব, সাড়ে ছয় কেজি স্বর্ণের মামলায় দেলোয়ার, এক ও দুই কেজি স্বর্ণ আটকের মামলায় আতিকুল ইসলাম, মনোয়ার, আবদুর রউফ, রব্বানী, মিজানুর রহমান, রাজেশ, আসাদুল্লাহ, কামাল উদ্দিন ও আবুল কাশেম জামিন পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, গত বছর স্বর্ণ চোরাচালান ঘটনার মামলাগুলোর তদন্তে এখনো তেমন অগ্রগতি নেই। এ রকম বেশিরভাগ মামলাই পুলিশের খাতায় ‘তদন্তাধীন’ থাকে বছরের পর বছর। তবে ৩১ ডিসেম্বর এক হাজার ৩৪০ ভরি স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তা কেএম কামরুল হাসান, উড়োজাহাজের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আবু জাফর, ভারতীয় এক নাগরিকসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। স্বর্ণগুলো বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর মগবাজার থেকে উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় করা মামলারও তদন্ত এখনো চলছে ।

শাহজালাল বিমানবন্দরে সোনা পাচারের ঘটনার বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তকারী সিআইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশি একটি চক্র হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাচালান করে। ভারত, পাকিস্তান, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। মূলত এসব রুট থেকে যাত্রীকে দিয়ে টাকা অথবা বিমান টিকিটের বিনিময়ে কখনো ফুলদানির ভেতর, কখনো বা জুতার ভেতর ও কার্বন পেপারে সোনার বার এ দেশে পাচার করা হয়। তাদের সহযোগিতা করে বিমানবন্দর ও বিমানের দেখভালে নিয়োজিতরা।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত বছরের ২৪ জুলাই ১২৪ কেজি সোনা উদ্ধার করেছিল শুল্ক কর্তৃপক্ষ। তবে এখনো পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ধরাও পরেনি জড়িত কেউ। গত ছয় মাসে বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে কিংবা বন্দরের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় একাধিকবার বিপুল পরিমাণ সোনা উদ্ধার করেছে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব ঘটনায় শুধু বিভাগীয় মামলা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৮ আগস্ট দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইটে ৩০ কেজি ও ২১ আগস্ট বিজি মাস্কট ফ্লাইটে ৮ কেজি সোনার বার আসার তথ্য ছিল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কাছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন এপিবিএনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিন্তু বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগ ও সিভিল এভিয়েশন সংস্থার কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা চোরাচালানিদের কাছে তথ্য ফাঁস করে দেন। ফলে হাত ফসকে বেরিয়ে যায় আরেকটি বড় চালান। সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরো জানান, ১২৪ কেজি সোনা বিমানবন্দরের যে এরিয়ায় ধরা পড়েছিল সে এরিয়াটি ‘প্যানেল বক্স’ নামে পরিচিত। এখানে বিমানের পাইলট ও সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। বিমানের প্রকৌশলী ছাড়া প্যানেল বক্সের ঢাকনা খোলাও অসম্ভব। তারা বলছেন, বিমানের নিজস্ব লোকজন ছাড়া এত বড় স্বর্ণের চালান আনা সম্ভব নয়। এর আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুই দফায় ২৩ কেজি সোনা পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের এক নিরাপত্তাকর্মী সাইফুল ইসলামসহ তিনজনকে আটক করা হয়। এর পূর্বে ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এই বিমানবন্দরের এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে আটক করেছে কাস্টমস। এছাড়া ২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাড়ে ১৩ কেজি সোনাসহ মনোয়ারুল হক নামের একজনকে গ্রেফতার করে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ। মনোয়ারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী দেবু ও সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী আবুল কালামকে গ্রেফতার করে তদন্ত সংস্থা ডিবি। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে বিমানবন্দরে কর্মরত জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মাঠ কর্মকর্তা আবদুল আজিজ শাহ, সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা অপারেটর রেখা পারভিন, নিরাপত্তা সুপারভাইজার আলো, নিরাপত্তারক্ষী লাভলী, মোতালেব খানসহ কয়েকজনের নাম উঠে আসে। এরপর আজিজ শাহ, সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী কবির আহমেদ, মোরশেদ আলম নামের এক চোরাকারবারি ও তার গাড়িচালক হেলাল মিয়াকেও গ্রেফতার করে ডিবি। তবে এদের অনেকে এখনো পলাতক।

সর্বশেষ গত ০৫ এপ্রিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এক কেজি ওজনের প্রায় ৬০ লাখ টাকা মূল্যের পাঁচটি সোনার বারসহ মাসুম শেখ নামের এক যাত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর আগে পহেলা এপ্রিলে এ বিমানবন্দর থেকে সোয়া সাত কেজি ওজনের ৬২টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। দুই যাত্রীর প্যান্ট ও মোজার ভেতর থেকে বারগুলো উদ্ধার করা হয়।

প্রেক্ষাপট : শাহ আমানত

চোরাপথে দেশে আসা স্বর্ণের বিরাট অংশ সীমান্ত পথে চলে যাচ্ছে ভারতে। সে দেশের চাহিদা মেটানোর পর বাকিটা অলঙ্কার হয়ে ফের ফিরে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। আন্তর্জাতিক অপরাধীচক্র স্বর্ণ চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে। শাহ আমানতে সম্প্রতি আটক বেশ কয়েকটি স্বর্ণের চালানের মামলা তদন্তে এমন তথ্য পেয়েছেন পুলিশ, কাস্টমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা। বিমানবন্দর-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শাহ আমানতকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে অপরাধীরা। এটা বুঝতে পেরে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকায় একের পর এক চালান আটক করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য যে পরিমাণ চালান ধরা পড়ছে তারচেয়ে বেশি নিরাপদে পার হয়ে যাচ্ছে বিমানবন্দর থেকে।

শাহ আমানতে ধরা পরা সোনা। ছবি - সুপ্রভাত বাংলাদেশ
শাহ আমানতে গত ১৩ মাসে ৬ মণের বেশি সোনা ধরা পড়েছে। এ বিমানবন্দরে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চালানটি ধরা পড়ে গত ২৫ মার্চ। কয়েকজন যাত্রীর সিটের নিচে এবং বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১০৭ কেজি ওজনের ৯২৩টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। দুদিন পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বিমানযাত্রীর জুতার ভেতর থেকে দুই কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। শাহ আমানতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে ১৬০ কেজির বেশি সোনা ধরা পড়েছে। আর চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনা গুলোয় সাধারণত মামলা হয় পতেঙ্গা থানায়। এই থানার ওসি শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে আমরাও শুনেছি বাংলাদেশ হয়ে স্বর্ণের চালান ভারতে যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। মূল চোরাচালানিরা ধরা না পড়ায় এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। গত কয়েক মাসে সোনা চালানের ৮টি মামলা রুজু হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি মামলায় ইতোমধ্যে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এসব মামলার কোনটিতেই মূল চোরাচালানিদের কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। বহনকারীদের আসামী করে মামলার তদšত শেষ করা হয়েছে। বহনকারীদের কেউ চোরাচালানিদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন তথ্য দিতে পারেনি।’

শাহ আমানত বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্বর্ণসহ যেসব যাত্রীকে আটক করা হয় তাদের প্রায় সবাই বহনকারী মাত্র। মোটা অংকের প্রলোভন এমনকি বিনা পয়সায় বিমানের টিকিট দিয়ে তাদের চোরাই স্বর্ণ বহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের কোন যাত্রী স্বর্ণের চালান বহনে রাজি হলে সেখানে তার ছবি তুলে রাখে চোরাকারবারীরা।এরপর ওই ছবি দেশের চোরকারবারীদের কাছে মেইলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বহনকারীকে সম্পূর্ণ নতুন একটি সিম ও একটি মোবাইল ফোন দেয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণের চালান নিয়ে নিরাপদে বের হওয়ার পর ফোনটি চালু করতে বলা হয়। আর তখনই বিমানবন্দরের বাইরে থাকা চোরাচালানিদের কল আসবে ওই ফোনে। এরপর তারা বহনকারীদের সাথে যোগাযোগ করে নিরাপদে নিয়ে যায় স্বর্ণের চালান। কিন্তু বিমানবন্দরে চালানসহ বহনকারী ধরা পড়ার পর বাইরে অবস্থানকারীরা চোরাচালানিরা দ্রুত এ খবর পেয়ে যায় এবং বহনকারীদের কাছে ফোন না করে তারা নিরাপদে সরে যায়। আর এ কারণেই স্থানীয় চোরাকারবারীদের ধরা যায় না বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিমান বন্দর কাস্টমের সহকারী কমিশনার মশিউর রহমান মন্ডল বলেন, একজন যাত্রী তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সর্বোচ্চ দুইশ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার কিংবা সোনার বার আনতে পারেন। ঘোষণা দিয়ে এ পরিমাণ স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কার আনলে ওই যাত্রীকে কোন ট্যাক্স দিতে হবে না। তবে কোনো যাত্রী চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী ঘোষণা দিয়ে নির্ধারিত শুল্কের বিনিময়ে সর্বোচ্চ দুই কেজি পর্যন্ত সোনা আনতে পারেন । ঘোষণা ছাড়া এ পরিমাণ সোনা আনলে ওই যাত্রীকে জরিমানা এবং নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। তবে ঘোষণা ছাড়া শরীর বা ব্যাগের কোথাও অথবা বিমানের কোন স্থানে লুকিয়ে স্বর্ণের চালান আনলে সেটি কাস্টম আইন অনুযায়ী চোরাচালান হিসেবে গণ্য হবে।
সর্বশেষ,চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে এক যাত্রীর হাঁটুর নিচে মোড়ানো অবস্থায় দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের প্রায় ছয় কেজি সোনার বার জব্দ করা হয়েছে। গতকাল ০৭ এপ্রিল বিমানবন্দরে নিয়োজিত শুল্ক কর্মকর্তারা নিয়মিত তল্লাশির অংশ হিসেবে এসব বার জব্দ করেন। বাই থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজে তল্লাশি চালিয়ে মো. আনিস চৌধুরী নামের এক যাত্রীর হাঁটুর নিচে মোড়ানো অবস্থায় ৫৩টি সোনার বার উদ্ধার করেন।


ভারতীয় চাহিদার সরূপ

গত ০২ এপ্রিল ‘ভারতে সোনা পাচারের ট্রানজিট বাংলাদেশ’ - শিরোনামেই সম্পাদকীয় প্রকাশ করে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক করোতোয়া। তারা বলেছে, ভারতের চোরাকারবারীরা সোনা চোরাচালানের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের ব্যবহার করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবি এবং শারজাহ থেকে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশী দেশে আসেন তাদের ওপর ভর করেন চোরাকারবারীরা। বাংলাদেশে আসার পর সীমান্ত দিয়ে এসব সোনা চলে যায় প্রতিবেশি দেশগুলোতে। শুধু বাংলাদেশ নয়, নেপাল হয়েও ভারতে সোনা চালান হচ্ছে বলে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মনে করছে।

ওই একই দিনে আজকের খবর ডটকম ‘ভারতে যাচ্ছে সোনা, ট্রানজিট বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। এতে বলা হয় - সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে সোনার চোরাচালান ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন ভারতে সোনা আমদানিতে কর বাড়ানোর কারণে বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করায় সোনার চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত বছরের জানুয়ারি মাসে ভারতে সোনা আমদানিতে ১০ ভাগ কর বৃদ্ধি করায় চোরাকারবারীরা ভারতে অবৈধভাবে সোনা পাচারের জন্য বাংলাদেশকে তাদের পছন্দের রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন।

এই সময়’র সৌজন্যে পাওয়া
জন্য ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে ভারত সোনা আমদানিতে করের পরিমান দুই ভাগ থেকে চার ভাগে বৃদ্ধি করে। এছাড়া বিগত বছরের জুন মাসে আমদানি কর ছয় ভাগে এবং আগস্ট মাসে ১০ ভাগে উন্নতি করা হয়। সোনা আমদানিতে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে চার দফা কর বৃদ্ধি করায় ভারতে সোনা আমদানিতে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ভারতে প্রতিবছরে প্রায় এক দশমিক ৬২ লাখ কেজি সোনা আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্ত আমদানিতে কর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিগত নভেম্বর মাসে সেই আমদানির পরিমাণ কমে গিয়ে দাড়ায় মাত্র ১৯ হাজার তিনশ কেজিতে। তাই লাভের আশায় চোরাকারবারীরা সোনা চোরাচালান করতে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ভারতের চেম্বার অফ কমার্সের তথ্য অনুযায়ী চোরাই পথে এক কেজি সোনা সংগ্রহ করতে পারলে দেড় লাখ টাকা সাশ্রয় ঘটে। বিশ্ব সোনা কাউন্সিলের হিসাব মতে, প্রতিবছর ভারতে ১৫০-২০০ টন সোনা চোরাচালান করা হয়ে থাকে।

প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দুবাইতে ১০ গ্রাম সোনার দাম ৩৮ হাজার টাকা, যেখানে ভারত ও বাংলাদেশে সেই পরিমান সোনার দাম যথাক্রমে ৪০ ও ৪৬ হাজার টাকা। বিএসএফ ও ভারত কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী ভারতে সোনা চোরাচালানের মোট ৫ ভাগ আসে বাংলাদেশ থেকে। সাধারণত বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলো থেকে ভারতে সোনার চালান পাঠানো হয়ে থাকে।

গত ০৬ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাও একই বিষয় নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন কামালের ওই প্রতিবেদনের শিরোনামটি আবার অনেক উপ –শিরোনাম সমৃদ্ধ। ‘দেশী-আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র সক্রিয় ।। আসছে সোনা যাচ্ছে ভারতে ।। ১১ ব্যবসায়ী শনাক্ত ।। অর্ধশত ব্যবসায়ী গোয়েন্দা নজরদারিতে’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে সোনার দাম বেশি এবং বৈধভাবে সোনা আমদানিতে কড়াকড়ি ও বেশি করারোপের কারণে ভারতীয় সোনা ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতে দেশী ও আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালান চক্রের নিরাপদ রুট হিসেবে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহৃত হচ্ছে। সোনা চোরাচালানীদের কাছে বাংলাদেশ নিরাপদ হয়ে উঠেছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে। ফলে দেশের বিমান ও স্থল বন্দরগুলো দিয়ে প্রতিদিনই মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে সোনার অবৈধ চালান আসছে। তবে এসব সোনা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিভিন্ন পথে সেসব সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে। সে দেশে সোনা ও সোনার অলংকারের রয়েছে প্রচুর চাহিদা। এছাড়া ভারতে তৈরি সোনার অলংকারেরও প্রচুর চাহিদা রয়েছে বিশ্ববাজারে। এ কারণেই সোনার চোরাচালান ঘটছে একের পর এক। আর এ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকার হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে একের পর এক চালান আটক করে শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা এমন তথ্য দিয়েছেন। আর এ কাজে জড়িত রয়েছেন এ দেশেরই বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। তাদের সাথে আছেন বেশ কিছু অসাধু সোনা ব্যবসায়ীও।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মঈনুল খান পত্রিকাটিকে জানান, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে সোনার মূল্য বেশি হওয়ার কারণে আমাদের পোর্টকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া আšতর্জাতিক বাজারে কম মূল্যের কারণে দেশে এনে বিক্রিরও প্রবণতা আছে। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা আনেক চালান ধরেছি। এসব চালানের হোতা পাওয়া গেলে রুটও বেরিয়ে আসে।’
এর আগে গত ০৩ এপ্রিল প্রকাশিত সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ‘সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট বাংলাদেশ’  শিরোনামে যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে - সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবি, শারজাহ, বাহরাইন, কুয়েত থেকে আসা প্রবাসী বাঙালিদের সোনার বার বহনের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া চোরাচালান সিন্ডিকেটের নিজস্ব বাহক মারফতও সোনার বার পাঠানো হয়ে থাকে। বিমানবন্দরের শুল্ক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এগুলো সহজেই চলে যায় দেশের অভ্যন্তরে। তারপর সময়-সুযোগ নিয়ে সেগুলো সীমান্ত দিয়ে দেদার পাচার হয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ভারতে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচার হওয়া সোনার বেশ কয়েকটি চালান আটক হওয়ার খবরও প্রকাশ হয়েছে। স্থলবন্দর বেনাপোলের বিপরীতে পেট্রাপোলের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব সোনার চালান আটক হয়েছে। গত ০৮ মার্চ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার স্বরূপনগর থানার সীমান্ত থেকে কলকাতাগামী একযাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ৪৫ কেজি সোনা। শুধুমাত্র স্বরূপনগর ও বনগাঁ সীমান্ত এলাকা থেকে গত তিন মাসে ২০ ও ১৫ কোটি রুপি মূল্যের সোনার বার উদ্ধার হয়েছে। যা চোরাপথে সেদেশে ঢুকেছে। একইভাবে বাংলাদেশের বিজিবি ২০১৩ সালে সাড়ে পাঁচ কেজি সোনার বার ও এবছর বেশ কয়েকটি সোনার বার আটক করেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্ত থেকে।

চোরাচালানের মাধ্যমে যাওয়া সোনা দিয়েই এখন চোরাচালানের অন্য পণ্যসামগ্রীর মূল্য পরিশোধ করারও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ভারতের ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) এর মতে প্রতিদিন সাতশ কেজি সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে সেদেশে যাচ্ছে। অতীতেও চোরাচালানের মাধ্যমে সেদেশে সোনা গেলেও গত এক বছরে তা তিনগুণ বেড়েছে বলে সংস্থা মত প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল হয়েও সেদেশে সোনা যাচ্ছে। ভারতে আর্থিক নিরাপত্তার ভিত্তি ধরা হয় সোনাকে। সেই ভারতে সোনার ওপর শুল্ক বাড়ানোর আগে যে হারে সোনা আমদানি হতো তা অনেক কমে এসেছে। ফলে চোরাপথে সোনা যাওয়ার ঘটনা বেড়ে গেছে। ভারতের বাজারে সোনার চাহিদার সাথে সাথে মূল্যবৃদ্ধির কারণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক চোরাচালানি চক্র। তারা ভারতের বাড়তি সোনার যোগান দিতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর তাদের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের সাথে রয়েছে ভারতের বিশাল সীমান্ত। এই সীমান্তের বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা সোনা পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।


সম্পাদকীয়টিতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পাচারকারী চক্র নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে। মাদক তার মধ্যে অন্যতম। ইয়াবার মতো ভয়াবহ সামগ্রী মায়ানমার হয়ে দেদার বাংলাদেশে আসছে। এখন আসছে সোনার বার। আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের হাত থেকে যেন বাংলাদেশের মুক্তি নেই। আর্থিক নিরাপত্তার দিক দিয়ে সোনার সোনার বিকল্প সোনাই। বাংলাদেশও সোনা আমদানি করে থাকে। কিন্তু ভারতের তুলনায় তা অতি নগণ্য। ভারতে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে চোরাচালানি চক্র। এই চক্রকে এখনই থামানো জরুরি। তা না হলে সোনার সাথে অন্য অনেক অপরাধও দেশে অবাধে ঢুকে পড়বে। যেমন ভারতে অন্য চোরাচালানের পণ্যের দাম এখন সোনা দিয়ে মেটানো হচ্ছে। তেমনি বাংলাদেশে মাদকের দাম সোনা দিয়ে মেটানোর পথ প্রশস্ত হলে সোনা চোরাচালান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাদকের চালানের বহরও বেড়ে যাবে। যা দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে।
এর অনেক আগে গত ২০ মার্চ ‘গরুর দামে সোনা পাচার’  শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন। তাদের কলকাতা প্রতিনিধির পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো - সীমান্তে গরু পাচার করার বিনিময়ে দাম হিসেবে আসছে সোনার বিস্কুট। সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্ত শহর বসিরহাটে গরু পাচারে যুক্ত স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতাকে ৪৫ কেজি সোনা সহ আটক করার পর এই তথ্যটাই সামনে এসেছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে বছর বছর যে গরু পাচার হয় তার দাম মেটানোর শর্ত দেয়া হচ্ছে নগদের পরিবর্তে চাই সোনার বিস্কুট। আর কারবারিরা তাতেই রাজি হওয়ায় সীমান্ত পথে কেজি কেজি সোনা আসছে বলে মনে করছেন শুল্ক বিভাগের গোয়েন্দারা। কিছুদিন আগেই বহরমপুরে ধরা পড়েছিল ৫৮ কিলোগ্রাম সোনা। আর গত সপ্তাহে সীমান্ত ও কলকাতা মিলিয়ে ধরা পড়েছে ৮৫ কিলোগ্রাম সোনা। ভারত সরকার সোনা আমদানির উপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে সোনা আমদানি আটকাতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতে সোনার চাহিদা বহাল থাকায় বেড়ে গিয়েছে সোনার চোরাচালান। আগে নিয়ম ছিল, বিদেশ থেকে শুধু ব্যাংকের মাধ্যমে সোনা আমদানি করবে সরকার। ব্যাংকের থেকে সোনা কিনে অলঙ্কার গড়ে বাজারে তা বিক্রি করবেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। সোনার আমদানি শুল্কও ছিল মাত্র ১ শতাংশ। প্রায় এক বছর হলো ব্যাংকের মাধ্যমে সোনা আমদানি বন্ধ করেছে সরকার। আমদানি শুল্ক বেড়ে হয়েছে ১০ শতাংশ। অভিযোগ, এ জন্যই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ সোনা কিনতে পারছেন না। আর বাজারে সোনার সেই চাহিদাকেই মূলধন করেছে সোনা পাচারকারীরা। আগে বিমানযোগে সোনার চোরাচালান চলতো রমরমিয়ে। কিন্তু বিমানবন্দরে কড়াকড়ি হওয়ায় এবার সীমান্ত পথে বেড়েছে সোনার চোরাচালান। আর এখন সোনা ভারতে আসছে গরুর দাম হিসেবে। গরুর দামের বিনিময়ে সোনা এনে বাড়তি লাভের মুখ দেখছেন গরু ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে সোনার দাম ভারতের থেকে প্রতি এক কিলোগ্রামে চার লাখ রুপি কম। তাছাড়া, আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরা পথে এক কিলোগ্রাম সোনা আনতে পারলে বাড়তি লাভ আরও প্রায় তিন লাখ রুপি। ফলে সীমান্ত পথে বাড়ছে সোনার চোরাচালান। শুল্ক বিভাগের গোয়েন্দাদের মতে, ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাঠিয়ে আগে নগদ বা হুন্ডিতে টাকা নেয়া হতো। ইদানীং সেই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। গরুর দাম শর্ত হিসেবে সোনার বিস্কুটে মেটাচ্ছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। গত ছ’মাসে বিএসএফের হাতে প্রায় ১৫ বার ধরা পড়ছে সোনা পাচারকারীরা। শুধু উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, স্বরূপনগর সীমান্তে প্রায় ২০ কোটি রুপির সোনা এবং বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্তে ১৫ কোটি রুপির মতো সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে শুল্ক দপ্তর এবং বিএসএফ। গত এক বছরে রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ, শুল্ক বিভাগ এবং বিএসএফ মিলে ১০৩ কোটি রুপির বেশি চোরাই সোনা উদ্ধার করেছে। এর বাইরেও যে আরও একই পরিমাণ সোনা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করছে সে ব্যাপারে শুল্ক বিভাগের গোয়েন্দারা নিশ্চিত। সোনার চোরাচালান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে কৌশলও। সাইকেলের চাকায়, জুতোর তলায়, এমনকি রেকটামে করেও সোনা পাচার চলছে।
সম্প্রতি একটি অনলাইন মিডিয়াকে যশোর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কমান্ডিং অফিসার লে.কর্নেল মতিউর রহমান বলেন, ‘স্থল বন্দরগুলোতে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের অভাবে সোনার চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। স্থল বন্দরগুলোতে যদি পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও জনবল থাকত তবে সোনা চোরাচালান বন্ধ করা সম্ভব হত।’ বিজিবির এই অফিসারের তথ্য মতে বিগত তিন মাসে বিজিবি ও পুলিশ যশোরের বেনাপোল বন্দর থেকে সাড়ে নয় কেজি সোনা উদ্ধার করেছে। তিনিও জানালেন সোনা ও গরুর চোরাচালান একে অপরের সাথে সংযুক্ত। গরু চোরাচালানের জন্য ভারতে অনেক সময় পয়সার পরিবর্তে সোনার বার দিয়ে লেনদেন করা হয়। তাই সোনার চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় গরু ব্যবসায়ীদেরও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ৩০ মার্চ যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোকসমাজ প্রকাশ করে সাংবাদিক সুন্দর সাহার লেখা প্রতিবেদন ‘সীমান্তের সিন্ডিকেটগুলো অপ্রতিরোধ্য চলছেই বেনাপোল দিয়ে সোনা পাচার’।  বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের মালিকানাধীন ওই পত্রিকা লিখেছে, আন্তর্জাতিক সোনা পাচারের প্রধান রুট বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে সোনা পাচার থামছেই না। প্রকাশ্যেই চলছে সোনা পাচারের রমরমা ব্যবসা। পাচার সিন্ডিকেট গুলোকে সহায়তা দিতে ব্যাপক তৎপর চোরাচালান ঘাট মালিকরা। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সোনা পাচার হচ্ছে এই পথে, তা প্রশাসনের কল্পনারও বাইরে। বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা সোনার বার নানাপথ ঘুরে বেনাপোল পুটখালী, ভুলট, দৌলতপুর, গাতীপাড়া, সাদীপুর ও রঘুনাথপুরসহ বিভিন্ন পকেট ঘাট দিয়ে ভারতে পাচার করা হচ্ছে। সীমান্তের দুই পারে গড়েওঠা বিশাল সিন্ডিকেট দুদেশের সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ-বিজিবি ও পুলিশের সাথে বিশেষ চুক্তির ভিত্তিতে সোনা পাচার করে যাচ্ছে। অনেকটা বাধাহীনভাবে পাচারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় চোরাচালানের হার দিন দিন বাড়ছে। ভয়ের কারণ কম থাকায় খোদ নো-ম্যান্স ল্যান্ড দিয়ে ব্যাগ বদল করে পাচার হচ্ছে সোনার চালান। সীমান্ত অঞ্চলে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মরত সূত্র ও আটক সোনা পাচারকারীদের ভাষ্য থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সম্প্রতি পুটখালী সীমান্তে বিজিবি সোনার একটি চালানসহ তুহিন নামে এক পাচারকারীকে আটক করে। পুটখালীর মুনসুর-ইউনুস-কাউসার সিন্ডিকেটের চার গাড়ি অর্থাৎ ৪৮ পিস সোনার একটি চালান পুটখালী পৌছায়। যার অংশবিশেষ আটক করে বিজিবি। ভারতে গৌতমের সিন্ডিকেটে পাচারের আগেই মুনসুর সিন্ডিকেটের কিছু সোনাসহ আটক হয় তুহিন। বাকি সোনার কিছু অংশ তুহিনের বাড়ি এবং বড় একটি অংশ মুনসুর-ইউনুস-কাউসারের জিম্মায় থাকে। তবে, সীমান্ত দিয়ে সোনার চালান পাচার ও আটক করা নিয়েও চলে অনেক নাটকীয়তা। পার্টির সোনার বার আত্মসাৎ করার জন্যই নাকি চালান ধরিয়ে দেয়া হয়। যাতে পাচারকারীর পাশাপাশি আটককারী বিজিবি বা পুলিশেরও বাণিজ্য হয়। কদিন আগেই যেমনটি ঘটেছে পোর্ট থানায়। এছাড়া গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুটখালী থেকে সেলিম সিন্ডিকেটের একটি চালান জামাই আলাউদ্দিনসহ কয়েকজন নিয়ে যায়। পুটখালীর দুই নম্বর গেট পেরিয়ে ভারতের ওপারে কদমতলায় গৌতম সিন্ডিকেটের বহনকারী দিপঙ্করের কাছে দেয়। পাচারকারীদের সাথে পরামর্শ করে সেখানে আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল পুটখালীর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আজিজুল, কালো মনি, মনিরুল, মিলন, সাহাঙ্গীর, রাশেদ ও দিনোসহ কতিপয় সন্ত্রাসী। দিপঙ্করকে কুপিয়ে জখম করে সোনার চালান কেড়ে নেয় আজিজুল-কালোমনি গং। নদী পার হয়ে এপারে এসে প্রথমেই এরা যায় দুর্ধর্ষ কিলার ফকিরের ডেরায়। পরে কিলার রেজার বাড়ি গিয়ে সোনার ভাগ বাটোয়ারা করে। যা নিয়ে দুপারের সোনা চোরাচালানীদের মধ্যে একমাস ধরে দফায় দফায় আলোচনা হলেও সোনা উদ্ধার হয়নি।

তুহিন আটক হলেও মুনসুর-ইউনুস-কাউসাররা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সীমান্তের কিলিং ইঞ্জিনিয়ার পুলিশের নামে এই চক্রের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৫ লাখ টাকা। তারপর থেকে বুক চিতিয়ে এই চক্র ফের ফ্রি-স্টাইলে সোনা পাচার করছে। এভাবেই প্রতিদিন বেনাপোলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মুনসুর-ইউনুস-কাউসার সিন্ডিকেট, মুনসুর-জাকির সিন্ডিকেট, শাবান-হানেফ-হামিদ আমজাদ সিন্ডিকেট, শহীদ-জামাই আলমগীর-আলাউদ্দিন সিন্ডিকেট, দেব কুমার সিন্ডিকেট, কামরুল-মফিজুর সিন্ডিকেট, ভূলটের কুখ্যাত অস্ত্র-ধূড়-সোনা সিন্ডিকেট, দৌলতপুরের জিয়া সিন্ডিকেট, গাতীপাড়ার জসিম-বহিরাগত খোকন সিন্ডিকেট, জাহাঙ্গীর-সামাদ সিন্ডিকেটসহ অন্তত ২০টি সিন্ডিকেট দিয়ে বেপরোয়াভাবে সোনা পাচার হচ্ছে। এসব সিন্ডিকেটগুলোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে পুটখালীর রেজা-ফকির-কালো রেজা ও সিরাজ-কামাল- ইউসুফ, দৌলতপুরের জিয়া-সেলিম, গাতীপাড়ার আলী আহম্মদ ও সীমান্তের কিলিং ইঞ্জিনিয়ার, সীমান্তের ডন কুখ্যাত মফিজুরসহ ক্ষমতাসীন দলের দুর্ধর্ষ সব বাহিনী প্রধান।

সোনা পাচার আটক ও আত্মসাৎ সম্পর্কে জানা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করায় কমছে না সোনা পাচার। বরং বিজিবি ও পুলিশের নাকের ডগায় গড়ে উটেছে এসব সিন্ডেকেট। সীমান্তের দুই পারে গড়ে ওঠা বিশাল সিন্ডিকেট সীমান্তরক্ষী ও পুলিশের সাথে বিশেষ সখ্য গড়েই দেদারছে সোনা পাচার করে যাচ্ছে। অনেকটা বাধাহীনভাবে পাচারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় চোরাচালানের হার দিন দিন বাড়ছে। ভয়ের কারণ কম থাকায় খোদ নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ব্যাগ বদল করে সীমান্তের প্রধান ফটক দিয়ে পাচার হচ্ছে সোনার চালান। যা রুখতে ভূমিকা নিচ্ছে না কেউ। সূত্র আরও জানায়, ভারতের ওপারে গৌতম, প্রহ্লাদ ও ডাকু সিন্ডিকেট ছাড়াও অন্তত ১০টি সিন্ডিকেট রয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে এসব সোনা বহনের দায়িত্ব পালন করে ডাকু, দেবা, দীপঙ্কর, জাল জয়ন্ত, রাজিব ও জয়ন্তসহ অন্তত ৫০ জন বহনকারী। এপারে বহনকারীর সংখ্যা শতাধিক। যাদের মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমান সোনা পাচার করা হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে পাচার করছে সোনার চালান। কারণ, এক গাড়ি অর্থাৎ ১২ পিস সোনা পাচার করতে পারলেই মেলে ১০ হাজার টাকা। দু দিন পর, মানে পহেলা এপ্রিল সাতক্ষীরা খবর ডটকম’ও একইধরণের একটি সংবাদ প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিলো ‘আন্তর্জাতিক সোনা পাচারের প্রধান রুট বেনাপোল সীমান্ত’

সংশ্লিষ্ট আরো সংযোগ

এমজি রোডের বাড়ি থেকে উদ্ধারসাড়ে বারো কোটির সোনা (১৪ মার্চ, ২০১৪)
ফের ১২ কোটির সোনা উদ্ধার শহরে, আসছিল দুবাই থেকে (১৪ মার্চ, ২০১৪)
লুকিয়ে সোনা এনে ধৃত সাত বিমানযাত্রী (২৪ মার্চ, ২০১৪)
বাংলাদেশ থেকে সোনা পাচারের সময় আটক ভারতীয় (১০ মার্চ, ২০১৪)
সীমান্তে ৪৫ কেজি সোনা সহ তৃণমূল কংগ্রেস নেতা গ্রেপ্তার  (১০ মার্চ, ২০১৪)

ভালোই ফেঁসেছে পুলিশ

প্রথম আলোর সাংবাদিক নজরুল ইসলামের প্রতিবেদন ‘সোনা চোরাচালানে পুলিশ জড়িত!’-  প্রকাশিত হয় গতকাল, মানে ০৭ এপ্রিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনা চোরাচালানিদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন কর্মকর্তার যোগাযোগ রয়েছে। চোরাই সোনা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চোরাচালানিরা ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন। সোনা উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর এক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানিয়েছেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা হলেন রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) এস এম শিবলী নোমান। যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি সোনা চোরাচালানিদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করিনি। তা ছাড়া, যে এলাকায় সোনা ধরা পড়েছে, সেটা আমার এলাকাও নয়।’

গত ১৩ মার্চ রামপুরা থানার পুলিশ ২৩৫টি সোনার বারসহ একটি কার আটক করে। এরপর ১৬৫টি বার আত্মসাৎ করে অন্যগুলো উদ্ধার দেখানো হয়। এ ঘটনা জানাজানির পর রামপুরা থানার তিন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। থানার ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালাকে প্রত্যাহার করা হয়। অভিযোগ ওঠে, সোনা চোরাচালানিদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এ ঘটনা তদন্ত করছে। ডিবির কর্মকর্তারা জানান, সোনা আত্মসাতের ঘটনায় চার পুলিশের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা। তাঁরা হলেন ওসি কৃপা সিন্ধু বালা, উপপরিদর্শক (এসআই) মঞ্জুরুল ইসলাম, কনস্টেবল আকাশ চৌধুরী ও ওয়াহেদুল ইসলাম। ওসি ছাড়া অন্য তিনজন এখন কারাবন্দী।

কর্মকর্তারা আরো জানান, গত ১৩ মার্চ পুলিশ সদস্যরা গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ২৩৫টি সোনার বার পেলেও ১৬৫টি ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। বিষয়টি তিন দিন গোপন রাখার পর ১৬ মার্চ কারের সিটে ৭০টি সোনার বার লুকিয়ে রেখে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তা উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এর আগে ধরা পড়া চোরাচালানির সঙ্গে যুক্ত মাহিন ও সমীর সব তথ্য ফাঁস করে দেন। তাঁরা জানান, গাড়িতে ২৩৫টি সোনার বার ছিল। তাঁদের কথার সূত্র ধরে ডিবির একাধিক দল তদন্তে নামে। গাড়ির জব্দ তালিকায় সাক্ষীদের ডিবি কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদে কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন যে গাড়ির ভেতর থেকে সোনার বার খোয়া গেছে। পুলিশ সোনা চোরাচালানির ঘটনায় জাহেদ হোসেন ওরফে মাহিন ও গাড়িচালক সমীর কুমার বিশ্বাসকে আটক করে তাঁদের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে। ডিবি পুলিশের সোর্স রনি, তিন পুলিশ মঞ্জুরুল, আকাশ ও ওয়াহেদুলের স্বজনদের বাসা থেকে ১৪৯টি বার উদ্ধার করা হয়। জাহেদ ও সমীর এ ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

আদালত সূত্র জানায়, জাহেদ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, গত ১৩ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে তিনি এবং চোরাচালান চক্রের মূল হোতা অনীক চট্টগ্রাম থেকে প্রাইভেট কারে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। গাড়িতে অনীক একটা কালো ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ‘ব্যাগে স্বর্ণের বার আছে, ব্যাগটা ঢাকায় পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের কাজ শেষ।’ জবানবন্দিতে জাহেদ আরও বলেন, ঢাকায় পৌঁছে অনীক ও তিনি বনশ্রী এলাকার একটি বাসায় ওঠেন। সেখানে তিনি ব্যাগ খুলে গণনা করে দেখতে পান ২৩৫টি স্বর্ণের বার আছে। রাত নয়টার দিকে তিনি ও অনীক স্বর্ণের বারগুলো নিয়ে সমীরের গাড়িতে তাঁতীবাজারের উদ্দেশে রওনা করেন। বনশ্রী ই ব্লকে পুলিশের একটি মাইক্রোবাস তাঁদের বহনকারী গাড়িকে পেছন থেকে অনুসরণ করতে থাকে। রাত ১০টার দিকে রাস্তা খুঁজে না পেয়ে বনশ্রী বালুরমাঠ এলাকায় গাড়ি ফেলে পালিয়ে যান তাঁরা। এক ঘণ্টা পর বনশ্রী ই-ব্লকের বাসায় ফেরেন।

জাহেদ আদালতকে বলেন, ১৫ মার্চ অনীক তাঁকে একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে ওই নম্বরে ফোন করতে বলেন। ফোন করলে তাঁকে ঢাকা ক্লাবে যেতে বলা হয়। সেখানে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সমীরের দেখা হয়। যাকে ফোন করেছিলেন তিনি তাঁকে ও সমীরকে ভেতরে নিয়ে যান। ভেতরে থাকা পাঁচজন বলেন, তাঁরা তাঁদের অপেক্ষায় আছেন। এরপর তাঁরা রামপুরা থানার ওসির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। এরপর সমীর ও তিনি বাইরে এসে দাঁড়ান। রাত ১২টার দিকে তাঁকে ফোন দিয়ে আবার ক্লারেব ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওনাকে চিনো? ওনি শিবলী নোমান, পুলিশ অফিসার।’ জাহেদ জানান, এরপর তাঁরা ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ঘটনা খুলে বলেন। ১৬ মার্চ অনীক ফোন দিয়ে ঢাকা ক্লাবের সামনে যেতে বলে। রাত আটটায় সেখানে গেলে যান গেটে সমীরের সঙ্গে দেখা হয়। ঢাকা ক্লাবে থাকা পাঁচজন লোক তাঁদের রামপুরা থানায় নিয়ে যান।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হয়তো শিবলী নোমান কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপে রামপুরা থানায় আটক সোনা চারাচালানিদের কারটি ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। তবে সোনা আত্মসাতের সঙ্গে রামপুরা থানার ওসির জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। চোরাচালানটি গাবতলীর একজন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের। ’
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, ৩১ মার্চ কথিত পুলিশ সোর্স রনিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর কাছ থেকে ১৪টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। এরপর পুলিশের তিন সদস্যকে ডিবিতে এনে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁরা সোনা ভাগ-বাঁটোয়ারার কথা স্বীকার করেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিন গভীর রাতে ডিবি পুলিশের একাধিক দল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অভিযান চালিয়ে এসআই মঞ্জুরুলের হবু শ্বশুরবাড়ির ফ্রিজ থেকে ৫৮টি বার, কনস্টেবল আকাশের গাজীপুরের শ্বশুরবাড়ি থেকে ১৪ এবং বগুড়ার সোনাতলায় ওয়াহেদের গ্রামের বাড়ি থেকে ৬৩টি সোনার বার উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ডিবির ওই কর্মকর্তা জানান, চোরাচালানিরা আটক সোনা ও গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে এক কোটি ১০ লাখ টাকা নিয়ে দুই দিন থানায় ঘোরাফেরা করেছিলেন বলে তদন্তে জানা গেছে। সোনা চোরাচালানির সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। এ ঘটনায় পুলিশ সোর্স রনির স্ত্রী ও গাড়িচালক সমীরের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। চক্রের মূল হোতা অনীককেও ধরার চেষ্টা চলছে।
প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী গত বছর রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৬৪টি চালানে ২৭২ কেজি সোনা উদ্ধার হয়। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৪৯টি চালানে ১৯১ দশমিক ২৯০ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গ : ভেজাল সোনা

‘বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা - ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ - এই শিরোনামেই বোমাটি ফাঠিয়েছিলেন রোজিনা ইসলাম | গত ০৬ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত এ সংবাদে জানানো হয় – ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময় দেওয়া ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। আর ক্রেস্টে রুপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু। জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) পরীক্ষায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সাত পর্বে দেয়া ওই সম্মাননার তৃতীয় পর্বে ৬১ ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য তৈরি করা ক্রেস্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিএসটিআইয়ের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠায়।’

বিদেশিদের সম্মাননা প্রদান-সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা আছে, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু পাওয়া গেছে। এনিয়ে একই পত্রিকায় ‘সহজিয়া কড়চা / পৌনে তেরো আনাই খাদ’ শিরোনামে একটি কলামও লিখেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ | এই গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখকের ওই লেখাটি এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো।

***
সৈয়দ আবুল মকসুদ
১০০ বছর আগে সুনামগঞ্জের মরমি পল্লিকবি রাধারমণ দত্ত লিখে গেছেন গানটি। বহুদিন পর তাতে সুরারোপ করেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। জনপ্রিয় গানটি হলো:

যে জন প্রেমের ভাব জানে না,
তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা;
খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় 
নকল সোনা, 
সে জন সোনা চেনে না।

গানটির কথাগুলো মনে পড়ল প্রীতিভাজনিয়া রোজিনা ইসলামের প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে। ‘বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা/ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময় দেওয়া ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। আর ক্রেস্টে রুপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু।

‘বিদেশিদের সম্মাননা প্রদানসংক্রান্ত নীতিমালায় বলা আছে, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা যে ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু পাওয়া গেছে।’

যে জন সোনা চেনে না, তার কাছে খাঁটি সোনাই কী আর নকল সোনাই বা কী! তৃতীয় পর্বে সম্মাননা প্রাপক ৬১ ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে যাঁরা উপমহাদেশের বাইরে অন্যান্য দেশের, তাঁরা খাঁটি আর নকল নিয়ে বোধ হয় মাথা ঘামাননি। তা ছাড়া রোজিনার প্রতিবেদনের একটি সুবিধা এই যে তা বাংলা ভাষায় লেখা। অবাংলাভাষী সম্মাননা গ্রহীতারা সোনা তিন আনাকেই মনে করবেন ১৬ আনা। সীমান্তের ওপারের সম্মাননা প্রাপক কেউ অনলাইনে এই প্রতিবেদন পড়ে মাথায় হাত দেবেন। বলবেন: ‘হায়, একি পেলুম!’ তবে তাঁরা বন্ধু-সরকারকে বিব্রতও করতে চাইবেন না। অনেকেই সস্ত্রীক এসেছিলেন ঢাকায়। ধারণা করি, এই প্রতিবেদন তাঁদের সম্মাননা পাওয়ার পরদিনও যদি প্রকাশিত হতো, তবু বাঙালি প্রাপকদের পত্নীরা সান্ত্বনা দিয়ে স্বামীকে রবীন্দ্রসংগীত শোনাতেন: ‘যাহা পাও তাই লও, হাসিমুখে ফিরে যাও।’

এই প্রতিবেদন দেখে মনে পড়ল আমার পিতৃপ্রতিম কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে। মাঝেমধ্যে তিনি সকালে হাঁটতে হাঁটতে আমার বাসায় আসতেন। একসঙ্গে নাশতা করতাম। একদিন বেশ বেলাবেলিতে খানিকটা উত্তেজিত অবস্থায় এলেন। তিনি ছিলেন অতি আবেগপ্রবণ, স্নেহশীল ও ছাত্রবৎসল। বললেন, জলদি চলো আমার সঙ্গে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে। একুশে পদক হিসেবে তাঁকে যে মেডেলটি দেওয়া হয়েছিল, স্যাকরার দোকানে গিয়ে তা পরীক্ষা করে দেখা গেল, তাতে খাদ ভর্তি। সেটা পল্লিবন্ধুর শাসনামল। তা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হলো। তিনি বলেন, আমার মেডেল-টেডেলের দরকার নেই। মেডেলে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা, সেই পরিমাণ স্বর্ণের দামটা আমাকে দিলেই আমি বর্তে যাই।

মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা প্রাপক ব্যক্তিরা দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে আছেন। তাঁরা শওকত ওসমান স্যারের ব্যাপারটা জানেন না। তাই তাঁর পথ অনুস্মরণ করতে যাবেন, সে সম্ভাবনা নেই। তবে এসব পদক-পুরস্কারের সোনার মেডেলে যে ১৩ আনাই খাদ ও ভেজাল দিয়ে হয়, তা আমাদের নেতা ও তাঁদের সহযোগী কর্মকর্তারা আলবৎ জানেন।

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের যাঁরা আমাদের সাহায্য করেছেন, তাঁদের সম্মান জানানো আমাদের জাতীয় কর্তব্য—এ কথাটা আমি দুই যুগ আগে অধ্যাপক মেসবাহ কামালের পত্রিকা সমাজ চেতনায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আদ্রেঁ মালরোসহ অনেকের নামও উল্লেখ করেছিলাম। তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সদ্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আমি কোথাকার কোন কে যে সরকার আমার কথা শুনবে? যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারও গেল। পরের বার তিনি সরকার গঠন করে এই জাতীয় গুরুদায়িত্বটি সম্পন্ন করেন। তবে একপর্যায়ে আমার মনে একটু খটকা বাধল, যখন দেখলাম সম্মাননা প্রাপকদের তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ব্যাপার কী? কত বন্ধু আমাদের? রোজিনার প্রতিবেদন পড়ে ব্যাপারটা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। যত বেশি মানুষকে সম্মাননা দেওয়া হবে, তত...।
তবে একটি জিনিস ভেবে আমি তাজ্জব না হয়ে পারিনি। তা হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে সোনায় ভেজাল দেওয়া হবে কেন? খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল হবে, নির্মাণসামগ্রীতে ভেজাল হবে, যাবতীয় জিনিসে ভেজাল হলেও স্বর্ণে ভেজাল কেন? দেশে কি এখন স্বর্ণের অভাব? স্বাধীনতার আগে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের যুগে, স্বর্ণও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার চেয়ে সস্তা। সে জন্য কেউ কেউ করাচি-লাহোর থেকে ঢাকায় আসার সময় কয়েক ভরি স্বর্ণ গোপনে আনত। কাগজে সে খবর বেরোত। কেউ সোনার পাত ঢোকাত জুতার সুকতলিতে, কেউ মোজার মধ্যে, কেউ গুহ্যদ্বারে। ওর ভেতরেই যে কয় ভরি আনা সম্ভব আনত। ধরা পড়ে দিন কয়েক শ্রীঘরে কাটাত। এখন এক মণ সোনা আনলেও নাজিমউদ্দিন রোড বা কাশিমপুরের দালানে ঢোকার আশঙ্কা নেই। এখন সোনার অভাব কোথায়? পাঁচ-দশ কেজি সোনা তো এখন বাংলাদেশ বিমানের টয়লেটে, বিমানবন্দরের বারান্দায় কিংবা কনভেয়ার বেল্টের ওপরই পড়ে থাকতে দেখা যায়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টে ভেজাল না দিয়ে সোনা চোরাচালানিদের বলে দিলেই মন্ত্রণালয়ে সোনার বিস্কুট পৌঁছে যেত।
প্রতিবেদনটিতে জানা গেল, ‘উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া এই ক্রেস্ট কেনা হয়েছিল। ৩৩৮টির মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে এমিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে ৬০টি ক্রেস্ট কোন প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছে, মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে তা জানা সম্ভব হয়নি।’ কী মুশকিলের কথা! রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য কেন তাঁরা মিডিয়ার লোকদের জানাবেন? পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে প্রতিবেদক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘বিএসটিআই স্বর্ণগুলো মেশিনে তাপ দিয়ে গলিয়েছে। গলানোর পর পানি বের হয়েছে এবং তার সঙ্গে স্বর্ণ চলে গেছে।’ অর্থাৎ পরীক্ষায় যাওয়াটাই হয়েছে ভুল।

ক্রয় কমিটির ব্যক্তিরা বলতে চাইছেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এত দিন পর সোনা নিয়ে টানাটানির দরকার কী? এক সদস্য সাফ জবাব দিয়েছেন, ‘স্বর্ণ তো কোটিং করা হয়েছে। কোটিংকে আলাদা করে পরীক্ষা করা হলে পুনরায় স্বর্ণ পাওয়া দুষ্কর।’ স্বর্ণ কার কাছ থেকে কিনেছিলেন, প্রতিবেদকের এ ধরনের অন্যায় প্রশ্নের জবাবে সরবরাহকারী বলেন, ‘তাঁতীবাজার থেকে কিনেছি।’ কোন দোকান থেকে কিনেছেন, এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব দেননি তিনি। স্বর্ণ কেনার রসিদ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন আগের কাগজপত্র। তাই খুঁজে পাব কি না, সন্দেহ।’ তাঁর সন্দেহ থাকলেও আমাদের কিন্তু কোনোই সন্দেহ নেই। কাগজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তারপর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে যে রসিদ রচনা করা হবে, তার রচনাকাল হবে ৬ এপ্রিলের পরবর্তী কোনো শুভদিন।

একটি বিল থেকে দেখা যায়, একটি ক্রেস্টের জন্য ২৩ দশমিক ৫ গ্রাম স্বর্ণ আর ৩০ গ্রাম রুপার বিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী স্বর্ণ দেওয়ার কথা ছিল ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম। ‘ওই বিলে ২৩ দশমিক ৫ গ্রাম স্বর্ণ এক লাখ ১৬ হাজার ৩২৫ টাকা, ৩০ গ্রাম রুপার জন্য ৮৭ হাজার টাকা, ধাতব মানপত্র পাঁচ হাজার টাকা, রুপা গলানো ও ছাঁচ তৈরি বাবদ ১৫ হাজার টাকা, ক্রেস্ট রাখার জন্য জামদানি বর্ডার দেওয়া কাঠের বাক্স বাবদ ১৫ হাজার টাকা, স্বর্ণ ও রুপা প্রক্রিয়াকরণ বাবদ ২৫ হাজার টাকা মিলিয়ে মোট দুই লাখ ৬৩ হাজার ৩২৫ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।’ চাওয়া হলো সাড়ে ১১ গ্রাম, বিল পরিশোধ করা হলো ২৩ গ্রামের। না চাইতেই দ্বিগুণেরও বেশি স্বর্ণ দেওয়ার কারণ, বাংলাদেশে এখন প্লাটিনামের কিছু অভাব থাকলেও, আগেই বলেছি, সোনার কোনো ঘাটতি নেই।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা গেল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিএসটিআইয়ের পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলেও ক্রেস্ট সরবরাহকারীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কী আশ্চর্যের কথা! কেন ব্যবস্থা নেবে? যেখানে দুধে ভেজাল, ঘিয়ে ভেজাল, গুঁড়া হলুদ-মরিচে ইটের গুঁড়া, মহান মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট জাল, নেতা-নেত্রীর জন্মতারিখ জাল, উঁচু পদের কর্মকর্তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট জাল, স্বাধীনতাসংক্রান্ত তথ্য জাল, সেখানে স্বর্ণে ভেজাল থাকলে ক্ষতি কী? নির্বাচনের ফলাফল জাল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সংসদ। যে দেশে সেই সংসদেই ভেজাল, সংসদের কথিত বিরোধী দলে ভেজাল, সেখানে স্বর্ণে ভেজাল তো মামুলি ব্যাপার। সোনার বাংলারও যে ১৫ আনাই ভেজাল হবে, তাতেই বা সন্দেহ কার?

এ ঘটনায় আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যা, তা হলো, রসায়নবিজ্ঞানের ইতিহাসে যোগ হলো এক নতুন অধ্যায়। পিতল, তামা ও দস্তা কিঞ্চিৎ স্বর্ণের সঙ্গে মিশিয়ে জন্ম নিল এক নতুন ধাতু, তার নাম ‘পিতাদ’। প্রখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদাও এ ধাতু বানাতে পারতেন না। সংকর ধাতু সৃষ্টি করে আমরা আরেকটি ইতিহাস গড়লাম।

লাখ লাখ শহীদের আত্মা নিঃশব্দ চিৎকার করে বলছে - ‘তোরা চুরিচামারি করবি তো কর। সে জন্য বহু প্রকল্প রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা থেকে কেন? তোরা চেতনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আর কত নিচে নামবি। ছেলেমেয়ে বিদেশে পাঠাবি, বাড়ি করবি, রাজউকের প্লট ও খাসজমি কিনবি, নতুন মডেলের গাড়ি কিনবি—টাকার দরকার। অন্য প্রকল্পের টাকা মার (মারা শব্দটি মহাজোট নেতাদের মুখের)। কাজ না করে প্রকল্পের টাকা তুলে নে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নামে এ কী করছিস? ছি, তোরা মানুষ না!’

আরো কিছু সংযোগ

শাজালাল খেকে উদ্ধার হওয়া ১২৪ কেজি সোনার এ ছবিটি ডেইলি স্টার থেকে নেয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

newsreel [সংবাদচিত্র]